দুই সে.মি. দীর্ঘ জিন

দুই সে.মি. দীর্ঘ জিন

বেশ কয়েক বছর পূর্বে, এক সাহিত্যসভায় জর্জের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আর আমি তার মধ্যবয়সী সুগোল মুখের অকপট সরল দৃষ্টি দেখে মোহিত হয়েছিলাম। তিনি এমনই এক ব্যক্তি ছিলেন, যার হাতে নিশ্চিন্তে ওয়ালেট সমর্পণ করে, সাঁতারে নামা যায়।

আমার বই-এর পেছনে আমার ফটো থেকে আমাকে দেখামাত্রই তিনি চিনেছিলেন। বলেছিলেন, আমার গল্প, উপন্যাস তাকে কতটা মুগ্ধ করেছে এবং অবশ্যই তাতে তার বুদ্ধিমত্তা ও রুচির পরিচয় পাচ্ছিলাম। আমরা আন্তরিক আগ্রহে করমর্দন করলাম। তিনি জানালেন, ‘আমার নাম জর্জ বিটারনাট। বিটারনাট! মনে রাখার জন্য আমি পুনর্বার উচ্চারণ করলাম, ‘ভারি অসাধারণ নাম!’

‘ড্যানিস।’ তিনি জানালেন, ‘এবং অভিজাত। আমি ক্লান্ট বংশোদ্ভূত যিনি ক্যানিউট নামে সুপরিচিত। ড্যানিশ সম্রাট একাদশ শতকে ইংল্যান্ড জয় করেন। আমার পূর্বপুরুষ তার পুত্র ছিলেন। কিন্তু সনাতন বৈধরীতিতে জন্মাননি।’

‘অবশ্যই,’ আমি বললাম, যদিও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে মনে করার কোনো কারণ দেখলাম না।

‘পিতার পদবী অনুসারে তিনিও ক্লান্ট,’ জর্জ বলে চললেন, ‘আর যখন তাকে রাজার কাছে নিয়ে আসা হল, রাজাধিরাজ ডেন বললেন, ‘আমার পবিত্র ধামে, এই কী আমার উত্তরাধিকারী?’

‘না,’ পুরোটা নয়, দ্বারী ছোট্ট ক্লান্টকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলল, ‘কারণ এতো অবৈধ সন্তান। মা হচ্ছে রজকিনী, যাকে আপনি — ‘

‘আঃ’ রাজা থামিয়ে দিলেন, ‘সেটাই বেটার।’ এবং তারপর থেকেই তার নাম চালু হয় ‘বেটারক্লান্ট।’ সেটিই একমাত্র নাম। পুরুষানুক্রমে আমার নামেও এসে গেছে। কালের যাত্রায়, উচ্চারণের ফারাকে দাঁড়িয়ে গেল ‘বিটারনাট।’

এবং জর্জের নীল চোখ আমার দিকে ছলাকলাহীন এক সম্মোহনী দৃষ্টি হানল, যাতে সংশয়ের অবকাশ ছিল না।

আমি বললাম, ‘আপনি কি দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবেন?’ আমি জাঁকজমকের একটি রেস্তোরাঁর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলাম, যা সত্যিই পকেটভারীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।

জর্জ বললেন, ‘আপনার কি মনে হয় না ভোজনশালাটি একটু বেশি উঁচুদরের? অন্য দিকে লাঞ্চ কাউন্টারে হয়তো বা–’

‘আরে, আমার অতিথি হয়ে,’ আমি বিশদ হলাম। এবার জর্জ ঠোঁট টিপে বললেন, ‘আমি এখন ভোজনশালাটি ভালর দিকে দেখছি, মনে হচ্ছে, ঘরোয়া আবহাওয়াই পাওয়া যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে, চলবে।’

খেতে খেতে জর্জ বললেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ বেটারক্লান্টের এক ছেলে ছিল, যার নাম তিনি রেখেছিলেন ‘স্বোয়েন’ একটি সুন্দর ডেনিস নাম।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি,’ আমি বললাম, ‘রাজা ক্লান্ট এর পিতার নাম ছিল স্বোয়েন ফর্কবার্ড। এখনকার দিন হলে নামটার বানান হতো স্বেন।’

জর্জ ভ্রূ কুচকিয়ে বললেন, ‘আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ আপনি পার হয়ে এসেছেন।

অপ্রতিভ হয়ে বললাম, ‘দুঃখিত’।

জর্জ মহান ক্ষমার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সুরার গ্লাসের অর্ডার দিলেন। বলে চললেন, ‘স্বোয়েন বেটারক্লান্ট সুন্দরীদের ভালবাসতেন। সেদিকে তিনি সফল পুরুষ ছিলেন, যেমন আমরা সকলেই। সর্বজনবিদিত রয়েছে, তাকে ছেড়ে আসার সময়, অধিকাংশ মহিলাই মাথা নাড়তেন, বলতেন, ‘উনি এক মহাশক্তিধর উপাসক’! একটু থেমে বললেন, ‘মানে বুঝলেন?’

‘না।’ মিথ্যা করে বললাম আমি। ওনার সামনে আর নিজের জ্ঞান জাহির করতে ইচ্ছা করলো না।

‘মহাশক্তিধর উপাসক অর্থে এক মহান জাদুকর। সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল, ‘স্বোয়েন গোপন তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনা করছিলেন। সে সময়ে সবই সম্ভব ছিল। আধুনিক নোংরা নাস্তিকতাবাদ তখন ছিল না। তিনি তরুণীদের কোমল বিনম্র ব্যবহারে বিশ্বাসী ছিলেন। যা ছিল নারীত্বের গরিমা। এবং স্বেচ্ছাচার ও কলহপ্রিয়তা সতত বর্জনীয় ছিল।’

‘তা বেশ।’ সহানুভূতির সুরে বললাম আমি।

‘আর এ জন্য দরকার পড়ত জিনের। কিছু কিছু মিষ্টি জড়িবুটি পুড়িয়ে, কিছু ভুলে যাওয়া শক্তিদের আহ্বান করার রীতি তার জানা ছিল।

‘এতে কি সত্যিই কাজ হত মি. বিটারনাট?’

‘অনুগ্রহ করে আমাকে ‘জর্জ’ নামে সম্বোধন করবেন। হ্যাঁ, অবশ্যই কাজ হতো। আর তার প্রায়শ অভিযোগ ছিল, সে সময়কার মেয়েরা ছিল মাথা মোটা গোঁয়ার, যারা তাকে রাজার নাতি হিসেবে মান্য করত না, কটু মন্তব্য করত, তার জন্মসূত্র নিয়ে। একদা এক জিন তার পক্ষে ছিল, যাতে তিনি স্বাভাবিক গুণের স্বীকৃতি পেতে পারতেন।

আমি বললাম, ‘আপনি কি এসব বিষয়ে নিশ্চিত জর্জ?’

‘নিশ্চয়ই, গত গ্রীষ্মেই আমি তার নির্দেশিত যাবতীয় গুণাবলী সম্বলিত বইটি পেয়েছি, যার সাহায্যে জিনদের আহ্বান করা হতো। আমি একটা পুরনো ইংরেজদের কেল্লার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে বইটি পাই। তখন থেকে বইটি আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। ঠিক কি কি গাছ-গাছড়া পোড়াতে হবে, কোথায় কীভাবে রাখতে হবে, বিভিন্ন শক্তিরূপীর নাম, ভজন-পূজনের রীতিনীতি সব তাতে তালিকাভুক্ত করা আছে। প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সন ভাষাতে লেখা, কিন্তু আপনি তো জানেন, আমি বহু ভাষাবিদ। তাই—’

মৃদু সন্দেহের অবকাশে আমি বলে ফেলি, ‘ঠাট্টা করছেন!’

ওঁর চাহনি উগ্র হয়ে উঠল, ‘এ রকম ভাবছেন কেন? আমি কি মজা করছি, নাকি? এটা একটি প্রামাণ্য পুস্তক। আমি পদ্ধতি-প্রণালী সকল নিজে পরীক্ষা করেছি।’

‘আর, একটা জিন পেয়ে গেছেন!’

‘হ্যাঁ, যথার্থ’ স্যুটের বুকপকেট নির্দেশ করে বললেন জর্জ।

‘ওইখানে?’

জর্জ পকেট স্পর্শ করলেন আর মাথা নাড়তে নাড়তে, কোনো কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন। হতাশ হয়ে বললেন, ‘ইস্ চলে গেছে। সব খতম। কিন্তু তাকে দুষতে পারেন না হয়তো। গতকাল রাতেও সে আমার সঙ্গে ছিল। কারণ, জানেন, সে এই সভা সম্বন্ধে কৌতূহলী ছিল। আমি একটা আই ড্রপারে করে তাকে হুইস্কি খাইয়েছিলাম। তার পছন্দও হয়েছিল হয়তো, একটু বেশিই ভাল লেগে থাকবে। কারণ পানশালার খাঁচায় রাখা কাকাতুয়ার সঙ্গে সে লড়তে চাইছিল আর চিৎকার করে তাকে গালাগাল দিচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে জিনের ঘুম এসে গেল, নয়তো অসন্তুষ্ট পাখিটি প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত। আজ সকালে হয়তো তার মেজাজ ভাল ছিল না। মনে হয় নিজের বাড়ি গেছে, নিজের শক্তি ফিরে পেতে।

মনে মনে আমি খানিক বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। জর্জ কি আশা করছে, তার এই সব আজগুবি বকুনি আমি বিশ্বাস করব! ‘আপনি কি বলতে চান, আপনার বুকপকেটে এক জিন ছিল?’

‘বাঃ, বেশ তো চটজলদি বুঝে ফেললেন,’ জর্জ বললেন, ‘বাঃ বাঃ বাঃ।’

‘কত বড় ছিল সেই জিন?’

‘দুই সেন্টিমিটার।’

‘বাঃ বাঃ, এক ইঞ্চিরও কম!’

‘ঠিক বলেছেন। এক ইঞ্চি মানে আড়াই সেন্টিমিটার।’

‘আমি বলতে চাইছি, কী ধরনের জিন? মাত্র দু সে.মি. লম্বা!’

‘এক রত্তি জিন!’ জর্জ বলেন, কিন্তু বোঝেন তো, একদম না থাকার চেয়ে ছোট্ট জিনই সই!’

‘ওতো নিজের মর্জির ওপর নির্ভর করে।’

‘ওঃ, আজাজেল্ হচ্ছে তার নাম। এক বন্ধু জিন। আমার সন্দেহ হয়, নিজের ভুতুড়ে জগতে তাকে হয়তো একটু নিচু নজরে দেখা হয়। কারণ, সে অসাধারণভাবে তার শক্তি দিয়ে আমাকে মোহিত করতে উৎসুক। তবে সেই শক্তি, সে আমাকে ধনী করে তুলতে ব্যবহার করবে না, যদিও সুন্দর বন্ধুত্বের নজির হিসেবে সেটুকু করা তার উচিত ছিল। তার বক্তব্য, তার শক্তি শুধু অপরের মঙ্গল সাধনের জন্য।

‘আরে রাখুন তো জর্জ! এটা তো নরকের দর্শন হতেই পারে না।’

জর্জ ঠোঁটে আঙুল রাখল। ‘একথা বলবেন না দাদু। আজাজেল্‌ যারপর নাই অসন্তুষ্ট হবে। সে বলে, তার দেশ মিত্রভাবাপন্ন, সুন্দর উচ্চদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সে তার শাসক সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধাবান, যার নাম সে জানে না বটে, তবে তাঁকে

সর্বেসর্বা বলে উল্লেখ করে।’

‘আর, সত্যিই কি সে দয়াপরবশ?’

‘যখন সে সক্ষম। এই ধরুন না, আমার ধর্ম মেয়ে জুনিপার পেন্ এর কথা। ‘জুনিপার পেন?’

‘হ্যাঁ। আমি আপনার চোখে ঘোর কৌতূহল দেখছি, আপনি যদি তার গল্প শুনতে আগ্রহী হন, তবে সানন্দে আমি বলতে রাজী।’

‘জুনিপার পেন’ জর্জ শুরু করলেন, ‘সে ছিল আয়ত নয়না ও সে সময়ে কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, যখনকার গল্প আপনাকে শোনাচ্ছি। একটি সরল মিষ্টি মেয়ে এবং বাস্কেটবল টিমের অনুরাগিনী। বিশেষভাবে কেউ অথবা দীর্ঘকায় তরুণ দল। দলের একজনের প্রতি তার তরুণীসুলভ আকর্ষণ গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। সে হল লিয়েন্ডার টমসন। লম্বা, কৃশকায়। তার দীর্ঘ হাতে বাস্কেটবলের বেষ্টন বা অন্য কিছু যা বাস্কেটবলের আকার আয়তনতূল্য, জুনিপারের মনে এমন দৃশ্য, অহরহ আনাগোনা করত। কোনো খেলা চলাকালীন, জুনিপার যদি দর্শকের আসনে থাকত, তবে তার উল্লসিত চিৎকার ছিল, লিয়েন্ডারের লক্ষ্যে।

জুনিপার আমাকে তার ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি স্বপ্নের কথা বলত, অন্য সমস্ত তরুণীদের মতোই (আমার ধর্ম মেয়ে ছাড়াও)। তার আবেগ সে মন খুলে আমার কাছে প্রকাশ করত। আমার সস্নেহ সাদর আচরণ তার আস্থা জিতে নিয়েছিল।

‘ওঃ আঙ্কেল জর্জ, লিয়েন্ডারকে নিয়ে যদি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, সেটা কি দোষের? আমি তাকে দেখি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে। দীর্ঘমেয়াদী বড় রকমের চুক্তিতে আবদ্ধ পেশাদারী খেলোয়াড়দের উচ্চতম আসনে। এটা কি আমার অতিরিক্ত কিছু চাওয়া! জীবনে যা কামনা করি, তা হল আঙুর লতা ছাওয়া এক প্রাসাদ, যত দূর দেখা যায়, একটি ছোট লাগোয়া বাগান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভৃত্যগোষ্ঠি, সারা সপ্তাহে ও সারা মাসের পোশাক-আশাক পর পর গোছানো রয়েছে আর…

আমি তার মজাদার বকবকানি থামিয়ে বললাম, ‘ছোট্ট খুকি, একটা ছোট্ট ত্রুটি থেকে গেছে, তোমার পরিকল্পনায়। লিয়েন্ডার কিন্তু মোটেই খুব বড় বাস্কেটবল খেলোয়াড় নয় আর এটা খানিক অসম্ভবই, যে সে বিশাল অর্থের চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবে!’

‘খুব খারাপ কথা,’ জুনিপার ঠোঁট ফোলাল, ‘কেন ও খুব ভাল বাস্কেটবল খেলোয়াড় নয়?’

‘কারণ এভাবেই জগৎ চলে। তুমি কেন না, তোমার নবীন প্রেম এক ভাল বাস্কেটবল খেলোয়াড়কে সমর্পণ কর না! কিংবা এসবের জন্য ওয়াল স্ট্রীটের দালালদের শরণাপন্ন হতে পার, যারা এ বিষয়ে খোঁজ খবর রাখে!’

‘আসলে, আমি নিজের সম্পর্কে ভেবে রেখেছি, আঙ্কেল জর্জ। কিন্তু আমি যে লিয়েন্ডারকেই পছন্দ করি। অবশ্য সময়ে সময়ে মনে হয়, জীবনে টাকাটা কি খুবই জরুরী!’

‘চুপ কর খুকি,’ আমি আহত হই, ‘আজকালকার মেয়েরা বড় বাচাল। ‘কিন্তু আমি টাকাটা পাবই না বা কেন? ওটা কি খুব বেশি চাওয়া?’

সত্যিই কি তাই! যাহোক আমার নিজের এক জিন রয়েছে। যদিও সে আমার একরত্তি, তবু মস্ত দিলদার। সে নিশ্চয়ই প্রকৃত প্রেমকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে, দুটি আত্মা যাদের অন্তরে সমস্পন্দন, দ্বৈত চুম্বন ও যৌথ সম্পদের আকাঙ্ক্ষা।

যখন আমি যথার্থ শক্তির নামে আজাজেকে তলব করলাম, সে মন দিয়ে শুনল। সেই শক্তি কি, তা আমি আপনাকে বলতে পারি না, আপনার কি প্রাথমিক নীতিজ্ঞান নেই? আজাজেল্‌ শুনল, কিন্তু তার মধ্যে প্রকৃত সহানুভূতির অভাব লক্ষ্য করলাম। স্বীকার করছি, আমি তাকে আমাদের গণ্ডীর মধ্যে টেনে এনেছিলাম, সম্ভবত তার তুর্কীয় স্নানের সময়ে। কারণ তার দেহে তখন ছোট্ট তোয়ালে জড়ানো ছিল আর সে কাঁপছিল। চড়া কণ্ঠস্বরে আগের চেয়ে চিৎকার করছিল। (আসলে, আমার মনে হয় না, সেটা সত্যিই তার কণ্ঠস্বর ছিল।) আমার ধারণা, সে যোগাযোগ করছিল কিছুটা অন্তরে অন্তরে টেলিপ্যাথি বা ঐ ধরনের কিছু। কিন্তু তার ফল হয়েছিল আমি শুনেছিলাম বা কল্পনা করেছিলাম এক তারস্বর।

‘বাস্কেটবল কি?’ সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাস্কেটের গড়নে একটা বল? তাহলে বাস্কেট কি রকম?’

আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু জিন তারও গভীরে যেতে চায়। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন খেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তার কাছে স্পষ্ট তুলে ধরছি না। শেষ পর্যন্ত সে বলল, ‘আমাকে বাস্কেট বল খেলা দেখাতে পার?’

‘নিশ্চয়ই’ আমি বললাম, ‘আজ রাতেই এক খেলা রয়েছে। আমাকে লিয়েন্ডার টিকেট দিয়েছে। আর তুমি তো আমার পকেটে আসতেই পার।’

‘বেশ’ আজাজেল্‌ বলে ‘যখন তুমি খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হবে, তখন ডেকে নিও আমায়। এক্ষুনি আমাকে জিগমিগ শেষ করতে হবে।’ জিগমিগ মানে বোধ হয় তুর্কীর স্নান। এবং পরক্ষণেই সে অদৃশ্য হল।

মানতেই হবে, আমার জোর বিরক্তি ধরে গেল, আজাজেলের এমন নিরাসক্ত অনুদার আচরণে। আমার কাছে আমার ব্যাপারটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। … দাদু, আমার মনে হচ্ছে, ওয়েটার বিল দেওয়ার জন্য আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ওর কাছ থেকে ওটা নিয়ে, আবার গল্পকে এগিয়ে নিতে দিন।

আমি তো সে রাতে বাস্কেট বল খেলা দেখতে গেলাম, আজাজেকে পকেটে পুরে। খেলা দেখার জন্য সে পকেট থেকে মাথাটি উঁচুতে রাখছিল আর কেউ যদি তাকে দেখে ফেলত তো মস্ত জিজ্ঞাসা! তার ত্বক উজ্জ্বল লাল ও কপালের ওপর দুটি শিং-এর ছোট্ট ছোট্ট দলা। ভাগ্যিস, সে সবসুদ্ধ বেরিয়ে পড়েনি, কারণ তার গঠনে সবচেয়ে প্রকট আর সবচেয়ে বিশ্রী ছিল তার এক সে.মি. লম্বা মাংসল পুচ্ছ।

আমি নিজে বাস্কেটবলের সূক্ষ্ম গুণগ্রাহী ভক্ত নই, বরং কী ঘটছে, তা বুঝে নেওয়ার ভার আজাজেলের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তার বুদ্ধি মানুষের মতন না হয়ে, জিনের বুদ্ধি হলেও তা যথেষ্ট তীক্ষ্ণ ছিল।

খেলার শেষে সে মন্তব্য করল, খেলার মাঠে গাব্দা-গোব্দা জবরজং, যাচ্ছেতাই মানুষগুলোর ঝাঁপাঝাঁপি থেকে আমার যতদূর মনে হল, যখনই গর্তের মধ্য দিয়ে বলটি গলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, তখনই ভরপুর উত্তেজনা।

‘ঠিক তাই’ আমি বলি, ‘তুমি এক বাস্কেট জিতলে।’

‘তাহলে, তোমার এই আশ্রিত, এই বোকা বোকা খেলায় এক বীরোচিত খেলোয়াড় হতে পারত, যদি সে প্রতিবারই গর্তের মধ্যে দিয়ে বলটাকে গলিয়ে দিতে পারত।’

‘একদম ঠিক।’

আজাজেল্ চিন্তিত হয়ে লেজ দোলাল। ‘সেটা খুব বেশি কঠিন হবে না। আমাকে শুধু ওর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলি নিয়ন্ত্রিত করে দিতে হবে, যাতে সে দিক নির্ণয়, উচ্চতা, কতটা জোর দিতে হবে ইত্যাদি সঠিক বিচার করতে পারে। এক মুহূর্তের জন্য ফের চিন্তামগ্ন হয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘দেখা যাক! আমি, খেলা চলাকালীন ওর নিজস্ব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে বুঝে নিয়েছি। …

হ্যাঁ হয়ে যাবে। আসলে হয়েই গেছে। তোমার লিয়েন্ডারের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না, বল গর্তের মধ্য দিয়ে গলবেই গলবে।…’

পরবর্তী নির্ধারিত খেলার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি খানিক উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। ছোট্ট জুনিপারকে একটা কথাও বলিনি। কারণ সে পর্যন্ত আমি আজাজেলের দানবিক শক্তি ব্যবহার করিনি এবং ওর কথাবার্তার সঙ্গে কার্যকলাপের কতটা সঙ্গতি থাকছে, সে সম্পর্কেও সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলাম না। তাছাড়া আমি তাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। (এবং তার পর যা ঘটেছিল, তাতে জুনিপার বিষম বিস্মিত হয়েছিল, আমিও।’)

অবশেষে খেলার দিন এসেই গেল, এবং খেলা শুরু হল। আমাদের স্থানীয় কলেজ নাদসভিলে টেক, যার বাস্কেটবল টিমে লিয়েন্ডার ছিল নিভু নিভু জ্যোতিষ্ক, আল্ কাপোন রিফর্মেটরি সংস্থার ঢ্যাঙঢেঙে লম্বা ও গাট্টাগোট্টা খেলোয়াড়দের মোকাবিলা করছিল এবং দর্শকদের প্রত্যাশা ছিল অভাবনীয় কিছু ঘটার।

কিন্তু কতটা অভাবনীয়, এ বিষয়ে আন্দাজ ছিল না। কাপোন-এর পাঁচজন অগ্রণী ভূমিকা নিল আর আমি লিয়েন্ডারকে তীক্ষ্ণ নজরে রাখলাম। মনে হল, কি করে উঠবে, বুঝতে লিয়েন্ডারের কষ্ট হচ্ছে এবং প্রথমে মনে হল, বলকে গর্তে গলিয়ে দিতে তার হাত ঠিক নাগাল পাচ্ছে না। তার তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা এতটাই পাল্টে গিয়েছিল, সে প্রথম প্রথম সমস্ত পেশী, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, সে যেন নবীন দেহে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বল ধরতেই তার হাত থেকে বল যেন পিছলিয়ে গেল। এ এক অদ্ভুত পিছলানো। বেঁকে গেল আকাশে, উঁচুতে এবং টুপ্ করে সিঁধিয়ে গেল গর্তে। দর্শকদের ভিতর বন্য উল্লাস আর লিয়েন্ডার চিন্তিতভাবে গোলের গর্তে তাকিয়ে রইল, কি যে ঘটে গেল, তাতে সে নিজেই বিস্মিত। যাই-ই ঘটুক, পুনরাবৃত্তি হতে থাকল বারংবার। লিয়েন্ডার বল ছোঁয়ামাত্র, বল ফকিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। আর বাঁকতে বাঁকতে ঘুরতে ঘুরতে আশ্রয় নিচ্ছে গোলের গর্তে। ঘটনাগুলো এতই দ্রুত ঘটে চলল, কেউ লিয়েন্ডারকে বলের লক্ষ্যে একাগ্র হতে বা কোনো চেষ্টা করতেই দেখতে পেল না। স্পষ্ট এক অদ্ভুত কৌশল মনে করে দর্শক জনতা উত্তরোত্তর উন্মত্ত হয়ে উঠল।

কিন্তু ততক্ষণে সাংঘাতিক গোলমাল যা ঘটার ঘটেই গেছে। সমগ্র খেলা চরম বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত। দর্শকমণ্ডলী থেকে সিটি মারার সাথে সাথে তীব্র ধিক্কার উঠছে। আমি আজাজেকে যা বলতে ভুলেছিলাম। আসলে, যা সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝে নেওয়া উচিত। আজাজেল্ সেটাই বোঝেনি। আজাজেল্ বোঝেনি দুটি বাস্কেটের একটি নিজের দল ও অন্যটি বিপরীত দলে। প্রতিটি খেলোয়াড়কে অন্য পক্ষের সঠিক বাস্কেটে বলটি ছুঁড়তে হবে। অচেতন বস্তুর শোচনীয় অজ্ঞতা নিয়ে, লিয়েন্ডারের ছোঁয়া বল, বেঁকে যাচ্ছিল সেই বাস্কেটের গর্তে, যেটি লিয়েন্ডারের কাছে রয়েছে। লিয়েন্ডার গোল করছিল, নিজেদের বাস্কেটেই। বল তার হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্র ধাবিত হচ্ছিল, তার নিকটতম বাস্কেটে।

নার্দস ভিলেরকাচের মিনতিপূর্ণ নিষেধ সত্ত্বেও, লিয়েন্ডারকে বারবার এই কাজটি করতে হচ্ছিল। কোচ ক্লজ (পপ্) ম্যাক ফাং, নরম ওষ্ঠ-আবরণীর আড়াল থেকেই চিৎকার করছিলেন। ফল হয়নি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে পপ ম্যাক ফাং দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন আর সর্বসমক্ষে কেঁদেই ফেললেন। কারণ লিয়েন্ডারকে খেলা থেকে বার করে দিতে হবে। লিয়েন্ডারের গলা থেকে সকলে তাঁর আঙুল সরিয়ে দিল, যাতে লিয়েন্ডারকে তখনই বহিস্কার করা যায়।

বন্ধু, লিয়েন্ডার আর সে লিয়েন্ডার রইল না। স্বভাবতই আমি ভেবেছিলাম, সে সুরার মধ্যে মুক্তি খুঁজবে এবং কঠোর চিন্তামগ্ন সুরাসক্ত মানুষে পরিণত হবে। কিন্তু তা হয়নি। সে অন্তরের অন্তস্তলের গহীনে গেল। পড়াশোনায় ডুবে রইল। সহপাঠীদের অবজ্ঞা ও করুণার দৃষ্টি মাথায় নিয়ে, সে নিয়মিত ক্লাস করে চলল। বইতে মাথা গুঁজে, অহরহ পাঠচর্চায় নিবেদিত হয়ে গেল।

এত কাণ্ডের পরও কিন্তু জুনিপার তার সঙ্গে ছিল। অশ্রুবর্ষণ না করে ঝাপসা চোখে জুনিপার বলত ‘ওর আমাকে প্রয়োজন।’ স্নাতক হওয়ার পর সব ছেড়ে জুনিপার, লিয়েন্ডারকে বিবাহ করেছিল। জুনিপার লিয়েন্ডারের সঙ্গেই জীবন কাটাচ্ছে। লিয়েন্ডার এখন পদার্থ বিদ্যায় পিএইচডি করে পরিচয়যোগ্য জ্ঞানী পুরুষ।

তারা দুজন পশ্চিমের দিকে একটা ছোট কো-অপারেটিভে বাস করে। যতদূর জানি, লিয়েন্ডার ফিজিক্স পড়ায়। আর লিয়েন্ডারকে যারা আগে থেকে চিনত স্কটল্যান্ডবাসী সৈনিক হিসেবে, তারা কিন্তু নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে বলে, লিয়েন্ডার নোবেল পুরস্কারের জন্য এক সম্ভাব্য প্রার্থী।

জুনিপার কখনো অনুযোগ জানায় না, সে তার আদর্শ প্রেমিকের প্রতি বিশ্বস্ত। কথায় বা কাজে তার কোনো কিছু খোওয়ানোর আক্ষেপ নেই। তাই বলে, সে বুড়ো ধর্মবাপকে বোকা বানাতে পারবে না।

আমি খুব ভাল করে জানি, কখনো কখনো তার ঐকান্তিক ভাবনায় ভাসে, এক আঙ্গুরলতাঘেরা প্রাসাদ, যা কখনো তার আয়ত্তে আসবে না। আর পাহাড় ঘেরা দূর দিগন্ত বিস্তৃত তার স্বপ্নের ছোট্ট তালুক, যা তার নাগালের বাইরে।

‘এই হল গল্প,’ থামলেন জর্জ। ওয়েটার যা ফেরত এনেছিল, তা তুলে নিয়ে জর্জ, ক্রেডিট কার্ড রসিদের মোট ডলারের পরিমাণটা লিখে নিলেন (হয়তো, তার আয়কর ছাড়ের কাজে লাগবে, মনে হল আমার) তারপর আরো বললেন, ‘আমি যদি আপনি হতাম, তবে বড় রকমের বকশিস ছেড়ে যেতাম।’

তাই-ই করলাম আমি, তবে খানিক হতবুদ্ধির মতন। জর্জ হেসে বের হয়ে গেলেন। অবশ্য, ফেরত ডলার না নিয়ে, ক্ষতি হয়েছে বলে, আমার অনুতাপ হল না। আমার মনে হল, জর্জের মাত্র একবার মুফতে আহার মিলেছে আর আমি পেয়েছি একটা গল্প। যা আমার মতো করে বলতে পেরে, আহারের তুলনায় অনেক গুণ অর্থ আমি উপার্জন করব। আসলে, আমি স্থির করেই ফেললাম, এখন থেকে মাঝে মাঝেই জর্জের সঙ্গে আমি রাতের খাবার চালু করবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *