ডার্ক এনার্জি

৬. ডার্ক এনার্জি

ছোটবেলায় মাইটি মাউস নামের কার্টুন চরিত্রটা আমাকে আকর্ষণ করত প্রবলভাবে। তীক্ষ্ণ দাঁতের একটা ইঁদুর, কিন্তু সব সময় সফল হতো। তার কণ্ঠটাও ছিল দারুণ, অপেরার মতো। এই ছোট্ট ইঁদুরটা গান গাইতে পারত। তার বুকটা ছিল ব্যারেলের মতো চওড়া ও অবিশ্বাস্য রকম শক্তিশালী। এমনকি সে উড়তেও পারত।

কৌতূহলী এক বালক হিসেবে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মাইটি মাউস কীভাবে উড়ে বেড়ায়। তার তো কোনো পাখা নেই। কিংবা তার বেল্টের নিচে কোনো প্রপেলার বা জেট ইঞ্জিনও লুকানো নেই। কিন্তু গায়ে আস্তিনহীন জামা থাকে। ওই সময়ের আরেকজন বিখ্যাত উড়ন্ত হিরো ছিল সুপারম্যান। তার গায়েও থাকত এ রকম আস্তিনহীন জামা। আমি ভাবলাম, এটাই কি তাহলে আসল রহস্য? তাহলে কি ওড়ার ক্ষমতা নির্ভর করে গায়ের জামাকাপড়ের ওপর?

অচিরেই একটা তত্ত্ব খাড়া করি আমি। সেটা হলো : আস্তিনহীন জামা পরার কারণে মানুষ আর ইঁদুর ওড়ার ক্ষমতা পায়।

তখনো আমি বিজ্ঞানী হয়ে না উঠলেও এভাবে চিন্তা করতে শুরু করে দিই। বিজ্ঞান শুধু তত্ত্বের মাধ্যমেই সাফল্য পায় না, তত্ত্বগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। কাজেই আমার ধারণাটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটা পরীক্ষার বন্দোবস্ত করার দরকার ছিল। আমার একটা আস্তিনহীন জামা ছিল। সেটা গলার চারদিকে বেঁধে লাফ দিলাম যতটা দূরে সম্ভব।

ওই জামা পরে কতটা দূরত্ব পার হতে পারলাম, তা মেপে দেখলাম।

এরপর জামাটা গা থেকে খুলে আরেকবার লাফ দিলাম। এবারও লাফের দূরত্ব মাপলাম।

কিন্তু দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না।

তার মানে, ওই জামা পরে আমি লাফ দিয়ে বেশি দূর যেতে পারিনি। সত্যি বলছি, উড়তে পারিনি আমি। কিন্তু এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেলাম : বিজ্ঞানে একটা তত্ত্বকে পরীক্ষা থেকে পাওয়া প্রমাণের সঙ্গে মিলতে হবে। তা না হলে, তত্ত্ব বা ধারণাটা ঠিকঠাক করতে হবে, কিংবা ছুড়ে ফেলে দিতে হবে আবর্জনার ঝুড়িতে। আমি অনুমান করেছিলাম, আস্তিনহীন জামার কারণে মানুষ আর ইঁদুর উড়তে পারে। কিন্তু লাফ দেওয়ার পরীক্ষার সঙ্গে ওই ধারণাটা মেলেনি। কাজেই আমার তত্ত্বটাকে বাতিল করতেই হলো। তারপর মানবজাতি যেভাবে উড়তে শেখে, মানে এরোপ্লেন নামের বড় একটা যন্ত্র দিয়ে, সেটাই মেনে নিলাম।

মাঝে মাঝে সবচেয়ে খেপাটে তত্ত্বগুলোকেও পরীক্ষামূলক যাচাইয়ে টিকে থাকতে হয়। আলবার্ট আইনস্টাইন গবেষণাগারে পা রাখেননি বললেই চলে। তিনি ছিলেন খাঁটি তাত্ত্বিক। প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে যেসব বিজ্ঞানী বিভিন্ন ধারণার জন্ম দেন, তাঁদের বলা হয় তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী। থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এই প্রক্রিয়ায় তোমার কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করতে পারো।

ষোলো বছর বয়সে আইনস্টাইন ভেবেছিলেন, তিনি যদি একটা আলোকরশ্মির পাশাপাশি দৌড়ান, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে। অবশ্যই সেটা অসম্ভব। আমরা আগেই কসমিক স্পিড লিমিট বা মহাজাগতিক গতিসীমার কথা বলেছি। কিন্তু এই উদ্ভট ধারণা নিয়ে বেশ কয়েক বছর চিন্তা করেন আইনস্টাইন। এটিই একসময় তাকে জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতার দিকে নিয়ে যায়।

মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে মডেল তৈরি করেন আইনস্টাইনের মতো তাত্ত্বিকেরা। এসব মডেল ব্যবহার করে তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। কোনো মডেল যদি অকার্যকর হয়, তখন পর্যবেক্ষক বা উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী ভবিষ্যদ্বাণী আর প্রমাণের মধ্যে অমিল খুঁজে বের করেন। ছোটবেলায় ওড়া নিয়ে আমি যে মডেল তৈরি করেছিলাম, তাতে জোর দিয়েছিলাম যে আস্তিনহীন জামা মানুষ আর ইঁদুরকে বাতাসে ভেসে থাকতে সাহায্য করে। এরপর মডেলটা পরীক্ষা করে দেখি আমি। কোনো উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়াই আবিষ্কার করি, আমার তত্ত্ব আর প্রমাণের মধ্যে কোনো মিল নেই। আমি হতাশ হয়েছিলাম বলা বাহুল্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যখন দেখেন আরেক গবেষকের মডেলেও এসব ভুল রয়েছে, তখন তাঁরা সাধারণত বেশ উত্তেজিত হন। আমাদের সবার কাজটা আসলে অনেকটা অন্যদের হোমওয়ার্কে খুঁত খুঁজে বের করার মতো।

আইনস্টাইন সর্বকালের অন্যতম শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারী একটা তাত্ত্বিক মডেল দাঁড় করেন। সেটি হলো তাঁর ‘জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি’ বা ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’। মহাকর্ষের প্রভাবে মহাবিশ্বের সবকিছু কীভাবে চলাফেরা করে এবং মহাকর্ষ কীভাবে খোদ স্থানকে আকৃতি দেয়, তা বিস্তারিত বলা হয়েছিল এই মডেলে। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এমন সব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, যা বিজ্ঞানীরা এখনো পরীক্ষা করে দেখেন।

দুটি কৃষ্ণগহ্বর সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কী হবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আইনস্টাইন। তিনি বললেন, তাদের শক্তি নিঃসরণ করা উচিত। আর সেই শক্তিটা হবে মহাকর্ষ তরঙ্গরূপে, যা মহাবিশ্বজুড়ে চলাচল করবে। পানির ভেতর দিয়ে চলার বদলে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ সৈকতে সার্ফিংয়ের তরঙ্গের মতো চলাচল করে। ফলে খোদ স্থানে ঢেউ বয়ে যায়। আরও দারুণ ব্যাপার হলো, অনেক আগে বহুদূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের কারণে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল, তা শনাক্ত করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে আরেকবার সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছেন আইনস্টাইন।

কয়েক বছর পর পর আইনস্টাইনের তত্ত্বকে আরও ভালো কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে দেখেন গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা I প্রতিবারই তত্ত্বটা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। আইনস্টাইন শুধু ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে ছিলেন না, তিনি ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে স্মার্ট মানুষদের একজন। কিন্তু তিনিও একটা ভুল করেছিলেন।

*

আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করতে সেকালে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কিছু মানুষ। তাঁর গবেষণা নিউটনের ধারণাগুলোয় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। তাই ব্যাপারটা নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলের কিছু মানুষ মোটেও খুশি ছিল না। তাঁদের মধ্যে এক দল একত্র হয়ে ১৯৩১ সালে একটা বই প্রকাশ করেন। বইয়ের শিরোনাম : আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে একশ জন লেখক। আইনস্টাইন একসময় বইটা সম্পর্কে জানতে পারলেন। প্রতিক্রিয়ায় বললেন, তিনি যদি ভুল হয়ে থাকেন, তাহলে মাত্র একজন লেখকই যথেষ্ট।

মহাকর্ষ সম্পর্কে আগের যেকোনো চিন্তাভাবনার চেয়ে একেবারে আলাদা ছিল সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। সাধারণ আপেক্ষিকতামতে, ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়। তাই স্থান ও কালের বুনন বক্র হয়ে যায় বা টোল খায়।

একটা আপেলের মতো ছোট ভরের ওপর এ প্রভাব অতি সামান্য। কিন্তু গ্রহ বা নক্ষত্রের মতো বড় কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে স্থান এতই বেঁকে যায় যে সেখানে সরলরেখাও বাঁকা। আমার সাবেক এক শিক্ষক ছিলেন জন আর্চিবল্ড হুইলার। বিশ শতকের মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ তিনি। একবার তিনি বলেছিলেন, “বস্তু স্থানকে বলে দেয় কীভাবে বক্র হতে হবে। আর স্থান বস্তুকে বলে কীভাবে চলাচল করতে হবে।’

আইনস্টাইন মহাকর্ষের এই নতুন সংস্করণ যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, তা বস্তুকে সরলভাবে প্রভাবিত করে না। মহাকর্ষ যেহেতু স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়, তাই মহাকর্ষের শক্তি আলোকেও বাঁকিয়ে দেবে। ফলে কোনো বড় ও ভারী বস্তুর চারপাশের আলো সরলরেখায় না গিয়ে একটা বক্র পথ অনুসরণ করবে। আইনস্টাইনের মডেলে দুই ধরনের মহাকর্ষের বর্ণনা ছিল। এর মধ্যে একটি আমাদের পরিচিত : পৃথিবী আর বাতাসে ছুড়ে দেওয়া বলের মধ্যে যে আকর্ষণ কাজ করে, কিংবা সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার আকর্ষণ। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা আরেক ধরনের রহস্যময় প্রতিমহাকর্ষ চাপের ভবিষ্যদ্বাণীও করে।

বর্তমানে আমরা জানি, আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের ছায়াপথ আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সেকালে আমাদের মহাবিশ্ব যে কেবল অস্তিত্বের বাইরেও অন্য কিছু করে, তা ছিল সবার কল্পনাতীত। এমনকি আইনস্টাইনও মনে করতেন, মহাবিশ্বের অবশ্যই স্থিতিশীল হওয়া উচিত। নইলে সেটা বড় হতে থাকবে, নয়তো সংকুচিত হয়ে যাবে। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাঁর মডেলেই ইঙ্গিত ছিল যে মহাবিশ্বের প্রসারিত বা সংকুচিত হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি ধরে নিলেন, সেটা নিশ্চয়ই ভুল। কাজেই নিজের সমীকরণে নতুন একটা রাশি যোগ করলেন তিনি। একে বলা হয় কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট বা মহাজাগতিক ধ্রুবক।

আইনস্টাইনের মডেলে মহাজাতিক ধ্রুবকের একমাত্র কাজ ছিল মহাকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করা। মহাকর্ষ যদি গোটা মহাবিশ্বকে একটা দানবীয় ভরের দিকে টানার চেষ্টা করে, তাহলে মহাজাগতিক ধ্রুবক তাকে ঠেলে আলাদা করে দিত।

কিন্তু এতে শুধু একটা সমস্যা ছিল।

সমস্যাটা হলো, কেউই কোনো দিন প্রকৃতিতে এ রকম কোনো বল দেখেনি।

এভাবে আইনস্টাইন শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হলেন।

*

আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্বটি প্রণয়ন করার ১৩ বছর পর মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ এডুইন পি হাবল আবিষ্কার করলেন, মহাবিশ্ব মোটেও স্থিতিশীল নয়। সে সময় বহুদূরের কিছু ছায়াপথ নিয়ে গবেষণা করছিলেন হাবল। তাঁর গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, এসব ছায়াপথ এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে নেই। সেগুলো আমাদের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, হাবল বিশ্বাসযোগ্য কিছু প্রমাণও দেখালেন, যেসব ছায়াপথ যত দূরে, সেগুলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কাছ থেকে সরে যাচ্ছে তত দ্রুত হারে। সহজ কথায়, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

হাবলের এই গবেষণার কথা জানতে পেরে ভীষণ বিব্রত হলেন আইনস্টাইন। এটা আসলে তাঁর নিজেরই ভবিষ্যদ্বাণী করা উচিত ছিল। এরপর তাঁর সমীকরণ থেকে মহাজাগতিক ধ্রুবকটা ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। এরপর বললেন, এটা তাঁর জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ভুল’। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কয়েক দশক পর, এই মহাজাগতিক ধ্রুবকটা আবারও ফিরিয়ে আনলেন তাত্ত্বিকেরা। তাঁরা প্রশ্ন তুললেন, তাঁদের ধারণাগুলো এমন মহাবিশ্বের মতো কেন হবে, যেখানে সত্যি সত্যিই একটি রহস্যময় প্রতিমহাকর্ষ বল আছে।

১৯৯৮ সালে আইনস্টাইনের সেই সবচেয়ে বড় ভুলটা কবর থেকে শেষবারের মতো টেনে বের করে আনল বিজ্ঞান।

ওই বছরের শুরুর দিকে লক্ষণীয় একটা ঘোষণা দিল জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের প্রতিযোগী দুই দল। সুপারনোভা বা অতিনবতারা নামের বিস্ফোরণুখ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছিল উভয় দলই। জ্যোতির্বিদেরা জানেন, সুপারনোভাদের আচরণ কেমন হবে, তারা কতটা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলবে এবং তাদের কতটা দূরে থাকা উচিত।

এই বিস্ফোরন্মুখ নক্ষত্র বা সুপারনোভা ১৯৮৭এ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে খুবই নামকরা। এ ধরনের নক্ষত্র আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।
এই বিস্ফোরন্মুখ নক্ষত্র বা সুপারনোভা ১৯৮৭এ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে খুবই নামকরা। এ ধরনের নক্ষত্র আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

কিন্তু এই সুপারনোভাগুলো ছিল একেবারে আলাদা।

প্রত্যাশার চেয়েও অনেক অনুজ্জ্বল ছিল সেগুলো।

এর কেবল দুটি ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব। হয় জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা আগে যেসব বিস্ফোরণুখ নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন ওই বিশেষ সুপারনোভাগুলো তাদের চেয়ে আলাদা, নয়তো তাদের দূরত্ব বিজ্ঞানীদের অনুমানের চেয়েও অনেক দূরে। আর তারা যদি অনেক দূরে হয়ে থাকে, তাহলে মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের মডেলগুলোতে আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ত্রুটি আছে।

বিজ্ঞানীরা কি প্রতিযোগিতা করেন?
হ্যাঁ! খুব বেশি। অ্যাথলেট বা দাবা চ্যাম্পিয়নদের মতো আমাদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব আছে। সাধারণত বিজ্ঞানে কেউই হারতে চায় না। চার্লস ডারউইন একসময় জানতে পারলেন, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস নামের আরেক বিজ্ঞানী কিছু ধারণা বিকশিত করেছেন, যা তাঁর নিজের মতো। তাই তিনি তাড়াহুড়ো করে নিজের ধারণাগুলো প্রকাশ করে ফেলেন। সেটিই এখন তাঁর বিবর্তন তত্ত্ব নামে পরিচিত। কোনোভাবেই ওয়ালেসকে ওই তত্ত্বের প্রথম কৃতিত্ব দিতে চাননি তিনি। বিজ্ঞানের যেকোনো শাখার ক্ষেত্রে এটা সত্য। তবে আমার মতামত হলো, মহাবিশ্ব আমাদের সবার জন্য অনেক অনেক বড়। এখানে গবেষণা করার মতো প্রচুর বিষয় রয়েছে।
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের যে দুটি দল এসব সুপারনোভা নিয়ে গবেষণা করেছিল, তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে উভয় দলই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল। বিজ্ঞানজগতে এটা হলো টাই করা বা সমানসংখ্যক পয়েন্ট পাওয়ার সমতুল্য।

হাবলের গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছিল, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এসব সুপারনোভা ইঙ্গিত করছে, মহাবিশ্ব আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক দ্রুত বেগে প্রসারিত হচ্ছে। আর আইনস্টাইনের সেই মহাভুল বা মহাজাগতিক ধ্রুবক ছাড়া এই অতিরিক্ত প্রসারণের কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। ধ্রুবকটাকে আবারও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতায় ফিরিয়ে আনলেন জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা। এবার মহাবিশ্ব নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেল।

সুপারনোভাগুলো যেখানে ছিল, এবার দেখা গেল সঠিক জায়গাতেই আছে। কাজেই আইনস্টাইন আসলে সঠিক ছিলেন।

এমনকি তিনি যখন নিজেকে ভুল ভেবেছিলেন, তখনো আসলে সঠিক ছিলেন।

*

এই দ্রুতগামী সুপারনোভা আবিষ্কারটা ছিল মহাবিশ্বজুড়ে মহাকর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অদ্ভুতরকম নতুন বল শনাক্তের প্রথম প্রমাণ মহাজাগতিক ধ্রুবক আসলে সত্যি এবং এর জন্য আরও ভালো নাম দেওয়ার দরকার পড়ল। এখন একে বলা হয় ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি

আধুনিককালে সবচেয়ে নিখুঁত পরিমাপে দেখা গেছে, গুপ্তশক্তি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে পদার্থ আর শক্তির সমন্বয়ে। মহাবিশ্বের সব ভর-শক্তি যোগ করলে দেখা যায়, ডার্ক এনার্জি বর্তমানে মহাবিশ্বের ৬৮ শতাংশের জন্য দায়ী। অন্যদিকে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তুর পরিমাণ ২৭ শতাংশ। আর মহাবিশ্বে আমাদের পরিচিত সাধারণ পদার্থের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ।

সাধারণ যেসব পদার্থ আমরা দেখি, অনুভব করি আর গন্ধ পাই, সেগুলো মহাবিশ্বের অতি সামান্য এক টুকরোমাত্র।

গরম কোকোয়ার মতো মহাবিশ্ব। একদম ওপরে উইপড ক্রিম আর সিনামনসহ এক কাপ গরম কোকোয়া। কোকোয়ার পরিমাণ ৬৮ শতাংশ, উইপড ক্রিম ২৭ শতাংশ এবং সিনামন হলো মাত্র ৫ শতাংশ।
গরম কোকোয়ার মতো মহাবিশ্ব। একদম ওপরে উইপড ক্রিম আর সিনামনসহ এক কাপ গরম কোকোয়া। কোকোয়ার পরিমাণ ৬৮ শতাংশ, উইপড ক্রিম ২৭ শতাংশ এবং সিনামন হলো মাত্র ৫ শতাংশ।

গরম কোকোয়ার মতো মহাবিশ্ব। একদম ওপরে উইপড ক্রিম আর সিনামনসহ এক কাপ গরম কোকোয়া। কোকোয়ার পরিমাণ ৬৮ শতাংশ, উইপড ক্রিম ২৭ শতাংশ এবং সিনামন হলো মাত্র ৫ শতাংশ।

*

তাহলে এই রহস্যময় বলটা আসলে কী? উত্তরটা কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে ভালো যে অনুমানটি পাওয়া গেছে, সেটা হলো, ডার্ক এনার্জি স্থানের শূন্যতা দিয়ে গঠিত। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা শুধু ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেসের বিপদ নিয়ে আলোচনা করিনি, বরং মহাজাগতিক ওই শূন্য মরুভূমিতে যেসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে, সেগুলোও বলেছি। কণা ও তাদের বিপরীত সঙ্গী জোড়া হুট করে অস্তিত্বে চলে আসে এবং তারপর পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি জোড়া বাইরের দিকে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করে। হয়তো মহাবিশ্বে সংঘটিত এসব ছোট ছোট চাপ একত্র করলে, তুমি শেষ পর্যন্ত এমন পরিমাণ বল পাবে, যা ডার্ক এনার্জির শক্তির জন্য যথেষ্ট।

এটা একটা যৌক্তিক ধারণা। দুর্ভাগ্যক্রমে, তুমি ভ্যাকুয়াম প্রেশার বা শূন্য চাপের মোট পরিমাণ হিসাব করলে সেটি অবিশ্বাস্য রকম বড় পাওয়া যায়। সেটা এতই বড় হয় যে তা আমাদের হিসাব করা ডার্ক এনার্জির মোট মানের চেয়েও অনেক বেশি। আমার সেই মাইটি মাউস পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করলে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা তত্ত্ব আর পর্যবেক্ষণের মধ্যে অনেক বড় একটা ফারাক। কাজেই শূন্য চাপ কোনোভাবেই ডার্ক এনার্জির শক্তির উৎস হতে পারে না।

হ্যাঁ, এ সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো ব্লু নেই।

তবে কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ডার্ক এনার্জি এখন পর্যন্ত প্রণয়ন করা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে ভালো মডেল থেকে উঠে এসেছে। সেটা হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা। এটা হলো মহাজাগতিক ধ্রুবক। ভবিষ্যতে ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে যেটাই আবিষ্কার হোক না কেন, আমরা এরই মধ্যে জানি, এই শক্তি কীভাবে মাপতে হয়। আমরা জানি, মহাবিশ্বের অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে এর প্রভাব কীভাবে অনুমান করতে হয়।

ক্লু না থাকাটা রোমাঞ্চকর কেন?
এ মুহূর্তে তুমি হয়তো খেয়াল করেছ যে আমি এখানে ‘ক্লুলেস’ বা ‘সূত্র নেই’ কথাটি একাধিকবার ব্যবহার করেছি। মানুষ প্রায়ই ভাবে যে বিজ্ঞানীরা অহংকারী এবং নিজেদের ব্যাপারে সব সময় নিশ্চিত থাকেন। কিন্তু মহাবিশ্বের কাছ থেকে কঠিন সব প্রশ্নে বিব্রত হতে আমরা ভালোবাসি। ক্লুলেস হতে ভালোবাসি আমরা। এটা খুবই রোমাঞ্চকর ব্যাপার। এ কারণেই আমরা প্রতিদিন কাজ করতে ছুটে যাই। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তোমাকে অজ্ঞতাকে বা না জানাটাকে সানন্দে গ্রহণ করা শিখতে হবে। তুমি যদি সব উত্তর জেনে যাও, তাহলে তোমার আর কাজ করার কোনো কিছুই বাকি থাকবে না। তখন তোমাকে সম্ভবত স্রেফ ঘরে বসে থাকতে হবে।

এখনো এ শিকার অভিযান চলছে। আমরা এখন জানি, ডার্ক এনার্জি সত্যি সত্যিই আছে। এর গোপন বিষয়গুলো খুঁজে পেতে প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন বেশ কয়েক দল জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। হয়তো তাঁরা একদিন সফলও হবেন। কিংবা এর জন্য আমাদের হয়তো সাধারণ আপেক্ষিকতার বদলে দরকার হবে বিকল্প কোনো তত্ত্বের। ডার্ক এনার্জির জন্য হয়তো ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কৃত হবে। সে জন্য যে বুদ্ধিমান মানুষটির দরকার, তিনি হয়তো এখনো জন্মই নেননি। কিংবা কে জানে, ভবিষ্যতের সেই জিনিয়াস হয়তো এখন এই বইটি পড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *