শুধুই নীতির খাতিরে

শুধুই নীতির খাতিরে

জর্জ নিরানন্দভাবে তার গ্লাসের দিকে চাইল, তাতে ছিল আমার পানীয় (এই ভেবে যে, আমিই নিশ্চয়ই তার দাম দেব) আর বলল, ‘শুধু নীতির খাতিরে, আমি আজ দরিদ্র।’

তারপর নাড়ী থেকে টেনে এনে, এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, আর বলল, ‘নীতির বা Principle এর উল্লেখে অবশ্যই আমি ক্ষমা চাইব, প্রিন্সিপ্‌ল শব্দ ব্যবহার করার জন্য, কারণ আমার ধারণা শব্দটা সম্বন্ধে তোমার সচেতনতা নেই, তুমি যখন প্রায় স্নাতক হতে চলেছিলে, তখন অধ্যক্ষ বা ‘Principal’ শব্দটির সঙ্গে হয়তো পরিচিত আছ।

আসল কথা হল, আমি হলাম নীতিবোধের মানুষ।’

‘সত্যি! আমি বলি, ‘আমি তো ভাবলাম, দু মিনিট আগে আজাজেল্ তোমাকে এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। কারণ এর আগে কারোর সামনেই একথা প্রকাশ করনি।’ জর্জ আমার দিকে কঠোর দৃষ্টি হাল।

আজাজেল্ হচ্ছে দুই সে.মি. লম্বা জিন। যার অত্যাশ্চর্য যাদু শক্তি রয়েছে এবং যাকে জর্জই ইচ্ছামতন আবির্ভূত হওয়ার মিনতি জানাতে পারে। সে বলল, ‘আমি কল্পনাও করতে পারি না, কোথা থেকে তুমি আজাজেলের কথা শুনেছ!’

‘এটা আমার কাছেও সম্পূর্ণ রহস্য।’ আমি সায় দিই ‘কিংবা হতে পারত, যদি না ইদানীং তোমার সমস্ত কথাবার্তার বিষয়বস্তু সেইই না হত!’

‘হাস্যাস্পদ হয়ো না’ জর্জ বলল, ‘আমি কখনো তার উল্লেখ করিনি।’

.

গটলিয়েব জোন্‌স (জর্জ বলল) ছিল এক নীতিবোধের মানুষ। তুমি ভাবতে পার, তা একেবারেই অসম্ভব। কারণ তার চাকরি ছিল এক বিজ্ঞাপন কোম্পানির লিপিকারের। কিন্তু আদতে, সে যে আবেগের সঙ্গে সামান্যতার ঊর্ধ্বে উঠে, উৎকৃষ্টতায় পৌঁছেছিল, তা সত্যিই আকর্ষণীয়। হ্যাম বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর আস্বাদ গ্রহণ করতে করতে, বহুবার সে আমায় বলেছে, ‘জর্জ, কথায় বলা যাবে না। যে ভয়াবহ চাকরি আমি করি, সে বিষয়ে যে হতাশা আমাকে ভরে থাকে, এই চিন্তায় যে আমাকে জিনিসপত্র বিক্রির একটা বিশ্বাসযোগ্য পন্থা খুঁজে বার করতেই হবে, কেননা প্রতিটি প্রবৃত্তি বলে, ওগুলো ছাড়াই মানুষ ভাল থাকে। মাত্র গতকাল আমাকে একটি নতুন পতঙ্গ উৎপীড়ক বিক্রি করতে হয়েছিল, যার যাচাইয়ে দেখা গিয়েছিল, সেটি কয়েক মাইল দূর থেকে অতিশাব্দিক উল্লাসের গুনগুনানিসহ মশাদের ঐখানেই জড় হতে আকৃষ্ট করছে। তার স্লোগান হচ্ছে, মশা তাড়াও, Skeeter – Hete নাও।

‘Skeeter-Hete?’ আমি আবার বললাম, জোরসে কেঁপে উঠে।

গলিয়েব এক হাতে তার চোখ ঢাকল। আমি নিশ্চিত, সে দুটো চোখই ঢাকত যদি না তাকে অন্য হাতে মুখের ভেতর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চালান করতে হত।

‘আমাকে লজ্জার সঙ্গে বাঁচতে হয় জর্জ, একদিন না একদিন, আমাকে চাকরি ছাড়তেই হবে। ব্যক্তিগত নীতিবোধ অথবা ব্যবসায়ের নীতিশাস্ত্র ও সর্বোপরি লেখার আদর্শের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এবং আমি একজন নীতিপরায়ণ মানুষ।’

আমি সৌজন্য সহকারে বললাম, ‘চাকরি থেকে তোমার বছরে পঞ্চাশ হাজার আসছে গটিলিয়েব আর তোমাকে সুন্দরী যুবতী স্ত্রী ও একটি শিশুর ভরণপোষণ করতে হয়।’

‘অর্থ!’ গটিলিয়েব উগ্র হয়ে উঠল, হচ্ছে আবর্জনা এটা। একটা যাচ্ছেতাই উৎকোচ যার জন্য মানুষ তার আত্মাকে বিক্রি করে বসে। আমি একে বর্জন করি জর্জ। আমি ঘৃণার সঙ্গে একে সরিয়ে দিতে চাই। আমার টাকা নিয়ে কিছুই করবার নেই।

‘কিন্তু গটলিয়েব, তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে না। তুমি তোমার বেতন নাও তো গটিলিয়েব। নাও না কি!’

স্বীকার করতেই হবে, এক মুহূর্ত কপর্দকহীন গটিলিয়েবের কথা চিন্তা করতে মনে এল, দিনের পর দিন আমাদের দুজনের লাঞ্চের ব্যবস্থা করা, তখন তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে।

‘বেশ, আমি বেতন নিই। আমার প্রিয় পত্নী মেরিলিনের গার্হস্থ্য খরচাপাতি সংক্রান্ত বক্তব্য পেশের ভঙ্গী অস্থির ও উত্তেজক। অন্যথায় যুক্তিযুক্ত। নানাবিধ পোশাক-আশাক ও গৃহস্থালি জিনিসপত্রে সে যে নির্বোধের মতন অযথা অপব্যয় করে, তাতে কিছু বলা চলে না। এতে আমার কর্মপরিকল্পনার ওপর প্রভাব পড়ে, সর্বদা রাশ টানতে হয়। আর ছোট্ট গটলিয়েব জুনিয়র, যার বয়স প্রায় ছয় মাস, সে এখনো টাকার অসীম তুচ্ছতা বুঝতে পারার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। তবু আমি প্ৰায় বিচার করেই বলব, এখনো পর্যন্ত সে আমার কাছে কিছু চায়নি।’

সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, আমিও তার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি প্রায়ই শুনি, যেখানে অর্থ জড়িয়ে থাকে, সেখানে স্ত্রী-সন্তানরা অসহযোগী প্রকৃতির হয়ে ওঠে। আর অবশ্যই এটাই প্রধান কারণ। যার জন্য আমি সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হইনি, দীর্ঘ জীবনে আমার অবর্ণনীয় সৌন্দর্য বিস্তর সুন্দরীদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছে। কারো ক্ষতি না করে, আমি মনোরম স্মৃতিচারণে নিজেকে খুশি করছিলাম, গটলিয়েব মাঝপথে বাধা দিল, ‘জর্জ, আপনি কি জানেন, আমার গোপন স্বপ্ন কি?’

আর মুহূর্তের জন্য তার চোখে এমন লোভী আভা চকচক করে উঠল, যে, আমি অল্প চমকে উঠলাম, মনে হল, সে কোনোভাবে আমার মন পড়ে ফেলেছে।

যাই হোক, সে আবারও বলল, ‘আমার স্বপ্ন হচ্ছে ঔপন্যাসিক হওয়ার, মানবাত্মার আবেগকম্পিত অন্তস্তলের মর্মভেদী কাহিনী লিখতে। যা তুলে ধরবে মানবতার সামনে, তৎক্ষণাৎ কাঁপিয়ে দেবে, আনন্দোচ্ছ্বাসে প্লাবিত করে দেবে মনুষ্য প্রকৃতির গৌরবময় জটিলতা। ক্লাসিক সাহিত্যে আমার নাম লেখা হবে অবিনশ্বর অক্ষরে। অ্যাসকাইলাস, সেক্সপিয়র, ইল্লিসন- এদের সাথে একই গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকবে যুগ যুগ ধরে।’

খাওয়া শেষ হলো। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে বিলের জন্য অপেক্ষা করছি। একটা উপযুক্ত মুহূর্ত খুঁজতে। যাতে ঠিক সময়ে আমি আমার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি। পেশার অঙ্গ হিসেবে, এই সব ব্যাপারে যথেষ্ট পোক্ত বেয়ারা ঠিক ওজন বুঝে গটলিয়েবকে বিল ধরিয়ে দিল।

বাঁচা গেল! বললাম, ‘ভেবে দেখ বাবা গটলিয়েব, ভয়াবহ পরিণামের কথা, যা ঘটতেই পারে। আমি সম্প্রতি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদপত্রে পড়েছি। যুক্তরাষ্ট্রে পঁয়ত্রিশ হাজার ঔপন্যাসিক তাদের উপন্যাস প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে সাতশোজনের, এর থেকে জীবিকা নির্বাহ হয় আর পঞ্চাশ, মাত্র পঞ্চাশ জন প্রকৃতই ধনী বক্তি। এর তুলনায় তোমার বর্তমান বেতন-

‘বা:’ গটলিয়েব বলল, ‘আমি টাকা রোজগার করি না করি, সেটা তুচ্ছ, তার চেয়ে দেখতে হবে, আমি অমরত্ব লাভ করছি। অন্তর্দৃষ্টি ও অমূল্য উপহার দিয়ে যাচ্ছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তার জন্য যদি মেরিলিনকে পরিচারিকা বা বাস ড্রাইভারের কাজ নিতে হয়, সে বেদনা আমার সইবে। আমি প্রায় নিশ্চিত যে, সে দিনে কাজ করার সুযোগ ও রাতে গটলিয়েব জুনিয়রকে দেখাশোনা সৌভাগ্য বলে মানবে। যাতে আমার সাহিত্যকলা পূর্ণ বিকশিত হতে পারে। কিন্তু …’

‘কিন্তু কি?’ আমি উৎসাহ ভরে জিজ্ঞাসা করি।

‘আমি জানি না, কেন, জর্জ!’ গলার স্বরে তার অধৈর্য চলে এল, ‘কিন্তু একটা ছোট্ট বাধা রয়েছে। আমার মনে হয় না, সত্যিই আমি এটা করে উঠতে পারব। আমার মগজ বিস্ময়কর সব মুহূর্তের কল্পনায় ঠাসা। দৃশ্যাবলী, সংলাপের টুকরো, অসাধারণ প্রাণবন্ত পরিস্থিতি আমার মগজে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা শুধু এক নগণ্য ব্যাপার। সেগুলোকে সঠিক শব্দে সাজিয়েগুছিয়ে যথাস্থানে বসানো। কিন্তু এই কৌশলটিই আমাকে ধরা দিচ্ছে না

‘এটা নিশ্চয়ই খুব সামান্য সমস্যা। কারণ, অদ্ভুত নামের আপনার সেই বন্ধুটির মতন প্রত্যেক দলিল লিপিকারের মনে হয় শতখানেক বই হাতড়াতেও অসুবিধে নেই এবং তবু আমি সম্পূর্ণভাবে কৌশলটি রপ্ত করতে পারি না।

(সে নিশ্চয়ই তোমাকেই ইঙ্গিত করে থাকবে। কারণ ‘অযোগ্য দলিল-লিপিকার; বিশেষণটি তোমারই উপযুক্ত। আমি তোমার পক্ষে সাফাই দিতে পারতাম, কিন্তু জানি কোনো লাভ হতো না।)

‘নিশ্চয়ই ‘ আমি বলি, ‘তুমি যথেষ্ট চেষ্টা করনি।’

‘করিনি, মানে? শত শত পাতা, প্রত্যেকটিতে রয়েছে চমৎকার এক উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদ- শুধুই প্রথম অনুচ্ছেদ আর নেই। এতে শত শত উপন্যাসের শত শত প্রথম অনুচ্ছেদ। প্রত্যেক দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমি আটকে যাচ্ছি।’

একটা চমৎকার ভাবনা মাথায় খেলে গেল, কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম না। উৎকৃষ্ট চিন্তাধারা সদা সর্বদা আমার মনে আন্দোলিত হয়।

‘গটলিয়েব, আমি বলি, ‘আমি তোমার সমস্যার সমাধান করতে পরি। আমি তোমাকে ঔপন্যাসিক তৈরি করে দেবো। আমি তোমাকে ধনী করে তুলতে পারি।’

অপ্রীতিকর সন্দেহের চোখে সে আমার দিকে তাকাল, ‘তুমি পার?’ ভরসা না করে, ‘তুমি’র উচ্চারণে অত্যাধিক জোর দিয়ে বলল।

আমরা উঠে পড়লাম, রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোলাম। লক্ষ্য করলাম, গটলিয়েব বকশিস দিতে ভুলেছে। কিন্তু তার উল্লেখ করার মতন অভদ্র হলাম না। কারণ তাতে আশঙ্কা ছিল, সে যদি আমাকেই পাল্টা অনুরোধ করে বসে।

‘বন্ধু’ আমি বলি, ‘দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের গোপন তত্ত্ব আমার কাছে আছে এবং সে জন্যই আমি তোমাকে বিখ্যাত ও ধনী করে তুলতে পারি।’

‘আঃ হা! গোপন কথাটা কি?’

আমি সৌজন্যসহকারে বলি, (যে চমৎকার চিন্তা আমার মাথায় খেলেছে, এইবার তাতেই আসছি আমরা)।

‘গটলিয়েব, একজন শ্রমিকেরও কিছু প্রাপ্য থাকে।’

গটলিয়েব হেসে ফেলল। ‘জর্জ আপনার ওপর আমার এতই বিশ্বাস রয়েছে, বলতে মোটেই ভয় পাই না যে, আপনি যদি আমাকে ধনী ও বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বানিয়ে দেন তবে আমার উপার্জনের অর্ধেক আপনার, অবশ্যই ব্যবসা-সংক্রান্ত খরচাপাতি বাদ দিয়ে।’

আমি আরো বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘আমি তোমাকে নীতিপরায়ণ মানুষ বলেই জানি। গটলিয়েব, তাই তোমার মুখের কথাই তোমাকে এক চুক্তিতে বেঁধে ফেলবে। যেন তুমি মসৃণতম অ্যালয় স্টিলের আংটায় বাঁধা। কিন্তু হাসির কথাই, হাঃ হাঃ তুমি. কি তোমার উক্তি লিখিতভাবে দিতে পার- হাঃ হাঃ, স্বাক্ষর করে, হাঃ হাঃ, নোটারি করে। আমাদের দুজনের কাছেই কপি থাকবে।’

ছোট্ট চুক্তিপত্র তৈরি করতে আধঘণ্টাও লাগল না। কারণ, শুধুমাত্র একজন নোটারিই দরকার ছিল, আর সেই নোটারি নিজেই টাইপিস্ট ও আমার বন্ধু।

মূল্যবান কাগজটি আমি যত্নসহকারে আমার ওয়ালেটে রেখে বললাম, আমি এক্ষুনি তোমাকে গোপন তত্ত্বটি দিতে পারছি না। কিন্তু ব্যাপারটা গুছিয়ে উঠতে পারলেই তোমাকে জানাব। তুমি তখন একটা উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করতে পার, আর দেখবে, যে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ লিখতে, তোমাকে এতটুকু বেগ পেতে হচ্ছে না। একটা কেন দুহাজারই লেখ না, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যাবে সাবলীল। অবশ্যই আমার কাছে তোমার কোনো ঋণ থাকবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে প্রথম আগামটা আসছে, আর খুবই বড় রকমের কিছু, তখন আমাকে দিতে হবে।’

‘ভালই হয়। সেই বিশ্বাসটা রাখতে পারলে’ গটলিয়েব যাচ্ছেতাই ভাবে বলল।

আজাজেল্‌কে সে সন্ধ্যায় ডেকে আনতে আমি সব আচারআচরণ পালন করলাম। সে মাত্র দুই সে.মি. লম্বা আর তার নিজের জগতে কোনো ব্যক্তিগত স্বীকৃতি নেই। সেটাই একমাত্র কারণ। সে নানান তুচ্ছ পন্থায় আমাকে সাহায্য করে। তাতে নিজেকে তার কেউকেটা মনে হয়।

অবশ্যই আমাকে সরাসরি ধনী করে তুলতে, আমি কোনো মতেই আজাজেকে প্ররোচিত করতে পারি না। ছোট্ট প্রাণীটির ধারণা যে, সেটা তার কলাকৌশলের অবাঞ্ছিত ব্যবসায়িক প্রয়োগ করা হবে। আমার তরফে সকল নিশ্চয়তা আজাজেকে দেওয়া সত্ত্বেও, সে কিন্তু নিশ্চিন্ত হয়েছিল বলে মনে হয় না। তাকে একথা বললে, জবাবে সে এক অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করেছিল, যার তাৎপর্য আমি বুঝিনি। সে বলেছিল ওটা Bronx-এর এক বাসিন্দার কাছ থেকে শেখা।

এই কারণেই আমি গটলিয়েব জোনসের সঙ্গে আমার চুক্তির কথা আজাজেলের কাছে প্রকাশ করিনি। আসলে আজাজেল্‌ তো আমাকে ধনী করে দিচ্ছে না। এর মধ্য যে এক সুন্দর বিশেষত্ব রয়েছে। তা আজাজেকে বোঝাতে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।

বরাবরের মতন, আজাজেল্‌কে আহ্বান করলেই সে বিরক্ত। ওর ছোট্ট মাথাটি সীউইডের মতন পর্ণগুচ্ছে শোভিত ছিল আর ওর অসংলগ্ন প্রকাশভঙ্গীতে মনে হল, কোনো শিক্ষা সংক্রান্ত সভার মধ্যে থেকে আসছে। যেখানে তাকে কোনো সম্মান বা ঐ ধরনের কিছু দিয়ে ভূষিত করা হচ্ছিল। সত্যি সত্যিই নিজের জগতে তার কোনো প্রতিষ্ঠা না থাকায় আগেই বলেছি আমি, এ ধরনের ঘটনাকে খুব গুরুত্ব দেওয়ার দিকে এবং কটূক্তি করায় তার ঝোঁক বেশি।

ওসব ঝেড়ে ফেলে, আমি বললাম, ‘যতই হোক আমার সামান্য অনুরোধটুকু রক্ষা করে, আর যে মুহূর্তে ওখান থেকে এসেছ, সেই মুহূর্তটিতেই ফিরে যেও। কেউ বলতেই পারবে না, তুমি চলে গিয়েছিলে।’

সে কিছুক্ষণ অল্প গজ্‌জ্ করল বটে। তবে আমার কথাটি ঠিক, তা স্বীকারও করল, কাজেই অনুপরিমাণ বিদ্যুৎসহ তার পাশের বাতাসের চট্‌পট্ আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল।

‘তুমি কি চাও বলতো?’ তার তরফে জিজ্ঞাসা।

আমি ব্যাখ্যা দিলাম।

আজাজেল্‌ বলল, ‘তাহলে তার পেশা হচ্ছে ভাবধারা আদানপ্রদান, তাইতো? তোমার সেই অদ্ভুত নামের বন্ধুর ক্ষেত্রে তা হলে ভাবধারার শব্দে রূপান্তর?

‘ঠিক তাই। কিন্তু সে চায়, তার কাজের উৎকর্ষ বর্ধন ও যাদের সঙ্গে তার কারবার তাদের খুশি করতে। আর তাতে তার যশ ও ধন দুইই উপার্জিত হবে। আদতে সে অর্থ ঘৃণা করে, তবে কিনা যশের বাস্তব প্রমাণস্বরূপ ওটা দরকার।’

‘বুঝতে পারছি। আমাদের জগতেও সংলাপকার রয়েছে। এক এবং সবাই যশকেই প্রাধান্য দিয়ে যদি ন্যূনতম বৃত্তিও গ্রহণ না করত, তবে কি তাদের যশের বাস্তব সাক্ষ্য থাকতো না?’

প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললাম,’ পেশার মিথ্যা গর্ব। তুমি আর আমি ভাগ্যবান, এ সবের ঊর্ধ্বে।

‘বেশ’ আজাজেল্‌ বলে, ‘এ বছরে আর কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারছি না। ভাবছি কি, নয়তো আমার ফেরার যথাযথ সময়টি নির্দিষ্ট করতে, বেগ পেতে হবে। তোমার এই বন্ধু কি মনের আওতার মধ্যে রয়েছে।’

গটলিয়েবকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হল। যদিও মানচিত্রে আমি তার বিজ্ঞাপনের ফার্মের অবস্থান দেখিয়ে দিয়েছিলাম। আর আমার স্বভাবগত বাকপটুতায় তার সঠিক বর্ণনাও দিতে পেরেছিলাম। তবে তোমাকে আমি বাজে কথা বলে ক্লান্ত করব না।

ঘটনাক্রমে গটলিয়েবকে খুঁজে পাওয়া গেল আর সংক্ষিপ্ত অনুশীলনের পর, আজাজেল্ বলল, ‘তোমাদের মতন অপ্রীতিকর প্রজাতির মধ্যে সর্বদাই এই অদ্ভুত প্রকৃতির চিত্ত দেখা যায়। অশক্ত কিন্তু ভঙ্গুর। দেখতে পাচ্ছি, শব্দ বন্ধনী গ্রন্থিযুক্ত ও জটিল। ও যে বসে রয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাধা-বিন্দুগুলি আমি অপসারিত করতে পারি। কিন্তু তাতে তার মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর কুপ্রভাব পড়তে পারে। তোমার কি মনে হয়, ও এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত!’

‘আরে, নিঃসন্দেহে,’ আমি বলি, ‘সে তার সাহিত্যকলায় যশ অর্জন করতে চায়, বিশ্বের সেবা করতে চায়। সে এই ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করবে না মোটেই।’

‘হ্যাঁ। তবু মনে হয়, তুমি বন্ধুগত প্রাণ। সে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় অন্ধ হতে পারে, তার সদিচ্ছা থাকতে পারে, কিন্তু তুমি আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পার। ‘তুমি কি তাকে এই ঝুঁকি নিতে দিতে পার?’

‘আমার একমাত্র লক্ষ্য,’ আমি বলি, ‘তাকে সুখী করা। তুমি এগিয়ে যাও, চেষ্টা কর যত্ন নিয়ে। যতটা তুমি পার। আর তাও যদি খারাপ কিছু ঘটে, তবে ভাবা যাবে, ভালর জন্যই ঘটেছে। (আর অবশ্যই এতো নিশ্চিত, সব কিছু ঠিকঠাক হলে অর্থপ্রাপ্তির অর্ধেক আমার)।’

অতএব সব কিছু পাক্কা হয়ে গেল। আজাজেল্‌ এবার বাতাস ভারী করে তুলল, যেমন সে বরাবর করে থাকে। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ হাঁফাল। অন্যায় অনুরোধ করার জন্য বিড়বিড় করতে থাকল। কিন্তু আমি তাকে বললাম, লক্ষ লক্ষ লোকের আনন্দের যে ব্যবস্থা সে করেছে, সেই কথা ভাবতে, আর আত্মপ্রেমে মগ্ন না থাকিতে। আমার উপদেশে আশ্বস্ত হয়ে, তার নগণ্য সম্মান প্রাপ্য হল কিনা দেখতে, বিদায় নিল।

এর প্রায় এক সপ্তাহ পরে। আমি গলিয়েব জোন্‌সকে খুঁজে বার করলাম। এর আগে তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো চেষ্টা করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, নতুন মস্তিষ্কের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, কিছু সময় তো তার লাগবেই। তাছাড়া অপেক্ষা করাই আমার ভাল মনে হয়েছিল আর পরোক্ষে তার সম্বন্ধে খোঁজ নিলাম, পাছে এই প্রক্রিয়ায় তার মস্তিষ্ক কোনোভাবে ক্ষতিগস্ত না হয়ে থাকে। যদি তাই হয়, তবে তো তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো প্রয়োজনই নেই। আমার ক্ষতি, তারও, আমার মনে হয়, সাক্ষাৎ হওয়াটা তখন কাঁটার মতন বিধত

তার সম্বন্ধে প্রতিকূল কিছু শুনলাম না আর অবশ্যই তাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই মনে হল। তার ফার্ম থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমার সঙ্গে দেখা হল। আমি তক্ষুনি লক্ষ্য করলাম, বিষাদ তাকে ঘিরে রয়েছে। অবশ্য বিশেষ মনোযোগ দিলাম না, কারণ দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করেছি, লেখকরা বিষাদগ্রস্ত হয়েই থাকেন। এটা মনে হয় কোনো কারণে, পেশার সঙ্গে জড়িত, বলে বিশ্বাস করি। হয়তো বা প্রকাশকদের সঙ্গে অবিরত যোগাযোগই বড় কারণ।

‘আঃ জর্জ,’ সে উদাসভাবে বলল, ‘আপনাকে দেখে কী ভালই না লাগছে। আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছে।’ (আসলে সব লেখকদের মতোই, সে যথেষ্ট কুৎসিত, কিন্তু সে কথা মুখের ওপর বলা চলে না) ‘তুমি কি এরপর উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করেছিলে?’

‘না, করিনি।’ হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল, এইভাবে সে বলল, ‘কেন? আমার সেই দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের গোপন তত্ত্ব এখন দেবে নাকি?’

‘সে যে মনে রেখেছে দেখে, আনন্দ হল। তার মাথা যে আগের মতোই পরিষ্কার কাজ করছে, এটা তার লক্ষণ।

আমি বলি, ‘সেসব তো হয়েই গেছে, বাবা। আমার আর বুঝিয়ে বলবার দরকার নেই। তবে তার থেকেও সূক্ষ্ম পদ্ধতি আমার জানা আছে। তুমি শুধু বাড়ি চলে যাও, টাইপরাইটারে বসে পড়, দেখবে তুমি দেবদূতের মতন লিখে ফেলছ। সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত। তোমার সব সমস্যা দূর হয়ে গেছে। এবার তোমার টাইপরাইটার থেকে হু হু করে উপন্যাস বেরিয়ে আসবে। দুটো অধ্যায় আর বাকিটার একটা মোটামুটি নক্সা খাড়া করে যে কোনো প্রকাশককে দেখাও, সে আনন্দে চিৎকার করে উঠবে আর তোমাকে মোটা চেক দেবে, যার অর্ধেক আমার।

‘আহা!’ ভোঁসভোঁস শব্দ করে উঠল গটলিয়েব।

‘আমার প্রতিশ্রুতি’ বুকের ওপর হাত রেখে বললাম, ‘আমার হৃদয় প্রশস্ত, শারীরবৃত্তের ক্রিয়াকলাপের কারণেই। প্রকৃতপক্ষে আমি মনে করি, তোমার চাকরি ছেড়ে দেওয়া পুরোপুরি নিরাপদ, যাতে টাইপরাইটার থেকে শুধু বস্তু বেরিয়ে আসবে, তা কোনো মতেই কলুষিত হতে না পারে। তোমাকে চেষ্টা করতে হবে গটলিয়েব এবং তোমাকে মানতে হবে, আমার অর্ধেক এর চেয়েও আমি বেশি পাব।’

‘তুমি বলতে চাইছ, আমি চাকরি ছেড়ে দিই!’

‘ঠিক তাই।’

‘আমি তা পারি না।’

‘নিশ্চয়ই পার। এই হীন পদ থেকে তোমার পিঠ ফিরিয়ে নাওতো। লাথি মারো তোমার পরস্পর বিরোধী ব্যবসায়িক প্রচারে।’

‘আমি তো বলছি, আপনাকে, আর আমি তা পারি না, কারণ এইমাত্র আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

‘বরখাস্ত করা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। এবং এমনভাবে কোনো রকম প্রশংসার উল্লেখ না করে, তাই আমার কখনো ক্ষমা করার প্রবৃত্তি হয় না।’

আমরা কম খরচে যেখানে রাতে খেতাম সেই ছোট জায়গার দিকে এগোলাম।

‘কি হয়েছিল, কি?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।

স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বিষণ্ণভাবে সে বলল, ‘আমি রুমফ্রেশারের জন্য স্লোগান লিখছিলাম আর তার জবরদস্তি স্নিগ্ধতা পরিবেশনে অভিভূত ছিলাম। ‘গন্ধ’ শব্দটির যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। হঠাৎই আমি মনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। এই রদ্দি বস্তুটিকে যদি এভাবে চালাতে হয়, তবে ঠিক কি করা উচিত। খুঁতখুঁতে হয়ে, শুরুতে লিখলাম Shrink the Stink আর নিচে Quench Stench এবং সরাসরি পাঠিয়ে দিলাম, বসের সঙ্গে আলোচনা না করে।

পাঠিয়ে দেওয়ার পর ভাবলাম, ‘কেন নয়?’ পরে বসকে সে কথা জানিয়ে দিলাম। তার যেন তাৎক্ষণিক সন্ন্যাসরোগের তীব্র আক্রমণ ঘটে গেল। আমাকে ডেকে গালিগালাজ করে, বরখাস্ত করল। এমন সব শব্দ, যা নিশ্চয় সে মায়ের কোলে শোনেনি, যদি না তার মা অসাধারণ মহিলা হয়ে থাকেন। অতএব, আমার আর চাকরি নেই।

শত্রুপক্ষীয় ভ্রূকুটি নিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, ‘আমার ধারণা আপনি বলবেন, এসব আপনারই কাণ্ড কারখানা!’

আমি বলি, ‘অবশ্যই। অবচেতন মনে যা ঠিক ভেবেছ, তাই করেছ। তুমি ইচ্ছা করেই নিজেকে নিজে বরখাস্ত করেছো। অতএব এখন তুমি তোমার সমস্ত সময়, প্রকৃত সাহিত্যকলায় ব্যয় করতে পারবে। বন্ধু গটলিয়েব, বাড়ি যাও এখন। উপন্যাস লেখো, আর নিশ্চিত জেনো তুমি একশত হাজার ডলারের কম আগাম পাচ্ছ না। এখানে যখন কোনো ব্যবসায়িক খরচাদি নেইই, শুধুমাত্র কয়েক পেনীর কাগজ ছাড়া। তোমাকে কিছুই বাদ দিতে হবে না, সরাসরি পঞ্চাশ হাজার ডলার রাখতে পারবে।’

সে বলল, ‘আপনি একটা পাগল।

‘আমি নিশ্চিত।’ আমি বলি, ‘আর এটা প্রমাণ করতে, আজকের লাঞ্চ আমার তরফে।

‘আপনি একটা ক্ষ্যাপা’ সে অদ্ভুত সুরে বলল, আর সত্যি সত্যিই আমাকে বিল মেটাতে রেখে নিজে বেরিয়ে গেল। যদিও সে জানত, আমার বলাটা ছিল নেহাতই কথার কথা।

পরের দিন রাতে তাকে ফোন করলাম। আমার হয়তো আরো অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আমার তাকে তাড়া দেওয়া উচিত হয়নি। তবু তার ওপর তো আমার আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে। লাঞ্চে আমার এগারো ডলার খরচ হয়েছে, তার ওপর ওয়েটারের বশিশের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি তখন সুখবরের জন্য অস্থির। তুমি নিশ্চয়ই বুঝছ।

‘গটলিয়েব’ আমি বলি ‘উপন্যাস কতদূর!’

‘চমৎকার।’ অন্যমনস্কভাবে সে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই। বিশ পাতা হয়ে গেছে এবং উৎকৃষ্ট রচনাই বটে।’ যদিও সব স্বাভাবিকই শোনাচ্ছিল। তবু তার মনের মধ্যে হয়তো আরো কিছু ছিল।

বললাম, ‘তুমি তো আনন্দে লাফাচ্ছ না?’

‘উপন্যাসের জন্য? বোকার মতন কথা বলবেন না। ফিয়েনবার্গ, সালজবার্গ আর রোসেনবার্গও আমাকে ডাকাডাকি করছে।’

‘তোমার বিজ্ঞাপনের, মানে প্রাক্তন বিজ্ঞাপন সংস্থা।’

‘হ্যাঁ, সবাই নয়, অবশ্য। শুধু মি. ফিয়েনবার্গ নিজেই। উনি চান আমি ফিরে যাই।’

‘আমি বিশ্বাস করি, গটলিয়েব এখনো পর্যন্ত যতদূর গড়িয়েছে, সবটা তুমি ঠিক বলছ।

গটলিয়েব মাঝপথে থামিয়ে দিল আমাকে। আপাতত মনে হচ্ছে, সে বলল আমার ‘এয়ার ফ্রেশনার’ এর স্লোগান দারুণ কাণ্ড ঘটিয়েছে। ওরা ওটা ব্যবহার করতে চাইছে। দূরদর্শন, সংবাদপত্র সর্বত্র বিজ্ঞাপনে কমিশন দিতে চেয়েছে, আর এ বিষয়ে মুখ্য দাবি লেখকেরই, যাকেই প্রচার কার্য চালাতে হবে। ওরা বলেছে যে, আমি যা করেছি তা দুঃসাহসিক ও মর্মভেদী এবং আগামী দশকের জন্যও যথোপযুক্ত। অভূতপূর্ব শক্তিশালী বিজ্ঞাপনের সূচনা করতে তারা আমাকেই চাইছে। স্বভাবত আমাকে তো ভেবে দেখতে হয়।’

‘তুমি ভুল করছ, গটলিয়েব।’

‘আমার উচিত, আরো দাম বাড়িয়ে দেওয়া, বেশ বড় রকমের কিছু। ফিয়েনবার্গ আমার সঙ্গে যে অমানুষিক ব্যবহার করেছে, আমাকে তাড়িয়েছিল, ইড্ডিশ ভাষায় অকথ্য গালি!’

‘অর্থ আবর্জনা সমান, গটলিয়েব’

‘অবশ্যই জর্জ। আমি দেখতে চাই, এর সঙ্গে কী পরিমাণ আবর্জনা জমা আছে।’

আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম না। গটলিয়েবের অনুভূতিপ্রবণ মনে, বিজ্ঞাপন লিখন কিভাবে বসে গিয়েছিল, আমি জানতাম। আরো জানতাম, এই স্বাচ্ছন্দ্যে সে যদি উপন্যাসও লিখত, তবে সেটা কত আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। শুধু অপেক্ষা করাই দরকার আর (প্রবাদে বলতে গেলে), প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে চলুক।

কিন্তু তারপরই ‘এয়ার ফ্রেশনার’-এর বিজ্ঞাপন বাজারে এল আর জনসাধারণের ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দারুণ সাফল্য। Quench the Stench’ স্লোগান আমেরিকার যুব সম্প্রদায়ের মুখে মুখে ঘুরতে থাকল আর প্রতিটি ব্যবহারই ছিল সামগ্রীর অনুকূলে পুনঃ পুনঃ প্রচার।’

‘মনে হয় নিজের খেয়াল খুশির কথা নিশ্চয় মনে রেখেছ, যা অবশ্য সচরাচর করেই থাক। আমি বুঝেই গিয়েছি, বাতিল করা বিজ্ঞাপন লিপিগুলি, তুমি যে সব পত্রিকায় লিখতে চেয়েছিলে, সবই সৌজন্যসহকারে গৃহীত হয়েছে আর এ অভিজ্ঞতা তোমার বহুবার ঘটেছে

অন্য সব বিজ্ঞাপনই সাফল্যের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে রইল।

তবে হঠাৎই আমার সব বোধগম্য হল। আজাজেল্‌ গটলিয়েবকে এক বিশেষ অবস্থার মন তৈরি করে দিয়েছে, যা তাকে তার লেখা দিয়ে জনগণকে মোহিত করে তুলছে। কিন্তু আজাজেল্‌ ছোট এবং তেমনি বিশেষ কাজের না হওয়ায়, গটলিয়েবের মনকে সূক্ষ্মভাবে সাজাতে পারেনি, যাতে তার দান শুধু উপন্যাসেই কার্যকর হয়। আবার এও হতে পারে, আজাজেল্‌ মোটে জানেই না, উপন্যাস কী!

তাতে কি কিছু এল গেল?

আমি বলতে পারবো না, গটলিয়েব তার ঘরের দোরগোড়ায় আমাকে দেখে খুশি হল, তবে এতটা নির্লজ্জ নয় যে, আমাকে অন্দরে আমন্ত্রণ জানাতে প্রত্যাখ্যান করবে। প্রকৃতপক্ষে কিছুটা সান্ত্বনা ছিল, যখন বুঝলাম, সে ডিনারে আহ্বান না করে পারবে না। যদিও সে (ইচ্ছা করেই, আমি মনে করি) সব আনন্দ মাটি করে দেওয়ার জন্য গটলিয়েব জুনিয়রকে ধরতে দিয়ে দিল, দীর্ঘ সময়ের জন্য। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তারপর ডাইনিং রুমে শুধু আমরা দুজন রয়েছি, বললাম ‘কতখানি আবর্জনার মাল তুমি পাচ্ছ গটলিয়েব?’

তীব্র ভর্ৎসনার চোখে তাকাল গটলিয়েব। ‘ওসবকে আবর্জনার মাল বলবেন না। এতো অশ্রদ্ধার কথা। বছরে পঞ্চাশ হাজার সত্যিই আবর্জনা কিন্তু একশত হাজার, সঙ্গে সন্তোষজনক আত্মজাহির, এ এক যথার্থ আর্থিক পদমর্যাদা।

আর কী চাই! আমি শিগগিরই নিজের ফার্ম তৈরি করে ফেলব আর সাথে সাথে কোটিপতি, যে স্তরে অর্থ মানে ধর্ম বা ক্ষমতা, দুটোই অবশ্য একই কথা। আমার ক্ষমতা হলে, ধরে নিন, ব্যবসা থেকে ফিয়েনবার্গকে বার করেও দিতে পারি। কোনো ভদ্রলোক অন্য ভদ্রলোকের সঙ্গে যে ভাষা কখনো ব্যবহার করতে পারে না, আমার ওপর তাই করেছিল, তার শাস্তি পাওয়া উচিত। আপনি কি কখনো শুনেছেন ‘shmendrick’। মানে জানেন, জর্জ?’

বলতে পারলাম না, অনেক ভাষাই আমার আয়ত্তে আছে। কিন্তু উর্দু আমি জানি না। বললাম ‘তাহলে তুমি এখন ধনী হয়েছ।’

‘এবং আরো ধনী হওয়ার তোড়জোড় করছি।’

‘সেক্ষেত্রে গটলিয়েব আমি তোমাকে মনে করাতে পারি, এসবই ঘটেছে, আমি তোমাকে ধনী করে তুলতে সম্মত হওয়ার পর। সে সময়ে তুমি শপথ করেছিলে, অর্ধেক ধনার্জন আমাকে দেবে।’

গটলিয়েব ভ্রূজোড়া উঁচিয়ে কুঞ্চিত করল, ‘আপনি করেছেন! আমি বলেছি?’

‘কেন, হ্যাঁ। স্বীকার করছি, এটা এমনই একটা কথা, যেটা ভুলে যেতে পারা খুব সহজ। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সব কিছু লিখিতভাবে রয়েছে, স্বাক্ষরিত নোটারাইজড্, সব কিছু আইনসম্মত। ‘

আর আমার কাছে চুক্তিপত্রের ফটোকপিও রয়েছে।

‘ও, তা আমি কি একবার দেখতে পারি!’

‘নিশ্চয়ই, তবে বলেই দিচ্ছি, এটা কিন্তু ফটোকপি। যদি তুমি উৎসাহ ভরে কাছে নিয়ে যাচাই করতে গিয়ে দৈবক্রমে এটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলো, আমার কাছে কিন্তু আসলটি রয়েছে।’

‘খুব ভাল কথা জর্জ, কিন্তু ভয় পাবেন না। যদি আপনি যা বলছেন তা ঠিক হয়, তবে একটুও নয়, এতটুকু নয় একপেনি পর্যন্ত নয়, আমি আপনাকে না দিয়ে রেখে দেবো। আমি নীতিবোধের মানুষ, আর আক্ষরিক অর্থে চুক্তিপত্রের সম্মান করি।’

তাকে ফটোকপিটি দিতে, সে পরম যত্নে যাচাই করল ‘ও হ্যাঁ,’ সে বলল ‘অবশ্যই মনে পড়েছে আমার। একটা মাত্র ছোট্ট কথা থেকে যাচ্ছে—’

‘কি?’ আমার জিজ্ঞাসা।

‘আচ্ছা! এই কাগজে আমার উপার্জন লেখা আছে, ঔপন্যাসিক হিসাবে। জর্জ, আমি কিন্তু ঔপন্যাসিক নই।’

‘তুমি চেয়েছিলে হতে, এবং এখনো তুমি তা পার, যদি একবার টাইপরাইটারের সামনে বসে যাও’

‘কিন্তু জর্জ, আমি তো আর হতে চাই না। আমি টাইপরাইটারের সামনে বসার আশা করি না।’

‘কিন্তু শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মানে অমর যশ। নির্বোধের স্লোগান তোমাকে কি দেবে?’

‘টাকা, টাকা আরো টাকা। জর্জ, তার ওপর আবার এক বিশাল ফার্ম, যা আমারই সম্পত্তি। আমি অনেক শোচনীয় লিপিকার কর্মী নিয়োগ করে নেবো, যাদের জীবন আমার হাতে ধরা থাকবে। টলস্টয় কি এমনটা পেয়েছেন? কিংবা ডেল রে।’

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আর, ‘আমি তোমার জন্য যা করেছি, তুমি আমাকে এক কপর্দক দিতেও রাজি হচ্ছ না। শুধুমাত্র আমাদের সচিত্র চুক্তিপত্রে উল্লিখিত একটি শব্দের জন্য।’

‘জর্জ, আপনি কি নিজের হাতে কখনো লিখতে চেষ্টা করেছেন? কারণ আমি পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে, ঘন বুনটের শব্দে রূপান্তরিত করতে পারলাম না। আমার নীতিবোধ আমাকে চুক্তিপত্রের অক্ষরে অটল রাখবে আর আমি একজন নীতিবোধের মানুষ।’

এই জায়গা থেকে গটলিয়েব আর নড়বে না। আর আমি উপলব্ধি করলাম, গতদিনে দুজনের লাঞ্চে আমি যে এগারো ডলার খরচ করেছি, সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কোনো লাভও নেই। কোয়ার্টার বখশিশের কথা তো দুরস্ত।

.

জর্জ উঠল, চলেও গেল। আর এই ঘটনা এমন নাটুকে হতাশায়, যে আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলাম না। অথচ বলতে হতো, পানীয়ের অর্ধেক বিল তার দেয়। আমি বিল চাইলাম, দেখি বাইশ ডলার মোট।

জর্জের পাটিগণিতের হিসেব খুব প্রাঞ্জল, গটলিয়েবের সঙ্গে তার লাঞ্চের খরচটা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। তাকে মনে মনে প্রশংসা করলাম, তবে আধ ডলার বখশিশ দিতে আমাকে কঞ্জুস হতে হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *