মনের গড়ন

মনের গড়ন

সেই সকালে আমি দার্শনিক ভাব প্রকাশে বিহ্বল হয়েছিলাম। বিষাদের স্মৃতি নিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, ‘মনের ভাব, মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে, এটা খোঁজার কোনো অর্থই হয় না। সে একজন সজ্জন ব্যক্তি ছিল, তার ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থাও ছিল।

সেটি রবিবারের অতি শীতল এক সকাল। জর্জ আর আমি স্থানীয় ব্যাগেল নশ রেস্তোরাঁর টেবিলে বসেছিলাম। আমার মনে পড়ে জর্জ তার দ্বিতীয় মস্ত তিল-তেল ব্যাগেল রুটি শেষ করছিল। দেদার চীজ ক্রীম মাখানো আর সঙ্গে হোয়াইট ফিস্।

সে বলল, ‘নিচু সারির সম্পাদকদের জন্য যে সমস্ত গল্প তুমি সংকলন করে থাক, উদ্ধৃতিটি কি তারই কোনো গল্প থেকে!

‘এটা সেক্সপীয়রের উক্তি, আমি বলি, ‘ম্যাকবেথ থেকে।’

‘ওঃ ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার সাহিত্য চুরির হীন রুচির কথা।’

‘যথার্থ উদ্ধৃতিতে নিজেকে প্রকাশ করা মানে হীন সাহিত্য চুরি নয়। যা বলছি, তা হল, আমার এক বন্ধু ছিল, যাকে আমি রুচিশীল ও বিবেচক ভেবেছিলাম। আমি তাকে নৈশভোজনে ডেকেছি, তাকে ধার দিয়েছি। আন্তরিকভাবে তার চেহারা ও চরিত্রের প্রশংসা করেছি। আর মনে রেখো, আমি এটা করেছি, বাস্তব সত্য এতটুকু না ভেবে, যে সে পেশায় একজন পুস্তক সমালোচক, অবশ্য যদি তুমি এটাকে পেশা বলতে চাও।’

জর্জ বলল, ‘তোমার এইসব আজেবাজে কাজ সত্ত্বেও, যখন সময় এল, তোমার বন্ধু তোমার একটা বই এর নির্দয় সমালোচনা করে, তোমাকে একেবারে আছড়িয়ে ফেলল।

‘ওঃ,’ আমি বলি, ‘তুমি কি সমালোচনা পড়েছিলে?’

‘মোটেই নয়। আমি মাত্র নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার বই এর কী ধরণের সমালোচনা আসতে পারে। আর সঠিক উত্তর বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে এসে গেল।’

‘এটা একটা মন্দ পুস্তক বলতে, আমি কিছু মনে করিনি, মনে রেখো জর্জ ঐ রকম ভোঁতা মন্তব্যে অন্য লেখকরা যা মনে করবে, অন্তত পক্ষে আমি তাও মনে করিনি। কিন্তু যখন সে ভীমরতি, চিত্তভ্রংশ এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছে, আমার বোধ হচ্ছে, অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হয়েছে।

বলতে পারে, ‘বইটা আটবছরের বাচ্চাদের জন্য, কিন্তু তার পরিবর্তে, খেলা নিয়ে বসে থাকুক এমন মন্তব্য নীতিবিরুদ্ধ অন্যায় আঘাত।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললাম, ‘এতে কোনো-’

‘তুমি আগেই বলেছ,’ তৎক্ষণাৎ জর্জ বলল।

‘তাকে এত মনোহর, বন্ধুভাবাপন্ন এবং সামান্য অনুগ্রহে এত কৃতজ্ঞ বোধ হয়েছিল কেমন করে বুঝব, তলে তলে সে এমন মন্দ, মতলবী, নরকের কুত্তা।’

জর্জ বলল, ‘কিন্তু সে একজন সমালোচক। সে অন্য কিছু কি করে হবে? তুমি তোমার মাকে দুষবার শিক্ষানবিশী নিয়েছ। এমন হাস্যকর ভাবে বোকা বলছ, সেটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তুমি আমার বন্ধু ভাণ্ডেভান্টের-এর চেয়েও মন্দ আর যে, তোমাকে বলছি, একবার নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রার্থী হয়েছিল স্বাভাবিক সাদাসিধা মনোভাবের জন্য। তার গল্প অদ্ভুত-

‘প্লিজ’ আমি বলি, ‘নিউইয়র্ক রিভিউ অফ্ বুকস’-এর বর্তমান সংখ্যায় সমালোচনাই বেরিয়েছে, পাঁচটি কলাম জুড়ে। তিক্ত হিংসা, বিদ্বেষ, বিষোদ্গার। তোমার কোনো গল্প শোনার আগ্রহ আমার নেই।’

.

আমি ভাবলাম, হয়তো তুমি ঠিক বলছো,’ জর্জ বলল, ‘এই গল্প তোমার মনকে তোমার এই ফালতু ঝামেলা থেকে ধরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।

আমার বন্ধু ভাণ্ডেভান্টের রবিসনকে, যে কেউ সম্ভাবনাময় যুবা পুরুষ হিসাবে বিচার করবে। সে সুদর্শন, সংস্কৃত, বুদ্ধিমান ও সৃজনশীল। সে উৎকৃষ্ট বিদ্যালয়ে গেছে বরাবর এবং প্রফুল্ল তরুণী মিনার্ভা স্লাম্প-এর প্রেমে পড়েছিল। মিনার্ভা আমার ধর্মকন্যাদের মধ্যে একজন এবং আমার অনুগত, যতটা যথার্থ হওয়া উচিত, ততটা।আমার মতো চরিত্রবান অবশ্যই সুঠাম সৌষ্ঠবের তরুণীর সাদর আলিঙ্গন অথবা ক্রোড়ারূঢ়া হওয়ার চেষ্টা অনুমোদন করার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। কিন্তু মিনার্ভার সোহাগে এমন কিছু ছিল এত সরল, বালিকাসুলভ আর সবচেয়ে বড় কথা তার স্পর্শ এত সহজ, স্বাভাবিক ছিল যে, আমি তাকে বাধা দিতাম না।

স্বভাবতই ভণ্ডেভান্টের এর উপস্থিতিতে কখনোই নয়, কারণ সে যুক্তি ছাড়া অবুঝ হিংসুটে ছিল। তার এই দুর্বলতার কথা সে একদা আমাকে এমনভাবে জানিয়েছিল, যে আমি বিচলিত হয়েছিলাম।

‘জর্জ’ সে বলেছিল, ‘বাল্যকাল থেকে এটা আমার আকাঙ্ক্ষা, এমন এক তরুণীর প্রেমে পড়ব, যার উৎকৃষ্ট গুণ, অস্পৃষ্ট পবিত্রতা, আমি এভাবে বলতে পারি, পোর্সেলিন তুল্য সারল্যের দীপ্তি। যদি মিনার্ভা স্লাম্প-এর স্বর্গীয় নামে নিঃশ্বাস নিতে পারি, তবে তার মধ্যে আমি ঠিক এমনই রমণীকে খুঁজে পেয়েছি। এই ক্ষেত্রে আমি জানি, আমি প্রতারিত হবো না। যদি কখনো আমার বিশ্বাস আহত হয়, তবে জানি না কেমন করে বাঁচব। আমি হয়ে যাব সান্ত্বনাহীন তিক্ত চিত্ত এক বৃদ্ধ যার এইসব তুচ্ছ বাড়ি ঘর, ভৃত্যাদি, ক্লাব আর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঐশ্বর্য ছাড়া আর কিছু থাকবে না।

বেচারি ভাণ্ডেভান্টের। সে মিনার্ভার দ্বারা প্রতারিত হয়নি, কারণ আমি জানি, যখন মিনার্ভা আমার কোলে দুলত, আমি তার মনে পাপের কোনো চিহ্নই পরিস্ফুট হতে দেখিনি। কিন্তু এটাই একমাত্র সত্তা, বস্তু বা ধারণা যেখানে ভাণ্ডেভান্টের প্রতারিত হয়নি।

বেচারি যুবকের কোনো বিচার বুদ্ধিই ছিল না। যদিও কথাটা নিষ্ঠুর শোনাবে। তবু সে তোমারই মতন বুদ্ধু ছিল। তার মন বুঝবার কৌশল জানা ছিল না। হ্যাঁ, আমি জানি তুমি তা আগেই বলেছ। হ্যাঁ হ্যাঁ দুবার বলেছ।

একটা কঠিন কাজ তার অবশ্য ছিল। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে নিযুক্ত নবীন গোয়েন্দা ছিল সে। এটাও তার জীবনের আকাঙ্ক্ষা (যথাযথ সুন্দরীর খোঁজ পাওয়া ছাড়াও)— একজন গোয়েন্দা হওয়া। এক তীক্ষ্ণচক্ষু, সরল-নাসিকা ভদ্রলোক, যে সর্বত্র দুষ্কৃতকারীদের নিকট ভয়ঙ্কর। এই কথাটি স্মরণে রেখে, সে গর্টন ও হার্ভার্ড উভয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অপরাধতত্ত্বে প্রধান বিষয় নিয়ে স্নাতক হয়েছিল।

স্যার আর্থার কোনান ডোয়েল, আগাথা ক্রিস্টির মতন বিশেষজ্ঞের প্রামাণিক রচনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র অক্লান্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে পাঠ করেছিল। এসবের সাথে অবিরাম পারিবারিক প্রভাব ছিল, প্রসঙ্গত তার এক কাকা সে সময়ে কুইন্স এর বোরো প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাতে সরাসরি পুলিশ বিভাগে প্রবেশ সম্ভব হয়েছিল।

দুঃখের বিষয় এবং অপ্রত্যাশিতও, তাতে তার সফলতা আসেনি। নিজে আরাম কেদারায় বসে থেকে, অন্যদের সংগৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করে, অপ্রতিরোধ্য যুক্তির মালা গাঁথতে সে ব্যর্থ হত। নিজে উদ্যোগী হয়ে, সরাসরি সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে সে নিজেকে অযোগ্য ভাবত।

তার মুস্কিল ছিল, যে কেউ তাকে যা কিছু বলুক, সেটা বিশ্বাস করে নেওয়ার এক অদম্য আবেগ তার ছিল। যে কোনো অ্যালিবাই, তা যতই ছিদ্রযুক্ত হত, তাকে হতবুদ্ধি করে দিত। সুপরিচিত মিথ্যা হলফনামাকারীরাও সম্মানজনক কথাবার্তা বললে, সে সন্দেহ করতে পারত না।

এতে এমনই কুখ্যাতি রটেছিল, ছোটখাটো ব্যাগ ছিনতাইকারী থেকে ঘাগু রাজনীতিবিদ বা শিল্পপতি সকলেই চাইত, ভাণ্ডেভান্টেরই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করুক। তারা চিৎকার করত, ‘ভাণ্ডেভান্টেরকে ডাকুন।’ ‘আমি তার কাছে সমস্ত কথা খুলে বলব, কিছু গোপন করব না।’

ছিনতাইবাজ বলত, ‘সমস্ত বাস্তব তথ্যাদি, যথাযথ ক্রম অনুযায়ী, ঠিক করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমিই তাকে বলতে পারি।’ রাজনীতিবিদের দাবী ছিল, ‘তুচ্ছ ক্যাশ ড্রয়ারে যে হাজার মিলিয়ন ডলারের সরকারি চেক এমনিই পড়েছিল, জুতা পালিশের ছেলেটিকে বখশিশ দিতে কেন আমি নিয়েছিলাম সব ভাণ্ডেভান্টেরকে ব্যাখ্যা করে বলব,’ শিল্পপতি বলেছিল। ফলত তার কাছে যে-ই-ই আসত, পার পেয়ে যেত।

অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার তার একটা অভ্যন্তরীণ তাগিদ থাকত, আমার এক সত্যিকারের বন্ধুর আবিষ্কার হচ্ছে, ভাণ্ডেভান্টের সব সময় ‘O.K’ নির্দেশক বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করত (অবশ্যই এই আবিষ্কার তোমার মনে পড়বে না, আমি তোমাকে ইঙ্গিত করছি না। আমি কি এতই পাগল যে, তোমাকে সত্যিকারের বন্ধু ভাবব!’

যতই মাস যেতে লাগল, আদালতে মামলার সংখ্যা কমে গেল। আর অসংখ্য শোচনীয় ডাকাত, লুটেরা, হত্যাকারী, দুর্বৃত্ত, তাদের বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে গেল, এতটুকু কলঙ্কের দাগ গায়ে না লাগিয়ে।

স্বভাবতই নিউইয়র্কের গুণীজনের পরিস্থিতি বুঝতে ও কারণ নির্দেশ করতে বেশি সময় লাগল না। ভাণ্ডেভান্টেরের চাকরি আড়াই বছরের বেশি টিকছিল না। সে বুঝতে পারছিল, সহকর্মীদের সঙ্গে যে অন্তরঙ্গতায় সে অভ্যস্ত, তা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে ও তার উপরওয়ালারা আর তাকে সপ্রশংসায় অভিনন্দিত করছে না। উচ্চতর পদে উন্নীত হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠছিল না। এমন কি যথাযথ মুহূর্তে বোরো সভাপতি কাকার কাছে উল্লেখেও কোনো কাজ হয়নি।

ভাণ্ডেভান্টের আমার কাছে এল। যেমন সমস্যাসঙ্কুল হয়ে যুবকেরা জগতের অভিজ্ঞ জনের কাছে আশ্রয় ভরসা খুঁজতে আসে (জানি না বন্ধু, তুমি কী মনে করছ। আমি কারো সুপারিশ করতে পারি কিনা, জানতে চাইবে। অনুগ্রহ করে অযথা অকারণ আমার খেই হারিয়ে দিও না)

‘আঙ্কেল জর্জ,’ ভাণ্ডেভান্টের বলল, ‘বিনা কারণেই আমাকে প্রমোশন দিতে অনীহা। আমি শূন্য সারিতে নতুন গোয়েন্দা হয়ে রয়েছি। আমার অফিস, করিডোরের একেবারে মাঝখানে। আমার শৌচাগারের দরজার লক বন্ধ হয় না। আমি এসবে কিছু মনে করি না।

কিন্তু জানেন, আমার সোনা মিনার্ভা তার নিটুট সারল্যে জানিয়েছে যে, তার মানে আমি একজন ব্যর্থ বিফল। তার ছোট্ট হৃদয় এই চিন্তায় ভেঙে পড়েছে।

‘আমি একজন অসফলকে বিয়ে করতে পারি না, ছোট্ট ঠোঁট অভিমান ভরে উল্টিয়ে ও বলেছে, ‘লোকেরা আমায় দেখে হাসবে।’

‘তোমার এই দুর্দশার কী কোনো সঙ্গত কারণ আছে, বাবা ভাণ্ডেভান্টের?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।

‘কিছু না। আমার কাছে এটা রহস্য। স্বীকার করছি, কোনো সমস্যারই আমি কিনারা করতে পারিনি। কিন্তু আমার মনে হয় না, এটা কোনো কারণ, জানেন, কেউই সব কিছু সমাধান করে উঠতে পারে না।’

‘অন্য গোয়েন্দারা কি কিছু কিছু সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে?’

আমি জিজ্ঞাসা করি।

‘হ্যাঁ, কখনো সখনও তারা করে। কিন্তু যেভাবে করে, তাতে আমি আহত হই। তাদের অপ্রিয় রকমের অবিশ্বাসের ধাত, অতি শোচনীয় সন্দেহপ্রবণতা। অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে অমার্জিত দৃষ্টি দিয়ে তারা বলে, ‘এ-ই’ ‘কি-রে!’ এতে তাদের অপমান করা হয়।

‘এটা ঠিক আমেরিকান পদ্ধতি নয়।’ এটা কি সম্ভব, যে অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ মিথ্যা বলতেই পারে, আর তাদের সাথে সন্দেহ নিয়েই কথাবার্তা চালানো উচিত?’

এক মুহূর্তের জন্য ভাণ্ডেভান্টেরকে হতবুদ্ধি লাগল, ‘কেন, আমাকে তা বিশ্বাস করতে হবে? কী সাংঘাতিক চিন্তা!’

‘বেশ, এ ব্যাপারে আমাকে চিন্তা করতে দাও।’ আমি বলি।

.

‘সেই সন্ধ্যায় আজাজেকে ডাকলাম। দুই সে.মি. লম্বা জিন। যে দু’একটি উপলক্ষ্যে তার রহস্যময় ক্ষমতা নিয়ে আমার কাছে এসেছে। জানি না এর আগে তোমাকে তার কথা বলেছি কিনা, ও বলেছি! বলেছি নাকি!’ আচ্ছা, সে আমার ডেস্কের ওপর রাখা হাতির দাঁতের ছোট্ট বৃত্তের ওপর আবির্ভূত হল। ওটার ওপরই আমি বিশেষ ধূপধূনা জ্বালাই আর প্রাচীন যাদুমন্ত্র সকল আবৃত্তি করে থাকি, বিস্তারিত, যদিও গোপনীয়।

যখন সে দেখা দিল, পরনে ছিল দীর্ঘ লুটিয়ে থাকা পোশাক। অন্তত তার লেজের গোড়া থেকে মাথার শিং পর্যন্ত সে মাত্র দুই সে.মি. দীর্ঘ। তার তুলনায় লুটানো পোশাক অনেক লম্বাই লাগছিল। একটা হাত উঁচুতে ওঠানো, আর এপাশ ওপাশ লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকারে কথা বলছিল।

স্পষ্টতই সে কিছু না কিছুর মধ্যে ছিল। সে এমনই এক প্রাণী, সব সময়েই অদরকারি কাজে ব্যস্ত থাকে। আমি কখনোই তাকে সম্পূর্ণ অবসর বা শান্ত সমাহিত অবস্থায় পাইনি। সে সর্বদা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে মগ্ন থাকে, আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ক্ষেপে যায়।

এইবার যা হোক্, সে আমার সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গে হাত নামিয়ে হাসল। অন্ততপক্ষে আমি ভাবলাম যে, সে হাসল, কারণ তার মুখ-মণ্ডলকে বিশদভাবে দেখতে পাওয়া সুকঠিন। একদা সুবিধা হবে ভেবে, হাত লেন্স ব্যবহার করেছিলাম, তাতে সে অহেতুক অসন্তুষ্ট হয়েছিল।

সে বলল, ‘এটা বলতে গেলে ভালই। আমি আমার নতুন পদকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমার বক্তৃতা আমি আগেই তৈরি করে রেখেছি। সাফল্য সম্পর্কেও আমি সুনিশ্চিত।’

‘কিসের সাফল্য, হে মহিমময়! যদিও যে কোনো বিষয়েই তোমার সাফল্য সুনিশ্চিত।’

(এই ধরনের লম্বা চওড়া কথা শুনতে সে ভালবাসে। এ বিষয়ে অদ্ভুতভাবে সে তোমার সঙ্গে তুলনীয়)।

সন্তোষের সঙ্গে সে বলল, ‘আমি এখন রাজনীতিক অফিস চালাচ্ছি। আশা করা যাচ্ছে, আমি গড শিকারী হিসাবে নির্বাচিত হবো।’

‘আমি কি বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে পারি, তুমি গ্রড সম্পর্কে জানকারি দিয়ে, আমার অজ্ঞতা দূর করবে কি-না?’

‘কেন? গ্রড হল আমাদের জগতের এক ধরনের পোষ্যজীব। এদের মধ্যে কারো কারো লাইসেন্স থাকে না। এই ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীরা ধূর্ত, শয়তান। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে অটল। কার্য সমাধা করতে বলশালী, বুদ্ধিমান একজন কাউকে চাই। কিছু জন রয়েছে, যারা নাক সিঁটকিয়ে বলছে ‘আজাজেল্‌ ভাল এড শিকারী হতে পারবে না’ কিন্তু আমি তাদের দেখাতে চাই, আমি পারি।

বল, এখন তোমার জন্য কী করতে পারি আমি?’

আমি পরিস্থিতি বাখ্যা করতে আজাজেল্‌ অবাক হল।

‘তার মনে বলতে চাও, তোমাদের শোচনীয় পৃথিবীতে প্রকৃত সত্যের সঙ্গে যদি বক্তব্য না খেলে, তবে লোকটা তা বুঝতে পারে না?

‘আমাদের লাই ডিটেক্টার বা মিথ্যা নির্ধারক যন্ত্র আছে,’ আমি বলি, ‘তাতে রক্তচাপ, ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা ইত্যাদি মাপা যায়। এটা মিথ্যাও ধরে ফেলতে পারে। যদিও সাথে সাথে স্নায়বিক দৌর্বল্য বা মানসিক চাপকেও মিথ্যা বলে ভুল করে!’

‘স্বভাবতই! বুদ্ধিমান প্রজাতির কার্যকরী সক্ষম স্নায়ুগ্রন্থি রয়েছে, যা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেখাতে পারে বা ঐ রকম কিছু, যা তুমি জানতে পার না।’

আমি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলাম। বললাম ‘কোনো উপায় আছে কি, যাতে শূন্য সারির গোয়েন্দা রবিনসন, ঐ কার্যকরী স্নায়ুগ্রন্থিসমূহ চিহ্নিত করে ফেলতে পারে?’

‘তোমাদের ঐ স্থূল যন্ত্র ছাড়াই? শুধুমাত্র মনের ক্ষমতা ব্যবহার করে?’

‘হ্যাঁ’।

‘নিশ্চয়ই বুঝেছ, তোমাদের প্রজাতির একজনের মন নিয়ে খেলা করতে বলছ আমায়। তোমাদের মন বড় বটে, তবে যারপরনাই অমার্জিত।’

‘আমি বুঝতে পারছি।’

‘আচ্ছা, চেষ্টা করবো। আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে হবে অথবা তাকে া মার কাছে আনতে হবে। যেভাবেই হোক, তাকে পরীক্ষা করতে দাও।

‘নিশ্চয়ই।’

আর সেটা সম্ভব করা গেলও।

সম্ভবত ভাণ্ডেভান্টের সপ্তাহখানেক বাদে তার সম্ভ্রান্ত মুখমণ্ডলে উৎসাহের ছা নিয়ে আমার কাছে এল।

‘আঙ্কেল জর্জ,’ সে বলল, ‘একটা মস্ত আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেছে। এক মদের দোকানে, ডাকাতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এক যুবককে জেরা করছিলাম। সে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা দিচিছল যে সে দোকানটা পার হচ্ছে, মাথায় ভীষণ চিন্তা। কারণ, আধ বোতল জিন খাওয়ার পর তার বেচারী মায়ের ভীষণ মাথার যন্ত্রণা।

দোকানে সে থেমেছিল, তার জিজ্ঞাসা করার ছিল, আধ বোতল রাম খাওয়ার পর পরই, সমপরিমাণ জিন খাওয়া কী যুক্তিযুক্ত? কিন্তু কী কারণে দোকানদার তার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে কাউন্টারের যাবতীয় নগদ অর্থসমূহ তার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সে বলতে পারবে না। যুবকটি অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়ে, সেগুলো নিয়েছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ এসে পড়ল। সে ভেবেছিল তার প্রিয় মায়ের ব্যথার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বুঝি দোকানদার তাকে এগুলো দিচ্ছিল। সে আমাকে যখন ঐ সব বলছিল, অদ্ভুতভাবে আমার মাথায় এল, সে গুল মারছে।’

‘সত্যি!’

‘হ্যাঁ, এমন অদ্ভুত ব্যাপারের অভিজ্ঞতা আমার ইতিপূর্বে হয়নি।’ ভাণ্ডেভান্টেরের গলার স্বর চুপি চুপি হয়ে এল, ‘শুধু আমি এটাই জানতে পারলাম না যে, যুবকটি বন্দুক নিয়েই দোকানে ঢুকেছিল, একথাও জেনে গেলাম, তার মায়ের কোনো রকম শিরঃপীড়াই হয়নি। ভাবতে পারেন আপনি, কেউ মাকে নিয়ে গুল মারছে?’

আরো নিবিড় অনুসন্ধানে ভাণ্ডেভান্টেরের ধারণাই সর্বতোভাবে সত্য হল। যুবকটি তার মায়ের সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল।

সেই মুহূর্ত থেকে ভাণ্ডেভান্টের-এর ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধারালো হয়ে উঠল। এক মাসের মধ্যেই সে মিথ্যাবাদী চিহ্নিত করতে তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টিসম্পন্ন অনুতাপহীন যন্ত্র হয়ে উঠলো।

গোয়েন্দা বিভাগ রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে পর্যবেক্ষণ করল। অভিযুক্তের পর অভিযুক্ত ভাণ্ডেভান্টেরের চোখকে ফাঁকি দিতে পারছে না। কোনো বেচারীর লুণ্ঠিত হওয়াকালীন বিবৃতিতে লুটেরার বিনীত আবেদন কোনো মতেই ভাণ্ডেভান্টেরের কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের সামনে টিকতে পারত না।

যে সমস্ত আইনবিদগণ অনাথ শিশুদের তহবিল ভেঙে, নিজেদের অফিসের জৌলুস বাড়াচ্ছিল, সব ঝটপট হেরে গেল। যেসব অ্যাকাউন্ট্যান্ট ‘ট্যাক্স বাকির আওতায় থাকা কোনো টেলিফোন নম্বর বাদ দিচ্ছিল, তারা নিজেদের কথার জালে নিজেরাই ধরা পড়ে গেল। ড্রাগ ব্যবসায়ী যারা নাকি, ক্যাফেটোরিয়া থেকে চিনি ভেবে পাঁচ কিলো হেরোইন তুলে নিয়েছিল, সব সাথে সাথে ভাণ্ডেভান্টেরের যুক্তির তোড়ে ভেসে গেল।

তার আখ্যা হয়ে গেল, ‘বিজয়ী ভাণ্ডেভান্টের’ পুলিশের সমবেত গোষ্ঠির অভিনন্দনের সাথে সাথে কমিশনার নিজে ভাণ্ডেভান্টের শৌচাগারের দরজার চাবি পুরস্কার দিলেন। তার অফিস, করিডরের প্রান্তে নিয়ে যেতে আপত্তি তুললেন না।

আমি নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম। সব ভাল হয়েছে এবং এবার ভাণ্ডেভান্টেরের সাফল্য নিশ্চিত। সে এখন সুন্দরী মিনার্ভা স্লাম্পকে বিবাহ করতে প্রস্তুত। এমন সময়ে মিনার্ভা আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় এসে দাঁড়াল।

‘ওহ, আঙ্কেল জর্জ’ সে ডুকরে উঠল, চোখের জল তার সুন্দর ঠোঁট পর্যন্ত গড়িয়ে এল, ‘ভাণ্ডেভান্টের!’

‘নিশ্চয়ই, সে তোমার ওপর কোনো অবাঞ্ছিত, অশোভন আচরণের সুযোগ নিয়ে তোমাকে আঘাত দেয়নি।’

‘না-না, আঙ্কেল জর্জ, সে এত মার্জিত রুচি সম্পন্ন! বিয়ের আগে ওসব কিছু অবশ্যই নয়। যদিও আমি সযত্নে তাকে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলাম যে, আমি বুঝি, কখনো হর্মোনের কারণে, যুবকদের ওপর অধিক প্রভাব যদি পড়ে যায়, সেক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে গেলে, আমি তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত। আমার নিশ্চিত আশ্বাস সত্ত্বেও বরাবর তার সংযম ছিল।’

‘তাহলে, কি মিনার্ভা?’

‘ওহ, আঙ্কেল জর্জ! ভাণ্ডেভান্টের আমাদের এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছে।’

‘অবিশ্বাস্য। তোমাদের জোড় তো সর্বোৎকৃষ্ট।’

‘সে বলেছে, আমি যথাযথ বিবৃতি দিই না।’

আমার অনিচ্ছুক ঠোঁটে শব্দ তৈরি করে নিল, ‘মিথ্যাবাদী।’

মিনার্ভা মাথা নাড়ল, ‘ঐ পাপ শব্দটা সে উচ্চারণ করে নি, কিন্তু সে তাই-ই মানে করেছে। মাত্র আজ সকালেই সে যখন প্রণয়ীর বিগলিত মোহময় দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল আর বলছিল, ‘প্রিয়া আমার, তুমি সর্বদা আমার কাছে সত্যবাদিনী ছিলে তো?’ আর আমি তো তাই।

আমি আবেগ ভরে বলেছিলাম, ‘সূর্যের কিরণ সূর্যের কাছে যত সত্য, গোলাপের পাপড়ি গোলাপের কাছে যত সত্য, ঠিক তেমন।’ তার চোখ সরু হয়ে গেল, ঘৃণাভরে বলে উঠল, ‘আহ, তোমার বিবৃতি সত্যের সঙ্গে মিলছে না, তুমি মিথ্যা বলছো।’

মনে হলো আমাকে কেউ সজোরে ঘুষি মেরেছে। আমি বললাম, ‘ভাণ্ডেভান্টের আমার, কী বলছ কী তুমি?’

সে জবাব দিল, ‘যা তুমি শুনলে। আমার ভুল হয়েছিল। আমরা চিরদিনের জন্য পৃথক হয়ে যাব। আর, সে চলে গেল। ও, এখন আমি কী করি? কী করতে পারি? কোথায় আবার সফলতা খুঁজতে যাব।

চিন্তিতভাবে বললাম, ‘ভাণ্ডেভান্টের কয়েক সপ্তাহ হল, এসব ব্যাপারে সচরাচর ঠিকই বলছে।’

তুমি কি তার কাছে কখনো অসত্য বলেছ?’

মিনার্ভার গালে এক আবছা শরমের ছায়া ঘনাল, ‘সে ভাবে ঠিক নয়।’

‘কী ভাবে ঠিক নয়?’

‘বেশ কয়েক বছর আগে, আমি কিশোরী মাত্র, সতেরো বছর বয়স। আমি এক যুবককে চুম্বন করেছিলাম। আমি তাকে চেপে ধরে রেখেছিলাম। স্বীকার করছি, কিন্তু সে শুধু যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে, তাই। ব্যক্তিগত আসক্তির জন্য নয়।’

‘আচ্ছা!’

‘সেটা খুব আনন্দের অভিজ্ঞতা ছিল না। অন্তত খুব বেশি নয়। ভাণ্ডেভান্টেরের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। অন্য যুবকের সঙ্গে আমার যে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, তার চেয়ে কত বেশি খুশি নিয়ে আসতে পারে, ভাণ্ডেভান্টেরের চুম্বন।

খুশির থেকে বেশি। স্বভাবতই তখন আমার অভিজ্ঞতা বাড়াবার ইচ্ছা হলো। ভাণ্ডেভান্টেরের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যেই মাঝে মাঝে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার উদ্দেশ্যেই আমি অন্য যুবকদের চুম্বন করে দেখেছিলাম, একটাও নয়, একটাও নয় আমার ভাণ্ডেভান্টেরের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। সেইসব করতে, আমি আপনাকে নিশ্চিত বলছি, আঙ্কেল জর্জ, আমি তাদের সমস্ত প্রকার ও ভঙ্গিমার চুম্বনে প্রশ্রয় দিয়েছি। আঁকড়ে ধরা বা মোচড়ানোতে কোনো আপত্তি করিনি, তবু কোনো দিকেই তারা ভাণ্ডেভান্টেরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। আর তবু সে বলবে, ‘আমি সত্যবাদিনী নই।’

‘কী হাস্যকর।’ আমি বলি, শোনো বাছা, তুমি ভুল করছো।’

আমি তাকে চার পাঁচবার চুমু খেলাম, তারপর বললাম ‘ভাণ্ডেভান্টেরের মতন খুশি করতে পারিনি, তাই তো?’

‘আচ্ছা, দেখি তবে,’ সে বলল, আরো চার পাঁচবার আমাকে চুমু খেল আবেগের সঙ্গে। তারপর বলল, ‘একবারেই নয়।’

‘আচ্ছা, আমি ভাণ্ডেভান্টেরের সঙ্গে দেখা করছি।’ আমি বলি সেই রাতে ভাণ্ডেভান্টেরের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হলাম। সে নিজের বসবার ঘরের মেঝেতে বসেছিল আর রিভলভারে গুলি ভরছিল।

‘তুমি তাহলে’ আমি বলি, ‘নিঃসন্দেহে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছ।’

‘কক্ষনো নয়। দম ফাটানো হাসি হেসে বলল, ‘কী কারণে আত্মহত্যা করতে যাব? তুচ্ছ একটা মেয়ে মানুষের ক্ষতিতে। কিংবা এক গপ্পো বানিয়ের? তার সঙ্গে ঠিকই করেছি আমি।’

‘তুমি ভুল বলছ। মিনার্ভা সব সময় তোমার কাছে সত্যবাদিনী। তার হাত, তার ঠোঁট, তার শরীর কখনো অন্য কোনো পুরুষের হাত, পা বা শরীরের সংস্পর্শে আসেনি, একমাত্র তুমি ছাড়া।’

‘আমি জানি, তা সত্যি নয়,’ ভাণ্ডেভান্টের বলে।

‘আমি বলছি সেটাই সত্য, আমি বলি, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে ক্রন্দসী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমার কাছে তার জীবনের অন্তর্নিহিত গোপন সত্য প্ৰকাশ করেছে।’

এক সময় সে এক যুবকের প্রতি উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিয়েছিল। তখন তার বয়স পাঁচ। ছেলেটির ছয়। সেই ক্ষণিক প্রণয়ের উন্মত্ততার জন্য তখন থেকে এ যাবৎ সে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে। আর কখনো এমন অশ্লীল দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হবে না। তুমি শুধু সেই মুহূর্তেই তাকে চিহ্নিত করেছিলে।’

‘আপনি কি সত্যি বলছেন, আঙ্কেল জর্জ?’

‘তোমার অব্যর্থ হৃদয়বিদারক দৃষ্টি দিয়ে দেখ, আমি আবার বলছি, যা এক্ষুনি বললাম আর তারপর বল, আমায়, সত্যি বলছি কী না?’

আমি গল্পটা আবার বললাম। আর সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আপনি একদম যথার্থ ও আক্ষরিক সত্য বলেছেন, আঙ্কেল জর্জ। আপনার কি মনে হয়, মিনার্ভা কি আমাকে কখনো ক্ষমা করবে?’

‘নিশ্চয়ই,’ আমি বলি, ‘মিনার্ভার কাছে গিয়ে নত হও। আর তারপর মদের দোকান, পৌরসভা, সিটি হলের করিডোর ইত্যাদি অন্ধকার জগতের পাঁকের মধ্যে, তোমার অনুসন্ধান চালিয়ে যাও। কিন্তু কখনো তোমার শ্যেনদৃষ্টি প্রিয়তমার ওপর বর্ষণ করো না। প্রকৃত ভালবাসা হচ্ছে, প্রকৃত বিশ্বাস আর তোমার মিনার্ভাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে।’

‘আমি করবো, আমি করবো। চিৎকার করে উঠল সে। আর সেই থেকে ভাণ্ডেভান্টের তাই-ই করে আসছে। ঐ বিভাগে সে এখন সবচেয়ে সুপরিচিত গোয়েন্দা। সম্প্রতি হাফ ক্লাস ডিটেকটিভ পদে উন্নীত হয়েছে। লন্ড্রি ঘরের পাশেই বেসমেন্টে তার অফিস।

মিনার্ভার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে শান্তিতে কাল কাটাচ্ছে। মিনার্ভা ভাণ্ডেভান্টেরের চুম্বনের চেয়ে উৎকৃষ্ট খুশির চুম্বন হতে পারে কিনা পরখ করে চলেছে পর পর, পরমানন্দে। সময় আসছে যখন পরীক্ষার জন্য মিনার্ভা কোনো পছন্দের মানুষের সঙ্গে সারারাত কাটিয়ে আসবে। কিন্তু ফল হবে একই। ভাণ্ডেভান্টেরই শ্রেষ্ঠ। বর্তমানে সে দুই পুত্রের জননী। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ভাণ্ডে ভাল্টেরের সামান্য সাদৃশ্য রয়েছে।

আর তোমার দাবি অনুযায়ী বন্ধু, আমার পরিশ্রম আর আজাজেলেরও, সব সময়ই বিপর্যয় আনে না।

.

‘যেমন ঘটল যদিও’ আমি বলি, ‘যদি তোমার গল্প মেনে নিই, তুমি ভাণ্ডেভান্টেরকে মিথ্যা বলেছিলে, যখন বলেছিলে, মিনার্ভা অন্য কোনো পুরুষকে ছোঁয়নি।’

‘আমি ও কথা বলেছিলাম, এক সরল তরুণীকে বাঁচাতে।

‘কিন্তু ভাণ্ডেভান্টের কেন তোমার মিথ্যা ধরতে পারল না?’

‘আমার মনে হয়’ জর্জ ঠোঁটের থেকে ক্রীম আর চীজ মুছে ফেলে বলল, ‘সেটা হচ্ছে আমার অপ্রতিরোধ্য মর্যাদার প্রভাব,’ জর্জ বলল।

‘আমার অন্য একটা তত্ত্বও রয়েছে,’ আমি বলি, ‘আমার মনে হয়,

না– তুমি, না তোমার ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা, না তোমার সূক্ষ্ম হর্মোনের প্রতিক্রিয়া, কিছুই সত্য মিথ্যা ফারাক করতে পারে না, না কেউ তোমার ওপর অনুশীলন করে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করতে পারে।

‘হাস্যকর।’ জর্জ বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *