২. এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় কী
ধরা যাক, কোনো এলিয়েন সভ্যতার খোঁজে আমরা অন্য আরেকটা গ্রহে নেমেছি। ওই এলিয়েনদের কোনো কিছুই হয়তো আমাদের মতো হবে না। তাদের পায়ের সংখ্যা হতে পারে তিনটা। কিংবা কে জানে, কোনো পা না-ও থাকতে পারে। তাদের চামড়া হতে পারে ঘিনঘিনে পিচ্ছিল ও রক্তবর্ণের। এমনকি ন্যাকেড মোল ইঁদুরের চেয়েও কুৎসিত হতে পারে। কে জানে, তারা চমৎকার নাচও জানতে পারে। আমরা আসলে এসবের কিছুই জানি না। শুধু একটা বিষয় নিশ্চিত জানি, আমাদের বিশ্বে প্রকৃতির যেসব নিয়মকানুন আছে, তাদের বিশ্বেও একই নিয়মকানুন প্রযোজ্য।
বিজ্ঞানে এই ধারণাকে বলা হয় ইউনিভার্সালিটি অব ফিজিক্যাল লজ। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সর্বজনীনতা।
তুমি যদি এলিয়েনদের সঙ্গে কথা বলতে চাও, তাহলে বাজি ধরতে পারো, তারা ইংরেজি বা ফরাসি কিংবা মান্দারিন ভাষায় কথা বলতে পারবে না। আবার তাদের সঙ্গে হাত মেলানোকে তারা আন্তরিক শুভেচ্ছা, নাকি ভয়ানক অপমান হিসেবে মনে করবে, তা-ও আমরা জানি না। কিন্তু তাদের সভ্যতা যদি উন্নত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো ঠিকই বুঝতে পারবে। এলিয়েনরা খাটো হোক বা লম্বা হোক, ঘিনঘিনে হোক বা তা না হোক, মহাকর্ষ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকবে। কাজেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, বিজ্ঞানের ভাষা ব্যবহার করা।
*
বৈজ্ঞানিক যেসব সূত্র আমাদের মহাবিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করে ও আকার দেয়, সেগুলো মহাবিশ্বের সব জায়গায় একই রকম। তোমার বাড়ির পেছনের উঠান থেকে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ এবং তা ছাড়িয়ে সব জায়গার জন্যই সূত্রগুলো সত্য। এমনকি ছায়াপথের বহু দূরের পটভূমিতে যে স্টার ওয়ার্স মুভি বানানো হয়েছে, সেগুলোতেও এসব সূত্রে অবিচল থাকা উচিত। কারণ, সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথগুলোও আসলে আমাদের মহাবিশ্বেরই অংশ।
ভৌত বা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো যে সর্বজনীন, তা একসময় বিজ্ঞানীরাও জানতেন না। মানে ১৬৬৬ সালের আগপর্যন্ত এটা জানা ছিল না কারও। কিন্তু ওই বছর মহাকর্ষ সূত্র লিপিবদ্ধ করেন আইজ্যাক নিউটন নামের এক ভদ্রলোক। মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে, সে রকম একটা রেসিপি বলা যায় একে। এর আগে কেউ জানত না, বা ভাবতেও পারেনি যে বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো আমাদের বাড়িতে আর মহাবিশ্বের সব জায়গায় একই রকম। নিজ নিজ ক্ষেত্রে পৃথিবীর পার্থিব জিনিসপত্র এবং স্বর্গীয় বা মহাকাশের স্বর্গীয় বস্তু (যেমন নক্ষত্র ও গ্রহগুলো) চলাফেরা করত।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার নিয়মকানুন বা সূত্র বদলে যেতে পারে। যেমন তোমার বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টে স্নিকার পায়ে দিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারো। তাতে হয়তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার বন্ধুর বাড়িতে গেলে হয়তো সেখানকার নিয়ম মেনে চলতে হবে। তোমাকে জুতা খুলে ফেলতে হতে পারে দরজার কাছে। কারণ, যাতে সব জায়গায় ধুলো বা কাদা ছড়িয়ে না পড়ে। মহাবিশ্বও হয়তো সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে একসময় মনে করতেন বিজ্ঞানীরাও। মানে একেক জায়গায় একেক নিয়ম। কিন্তু নিউটন আবিষ্কার করলেন, মহাবিশ্ব আসলে অন্যভাবে কাজ করে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সব জায়গায় একই নিয়ম খাটে।
*
১৬৬৫ সালে ভয়াবহ সংক্রামক রোগ প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে। এ রোগ থেকে বাঁচতে লোকজন শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্যার আইজ্যাক নিউটনও। লিঙ্কনশায়ারে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। শহরে থেকে দূরে এসে বেশ সময় ছিল নিউটনের হাতে। তাই সেই অবসরে কিছু চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। বাগানের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, পাকা আপেলকে গাছ থেকে নিচের দিকে টেনে আনে কোন ধরনের বল? আপেলগুলো সোজাসুজি মাটিতে এসে পড়ে যায় কেন? ১৬৬৬ সালের মধ্যে এই প্রশ্নটা তাঁকে মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করতে সহায়তা করল।
নিউটনের বুদ্ধিদীপ্ত কাজের কারণে সেবার বোঝা সম্ভব হলো, মহাকর্ষ শুধু সামান্য আপেলকেই মাটিতে টেনে নামায় না। তিনি আবিষ্কার করলেন, চাঁদকে পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথে আটকে রাখে ওই মহাকর্ষ বল।
শুধু তা-ই নয়, দেখা গেল, সূর্যের চারপাশের গ্রহ, উল্কা আর ধূমকেতুও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মাধ্যমে।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কয়েক শ বিলিয়ন নক্ষত্রকে মহাবিশ্বে ছিটকে পড়া থেকে রক্ষা করছে এই বলটাই।
এই পরিসরে পৌছানোর মতো সূত্র শুধু একমাত্র মহাকৰ্ষই নয়, নিউটনের পর থেকে বিজ্ঞানীরা আরও বেশ কিছু ভৌত সূত্র আবিষ্কার করেছেন। সেগুলোও প্রয়োগ করা যায় মহাবিশ্বের সব জায়গায়। ভৌত সূত্রগুলোর এই সর্বজনীনতা চমৎকার সব আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করেছে। তাই এখন আমরা বহুদূরের নক্ষত্র ও গ্রহ নিয়ে গবেষণা করতে পারি। সেই সঙ্গে বুঝতেও পারি, তারাও একই সূত্র অনুসরণ করছে।
নিউটনের পর উনিশ শতকের জ্যোতির্বিদেরা এই ধারণা ব্যবহার করে নির্ণয় করলেন যে পৃথিবীতে যেসব মৌল পাওয়া যায়, সূর্যও ঠিক একই মৌল দিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ও লোহা। এমনকি সূর্যের আলোতে নতুন একটা মৌল দেখতে পেলেন জ্যোতির্বিদেরা। সূর্যেই সেটা প্রথম খুঁজে পাওয়ার কারণে নতুন পদার্থটির নাম রাখা হলো হিলিয়াম। আসলে গ্রিক ভাষায় সূর্যের আরেক নাম হেলিয়স। সে কারণে নতুন মৌলটির নাম এ রকম। হিলিয়াম হলো পর্যায় সারণির প্রথম এবং একমাত্র মৌল, যার আবিষ্কার হয়েছে পৃথিবীর বাইরে। এ মৌলের ফলে অনেক দিন পর বার্থডে পার্টির ধরন পাল্টে গেল। কারণ, একসময় বাচ্চারা আবিষ্কার করে বসল, বেলুন থেকে এই গ্যাস একটু গিলে নিলে তাদের কণ্ঠস্বর কার্টুন চরিত্রগুলোর মতো তীক্ষ্ণ হয়ে যায়।
*
এতক্ষণে বোঝা গেল, এই সূত্রগুলো আমাদের সৌরজগতে কাজ করে। কিন্তু গোটা ছায়াপথে তা একইভাবে কাজ করে কি?
কিংবা গোটা মহাবিশ্বে?
কিংবা ১ মিলিয়ন বা কয়েক বিলিয়ন বছর আগেও কি সেগুলো এভাবে কাজ করত?
ধাপে ধাপে সূত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
জ্যোতির্বিদেরা দেখতে পেয়েছেন, পার্শ্ববর্তী নক্ষত্রগুলোও তৈরি হয়েছে হাইড্রোজেন ও কার্বনের মতো পরিচিত গাঠনিক একক দিয়ে পরে বাইনারি স্টার বা যুগ্ম তারা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। যুগ্ম তারা হলো, এমন এক জোড়া তারা, যারা একটা আরেকটাকে কেন্দ্র করে পাক খায়। বক্সিং রিংয়ের ভেতর ফাইটাররা ইতস্তত করে যেভাবে পরস্পরকে ঘিরে পাক খায়, অনেকটা সে রকম। এই যুগ্ম তারা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আরেকবার মহাকর্ষের প্রভাব আবিষ্কার করছেন জ্যোতির্বিদেরা। নিউটনের আপেলগাছ থেকে যে সর্বজনীন বল আপেল মাটিতে ফেলে দেয়, কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া কোনো বাচ্চাকে বাস্কেটবল ডাঙ্কিং করতে বাধা দেয়, সেই একই সূত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই যুগ্ম তারাদের চলাফেরা অনুমান করতে পেরেছেন।
কাজেই এসব সূত্র এখানেও কাজ করে, আবার বহুদূরেও কাজ করে। কিন্তু আমরা কীভাবে জানব, এটা সব সময়ের জন্য সত্য? এসব সর্বজনীন সূত্র কি ১ মিলিয়ন বছর আগেও কার্যকর ছিল?
এর উত্তর হলো, হ্যাঁ। আমরা এটা জানি, কারণ অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টরা অতীতেও উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন।
তুমি যখন একটা টেলিস্কোপে মঙ্গল গ্রহের দিকে তাকাও, তখন তুমি যে লাল গ্রহটা দেখো, সেটা আসলে ওই মুহূর্তের নয়। পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহের মাঝখানের দূরত্ব সব সময় বদলে যাচ্ছে। তবে ধরে নেওয়া যাক, তাদের মাঝখানের দূরত্ব গড়ে ১৪০ মিলিয়ন মাইল। তার মানে, কোনো আলোকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে এই ১৪০ মিলিয়ন মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। আলোর জন্য এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে প্রায় ১২ মিনিট। আলো যেহেতু তোমার টেলিস্কোপে এসে পৌছাতে ১২ মিনিট লাগছে, তাই তুমি আসলে ১২ মিনিট আগের মঙ্গল গ্রহ দেখতে পাচ্ছ।
অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টদের কাছে অনেক বড় বড় টেলিস্কোপ আছে। এগুলো দিয়ে আমরা আরও অনেক দূরের বস্তু নিয়ে গবেষণা করতে পারি। আর আমরা মহাকাশের যত দূরে দেখব, ততই পেছনের সময় দেখতে পাব।
আমি জানি, তুমি কী ভাবছ : ওয়াও।
আসলেই তা-ই। এটাই প্রশংসাযোগ্য প্রতিক্রিয়া।
আমরা বহুদূরের নক্ষত্র ও ছায়াপথ নিয়ে কথা বলি আলোকবর্ষ বা লাইট ইয়ারের হিসাবে। অর্থাৎ কোনো বস্তু থেকে আমাদের টেলিস্কোপে আলোকরশ্মি আসতে যে সময় লাগে, তার হিসাবে। কাজেই আমরা যখন ৫ বিলিয়ন দূরের কোনো ছায়াপথ নিয়ে গবেষণা করি, তার মানে ওই ছায়াপথ থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে সময় লেগেছে ৫ বিলিয়ন বছর।
অন্য কথায়, আমরা যে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ দেখতে পাচ্ছি, সেটা আসলে পাঁচ বিলিয়ন বছর আগেকার।
আক্ষরিক অর্থেই আমরা এভাবে সময়ের পেছনে উঁকি দিতে পারি। আমরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরের বস্তুও খুঁজে পাই। সেগুলোর বয়স কয়েক বিলিয়ন বছর। ওই সব বস্তুকেও আমাদের বর্তমানের সূত্রগুলো মেনে চলতে দেখা গেছে। একদম শুরু থেকেই মহাবিশ্বের সবকিছু সর্বজনীন সূত্র কঠোরভাবে মেনে চলছে।
*
অবশ্য ভৌত সূত্রের সর্বজনীনতার মানে এই নয় যে মহাবিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটে, তার সবকিছু পৃথিবীতেও ঘটতেই হবে। এসব সূত্র সব জায়গায় একই রকম—এ কথার মানে এই নয় যে সব জায়গাতেই সবকিছু করা সম্ভব। যেমন আমি বাজি ধরে বলতে পারি, রাস্তায় কোনো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরকে তুমি কখনো শুভেচ্ছা জানাও না।
অবিশ্বাস্য রকম অতিঘন কোনো নক্ষত্রকে মহাকর্ষ যখন চুপসে দেয়, তখন মহাবিশ্বের এই দানবীয় বস্তু কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হয়। সে সময় ওই নক্ষত্রের কেন্দ্রের দিকে সব পদার্থ শুষে নিতে থাকে মহাকর্ষ। তাতে এককালে নক্ষত্রটি যে স্থানে আলো নিঃসরণ করত, সেখানে একটা গর্তের সৃষ্টি হয়। এসব কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের মহাকর্ষ বল এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে সেখান থেকে আলোও আর বেরিয়ে আসতে পারে না। এ রকম মহাজাগতিক কোনো গর্ত যদি কখনো সত্যি সত্যি রাস্তায় উদয় হয়, তাহলে শুধু তুমিই নও, আরও অনেকে তার শিকারে পরিণত হবে। গোটা গ্রহটা তখন ঘূর্ণিপাকের ভেতর পড়বে এবং স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাবে।
কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারাও প্রকৃতির সূত্র মেনে চলে।
*
মহাবিশ্বের সর্বত্র শুধু ভৌত সূত্রগুলোই প্রয়োগ করা যায়, ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। এসব সূত্র কিছু সংখ্যা বা রাশির ওপর নির্ভর করে, যাদের বলা হয় কনস্ট্যান্ট বা ধ্রুবক। কোন সূত্র কী করবে, তা অনুমান করতে এই ধ্রুবক বিজ্ঞানীদের সহায়তা করে। যেমন মহাকর্ষ ধ্রুবকের জন্য ব্যবহার করা হয় ইংরেজি বড় হাতের জি (G) বা বিগ জি। প্রদত্ত কোনো পরিস্থিতিতে কোনো স্থানের মহাকর্ষ কতটা শক্তিশালী হবে, তা নির্ণয় করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে এটি। যেমন মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে মহাকর্ষের পরিমাণ নির্ণয় করতে আমরা বিগ জি ব্যবহার করতে পারি। অবশ্য সব ধ্রুবকের মধ্যে আলোর গতি সবচেয়ে বিখ্যাত। চাঁদে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত অ্যাপোলো মিশনের সময় নভোচারীদের চাঁদে উড়ে যেতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল। কিন্তু নভোচারীরা যদি আলোর গতিতে চলত, তাহলে পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত ওই দুই হাজার চার শ মাইল পথ পেরোতে ১ সেকেন্ডের একটু বেশি সময় লাগত। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে নভোচারীরা কেন আলোর গতিতে চাঁদে গেল না? আসলে ওই গতিতে চলা অসম্ভব।
এখনো কোনো পরীক্ষাতে কোনো বস্তুকে কোনোভাবে আলোর গতিতে চালানো যায়নি
আমরা যত দ্রুতই চলি না কেন, কখনো আলোর এই গতিসীমা পেরোতে পারব না।
দৃশ্যত সব ধরনের অসম্ভবকে সব সময় জয় করেছে মানবজাতি। অথচ আমরা আমাদের প্রকৌশলী ও উদ্ভাবকদেরও ছোট করে দেখেছি। মানুষ একসময় বলাবলি করত, আমরা নাকি কখনো আকাশে উড়তে পারব না। এমনকি আমরা কখনো চাঁদেও যেতে পারব না, কিংবা পরমাণুকে ভাঙতে পারব না—এমনও বলত অনেকে। তারপর আমরা এই তিনটি কাজই করতে পেরেছি। কিন্তু এর কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কোনো ভৌত সূত্র আমাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
চাঁদে যাওয়া কঠিন বটে, কিন্তু অসম্ভব নয়।
তবে ‘আমরা কখনো আলোর গতিসীমা পার হতে পারব না’—এই দাবি একেবারেই ভিন্ন ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী। এটি এসেছে সময় পরীক্ষিত ভৌতনীতি থেকে। মহাবিশ্বে হয়তো এমন কোনো স্পিড লিমিট বা গতিসীমার সাইন থাকতে পারে, যেখানে লেখা থাকবে : আলোর গতি : এটা শুধু ভালো একটা ধারণাই নয়, এটা একটা আইন।
কোনো এলিয়েন যত উন্নত বা বুদ্ধিমান হোক না কেন, তারাও কখনো আলোর গতিসীমা পার হতে পারবে না। তারাও সম্ভবত এই ধ্রুবকের সঙ্গে পরিচিত। মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের সব বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিত করে যে বিগ জি থেকে শুরু করে আলোর গতির মতো প্রধান ধ্রুবকগুলো কখনো সময় বা স্থান পাল্টে গেলেও বদলে যায় না। একইভাবে যেসব ভৌত সূত্রে এসব ধ্রুবক ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও বদলে যায় না।
*
আমাকে হয়তো খুব বেশি নিশ্চিত দেখাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আসলে সবকিছু জানেন না। আবার আমরা সবকিছুতে একমতও হই না। আমরাও খুব তর্কবিতর্ক করি অনেকটা ভাইবোনদের মতো। কিন্তু আমরা যখন তর্কবিতর্ক করি, তখন আমাদের যুক্তিগুলো নিবদ্ধ থাকে ধারণার প্রতি এবং মহাজাগতিক যেসব ঘটনা আমরা বুঝতে পারি, সেগুলোর প্রতি।
যখন কোনো সর্বজনীন ভৌত সূত্র জড়িত থাকে, তখন বিতর্কটা সংক্ষিপ্ত হওয়ার গ্যারান্টি থাকে।
তারপরও সবাই ওই ধারণাটি বোঝে না।
কয়েক বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনার এক ডেজার্ট শপে আমি একটা গরম কোকোয়া খাচ্ছিলাম। অবশ্যই উইপড ক্রিমসহ অর্ডার করেছিলাম সেটা। আমার টেবিলে কোকোয়া আসার পর আমি উইপড ক্রিম নামের কোনো বস্তু দেখতে পেলাম না। ওয়েটারকে ডেকে বললাম, আমার কোকোয়ায় কোনো উইপড ক্রিম দেওয়া হয়নি। সে জোর গলায় বলল, আমি ওটা দেখতে পাচ্ছি না, কারণ তা গ্লাসের নিচে ডুবে গেছে।
কিন্তু উইপড ক্রিমের ঘনত্ব কম। মানুষ যেসব পানীয় পান করে, সেসব তরলের ওপর এই ক্রিম ভেসে থাকে। এমনকি হট চকলেটের ওপরও ওটা ভাসে। তুমি মহাবিশ্বের যে প্রান্তেই যাও না কেন, বেশি ঘনত্বের তরলের ওপর কম ঘনত্বের পদার্থ ভেসে থাকবে। এটা একটা সর্বজনীন আইন বা ইউনিভার্সাল ল।
কাজেই ওই ওয়েটারকে আমি দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রস্তাব করলাম : হয় আমার হট কোকোয়াতে কেউ উইপড ক্রিম দিতে ভুলে গেছে, নয়তো পদার্থবিজ্ঞানের সর্বজনীন আইন এই রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে আলাদা। আমার কথা বিশ্বাস করল না ছোকরা। তাই তার দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে একদলা উইপড ক্রিম বয়ে আনল। আমার হট কোকোয়াতে একবার বা দুবার দ্রুত ওঠানামা করার পর উইপড ক্রিমটা ওপরে ভেসে উঠল। তারপর সেখানেই ভাসতে লাগল।
ভৌত সূত্রের সর্বজনীনতা নিয়ে তোমার কি এর চেয়ে ভালো কোনো প্রমাণের দরকার আছে?