পূর্বকথা : তারা দেখতে
আমার বয়স তখন সবে ৯ বছর। সেই বয়সেই সিদ্ধান্ত নিই, আমি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হব। আমার এখনো ওই রাতের কথা মনে আছে। তারায় তারায় ছেয়ে গিয়েছিল গোটা আকাশ। বিগ আর লিটল ডিপারস। বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ। দিগন্তের দিকে বিদ্যুতের মতো ছুটে গেল একটা উল্কা। আমার কাছে মনে হলো, যেন আকাশ চিরে একখণ্ড মেঘ চলে গেল আরেক প্রান্তে। কিন্তু ওটা আসলে নিছক কোনো মেঘ ছিল না। আমাদের অতি নিকট মহাজাগতিক প্রতিবেশী মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দিকে তাকালাম। বাংলায় যাকে বলে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র দিয়ে ভরা মহাকাশের একটা এলাকা ওটা। বিস্মিত চোখে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এসব দেখলাম আমি।
এরপর আবারও আলো জ্বলে উঠল দপ করে। নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্লানেটারিয়ামে বসে থাকা অবস্থায়। আমি এতক্ষণ যা দেখছিলাম, সেটা আসলে ছিল একটা স্টার শো। কিন্তু তাতে এর প্রভাব বাধাগ্রস্ত হয়নি। ওই রাতে আমি বুঝে ফেলি, বড় হয়ে কী হতে চাই। আমি হতে চাই একজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট বা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী।
সে সময় এই শব্দটাও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতাম না। কিন্তু ওটা আসলে কিছুটা সাধারণ ধারণা। জ্যোতিঃপদার্থ হলো গ্রহ, নক্ষত্র ও আমাদের মহাজাগতিক বস্তুগুলো এবং তারা কীভাবে কাজ করে ও পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তা নিয়ে গবেষণা করা।
কৃষ্ণগহ্বর নামের দানব নিয়ে গবেষণা করেন জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা। আলো ও পদার্থের নাগাল পেলেই এরা তার সবটুকু শুষে নেয়। আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করি সুপারনোভার লক্ষণের খোঁজে। মৃত্যুমুখী নক্ষত্রের উজ্জ্বল বিস্ফোরণই হলো সুপারনোভা বা অতি নবতারা।
আমরা সদা কৌতূহলী ও অদ্ভুত এক দল। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীর কাছে একটা বছরের মানে হলো, সূর্যের চারপাশে আমাদের গ্রহটির বার্ষিক ভ্রমণ শেষ করতে যেটুকু সময় লাগে, তার হিসাব। তুমি যদি কোনো জ্যোতিঃপদার্থবিদের জন্মদিনে উপস্থিত থাকো, তাহলে হয়তো একটা গান শোনার সম্ভাবনা রয়েছে :
হ্যাপি অরবিট অব দ্য সান টু ইউ…
আমাদের মনের ভেতর সব সময় বিজ্ঞান ভুড়ভুড়ি কাটে। একটু মজা করা যাক। আমার এক অভিনেতা বন্ধু কিছুদিন আগে আমাকে ‘গুডনাইট মুন’ নামের ক্ল্যাসিক বেডটাইম স্টোরি পড়ে শোনাল। গল্পের গরু লাফ দিয়ে চাঁদেও উঠতে পারে। কিন্তু গরু যে চাঁদে লাফ দিয়ে উঠতে পারে না, সেটা বলার জন্য কোনো বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কিন্তু ওটা করতে গরুটাকে কী করতে হবে, তা হিসাব করে বের দিতে পারেন একজন জ্যোতিঃপদার্থবিদ। একটা গরু যদি চাঁদ লক্ষ্য করে লাফ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে সেখানে পৌঁছাতে চায়, তাহলে তাকে লাফ দিতে হবে ঘণ্টায় প্রায় ২৫ হাজার মাইল বেগে। তাহলে সেখানে পৌঁছানোর একটা সুযোগ পেলেও পেতে পারে।
৯ বছর বয়সে অ্যাস্ট্রোফিজিকস সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানতাম না। প্লানেটারিয়াম শোতে আমি যা দেখেছিলাম, সেফ সেটাই বুঝতে চাইতাম। আর বাস্তবে কসমস, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে গোটা মহাবিশ্বটা সত্যিই সে রকম দুর্দান্ত একটা ব্যাপার। প্রথমে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করি আমি। সেখানে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বকবক করতাম আর তার ছোট্ট বাইনোকুলার দিয়ে আকাশ দেখতাম। পরে ডগ ওয়াকিং ব্যবসা শুরু করি। মানে কুকুরকে হাঁটিয়ে আনার কাজ। এভাবে করে তখন নিজের জন্য একটা টেলিস্কোপ কিনে ফেলতে পারলাম। আমার কাছে বড় কুকুর, ছোট কুকুর, আলুথালু বিশ্রী কুকুর এবং আন্তরিক কুকুরও ছিল। সঙ্গে ছিল রেইনকোট পরা কুকুরও। এমনকি বাদ যায়নি হ্যাট আর বো-টাই পরা কুকুরও। আকাশের তারা দেখার লোভে তাদের নিয়ে হাঁটতে বের হতাম আমি।
এরপরের বছরগুলোতে স্থিরভাবে বসানো বড় টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছি। তখন নিউইয়র্কে আমাদের বাসার ছাদ থেকে চলে গিয়েছি দক্ষিণ আমেরিকার পাহাড়চূড়ায়। এসবের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল। সেটা হলো কসমসটাকে বোঝার জন্য আমার বাসনা। সঙ্গে আমার এই প্রবল অনুরাগটা যতটা সম্ভব বেশি মানুষের সঙ্গে শেয়ার করা। সেসব মানুষের মধ্যে তুমিও রয়েছ।
এই বইটা যারাই পড়বে, তারাই যে রাতারাতি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হতে চাইবে, আমি সেটা আশা করি না। কিন্তু তোমার কৌতূহলে হয়তো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেবে এই বইটা। রাতের আকাশে তাকিয়ে তুমি যদি কখনো বিস্মিত হয়ে ভাবো : এসবের মানে কী? এগুলো কীভাবে কাজ করে? মহাবিশ্বে আমার জায়গাটা কোথায়? তাহলে তোমাকে বইটা পড়া চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করব। অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর ইয়াং পিপল ইন আ হারি বইটা বড় বড় ধারণা ও আবিষ্কার সম্পর্কে তোমাকে প্রাথমিক জ্ঞান দিতে পারবে। এসব ধারণা ও আবিষ্কার মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ভাবতে সাহায্য করে। আমি যদি এ কাজে সফল হই, তাহলে ডিনার টেবিলে বসে তোমার বাবা-মাকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে তুমি। তোমার শিক্ষককেও মুগ্ধ করতে পারবে। আবার মেঘহীন রাতে নক্ষত্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারবে গভীর অনুভূতি নিয়ে। তখন তোমার দৃষ্টিতে একই সঙ্গে থাকবে উপলব্ধি আর বিস্ময়।
কাজেই আর কথা না বাড়িয়ে চলো শুরু করা যাক। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্য ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দিয়ে আমরা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু প্রথমে আমাদের আসলে এমন কিছু দিয়ে শুরু করা উচিত, যাকে আমি বলি, সর্বকালের সেরা কাহিনি।
সেটা হলো জীবনের গল্প।
নীল ডিগ্র্যাস টাইসন
গত শতকে জ্যোতির্বিদেরা সর্পিল ছায়াপথে আটটি নক্ষত্রের বিস্ফোরণের ঘটনা দেখতে পেয়েছেন। সে কারণেই এ ঘটনাকে বলা হয় ছায়াপথের আতশবাজি।
স্বচ্ছ রাতের আকাশ তোমার চোখ ও মন খুলে দেবে। নিঃসীম শূন্যে নক্ষত্ররাজি, আন্তনাক্ষত্রিক ধূলিকণা এবং আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ভিড়ে ঠাসা নক্ষত্রদের দেখে বিস্মিত হবে তুমি।