যে হাসিটি হেরে যায়

যে হাসিটি হেরে যায়

হালে আমি বন্ধু জর্জকে বলছিলাম, যখন সে সুরায় বুঁদ (তার মদে; আমি তো নিচ্ছিলাম আদ্রক সুরা), ‘তোমার আজ্ঞাবহ দাসের খবর কি, আজকাল?’

জর্জের দাবি, তার আজ্ঞা পালনে সদাতৎপর এক দুই সে.মি. দীর্ঘ জিন রয়েছে। সে যে মিথ্যা বলছে, এমন স্বীকারোক্তি সে আমার কাছে বা অন্য কারো কাছে কখনো করেনি।

জর্জ রুষ্ট নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও: আপনি তার কথা জানেন! না? আশা করি, আর কাউকে বলেন নি?’

‘একটা শব্দও নয়।’ আমি বলি, ‘এটাই যথেষ্ট যে আমি মনে করি, তুমি একটা পাগল। আমি চাই না, আমার সম্পর্কেও কেউ এমন ভাবুক!’ (তাছাড়া আমার জ্ঞানত তিনি নিজেই অন্তত আধডজন লোককে জিনের সম্বন্ধে বলেছেন। কাজেই আমার সেই বিশেষ ব্যক্তিটি হওয়ার আবশ্যকতা নেই।)

জর্জ বললেন, ‘আপনার মতো ঘৃণ্য অক্ষমতা আমার নেই, যা আপনি বোঝেন না, তা বিশ্বাস করেন না। আর আপনি তেমন বিশেষ বোঝেনও না, যা এক পাউন্ড প্লুটোনিয়ামতূল্য হতে পারে। আমার জিন যদি জানতে পারত, তাকে আপনি দাস বলেছেন, তবে আপনার কী বাকী থাকবে?

এই ভয়াবহ সতর্কবাণী সত্তেও বিচলিত না হয়ে বলি, ‘আপনি কি তার আসল নাম জানতে পেরেছেন?’

‘না, পারিনি। পার্থিব ওষ্ঠ দ্বারা তার উচ্চারণ সম্ভব নয়। আমি যতটুকু বুঝেছি, অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘আমি হচ্ছি রাজার রাজা, তোমরা শক্তিমান ও হতাশ-’

‘এটা অবশ্য মিথ্যে।’ খোশমেজাজে নিজের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিজের জগতে সে নগণ্য হবে। সে কারণেই সে আমাদের এখানে সাহায্যের হাত বাড়ায়। আমাদের জগতের আদিম প্রযুক্তির তুলনায় সে বড়াই করতে পারে।’

‘এর আগেও সে তার ক্ষমতা জাহির করেছে কি?’

‘সত্যি বলতে কি, হ্যাঁ।’ আমার দিকে জর্জ তার বিবর্ণ নীল চোখ তুলে এক মস্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। জোর নিঃশ্বাসের তোড় সামলিয়ে তার কর্কশ সাদা গোঁফ ধীরে ধীরে বশে এল।

জর্জ বলতে লাগলেন, ‘প্রথম শুরু হয়েছিল আমার এক ভাগ্নির বান্ধবী রোজি ও’ডোনেল এর তুচ্ছ একটা ফটোগ্রাফ নিয়ে। মেয়েটি ছিল নীলনয়না এবং প্রায় আমার মতোই বুদ্ধিদীপ্ত। পিঙ্গল, মসৃণ, চকচকে দীর্ঘ কেশ। পাউডার লাগানো ছোট্ট কৌতুকপূর্ণ নাসিকা, টিপে রঞ্জিত, যারা রোমান্স লেখে, তাদের ভাল লাগবেই। ছিল মহিমামণ্ডিত গ্রীবা। সে ছিল তন্বী, শিখরি দশনা। শরীরে না আছে বাহুল্য, না আছে ঘাটতি এবং প্রফুল্লরূপিনী।

অবশ্যই সব কিছু যুক্তির খাতিরেই চমৎকার লেগেছিল আমার। কারণ বহু পূর্বেই আমি সেই বিশেষ বয়সটি পার হয়ে এসেছি। এখন তাদের শারীরিক স্পর্শে তখনই যাই, যদি নারী নিজে থেকে আগ্রহী হয়। ভাগ্যকে ধন্যবাদ, যা আজকাল প্রায় ঘটেই না। হয়তো বা কখনো সখনো সপ্তাহান্তে।

তাছাড়াও রোজি সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং যে কোনো কারণেই হোক বিশেষ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দীর্ঘদেহী আইরিশ পুরুষটির প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সুগঠিত দেহের অধিকারী ভদ্রলোক সম্ভবত বদমেজাজি ছিলেন এবং তিনি নিজেও তা লুকোবার চেষ্টা করতেন না। যদিও আমি নিঃসংশয় ছিলাম আমার তরুণ বয়স হলে, পতিটিকে আমি ঠিকই সামলিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি আর তরুণ নই, যদিও ফারাকটা অল্প।

সেই জন্য খানিক অনিচ্ছাসত্ত্বেও রোজির নিজের বান্ধবীদের মতোই আমাকে গ্রহণ করার ভুলটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। সে আমাকে তার মেয়েলি আস্থার মধ্যে নিয়ে নিয়েছিল। এখন আমি তাকে দোষ দেই, বুঝতেই পারছেন। আমার স্বাভাবিক মর্যাদা এবং বাস্তব সত্যও বটে। আমার চেহারা এক বা একাধিক রোমান সম্রাটের কথা মনে করিয়ে দিত। অবধারিতভাবে সুন্দরী যুবতীরা আমার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। আমি কখনো বেশি দূর আগাতাম না। আমি সব সময়ে আমার ও রোজির মধ্যে যথেষ্ট গণ্ডী টানতাম। কারণ আমি চাইতাম না, কথা বাড়তে বাড়তে গুজব ছড়িয়ে, বদমেজাজী কেভিন ওডোনেল এর কাছে পৌঁছে যাক।

‘ওঃ জর্জ,’ একদিন রোজি বলল, তার ছোট্ট হাতে আনন্দে তালি দিয়ে, ‘আপনি ধারণা করতে পারবেন না, কেভিন আমার কতটা প্রিয় আর সে আমায় কতটা সুখী করেছে। জানেন, সে কি করে?’

‘আমি কেমন করে বলব?’ খুব সাবধানে শুরু করি, স্বভাবতই অশালীন কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়, ‘তোমার কি উচিত— ‘

কিন্তু রোজি ভ্রূক্ষেপই করল না, বলে চলল, ‘নাক কুঁচকিয়ে চোখ নাচিয়ে কেভিন এক বিশেষ ভঙ্গিতে ঝকঝকে হাসি হাসে, তখন চারিদিক খুশিতে ঝল্‌মল্ করে। মনে হয় যেন সারা বিশ্ব সোনালি রোদে ভরে গেছে। ওহ্! যদি কেভিনের অমন একটা ছবি আমার কাছে থাকতো। আমি চেষ্টা করেছিলাম, ফটো নিতে। কিন্তু ঐ ভঙ্গিমায় ধরতে পারিনি।’

আমি বললাম, ‘আসল জিনিস নিয়ে কেন সন্তুষ্ট থাকছো না, সোনা?’

‘ওঃ আচ্ছা!’ চমৎকার লজ্জা পেয়ে রোজি ইতস্তত করে বলল, ‘আসলে, সব সময় সে অমনটি থাকে না। বিমানবন্দরে সে ভারি কঠিন চাকরি করে এবং কখনো কখনো ভয়ানক ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে ফেরে। আর সে সময় সে স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে, আমার ওপর একটুকুতেই অখুশি হয়। আমি যদি তার প্রকৃত চেহারাটা ফটোতে ধরে রাখতে পারতাম, সেটা আমার কাছে ভারী আরামের হত, পরম স্বস্তিকর। বলতে বলতে, তার নীল চোখ, বিনা অশ্রুপাতে ঝাপসা হয়ে এল।

স্বীকার করতেই হবে, আজাজেলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার জন্য, আমাকে এক ছোট্ট আবেগ ধাক্কা দিল (তাকে তো আমি ঐ নামেই ডাকি, কারণ সে আমাকে তার আসল নামের অনুবাদ যা জানিয়েছিল, সেই সম্বোধন আমি করি না)। রোজিকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আজাজেল্‌ তার জন্য কী করতে পারে।

যাই হোক্, আমি যারপরনাই বিচক্ষণ এবং আমার তো সামান্যতম ধারণাই নেই, কি করে আপনি আমার জিন সম্বন্ধে জেনে গেছেন। তাছাড়া নিজের আবেগের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সহজ, কারণ আমি দৃঢ়চিত্ত, বাস্তববাদী মানুষ। নির্বোধ ভাবপ্রবণতার শিকার নই। অসামান্য সুন্দরী মিষ্টি মেয়েদের জন্য আমার কঠিন হৃদয়েও অংশত কোমল এক অঞ্চল রয়েছে, মানছি, অবশ্যই মহিমময় পিতৃসুলভ ব্যবহারে।

আজাজেল্‌ সম্পর্কে বিশদ অবগত না হয়েও রোজিকে আমি বাধিত করতে পারতাম। সে যে আমাকে অবিশ্বাস করতো তা নয়, কারণ আমি এমনই একজন মানুষ, যার মুখের কথা মানেই প্রতিষ্ঠিত সত্য, সকলের কাছে। শুধু তারা ছাড়া, যারা আপনার মতন মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমি আজাজেকে ব্যাপারটা বললাম। সে কিন্তু কোনো মতেই সন্তুষ্ট হল না। বলল, ‘তুমি অবাস্তব কিছু চাইছ।’

আমি বললাম, ‘মোটেই নয়। মাত্র একটা সাধারণ ফটোগ্রাফ চাই। তুমি একে বাস্তবায়িত কর।’

‘এইটুকু করতে হবে! এটা যদি এতই সহজ, তবে তুমিই কর। আমার বিশ্বাস তুমি ভর ও শক্তির সমতা বুঝবে।’

‘শুধুমাত্র একটি ফটোগ্রাফ।’

‘এবং এমন এক ভাব ফুটে ওঠা চাই, যার কোনো সংজ্ঞা নেই বা তুমি বর্ণনা করতেও পারছ না।’

‘স্বাভাবিক। আমি তো কখনো দেখিনি, কেভিন তার স্ত্রীর দিকে কীভাবে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আমার অগাধ বিশ্বাস তোমার ক্ষমতার ওপর।

আমি বরং আশা করলাম, আমার এই দুর্বল প্রসঙ্গ আজাজেল্‌কে সঠিক আসনে বসিয়ে দেবে। আজাজেল্‌ গোমড়া মুখে বলল, ‘তোমাকেই ফটো নিতে হবে।’

‘কিন্তু আমি তো ঠিক ঠিক-

‘দরকার নেই। সে চিন্তা আমার। কিন্তু অবাস্তবকে সামনে আনতে, প্রকৃত বস্তু লক্ষ্যে থাকলে, কাজটা সহজ হয়। একটা ফটোগ্রাফ, বলতে গেলে অসাধারণ ফটো, সে রকমটাই তোমার কাছে আশা করব। এবং মাত্র একটাই কপি, তার বেশি আমি সামাল দিতে পারব না। আর আমার কর্মক্ষম পেশীকে কষ্ট দেবো না, না তোমার জন্য, না তোমার জগতের মূর্খ মানুষগুলোর জন্যে।’

‘আচ্ছা বেশ!’ আজাজেল্‌ প্রায়ই খেয়ালী হয়ে পড়ে। আশা করি, সেটা শুধুমাত্র নিজের ভূমিকা জোরদার করতে এবং যাতে সে যে সব সময়েই আপনার বাক্য মানবে, এমন ধারণা আপনার না জন্মায়।

ও-ডোনেল দম্পতির গীর্জা থেকে ফেরার পথে, পরের রবিবার আমার তাদের সঙ্গে দেখা হল (আসলে আমি নিজেই তাদের অপেক্ষাতে ছিলাম)। রবিবারের কারুকার্যখচিত বিশেষ পোশাকে, তারা আমাকে ফটো তুলবার অনুমতি দিল। রোজি ভারি উৎফুল্ল। কিন্তু কেভিন একটু মেজাজ দেখাল। যথাসম্ভব অশোভন না হতে হয়, সেদিকে চোখ রেখে, সামনাসামনি কেভিনের মুখের ফটো নিলাম। এমন কোনো উপায়ই ছিল না, যাতে কেভিনকে হাসি বা তার গালের টোল বা নাক কোঁচকানো বা অন্য কিছু যা রোজির কাছে দারুণ আকর্ষক ছিল, সে সব কিছু পেতে পারি। এমন কি আমি এ বিষয়েও নিশ্চিত ছিলাম না, যে ক্যামেরা ঠিক মতন ফোকাস করা হয়েছিল কিনা! যতই হোক, আমি শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফারদের একজন নই।

এরপর আমি এক পাকা ফটোগ্রাফার বন্ধুর কাছে গেলাম। সে দুটো নেগেটিভই প্রিন্ট করল আর কেভিনের মুখচ্ছবিকে ৮ ́-১০ ́ ́ আকারে এনলার্জ করতে গেল। সে কী পরিমাণ ব্যস্ত, এমনি কিছু বলে গজগজ করতে করতে কাজটা করল। আমি তার কথায় কর্ণপাত করলাম না। যতই হোক, যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে আমি মগ্ন ছিলাম, তুলনায় ফটোগ্রাফারের নির্বোধের মতন কার্যকলাপের সম্ভাব্য মূল্য কতটুকু ছিল? অধিকাংশ লোক, যারা এটা বোঝে না, তাদের সম্পর্কে আমি সব সময়ে বিস্ময় বোধ করি।

এনলার্জ করা শেষ হতেই, তার ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ফটোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, আমাকে দোষারোপের সুরে বলল, ‘একথা আমাকে বলো না, যে, এমন ফটো তুমি তুলেছ!’

‘কেন নয়?’ বলেই আমি ফটোটি নিতে হাত বাড়ালাম। কিন্তু সে আমাকে ফটোটা দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাল না।

‘তুমি কি আরো কপি চাও?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

‘না।’

তার কাঁধের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দৃঢ় সুরে বললাম, ‘না উজ্জ্বল রঙে ফটোগ্রাফটি ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে স্বচ্ছ স্পষ্ট ও নিখুঁত। কেভিন ও’ডোনেল হাসছে। যদিও যখন ফটো নিয়েছিলাম, তখন সত্যিই সে হাসছিল কিনা, আমি মনে করতে পারি না। তাকে সুদর্শন ও প্রফুল্ল মনে হয়েছিল, কিন্তু আমি সে ব্যাপারে উৎসুক ছিলাম না। হয়তো একজন নারী আরো বিশদভাবে লক্ষ্য করে কিংবা যেমন ঘটেছিল আমার ঐ ফটোগ্রাফার বন্ধুটির মতন কেউ, যার আমার মতো দৃঢ় পৌরুষ নেই, সেও লক্ষ্য করতে পারে।

ফটোগ্রাফার বন্ধুটি বলল, ‘একটা মাত্র, অন্তত আমার জন্য একটা।’

‘না,’ দৃঢ় স্বরে বললাম। তার কব্জি চেপে ধরে রেখে ছবিটি নিলাম। যাতে সে কেড়ে নিতে না পারে। ‘আর নেগেটিভটি দাও অনুগ্রহ করে। তুমি অন্যটি রেখে দিতে পার, যে পোজুটি দূর থেকে নেওয়া।’

‘ওটা আমার চাই না,’ রাগ রাগ ভাব দেখিয়ে বলল সে। আমি তো বেরিয়ে এলাম, আর তাকে দেখাচ্ছিল যেন এক হতভাগা। আমি ছবিটা বাঁধিয়ে এনে তাকে রেখে, আবার ফিরে তাকালাম। সত্যিই এক অদ্ভুত দীপ্তি শোভা পাচ্ছে ছবিটিকে ঘিরে। আজাজেল্‌ চমৎকার কাজ করেছে। আমার অবাক লাগল এই ভেবে, রোজির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে! তাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি তার বাড়ি আসতে পারি!’

সে জানাল, ‘সে দোকানে বার হচ্ছে, তবে আমি যদি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছতে পারি-’ আমি রওনা হলাম।

ফটোটিকে উপহার হিসেবে কাগজের মোড়কে জড়িয়ে, কথাটি না বলে, তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।

‘বাপরে,’ বলেই সে দড়ি কেটে মোড়ক ছিঁড়ে ফেলল, ‘আরে এটা কি! আজ কি কোনো উৎসবের কিংবা’- ততক্ষণে সে ছবিটি বার করে ফেলেছে আর তার বুলি বন্ধ হয়ে গেল। চোখ বড় বড় হল, নিঃশ্বাস দ্রুততর আর সে ফিসফিসিয়ে বলতে পারল, ‘ওঃ আমার!’

আমার দিকে তাকাল এবার, ‘আপনি কি গত রবিবার এই ছবিটা তুলেছিলেন?’ আমি ঘাড় নাড়লাম।

‘কিন্তু, আপনি ওকে নিখুঁত ধরে ফেলেছেন। ও যে, পুজো পাবার মতন। এই সেই চাহনি। ও হো, আমি কি নেবো নাকি?’

সরলভাবে বলি, ‘তোমার জন্যই তো এনেছি।’

আবেগে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে জোরসে চেপে এক চুমু খেয়ে ফেলল। আমার মতন লোক, যে আবেগ পছন্দ করে না, তার পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর। এরপরেই আমাকে গোঁফ মুছতে হল, কিন্তু আমি বুঝলাম, আবেগ সংযত করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

তারপর সপ্তাহখানেক রোজির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। একদিন বিকেলে দেখা হয়ে গেল, মাংসের দোকানের বাইরে। আর তখন যদি আমি তার বাজারের থলিটি বাড়ি পর্যন্ত বয়ে না দিই, তবে সত্যিই খারাপ দেখায়। স্বভাবতই আমি ভাবছিলাম, সে যদি আবার আমাকে চুমু খেতে আসে, তবে প্রত্যাখান করলে, আমার সোনাকে আহত করা হবে। যাই হোক, রোজি চোখ নত করে রইল।

‘কেমন ছিল ফটোটি।’ জিজ্ঞাসা করি। মনে হচ্ছিল ভাল কিছু শুনব না, হয়তো, কিন্তু তক্ষুনি সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘নিখুঁত। রেকর্ড প্লেয়ারের স্ট্যান্ডের ওপর ওটা রেখেছি, এমনভাবে যাতে ডাইনিং টেবিলে আমার চেয়ার থেকে সোজাসুজি দেখা যায়। কেভিনের চোখ একটু তেরছাভাবে আমাকে দেখছে, দুষ্টু চোখ আর ঠিক তেমনিভাবে কোঁচকানো নাক। সত্যি কথা বলতে কি, এত জীবন্ত! আমার কোনো কোনো বন্ধু চোখ ফেরাতে পারে না। আমি ভাবছি, ফটোটা লুকিয়ে রাখতে হবে, নয়তো ওরা ওটা চুরি করে নিতে পারে।’

ঠাট্টা করে বলি, ‘আর যদি মানুষটাকে চুরি করে?

রোজির মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, তা হতে পারে না।’ আমি অন্য পথ ধরলাম, ‘কেভিন ফটো সম্পর্কে কি বলছে?’

‘সে একটা কথাও বলেনি। একটাও না। আসলে সে ভাল করে দেখতেই জানে না, জানেন? আমার অবাক লাগে, সত্যিই কি সে কিছু দেখতে পায়?’

‘তুমি কেন তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছ না, সে কী ভাবছে!’

অর্ধেক ব্লক ভারী থলি নিয়ে, তার পাশে হাঁটছিলাম, কিন্তু সে চুপচাপ! ভাবছিলাম, সে একটি বাড়তি চুমুর আশা করছে?

‘আসলে’ হঠাৎ সে মুখ খুলল, ‘(কাজের জায়গায় এখন ওর সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা। ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করার এটা ঠিক সময় নয়। ও দেরি করে বাড়ি ফেরে, আর আজকাল আমার সঙ্গে প্রায় কথাই বলে না। আপনি ভাল করেই জানেন, পুরুষ মানুষ কেমন হয়!’ সে খিলখিলিয়ে হাসতে চেয়ে ব্যর্থ হল।

তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে থলিটি তার হাতে দিলাম।

রোজি আন্তরিকভাবে বলল, ‘আপনাকে আবার ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ, ফটোটির জন্য।’

সে চলে গেল, চুমু খাওয়া হল না। আমি চিন্তায় নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাড়ির অর্ধেক পথ পার হয়ে এসেছি, খেয়াল করিনি। তখন রোজির হতাশা দূর করতে ফিরে যাওয়া বোকা বোকা দেখাবে।

প্রায় দশ দিন পর, এক সকালে রোজি আমাকে ফোন করল। আমি কি তার বাড়িতে তার সঙ্গে লাঞ্চ করতে আসতে পারি! আমি একটু থতমতিয়ে গেলাম, ‘এটা কি একটু বাড়াবাড়ি হবে না। পাড়াপড়শীরা কী ভাববে?’

‘কি যে বোকার মতন বলেন!’ রোজি বলল, ‘আপনার এত বয়স হয়ে গেছে, মানে আমি বলতে চাইছি, আপনি আমাদের এত পুরনো বন্ধু, তারা এমন কখনোই— তাছাড়া আমি যে আপনার পরামর্শ চাই।’

মনে হল, কথা বলতে বলতে সে কান্না চাপছে। আচ্ছা, যা হোক। ভদ্রলোকের ব্যবহার তো করতেই হয়। অতএব দুপুরে আমি রোজির রোদঝলমলে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হলাম। হ্যাম আর চীজ স্যান্ডউইচ তৈরি করেছিল রোজি। আর ছিল আপেল পাই-এর বরফি। রেকর্ড প্লেয়ারের স্ট্যাণ্ডে শোভা পাচ্ছিল ফটোগ্রাফটি।

রোজি আমার সঙ্গে করমর্দন করল বটে, কিন্তু চুমু খাওয়ার কোনো চেষ্টাই করল না। তাতে আমি নিশ্চিন্ত কিনা বড় কথা নয়, কারণ তার চেহারা দেখে আমার খারাপ লাগছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল। রোজিকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। আমি অর্ধেক স্যান্ডউইচ্ খেয়ে, রোজির বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যখন সে কোনো কথাই বলল না, আমি সরাসরি কারণ জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম। ভারি বিষণ্ন বাতাস চারপাশ ঘিরে ছিল।

বললাম, ‘তবে কি কেভিন?’ নিশ্চিত ছিলাম, সেটাই কারণ। মাথা নেড়ে রোজি ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি তার হাতে চাপ দিলাম, কিন্তু তাতে সে সান্ত্বনা পেল বলে মনে হলো না। তার কাঁধ ঝাঁকাতে, অবশেষে সে বলল, ‘আমার মনে হয়, কেভিনের চাকরি চলে যাচ্ছে!’

‘হতেই পারে না। কেন!’ কেভিন খানিক অভদ্র, হয়তো বা তার কাজের জগতেও। কতদিন সে হাসেনি, আমাকে চুমো খায়নি। কবে যে ভাল করে কথা বলেছে, মনেই পড়ে না। কী যে হয়েছে, বলে তো না-ই-ই। জিজ্ঞেস করলে, আমার ওপর ফুঁসে ওঠে। আমাদের এক বন্ধুও বিমানবন্দরে কাজ করে। সে কাল ফোন করেছিল। সে বলেছে, ‘কেভিন সর্বদা গোমড়া মুখে থাকে, কাজে যে একেবারেই স্ফূর্তি নেই, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও নজরে পড়েছে। আমি নিশ্চিত ও কাজ খোয়াতে বসেছে। এখন আমি কী করি!’

আমাদের গতবারের সাক্ষাতের পর থেকে আমি এমনই একটা কিছু আন্দাজ করছিলাম। আর জানতাম, ‘এবার সত্যি কথাটা বলতেই হবে। আজাজেল্‌ চুলোয় যাক। আমি গলা সাফ করে বললাম, রোজি ঐ ফটোগ্রাফটা…’

‘হ্যাঁ, আমি জানি। বলেই রোজি ওটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। এটাই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই হল আমার কেভিন। আমি সব সময়ে তার সঙ্গে রয়েছি। যাই-ই ঘটুক না কেন। রোজি আবার ফোঁপাতে শুরু করল। আমি খুব মুশকিলে পড়লাম, কী বলব, কী বলা উচিত। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই।

আমি বলি, ‘তুমি জান না রোজি, ঐ ফটোটাই যত নষ্টের গোড়া। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। ফটোগ্রাফের সৌন্দর্য ও প্রফুল্লতা অন্য কোথাও থেকে এসেছে। এটা কেভিনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তুমি বুঝতে পারছ না?’

রোজি ফোঁপানি বন্ধ করল। ‘কী বলছেন কি আপনি? একটা ফটোগ্রাফ মাত্র। আলোর ফোকাসে, ফিল্ম থেকে তৈরি হয়েছে বা ওই রকম কিছু।’

‘সাধারণভাবে তাই। কিন্তু এই ফটোগ্রাফ-’ আমি আশা ছেড়ে দিলাম। আমি জানতাম আজাজেলের তাৎক্ষণিক তৎপরতা। কিন্তু তার বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আমি রোজিকে দিতে পারছিলাম না- ‘আনন্দের সংরক্ষণ নীতি’।

‘তাহলে, এভাবে বোঝাচ্ছি,’ বললাম আমি, ‘যতক্ষণ ঐ ফটোগ্রাফ থাকবে, কেভিন থাকবে অসুখী, রাগী ও বদমেজাজী। ওই ফটো কেভিনের হাসি কেড়ে নিয়েছে।’

‘কিন্তু এটা তো এখানেই থাকবে।’ রোজি সজোরে ফটোটি স্ট্যান্ডে বসিয়ে দিল। ‘এই আশ্চর্য ফটো সম্পর্কে, আপনি ক্ষ্যাপার মতন কেন অমন অদ্ভুত কথা বলছেন। দাঁড়ান কফি বানাই।’ রোজি ঝটতি রান্না ঘরে দৌড়াল। আর আমি দেখলাম, সে ভীষণ মর্মাহত হয়েছে।

একটা কাজই সম্ভবত আমি করতে পারতাম। যতই হোক, আমিই ফটোটা তুলেছি। আজাজেলের মধ্য দিয়ে আমিই তো দায়ী। ফটোটির রহস্যময় গুণাগুণের জন্য। ঝট্‌তি ফ্রেমটি উঠিয়ে নিলাম। সাবধানে পিছনটি সরিয়ে ফেললাম। তারপর ফটোটি। ফটোটিকে প্রথম দু টুকরো, তারপর পরপর চার টুকরো, আট টুকরো, ষোল টুকরো এবং শেষে টুকরোগুলো সব পকেটে ভরলাম। আমার কাজ শেষ হতে না হতেই, টেলিফোন বেজে উঠল। রোজি বসার ঘরে দৌড়ে গেল ফোন ধরতে। আমি ফ্রেমের পিছন দিকটা আটকিয়ে সেটিকে স্বস্থানে রেখে দিলাম। ওখানেই রইল। ফাঁকা, খালি।

আমি রোজিকে খুশিতে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠতে শুনলাম, ‘ওঃ কেভিন, ‘ শুনতে পেলাম সে বলছে, ‘কী আশ্চর্য,’ আমার এত আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু তুমি আমাকে বলনি কেন? আর কক্ষনো এমন করবে না।’

সে ফিরে এল, সুন্দর মুখ দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে। ‘আপনি জানেন দুষ্টু কেভিন কি বলেছিল? ওর কিডনিতে স্টোন দেখা গিয়েছিল সপ্তাহতিনেক আগে। ডাক্তার দেখাচ্ছিল, যত হাঙ্গামা, লাগাতার যন্ত্রণা, কাটা ছেঁড়া। আর আমাকে সে কিছুই জানায়নি। পাছে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই! বোকা কোথাকার। আশ্চর্য কী, যে তার অমন শোচনীয় অবস্থা হবে! ওর একবারও মনে হলো না, জানার চেয়ে না জানলে, ওর কষ্টে আমি আরো কষ্ট পাব! সত্যি, পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই!

‘কিন্তু তোমার কেন এখন এত আনন্দ হচ্ছে!’

‘কারণ, তার স্টোন বেরিয়ে গেছে। এই একটু আগে বেরিয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই ও আমাকে ফোন করেছে। সত্যিই বিবেচক, সময় মতো খবর দিয়েছে। তাকে এত খুশি আর উৎফুল্ল লাগল, এ যেন আমার সেই পুরনো কেভিন ফিরে এল। মনে হচ্ছে, আবার সেই ফটোগ্রাফের মতোই হয়ে গেছে।’

তারপরই আর্ত চিৎকার ‘একি ফটো কই?’

আমি তখন বেরুবার জন্য দুপায়ে খাড়া। হনহনিয়ে দরজার দিকে চলছি আর বলছি, ‘আমি ওটা নষ্ট করে ফেলেছি। আর সে জন্যই স্টোন বেরিয়ে গেছে। নয়তো—’

‘আপনি নষ্ট করে ফেললেন! আপনি?’

আমি ততক্ষণে বাড়ির বাইরে। আমি রোজির কাছে কৃতজ্ঞতা আশা করি না বরং ভাবছিলাম, হয়তো আমাকে খুন করেই বসবে। আমি এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করলাম না। সোজা সিঁড়ি দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি, নামতে থাকলাম। দরজা ভেদ করে তার দীর্ঘ আর্তনাদ কানে এল আর দুটো তলা নামতে নামতেও আমি তা শুনতে পেলাম।

বাড়ি ফিরে ফটোগ্রাফের টুকুরোগুলি পুড়িয়ে ফেললাম। রোজির সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। কিন্তু খবর পেয়েছি, কেভিন প্রফুল্ল ও প্রেমময় স্বামীই রয়েছে। তারা দুজনে খুব সুখী, কিন্তু রোজির কাছ থেকে সাত পাতার চিঠি পেয়েছি। ক্ষুদে ক্ষুদে লেখা। অসঙ্গতিতে ভরা, পরিষ্কার বোঝাতে চেয়েছে, তার মতে, স্টোনই কেভিনকে বদমেজাজি করে তুলেছিল, আমরা ফটো তোলা ও ছেঁড়ার সঙ্গে স্টোনের আসা-যাওয়া সমকালীনতা নেহাতই আকস্মিক। বিনা বিচারে সে আমাকে জীবনের ভয় দেখিয়েছে এবং বেশ নাটকীয়ভাবে। আমার চেহারা নিয়ে যে সব গালাগাল করেছে, তার শব্দ চয়ন প্রণালীতে বোঝা যায়, শব্দগুলো সে সম্ভবত ইতিপূর্বে নিজেও কখনো শোনেনি, ব্যবহার করা তো দূর-অস্ত।

আর আমার ধারণা, আর কোনোদিনও সে আমাকে চুমু খাবে না, কোনো কারণ ছাড়াই, যা আমাকে হতাশ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *