গ্যালেটিয়া

গ্যালেটিয়া

কিছু অজ্ঞাত কারণে, বিশেষ করে আমার নিজের ক্ষেত্রে, আমি মাঝে মাঝেই জর্জকে আমার অন্তরতম অনুভূতির আশ্রয়স্থল মনে করতাম। যেহেতু, তার ফুরন্ত আবহমান সান্ত্বনার ভাণ্ডার ছিল, সবটাই তার নিজের জন্য সংরক্ষিত, কিন্তু তা নিষ্প্রয়োজন, তাই যখন তখন আমিই ব্যবহার করতাম।

অবশ্যই আমার আত্ম-অনুকম্পার নিজস্ব ভাঁড়ার সেই মুহূর্তে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, তাই আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না।

পীকক-এ্যালে’তে ভালরকম লাঞ্চের পর আমরা স্ট্রবেরী কেকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর আমি বললাম, ‘আমি কী করতে চাই, সমালোচকেরা সেটা খুঁজে বার করতে চেষ্টাই করে না। আমি অসুস্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তারা যদি আমি হত, তবে কি করত, আমি তা জানতে চাই না। যতই হোক, তারা লিখতে জানে না, আর সমালোচক হয়ে সময় অপচয় করাও তাদের উচিত নয়।

আর, যদি তারা লিখতেই পারে, একটা স্তরে তাদের সমালোচনার একমাত্র কাজ হল, লেখকদের দূরছাই করতে পারার সুযোগ পাওয়া। আর বেশি কি?’

কিন্তু স্ট্রবেরী কেক এসে গেল, আর জর্জও যেন কথাবার্তা চালাবার সুযোগ ধরে নিল। তবে ঠিক তখনই কেক এসে না পড়লেও ঐ ধরনের কিছু সে করতই।

সে বলল, ‘ভাই, জীবনের উত্থান-পতন শান্তভাবে গ্রহণ করার শিক্ষা তোম পাওয়া দরকার। নিজেকেই বল, কেননা এটা তো সত্যি, যে পৃথিবীর ওপর তো র যাচ্ছেতাই রচনার প্রভাব এতই সামান্য যে, সমালোচকেরা যাই-ই বলুক না কেন, যদি তারা কিছু বলতে চায়ও, সবটাই নিষ্ফল। এ ধরণের চিন্তা তোমাকে অনেক শান্তি দেবে আর আলসার হওয়াও প্রতিরোধ করবে।

‘যদি বুঝতে, আমার কাজকর্ম, তোমার লেখার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মাঝে মাঝে তোমার লেখার যে সমস্ত সাংঘাতিক সমালোচনা আমি পাই, তাতে আমার সামনে বিরক্তিপূর্ণ ভাবপ্রবণ বক্তৃতা দিতে বিরত হতে।’

কেক কাটতে কাটতে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে বলি, ‘তুমি কী বলতে চাও, তুমিও লেখ।’

নিজের কেক কাটতে কাটতে জর্জ বলে, ‘আমি তার চেয়েও যোগ্যতর ব্যক্তিসত্তা, মনুষ্যত্বের শুভার্থী, একজন ভর্ৎসিত, নিন্দিত, কিন্তু মানব শুভ চিন্তক।’

সামান্য অশ্রুভেজা ছিল তার চোখ, আমি শপথ করে বলতে পারি। সদয়ভাবে বললাম, ‘আমি তা মনে করি না। তোমার সম্পর্কে কারও ব্যক্তিগত মতামত কেমন করে এতটা নেমে যেতে পারে, যাতে তা প্রশংসাযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে না।’

জর্জ বলল, ‘আমি উন্নাসিকতা উপেক্ষা করি। যেহেতু তোমার থেকে এর সূত্রপাত, তোমাকে বলি, আমি সেই সুন্দরী রমণী এল্ডারবেরী মাগ্‌স এর কথা ভাবছি।’

অবিশ্বাসের সঙ্গে বলি ‘এল্ডারবেরী’!

জর্জ বলল, ‘তার নাম ছিল এল্ডারবেরী। জানি না কেন, পিতামাতা তার অমন নাম রেখেছিলেন। হতেও পারে, তাদের বিবাহ পূর্ব সম্পর্কের কোনো স্নিগ্ধ স্মৃতি বিজড়িত মুহূর্ত রয়েছে। এল্ডারবেরীর নিজস্ব মত ছিল যে, তার পিতামাতা উভয়েই তার জন্মের সূচনার ক্রিয়াকলাপের সময়ে, এল্ডারবেরী সুরায় আপ্লুত ছিলেন। নতুবা তার জন্মের হয়তো কোনো সম্ভাবনাই ঘটত না।

যাই-ই হোক, ওর বাবা আমার পুরনো বন্ধু। মেয়ের খৃষ্টীয় নামকরণের সময়ে আমাকে ওর ধর্মপিতা হতে অনুরোধ করলে, আমি তা প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি।

আমার অনেক বন্ধুই আমার সৌম্য চেহারা ও আমার অকপট ধর্মভাবে মোহিত হয়ে, গীর্জাতে আমাকেই নিকটতম আপনজন মনে করেন, যার ফলে আমি অনেকের ধর্মপিতৃত্ব গ্রহণ করেছি।

স্বভাবত এসবই আমি গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করি এবং পদটির দায়িত্ব সম্পর্কে আমি তীব্র সচেতন। পরবর্তী জীবনে তাই আমার ধর্ম সন্তানদের যত কাছাকাছি সম্ভব থাকি। সকলেই বড় হয়ে, এল্ডারবেরীর মতন স্বর্গীয় সৌন্দর্য লাভ করেছে।

এল্ডারবেরীর বিশ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান আর সে প্রচুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়ে বসে। তাতে পৃথিবীর চোখে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

আমি নিজে অর্থের মতন আবর্জনা দিয়ে কিছু করার অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু অনুভব করলাম, সৌভাগ্যান্বেষীদের হাত থেকে এল্ডারবেরীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে আমার। সে জন্য আমার ব্যবসা, তার সমাজেই বিস্তৃত করেছিলাম।

আর প্রায়ই তার বাড়িতে ডিনার করতে যেতাম। যতই হোক, আঙ্কেল জর্জ তার খুব প্রিয় ছিল। যেমন, তুমি বুঝতেই পারছ আর সে জন্য আমি তাকে নিন্দা করি না।

তারপর যা ঘটল, বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে তার আর বিশেষ প্রয়োজন রইল না। তার ভাস্কর্য শিল্পের ঔৎকর্ষ প্রশ্নাতীত ছিল এবং বাজারদরও ছিল অত্যন্ত চড়া। তার শিল্পজাত সামগ্রীর মান সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না, কারণ শিল্পে আমার আগ্রহ খানিকটা হাওয়ায় ভাসে। আর, স্থূল জনতার যে অংশের চিত্ত- বিনোদনের জন্য সৃষ্ট তার দ্রব্যসামগ্রী এবং যারা সেগুলোর দাম ধার্য করত, সেগুলোর কদর করতে পারব, এমন আশা করতাম না।

মনে আছে, একবার একটি বিশেষ খোদাই করা শিল্পকর্ম দেখে, সেটা কী বস্তু জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

সে বলেছিল, ‘দেখতেই পাচ্ছেন, লেবেল লাগানো রয়েছে ‘উড়ন্ত সারস’।

জিনিসটাকে ভাল করে দেখলাম, সূক্ষ্ম ব্রোঞ্জের ছাঁচে ঢালা।

বললাম, ‘লেবেল তো দেখছি, কিন্তু সারস কোথায়?’

‘এই তো, এখানে।’ ভোঁতা আকারের ব্রোঞ্জের ওপর থেকে ধাতুনির্মিত একটা ছোট্ট শঙ্কু, সূচালো হয়ে এসেছে।

চিন্তাশীল হয়ে বললাম, ‘ওটা কী একটা সারস?’

‘নিশ্চয়ই, এটাই তো। আপনি বুদ্ধু বৃদ্ধ!’ সে বলল (কারণ সে সব সময়ে আমাকে আদরের ডাকে ডাকত)। ‘এটা সারসের দীর্ঘ চঞ্চুর অগ্রভাগ। ‘

‘এটুকুই কি যথেষ্ট, এল্ডারবেরী।

এল্ডারবেরী বলল, ‘সম্পূর্ণরূপে। এটা ঠিক সারস নয়, যা আমি দেখাতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে সারস্বত্বের বিমূর্ত ভাব। যেমনটি ঠিক আমার মনে এসেছে।’

‘হ্যাঁ। তাই-ই,’ খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে বলি, ‘এখন, যখন তুমি বলেই দিলে।’

‘তবু, লেবেলে লেখা আছে, উড়ন্ত সারস। সেটা কী করে হচ্ছে!’

সে আশ্চর্য হয়ে গেল, ‘কেন ছেলেমানুষের মতন কথা বলেন? আপনি কি ব্রোঞ্জের এবরোথেরো অমসৃণ তলাটা দেখতে পাচ্ছেন না?’

আমি বলি, ‘হ্যাঁ, ওটা তো জোর নজর কেড়েছে আমার।’

‘আর আপনি তো বাতাস কিংবা কোনো গ্যাসের মতন কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবেন না। এটা তেমনই অসমাকৃতি বস্তু। আসলে এই অমসৃণ ব্রোঞ্জের তলাটা হচ্ছে আবহমণ্ডলের স্ফটিক-স্বচ্ছ বিমূর্তভাব। আর এই দেখুন। এই তলাটার ওপরেই রয়েছে প্রায় আনুভূমিক এক সূক্ষ্ম সরলরেখা।’

‘হ্যাঁ, সত্যিই। তুমি দেখিয়ে দেওয়ার পর যা কিছু দুর্বোধ্য ছিল, হয়ে গেল জল।’

‘ওটাই হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে উড়ানের বিমূর্ত ভাব।’

‘লক্ষণীয়, বুঝিয়ে দেওয়ার পর স্বচ্ছ, স্পষ্ট। তা এটার জন্য কত পেলে?’

‘ওঃ! যেন এসবের মধ্যে কিচ্ছুটি নেই,’ এইভাবে অবহেলা ভরে একটা হাত নাড়িয়ে বলল, ‘বোধহয় দশ হাজার ডলার। এটা এমনই সরল সুস্পষ্ট এক বস্তু। এর থেকে বেশি দাম চাইতে আমার অপরাধবোধ জাগল। অন্য কিছুর চেয়ে, কোনোরকমে একটা দাম ধরে দেওয়া আর কি!’

‘ঐ রকম নয়,’ সে দেওয়ালে টাঙানো এক বস্তুর দিকে হাত নাড়ল।

গুণচট আর কার্ডবোর্ডের টুকরো দিয়ে তৈরি, মধ্যে একটা ভাঙা ডিম ফেটানোর যন্ত্র, দেখাচ্ছে বহু ব্যবহৃত মলিন। আমি শ্রদ্ধাসহকারে দেখলাম, ‘অমূল্য অবশ্যই!’

‘আমারও তাই বোধ হয়,’ সে বলল, ‘জানেন তো ওটা কোনো নতুন ডিম ফেটানোর যন্ত্র নয়। দীর্ঘদিনের জীর্ণতার বহিঃসৌন্দর্য্য রয়েছে ওতে। আমি কারো একটা রাবিসের থলি থেকে পেয়েছি।’

আর তারপর, কোনো কারণে আমি থই পেলাম না, ওর নিচেকার ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল আর সে কম্পিত স্বরে বলল, ‘ওঃ, আঙ্কেল জর্জ।’

চকিত হয়ে, তার সমর্থ বামহাতখানি হাতে নিলাম। তার শক্তপোক্ত ভাস্করের অঙ্গুলিসমূহে মোচড় দিয়ে বললাম, ‘ওটা কি বাছা?’

‘ওঃ জর্জ’ সে বলল, ‘শুধু জনসাধারণের রুচির মোকাবিলায় এই সমস্ত সরল বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করতে করতে, আমি এত শ্রান্ত হয়ে পড়েছি!

ডান হাতের গাঁটগুলো দিয়ে কপাল স্পর্শ করতে করতে করুণ স্বরে বলল, ‘আহা, যদি আমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম! যা আমার শিল্পী মন বলে, আমি তা অবশ্যই করবো।’

‘সেটা কী এল্ডারবেরী?’

‘আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আমি নতুন নতুন দিকে যেতে চাই। যা এ যাবৎ কেউ চেষ্টা করেনি, তাই চেষ্টা করতে চাই। যা কেউ সাহস করেনি, তাই সাহস করতে চাই, যা সৃষ্টি হয়নি, তাই সৃষ্টি করতে চাই।’

‘তাহলে করছো না কেন সোনা! যা ইচ্ছে করার মতন যথেষ্ট অর্থ তোমার রয়েছে।’

সে হঠাৎ হেসে উঠল আর সমস্ত মুখমণ্ডল লাবণ্যে ঝলমল করে উঠল।

‘ধন্যবাদ, আঙ্কেল জর্জ, সে বলল, ‘বললে বলে, অজস্র ধন্যবাদ। আসলে মাঝে মধ্যেই নিজের ইচ্ছামতো কাজ করি। আমার একটা গুপ্ত কক্ষ আছে। সেখানে ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। সেই রকম পরীক্ষা, যা কেবলমাত্র শিক্ষিত শৈল্পিক রুচিবোধই উপলব্ধি করতে পারে। যারা সাধারণের ঊর্ধ্বে প্রকৃত রুচিশীল।’

‘আমি সেগুলো দেখতে পারি?’

‘অবশ্যই আঙ্কেল। আমার ব্যাকুল বাসনাকে উৎসাহিত করতে, আপনি যা বললেন, তার পরে কি আমি ‘না’ বলতে পারি?’

সে একটা পুরু পর্দা ওঠাল, একটা গুপ্ত দ্বার দেখা দিল, যা প্রায় দৃশ্যমানই ছিল না, এমন ঘন হয়ে দেওয়ালে সাঁটা রয়েছে। একটা বোতাম টিপতেই বৈদ্যুতিক কায়দায় দরজা খুলে গেল।

ঘরে ঢোকামাত্রই পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জানলাবিহীন কক্ষ উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় দিবসের মতন উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। প্রায় সাথে সাথেই সামনে দেখলাম একটা প্রস্তরনির্মিত সারস মূর্তি। প্রতিটি পালক সস্থানে, প্রাণপূর্ণ উজ্জ্বল চোখ, ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁট। অর্ধেক পাখনা ছড়ানো। আমার চোখে বোধ হল, এক্ষুনি ও উড়ে যাবে।

‘ওরে বাপস!’ এল্ডারবেরী!’ আমি বলি, ‘এমনটা কখনো দেখিনি।’

‘তোমার এটা পছন্দ? আমি একে বলি ‘ফটোগ্রাফিক শিল্প।’ আর, সেদিক দিয়ে এটি সার্থক। যদিও সবটাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার। সমালোচক ও সাধারণে হাসবে আর নাক সিঁটকাবে, আমি কী করতে চেয়েছি বুঝবে না। তারা শুধু বিমূর্ত ভাবকেই সম্মান করে, যা শুধু ওপরওপর, ভাসাভাসা ব্যাপার। যে কেউই বুঝতে পারে। কিন্তু এটার মতন নয়, যার আবেদন শুধু সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির কাছে এবং যারা ধীরে ধীরে প্রতিভাত হতে দিয়ে পরিতুষ্ট হয়।

এরপর থেকে যখন তখন তার গুপ্তকক্ষে প্রবেশের সুযোগ আসছিল। তার শক্তিশালী অঙ্গুলি ও শিক্ষিত চিজেলের সাহায্যে তার অদ্ভুত, উদ্ভট শিল্পকর্ম পরীক্ষা করতে পারছিলাম। একটি স্ত্রীলোকের মাথা, যাকে দেখতে হুবহু এল্ডারবেরীর মতন। সেটির প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল।

আমি ওটাকে বলি, ‘আয়না,’ গালে টোল ফেলে সে লজ্জিত স্বরে বলল, ‘এতে আমার আত্মা শিল্পায়িত হয়েছে। তোমার মনে হয় না?’

আমি উৎসাহের সঙ্গে সহমত হলাম। এটাই আমার মনে হয়, তাকে শেষ পর্যন্ত তার গভীরতম গোপনতা আমার কাছে প্রকাশ করতে প্ররোচিত করেছিল।

আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এল্ডারবেরী, এটা কেমন করে হয়, যে তোমার কোনো-’

একটু থেমে সস্নেহ ভর্ৎসনায় বাক্য সম্পূর্ণ করলাম, ‘বয়ফ্রেন্ড নেই?’

‘বয়ফ্রেন্ড!’ গভীর ঘৃণার দৃষ্টিতে সে বলল, ‘যাঃ! তারা চারদিকে ঘোরে ফেরে। এইসব ভবিষ্যৎ বয়ফ্রেন্ড, যাদের কথা বলছ, তাদের দিকে আমি কেমন করে তাকাই? আমি একজন শিল্পী। আমার হৃদয়ে, মনে আত্মায়, প্রকৃত পুরুষালি সৌন্দর্য আঁকা রয়েছে। কোনো রক্তমাংসের চেহারা তারা নকল করতে পারে না। আর সেই অদ্বিতীয় সেই একমাত্র যে আমার হৃদয় জয় করতে পারে। সেই একমাত্রই আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছে।’

‘হৃদয় জয় করে নিয়েছে, সোনা।’ নরম করে বলি, ‘তাহলে তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে?’

‘মানে, আমি … আসুন আঙ্কেল জর্জ, আপনাকে তাকে দেখাই। আপনি আমার গোপনীয়তার ভাগ নিন।’

আমরা তার ফটোগ্রাফিক শিল্পের ঘরে গেলাম। আরেকটা পুরু পর্দা সরিয়ে দিতে, আমরা একটা চোরাকুঠুরির সামনে দাঁড়ালাম, যেটা আগে কখনো দেখিনি।

সেই চোরা কুঠুরিতে এক দীর্ঘকায় নগ্ন পুরুষ মূর্তি, যত দূর বলব, গাঠনিক মাত্রায় শেষ মিলিমিটার পর্যন্ত নিখুঁত।

এল্ডারবেরী আরেকটা বোতাম টিপল। মূর্তিটি বেদীর ওপর ঘুরে গেল, ধীরে ধীরে। মূর্তিটির মসৃণ সামঞ্জস্য ও নিখুঁত অনুপাত, প্রতিটি কোণা থেকে প্রকট হল।

‘আমার মাস্টারপীস্!’ এল্ডারবেরী প্রশ্বাস টানল। আমি নিজে পুরুষালি সৌন্দর্যের পূজারী নই, কিন্তু এল্ডারবেরীর সুন্দর মুখে এমন এক আকুলতা স্পন্দিত হতে দেখলাম, তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হল, সে প্রেমে ও পূজায় নিবেদিতা

‘তুমি মূর্তিটিকে ভালবাস? সাবধানে বললাম, ‘ওটাকে’ বললাম না।

‘ওঃ!, হ্যাঁ’ সে চুপিচুপি বলল, ‘আমি ওর জন্যে মরে যেতে পারি। যতক্ষণ ও রয়েছে, আমার সমস্ত পুরুষকে বিকৃত ও ঘৃণ্য মনে হয়। ও ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করবে, ভাবতেই বিতৃষ্ণা জাগে। আমি শুধু ওকেই চাই। শুধু ওকে।’

‘সোনা আমার’ আমি বলি,’মূর্তি তো জীবন্ত নয়!’

‘জানি জানি,’ সে ভেঙে পড়ল ‘আমার হতভাগ্য হৃদয় ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। আমি কী করবো?’

আমি বিড়বিড় করলাম ‘কী দুঃখের ব্যাপার। আমার পিগম্যালিয়নের কাহিনী মনে পড়ছে।’

‘কার কথা?’ এল্ডারবেরী বলল।

বেচারি অন্য সব শিল্পীর মত বাইরের জগৎ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানে না।

‘পিগম্যালিয়ন! প্রাচীন গ্রীস উপকথা।

পিগম্যালিয়ন তোমারই মতন ভাস্কর ছিল। তফাতের মধ্যে, সে ছিল পুরুষ। আর সেও তোমারই মতন এক মূর্তি তৈরি করেছিল, তফাতের মধ্যে তার পুরুষালি সংস্কারে সে নারীমূর্তি তৈরি করেছিল। যার নাম দিয়েছিল ‘গ্যালেটিয়া।’ সেই মূর্তি এত লাবণ্যময়ী, সে তার প্রেমে পড়ে গেল। দেখ, ঠিক তোমারই মতন, এখানে পার্থক্য হচ্ছে, তুমি গ্যালেটিয়া আর মূর্তিটি কল্পনা খোদিত।

‘না,’ সোৎসাহে এল্ডারবেরী বলল ‘ওকে আমি পিগম্যালিয়ন বলে ডাকবো, এমন আশা করো না। এটা একটা কর্কশ বিশ্রী নাম, আমি চাই কাব্যিক নাম। আমি ডাকবো, তার মুখমণ্ডল আবার প্রেমের প্রভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘হ্যাঙ্ক।’ হ্যাঙ্ক নামের মধ্যে এমন কমণীয় সুরেলা ছোঁয়াচ রয়েছে, যা আমার আত্মার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু পিগম্যালিয়ন আর গ্যালেটিয়ার কী হয়েছিল?’

আমি বলি, ‘ভালবাসায় ডুবে গিয়ে, পিগম্যালিয়ন দেবী অ্যাফ্রোডাইটের কাছে—’

‘কার কাছে?’

‘অ্যাফ্রোডাইট’ গ্রীসের প্রেমের দেবী। সে তার কাছে প্রার্থনা জানাল আর তিনি সহানুভূতিতে, মূর্তিটিতে প্রাণ দিলেন। গ্যালেটিয়া জীবন্ত রমণী হয়ে গেল, আর তারপর তারা সুখে জীবন কাটাল।

‘হুম্!’ এল্ডারবেরী বলল, ‘আমার ধারণা, সত্যি সত্যি অ্যাফ্রোডাইট নেই। আছেন কি?’

‘না, সত্যিই নেই। অন্য দিকে-’ কিন্তু আর কথা বাড়ালাম না।

আমি ভাবিনি যে, এল্ডারবেরী বুঝতে পারবে, যদি তাকে দুই সে.মি. লম্বা জিন আজাজেলের কথা বলি।

‘খুব খারাপ,’ সে বলল, ‘কেননা কেউ যদি আমার জন্য হ্যাঙ্ককে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারত, কেউ যদি তাকে শীতল কঠিন শ্বেতপাথর থেকে উষ্ণ নরম মাংসে পরিণত করতে পারত। আমি তাকে দিতাম- আঙ্কেল জর্জ আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। হ্যাঙ্ককে আলিঙ্গন করা আর হাতে তার দেহের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করা, উঃ নরম নরম।

সে এক সচেতন উল্লাসে পরমানন্দে বিড়বিড় করে চলল।

আমি বলি, ‘আসলে, সোনা এল্ডারবেরী। আমি এটা নিজে করতে পারি, এমন ভেবো না। কিন্তু আমি এমন ব্যবস্থা করতে পারি, যাতে তুমি আনন্দ পাও। কিন্তু তুমি বলছিলে যদি কেউ ওকে শীতল কঠিন শ্বেতপাথর থেকে উষ্ণ কোমল মাংসল করে দিতে পারে, তবে তুমি তাকে কিছু দেবে। তুমি কি তার জন্য মনে মনে বিশেষ কিছু ভেবে রেখেছ, সোনা?’

‘কেন? হ্যাঁ। আমি তাকে দশ লক্ষ ডলার দেবো।

আমি থতিয়ে গেলাম। যে কারোই ঐ বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রতি সরল শ্রদ্ধায় তাই-ই হত। বললাম, ‘এল্ডারবেরী, তোমার কি দশ লক্ষ ডলার আছে?’

‘আমার বিশ লক্ষ ডলার আছে। আঙ্কেল জর্জ, ‘

সে সরল অকপটে বলল ‘অর্ধেক চলে গেলেও আমার যথেষ্ট থাকবে। হ্যাঙ্কের জন্য ওটা আমি করতেই পারি। বিশেষত যেহেতু আমি জনসাধারণের জন্য আর কয়েকটা বিমূর্ত সৃষ্টি করেই দিতে পারি।

‘তাহলে তুমি পার,’ আমি বিড়বিড় করলাম, ‘বেশ, মন শক্ত রাখ এল্ডারবেরী, আর দেখ তোমার আঙ্কেল জর্জ তোমার জন্য কী করতে পারে

এটা একেবারেই আজাজেলের এক্তিয়ার। অতএব আমি ছোট্ট বন্ধুটিকে ডেকে নিলাম। দুটি ছোট্ট ছোট্ট শিং এর দলা আর খোঁচা খোঁচা কোঁচকানো লেজ নিয়ে সে দুই সে.মি. শয়তানস্বরূপ দেখতে।

বরাবরের মতন সে মন্দ মেজাজে ছিল আর কেন সে মন্দ মেজাজে রয়েছে তার একঘেয়ে বিবরণ দিয়ে আমার সময় নষ্ট করতে বাধ্য করছিল। মনে হল, সে শিল্প সংক্রান্ত কিছু করেছে, অন্তত তার নিজের একার জগতের হিসাবে। যদিও সে বিস্তারিত বিবৃতি দিচ্ছিল, তবু আমি সম্পূর্ণ বুঝছিলাম না। তবে সমালোচকরা নাকি ভ্রূকুটি করেছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব সমালোচকেরা এক রকম। আমার ধারণায়, অপদার্থ ও অসৎ, একজন ও সব্বাই।

তাতে যদিও আমি মনে করি, তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ পৃথিবীর সমালোচকদের সামান্য ভদ্রতার তলানিও থাকে। যদি আজাজেল্‌কে বিশ্বাস করা যায়, তবে তার সম্পর্কে, তাদের সমালোচকেরা যা বলে, তোমার সম্পর্কে সমালোচকেরা যা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি মন্দ। সবচেয়ে কোমল বিশেষণ হল, ঘোড়ার চাবুক। তোমার অভিযোগের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে, যাতে আমার এই ঘটনার কথা মনে এল।

খুব কষ্ট করে তার অনর্গল গালাগালের মাঝখানে বাধা দিয়ে কোনোমতে একটা অনুরোধ পেশ করা সম্ভব হল যে, একটি প্রস্তর মূর্তিতে প্রাণ দিতে হবে।

‘সিলিকেট জাত বস্তুকে কার্বন ও জলের সংমিশ্রণে জীবনে রূপান্তরিত কর! কেন, আমাকে বলছ না, পশুর বিষ্ঠা থেকে একটা গ্রহ সৃষ্টি করে দাও। পাথরকে কেমন করে মাংসে পরিণত করব?’

‘নিশ্চয়ই কোনো একটা উপায় বার করতে পারবে, হে, বলশালী’ আমি বলি, ‘মনে কর, এই মস্ত কাজটা তুমি করতে পেরেছ। আর তোমার নিজের জগতে তার নিদর্শন দিতে পারলে, সমালোচকদের মুখের ওপর জবাব দেওয়া হবে, সব বোকা গাধার দল।

‘তারা বোকা গাধার দলের চেয়েও মন্দ, আজাজেল্‌ বলল, ‘যদি তারা নিজেদের বোকা গাধা মনে করে, তবে সেটা একটু উঁচুদরের। এ রকম অনুভূতি তো তাদের পুরস্কার। আমি চাই, তারা নিজেদের আরো নিকৃষ্টতম জীব মনে করুক।

‘ঠিক এমনিই মনে করুক নিজেদের। তোমাকে যা করতে হবে, তা হল শীতলকে উষ্ণতায়, পাথরকে মাংসে, কঠিনকে নরমে বদলে দেওয়া। বিশেষভাবে নরম। আমার মনে হয়, এক যুবতী মূর্তিটিকে আলিঙ্গন করে বিশেষ কোমল অনুভূতি চায়, তার আঙ্গুলের নিচে প্রাণবন্ত স্পর্শ, শক্ত হবে না। মূর্তিটি এক পুরুষের সার্থক রূপায়ণ। তোমাকে শুধু তার পেশী, রক্তকোষ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্নায়ুতন্ত্র সৃষ্টি করে ত্বক দিয়ে আবৃত করে দিতে হবে। আর তুমি নিশ্চয় পারবে।’

‘শুধু ঐভাবে পূরণ করে দেবো তো? তার বেশি কিছু নয়?’

‘কিন্তু মনে রেখো, সমালোচকদের নিকৃষ্ট জীব মনে করাতে হবে। জানো কি আমাদের জগতের নিকৃষ্টতম জীবের গায়ের গন্ধ কেমন?

‘জানি না, আমাকে বলতেও হবে না। আর, আমাকে তুমি মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে পার।’

‘মডেল-মডেল,’ খিটখিটেভাবে আজাজেল্‌ বলল (ঐ ভঙ্গী সে কোথায় শিখেছে জানি না), ‘তুমি কি জানো, সর্বাপেক্ষা জটিল এমন কী আদিমতম মৌলিক হচ্ছে মনুষ্য মস্তিষ্ক?’

‘বেশ’ আমি বলি, ‘তোমাকে মস্তিষ্ক নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। এল্ডারবেরী এক সরল সাদাসিধা মেয়ে আর যা মনে হয়, মূর্তিটির মস্তিষ্কের গভীরতা নিয়ে তার চিন্তা নেই, আমি মনে করি।’

তোমাকে আমায় মূর্তিটি দেখাতে হবে, তারপর আমাকে বিষয়টি বিবেচনা করতে দাও।’

‘তাই-ই হবে। কিন্তু মনে রেখো, এমন ব্যবস্থা কর, যেন আমরা দেখতে পাই, মূর্তিটি ক্রমশ প্রাণ পাচ্ছে আর নিশ্চয় করে সে যেন ভীষণভাবে এল্ডারবেরীর প্রেমে পড়ে যায়।’

‘প্রেম ভীষণ সহজ, শুধু হর্মোনের কারসাজি।’

পরের দিন, আবার আমি এল্ডারবেরীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আদায় করলাম, মূর্তিটি পুনরায় পরিদর্শন করতে। আজাজেল্‌ শার্টের পকেট থেকে উঁকি মারছিল আর অস্পষ্ট চড়া সুরে চিচি করছিল। ভাগ্যবশত এল্ডারবেরীর দৃষ্টি শুধু মূর্তিতেই নিবদ্ধ আর যদি বিশটা সমান মাপের জিনও তার সামনে উপস্থিত হত, তাও হয়তো সে লক্ষ্য করত না।

‘বেশ, তাহলে?’ পরে আমি আজাজেল্‌কে বলেছিলাম।

‘আমি চেষ্টা করবো, করবো’ সে বলল, ‘আমি তোমার মতন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে মূর্তিটিকে ভরিয়ে দেব। তোমাদের জঘন্য নিকৃষ্ট প্রজাতির মধ্যে তুমি একজন স্বাভাবিক প্রতিনিধি বলেই বিশ্বাস করি।

‘স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচুদরের,’ আমি উগ্রভাবে বলি, ‘আমি একজন বিশিষ্ট নমুনা’

‘খুব ভাল, তাহলে। মেয়েটি তার মূর্তিকে নরমগরম স্পন্দিত শরীরে পাবে। ওকে আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তার আগে হবে না।’

পরদিন এল্ডারবেরীকে ফোন করলাম। ‘এল্ডারবেরী, আমার সোনা, আমি অ্যাফ্রোডাইটের সঙ্গে কথা বলেছি।

‘আপনার কি মনে হয়, সত্যিই তার অস্তিত্ব রয়েছে?’

‘তাহলে বলতে হয় সোনা, তোমার আদর্শ পুরুষ কাল দুপুরে আমাদের চোখের সামনে উদয় হবে।’

‘ওঃ হো’ সে অস্পষ্টভাবে বলল, ‘আমাকে প্রতারণা করছেন না তো, আঙ্কেল?‘

‘আমি কখনো প্রতারণা করি না,’ আমি বলি ‘আর কখনো করি না।’ কিন্তু স্বীকার করছি কিছুটা দুর্বল অসহায় লাগছিল নিজেকে’ কারণ আমি তো আজাজেলের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছিলাম। কিন্তু তাহলেও সে তো কখনো ব্যর্থ হয় না।

দুপুর বেলা আমরা দুজনেই আবার চোরাকুঠুরিতে গেলাম। মূর্তিটির দিকে তাকালাম। পাথরের দৃষ্টিতে শূন্যে চেয়ে আছে।

এল্ডারবেরীকে বললাম, ‘তোমার ঘড়ি ঠিক সময় দিচ্ছে তো সোনা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার ঘড়ি মেলানো আছে, ঠিক এক মিনিট বাকি।’

‘পরিবর্তনটা এক মিনিট, দু মিনিট দেরী হয়ে যেতে পারে অবশ্যই। একদম ঠিকঠাক বলা একটু শক্ত।

‘নিশ্চয়ই, দেবী ঠিক সময়েই নির্দেশ করবেন,’ এল্ডারবেরী বলল, নয়তো দেরি হওয়ার মধ্যে আর কী ভাল রইল?’

একেই বলে সত্য বিশ্বাস আর এল্ডারবেরী ঠিকই বলেছিল, ঠিক দুপুরে মূর্তির মধ্যে কম্পন শুরু হল। মৃত শ্বেতপাথর থেকে তার রং বদলে ধীরে ধীরে উষ্ণ মাংসল গোলাপী হয়ে উঠল। ধীর গতিতে কাঠামো সম্পূর্ণ হল। বাহুদ্বয় পাশে ঝুলে এল, চোখে এল নীল উজ্জ্বল দ্যুতি। মাথার চুলের রঙ ঘন হয়ে হাল্কা ধূসর আর দেহের অন্যান্য নির্দিষ্ট জায়গাতেও কেশোদ্গাম হয়ে গেল। তার মাথা নিচু হল, সে এল্ডারবেরীর দিকে তাকাল। এল্ডারবেরীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস তখন পাগলের প্রায়, যেন ঝড়ের বেগে উঠছে নামছে।

ধীরে ধীরে ক্যাচরক্যাচর শব্দ করে, বেদী থেকে নেমে সে এল্ডারবেরীর দিকে হেঁটে এল, দুই বাহু প্রসারিত।

‘তুমি এল্ডারবেরী, আমি হ্যাঙ্ক,’ সে বলল।

‘ওঃ, হ্যাঙ্ক’ বলেই এল্ডারবেরী তার বাহুর ঘেরে গলে গেল।

দীর্ঘক্ষণব্যাপী তারা জমা বরফের মতন চালিঙ্গনাবদ্ধ রইল আর এল্ডারবেরীর কাঁধের ওপর দিয়ে আমাকে দেখতে পেল।

পরমানন্দে এল্ডারবেরীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আমাকে বলল, ‘হ্যাঙ্ক আর আমি কয়েকদিন এই বাড়িতে মধুচন্দ্রিমা কাটাবো, আর আঙ্কেল জর্জ, আপনার সঙ্গে পরে দেখা হবে।’

নিজের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করতে লাগল এল্ডারবেরী, যেন ডলার গুনছে।

তাতে আমার চোখও মহানন্দে জ্বলে উঠল। আমি পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে চলে এলাম। সত্যি কথা বলতে কি একজন সম্পূর্ণ পোশাকপরিহিতা রমণী, এক নগ্ন যুবা পুরুষকে উষ্ণভাবে আলিঙ্গন করছে, আমার কাছে বড়ই বেমানান ঠেকছিল। তবে আমি নিশ্চিত, আমার বেরিয়ে আসার পরপরই এল্ডারবেরী নিশ্চয়ই বিষয়টিকে মানানসই করে তুলেছিল।

আমি এল্ডারবেরীর ফোনের জন্য দশদিন অপেক্ষা করলাম, কিন্তু সে ফোন করল না। আমি একেবারেই আশ্চর্য হইনি, কারণ কল্পনা করে নিয়েছিলাম, সে বিশেষ ব্যস্ত রয়েছে।

আরো দশদিন পর মনে হল, এবার নিশ্চয় তার স্বস্তি ফেলার সময় হয়েছে। আর আমি আরো ভাবতে শুরু করলাম, যেহেতু এল্ডারবেরীর ভাব-উচ্ছ্বাস আমার আর আজাজেলের চেষ্টায় পূর্ণ হয়েছে, সেটা ভালই। কিন্তু আমার ভাব উচ্ছাসও পূর্ণ হওয়া উচিত।

আমি এল্ডারবেরীর বাসায় গেলাম, যেখানে সুখী জোড়াকে দেখে এসেছিলাম। পৌঁছে ঘণ্টা বাজালাম। বেশ কিছুক্ষণ সাড়া নেই, আর আমার সামনে তখন একজোড়া তরুণ তরুণীর ভাবাবেগের আনন্দে মৃত্যুবরণের ছবি ভাসছিল। দরজা খোলার শব্দ।

এল্ডারবেরী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, যদি তার রুষ্ট মুখকে স্বাভাবিক বলা যায়।

সে বলল, ‘ওঃ, আপনি!’

‘হ্যাঁ, আমি কেন!’ আমি বলি, ‘আমার ভয় হচ্ছিল, তুমি বুঝি হানিমুন চালিয়ে যেতে ও বাড়িয়ে নিতে, শহরের বাইরে গিয়েছ।’ আমি বলিনি, তারা আমৃত্যু হানিমুন চালিয়ে যেত। সেটা বলা কূটনীতিবিরোধী।

সে বলল, ‘আপনি কি চান?’

সম্বোধন একেবারেই বন্ধুসুলভ ছিল না। বুঝলাম তার কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করি, সে তা চায় না। কিন্তু দশ দিন পরে সামান্য ছেদ পড়াটা তো পৃথিবীর অন্ত নয়।

আমি বলি, ‘দশ লক্ষ ডলারের একটা সামান্য ব্যাপার ছিল সোনা।’

আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

শীতল অবজ্ঞায় সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যা পাবেন, তা হলো কাঁচকলা, বন্ধু।’

আমি জানি না কাঁচকলার দাম কত। তবে তক্ষুনি ধরে ফেললাম, তা দশ লক্ষ ডলারের চেয়ে অনেক কম। হতবুদ্ধি আমি যারপরনাই আহত হয়ে বললাম,

‘কেন? হল কী?’

‘কী হল? সে বলল, ‘কী হল?’ বলছি আপনাকে গলদ কোথায়। যখন আমি বলেছিলাম, আমার নরম হ্যাঙ্ক চাই। তার মানে সব সময়ে সব প্রত্যঙ্গই স্থায়ী ভাবে নরম নয়।

তার বলিষ্ঠ ভাস্করের হাত দিয়ে আমাকে দরজার বাইরে ঠেলে দিয়ে ধমাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলাম।

সে আবার দরজা খুলল, ‘আর যদি কখনো এদিকে আসেন, হ্যাঙ্ক আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে। অন্য দিকে সে ষাঁড়ের মতন বলবান।’

অতএব আমি চলে এলাম। আমি কী করতে পারতাম? আর, তুমি আমার শৈল্পিক প্রচেষ্টার সমালোচনার জন্য এমনটি পছন্দ করবে? আমার কাছে আর তোমার সামান্য অনুযোগ নিয়ে এসো না।’

.

জর্জ গল্প শেষ করে মাথা নাড়ল, আর তাকে এত হতাশ দেখাল যে, আমি বিচলিত হলাম।

‘জর্জ’ আমি জানি, তুমি আজাজেকেই দোষ দেবে, কিন্তু এটা তো ছোট্ট জিনটার অপরাধ নয়। তুমি ‘নরম’ ব্যাপারটার ওপর জোর দিয়েছিলে। সক্রোধে জর্জ বলল, ‘এল্ডারবেরীও দিয়েছিল।

‘হ্যাঁ।’

কিন্তু তুমি আজাজেকে বলেছিলে, মূর্তিটিকে তোমার মডেলে মানুষ পরিণত করতে আর তাতে নিশ্চয়ই তোমার অক্ষমতাও-’

জর্জ আমাকে থামতে ইঙ্গিত করে হাত উঠিয়ে আমার দিকে তাকাল।

‘এটাই’ সে বলল, ‘অর্থক্ষতির চেয়েও আমাকে বেশি করে বিঁধছে।’

আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, প্রকৃত তথ্য ছাড়াও আমি কয়েক বছর ছাড়িয়ে গিয়েছি আমার মৌলিক – ‘

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জর্জ আমি ক্ষমা চাইছি। এখন আমি বিশ্বাস করি, তোমার কাছে

আমার দশ ডলার ঋণ রয়েছে।

বেশ, দশ ডলার তো দশ ডলারই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। জর্জ নোটটা নিয়ে হাসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *