সঙ্গীতের এক রজনী
যেমন ঘটে থাকে, আমার এক বন্ধু রয়েছে, যিনি মাঝে মাঝেই ইঙ্গিত দেন সীমাহীন নিদ্রা থেকে তুলে, তিনি আত্মা সকল আহ্বান করতে পারেন। অন্ততপক্ষে একটি আত্মা। এক ক্ষুদ্র আত্মা যার শক্তি সীমিত। তিনি মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, অবশ্য তখনই, যখন স্কচ ও সোডার চতুর্থগ্লাসে পৌঁছান। এটি একটি স্পর্শকাতর সমতা রক্ষার বিষয়। তিনগ্লাস ও তিনি, আত্মা (অতি প্রাকৃত প্রকারে) সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পাঁচ গ্লাস ও তিনি নিদ্রায় ঢলে পড়েন।
আমার মনে হয়েছিল, সে সন্ধ্যায় তিনি সঠিকমাত্রায় পৌঁছেছিলেন, সে জন্য বললাম, ‘আপনার সেই আত্মাকে মনে পড়ে?’
পানীয়ের দিকে তাকিয়ে জর্জ বলেন, ‘হ্যাঁ,’ যেন, কেন মনে করা দরকার, সে সম্পর্কে তিনি বিস্মিত।
‘না, আপনার পানীয়ের কথা বলছি না,’ আমি বললাম, ‘সেই যে দুই সে.মি. লম্বা ছোট্ট আত্মা, যার সম্বন্ধে বলেছিলেন, অন্য কোনো অস্তিত্ব থেকে তাকে আহ্বান করে এনেছেন। এমন একজন, যার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে।
‘আ:’ জর্জ বললেন, ‘আজাজেল্।’ অবশ্য এটা তার নাম নয়। তার প্রকৃত নাম উচ্চারণ করতে পারলাম না। আমার ধারণা, তাকে আমি এই নামেই ডাকি, এই নামেই মনে রাখি।’
‘তাকে কি আপনি খুব বেশি ব্যবহার করেন?’
‘না, বিপজ্জনক। অত্যন্ত বিপজ্জনক। সব সময়ে শক্তির মোকাবিলা করতে সাধ যায় ঠিক। কিন্তু আমি নিজে সতর্ক, ভুলেও অসতর্ক হই না। আপনি জানেন, আমার নীতিবোধের মাত্রা উচ্চস্তরের। সে জন্য একবার এক বন্ধুকে সাহায্য করতে, তাকে আহ্বান করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম।
‘কি ঘটেছিল?’
‘বোধকরি আমার বুক হাল্কা করার প্রয়োজন পড়েছে।’ চিন্তিতভাবে জর্জ বললেন, ‘না বলতে পেরে চিত্ত কলুষিত হতে শুরু করেছে- আমার বয়স তখন অনেকটাই কম, আর সেই সময়ে, নারী মানেই পুরুষের জীবনে এক বিশেষ ভূমিকা। এখন ভাবলে মুর্খামি মনে হয়, কিন্তু পিছু ফিরে তাকালে, আমি পরিষ্কার মনে করতে পারি, সে সময়ে বিশেষ একটি নারী পৃথক অর্থ নিয়ে প্রতিভাত হতো।
আসলে সব মেয়েই হয়তো মোটামুটি এক ধাতুতে গড়া, তবু সেই সব দিনগুলোতে, আমার এক বন্ধু ছিল মর্টেনসন, অ্যান্ড্রু মর্টেনসন। আমার মনে হয় না আপনি তাকে চিনবেন। গত কয়েক বছরে আমিও তাকে দেখিনি বিশেষ।
কথা হচ্ছে, সে বিশেষ একটি নারী সম্পর্কে আপ্লুত ছিল। তার চোখে মেয়েটি ছিল দেবদূতী। সে তাকে ছাড়া বাঁচবে না। এই ধরায় একমাত্র, অদ্বিতীয়া এবং সুস্বাদু খাদ্য চরকার তেলে ডোবালে যে অবস্থা হয়, মেয়েটি বিহনে তার জীবনেরও তদনুরূপ পরিণতি ঘটবে। আপনি জানেন, এভাবেই প্রেমিকেরা মনের ভাব ব্যক্ত করে থাকে।
মুশকিল হল, মেয়েটি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, ত র আত্মাভিমানকে এতটুকু মর্যাদা না দিয়ে। মেয়েটি তাকে ঘোরতর অপমান করল তার নাকের ডগা দিয়ে, চোখের সামনে দিয়ে অন্য একজনের হাত ধরে চলে গেল। মর্টেনসনের চোখের জলের পরোয়া করল না সে।
আক্ষরিক অর্থে এভাবেই ঠিক বলতে চাইছি না, মর্টেনসন আমাকে যেমন ধারণা দিয়েছিল,’ আমি সেটাই উপস্থাপন করতে চাইছি। এই ঘরেই সে আমার সঙ্গে পান শুরু করেছিল। বন্ধুর জন্য আমার তখন বুকে রক্তক্ষরণ, বললাম, ‘দুঃখিত মর্টেনসন। তুমি এভাবে ভেঙো না। যখন তুমি মেয়েটি সম্পর্কে ভাবনা বন্ধ করে দেবে, দেখবে সে সাধারণ একটি মেয়ে মাত্র। পথের দিকে তাকাও সারে সারে মেয়ে চলেছে।’
সে তিক্ত স্বরে বলল, ‘এখন তো আমি চাই রমণীবিহীন অস্তিত্ব। অবশ্যই আমার স্ত্রী ব্যতীত, যাকে আমি যখনতখন, কখনোই এড়িয়ে যেতে পারি না। শুধুমাত্র প্রতিদানে যদি মেয়েটির জন্য কিছু করতে পারতাম।’
বললাম, ‘তোমার স্ত্রীর প্রতি?’
‘না-না, আমি কেন স্ত্রীর প্রতি কিছু করতে চাইব? আমি সেই নারীর কথা বল’ ই, যে আমাকে নির্দয়ভাবে ছুঁড়ে ফেলেছে।’
‘কার মতন?’
‘চুলোয় যাক… যদি নিজেই জানতাম!’ সে বলল।
‘হয়তো, আমি তোমার সাহায্যে আসতেও পারি,’ আমি বললাম, কারণ তখনে। আমার অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। ‘আমি এক আত্মাকে ব্যবহার করতে পারি, যার অলৌকিক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে, যদিও ক্ষুদ্র আত্মা।’ আমি একটা আঙুল আর বুড়ো আঙুল দিয়ে ইঞ্চিখানেক মাপ দেখালাম যাতে তার নিশ্চিত ধারণা জন্মায়। বললাম, ‘সেই কিন্তু কিছু করতে পারবে’
আমি তাকে আজাজেলের কথা বললাম, ও বিশ্বাস করল। আমি প্রায়ই লক্ষ্য করেছি, আমি যখন কোনো গল্প বলি, শ্রোতার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায়। কিন্তু মশাই, আপনি যখন গল্প বলেন, ঘরে যে অবিশ্বাসের বাতাস নামে, তা এতই পুরু, যে কঠিন করাত দিয়ে কাটতে হবে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা নয়। নৈতিক দৃঢ়তার এবং এক ঝলক সততা ও স্বচ্ছতার কাছে কিছুই লাগে না।
যখন আমি বললাম, মর্টেনসনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, ‘সে যদি মেয়েটিকে কিছু দিতে চায়, তার বন্দোবস্ত করতে আমার সাহায্য পাওয়া কি সম্ভব?’
‘যদি সত্যিই উপহারযোগ্য কিছু হয় মশাই। আশা করি, মেয়েটির শ্বাসে দুর্গন্ধ আনা অথবা কথা বলার সময় ব্যাঙ বেরিয়ে আসার মতন কোনো কিছু করার কথা আপনি মনে আছেন না।
‘নিশ্চয় নয়,’ সে ফুঁসে উঠল।
‘আপনি আমাকে কী মনে করেন! যতই হোক ও আমাকে দুটি সুখী বছর উপহার দিয়েছিল। আমি তার উপযুক্ত প্রতিদান দিতে ইচ্ছা করি। আপনি বলেন, আপনার আত্মার শক্তি সীমিত।’
‘সে এই একরত্তি।’ আমি বলি, আমার তর্জনী আর মধ্যমা ফাঁক করে দেখাই। ‘ওই আত্মা মেয়েটিকে সর্বোৎকৃষ্ট কণ্ঠস্বর দিতে পারে? কোনো একটু সময়ের জন্য! অন্ততপক্ষে একটি অনুষ্ঠানে গাইতে।’
‘আমি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখব।’
মর্টেনসনের প্রস্তাব সজ্জনসুলভ বলেই মনে হল (তার পূর্ব প্রণয়িনী স্থানীয় গীর্জায় গান গাইতো), এটিই যদি যথার্থ চুক্তি হয়। সে সব দিনে, সত্যিই আমার সুরের কান ছিল, আর প্রায়ই ঐ সব জায়গায় যেতাম (অবশ্যই কালেকশন বক্স থেকে দূরে থেকে)। আমি বরং তার গান উপভোগ করতাম এবং মনে হতো শ্রোতাগণ বিনয় সহকারে গ্রহণ করছে। সে সময়ে মনে হতো, মেয়েটির নীতিবোধ পরিপার্শ্বের সঙ্গে মানাচ্ছে না। কিন্তু মর্টেনসন বলত, সঙ্গীত পরিবেশনে মেয়েটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অতএব আমি আজাজেলের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সাহায্য করতে সে সর্বতোভাবে উৎসুক ছিল। আপনি জানেন, কেউই বিনিময়ে আমার আত্মা দাবি করল না। আমার মনে পড়ে, একবার আজাজেল্কে বলেও ছিলাম, যদি সে আমার আত্মা চায়। সে জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা আমার কি? সেটা যে কী তাতো আমি নিজেও জানতাম না। শুধু বলা যায়, এই আত্মা তার নিজের জগৎ থেকে আমাদের জগতে তার প্রভাব ছড়িয়ে বিরাট সাফল্য অর্জন করতে চাইছিল। তার ইচ্ছা, সে সহায় হবে।
ওই আত্মার বক্তব্য, সাফল্যের সঙ্গে সে তিন ঘণ্টা পার করে দেবে, আর মর্টেনসনকে সে সংবাদটা দিতে, সে বলল, ‘চমৎকার।’
আমরা একটা রাত বেছে নিলাম, যে রাতে মেয়েটি বাক্ বা হ্যান্ডেলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অথবা পিয়ানোর কোনো প্রাচীন ধূন গাইতে চলেছে এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী একক সঙ্গীত পরিবেশনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে।
সে রাতে, মর্টেনসন গীর্জায় গেল এবং অবশ্যই আমিও। যা ঘটতে চলেছে, তার জন্য নিজেকেই দায়ী ভাবছিলাম এবং মনে করলাম, পরিস্থিতির তত্ত্বাবধান আমার করাই মঙ্গল।
বিষাদগ্রস্ত মর্টেনসন বলল, ‘আমি মহড়ায় গিয়েছিলাম, ও তো যেমন গায় তেমনই গাইছিল। জানেন মনে হচ্ছিল সে এক লেজবিশিষ্ট এবং কেউ তার লেজ মাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক এইভাবে অবশ্য মর্টেনসন মেয়েটির কন্ঠস্বর বাখ্যা করেনি। অবশ্য যদিও তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে পুরুষ বুদ্ধিভ্রষ্ট হতে পারে।
আমি তার দিকে নিন্দার দৃষ্টি হানলাম। ‘একজন মহিলা সম্পর্কে এমন উক্তি করো না। বিশেষ করে তাকে যখন মহান দান দিতে চলেছ।’
‘ঠিক তাই! আমি চাই তার কণ্ঠস্বর হোক নিখাদ। সম্পূর্ণ শুদ্ধ। এখন আমার চোখ থেকে ভালবাসার কুয়াশা উঠে গেছে, আমি দেখছি, ওকে অনেক দূরে যেতে হবে এখনো। তোমার কি মনে হয়, ওই আত্মা এটা করে উঠতে পারবে?’
‘কিন্তু রাত ৮-১৫ মিনিটের আগে পরিবর্তন আসবে না।, একটা সন্দেহের ছুরি আমাকে আঘাত করল, ‘তুমি তো এমন চাইছ না, যে শুধু মহড়ার সময় তার কণ্ঠস্বর পরম শুদ্ধ হোক আর মূল অনুষ্ঠানের সময় শ্রোতারা হতাশ হোক! ‘
‘তুমি আমাকে ভুল ভাবছ,’ সে প্রতিবাদ করল।
যাই হোক, অনুষ্ঠান শুরু হল এক মিনিট আগে। শুক্লবসনা মেয়েটি গান গাইতে উঠল, ঠিক রাত ৮-১৫ মিনিটে। আমার পকেট ঘড়ি দুমিনিটের বেশি এদিক ওদিক করে না।
মেয়েটি ছোটখাটো গায়িকা ছিল না। সুরের মাত্রায় মাধুর্য ছিল, অনুরণনের বিস্তার ছিল, উচ্চগ্রামে পৌঁছলে অর্কেস্ট্রার সুরকে ছাপিয়ে যেতে পারত। যখন সে গানের সঙ্গে তাল রাখতে, প্রশ্বাস নিতে কয়েক গ্যালন বাতাস গ্রহণ করত, তখন আমি বুঝতে পারতাম মর্টেনসন তার মধ্যে দেখেছিল এক পোশাকসর্বস্ব নারীকে।
ও তার চিরাচরিত স্বরগ্রামে গান শুরু করল এবং ঠিক ৮-১৫ মিনিটে মনে হলো আরেকটি কণ্ঠ যোগ দিয়েছে আমি যেন দেখলাম, মেয়েটি ছোট্ট একটি লাফ দিল। যেন কী শুনছে, নিজেই বুঝতে পারল না। যে হাতে মাইক ধরা ছিল, হাতটি কেঁপে উঠল। ওর কণ্ঠস্বর এত উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে, যেন সে নিজেই একটা অর্গান, যা পরম শুদ্ধ সুর লয় তালে বেজে চলেছে। প্রতিটি অনুনাদ যথাযথ। সেই মুহূর্তে যেন অনন্য কোনো নবীন সুরের মূর্ছনা জন্ম নিল আর একই তালে লয়ে। একই গুণ মানের বাকি সুর মূর্ছনা সকল যেন মূল সুর মুর্ছনার অশুদ্ধ প্রতিফলন। প্রতিটি নাদ যথাযথ স্পন্দনে সুর সুধার অনুরণন। কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা স্পন্দিত হচ্ছে বলিষ্ঠ কুশলী নিয়ন্ত্রণে।
প্রতিটি নাদে ওর সুরেলা কণ্ঠ উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর হয়ে চলেছে। অর্গান বাজিয়ের আর বাজনার দিকে মন নেই। সে শুধু ওরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শপথ করে বলতে পারব না, তবে মনে হয় সে বাজনা থামিয়ে দিল। যদি সে বাজিয়ে চলতও, তবু তার বাজনা আমি শুনতে পেতাম না। যখন ও গাইছিল, আপনার অন্য কিছু শোনার উপায়ই ছিল না। কিচ্ছু না, শুধু ওর গান ছাড়া। ততক্ষণে ওর নিজের মুখ থেকেও বিস্ময়ের ছাপ অন্তর্হিত, নয়নে ঘনিয়েছে মহিমময় দৃষ্টি। তার গানের সঙ্গে আর বাজনার প্রয়োজন পড়ছে না। কণ্ঠে সুর খেলছে আপনিই, কোনো নির্দেশ বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। সঞ্চালক স্থাণুবৎ আর সমবেত সঙ্গীত গাইয়ের দল একদম মূক।
একক সঙ্গীত সমাপ্ত হল। সমবেত সঙ্গীত তখন সকলের কানে যেন ফিসফিসানি। গানের দল, তাদের কণ্ঠস্বরের জন্য লজ্জিত হয়ে পড়েছে। একই রাতে একই গীর্জায়, গীত পরিবেশনে তারা বিব্রত।
পরবর্তী সমগ্র অনুষ্ঠানই ছিল ওর। সে যখন গাইছিল, তখন শুধু তার কন্ঠস্বরই শ্রবণগ্রাহ্য ছিল। অন্য সব কণ্ঠস্বর পুরোপুরি নিস্তব্ধ। সে যখন গাইছিল না, শ্রোতাদের মনে হচ্ছিল তারা সবাই অন্ধকারে ডুবে রয়েছে, আলোর অভাব তখন অসহ্য লাগছিল।
আর যখন অনুষ্ঠান একেবারে শেষ হল, আপনি কি জানেন, গীর্জায় করতালি দেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু করতালি পড়তে লাগল। গীর্জায় উপস্থিত প্রত্যেকে এক সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, যেন তাদের পা পুতুলনাচের দড়ি দিয়ে এক সঙ্গে বাঁধা। তারপর করতালির পর করতালি। স্পষ্ট বোঝা গেল শ্রোতারা সারারাত করতালি দেবে, যতক্ষণ না মেয়েটি আবার গাইছে।
ও আবার শুরু করল, একক কণ্ঠস্বরে, আবহসঙ্গীত তখন দ্বিধাগ্রস্ত মেজাজের মৃদু সুরে বাজছে। ওর ওপর জোর স্পট লাইটের আলো পড়ছে। সমবেত গাইয়ের দলকে দেখাই গেল না। কোনো প্রয়াসের প্রয়োজন হচ্ছিল না ওর।
আপনি ধারণা করতে পারবেন না, কোনো চেষ্টা ছাড়াই কি সাবলীল ছিল সেই সঙ্গীত। আমি নিজের কানে মোচড় দিলাম, ওই স্বর ছাপিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা। আশ্চর্য হলাম, এক নাদে উচ্চগ্রামে সুর ধরে রাখতে, তার দুজোড়া ফুসফুস কী কসরতে বাতাসের যোগান দিতে পারছে। কিন্তু তাকে থামতেই হল। এমন কি করতালিও থামল। আর তখনই খেয়াল করলাম, মর্টেনসন চকচকে চোখে বসে রয়েছে তার সমস্ত স্বত্তা দিয়ে সঙ্গীতে মগ্ন হয়ে। তখনই উপলব্ধি করলাম, কী ঘটে গেছে!
আমি তো সত্যি বলতে গেলে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সরলরেখা মাত্র। কোনো রকম বক্র তঞ্চকতা আমার মধ্যে ছিল না। তাই আমি বুঝতেই পারিনি মর্টেনসনের মতলব কী ছিল!
মেয়েটি পরম শুদ্ধ স্বরে গেয়েছে, কিন্তু আর কখনো সে এমনটি পারবে না। যেন মেয়েটি জন্মান্ধ ছিল, তিন ঘণ্টার জন্য তার চোখে আলো এল। চারপাশের বস্তু, বর্ণ, আকার, আশ্চর্য সব কিছু ঘিরে আছে আমাদের। এসব দেখতে আমরা অভ্যস্ত, দেখতে যে পাচ্ছি সে সম্পর্কে সচেতন নই। কিন্তু আপনি মনে করুন, আপনি পূর্ণ গৌরবে সব কিছু দর্শন করলেন মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য, তারপর আবার অন্ধ হয়ে গেলেন।
আপনি অন্ধত্ব সহ্য করতে পারতেন, যদি কখনো দেখতে না পেতেন। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সময়ে জ্ঞান লাভ করে, আবার অজ্ঞানে ফেরা? কেউ পারে নাকি?
ঐ নারী অবশ্যই আর কখনোই গায়নি। কিন্তু এটি গল্পের একটি অংশ মাত্র প্রকৃত বিয়োগান্ত নাটক ছিল আমাদের জন্য, সব শ্রোতাদের জন্য। আমরা তিন ঘণ্টা ব্যাপী প্রকৃত সঙ্গীতের মাধুর্য উপভোগ করেছি। আপনি কি মনে করেন, ঐ অনন্য সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো গান শোনা আমাদের সহ্য হবে!
আমি তখন থেকে সুরবধির। হালে একটা রক সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ইদানীং তা এত জনপ্রিয়, শুধুমাত্র নিজেকে পরীক্ষা করতে। বিশ্বাস করবেন না, একটি সুরও কানে লাগল না। সব কিছুই হট্টগোল।
আমার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল মর্টেনসন। সে অতি উৎসাহভরে, শ্রেষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে, কিন্তু শ্রোতা সকলের মধ্যে নিকৃষ্টতম। কারণ সে সবসময় কানে ইয়ারপ্লাগ পরে থাকে। চুপি চুপির ঊর্ধ্বে, উচ্চগ্রামের শব্দ সে সহ্য করতে পারে না।
উচিত শিক্ষা হয়েছে তার।