বসন্তের লড়াই

বসন্তের লড়াই

আমরা নদীর ওপারে কলেজ ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়েছিলাম, জর্জ আর আমি। আর জর্জ আমার খরচে আকণ্ঠ খেয়ে, অশ্রু আপ্লুত নষ্টালজিয়ায় চলে গেল।

‘আহা, কলেজের দিনগুলি, কলেজের দিনগুলি।’ সে ডুকরে উঠল।

‘জীবনে আমরা আর কী পেতে পারি, তোমার এই ক্ষতিপূরণের জন্য?’ আমি তার দিকে বিস্ময়ে তাকালাম। ‘তুমি যে কোনোদিন কলেজে গিয়েছিলে, তা আর বোলো না আমায়।

সে উগ্রভাবে তাকিয়ে আমাকে বাধিত করল। ‘তুমি কি বোঝ, আমি ছিলাম ছাত্র সংগঠনের ‘ফি-ফো-ফোম’-এর সভাপতি।

‘কিন্তু তুমি কিভাবে টিউশন ফি দিতে?’

‘স্কলারশিপ।’ সে বলল, ‘কো-এড ডর্মিটরিতে, আমাদের বিদায় উৎসব পালনে খাদ্যের লড়াইয়ে, আমার ক্ষমতা দেখানোর পর ওগুলো আমার ওপর বর্ষিত হয়েছিল। এটাও ছিল, আরো এক ধনী কাকাও ছিলেন।

‘জানতাম না তো, তোমার একজন ধনী কাকাও রয়েছেন, জর্জ।’

‘ধীরগতি কর্মসূচি শেষ করতে আমার ছয় বছর লেগেছিল। তারপর তিনি আর নেই, হায়! অন্ততপক্ষে ততটা নয়। নষ্ট হওয়ার থেকে কতটা অর্থই বা তিনি বাঁচাতে পারতেন! সবই তো দিয়ে গিয়েছিলেন অভাবী বেড়ালদের হোমে। আমার সম্পর্কে তার উইল দলিলে এমন সব মন্তব্য করেছিলেন, আর তার পুনরাবৃত্তি করতে ঘৃণা হয়। আমার জীবন হয়ে গেছে বিষাদগ্রস্ত ও মূল্যহীন।

‘কোনো সময়ে দূর ভবিষ্যৎ’ আমি বলি, ‘আমাকে সব তুমি বিস্তারিত বলো, কোনো কিছু না বাদ দিয়ে।’

‘কিন্তু’ জর্জ বলে চলল, ‘কলেজ জীবনের স্মৃতি আমার কট্টর জীবনকে সোনা মুক্তোর দীপ্তিতে ভরিয়ে দেয়। যখন কয়েক বছর আগে পুরনো স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, তখন আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি।

‘তোমাকে ওরা আবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল?’ আমার কন্ঠস্বরে অবিশ্বাসের অভ্রান্ত সুর বজায় রাখতে সক্ষম হয়ে বললাম।

‘তারা করতই, আমি নিশ্চিত,’ জর্জ বলল, ‘তবে আমি আসলে ফিরেছিলাম, আমার কলেজ জীবনের এক প্রিয় বন্ধু বৃদ্ধ অ্যান্টিওকাস সেল এর অনুরোধে।’

.

‘যতটুকু আমি বলেছি তাতে নিশ্চয়ই তোমার আগ্রহ জন্মে গেছে’ [জর্জ বলল]

‘এবার আমি বৃদ্ধ অ্যান্টিওকাস স্নেলের সম্বন্ধে বলব। পুরনো দিনে সে আমার অবিচ্ছেদ্য বন্ধু ছিল। পরে বিশ্বস্ত প্রাণের বন্ধু।

(যদিও কেন যে শ্রেষ্ঠ পরোক্ষ উক্তিগুলো তোমার মতন জড় বুদ্ধির ওপর বর্ষণ করি, নিজেই জানি না)। এমন কি এখনো যদিও সে আমার চেয়ে অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছে, আমার সেসব দিনের কথা মনে পড়ে। যখন দুজনে এক সঙ্গে গোল্ড ফিশ গলাধঃকরণ করতাম, অন্তরঙ্গ বন্ধুদের নিয়ে টেলিফোন বুথ ভরিয়ে রাখতাম, কব্জীর কুশলী মোচড়ে প্যান্টি খুলতাম। টোল খাওয়া গালে সহপাঠিনীরা আনন্দে চিৎকার করে উঠত। সংক্ষেপে আমরা আলোকপ্রাপ্ত সংস্থার সব রকম অত্যুচ্চ আনন্দের আস্বাদ গ্রহণ করেছি।

তাই যখন বৃদ্ধ এ্যান্টিওকাস স্নেল আমাকে গুরুতর কারণে দেখা করতে বলল, আমি তখনই হাজির হলাম।

‘জর্জ,’ সে বলল, ‘আমার ছেলে!’

‘তরুন আর্টাক্সেরক্স স্পেন।’

‘হ্যাঁ, তাই। সে স্টেট ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিন্তু তার সঙ্গে যা ঘটছে, তা মোটেই ভাল নয়।’

আমার চোখ সরু হয়ে এল। ‘ও কি দুঃসঙ্গে পড়েছে? ও কি দেনায় ডুবেছে? ও কি নির্বোধের মতন নিজেকে পানশালার কোনো বর্ষিয়সী পরিচারিকার কবলিত হতে দিয়েছে?’

‘মন্দ, আরো মন্দ।’ ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বৃদ্ধ অ্যান্টিওকাস স্নেল বলল,

‘সে নিজে একথা কখনো আমাকে বলেনি, তবে বলার মুখই নেই, আমি মনে করি। কিন্তু তার সহপাঠীর কাছ থেকে আমি এক মর্মান্তিক চিঠি পেয়েছি। কঠোরতম গোপনীয়তায় লেখা। জর্জ, আমার পুরনো বন্ধু, বেচারি পুত্র আমার, নরম করে বলার চেষ্টা না করে সোজাসুজিই বলি, সে ক্যালকুলাস পড়ছে।’

‘কী পড়ছে’ ক্যালকু~’ আমি অদ্ভুত কথাটা উচ্চারণ করতেই পারলাম না।

অভাগার মতন অ্যান্টিওকাস স্নেল মাথা নাড়ল। ‘আবার পলিটিক্যাল সায়েন্সও। সে সত্যি সত্যি ক্লাসে যায়, আর পড়াশোনা করে।’

‘হায় ঈশ্বর!’ আমি আতঙ্কিত হয়ে বলি।

—জর্জ, আমি তো তরুণ আর্টাক্সেরক্সের সম্পর্কে এটা বিশ্বাস করতেই পারছি না। ওর মা যদি এ কথা শোনেন, তবে তো শেষ হয়ে যাবেন। উনি এক বিচক্ষণ মহিলা, জর্জ, এবং খুব সুস্থ নন। আমাদের পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে আমি তোমাকে মিনতি করছি, তুমি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখ। যদি ছেলেটা স্কলারশিপের লোভে এই সব করে থাকে, তবে তাকে সজ্ঞানে নিয়ে এসো যেমন করে হোক। ওর মায়ের জন্যে, নিজের জন্যে, যদি আমার জন্য নাও হয়।’

চোখে জল নিয়ে আমি তার হাতে চাপ দিলাম।

‘কেউ আমাকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।’ আমি বললাম, ‘পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে এই পুণ্য কর্ম থেকে সরাতে পারবে না। আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাব দরকার পড়লে, কথা বলে বুঝিয়ে অর্থ ব্যয় করে। আমার একটা চেক চাই।’

‘একটা চেক?’ বৃদ্ধ অ্যান্টিওকাস স্পেন কেঁপে উঠল। সব সময় ওয়ালেট বন্ধ রাখতে সে তৎপর থাকে।

‘হোটেলের ঘর।’ আমি বলি, ‘খাদ্য, পানীয়, বকশিশ, মুদ্রাস্ফীতি, আর সব মিলিয়ে মোটামুটি। এটা তোমার ছেলের কথা, বন্ধু। আমার জন্যে নয়।’

অবশেষে চেক পেলাম আর স্টেট-এ পৌঁছে তরুণ আর্টাক্সেরক্সের সঙ্গে দেখা করতে দেরি করলাম না। ভাল ডিনার, উৎকৃষ্ট ব্রান্ডি, দীর্ঘ রাত্রির নিদ্রা আর

ব্যস্ততাহীন অবকাশের ব্রেকফাস্টে আমি বেশি সময় নিইনি। ওর ঘরে আমার ডাক পড়ল।

ঘরে ঢুকেই এক মস্ত ধাক্কা। যে কোনো দেওয়ালে তাকাই, চোখ ধাঁধানো টুকিটাকি জিনিসে ভরা নয়, সুরা ভাণ্ডারের পুষ্টিকর বোতলে ভরা নয়, বেহিসেবী পোশাক হারানো হাসিখুশি তরুণীদের ফটোতে ভরা নয়- শুধু বইয়ে ভরা।

তার ডেস্কের ওপর একটা বই নির্লজ্জভাবে খোলা পড়ে রয়েছে। আর আমার বিশ্বাস, আমার আসার আগের মুহূর্তেও বইতে তার আঙ্গুল ছিল। তার ডানদিকের তর্জনীতে সন্দেহজনক ধুলো চিহ্ন যা, সে জড়সড় হয়ে পেছনে মুছতে চাইছিল।

কিন্তু আর্টাক্সেরক্স নিজে আরো বেদনাদায়ক ছিল। পরিবারের পুরনো বন্ধু হিসেবে সে অবশ্যই আমাকে চিনতে পারল। আমি তাকে নয় বছর দেখিনি। কিন্তু এই নয় বছরে আমার সম্ভ্রান্ত আচরণ এবং সতেজ ও প্রশান্ত চেহারা কিছুই বদলায়নি। নয় বছর পূর্বে আর্টাক্সেরক্স একজন বৈশিষ্ট্যহীন বালক ছিল। এখন সে একজন অপরিচিত কিন্তু সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্যহীন উনিশ বছরের তরুণ। কোনোক্রমে সে হয়তো পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হবে, চোখে মস্ত গোল চশমা আর গর্তে ঢোকা চেহারা।

আমি উত্তেজনায় বলে ফেললাম, ‘তোমার ওজন কত?’

সে চুপি চুপি উত্তর দিল, ‘সাতানব্বই পাউন্ড।’

হৃদয়ের অনুকম্পায় তার দিকে তাকালাম। সাতানব্বই পাউন্ডের কৃশকায়।

সে নেহাতই অবজ্ঞা ও উপহাসের পাত্র।

আমার হৃদয় বিগলিত হল, যেই ভাবলাম, বেচারি। বেচারি। এই রকম শরীর নিয়ে সর্বোৎকৃষ্ট কলেজ শিক্ষার কোন্ ক্রিয়াকলাপে সে অংশগ্রহণ করবে? ফুটবল, ট্র্যাক্, কুস্তি? সুরা পানীয় গলাধঃকরণের প্রতিযোগিতা!

যখন অন্য তরুণরা চিৎকার করবে, আমরা স্টেজ বানাবার পুরনো খামার খুঁজে পেয়েছি, আমরা আমাদের নিজেদের কস্ট্যুম সেলাই করে নিতে পারি, বা আমরা এক গীতিনাট্য করি, তখন ও কী করবে? ওই রকম ফুসফুস নিয়ে সে কি কোনো গান গাইতে পারে, অস্পষ্ট সপ্তক ছাড়া?

স্বভাবতই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গান গেয়ে, তাকে অপযশ কুড়াতে হবে!

নরম করে প্রায় সাদরে বললাম, ‘বাছা আর্টাক্সেরক্স, এটা কি সত্যি, তুমি ক্যালকুলাস আর পলিটিক্যাল ইকনমি পড়ছো?’

সে মাথা নাড়ল, ‘এ্যানথ্রোপলজিও।’

নিদারুন বিরক্তি ও বিস্ময়ে আমার শ্বাসরোধ হয়ে গেল। বললাম, ‘আর এও কি সত্যি, তুমি ক্লাসে যাও?’

‘দুঃখিত স্যার, হ্যাঁ। বছরের শেষে আমি শ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসেবে পরিগণিত হবো।’

তার এক চোখের কোনে জলের আভাস দেখা গেল।

আর আমার ভীষণ ভয়ের মাঝে আমি একটু আশা দেখতে পেলাম যে, সে অন্তত পক্ষে চিনতে পেরেছে, নৈতিক বিচ্যুতির কী গভীরে সে চলেছে।

আমি বলি, ‘এখনো কি এই সব মন্দ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে বিশুদ্ধ পরিষ্কার কলেজ জীবনে ফিরতে পার না?

‘আমি পারি না।’ সে ফুঁপিয়ে উঠল, ‘আমি অনেক দূর চলে এসেছি। কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।’

আমি তখন খড়ের কুটো আঁকড়ে ধরলাম, ‘কলেজে কি কোনো শালীন রমণী নেই, যে তোমার ভার নিতে পারে! একজন ভাল মেয়ের ভালবাসা অতীতে পরমাশ্চর্য ঘটিয়েছে এবং এখনো ঘটাতে পারে।’

তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি স্পষ্টতই তার স্নায়ু স্পর্শ করতে পেরেছি।

সে আকুল হয়ে বলল, ‘ফিলোমেল ক্রিব’।

‘সে আমার আত্মার সমুদ্রে দীপ্তি ছড়ানো সূর্য, চাঁদ, তারা।

নিয়ন্ত্রিত প্রবাদতত্ত্বের পশ্চাতে লুকিয়ে থাকা আবেগকে চিনতে পেরে, বললাম, ‘আঃ, সে কি জানে?’

‘কেমন করে তাকে বলি? তার অনুকম্পার ভার আমাকে গুঁড়িয়ে দেবে।’

‘তার অনুকম্পা মুছে ফেলতে, তুমি কি ক্যালকুলাস ছাড়তে পারবে না?’

‘তার মাথা ঝুলে পড়ল। ‘আমি দুর্বল, আমি দুর্বল।’

আমি তাকে ছেড়ে তক্ষুনি ফিলোমেল ক্রিকে খুঁজতে মনস্থ করলাম।

খুব বেশি দেরি হলো না। রেজিস্টারের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম তার প্রধান বিষয় চিয়ার লিডিং অর্থাৎ খেলোয়াড় গায়ক ইত্যাদিতে উৎসাহ প্রদান ও সহবিষয় নাটকে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়।

আমি তাকে চিয়ারলিডিং স্টুডিওতে পেলাম।

জটিল নৃত্য-লম্ফ ও সুরেলা তীক্ষ্ণ চিৎকারে শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমি অপেক্ষা করলাম আর তারপর ফিলোমেলকে লক্ষ্য করা গেল। মধ্যমাকৃতির, সোনালী চুল, স্বাস্থ্য ও স্বেদে দীপ্তিময়ী। এবং এমনই সুঠাম, যে ওষ্ঠ সঙ্কুচিত করে, আমাকে তা মানতেই হল। আর্টাক্সেরক্স এর পাঠাসক্তি থেকে একজন কলেজ পড়ুয়ার যথার্থ আগ্রহের বিষয়গুলি কি সে সম্পর্কে ক্ষীণ উপলব্ধি হল আমার।

স্নান সেরে কলেজের রঙবাহারী যৎসামান্য পোশাকে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, শিশিরস্নাত প্রান্তরের মতন তাজা ও উজ্জ্বল।

আমি একেবারে বিষয়টির গভীরতম স্থানে চলে গেলাম। বললাম, ‘তরুণ আর্টাক্সেরক্স তোমাকে তার জীবনের জ্যোতিষ্ক মনে করে। মনে হল, তার চোখ অল্প নরম হয়ে এল। ‘আর্টাক্সেরক্স। তার এত সাহায্যের দরকার।

‘একজন ভাল মেয়ের কাছ থেকেই তার প্রয়োজন মিটতে পারে।’ আমি নির্দেশ করলাম।

‘আমি জানি,’ সে বলল, ‘মেয়েরা যেমন হয়ে থাকে, আমি তেমনই ভাল মেয়ে, আমাকে সবাই তেমনই বলে। বলেই সে চমৎকার লজ্জা পেল। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমি তো দেহতত্ত্বের বাইরে যেতে পারি না। বুলহুইপ কস্টিগান যখন তখন আর্টাক্সেরক্সকে অপমান করে। সর্বসময়ে তার দিকে নাক সিঁটকায়। তাকে ঠেলে দেয়, তার বাজে বইগুলো মাটিতে ফেলে দেয়, সমবেত নিষ্ঠুর হাস্যরোলের সামনে। আপনি জানেন, বসন্তের এই উচ্ছ্বাসে এটা কেমন।

‘ওঃ, হ্যাঁ।’ আমি গভীরভাবে অনুভব করলাম, স্মরণে এল সুখের দিনগুলি, যখন এরকম কতবার প্রতিযোগীদের কোট ধরে রেখেছি, ‘বসন্তের লড়াই!’

ফিলোমেল দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমার দীর্ঘ আশা ছিল যদি আর্টাক্সেরক্স বুলহুইপের সমানে সমানে দাঁড়াতে পারে। অবশ্যই তার ফুটলের দরকার হবে। বুলহুইপ ছয় ফুট দশ ইঞ্চি, কিন্তু কোনো কারণে আর্টাক্সেরক্স তা নয়। সব সময়ে পড়াশোনা, সে কেঁপে উঠল ‘নৈতিক দৃঢ়তা দুর্বল করে দেয়।

‘নিঃসন্দেহে, কিন্তু তুমি যদি তাকে এই খোলস ছেড়ে বাইরে আসতে সাহায্য কর।’

‘ওঃ, স্যার, অন্তরে গভীর, দয়াপরবশ, চিন্তাশীল তরুণ, পাগল, তাকে আমি সাহায্য করতাম, কিন্তু আমার দেহে জিনগত বৈশিষ্ট্য সর্বশ্রেষ্ঠ, আর আমাকে সেটা বুলহুইপের দিকে আকর্ষণ করে। বুলহুইপ সুদর্শন, হৃষ্টপুষ্ট, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং এই সমস্ত গুণাবলী স্বভাবতই আমারে চিয়ারলিডিং হৃদয়ে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

‘আর যদি আর্টাক্সেরক্স বুলহুইপকে অপমান করতে পারে।’

‘একজন চীয়ারলিডার’ বিস্ময়করভাবে উন্নত বক্ষ আন্দোলিত করে, বলল, ‘অবশ্যই নিজের হৃদয়কে অনুসরণ করবে, যা অবধারিতভাবে অপমানিতের থেকে যে অপমান করছে, তার দিকে ঝুঁকবে।’

আমি জানি সৎ মেয়েটি। মন থেকে সরল সত্য বেরিয়ে এল।

আমার পরিকল্পনা সহজ সরল ছিল। যদি আর্টাক্সেরক্স তের ইঞ্চি আর ওজনে একশো দশ পাউন্ডের ঘাটতি অবজ্ঞা করতে পারে, আর বুলহুইপ কস্টিগানকে পাঁকে ডুবিয়ে দিতে পারত। ফিলোমেল আর্টাক্সেরক্স হয়ে যেত আর সে তাকে এক প্রকৃত অভিজাত পুরুষ মানুষে পরিণত করতো, যে সুরা পান করতে করতে আর টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে, সম্মানের সঙ্গে নিজের বয়স বাড়াত।

স্পষ্টতঃ এটা আজাজেলের এক্তিয়ার।

আমি জানি না, তোমাকে আজাজেলের কথা বলেছি কী না, সে এক দু সে.মি. লম্বা জিন। অন্য এক জগতের অন্য সময়ের বাসিন্দা, যাকে আমি সামনে মন্ত্ৰ উচ্চারণ করে, ধূপধূনো পুড়িয়ে আমার কাছে ডেকে নিতে পারি। আমাদের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী আজাজেল্‌, কিন্তু সে সামাজিক দায়িত্ব স্বীকার করে না, কারণ সে সাংঘাতিক স্বার্থপর। যে অবিরত নিজের তুচ্ছ প্রয়োজনকে আমার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

এইবার যখন সে আবির্ভূত হল, পাশ ফিরে শুয়ে। তার ছোট্ট চোখ বোজা, শূন্যে তার ছোট্ট চাবুকের মতো লেজের মোলায়েম ও নির্জীব আঘাত যেন ফাঁকা বাতাসকে সোহাগ জানাচ্ছে।

‘হে বলশালী’ আমি বললাম, কারণ সে এই ধরনের সম্বোধনের ওপর জোর দেয়। তার চোখ খুলল, আর তখুনি সে হুইসলের স্বরে এক কর্ণভেদী চিৎকার দিল। খুবই বিশি।

‘কোথায়।’ সে বলে উঠল, ‘আমার প্রাণের আস্টারোথ এই মুহূর্তে সে তো আমার বাহুর ঘেরেই ছিল।’

তারপর সে আমাকে লক্ষ্য করে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ওঃ, তুমি। তোমার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে, তোমার কাছে আমাকে ডেকে পাঠালে সেই মুহূর্তে, যে মুহূর্তে আস্টারোথ, কিন্তু সে এখানেও নেই, সেখানেও নেই।

‘তুমিও না’ আমি বলি, ‘তবু মনে কর তুমি আমাকে একটুখানি সাহায্য করেই তোমার নিজের জগতে ফিরে যেতে পারবে আধ মিনিটে। আস্টারোথ ঐ সময়ের মধ্যে হয়তো বিরক্ত হতে শুরু করত, কিন্তু ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে না। তোমার পুনরাবির্ভাব তাকে আনন্দে ভরিয়ে দেবে। আর যা তুমি করতে যাচ্ছিলে, তা দ্বিতীয়বার করতেই পার।

আজাজেল্‌ মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে তার মতে মহিমময় স্বরে বলল, ‘তোমাদের ছোট মন, তুমি প্রাচীন কীটসদৃশ, কিন্তু সর্পিল, আর আমাদের মতো যাদের বিশাল মানসিকতা কিন্তু খেলোমন উজ্জ্বল, সাদাসিধা প্রকৃতির। তাদের কাজে আসতে পারে। যাহোক, কি ধরণের সাহায্য এখন তুমি চাইছ?

আমি আর্টাক্সেরক্সের দুর্দশার কথা বিবৃত করলাম। আর আজাজেল্‌ বিবেচনা করে বলল, ‘আমি তার বাহুবলের প্রয়োগ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারি।

মাথা নাড়লাম। এটা শুধু একমাত্র পেশীশক্তির বিষয় নয়। নৈপুণ্য চাই, সাহস চাই, যার কিছুই তার নেই।

আজাজেল্ ঘৃণা ও ক্রোধের সঙ্গে বলল, ‘তুমি কি চাও, আমি আমার লেজ ঘামিয়ে, ক্লান্ত হয়ে, তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বাড়িয়ে দিই?

‘তুমি কি অন্য কিছু প্রস্তাব দিতে পার?’

‘নিশ্চয়ই রয়েছে। আমি এমনি এমনি তোমার তুলনায় অনেক গুণ উৎকৃষ্ট। যদি তোমার দুর্বল বন্ধু তার শত্রুকে সরাসরি নিগৃহীত করতে না পারে, তবে কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললে কেমন হয়?’

‘অর্থাৎ, দ্রুত বেগে পলায়ন!’ মাথা নাড়লাম। ‘মনে হয় না, সেটা খুব প্রশংসনীয় হবে।’

‘আমি পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছি না। আমি বলছি, কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার কেরামতি। আমাকে তার প্রতিক্রিয়া সামলে সংক্ষিপ্ত করে আনতে হবে, আমার বিশাল অধিগত বিদ্যা দ্বারা তা সহজেই সম্ভব। নিষ্প্রয়োজনে তার শক্তি ক্ষয় নিবৃত্ত করতে, আমি তার বৃক্ক রস এর সাহায্য নিয়ে সংক্ষিপ্তকরণ করতে পারি। অন্যভাবে বলতে গেলে, যখন সে ভয়, রাগ বা অন্য কোনো তীব্র আবেগের বশবর্তী হবে, এই শক্তি কার্যকরী হয়ে উঠবে। শুধু একটুক্ষণের জন্য তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিও, তারপর সব দায় আমার।

‘অবশ্যই।’ আমি বলি।

পনেরো মিনিটের ব্যাপার মাত্র। ডর্মিটরি রুমে আমি আর্টাক্সেরক্সের সঙ্গে দেখা করলাম আর আজাজেল্‌ আমার শার্টের পকেট থেকে উঁকি মারছিল। খুব কাছ থেকে আজাজেল্ ততক্ষণ আর্টাক্সেরক্সের স্বতন্ত্র স্নায়ুতন্ত্রের ওপর জারিজুরি চালাতে পারল। তারপর সে তার আস্টারোথের কাছে ফিরে গিয়ে সানন্দে অন্যায় আচরণ শুরু করতে পারে।

আমার পরের পদক্ষেপ ছিল একজন কলেজ পড়ুয়ার ছদ্মহাতের লেখায় খুব চালাকি করে একটি চিঠি লেখা। ব্লক লেটারে। ক্রেয়ণ দিয়ে লিখে বুলহুইপের দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বুলহুইপ ছাত্রদের নোটিশ বোর্ডে, আর্টাক্সেরক্স আহ্বান জানিয়ে, বিশেষ সুরা কক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখা করতে নির্দেশ দিল। পরে আর্টাক্সেরক্স বুঝে গেল, প্রত্যাখ্যান করার কোনো উপায় নেই।

ফিলোমেল আর আমিও গেলাম। মজা দেখতে ছাত্রছাত্রীদের ভীড়ে ভীড়। আমরা বাইরের দিকে রইলাম। আর্টাক্সেরক্স দাঁতকপাটি লাগার অবস্থায়। সে সঙ্গে একটা ওজনদার বই নিয়ে এসেছে হ্যাণ্ডবুক অফ্ ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রি। এই রকম চরম সঙ্কটেও সে তার বইয়ের নেশা ছাড়তে পারেনি। দীর্ঘকায় পেশীবহুল বুলহুইপ সযত্ন ছিন্ন টি শার্টে, সোজা দাঁড়িয়ে ফুঁসছে, ভয়াবহ দর্শনীয়।

সে বলল, স্নেল, আমি জানতে পেরেছি, তুমি আমার সম্বন্ধে মিথ্যে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছ। একজন প্রকৃত অভিজাত কলেজ ছাত্র হিসেবে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার আগে, এসব অস্বীকার করার একটা সুযোগ দিচ্ছি।

তুমি কখনো কাউকে বলেছ যে, আমাকে বই পড়তে দেখেছিলে?’

আর্টাক্সেরক্স বলল, ‘আমি স্বয়ং তোমাকে একটা কমিক বই, চোখ বোলাতে দেখেছিলাম, তাও সেটা উল্টোদিক করে ধরেছিলে। কাজেই আমার মনে হয়, তুমি পড়ছিলে না, তাই আমি কাউকেই অমন কথা বলিনি।’

‘তুমি কি বলেছ, আমি মেয়েদের ভয় পাই আর বড় বড় কথা বলি, কিন্তু বড় কিছু করতে পারি না?’

আর্টাক্সেরক্স বলল, ‘কিছু মেয়ে একবার ওরকম বলেছিল শুনেছি। বুলহুইপ, কিন্তু আমি কখনো বলে বেড়াইনি।’

বুলহুইপ থামল। আসল হাঙ্গামা তখনো বাকি। ‘ঠিক আছে স্নেল, তুমি কি কখনো বলেছ, আমি নির্বোধ কদাকার!’

আর্টাক্সেরক্স বলল, ‘না স্যার, আমি যা বলেছি তা হল, তুমি নিশ্চয়ই অদ্ভুত।’

‘তাহলে তুমি সব অস্বীকার করছ?’

‘জোরের সঙ্গে বলতে পারি।

‘আর স্বীকার করছ, এ সমস্তই অসত্য।’

জোর গলায় বলতে পারি।’

‘আর তুমি একটা জঘন্য মিথ্যাচারী, প্যান্টে আগুন’

‘শোচনীয়ভাবে।’

‘তাহলে বুলহুইপ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তোমাকে আমি মেরে ফেলব না। আমি শুধু তোমার সামান্য দুটো একটা হাড় ভেঙে দেবো।’

ছাত্ররা চিৎকার করে উঠল, ‘বসন্তের লড়াই,’ হাস্যরোল উঠল, সকলে বৃত্তাকারে দুই প্রতিযোগীকে ঘিরে ধরল।’

বুলহুইপ ঘোষণা দিয়ে দিয়ে বলে, ‘নিরপেক্ষ লড়াই হবে।’

যদিও একজন নির্দয় উৎপীড়ক, কলেজীয় নীতি অনুসরণ করল।

‘কেউ ওকে সাহায্য করবে না, কেউ আমাকে সাহায্য করবে না। একদম একে একে লড়াই হবে।

বুলহুইপ বলল, ‘চশমা খুলে ফেল স্নেল।’

‘না।’ আর্টাক্সেরক্স সাহসের সঙ্গে বলল। এদিকে একজন দর্শক গিয়ে আর্টাক্সেরক্সের চশমা খুলে নিল।

‘এই।’ আর্টাক্সেরক্স বলল, ‘তুমি বুল হুইপকে সাহায্য করছো।

‘না, করছি না, আমি তোমাকে সাহায্য করছি।’ চশমা হাতে ছাত্রটি বলল।

‘কিন্তু আমি যে এখন বুলহুইপকে পরিষ্কার দেখতেই পাচ্ছি না।’

‘চিন্তা করোনা’ বুলহুইপ বলল, তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে।’

আর হৈ হৈ না করে শুয়োরের উরুর মতন মুঠি আর্টক্সেরক্সের চিবুকের দিকে

দুলিয়ে দিয়ে হুইসল বাজাল। বুলহুইপ অর্ধেক ঘুরে গেল, কারণ আর্টাক্সেরক্স ঘুষির সামনে থেকে সরে গেল, আধ ইঞ্চির জন্য তার গায়ে লাগল না।

বুলহুইপ আশ্চর্য হয়ে গেল, আর আর্টাক্সেরক্স হতবুদ্ধি।

‘আচ্ছা, তবে রে!’ বুলহুইপ বলল, ‘নে, এইবার দেখ।’ সামনে এগিয়ে গিয়ে বাহু এদিকওদিক ঘুরে গেল। আর্টাক্সেরক্স মুখে চরম উদ্বেগের ছাপ নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে নেচে নিল। বুলহুইপের তীব্র আঘাতের জোড়ে যে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস উঠল, আমার ভয় ধরে গেল, তাতে হয়তো আর্টাক্সেরক্সের ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

বুলহুইপ স্পষ্টতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার বলশালী ছাতি হাঁপাচ্ছে। ‘তুমি কী করছো কি? সে ঝগড়াটে সুরে দাবিয়ে দিল।

আর্টাক্সেরক্স ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে, যেমন করেই হোক, সে অক্ষতই থাকবে। সে সেই জন্য এগিয়ে এসে যে হাতে তার বই ধরা ছিল না, সেই হাত দিয়ে বুলহুইপের গালে সশব্দে এক চড় কষিয়ে দিল, ‘এই নাও নির্বোধ কদাকার।’

উপস্থিত দর্শকদের একসাথে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম আর বুলহুইপ উন্মত্তপ্ৰায়।

সবাই দেখছে যেন এক শক্তিশালী যন্ত্র ঝাঁপাচ্ছে, আঘাত করতে যাচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে আর যার দিকে তাক করছে সে মধ্যে থেকে নেচে কুঁদে দুলে সরে যাচ্ছে।

যেন অনন্তকাল। বুলহুইপ হাঁপাচ্ছে, মুখমণ্ডল ঘামে ভেসে যাচ্ছে আর ক্লান্তিতে সম্পূর্ণ অসহায়। তার সামনে আর্টাক্সেরক্স দাঁড়িয়ে আছে শান্ত, অক্ষত। সে তার বইটাও হাত থেকে ছাড়েনি।

এইবার সে বইটা ঠেলে সজোরে বুলহুইপের নাইকুগুলে মারল। বুলহুইপ দ্বিগুণ জ্বলে উঠল। আর্টাক্সেরক্স তার বইটা দিয়ে তার মাথায় মারল। বইটার অবস্থা খুব বিশ্রি হয়ে গেল কিন্তু বুলহুইপ পপাত ধরণীতলে, পরমসুখে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ক্ষীণদৃষ্টি আর্টাক্সেরক্স ঝাপসা চোখে বলল, স্কাউড্রেল, কি আমার চশমাটা এবার ফেরত দেবে?’

‘হ্যা স্যার, মি. স্নেল।’ যে ছাত্রটির কাছে চশমা ছিল, সে এগিয়ে এসে আর্টাক্সেরক্সকে শান্ত করার চেষ্টায় আবেগে হেসে বলল, এই নিন স্যার, আমি ওটা সাফ্ করে রেখেছি স্যার।’

‘বেশ। এবার সব ভাগো তো। সব নির্বোধের দল। ভাগো।’

সাথে সাথে সারিবদ্ধভাবে নয়, একে অন্যের ঘাড়ে পড়তে পড়তে, অন্য কোথাও পালাবার উদ্দেশে জায়গা ছাড়তে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শুধু ফিলোমেল আর আমি রয়ে গেলাম। আর্টাক্সেরক্সের চোখ পড়ল দুরু দুরু বক্ষের তরুণীটির ওপর। উগ্রভাবে ভ্রূ উঁচিয়ে কড়ে আঙুলটা বাঁকিয়ে ধরল আর সুড়সুড় করে ফিলোমেল তার এগিয়ে গেল। আর্টাক্সেরক্স মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিলে, মেয়েটি মাথা নিচু করে তার অনুসরণ করে চলল।

সব ভাল, মধুরেণ সমাপয়েৎ। আর্টাক্সেরক্স তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। যোগ্যতার কৃত্রিম চেতনা আনতে, তার আর পুস্তকের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সে সব সময়ে বক্সিং-রিং-এ সময় কাটিয়ে, চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। তারপর সে সমস্ত সহপাঠিনীদের হিরো, পরিশেষে ফিলোমেলকে বিবাহও করল।

তার বক্সিং ক্ষমতা তাকে এমনই সহজ যশ এনে দিল যে নিজের পছন্দ মতন জুনিয়র বিজনেস এক্সিকিউটিভ পদ অলঙ্কৃত করে ফেলল। তার তীক্ষ্ণ মেধা তাকে দেখিয়ে দিল, কোথায় অর্থের উৎস। সে পেন্টাগন অফিসের জন্য টয়লেট সিট, সুবিধা দিয়ে তার সাথে হার্ডওয়ার স্টোর থেকে কেনা ওয়াশার যোগ করে দিয়ে, সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করল।

প্রথমদিককার বেচাকেনার দিনগুলোতে তার পড়াশোনা তাকে যতই হোক সব দিকে সুপ্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। সে ক্যালকুলাসের সাহায্যে লাভের হিসাব কষত। পলিটিক্যাল ইকনমিক্স ব্যবহারে আয়করে ছাড় নিত আর নৃতত্ত্ব বা অ্যানথ্রোপলজির সাহায্য নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের মোকাবিলা করত।

.

আমি জর্জের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালাম। তুমি কি বলতে চাও, তোমার আর আজাজেলের হস্তক্ষেপে এই ব্যাপারটা তাহলে ভালয় ভালয় মিটেছিল।

‘নিশ্চয়ই’ জর্জ বলল।

‘কিন্তু তার মানে, তোমার এখন এক পরম সমৃদ্ধ পরিচিতি রয়েছে, তার কাছে যে সমস্ত কিছুর জন্যই তোমার কাছে ঋণী।

‘তুমি যথার্থই বললে, বন্ধু।’

‘কিন্তু তাহলে নিশ্চয়ই তার ওপর ভাগ বসাতে পার তুমি।’

জর্জের ভ্রূ অন্ধকারাচ্ছন্ন হল। ‘তুমি এমনই ভাবছ। তাই না? তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে কৃতজ্ঞতা আছে, তাই না? তুমি হয়তো ভাবছ, ব্যক্তিবিশেষ রয়েছে, যখন তার কাছে বিশ্লেষণ করা হবে, যে তার অতিমানবিক এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো বন্ধুর দুঃসাধ্য পরিশ্রমের অবদান। তার জন্য সেই বন্ধুর ওপর পুরস্কার বর্ষণ করা উচিত তো।’

‘তার মানে আর্টাক্সেরক্স তা করেনি!’

‘ঠিক তাই। যখন একবার তার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলাম, যে সে আমাকে দশ হাজার ডলার দিক, আমি আমার এক পরিকল্পনায় দশ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে তার নিশ্চয়ই শতগুণ ফেরত আসবে। সে সৈন্যবাহিনীতে এক ডজন নাট বল্টু বেচে তুচ্ছ দশ হাজার ডলার রোজগার করে, আর আমাকে মাত্র ছুতো করে এড়িয়ে গেল।

‘কিন্তু কেন জর্জ? তুমি কি কখনো তার কারণ খুঁজে পেয়েছিলে।’

‘হ্যাঁ ঘটনাচক্রে পেয়েছিলাম। দেখ বন্ধু, যখনই সে তীব্র আবেগের বশবর্তী হয়, রাগ বা অন্য কিছু তার বৃক্করস নিঃসৃত হয়ে, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলে যেতে বাধ্য করে। আজাজেল্‌ ব্যাখ্যা করেছিল সেটা।’

‘হ্যাঁ, তাতে কি?’

‘আর তাই, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে ফিলোমেলকে যখনই তীব্র কামাবেগ ঘিরে ধরে, সে আর্টাক্সেরক্সের দিকে এগোলে, আর্টাক্সেরক্স তার বাসনা উপলব্ধি করে, নিজেও আবেগে আপ্লুত হয়, আর তখনই সাড়া দেয় বৃক্করস। তাই ফিলোমেল যেমনই আর্টাক্সেরক্সকে আঁকড়াতে যায়, তার রমণীসুলভ উৎসাহে, সমর্পণের তাগিদে—’

‘তাহলে?’

আর্টাক্সেরক্স কৌশলে তাকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়।

‘আঃ হা!’

‘প্রকৃত পক্ষে ফিলোমেল কখনোই আর্টাক্সেরক্সের দিকে হাত বাড়াতে পারে না যেমন সে বুলহুইপের দিকে বাড়াতো। যতই দিন যায়, আর্টাক্সেরক্সের বিরক্তি হতাশার মাত্রা বাড়তে থাকে। আর যত তার বৃক্করস প্রবাহিত হয়, ফিলোমেলের দর্শন পাওয়া মাত্র, নিপুণ কৌশলে যন্ত্রের মতো সে তাকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ফিলোমেল অবশ্য কেঁদে কেটে হতাশায়, অন্য জায়গায় সান্ত্বনা খুঁজতে যায়। কিন্তু আর্টাক্সেরক্স যদি কখনো দাম্পত্য বন্ধনের বাইরে সাময়িক সম্পর্ক করতে চায়, সে তা পারে না। যে কোনো রমণীই তার দিকে এগোনো মাত্র, সে তাকে কৌশলে এড়িয়ে যায়। এমনকি যদি মেয়েটির তরফে ব্যবসায়িক আদান প্রদান থাকে তাও।

আর্টাক্সেরক্স এর অবস্থা টান্টালাসের কাপের মতন। উপাদান সব সময় চিরদিনের জন্যই সর্বাঙ্গীণভাবে সর্বত্র রয়েছে, কিন্তু বরাবরের জন্য তার নাগালের বাইরে।’ জর্জের কণ্ঠস্বর ঘৃণায় ক্রোধান্বিত হল ওইখানে,

‘আর এই অকিঞ্চিৎকর অসুবিধার জন্য আর্টাক্সেরক্স আমাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে।’

‘তুমি হয়তো,’ আমি বলি ‘বরং আজাজেল্‌কে ডাক, তাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে। আমি বলতে চাইছি, যে উপহার তাকে তুমি দিয়েছ, তার থেকে মুক্তি।’

‘বিশেষত একই ব্যক্তির ওপর দুবার প্রক্রিয়া চালাতে আজাজেলের ঘোর আপত্তি। জানি না কেন। তাছাড়া আমিই বা কেন একজনকে অতিরিক্ত অনুগ্রহ করতে যাব, যে পূর্বে অনুগৃহীত হয়েও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না!’

অপরপক্ষে, তোমাকে দেখ! যদিও তুমি একজন সুপরিচিত কৃপণ, মাঝে মাঝে আমাকে পাঁচ ডলার ধার দেবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এইসব উপলক্ষ্যের হিসাব, আমি এখানে সেখানে, কাগজের টুকরায় লিখে রেখে দেবো। আমার ঘরেও কিছু রাখবো। আর, তবু আমি তোমাকে কখনো অনুগ্রহ করিনি, করেছি কি?

যদি তুমি কোনো অনুগ্রহ ছাড়াই আমাকে সাহায্য করে থাকতে পার, তবে সে-ই বা পারবে না কেন!’

আমিও ভেবে দেখলাম। তারপর বললাম, ‘শোনো জর্জ। আমাকে তুমি অনুগ্রহ ছাড়াই রাখ। আমার জীবনে সব কিছুই ঠিকঠাক। প্রকৃতপক্ষে আমি অনুগ্রহ চাই না এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে, একটা দশ ডলার যদি দিই!

‘তা বেশ তো,’ জর্জ বলল, ‘যখন এত করে বলছো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *