সংহারক সারমেয়

সংহারক সারমেয়

উদয়গড় থানার ওসি বিজয় চৌধুরির সামনে ধুতি-পাঞ্জাবি আর গরম জহরকোট পরা একজন নিতান্ত নিরীহ দর্শন মাঝবয়সি ভদ্রলোক বসেছিলেন। অত্যন্ত সন্ত্রস্তভাবে ভদ্রলোকটি তাঁর বক্তব্য বলতে শুরু করলেন, ‘আমার নাম অরিন্দম ঘোষাল, এই কাছেই বৃন্দাবন গোস্বামী লেনের বাইশ নম্বর বাড়িতে থাকি। আমি আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’

বিজয় চৌধুরি একটা মস্ত বড়ো হাই তুলে বললেন, ‘কীসের অনুরোধ?’

‘ইয়ে মানে, ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তাই কীভাবে বলব, বুঝতে পারছি না।’

‘খুলে বলুন, তাহলেই হবে।’ বলে বিজয় চৌধুরি কানে একটা পেনসিল ঢুকিয়ে সেটা ঘোরাতে শুরু করলেন।

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ, তাই বলছি। মানে, আমার অনুরোধটা ওই কুকুরটা সংক্রান্ত আর কী।’

বিজয় চৌধুরি এবার সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘কুকুরটা? কোন কুকুরটা?’

‘ওই তো যেটাকে বাংলা পত্রিকা ”সংহারক সারমেয়” নাম দিয়েছে।’

পেনসিলটা খটাস করে টেবিলের ওপর ফেলে বিজয় চৌধুরি বললেন, ‘বলেন কী? ওটাকে আপনি দেখেছেন নাকি? কোথায় দেখেছেন? কবে?’

মাথা নেড়ে অরিন্দম বললেন, ‘না না, আমি ওটাকে কোনোদিন দেখিনি। তবে ওই কুকুরটাকে নিয়েই আমার একটা অনুরোধ আছে। আর তা হল, তার পরের শিকারকে আপনারা বাঁচান।’

‘তার পরের শিকার কে তা আপনি জানেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি হলেন নিউ ট্যাংরাবাজার রোডের পূর্বাচল অ্যাপার্টমেন্টসের সতেরো নম্বর ফ্ল্যাটের শ্রী কমলেশ্বর নন্দী।’

‘এঁকে আপনি চিনলেন কী করে?’

‘আমি এঁকে চিনি না।’

‘অ!’ বলে বিজয় চৌধুরি আবার পেনসিলটা তুলে নিলেন। বললেন, ‘আপনি কুকুরটাকে কোনোদিন দেখেননি, কমলেশ্বর নন্দীকে চেনেন না, অথচ কুকুরটা এবার ওই ভদ্রলোকটিকেই মারবে, সেটা আপনি জানেন। কী করে জানলেন?’

‘দেখুন, সেটা আমি বলতে পারব না। কারণ, বললে আপনি হাসবেন, আমার কথায় গুরুত্ব দেবেন না। তবে যে-ভাবেই হোক, আমি জানতে পেরেছি। এর আগে কুকুরটা যে তিনজনকে মারে, তাদের খবরও আমি পেয়েছিলুম। প্রথমটা পাত্তা দিইনি। দ্বিতীয়টা ভেবেছিলুম কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু তৃতীয়টা যখন মিলে গেল, তখন আর ব্যাপারটা হালকাভাবে নেওয়া গেল না। তাই বিবেকের তাড়নায় আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’

বিজয় চৌধুরির পেনিসিল ইতিমধ্যে আবার তাঁর কানে ঢুকে গেছে। সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘তা বেশ করেছেন, অরিন্দমবাবু। আপনি বাড়ি যান। আমরা যা করবার, ঠিক করব।’ বলে আবার প্রকাণ্ড একটা হাই তুললেন।

অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অসিতবরণ আইচের ঘরে কথা হচ্ছিল। বিজয় চৌধুরি বলছিলেন, ‘আমি তো স্যার লোকটাকে পাত্তাই দিইনি। ভেবেছিলুম আর একটা পাগল। আর না-ভেবেই বা কী করব স্যার? প্রত্যেকদিনই তো সমস্ত থানায় তিন-চারজন করে এই ‘সংহারক সারমেয়’ আর তার মালিকদের খোঁজ নিয়ে আসছে। সব ক-টা উন্মাদ। তবে, আমার কপাল ভালো যে আমার থানায় এরকম যারা আসে তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা আর বক্তব্য আমার ডায়েরিতে লিখে রাখি। নইলে স্যার, হয়তো এই অরিন্দম ঘোষালকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।’

অসিতবরণ বললেন, ‘এই অরিন্দম ঘোষাল সম্পর্কে কী খোঁজখবর পেলে?’

বাইশ নম্বর বৃন্দাবন গোস্বামী লেনে থাকেন। স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে সংসার। জন্মেছেন ঢাকায়, সেখানেই বড়ো হয়েছেন। বাইশ বছর বয়সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাশ করে আটাত্তর সালে কলকাতায় চলে আসেন। এখন ব্যাঙ্ক অব কেরালায় চাকরি করেন। বয়েস চুয়াল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ। ভদ্রলোক কুকুর পোষেন না। ওঁর স্ত্রী কোনোরকম জীবজন্তুই পছন্দ করেন না। পাড়ার লোক সকলেই একবাক্যে বলেছে ভদ্রলোক অত্যন্ত ভালোমানুষ। কারুর সাতে-পাঁচে নেই। পলিটিকসে নেই। তাঁর কোনো শত্রু আছে সেরকম কোনো সম্ভাবনার কথাই কেউ ভাবতে পারে না। তবে ওঁর স্ত্রী কিন্তু একেবারে অন্যরকম। তিনি প্রচণ্ড ঝগড়াটে, অভব্য এবং রেগে গেলে মাথার ঠিক থাকে না। ভদ্রলোক নাকি প্রায় রোজই তাঁর স্ত্রী হাতে বেধড়ক মার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকেন। শুধু উনিই নন, পাড়ার আরও কয়েক জন ভদ্রলোক তাঁর হাতে মার খেয়েছেন। দু-জন মস্তানও বাদ যায়নি। এর ফলে ওঁদের ছেলেটি কেমনধারা হয়ে গিয়েছে। সে শুনলুম কারুর সঙ্গে কথা বলে না, হাসে না, প্রশ্ন করলে হাঁ-হাঁ করে গলার মধ্যে একটা শব্দ করে। যার মা-র অমন ভয়ংকর স্বভাব, সে এমন হবে না-তো কী হবে?’

‘তোমরা যে ইনভেস্টিগেশনে গিয়েছিলে, কীরকম সংবর্ধনা পেলে?’

‘আমরা স্যার, ওই বাড়িতে আর ঢুকিনি। লোকাল কমিটির চেয়ারম্যান শিবদাস দে আর ও-পাড়ার ক্লাব কল্যাণ সংঘের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে এইসব খবর পেয়েছি। আপাতত আর তো জানবার কিছু নেই। যদি ও-বাড়িতে ঢুকতে বলেন, তাহলে কিন্তু স্যার, সার্চ-ওয়ারেন্ট নিয়ে পুরো ফোর্স নিয়ে যেতে হবে।’

ফিক করে হেসে অসিতবরণ বললেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’ তারপর ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সিদ্ধার্থ বাগচির দিকে ফিরে বললেন, ‘দ্যাখো সিদ্ধার্থ, আমরা যে ভাবছিলুম— যে ব্যাপারটা একটা পাগলা কুকুরের কাজ, মনে হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। এই অরিন্দম ঘোষালের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র আছে। সেটা বের করতে পারলে হয়তো রহস্যটা পরিষ্কার হবে।’

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘যোগসূত্রের যে খোঁজ করিনি, তা নয় স্যার। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। দুটো জায়গায় মিল আছে। প্রথমত, এঁরা প্রত্যেকেই রট ওয়াইলার জাতীয় কোনো কুকুরের আক্রমণে মারা গেছেন নির্জন জায়গায় মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়ে। আর দ্বিতীয়ত, এঁরা প্রত্যেকেই অর্থশালী প্রৌঢ়-ভদ্রলোক। ডাক্তার হরিমোহন কুণ্ডু নামজাদা হোমিয়োপ্যাথ, চেম্বার ঢাকুরিয়ায়। বিবেক বিশ্বাস কাগজের ব্যাবসা করতেন, থাকতেন এলগিন রোডে। শান্তিময় ঘোষ কনট্রাক্টর, থাকতেন বাগবাজারে। আর এই কমলেশ্বর নন্দী একটা ফ্যাব্রিকেশন শপের মালিক ছিলেন। আমরা এঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, তাতে মনে হয় এঁরা পরস্পরকে চিনতেনই না। মিল অবশ্য আরও একটা অছে। এঁরা প্রত্যেকেই আশির দশকের গোড়ায় সপরিবারে বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে আসেন। ওখানেও ওঁরা যা করতেন, এখানে এসে সেই ব্যাবসাই শুরু করেন। প্রথমদিকে কষ্ট হয়তো হয়েছিল, পরে সকলেই দাঁড়িয়ে যান। এখন স্যার, এই মিলগুলো যে কিছু প্রমাণ তা আমার মনে হয় না।’

‘বাংলাদেশে এরা কি একই জায়গায় থাকতেন?’

‘না, স্যার। ডা. কুণ্ডু থাকতেন ঢাকায়, বিবেক বিশ্বাস যশোরে, শান্তিময় কুষ্ঠিয়ায় আর কমলেশ্বর চট্টগ্রামে।’

‘চমৎকার! বিজয়, তুমি একটা কাজ করো। ওই অরিন্দম ঘোষালকে আবার ভালো করে জেরা করো। দ্যাখো, কিছু বের করতে পারো কিনা। আর সে কীভাবে খবরটা পায়, সেটা বের করবার চেষ্টা করো। ভয়-টয় দেখাও, কাকুতি-মিনতি করো। যাহোক, কিছু একটা করো। আজকের কাগজগুলো আমাদের যা গালাগাল করছে, তা আর সহ্য হচ্ছে না।’

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘একটা কাজ করলে হয় না স্যার? কলকাতায় যাদের রট ওয়াইলার বা ওই জাতীয় কুকুর আছে, তাদের থানায় ডেকে এনে জেরা করলে হয় না? হয়তো কিছু সূত্র বেরিয়ে পড়তে পারে।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? রট ওয়াইলার তুমি চেনো? আমি তো চিনি না। ওই কর্ম করতে গেলে তোমার লোকেরা কলকাতা সুদ্ধু নেড়ী থেকে গ্রেট ডেন সবার মালিকদের থানায় টেনে আনবে আর আবার একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। তা ছাড়া, কুকুরটা যে রট ওয়াইলার সেটা তো কাউকে জানানো হয়নি। সে-কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে তার মালিকটি সাবধান হয়ে যাবে না? ওভাবে হবে না।’

‘তাহলে কীভাবে এগোব স্যার? আর কিছুদিনের মধ্যেই কিন্তু কলকাতা সুদ্ধু লোক খেপে যাবে। কেউ বেলা আটটার আগে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে না। কাগজ আসছে দশটায়, দুধ আসছে তারও পরে। মর্নিংওয়াকাররা নুনওয়াকার হয়ে রোদে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এমনভাবে আর বেশিদিন চলবে না স্যার। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।’

‘এক কাজ করো। তুমি যে চারজন মারা গেছেন তাঁদের বাড়িতে যাও, তাঁদের যাবতীয় কাগজপত্র ভালো করে ঘেঁটে দ্যাখো, এঁদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল কি না। তবে কাজটা সাবধানে কোরো, তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের মনে যেন কোনোরকম আঘাত না-লাগে। আর বিজয়, তোমাকে যেরকম বললুম, সেইরকম করো। ওই অরিন্দম ঘোষালকে বাজিয়ে দ্যাখো।’

বিজয় চৌধুরি বললেন, ‘আপনাকে এত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে কেন অরিন্দমবাবু? আপনি কি ভাবছেন যে আমি আপনাকে হাজতে ঢোকাব বলে ডেকে পাঠিয়েছি? একেবারেই তা নয়। আমি শুধু একটা অনুরোধ করব আপনাকে। ওই রহস্যময় খুনে কুকুরটার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র সূত্র আপনি। কাজেই, জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা ভেবে, আপনাকে অনুরোধ করছি যে অসম্ভব না-হলে প্রত্যেকদিন একবার করে এসে যদি আমার সঙ্গে দেখা করে যান তো বড়ো ভালো হয়। সকাল, বিকেল বা দুপুর— যখন আপনার সুবিধে।’

অরিন্দম বিমর্ষ মুখে বললেন, ‘রোজ হাজিরা দিতে হবে?’

‘আহা-হা, হাজিরা কেন বলছেন? সে তো দেবে ক্রিমিন্যালরা। আপনি তো তা নন। আপনি তো আমাদের সাহায্যই করতে চান, তাই না? আচ্ছা, অরিন্দমবাবু, আপনি তো এই হত্যাকাণ্ডগুলোর খবর কী করে পান সেটা বলবেন না। বেশ, না-ই বললেন। কিন্তু এই খুনে কুকুরটা কী জাতীয় কুকুর তা কি আপনার জানা আছে?’

‘আছে। রট ওয়াইলার।’

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হয়ে বসলেন বিজয়। বললেন, ‘কী করে জানলেন? রট ওয়াইলার আপনি চেনেন?’

‘চিনি। আমার ছোটোমামার একটা ওই কুকুর ছিল। তার ভয়ে আমাদের তাঁর বাড়িতে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’

‘কোথায় থাকেন আপনার ছোটোমামা? কী করেন?’ উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন করলেন বিজয়।

‘ঢাকার কাছে টঙ্গি বলে একটা শহর আছে। সেখানে থাকতেন। কলেজে পড়াতেন। সাতাত্তর সালে মারা যান।’

‘মারা গেছেন?’ বিজয়ের গলাটা একটু হতাশই শোনাল। ‘তাঁর কুকুরটা কোথায়?’

‘জানি না। শুনেছি, ছোটোমামা মারা যাওয়ার পর তার আর হদিশ পাওয়া যায়নি।’

‘আপনার মামাবাড়ির অন্যান্য আত্মীয়রা কোথায় থাকেন? মানে কলকাতার কাছে-পিঠে কেউ থাকেন কি?’

‘অনেকেই থাকেন। বড়োমামা থাকেন গড়িয়ায়, মেজোমামা ভবানীপুরে। আমার দিদিমা মেজোমামার সঙ্গে থাকেন।’

‘আপনার ছোটোমামা তাহলে বেশ অল্প বয়সেই মারা যান, তাই না? কী হয়েছিল?’

ভাবলেশহীন গলায় অরিন্দম বললেন, ‘খুন হয়েছিলেন। ওঁর বাড়ির সামনে ওঁকে গুলি করে মেরেছিল কেউ। ঢাকা পুলিশ তদন্ত বেশি করেনি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ব্যাপার বলে ফাইল ক্লোজ করে দিয়েছিল।’

‘বলেন কী? আপনার মামাদের ঠিকানাগুলো আমাকে দিতে পারেন?’

‘হ্যাঁ, পারি।’ বলে অরিন্দম একটা কাগজ টেনে নিলেন।

অসিতবরণ বললেন, ‘বিজয়ের রিপোর্টটা পড়েছ সিদ্ধার্থ? কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, তাই না?’

সিদ্ধার্থ ব্যাজার মুখে বললেন, ‘কী জানি স্যার। আমি তো কোনো আলোই দেখতে পাচ্ছি না। আজ থেকে তেইশ বছর আগে টঙ্গিতে প্রফেসর কৃষ্ণদেব চক্রবর্তীর একটা রট ওয়াইলার কুকুর ছিল, আর তার তেইশ বছর বাদে কলকাতায় চারজন লোক ওই জাতীয় কুকুরের আক্রমণে বীভৎসভাবে মারা গেছেন। টঙ্গির কুকুরটা নিরুদ্দেশই হোক আর যাই হোক, এত বছর বাদে কলকাতায় এসে এই খুন-খারাপি শুরু করবে, এ কখনোই হতে পারে না। একটা রট ওয়াইলার বারো বছরের বেশি বাঁচতেই পারে না।’

‘এমন তো হতে পারে যে, কৃষ্ণদেব দাঙ্গায় মারা যাননি। এই চারজনে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে মেরেছিল। এখন কেউ তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। রট ওয়াইলার দিয়ে খুন করিয়ে ব্যাপারটা বেশ নাটকীয় করা হচ্ছে।’

‘এটাও স্যার, খুব জোরালো অনুমান হচ্ছে না। প্রথমত, এত বছর বাদে কেন? দ্বিতীয়ত, এই চারজনের মধ্যে কিন্তু কোনোরকম যোগাযোগের খবর আমরা পাইনি। আর স্যার, নাটকীয়তার একটা সীমা আছে। রট ওয়াইলার ভয়ংকর খুনে কুকুর তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে নাটকীয়তার জন্য শিখিয়ে পড়িয়ে কেউ চার-চারটে লোককে মারবে— এটা যেন কেমন ঠিক হচ্ছে না বলে মনে হয়।’

অসিতবরণ চিন্তিতভাবে কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ভয়ানক উত্তেজিত বিজয় চৌধুরি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘কুকুরটার পরের শিকারের নাম জেনেছি স্যার। আজ সকালে অরিন্দম ঘোষাল এসেছিলেন। বললেন, সংহারক সারমেয় এবার যাকে মারবে তিনি শোভারাম মল্লিক লেনের সনাতন হালদার।’

অসিতবরণ বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘বলো কী? সনাতন হালদার মানে আমাদের হায়না হালদার? শোভারাম মল্লিক লেন যখন তখন হায়নাই বটে। ইস! ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের কী-জ্বালান জ্বালিয়েছে! আগে যখন স্মাগলিং আর জাল নোটের ব্যাবসা করত তখন ছিল একরকম। ইদানীং পলিটিশিয়ান হয়ে একেবারে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।’

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘যা বলেছেন স্যার! ওই হায়না হালদার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা সকলেই একেবারে নরকের জীব। সংহারক সারমেয় যদি হায়নাকে মারে তাহলে অন্তত আমার মনে কোনো দুঃখ থাকবে না।’

‘অত রেগে যেও না সিদ্ধার্থ। হায়নাকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। সেটা অন্য কারুর ওপর ছেড়ে দিলে তো চলবে না। তুমি আজ থেকেই চারজন দায়িত্বশীল অফিসারকে হায়নার ওপরে সর্বত্র আর সর্বক্ষণ নজর রাখার কাজে লাগিয়ে দাও। তবে, হায়না যেন কিছু জানতে না-পারে। যে বা যা-কিছু হায়নাকে আক্রমণ করবে, তাকে যেন যেন-তেন-প্রকারেণ আটকে ফেলা হয়।’

‘ঠিক আছে স্যার। তা আপনি যখন বলছেন তখন লোক লাগিয়ে দিচ্ছি। তবে, এর কিন্তু কোনো দরকার ছিল না স্যার।’

‘কেন? দরকার নেই কেন?’

‘আগে তো হায়না দু-জন বডিগার্ড নিয়ে ঘুরত, ইদানীং ঘুরছে ছ-জনকে নিয়ে। সে যেখানেই যায়, তার গাড়ির পেছনে একটা সুমো যায়। এই বডিগার্ডরা তাকে সবসময় ঘিরে থাকে, এমনকী সে যখন কোনো জনসভায় বক্তৃতা দেয় তখনও। সেদিন টিভি-তেও তাই দেখাল। আমরা নিজেদের মধ্যে এ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনাও করেছি।’

‘তার মানে, সে তার বিপদটা আঁচ করেছে। কী করে করল? তবে কি এই অরিন্দম ঘোষাল তাকে জানিয়েছে? নাঃ, এই ঘোষাল লোকটাকে আমার সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না, বিজয়। যতই শান্তশিষ্ট দেখাক, লোকটা কিন্তু ঘোড়েল আছে। সে সবকথা আমাদের বলছে না। কিছু চেপে যাচ্ছে। এবার তুমি ওকে থানায় এনে একটু কড়কাও তো।’

বিজয় বললেন, ‘একটা কথা বলব স্যার? আমি বরং এখুনি গিয়ে অরিন্দমের ছেলেটাকে ধরে লক-আপে ঢুকিয়ে দি। সে উদয়গড় কলেজে পড়ে, ফার্স্ট ইয়ারে। সে যখন কলেজ থেকে ফিরবে তখন রাস্তা থেকে তাকে তুলে নেব।’

‘অরিন্দমের ছেলেটাকে লক-আপে ঢোকাবে কেন? সে আবার কী করল?’

‘আমার ধারণা যে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় স্যার। আপনি তো অক্ষয়, মানে এই ছেলেটিকে দেখেননি, আমি দেখেছি। আপনি দেখলেই বুঝতে পারতেন যে তার মধ্যে একটা জটিল গণ্ডোগোল আছে। কেমন যেন ভূতুড়ে ছেলেটা। গায়ের রং ঘোর কালো, মুখে অবিন্যস্ত দাড়িগোঁফ, দাঁতগুলো বড়ো বড়ো আর ছুঁচোলো, চোখ দুটো লাল। কোনো কথাই প্রায় বলে না ছেলেটা।’

‘গায়ের রং আর দাড়ি গোঁফের জন্য তুমি অক্ষয়কে লক-আপে ঢোকাতে চাও? কী ভাবছ বলো তো তুমি? এই অক্ষয় ছেলেটি চারজনকে কামড়ে খুন করেছে আর আমাদের ফরেন্সিক এক্সপার্টরা সেটা রট ওয়াইলারের কাণ্ড বলে সনাক্ত করেছেন?’

‘সেটাও হতে পারে স্যার। তবে আমার ধারণা ঘটনাটা অলৌকিক। আমার বিশ্বাস অক্ষয় কুকুরে রূপান্তরিত হয়, অনেকটা ওয়্যারউল্ফের মতো।’

‘অলৌকিক! তুমি না পুলিশ? তুমি এসবে বিশ্বাস করো? আরে, অলৌকিক উপায়ে যদি খুনখারাপি করা যেত তাহলে লোকে পুলিশ না-ডেকে ওঝা ডাকত, বুঝেছ? এইরকম গেঁয়ো কুসংস্কার মন থেকে বের করে দাও তো।’

পরদিন সকাল থেকে কলকাতায় হুলুস্থুল পড়ে গেল। দলেদলে সাংবাদিক, ফোটোগ্রাফার আর টিভি ক্যামেরাম্যান অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড চেঁচামেচি জুড়ে দিল। সবাই একসঙ্গে কথা বলছে। কে কার কথা শোনে তার ঠিক নেই।

অসিতবরণ কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে রইলেন। ধৈর্য ধরে সবার কথা শুনে, উত্তর দিতে শুরু করলেন। গত কাল সন্ধ্যায় জননেতা সনাতন হালদার ফকিরহাটে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কলকাতা ফিরতে ওঁর রাত এগারোটা হয়ে যায়। ওঁর সঙ্গে ছ-জন বডিগার্ড ছিল। শোভারাম মল্লিক লেনে ওঁরা যখন পৌঁছল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। তখন লোডশেডিং চলছিল আর এই জানুয়ারি মাসে যেরকম কুয়াশা হয় সেইরকমই ছিল। সনাতনবাবু গলির মুখে গাড়ি থেকে নামামাত্র কুয়াশার ভেতর থেকে কালো র‌্যাপার মুড়ি দেওয়া কিছু একটা বেরিয়ে এসে ওঁকে আক্রমণ করে। ব্যাপারটা এতই অতর্কিতে ঘটে যায় যে ওই বডিগার্ডরা বাধা দেওয়ারও সময় পায়নি। প্রথমদিকে তারা গুলিও চালাতে পারেনি পাছে সেই গুলি সনাতনবাবুর গায়ে লাগে এই ভয়ে। পরে কোনোরকমে আততায়ীকে ছাড়িয়ে খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়। সেটা পালিয়ে যায়। এই আততায়ী কে বা কী তা নিয়ে বডিগার্ডদের মধ্যে মতভেদ আছে। যারা খুব কাছে ছিল তারা বলছে সেটা নেকড়ে জাতীয় কোনো জানোয়ার আর যারা একটু দূরে ছিল তারা বলছে আক্রমণকারী ছিল মানুষ। আমাদের ধারণা প্রথম মতটিই ঠিক। সনাতনবাবুর গলায় যে দাগ তা কোনো জানোয়ারের দাঁতের বলেই মনে হয়।

যাই হোক আমাদের দু-জন অফিসার হঠাৎই ওখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তাঁরা সনাতনবাবুকে নিয়ে সঙ্গেসঙ্গে হাসপাতালে চলে যান। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। যেতও না, কারণ গলাটা একেবারে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আজ ভোররাতে এই মহান সমাজসেবীর জীবনাবসান ঘটে।

এই ঘটনাগুলো থেকে মাইল দুয়েক দূরে প্রাণকৃষ্ণ সরকার রোডের ওপরে একজন অজ্ঞাত পরিচয় মধ্যবয়স্কা মহিলার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। তাঁকে এখনও কেউ সনাক্ত করেনি। তবে, এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক আছে, তা আমাদের মনে হয় না। যাহোক, আমরা তদন্ত করে দেখছি। তবে একটা ব্যাপার আমরা নিশ্চিত যে এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। কারণ সনাতন হালদারকে যে আক্রমণ করেছিল, সে মানুষই হোক বা জানোয়ারই হোক, আটটা গুলি খেয়ে সে বেঁচে থাকতে পারে না।

অসিতবরণের ঘরে তিনি ছাড়া আর ছিলেন বিজয় চৌধুরি, সিদ্ধার্থ বাগচি আর অরিন্দম ঘোষাল। ঘরের বাইরে লাল আলো জ্বলছিল। অসিতবরণ বলছিলেন, ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখিত অরিন্দমবাবু যে আপনার স্ত্রীর মৃতদেহ বেওয়ারিশ বলে আমাদের দাহ করতে হল। তবে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে এবং ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনো গোলমাল যাতে না-হয়, যার মধ্যে নিরপরাধ হলেও আপনাকে জড়িয়ে পড়তেই হত, আমরা এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। আশা করি, আপনি আমাদের অবস্থাটা বুঝতে পারবেন এবং আমাদের ক্ষমা করবেন। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই…’

অরিন্দম বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনারা যা করেছেন ঠিকই করেছেন। সত্যি এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। আমি সবাইকে বলেছি উনি বদ্রীনাথে ওঁর গুরুর আশ্রমে চলে গিয়েছেন। সম্ভবত সন্ন্যাস নেবেন। তাই শুনে সবাই এতই স্বস্তি পেয়েছেন যে, আর কেউ কোনোরকম প্রশ্নই করেননি।’

‘এইবার ব্যাপারটা আমাদের একটু খুলে বলবেন?’

‘কী আর বলব? অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি তো নিজেই ভালো করে সব ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি। তাহলেও বলছি শুনুন।’ বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরিন্দম শুরু করলেন— ‘প্রথমেই বলি আমার ছোটোমামার কথা। উনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না। তাঁর একটা স্বাভাবিক অপরাধপ্রবণতা ছিল। সেজন্য আমার দাদু তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। আমার মামাবাড়ি ছিল ঢাকায়। ছোটোমামা টঙ্গিতে চলে গেলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। টঙ্গিতে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ছোটোমামা একটা স্মাগলিং-এর চক্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। আজ বুঝতে পারছি যে-পাঁচজন মারা গেছেন, তাঁরাই এই চক্রটা চালাতেন। সারা বাংলাদেশে এদের জাল ছড়ানো ছিল। এঁরাই কোনো কারণে ছোটোমামাকে খুন করেছিল।’

অসিতবরণ বললেন, ‘আপনার অনুমান ঠিক। হায়না তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সেই কথাই বলে গেছে। এদের নিজের নিজের ব্যাবসার আড়ালে এরা এই কাজ চালাত। আপনার ছোটোমামা কৃষ্ণদেব চক্রবর্তী এদের একটা বিরাট অঙ্কের টাকা সরিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। শেষমুহূর্তে ধরা পড়ে যান আর চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে গিয়ে খুন হন। ওরা আপনার ছোটোমামা আর কুকুরটাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর নৃশংসভাবে মেরেছিল।’

‘তাই হবে। তবে ছোটোমামা মারা যাওয়ায় আমার মা খুব ভয় পেয়ে যান আর আমাকে প্রায় ঠেলে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন।

এই ঘটনার প্রায় পঁচিশ বছর বাদে এই কয়েক মাস আগে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। কালীপুজোর তিন-চারদিন আগে রাত তিনটে নাগাদ লোডশেডিং-এ গুমোট সহ্য করতে না-পেরে বাড়ির সামনে রোয়াকে বসে আছি। হঠাৎ দেখি সামনে ছোটোমামা দাঁড়িয়ে আর তাঁর পাশে গলায় চেন-বাঁধা একটা ভয়ংকর দর্শন কালো কুকুর। আমি প্রথমটা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম কারণ দৃশ্যটা যে অনৈসর্গিক তাতে সন্দেহের তো কোনো অবকাশ ছিল না। তার ওপর দেখলুম ছোটোমামা আর তাঁর কাকুরটার চারপাশে একটা অপার্থিব অস্পষ্ট আলোর বলয়। অনেক কষ্টে নিজেকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচালুম।

ছোটোমামা বললেন, ”ভয় পাস না, মৈন্টা।” মৈন্টা বা মন্টু আমার ডাকনাম। তারপর বললেন যে, একটা বিশেষ ব্যাপারে তাঁকে আমার কাছে আসতে হয়েছে। ব্যাপারটা কী? না তিনি শত্রু নিধন করতে চান। সেই কাজের জন্য একজন দেহধারীর দরকার। গত পঁচিশ বছর যাবৎ তিনি একজন উপযুক্ত লোক খুঁজে বেরিয়েছেন, কিন্তু পাননি। এদিকে তাঁর শত্রুদের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে। ষাট-সত্তর পেরিয়ে এমনিতেই মারা যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তাহলে, প্রতিশোধ এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে ফেলতে হয়। সেজন্য, খুব একটা পছন্দ না-হলেও তিনি আমার পরিবারকেই বেছে নিয়েছেন।

ততক্ষণে আমার ভয় কিছুটা কেটেছে। বললুম, ”ওসব প্রতিশোধ-টতিশোধ আমি নিতে পারব না।”

ছোটোমামা বললেন, ”তা আমি জানি। তুমি একটা বিশ্বন্যাকা আর তোমার ছেলেটা একটা আস্ত গবেট। এ-কাজ আমি করাব তোমার পরিবার, মানে তোমার স্ত্রীকে দিয়ে। তুমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। কোনো লাভ হবে না। তোমাকে কথাটা জানালুম এইজন্য যে এখন তোমার বাড়িতে কিছু ঘটনা ঘটবে যা দেখলে তোমার দাঁতকপাটি লাগতে পারে, হার্টফেল হওয়াও অসম্ভব নয়। শত হলেও তুমি আমার ভাগনে, তোমার এই ধরনের কোনোরকম ক্ষতি তো আমি চাই না। শুধু তোমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্যেই আমি এসেছি।”

আমি পরে ভেবে দেখেছি, মালতী মানে আমার স্ত্রীকে এই কাজের জন্য আন্দাজে বা ঝোঁকের মাথায় নির্বাচিত করা হয়নি। মালতীর মধ্যে স্পষ্টতই দুটো আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। একটা ব্যক্তিত্ব ছিল মোটামুটি স্বাভাবিক কিন্তু অন্যটা ছিল ভীতিজনক। রেগে গেলে তার রূপটাই পালটে যেত। তার ভেতর থেকে তখন একটা আদিম জান্তব ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে আসত। তার সেই চেহারা শুধু আমি নয়, আমাদের পাড়ার অনেকেই দেখেছে এবং তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সন্দেহ নেই যে ছোটোমামা তার চরিত্রের এই পাশবিক অংশটিকেই কাজে লাগিয়েছিলেন।

আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন যে, মালতীকে সাইক্যায়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছিল কি না। হয়নি। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রস্তাব তোলবার সাহসই হয়নি আমার। শেষ পর্যন্ত বারাসতে ওদের বাপের বাড়ির গুরুদেব স্বামী সীতানাথানন্দের কাছে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলুম। তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। আমার কেবল ভয় হত যে স্বয়ং গুরুদেবই না কোনোদিন মারধোর বা আচড়-কামড় খেয়ে বসেন।

এরপর সত্যিই আমাদের সংসারে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনি মালতী ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কী বলছে। কান পেতে শুনলুম কোনো এক ঘোষের নাম বলছে বার বার আর সেইসঙ্গে নয়নকৃষ্ণ সাহা লেনের একটা ঠিকানা। আমি পাত্তা না-দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। দু-দিন পরে কাগজে যখন শান্তিময় ঘোষের মৃত্যুসংবাদ পড়লুম তখন তাঁর ঠিকানাটা কেমন চেনা চেনা লাগল। মনের মধ্যে কেমন একটা ধন্দ লেগে গেল। এর কিছুদিন বাদে আবার সেই ব্যাপার, এবার শুনি মালতী কোনো এক হরিমোহন কুণ্ডুর নাম আওড়াচ্ছে আর সেইসঙ্গে শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডের একটা ঠিকানা। আমি নাম-ঠিকানাটা মনে করে রাখলুম। দু-দিন পরে কাগজে সংহারক সারমেয়র ঘটনা পড়ে দেখলুম, তার শিকারের নাম-ঠিকানা আর আমার মনে করে রাখা নাম-ঠিকানা এক। কী করে হল? এটা বুঝলুম যে এর পেছনে ছোটোমামার কারসাজি রয়েছে, কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে কী করে? তৃতীয়বার যখন মালতী কোনো এক বিশ্বাস আর এলগিন রোডের ঠিকানা আওড়াল, আমি তার পরদিন থেকে রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলুম।

এর দু-দিন পরে, মশায়, যা ঘটল তাতে তো সত্যি-সত্যি আমার হার্টফেল হওয়ার অবস্থা! শেষরাত্রে প্রায় তিনটে নাগাদ হঠাৎ মালতী খাটের ওপর উঠে বসল। আমাদের শোওয়ার ঘরটা নিশ্ছিদ্র নয়। রাস্তা থেকে এসে পড়া আলোয় আমি সব দেখতে পাচ্ছিলুম। বললে বিশ্বাস করবেন না, আমার চোখের সামনে মালতীর মুখটা বড়ো বড়ো কালো লোমে ভরে গেল, ওর এমনিতে ছুঁচোলো মুখ আরও ছুঁচোলো হয়ে লম্বা হয়ে গেল, দাঁতগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেল আর তার চোখে সে-এক কী ভয়ংকর জিঘাংসা! সে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা হেঁচড়ে খাট থেকে নেমে কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে দুলতে-দুলতে গিয়ে দরজা খুলে বিদ্যুদ্বেগে বেরিয়ে গেল। আমি অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে খাটের ওপর পড়ে গেলুম। পরদিন সকাল সাতটায় যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি মালতী নির্বিকার মুখে ঘরের কাজকর্ম করছে।’

এইখানে বিজয় চৌধুরি বললেন, ‘আমি তো এইরকমই সন্দেহ করেছিলুম স্যার। আপনি বললেন, গেঁয়ো কুসংস্কার।’

অসিতবরণ চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘চোপ!’ তারপর অরিন্দমকে বললেন, ‘তারপর? বলে যান।’

অরিন্দম মাথা নেড়ে বললেন, ‘আর বলবার কিছু নেই। চতুর্থ ব্যাক্তির নাম শুনেই আমি থানায় চলে যাই। এর পরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন।’

‘হুঁ, তা জানি। আচ্ছা, অরিন্দমবাবু, এ-কথাগুলো আপনি গোড়াতেই পুলিশকে বলেননি কেন?’

‘কী করে বলি? আপনারা কি আমার কথা বিশ্বাস করতেন? উলটে আমাকেই পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিতেন।’

‘তা তো না-ও হতে পারত। অন্তত পুলিশ আপনার বাড়ির চারদিকে পাহারা বসাতে পারত। আপনার বাড়ি থেকে সকলের ঢোকা-বেরুনো মনিটর করতে পারত।’

অরিন্দম চুপ করে রইলেন। অসিতবরণ বলে চললেন, ‘আপনি জানতেন যে আপনি যাদের নাম করেছেন, পুলিশ তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে আর মানুষই হোক বা কুকুরই হোক, যে তাদের আক্রমণ করবে তাকে তারা গুলি করে মারবে। আপনি নিখরচায় বেঁচে যাবেন। আমি এদের সেই কথাই বলেছিলুম যে আপনাকে দেখতে যতটা বোকাসোকা মনে হয়, আপনি মোটেই তা নন। সুযোগের সদব্যবহার করতে আপনি আপনার ছোটোমামার চেয়ে কিছু কম যান না।’

সিদ্ধার্থ বাগচি নীচু গলায় বললেন, ‘নরানাং মাতুলক্রমঃ’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *