১১. এলিয়েনের চোখে পৃথিবী দেখতে কেমন
বহুদূরের কোনো এলিয়েন দলের কাছে পৃথিবী কীভাবে আবির্ভূত হয়, তা বুঝতে হলে পৃথিবী থেকে ওপরে এবং বাইরে গিয়ে আমাদের গ্রহটি দেখতে হবে। তুমি পৃথিবীর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা পর্যন্ত জোরে দৌড়াও, সাঁতার কাটো, হাঁটো বা তোমার বাইক চালাও না কেন, তুমি আমাদের গ্রহের সীমাহীন বস্তুর জোগানের ক্লোজআপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারো। তুমি হয়তো দেখেছ একটা মাকড়সা তার জালের ভেতর একটা মথকে আটক করছে, একটা পাতা থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে, একটা হারমিট ক্র্যাব দ্রুতবেগে বালুর ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কিংবা কোনো টিনএজারের নাকে একটা ব্রণ উঠেছে।
ভূপৃষ্ঠের কথা যদি বলি, খুঁটিনাটি ব্যাপারে পৃথিবী সমৃদ্ধ। তোমাকে শুধু দেখতে হবে। এখন ওপরের দিকে যাওয়া যাক। ক্ৰমে ওপরের দিকে উঠতে থাকা এরোপ্লেনের জানালা দিয়ে ভূপৃষ্ঠের এই বিস্তারিত দৃশ্য হারিয়ে যেতে থাকে। কোনো ক্ষুধার্ত মাকড়সা আর দেখা যায় না। আতঙ্কিত কাঁকড়াও নয়। কোনো ব্রণও নয়। প্ৰায় সাত মাইল উচ্চতায় ওঠার পর তোমার নিজের শহরটাকেই চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। তুমি মহাকাশের যত ওপরে উঠবে, ততই ভূপৃষ্ঠের বিশদ দৃশ্যপট হারিয়ে যেতে থাকবে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রায় ২৫০ মাইল ওপরের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। অবশ্য এর একটা জানালা দিয়ে তুমি হয়তো দিনের বেলা প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেস শহর খুঁজে পাবে। কিন্তু সেটা কেবল সম্ভব তুমি যদি ভূগোল জানো। তুমি মহাকাশ থেকে গিজার গ্রেট পিরামিড দেখতে পাবে না। এমনকি দেখতে পাবে না চীনের মহাপ্রাচীরও।
তুমি যদি চাঁদের পৃষ্ঠে দাঁড়াও, তাহলে নিউইয়র্ক, প্যারিস এবং পৃথিবীর বাকি উজ্জ্বল শহরগুলো ঝিকঝিক করতেও দেখতে পাবে না। কারণ, পৃথিবী থেকে তখন তোমার দূরত্ব হবে এক মিলিয়ন মাইলের চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তখনো তুমি ঠান্ডা বাতাসের পুঞ্জ এবং আবহাওয়ার অন্যান্য প্রধান রূপ আমাদের গ্রহজুড়ে ছুটে যেতে দেখতে পাবে। ধরা যাক, তুমি মঙ্গল গ্রহে চলে গিয়েছ। পৃথিবীর সঙ্গে এই গ্রহটির সবচেয়ে নিকটতম দূরত্ব প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মাইল। সেখান থেকে বড় একটা টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে বিশাল তুষারের টুপি পরা পর্বতের সারি এবং পৃথিবীর মহাদেশের কিনারা দেখা যাবে। কিন্তু এগুলোই সব, আর কিছু নয়। আমাদের শহরগুলো দেখতে পাবে না।
টুকরো তথ্য
মহাকাশ থেকে কি চীনের মহাপ্রাচীর দেখা যায়? না! মহাপ্রাচীর কয়েক হাজার মাইল লম্বা হলেও, এর প্রশস্ততা মাত্র ২০ ফুট। যুক্তরাষ্ট্রের হাইওয়ের চেয়েও অনেক সরু। তাই অনেক উঁচুতে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন থেকে মহাপ্রাচীর কোনোমতে দেখতে পাওয়া যায়।
তিন বিলিয়ন মাইল দূরে নেপচুন ছাড়িয়ে যাওয়ার পর খোদ সূর্যকেই অনেক ম্লান দেখা যায়। পৃথিবী থেকে আমাদের দেখা সূর্যের তুলনা করলে, নক্ষত্রটিকে এক হাজার ভাগ ম্লান দেখা যায়। তাহলে পৃথিবীর কী অবস্থা দাঁড়ায়? এটা সঙ্গে একটা ফুটকির মতো দেখা যায়, এটা কোনো ম্লান নক্ষত্রের চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা থাকে না। কিন্তু তা-ও সূর্যের তীব্রতার মধ্যে হারিয়ে যায়।
আমাদের কাছে একটা প্রমাণ আছে। ১৯৯০ সালে ভয়েজার ১ নভোযান নেপচুনের কক্ষপথ ছাড়িয়ে একটু দূর থেকে পৃথিবীর একটা ছবি তুলেছিল। আমাদের গ্রহটিকে গভীর মহাকাশ থেকে মোটেও মনোমুগ্ধকর কিছু মনে হয়নি। মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ কার্ল সাগান একে বলেছিলেন ‘পেল ব্লু ডট’ বা মলিন নীল বিন্দু আর সেটাই ছিল অনেক বেশি। তুমি যদি ভয়েজার ১-এর পাঠানো ছবিটা একনজর দেখো, তাহলে তুমি হয়তো বুঝতেও পারবে না যে ওখানে পৃথিবী আছে।
তাহলে অনেক অনেক দূর থেকে কোনো মাথামোটা এলিয়েন যদি তাদের সবচেয়ে উন্নত মানের টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ স্ক্যান করে, তাহলে কী হবে? পৃথিবীর কোন দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য তারা শনাক্ত করতে পারবে?
নীলচে বৈশিষ্ট্য। এটিই হবে প্রথম এবং সবার আগে। পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের তিন ভাগের দুই ভাগের বেশি পানি দিয়ে ভরা। শুধু প্রশান্ত মহাসাগর একাই গ্রহটির পুরো একটা দিক জুড়ে রয়েছে। এই এলিয়েনরা কখনো যদি আমাদের গ্রহের রং শনাক্ত করতে পারে, তাহলে তারা হয়তো এটাও অনুমান করতে পারবে যে এই নীলের সবটুকুর উৎস আসলে পানি। তারা হয়তো পানির সঙ্গেও পরিচিত হবে। পানি শুধু জীবনধারণে সহায়তাই করে না, সেই সঙ্গে মহাবিশ্বে এটিই সবচেয়ে প্রাচুর্যময় অণুগুলোর মধ্যে একটি।
এলিয়েনদের কাছে যদি সত্যিই শক্তিশালী যন্ত্রপাতি থাকে, তাহলে তারা শুধু মলিন নীল বিন্দু ছাড়াও আরও কিছু ব্যাপার দেখতে পাবে। তারা দেখতে পাবে মহাসাগরের উপকূলরেখা। এটিই জোরালোভাবে ইঙ্গিত করবে যে এই গ্রহের পানি তরল। কারণ, জমাটবাঁধা পানির গ্রহে কোনো উপকূল থাকে না। আর স্মার্ট এলিয়েনরা নিঃসন্দেহে জানবে, কোনো গ্রহে তরল পানি থাকার মানে হলো, সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও থাকতে পারে।
এই এলিয়েনরা হয়তো পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের আইস ক্যাপও দেখতে পারবে। এগুলো তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ে ও সংকুচিত হয়। ভূপৃষ্ঠ গবেষণা করে ও প্রধান স্থল অংশ কতটা সময় ধরে ঘোরে এবং আবারও দৃষ্টিসীমায় আসে তা শনাক্ত করে তারা হয়তো বুঝতে পারবে, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আবর্তিত হচ্ছে আমাদের গ্রহটি। এভাবে আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য জানতে পারবে তারা। হয়তো আমাদের প্রধান আবহাওয়া চক্রের আসা-যাওয়াও দেখতে পাবে এলিয়েনরা। আমাদের মেঘ নিয়েও তারা গবেষণা করতে পারবে।
এবার বাস্তব অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা যাক।
আমাদের সবচেয়ে কাছের এক্সোপ্লানেট বা বহিঃসৌরগ্রহটিকে পাওয়া যাবে আমাদের প্রতিবেশী নক্ষত্র ব্যবস্থা আলফা সেন্টরিতে। জানিয়ে রাখি, এক্সোপ্লানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ হলো সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণমান একটি গ্রহ। আলফা সেন্টরি অবস্থান আমাদের কাছ থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ একটা আলোকরশ্মি চার বছরে যে দূরত্ব পাড়ি দেয়, সেটাই হলো চার আলোকবর্ষ বা লাইট ইয়ার। আলো কিন্তু এই চলার পথে কোথাও জ্বালানি নেওয়ার জন্য কিংবা বাথরুম করার জন্য থামে না। প্ৰতি ঘণ্টায় আলো প্রায় ৬৭০ মিলিয়ন মাইলের বেশি পথ পাড়ি দেয়। কাজেই চার আলোকবর্ষ দূরের আলফা সেন্টরিতে আমাদের প্রতিবেশীর অবস্থান আসলে অনেক অনেক দূরে।
এরাই আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। বিজ্ঞানীরা যেসব এক্সোপ্লানেট আবিষ্কার করেছেন, সেগুলোর বেশির ভাগ আমাদের কাছ থেকে কয়েক ডজন আলোকবর্ষ দূরে। পৃথিবীর উজ্জ্বলতা
এমনিতেই সূর্যের তুলনায় এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ মাত্ৰ। কাজেই সেখানকার কোনো এলিয়েনের পক্ষে আমাদের গ্রহকে দৃশ্যমান আলোক টেলিস্কোপ দিয়ে সরাসরি দেখতে পাওয়া খুব কঠিন। এটা অনেকটা বিশাল কোনো সার্চলাইটের কাছে একটা জোনাকি পোকা খুঁজে বের করার মতো। সুতরাং কোনো এলিয়েন যদি আমাদের খুঁজে পায়, তার মানে হবে, তারা ইনফ্রারেডের মতো কোনো অদৃশ্য আলো দিয়ে আমাদের খোঁজ করেছিল। দৃশ্যমান আলোতে সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতায় পৃথিবী হারিয়ে গেলেও, ইনফ্রারেডে ওই উজ্জ্বলতায় আমাদের ঝাপসা করে দেয় না। কিংবা এমনও হতে পারে, একেবারেই ভিন্ন কোনো কৌশল অবলম্বন করেছে তাদের ইঞ্জিনিয়াররা।
*
আমি ধারণা করছি, তুমি এর আগে তোমার কোনো বন্ধুর ছবি তোলার সময় ছবিটা নষ্ট করে দিয়েছ। একে বলা হয় ফটোবম্বিং। রুচিসম্মত জ্যোতিঃপদার্থবিদেরাও এ ধরনের প্রচলিত প্রাঙ্ক করার লোভ সামলাতে পারেন না। দূরের গ্রহগুলো খুঁজে পেতে আমরা যে কৌশল ব্যবহার করি, তার সঙ্গে ফটোবম্বিংয়ের কিছু মিল আছে। এলিয়েনরা যেমন অনেক দূরে থেকে পৃথিবীকে দেখার জন্য কষ্ট করে, তেমনি দূরের কোনো গ্রহকে সরাসরি দেখা আমাদের জন্যও অনেক কঠিন কাজ। কাজেই নাসা এমন একধরনের টেলিস্কোপের নকশা করেছে এবং বানিয়েছে, যা অতিক্ষুদ্র গ্রহকে খুঁজে বের করে। কৌশলটা এমন, যেন তারা পার্শ্ববর্তী নক্ষত্রের ওপর ফটোবম্বিং করছে। এই টেলিস্কোপের নাম কেপলার।
কেপলার টেলিস্কোপ এমন সব নক্ষত্র দেখেছে, যাদের মোট উজ্জ্বলতা নিয়মিতভাবে কিছুটা কমে যায়। এসব ক্ষেত্রে কেপলার দেখে যে কোনো নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা কমল কি না। অতি সামান্য হলেও। এর কারণ হতে পারে, তার নিজের গ্রহগুলো সরাসরি ওই মাতৃনক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করছে। অনেকটা তোমার আর তোমার বন্ধুর ছবিতে উড়ে আসা ছোটখাটো কোনো উৎপাতের মতো। এই পদ্ধতিতে তুমি খোদ গ্রহটিকে দেখতে পারবে না। এমনকি নক্ষত্রটির পৃষ্ঠতলের কোনো বৈশিষ্ট্যও তোমার চোখে ধরা পড়বে না। কিন্তু দেখতে পাবে যে সেখানে কিছু একটা আছে। এভাবে কয়েক হাজার এক্সোপ্লানেট আবিষ্কার করেছে কেপলার। এদের মধ্যে কয়েক শ আছে এমন নক্ষত্র ব্যবস্থা, যেখানে আমাদের নিজেদের মতো অনেকগুলো গ্রহ আছে।
পৃথিবী শনাক্ত করতে এই কৌশলটি কাজে লাগাতে পারে এলিয়েনরা। সূর্য পর্যবেক্ষণ করে এর উজ্জ্বলতা কিছুটা কমে যাওয়া শনাক্ত করতে পারবে তারা। কারণ, তখন আমাদের গ্রহটি আমাদের স্থানীয় নক্ষত্র এবং তাদের মধ্যবর্তী স্থানটি অতিক্রম করবে। চমৎকার, তাই না? তারা পৃথিবীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করবে, কিন্তু আমাদের ভূপৃষ্ঠে কী হচ্ছে, সেসব সম্পর্কে তারা কোনো কিছুই জানতে পারবে না।
সে ক্ষেত্রে রেডিও ওয়েভ এবং মাইক্রোওয়েভ হয়তো তাদের সহায়তা করবে। হয়তো আমাদের দিকে আড়ি পাতা ফাস্ট (FAST) টাইপের কোনো টেলিস্কোপ থাকবে এলিয়েনদের কাছে। ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বিশালাকৃতির এই টেলিস্কোপটি চীনে স্থাপন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। তারা যদি সেটি করতে পারে এবং যদি সঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে তা টিউন করতে পারে, তাহলে তাদের কাছে আমরাই আবির্ভূত হব আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল উৎস হিসেবে। আমাদের আধুনিক রেডিও, মোবাইল ফোন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, গ্যারেজ ডোর ওপেনার, কার ডোর আনলকার এবং যোগাযোগ স্যাটেলাইট—সব কটিই সংকেত নিঃসরণ করছে। আমরা দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে জ্বলজ্বল করছি। তাই ওই এলিয়েনরা যদি সঠিক টেলিস্কোপ আর ডিটেক্টর ব্যবহার করে, তাহলে তাদের কাছে অসাধারণ প্রমাণ মিলবে যে এখানে কোনো অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে। পৃথিবীকে দেখতে বেশ মজার পার্টির মতো মনে হবে।
*
রহস্যময় রেডিও সিগন্যালে একবার বিভ্রান্ত হয়েছিলেন আমাদের বিজ্ঞানীরাও। সেবার তাঁরা বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন, এলিয়েনরা সম্ভবত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। আকাশে শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গের কোনো উৎস পাওয়া যায় কি না, তার খোঁজ চলছিল ১৯৬৭ সালে। তখন চরম অস্বাভাবিক কিছু একটা আবিষ্কার করে বসলেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ অ্যান্টোনি হিউয়িশ এবং তাঁর দল। অনেক দূরের কোনো একটা বস্তু প্রতি সেকেন্ডের কিছুটা বেশি সময় পরপর নির্দিষ্টভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল। সেটা প্রথম খেয়াল করেন হিউয়িশের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী জোসেলিন বেল।
কে পুরস্কার পেল?
পালসার আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা কৃতিত্ব দেন জোসেলিন বেলকে (তিনি এখন জোসেলিন বেল ব্রুনেল)। কিন্তু সে জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁর বস অ্যান্টোনি হিউয়িশকে। ১৯৭৭ সালে বেল ব্রুনেল জোরালোভাবে জানান, এই অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণের জন্য তিনি হতাশ হন। কিন্তু অন্য অনেকে বলেন, তিনি যদি মেয়ে না হতেন, তাহলে পুরস্কারটা পেতেন। পালসার আবিষ্কারে তাঁর অবদান ও চলমান অন্যান্য গবেষণার কারণে বেল ব্রুনেল আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। পাশাপাশি বিজ্ঞানে নারীদের বড় সমর্থক তিনি।
এ থেকে মনে করা হলো, এই সিগন্যাল আসছে অন্য কোনো সভ্যতা থেকে। এভাবে গোটা মহাকাশে তাদের কার্যকলাপের প্রমাণ পাঠাচ্ছে তারা। নিশ্চয়ই কোনো এলিয়েন। যার রেডিওভিত্তিক সংস্করণ ‘হেই, আমরা এখানে!’ অবশ্য বেলের জন্য এ ভাবনাকে অনিবার্য বলা চলে। এতে বেশ হতাশা বোধ করলেন বেল। সে সময় তিনি গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এসব লিটল গ্রিন মেন এবং তাঁদের সিগন্যাল বেশ ঝামেলা পাকাচ্ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে বেল আবিষ্কার করলেন, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্যান্য জায়গা থেকেও এ রকম পুনরাবৃত্ত সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। বেল এবং অন্য বিজ্ঞানীরা এবার বুঝতে পারলেন, তাঁরা কোনো এলিয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেননি, বরং আসলে নতুন ধরনের একটা মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার করেছেন। অর্থাৎ পুরোপুরি নিউট্রন দিয়ে তৈরি একটা নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। নক্ষত্রটা প্রতিটি ঘূর্ণনের সময় একটা রেডিও ওয়েভের স্পন্দন দেয়। (চ্যাপস্টিকের টিউবের ভেতর এক শ মিলিয়ন হাতি ঢোকালে যেমন ঘনত্ব হয়, নক্ষত্রটাও সে রকম ঘনত্বের বস্তু।) হিউয়িশ এবং বেল যুক্তিসংগতভাবে এর নাম দিলেন পালসার। ফলে বেলের ঝুলিতে শুধু গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিই নয়, সঙ্গে পেলেন বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কৃতিত্বও।
*
এলিয়েনদের ব্যাপারে নাক গলানোর কিংবা আমাদের ওপর কোনো উন্নত ভিনগ্রহবাসীদের আরও নজরদারির অন্য উপায়ও আছে। ভিনগ্রহবাসীরা আমাদের গ্রহের আলো পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারে, পৃথিবী এবং তার চারপাশে কোন ধরনের অণু আছে। কোনো গ্রহে যদি উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকে, তাহলে তার বায়ুমণ্ডল একটা দিক দিয়ে বেশ সমৃদ্ধ হবে। একে আমরা বলি বায়োমার্কার। ম্যাজিক মার্কারের সঙ্গে আবার বিষয়টাকে গুলিয়ে ফেলো না। যা-ই হোক, এই অণুগুলো অনেকটা ব্লুর মতো কাজ করবে। কোনো গ্রহের বায়োমার্কার থাকার মানে হলো, বিজ্ঞানীরা জানেন সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। আশপাশে প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে এসব অণু সমৃদ্ধ হয়।
পৃথিবীতে মিথেন এ রকম একটি বায়োমার্কার। প্রাকৃতিক উৎস যেমন গাছপালা পচে মিথেন তৈরি হয়। বাকি অংশ তৈরি হয় মানুষের কার্যকলাপের কারণে। যেমন জ্বালানি তেল উৎপাদন, ধান চাষ, নর্দমা ব্যবস্থা ও গবাদিপশুর ঢেকুর ও বায়ুনির্গমন।
হ্যাঁ, গরুর বায়ুনির্গমনের কারণে এলিয়েনরা কোনো একদিন হয়তো আমাদের খুঁজে পাবে। অবশ্য আমাদের এলিয়েনদের জন্য সবচেয়ে ভালো চিহ্ন হতে পারে, বায়ুমণ্ডলে ভাসমান মুক্ত অক্সিজেন। মহাবিশ্বের তৃতীয় প্রাচুর্যময় মৌল হলো অক্সিজেন। এটি রাসায়নিকভাবেও সক্রিয়। মাধ্যমিক স্কুলের নাচের আসরে যে বাচ্চাটি যে কারও সঙ্গে নাচ শুরু করে দেয়, তার পারমাণবিক সংস্করণ হলো অক্সিজেন। হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, সিলিকনসহ আরও অনেক পরমাণুর সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে পারে অক্সিজেন। আবার নিজের সঙ্গেও বন্ধন তৈরি করতে পারে এরা। এই অণুটি নিঃসঙ্গ ও মুক্ত থাকতে একদম পছন্দ করে না।
কাজেই এলিয়েনরা যদি অক্সিজেনকে মুক্তভাবে ভাসমান অবস্থায় দেখে, তাহলে তারা হয়তো অনুমান করবে, কোনো কিছু এদের মুক্ত করে দিচ্ছে। এখানে পৃথিবীতে আমরা জানি, সে জন্য জীবসত্তা দায়ী। গাছপালা যে প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোকে জ্বালানি হিসেবে মঙ্গল গ্রহে সামান্য পরিমাণ মিথেন আছে। অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণ মিথেন আছে শনির চাঁদ টাইটানে। এই মিথেনের উৎস কী, তা নিয়ে এখন তর্কে মেতেছেন বিজ্ঞানীরা। এই মিথেন কোথা থেকে এসেছে? সেটার উৎস নিশ্চয়ই কোনো মহাজাগতিক গরু নয়। টাইটানে এমন একটা নদী আছে, যেখানে মিথেন প্রবাহিত হচ্ছে। গোটা হ্রদটাই এই বায়োমার্কারে ভরা।
টাইটানে কি গরু আছে?
রূপান্তর করে, তাকে বলা হয় ফটোসিনথেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ। এই প্রক্রিয়ায় সাগর-মহাসাগর এবং বায়ুমণ্ডলে মুক্ত অক্সিজেন তৈরি হয়। বাতাসের এই মুক্ত অক্সিজেনই মানুষ এবং আক্ষরিক অর্থে প্রাণিজগতের প্রতিটি জীবজন্তুকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
আমরা পার্থিব মানুষ এরই মধ্যে জেনে গেছি, অক্সিজেন ও অন্যান্য বায়োমার্কার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এলিয়েনদের এই সবকিছুর কারণ নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তারা যদি সিদ্ধান্তে আসে যে এসব ব্লু আসলে জীবসত্তার অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ, তাহলে তারা হয়তো ভাবতে বসবে, ওই প্রাণীরা বুদ্ধিমান কি না। মাঝেমধ্যে আমি নিজেকেও এই প্রশ্ন করি।
কিন্তু সত্যিই কি বাইরে কোথাও কোনো এলিয়েন আছে? তারাও কি গোটা মহাবিশ্ব তন্ন তন্ন করে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে? প্ৰথম এক্সোপ্লানেট আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। আর এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন সেই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজারে। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন, শুধু আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই পৃথিবীর সমান আকৃতির গ্রহের সংখ্যা প্রায় চার বিলিয়ন। বাইরের কোথাও থেকে কেউ বা কোনো কিছু হয়তো আমাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।