৭. আমার প্রিয় কিছু মৌল
এক মিডল স্কুলে পড়ার সময় আমার শিক্ষককে একবার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম, রাসায়নিক মৌলের পর্যায় সারণি নিয়ে ওটা সহজ-সরল একটা প্রশ্ন। বেশির ভাগ বিজ্ঞানের ক্লাসরুমের দেয়ালে তুমি একটা পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণির পোস্টার ঝোলানো দেখতে পাবে। একনজর দেখে ভুলক্রমে একে জটিল-কঠিন কোনো বোর্ড গেম বলে ভেবে বসতে পারো। কিন্তু এটা আসলে কোনো খেলা নয়। মহাবিশ্বের ১১৮টি মৌলিক পদার্থ বা পরমাণুর ধরন সম্পর্কে আমাদের জানায় এই পর্যায় সারণি।
যা-ই হোক, আমার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম, এসব মৌল আসে কোথা থেকে।
তিনি জবাব দিলেন, পৃথিবীর কঠিন ভূত্বক থেকে।
উত্তরটা মেনে নিলাম। নিঃসন্দেহে স্কুলের ল্যাবে এগুলোর জোগান সেখান থেকেই আসে। কিন্তু এই উত্তরটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, পৃথিবীর ভূত্বকে এই মৌলগুলো কীভাবে জমা হয়। হ্যাঁ, আমিই ছিলাম সেই ছেলে, যে ক্লাসে অনেক প্রশ্ন করত। এ জন্য যাকে অনেকেই পছন্দ করত না। তবে আমি খুঁজে বের করেছিলাম যে এই উত্তরটা অবশ্যই জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কিছু একটা হবে। মৌলগুলো অবশ্যই মহাকাশের কোথাও তৈরি হয়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য তোমার কি মহাবিশ্বের ইতিহাস জানাও দরকার?
মৌলের পর্যায় সারণি
হ্যাঁ, আসলে তা জানতেই হবে।
সাধারণ পদার্থগুলো তৈরি হয় প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণা দিয়ে। প্রোটন ও নিউট্রন পরমাণুর একটা অংশে একত্রে গুচ্ছবদ্ধ হয়ে থাকে। তাদের একত্রে বলা হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস বা পরমাণুকেন্দ্ৰ। অন্যদিকে এই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বাইরে ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন। এই কণাগুলোকে একত্রে যোগ করলে যেটি পাওয়া যাবে, তাকে বলা হয় অ্যাটম বা পরমাণু। একটা মৌল আসলে এক বা একাধিক একই ধরনের পরমাণু, যেখানে একই সংখ্যক ও একই ধরনের কিছু কণা থাকে। সবচেয়ে সরলতম মৌলের নাম হাইড্রোজেন। এতে একটামাত্র প্রোটন আর একটামাত্র ইলেকট্রন থাকে। এক বা একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে গঠন করে হাইড্রোজেন মৌল।
হাইড্রোজেন হলো প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা মাত্র তিনটি মৌলের মধ্যে একটা। একে আমরা ল্যাবে বা কোনো পরীক্ষায় তৈরি করি না। এই মৌলটি তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময়। বাকিগুলো তৈরি হয়েছিল বিস্ফোরন্মুখ নক্ষত্রের কেন্দ্রের উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপের ভেতর। এসব মৌলের একধরনের গাইড হিসেবে কাজ করে পর্যায় সারণি, যা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কিন্তু তারপরও বিজ্ঞানীরাও একে ড. সসের কল্পিত জীবজন্তুর উদ্ভট কোনো চিড়িয়াখানার মতো না ভেবে পারেন না। মোট কথা, এই মৌলগুলো অবিশ্বাস্য রকম অদ্ভুত
এই তালিকায় সোডিয়াম নামের একটা বিষাক্ত ধাতু রয়েছে। একে তুমি মাখনের মতো চাকু দিয়ে কেটে ফেলতে পারবে। আবার তালিকার এক জায়গায় তুমি খুঁজে পাবে ক্লোরিন। এটা গন্ধযুক্ত মারাত্মক একটা গ্যাস। পর্যায় সারণি আমাদের বলে যে এই দুটি বিপজ্জনক মৌল একত্র হয়ে অন্য একটা পদার্থ বা যৌগ তৈরি করতে পারে। শুনতে হয়তো ভয়াবহ ব্যাপার বলে মনে হবে। কিন্তু তুমি যদি এই দুটি মৌলকে এক করো, তাহলে তৈরি হবে সোডিয়াম ক্লোরাইড। এটি আসলে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত খাবার লবণ হিসেবে।
কিংবা হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের কথা ধরা যাক। প্রথমটা হলো বিস্ফোরক গ্যাস। আর দ্বিতীয়টা বিভিন্ন পদার্থ পুড়তে সহায়তা করে। কোনো আগুনে অক্সিজেন যোগ করলে তা আরও বেশি করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু তবু পর্যায় সারণি আমাদের বলে, এই দুটি মৌল একত্রে জোড় বাঁধতে পারে। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন জোড় বাঁধলে তুমি পাবে তরল পানি; যা কিনা আগুন নিভিয়ে দেয়।
এ রকম অসংখ্য বিস্ময়ে ভরা পর্যায় সারণি। আমরা প্রতিটি মৌল নিয়ে অনেক অদ্ভুত আর বিস্ময়কর গুণাবলির কথা বলতে পারি। কিন্তু তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছ, আমি নক্ষত্রের দিকে মনোযোগ দিতে বেশি আগ্রহী। কাজেই একজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের চোখ দিয়ে পর্যায় সারণি ঘুরে দেখানোর অনুমতি চাইছি তোমার কাছে।
মহাবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মৌল
সবচেয়ে হালকা ও সরল মৌল হলো হাইড্রোজেন। এর পুরোটাই তৈরি হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের সময়। এটি ছাড়াও বাকি আরও ৯৪টি মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে তাদের মধ্যে হাইড্রোজেনের আধিপত্য। মানবদেহের প্রতি তিনটি পরমাণুর মধ্যে দুটিতেই হাইড্রোজেন রয়েছে। গোটা মহাবিশ্বের প্রতি ১০টি পরমাণুর মধ্যে ৯টিই হাইড্রোজেন পরমাণু। প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে ৪.৫ বিলিয়ন টন দ্রুতগতির হাইড্রোজেন কণা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। আর ঘটনাটা ঘটছে আমাদের সূর্যের অগ্নিগর্ভ উত্তপ্ত কেন্দ্রে। এই সংঘর্ষ থেকে বেরিয়ে আসছে বিপুল শক্তি, যা সূর্যকে জ্বলতে সহায়তা করে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট
জন্মদিনের পার্টিতে হিলিয়ামের ভূমিকা আছে। তাই এই মৌলটিকে তোমার চেনার কথা। গ্যাস হিসেবে হিলিয়াম প্রায় হাইড্রোজেনের মতোই বাতাসে ভাসে। কিন্তু আগেই বলেছি, হাইড্রোজেন হলো ভয়াবহ রকম বিস্ফোরক। কোনো জন্মদিনের পার্টিতে বেলুনে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা থাকলে, তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কোনো বেলুন যদি তখন জন্মদিনের মোমবাতির ওপর এসে পড়ে, তাহলে সেখানে উপস্থিত কেউই বাঁচতে পারবে না। এ কারণে আমরা হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে বেলুন ভরি। এরপর এই অদ্ভুত গ্যাসটা শুষে নিয়ে কথা বললেই মিকি মাউসের কণ্ঠের মতো মনে হয়।
হিলিয়াম হলো মহাবিশ্বের দ্বিতীয় সরলতম ও দ্বিতীয় প্রাচুর্যপূর্ণ মৌল। হাইড্রোজেনের মতো হিলিয়ামও তৈরি হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের সময়। কিন্তু নক্ষত্রের ভেতরও হিলিয়াম তৈরি হয়। মহাবিশ্বে হিলিয়ামের পরিমাণ হাইড্রোজেনের মতো অত বেশি নয়। কিন্তু তারপরও মহাবিশ্বের অন্য সব মৌল একত্রে যোগ করলে যা দাঁড়ায়, তার চেয়েও হিলিয়ামের পরিমাণ চার গুণ বেশি 1
দুর্ভাগ্যজনক অবশিষ্টাংশ
নিউক্লিয়াসে তিনটি প্রোটন নিয়ে লিথিয়াম হয়ে উঠেছে মহাবিশ্বের তৃতীয় সরলতম মৌল। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মতো লিথিয়ামও তৈরি হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের সময়। আবার এই মৌলটি বিগ ব্যাং থিওরি যাচাই করতে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করে। বিগ ব্যাং মডেল অনুসারে, মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে প্রতি এক শ পরমাণুর মধ্যে লিথিয়ামের পরিমাণ একটার বেশি হওয়া উচিত নয়। এখন পর্যন্ত কোনো গ্যালাক্সি খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেখানে লিথিয়ামের পরিমাণ এই সীমার চেয়ে বেশি। এটি আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং টেলিস্কোপে পাওয়া প্রমাণের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে আসলে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা বড় বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।
জীবনদায়ী মৌল
কার্বন মৌলকে সব জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায়। কার্বন তৈরি হয়েছিল নক্ষত্রগুলোর ভেতর। এরপর নক্ষত্রের পৃষ্ঠতলে উঠে এসে ছড়িয়ে পড়ে ছায়াপথে। অন্য যেকোনো মৌলের চেয়ে কার্বন দিয়ে অনেক বেশি অণু তৈরি করা যায়। অতিক্ষুদ্র গাছপালা ও পোকামাকড় থেকে শুরু করে বিশালদেহী রাজকীয় হাতি কিংবা পপ স্টারদের মানুষের মতো আমাদের চেনাজানা জীবনেরই জন্য এটি অন্যতম প্রধান উপাদান। সেলেনা গোমেজও কার্বনভিত্তিক জীবনের একটা রূপ!
কিন্তু যেসব জীবরূপ সম্পর্কে আমরা এখনো কিছু জানি না, তাদের ব্যাপারটা কী? মহাবিশ্বের কোথাও যদি কোনো এলিয়েন প্ৰাণ থাকে, যারা হয়তো কার্বন ও অক্সিজেনের বদলে অন্য কোনো মৌল দিয়ে গঠিত? সিলিকনভিত্তিক জীবনের রূপটা কেমন হবে? সিলিকনভিত্তিক এলিয়েনদের নিয়ে গল্প লিখতে পছন্দ করেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখকেরা। অন্য গ্রহের জীবনরূপ কেমন হতে পারে, তা নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী সময় ব্যয় করেন, তাঁদের বলা হয় এক্সোবায়োলজিস্ট। এই বিজ্ঞানীরা সিলিকনভিত্তিক জীবনরূপের সম্ভাবনার কথাও বিবেচনা করেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমাদের ধারণা, বেশির ভাগ জীবনের রূপও হবে কার্বন দিয়ে তৈরি। কারণ, মহাবিশ্বে সিলিকনের চেয়ে কার্বনের পরিমাণ অনেক অনেক বেশি
ভারী মৌলরা
আমাদের গ্রহের অগ্নিময় কেন্দ্রের চারপাশে একটা খোলস আছে। একে বলা হয় ভূত্বক। পৃথিবীর এই ভূত্বকের বড় একটা অংশ দখল করে আছে অ্যালুমিনিয়াম। প্রাচীনকালের মানুষ অ্যালুমিনিয়াম সম্পর্কে কিছু জানত না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এই মৌলটি পছন্দ করি। কারণ, পলিশ করা অ্যালুমিনিয়ামকে প্রায় নিখুঁত আয়না বানাতে ব্যবহার করা যায়। আলোকে বিবর্ধিত ও ফোকাস করতে টেলিস্কোপের ভেতরে আয়না থাকে। ফলে দূরের বস্তুগুলো অনেক ভালোভাবে দেখতে পারেন জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা। বর্তমানের প্রায় সব টেলিস্কোপে অ্যালুমিনিয়ামের আবরণ দেওয়া হয়।
আরেকটি ভারী মৌল হলো টাইটেনিয়াম। গ্রিকদের শক্তিশালী দেবতা টাইটানের নামে নামকরণ করা হয়েছে মৌলটির। অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে দুই গুণেরও বেশি শক্তিশালী টাইটেনিয়াম। সামরিক বিমান, কৃত্রিম হাত-পা এবং ল্যাক্রোস স্টিকে (একধরনের খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি) টাইটেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। জ্যোতিঃপদার্থবিদদের জন্যও এ মৌলটি ভালো সঙ্গী।
মহাবিশ্বের বেশির ভাগ জায়গায় কার্বনের চেয়েও অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি। এ ধরনের অণু একা একা থাকতে পারে না। তাই কার্বন পরমাণু মুক্ত অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়। সব কটি কার্বন একটা বা দুটো অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও কিছু অক্সিজেন অন্য মৌলের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করার জন্য বেঁচে যায়। অক্সিজেন যখন টাইটেনিয়ামের সঙ্গে বন্ধনে যুক্ত হয়, তখন ফলাফল হিসেবে পাওয়া যায় টাইটেনিয়াম অক্সাইড।
নির্দিষ্ট কিছু নক্ষত্রে জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা টাইটেনিয়াম অক্সাইড শনাক্ত করেছেন। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী নতুন একটা গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, যা টাইটেনিয়াম অক্সাইডে ঢাকা। আমাদের টেলিস্কোপগুলোর যন্ত্রাংশগুলোতে সাদা রং মাখা থাকে, যাতে টাইটেনিয়াম অক্সাইড থাকে। নক্ষত্র আর অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু থেকে আসা আলোকে তীক্ষ্ণ করতে এই যৌগ সহায়তা করে।
স্টার কিলার
লোহা মহাবিশ্বের সাধারণ কোনো মৌল নয়। তবে এটা হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারী নক্ষত্রগুলোর ভেতরে ক্ষুদ্র মৌলগুলোর মধ্যে অনবরত সংঘর্ষ হচ্ছে। এভাবে সংযুক্ত হচ্ছে সেগুলো। হাইড্রোজেন পরমাণু পরস্পরের সঙ্গে প্রবল ধাক্কা খেয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম মৌল। এরপর হিলিয়াম, কার্বন, অক্সিজেন ও অন্যান্য মৌল সংযুক্ত হতে থাকে। একসময় নক্ষত্রের ভেতরের পরমাণুগুলো যথেষ্ট বড় হয়ে গঠন করে লোহা বা আয়রন। এই মৌলের নিউক্লিয়াসে থাকে ২৬টি প্রোটন। এ ছাড়া থাকে অন্তত একইসংখ্যক নিউট্রনও। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটিমাত্র প্রোটন। তাই হাইড্রোজেনের সঙ্গে তুলনা করলে লোহা অনেক ভারী বা বড় মৌল।
লোহার পরমাণুর ভেতরের প্রোটন ও নিউট্রন যেকোনো মৌলের তুলনায় সবচেয়ে কম শক্তিশালী। তবু এটি রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে বেশ সরল ও উত্তেজিত অন্য কিছুতে। এরা নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে শক্তি শোষণ করতে পারে। সাধারণত তুমি যদি কোনো পরমাণুকে ভেঙে ফেলো, তাহলে তা থেকে শক্তি নিঃসৃত হবে বা বেরিয়ে আসবে। একইভাবে তুমি যদি দুটি পরমাণুকে একত্র করে নতুন কোনো মৌল তৈরি করো, তাহলেও সেখান থেকে শক্তি বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু লোহা অন্য মৌলগুলোর মতো নয়। তুমি যদি লোহার পরমাণুকে ভেঙে আলাদা করো, তাহলে তারা শক্তি শোষণ করবে।
আবার তুমি যদি লোহাকে একত্র করে নতুন কোনো মৌল তৈরি করো, তাহলেও তারা শক্তি শোষণ করবে।
নক্ষত্রদের কাজ হলো শক্তি তৈরি করা। যেমন আমাদের সূর্য হলো একটা শক্তি তৈরির কারখানা। সৌরজগৎজুড়ে শক্তিশালী ফোটনে ভরে আছে। কিন্তু অতি ভারী কোনো নক্ষত্র যখন তাদের কেন্দ্রে লোহা তৈরি করতে শুরু করে, তখন তারা পৌঁছে যায় মৃত্যুর দুয়ারে। অনেক বেশি লোহা তৈরি হওয়া মানে শক্তি অনেক কমে যাওয়া। আর কোনো শক্তির উৎস ছাড়া নক্ষত্রটি তার নিজের ভরের চাপে সংকুচিত হতে থাকে এবং সবশেষে বিস্ফোরিত হয়। তখন নক্ষত্রটি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এক বিলিয়ন সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লোহাকে ধন্যবাদ। কারণ, নক্ষত্রের কেন্দ্রে রান্না হওয়ার পর এভাবে এসব মৌল মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে আরও বেশি নক্ষত্র ও গ্রহের বীজ সরবরাহ করে ওরাই।
ডাইনোসর ধ্বংসকারী
পর্যায় সারণিতে সবচেয়ে ভারী মৌলগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইরিডিয়াম। ভূপৃষ্ঠে এই মৌলটি বিরল, কিন্তু এর একটা পাতলা ও বিস্তৃত স্তর রয়েছে। এ স্তরটি আমাদের গ্রহটির অতীত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে মাউন্ট এভারেস্ট আকৃতির একটা গ্রহাণু আছড়ে পড়েছিল আমাদের পৃথিবীতে। এতে সংঘর্ষস্থলটা স্রেফ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তারপর স্যুটকেসের চেয়ে বড় আকারের সব স্থলচর প্রাণী ক্রমেই মরে যায়। কাজেই ডাইনোসরদের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তোমার পছন্দের তত্ত্ব যেটাই হোক না কেন, বাইরের মহাকাশ থেকে আসা একটা বড় আকৃতির গ্রহাণু ওই সব তত্ত্বের মধ্যে শীর্ষে থাকা উচিত।
ইরিডিয়াম পৃথিবীপৃষ্ঠে বিরল হলেও বড় আকৃতির ধাতব গ্রহাণুতে সুলভ। মহাকাশের বিশাল আকৃতির কোনো পাথর যখন পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে, তখন তার ভেতরের ইরিডিয়াম বিস্ফোরিত হয়ে ফেটে বেরিয়ে এসে বিশালাকৃতির মেঘ তৈরি করে। এই বিস্ফোরণের ফলে গোটা গ্রহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে ইরিডিয়াম পরমাণু। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মাটির নিচে খুঁড়ে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের ভূপৃষ্ঠ কেমন ছিল, তা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা দেখেছেন, এই মৌলের পাতলা একটা স্তর সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে।
দেবতারা
পর্যায় সারণির কিছু মৌলের নামকরণ করা হয়েছে গ্রহ আর গ্রহাণুদের নামানুসারে। আবার ওই সব গ্রহ ও গ্রহাণুর নাম দেওয়া হয়েছে রোমান দেবতাদের নামে। উনিশ শতকের শুরুতে মঙ্গল গ্রহ আর বৃহস্পতির মাঝখানে দুটি বস্তু আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদেরা। বস্তু দুটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এদের একটির নাম দেওয়া হয় সেরেস। সেরেস হলো ফসল কাটার দেবী। দ্বিতীয়টির নাম দেওয়া হয় রোমান জ্ঞানের দেবীর নামে—প্যালাস। সেরেস আবিষ্কারের পর প্রথম যে মৌল আবিষ্কৃত হয়, তার নাম দেওয়া হলো সিরিয়াম। আর প্যালাস আবিষ্কারের পর প্রথম যে মৌলটি আবিষ্কৃত হলো, জ্যোতির্বিদেরা তার নাম দিলেন প্যালাডিয়াম। মুভিতে আয়রনম্যান স্যুটকে শক্তি দিতে এবং তার বাইরের অবকাঠামো বানাতে প্যালাডিয়াম মৌলটি ব্যবহার করছিলেন টনি স্টার্ক। (দুঃখিত, এটা পুরোটাই কল্পনা। বাস্তবে প্যালাডিয়াম থেকে প্রায় অন্তহীন শক্তি পাওয়া যায় না। সে তুলনায় প্লুটোনিয়াম অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। কিন্তু এই মৌলটা খুবই তেজস্ক্রিয়। কাজেই এ মৌলের কারণে আয়রনম্যান ভয়াবহভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে কিংবা বিশ্বকে বাঁচানোর আগে নিজেই মারা পড়বে। )
মার্কারি বা পারদ হলো রুপালি ধাতু, যা কক্ষ তাপমাত্রায় তরল। এই মৌলটির নাম রাখা হয়েছে দ্রুতগতির রোমান বার্তাবাহক দেবতা মার্কারির নামে। থোরিয়াম নামটি অনুপ্রাণিত হয়েছে থর থেকে। পূর্ব ইউরোপের বজ্রবিদ্যুতের স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেবতা হলো থর। থর আর আয়রনম্যান যে ভালো বন্ধু হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তারা একটা মৌলিক বন্ধন শেয়ার করে।
শনি বা স্যাটার্ন আমার প্রিয় গ্রহ (আসলে আমার প্রথম প্রিয় গ্রহ হলো পৃথিবী। তারপর শনিগ্রহ।)। এ গ্রহের নামে কোনো মৌলের নামকরণ করা হয়নি। তবে ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটোর নামে মৌল আছে। এরা সবাই রোমান পুরাণের দেবতা। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা প্রথম যে পারমাণবিক বোমাটি বানানো হয়েছিল, তার প্রধান উপাদান ছিল ইউরেনিয়াম। আমাদের সৌরজগতে ইউরেনাসের পরে আসে নেপচুন। একইভাবে পর্যায় সারণিতেও ইউরেনিয়ামের পর আসে নেপচুনিয়াম।
পর্যায় সারণির পরের মৌলটি হলো প্লুটোনিয়াম। এই মৌলটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। তবে একটা পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য এটা যথেষ্ট পরিমাণে কীভাবে বানানো যায়, সে প্রক্রিয়া জেনে গেছেন বিজ্ঞানীরা। প্লুটোনিয়াম দিয়ে বানানো প্রথম বোমাটি জাপানের নাগাসাকি শহরে ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। জাপানের হিরোশিমা শহরে ইউরেনিয়াম দিয়ে বানানো বোমাটি ফেলা হয়। এর ফলে দ্রুত সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। নির্দিষ্ট ধরনের অল্প পরিমাণ প্লুটোনিয়াম ভবিষ্যতে নভোযানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে, যা সৌরজগতের বাইরে ভ্রমণ করতে পারবে।
তাহলে সৌরজগতের কিনারায় এবং তা ছাড়িয়ে রাসায়নিক মৌলের পর্যায় সারণিতে আমাদের মহাজাগতিক ভ্রমণ আপাতত এখানেই শেষ। অবশ্য কিছু মানুষ রাসায়নিক পদার্থ পছন্দ করে না। কারণটা আমি এখনো বুঝতে পারি না। হয়তো রাসায়নিকের নামগুলো তাদের কাছে বিপজ্জনক বলে মনে হয়। কিন্তু ঘটনা সে রকম হলে কোনো রসায়নবিদকে দোষ দেওয়া উচিত, কোনো রাসায়নিক মৌলকে নয়। ব্যক্তিগতভাবে রাসায়নিক পদার্থ আমার বেশ পছন্দ। আমার প্রিয় তারকারা, আর সেই সঙ্গে আমার প্রিয় বন্ধুরাও তৈরি হয়েছে এসব পদার্থ দিয়ে!