নিমন্ত্রণ
শশধরবাবু টি-পটের ঠিক পাশেই পটাশিয়াম সায়ানাইড মেশানো চিনির কৌটোটা যত্ন করে সাজিয়ে রাখলেন। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে তার চেম্বারটা পরীক্ষা করে দেখলেন সব ক-টা গুলি ঠিকমতো আছে কি না। বলা তো যায় না। রাসপুটিন নাকি পটাশিয়াম সায়ানাইড মেশানো একগাদা কেক চেটেপুটে খেয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। তখন, পেছন থেকে গুলি করে তাকে মারতে হয়। বিষটা হয়তো ভেজাল ছিল, কিন্তু শশধরবাবু শুনেছেন যে অনেক লোকের নাকি ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা থাকে বিষ খেয়ে বেবাক হজম করে ফেলার। কাজেই, কোনোরকম ঝুঁকি তো নেওয়া যায় না। শশধরবাবু অত্যন্ত সাবধানী লোক। বিকল্প ব্যবস্থা না-করে তিনি কক্ষনো কোনো কাজ করেন না। তাই পটাশিয়াম সায়ানাইডও রইল, পিস্তলও রইল। তা ছাড়া, সোফার নীচে একটা বড়ো ছোরাও গোঁজা আছে। সেটাও কাজে লাগানো যাবে যদি দরকার পড়ে।
তবে, অতটা দরকার পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, তড়িতের শরীরটা যতই ভীমাকৃতি হোক না-কেন, সে তো রাসপুটিন নয়। রাসপুটিনের কতগুলো অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তড়িৎ নেহাতই রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষ। একটা অপদার্থ, নির্বোধ, কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ। তাকে খুন করতে খুব বেশি ঝামেলা পোয়াতে হবে না। শশধরবাবুর এখন বয়স হয়েছে, তা হলেও এখনও তড়িতের মতো একটা গাড়লকে মারা তাঁর কাছে একটা মশা মারার চেয়েও সহজ ব্যাপার। এই তো, আজ সন্ধে বেলা মাত্র একঘণ্টার মধ্যে পেছনের বাগানে যে একটা পরিষ্কার, সুন্দর কবর খুঁড়ে রেখেছেন, আজকালকার কোনো জোয়ানেরও সাধ্যি আছে অমন চমৎকার কাজ করতে পারে? শশধরবাবুর বয়েস হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই হাড়েই এখন ইচ্ছে করলে তিনি ভেলকি দেখিয়ে দিতে পারেন।
তৃপ্ত মুখে শশধরবাবু সোফায় এসে বসলেন। বাইরে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ জাপানি ঘড়ি টংটং করে সাতটা বাজল। এখন প্রতীক্ষা। তড়িৎ সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আসবে বলেছে। ছোঁড়ার আবার সময় জ্ঞান ভীষণ টনটনে। আটটা বলল তো আটটাই। এমন ছেলে জীবনে কখনো উন্নতি করতে পারে?
বাড়িটা যেন আজকে ভীষণ নির্জন বলে মনে হচ্ছে। অবিশ্যি, জনমনিষ্যি নেই, নির্জন তো হবেই। বাড়ির চাকর, মালি সবাইকে দুপুর বেলা ছুটি দিয়ে দিয়েছেন শশধরবাবু। আহা, বেচারিরা। শশধরবাবু এলে ওরা কী পরিশ্রমই না করে। গত দু-মাস ধরে প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে ওরা শশধরবাবুর সেবা করছে। মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম না-পেলে ওরাই বা কাজকর্ম করে কী করে? তা, সেইজন্যে শশধরবাবু সবাইকে দশটা করে টাকা দিয়ে শ্যাওড়াফুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওরা ওখানে সিনেমা-টিনেমা দেখবে, একটু খাওয়া-দাওয়া করবে, একটু মেয়েছেলে নিয়ে আনন্দফূর্তি করবে। ফিরতে ফিরতে সেই কাল দুপুর। শশধরবাবুর তাতে কোনো কষ্ট নেই, ওদের আনন্দেই ওঁর আনন্দ। নিজের জন্যে দুটো ভাতে ভাত উনি নিজেই ফুটিয়ে নিতে পারবেন। মাছ-মাংস খাওয়া অনেক দিনই ছেড়ে দিয়েছেন, কাজেই অসুবিধে তো কিছু নেই। যবে থেকে শ্রীশ্রীসন্তাপহারী ঈশ্বরানন্দ অবধূতের শ্রীচরণে ঠাঁই মিলেছে, তখন থেকে তো শুধু আনন্দ, পরিপূর্ণ হৃদয়।
তাহলেও বাড়িটা যেন বড়োই নির্জন লাগছে। তার ওপর সন্ধে থেকে কেমন একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠেছে। একতলার বিরাট বিরাট ঘর আর প্যাসেজের মধ্যে সেই হাওয়া পাক খেয়ে খেয়ে একটা অদ্ভুত গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারংবার মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছেন শশধরবাবু। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, হিমানী মরবার আগে ঠিক এমনি করেই গোঁ গোঁ আর্তনাদ করেছিল। অথচ, উনি ঠিকই বুঝতে পারছেন যে, আজ তড়িৎ আসছে বলেই তাঁর হিমানীর কথা মনে পড়ছে। এতে তাঁর বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁর স্নায়ু কোনোদিনই এত দুর্বল নয়। আজ পর্যন্ত কম মেয়েকে তো তিনি গলা টিপে মারেননি। তাদের অনেকেই তো তাঁর পা জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু তিনি কি বিচলিত হয়েছিলেন? মোটেই না। কর্তব্য হল কর্তব্য। কিন্তু, আজ যে হিমানীর কথা মনে পড়ে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠছেন, এতেই তাঁর আশ্চর্য লাগছিল।
আসলে, সব নষ্টের গোড়া হল ওই হারামজাদা তড়িৎ মজুমদার। বিয়ে যেন আর কেউ করে না, আর বউ যেন কারোর হয় না। বউ মরেছে, কোথায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবি, আর-একবার ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াবি— তা নয়, শোকের ঠ্যালায় একেবারে গৃহত্যাগ! আচ্ছা, তা-ও না-হয় বুঝলুম বেদনা-টেদনায় কাতর হয়ে গৃহত্যাগ করেই ফেলেছিস, তাহলে সন্ন্যাস নে, হিমালয়ে গুহায় গিয়ে তপস্যা করে শান্তি খোঁজবার চেষ্টা কর। তা নয়, ছোঁড়া বলে কিনা হত্যাকারীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! কী গোঁয়ার গোবিন্দ ছেলে রে বাবা! হত্যাকারীকে তুই খোঁজার কে রে? পুলিশ রয়েছে কোন কর্মে? তারা যদি খুঁজে না-পায়, মিটে গেল ঝামেলা। শশধরবাবু যদি আগে জানতেন যে তড়িৎ ছোকরা এতদূর গাধা, তাহলে কি আর ওর মুখদর্শন করতেন?
অবিশ্যি, তড়িতের মুখদর্শন তো আর তিনি তড়িতের জন্যে করেননি, করেছিলেন হিমানীর জন্যে। হিমানীর দারিদ্র্যক্লিষ্ট মুকখানি দেখে ওঁর কোমল হৃদয় গলে জল হয়ে গিয়েছিল। ওদের সাহায্য করার জন্যেই না নিজের হাতখানি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওদের দিকে। এরকম অসহায়, দুর্বল লোকেদের সাহায্য করাই তো তাঁর ধর্ম এবং তাঁর ব্যাবসা।
না হলে কী ছিল তড়িৎ? এম এ পাশ করে একটা বাসনের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করছিল। হিমানীকে পুজোয় একটা শাড়িও কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। আর, হিমানী বাচ্চাদের স্কুলে পড়াত আর উদয়াস্ত পরিশ্রম করত। শশধরবাবু যদি এগিয়ে না-আসতেন, ওদের কাকে-চিলে তুলে নিয়ে যেত না? তড়িৎ কি জীবনে কোনোদিন ফিলমস্টার হতে পারত, না হিমানী টালিগঞ্জের বিলাসী ফ্ল্যাটে আয়েশ করে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে দিন কাটাতে পারত? কিন্তু, তার প্রতিদানে শশধরবাবু কী পেলেন? আজকের এই ঝামেলা। এই জন্যেই কখনো পরের উপকার করতে নেই।
অথচ শশধরবাবু কিন্তু ওদের উপকারই করতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে হিমানীর। শশধরবাবুর মায়ের স্মৃতি বিজড়িত নগেন্দ্রবালা শিশুমন্দিরে যখন হিমানী প্রথম টিচার হয়ে এল, তখন থেকেই তার উপকার করবার জন্য শশধরবাবু ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। শিশুমন্দিরের হেডমিস্ট্রেস মিস মনোলোভা চক্রবর্তী তাঁর অনেক দিনের বিশ্বস্ত সঙ্গিনী— প্রথম দিকে শয্যায়, পরের দিকে অন্যত্র। তিনিই হিমানী যাতে শশধরবাবুর সাহায্য পায়, সেদিকে নজর রাখবেন বলেছিলেন।
না রাখবেনই বা কেন? তিনিও তো শশধরবাবুর সাহায্যেই আজ নিউ আলিপুরে একটি বারো-শো স্কোয়ারফুট ফ্ল্যাটের মালিক। না-হলে আজ কোথায় থাকতেন তিনি? বেলেঘাটার একটা এঁদো গলিতে শ্বশুরবাড়ির বাসন মাজতে-মাজতেই তাঁর সেদিনের অসাধারণ রূপ নষ্ট করে ফেলতেন! আজ অবশ্য তাঁর সেই রূপের আর অবশিষ্ট বিশেষ কিছু নেই। শশধরবাবু যাদেরই ফুসলিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই যে খুবই রূপসী ছিল তা তো বলাই বাহুল্য। শশধরবাবু সুন্দরের পূজারি, কুৎসিত কোনো কিছুই তিনি সহ্য করতে পারেন না। তবে সুন্দরের পূজারি বলেই তো তিনি মাত্র একটি সুন্দরীকে নিয়েই দিন কাটাতে পারেন না। তাহলে, অন্যান্য সুন্দরীরা কি ভেসে যাবে নাকি? কাজেই, কিছুদিন বাদেই তাদের শশধরবাবু পাঠিয়ে দেন তাঁর অন্যান্য কর্মকেন্দ্রে। কেউ যায় তাঁর সিনেমা ব্যাবসায়ে, কেউ স্মাগলিংয়ে, কেউ জাল নোট পাচারের কাজে, কেউ বা সারা শহরের ছড়িয়ে থাকা তাঁর বেশ্যাগারগুলোয়। এসব জায়গাগুলো থেকে তারা যে আয় করে, তার এক-শো ভাগের এক ভাগও তারা তাদের সংসারে থাকলে করতে পারত না। সকলেই কী সুখী। তবে কিছু কিছু মেয়ে থাকেই যারা গাধারও অধম। যেমন ছিল হিমানী। তারা প্রতিবাদ করে, কান্নাকাটি করে। দুঃখ পান শশধরবাবু। কিন্তু এত প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাই তাদের আর বেঁচে থাকতে দেন না তিনি, খুন করে ফেলেন।
এসব অত্যন্ত পরিষ্কার ব্যাপার। এর মধ্যে কোনোই গণ্ডোগোল নেই। এসব তাঁর মনে কোনোদিনই রেখাপাত করে না। যে ক-টা মেয়েকে তিনি খুন করেছেন তাদের প্রত্যেকের নাম মনে আছে, কণ্ঠস্বর মনে আছে, তারা কে কোন রং পছন্দ করত তা-ও মনে আছে। এখনও সেইসব গান শুনলে, রং দেখলে তাদের কথা তাঁর মনে পড়ে। কিন্তু, কই তিনি তো কোনোদিনই বিচলিত বোধ করেননি। অথচ আজ হিমানীর কথা মনে পড়তেই তাঁর কীরকম মনে হচ্ছে— যেন তাঁর মনের মধ্যে কোথায় একটা বিরাট জট পাকিয়ে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তিনি ভয়ংকর একা। তাঁর অন্তরাত্মা যেন বারংবার বলছে, ‘সাবধান শশধর, তোমার সামনে ভীষণ বিপদ!’
এসব তো ভালো কথা নয়। আচ্ছা, ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করা যাক। কীসের বিপদ? স্পষ্টতই তড়িৎ। আসলে তাঁর মনে ভয় ঢুকেছে যে, তড়িৎ জেনে গেছে যে তিনিই হিমানীর হত্যাকারী এবং তিনি ওকে হত্যা করার আগেই ওই তাঁকে খুন করে বসবে। এটা একটা নিতান্তই অবাস্তব ভয়। দেউকিপুর স্টেশনের গায়ে চায়ের দোকানে তড়িতকে যখন তিনি বসে থাকতে দেখেছিলেন, তখন তড়িৎ ওঁকে দেখতে পায়নি বা তার পক্ষে দেখা সম্ভবও ছিল না। তড়িতকে দেখেই তাঁর বুক ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। তাহলে কি তড়িৎ সব জেনে গেছে এবং তাঁকেই তাড়া করে এতদূরে তাঁর এই গোপন বাসের কাছে এসে পৌঁছেছে? চট করে একটা পাশের দোকানে ঢুকে দ্রুত চিন্তা করে নিলেন তিনি। তখন সকাল আটটা, চারদিকে গিজগিজ করছে লোক, চায়ের দোকানের মালিক নিত্যানন্দ তাঁর মাইনে করা গুণ্ডা, কাজেই এর মধ্যে তড়িৎ কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু কোনো কিছু করার আগে, জানা দরকার তড়িৎ ওখানে কী করছে। তড়িৎ ভালো অভিনেতা হতে পারে, কিন্তু হঠাৎ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ও মনের ভাব গোপন করতে পারবে না। হয় গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, নয়তো পুরোনো দিনের মতো পরামর্শ শুরু করবে। ঝাঁপিয়ে যদি পড়ে, তাহলে তৎক্ষণাৎ নিত্যানন্দকে দিয়ে ওর মাথাটা দু-ফাঁক করে দেওয়া যাবে। যদি না-পড়ে, তাহলে কর্তব্য পরে স্থির করলেই চলবে। এইভেবে হঠাৎ দুম করে তিনি তড়িতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তড়িৎ কি তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? মোটেই নয়। বরং স্বভাবসিদ্ধ সরল হাসিতে তৎক্ষণাৎ ওর সমস্ত মুখটা ভরে গিয়েছিল। খুশি-খুশি গলায় বলে উঠেছিল, ‘আরে, কাকাবাবু! আপনি এখানে কী করছেন?’
তাহলে এত অস্বস্তির কী আছে? ভুল তাঁর হয়নি। মানুষ চেনায় তাঁর ভুল হয় না। তবে কি নীচের ঘরগুলোয় ওই বাতাসের শব্দটা? কী অদ্ভুত ব্যাপার! বাতাসের শব্দে শশধরবাবু ভয় পাচ্ছেন শুনলে যে একটা বাচ্চা ছেলেও হাসবে।
আসলে, দুপুরে বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি, সেইজন্যেই এরকম হচ্ছে। তড়িতকে বিনা ঝামেলায় খুনটা করে ফেলতে পারলে চিত্তও প্রফুল্ল হবে, এসব অস্বস্তিও চলে যাবে এবং হয়তো আর কোনোদিন হিমানীর কথা মনেও পড়বে না।
মনে পড়ার তো কোনো কারণ নেই। তিনি তো আর হিমানীকে উপভোগ করেননি। স্ত্রীলোকের সত্বীত্বে তিনি কোনোদিনই বিশ্বাস করেন না, যেমন করেন না সোনার পাথরবাটিতে। কিন্তু হিমানীর সতীত্ব হয়তো অন্য কেউ হরণ করে থাকতে পারে, তিনি পারেননি। এ হেন ব্যর্থতা তাঁর জীবনে খুবই কম হয়েছে। উপভোগটা না-করেই আর কোনো মেয়েকে তিনি মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন— এরকম কথা তাঁর স্মরণে আসে না। সেইজন্যেই কি তাঁর বার বার হিমানীর কথা মনে পড়ছে আজ? তাহলে অস্বস্তি হওয়ার কী কারণ? বরং রাগ হওয়া উচিত।
রাগও যে হচ্ছে না তা নয়। কী অদ্ভুত বুদ্ধিহীন, গণ্ডমূর্খ মেয়েই না ছিল হিমানী। এম এ পাশ করেছিল না কি। কী করে করেছিল, কে জানে। শশধরবাবু তো কল্পনাই করতে পারেন না যে কোনো শিক্ষিত মেয়ে এমন বোকা হতে পারে!
মনোলোভা অবশ্য গোড়াতেই বলেছিল, ‘হিমানী বড়ো কঠিন ধাতুর মেয়ে শশধরবাবু। আমাদের মতো লোভী, দুর্বল চরিত্রের মেয়ে ও নয়। আপনার জালে ধরা পড়বে কি না বুঝতে পারছি না।’
এসব কথা শুনলে শশধরবাবুর হাসি পায়। মেয়েরা যে কী ধাতুর, তা তাঁর আর জানতে বাকি নেই। একটিমাত্র ধাতুই ওদের আছে, সেটি হল সোনা। সোনা ছাড়া ওরা কিছু বোঝেও না, জানেও না। সোনার লোভ দেখালে ওদের দিয়ে সবকিছু করানো যায়। বাড়ি, গাড়ি, গহনা ব্যস! তবে কারোর লোভ বেশি, কারোর কম।
কিন্তু হিমানী যেন কেমন একটা ছিল।
প্রথম দিকে শশধরবাবুর ধারণা হয়েছিল, হিমানীকে বাগানো খুব কঠিন হবে না। উনি যে উপহারগুলো দিতেন সেগুলো নিত, কিন্তু তার পরেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। বলত, ‘আমার বাবা নেই। আপনাকে দেখলে, আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়।’ এসব কথায় শশধরবাবুর হৃদয় বিচলিত হয় না। অনেক মেয়েই ধর্ষিতা হওয়ার আগে তাঁর পা ধরে তাঁকে পিতৃসম্বোধন করেছে। কিন্তু হিমানীর মধ্যে এমন একটা অসংকোচে সারল্য ছিল যে, তিনি চট করে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন না। তারপর যখন তিনি ওকে সিনেমায় চান্স দেওয়ার কথা পাড়লেন, হিমানী বলল, ‘কী যে বলেন জ্যাঠামশাই! আমি আবার অভিনয় করতে পারি না কি? বরং ওকে একটু চান্স দিন না। ও কলেজে পড়ার সময় খুব থিয়েটার-টিয়েটার করত। আর ওর চেহারা যা সুন্দর, আপনার দেখলেই পছন্দ হবে।’ বলে সলজ্জ হাসল।
এই ‘ও’ হল তড়িৎ। তা তড়িৎ দেখতে সত্যিই সুদর্শন ছিল। আর হিমানীকে পাওয়ার জন্য তখন হেন কাজ নেই, যা তিনি করতে পারেন না। অগত্যা, সেই ছোকরাকে তাঁর সিনেমা কোম্পানিতে ঢুকিয়ে নিলেন শশধরবাবু।
তখন মহা হইচই পড়ে গেল। শশধরবাবু কস্মিনকালেও সিনেমা দেখেন না, কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন, সেই ছোকরার অভিনয় দেখে না-কি সবার তাক লেগে গেছে। সূর্যকুমার বলতে সবাই অজ্ঞান। তড়িৎ ওই নামেই সিনেমায় নেমেছিল।
তড়িতের হয়তো মাথা ঘুরে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কে জানে কেন ছোকরা অজস্র অফার নাকচ করে দিয়ে তাঁর কোম্পানিতেই রয়ে গেল। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে যে কত টাকা দিতে চেয়েছিল সে খবর শশধরবাবু রাখতেন, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তড়িৎ তাদের সকলকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। তড়িতের বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে গোপনে তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন এবং তারা সকলেই বলেছিল যে এই প্রত্যাখ্যানের কারণ তাঁর প্রতি তড়িতের কৃতজ্ঞতা। শুনে শশধরবাবু স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতা? সে আবার কী? সেরকম কোনো কিছু আবার হয় না কি? হুঁ, হুঁ। শশধরবাবুকে দেখলে যতটা বোকা বলে মনে হয়, আসলে তিনি মোটেই তা নন। আসল ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর খুব বেশি দিন লাগেনি।
খুবই সোজা ব্যাপার। কৃতজ্ঞতা-টৃতজ্ঞতা বাজে, আসল কথা গলায় গামছা দিয়ে আরও টাকা আদায়ের ধান্দা। এখন খুব সরল হেসে ‘আপনি যা দেবেন তাই নেব, কাকাবাবু!’ যতই বলো না কেন, আরও কিছু দিন গেলে আরও একটু নাম করলে, চেহারা যে কতদূর পালটাবে শশধরবাবুর তা জানা আছে। আর বাকি সব প্রডিউসাররা তো চুনোপুঁটি, তাঁর মতো টাকার কুমির বাংলাদেশে আর ক-টা আছে। খসাতে হলে, এখানে খসানোই ভালো।
তড়িৎকে তখন তাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হিমানীর জন্য পারা গেল না, মেয়েটা তখনও তাঁর কাছে দূর অস্ত। তিনি যতই হিমানীর দিকে এগিয়ে যান, তাকে কাছে টানতে চান, সে ততই মিষ্টি হেসে ভক্তি-টক্তির ভাব দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। প্রথম দিকে শশধরবাবু ভেবেছিলেন মেয়েটা ওঁকে খেলাচ্ছে। ভেবে খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু, পরে দেখলেন তা তো নয়। খেলাটা যে বড্ড বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন শশধরবাবু। শেষপর্যন্ত মনস্থিরই করে ফেললেন। সূক্ষ্ম ব্যাপার-ট্যাপারে কিসসু হবে না, হিমানীর গোবর-পোরা মাথায় কোনো ইঙ্গিতই ঢুকবে না, সোজা বাংলায় বলতে হবে! তারপর, ধর তক্তা মারো পেরেক, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বলপ্রয়োগ।
শশধরবাবু কিন্তু ফেল করে গেলেন। হিমানীকে তাঁর চৌরঙ্গীর বাড়িতে ডেকে যখন সবকথা খুলে বললেন, তাকে সোনায় মুড়ে দেবেন, বাগুইহাটির বাগানবাড়ি লিখে দেবেন বললেন, নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ কিনে দেবেন বললেন, তখন লোভে তার দুই চোখ চকচক করে ওঠার বদলে অপরিসীম ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বিকৃত কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনি যে এতদূর নারকীয় শয়তান তা আমার জানা ছিল না শশধরবাবু, জানলে আপনাকে জ্যাঠামশাই বলে সম্বোধন করতুম না। আপনার সমস্ত টাকাপয়সা আপনি ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। আমি আর তড়িৎ একবস্ত্রে এ শহর ছেড়ে চলে যাব এমন জায়গায়, যেখানে আপনার ক্লেদাক্ত হাত গিয়ে পৌঁছবে না।
অতঃপর বলপ্রয়োগ। কিন্তু সেখানেও ফেল। হিমানীর গায়ে যে এত জোর ছিল, আর সে যে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো লড়াই করতে পারে কে ভেবেছিল। শেষপর্যন্ত মুস্তাফা আর জমরুকে দিয়ে মেয়েটাকে বেঁধে ফেলতে হল।
হিমানী তখন খাঁচায় বদ্ধ জন্তুর মতো গর্জন করতে লাগল, ‘আপনি আমার ওপর অত্যাচার করতে পারেন শশধরবাবু, কিন্তু আমি আপনাকে ছেড়ে দেব না। বাইরে সমস্ত লোককে ডেকে বলব, ওই দ্যাখো, ভদ্রতার মুখোশ পরা কী ভয়ংকর এক পিশাচ তোমাদের বুকের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। পুলিশ হয়তো কিছু করবে না, আপনি টাকা ঢেলে অনেকের মুখ বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ করতে আপনি পারবেন না। আমি রাস্তার মোড়ে মোড়ে চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দেব, আপনার ওই মুখোশ আমি খুলে দেব। প্রতিশোধ আমি নেবই।’
শশধরবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘সে কী কথা? তুমি সবাইকে ডেকে বলবে যে, একজন তোমার সতীত্বনাশ করেছে? তোমার লজ্জা-শরম নেই, তুমি না কুলবধূ?’
‘না, আমার লজ্জা-শরম নেই। আমি যদি না-বলি, যদি আপনার স্বরূপ না-সকলকে জানাই, তাহলে তো কাল আপনি আর একটি নিরপরাধ মেয়ের ওপরে অত্যাচার করবেন। তা আমি হতে দেব না।’
শশধরবাবু মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘আহা, কী আমার রানিভবানী এলেন রে! তোর বর তো তোকে রাস্তায় দূর করে তাড়িয়ে দেবে। তখন খাবি কী? তখন তো আমার বেশ্যাবাড়িতেই আশ্রয় নিতে হবে।’
‘না, তড়িৎ আমায় তাড়িয়ে দেবে না। সে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে।’
‘ইঃ, কুলটা বউয়ের পাশে এসে দাঁড়াবে?’
‘হ্যাঁ, শশধরবাবু, তাই দাঁড়াবে, আমি কুলটা নই। আপনি জোর করে আমার ওপরে অত্যাচার করেছেন জানলে সে আমায় বুকে তুলে নেবে, এবং তারপর আপনাকে সে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলবে। হাজার মুস্তাফা এলেও কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। পুলিশের দরকার নেই, আমরা দু-জনেই আপনার ভণ্ডামির, শয়তানির শেষ করে ছাড়ব। আপনি সাপের চেয়েও মারাত্মক, আপনাকে ছেড়ে রাখা আত্মহত্যার সমান।’
এরপরে আর মাথা ঠিক থাকে? শশধরবাবু মানুষ, দেবতা নন। তা ছাড়া, মেয়েটার কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছিল। এসব আজকালকার লেখাপড়া জানা মেয়ে, এরা করতে পারে না হেন কাজ নেই। এইজন্যেই শশধরবাবু মেয়েদের বেশি পড়াশুনো করা পছন্দ করেন না। বেশি পড়াশুনো করলে এমনই সব মারাত্মক কথাবার্তা বলতে শেখে যে মাথায় খুন চেপে যায়। কাজেই, শশধরবাবু মুস্তাফা আর জমরুকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে হিমানীর গলা টিপে ধরলেন। ব্যাপারটা একটু কাঁচা হয়েই গিয়েছিল হয়তো। ফূর্তি করে নিয়ে তারপরে মেয়েটাকে শেষ করাই উচিত ছিল। কিন্তু রাগ চণ্ডাল। আগে তো শশধরবাবুর রাগ আরও বেশি ছিল। আজকাল ঈশ্বরানন্দ অবধূত বাবাজির শ্রীচরণে ঠাঁই পাওয়ার পর মাথা অনেক ঠান্ডা হয়েছে।
শশধরবাবু যখন মানুষ খুন করেন তখন কক্ষনো সাক্ষী রেখে করেন না, তা সে যত বিশ্বস্ত লোকই হোক না-কেন, কিন্তু হিমানীর বেলা সবই কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেল। সবে তিনি মেয়েটার গলা টিপে ধরেছেন আর সে চোখ উলটে গোঁ গোঁ করছে, তখুনি হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেন, ঘরের মধ্যে মুস্তাফা দাঁড়িয়ে। তিনি তো স্তম্ভিত! মুস্তাফা তাড়াতাড়ি তার ফেলে যাওয়া কোটটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
এখানেও আবার গণ্ডগোল। মুস্তাফাকে তাঁর চিরকালের জন্য সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু লোকটা এতদিন তাঁর সমস্ত দুষ্কর্মে এতরকম সাহায্য করেছে যে, কেমন যেন লোকটাকে একেবারে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হল না। তিনি তাকে একগাদা টাকা দিয়ে তার দেশ বিহারের কোনো গণ্ডগ্রামে পাঠিয়ে দিলেন এই কড়ারে যে, যতদিন না তিনি তাকে ডাকছেন, ততদিন সে যেন গ্রাম ছেড়ে কোথাও না-যায়।
তারপর হিমানীর মৃতদেহ কম্বলে মুড়ে গভীর রাত্রে পেছনের গলিতে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে তাঁর ওল্ড বালিগঞ্জের বাড়িতে চলে গেলেন। ফ্ল্যাটের আসল মালিকরূপে পরিচিত বেঞ্জামিন গোমেস পরের দিন এসে উদয় হল।
গণ্ডগোল কিন্তু এখানেই মিটে যাওয়া উচিত ছিল, অথচ তা গেল না। তার প্রধান কারণ অবশ্য গাধা তড়িৎ আর কলকাতার স্টুপিড কাগজগুলো। সূর্যকুমার যে এত জনপ্রিয়, কে জানত। তার স্ত্রীকে নিহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যাওয়ায়, কলকাতাসুদ্ধু লোক যেন খেপে গেল। কাগজগুলো যাচ্ছেতাই করে পুলিশকে গালিগালাজ করতে লাগল। কারোর আর খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই, দিনরাত শুধু এই আলোচনা। এত বিরক্তিকর সব ব্যাপার!
পুলিশ বাধ্য হয়ে তদন্ত শুরু করল। দেখা গেল, সেখানেও গণ্ডগোল। যে ডি এস পি টি তদন্ত শুরু করলেন, সেই শ্রীমন্ত বোস নাকি তড়িতের ভীষণ বন্ধু। সে কাগজে স্টেটমেন্ট দিল, যেভাবেই হোক, সে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবেই। এইসব ছেলে-ছোকরাদের বাড়াবাড়ি দেখলে রাগে হাড় জ্বলে যায় শশধরবাবুর।
তবে, এতেও তিনি খুব একটা ঘাবড়াননি। এর আগে একবার যখন সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ স্মৃতিময় ভট্টাচার্যিকে খুন করিয়েছিলেন, তখনও বেশ গোলমাল হয়েছিল। অবশ্য কিছুই হয়নি, সব ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে, এবার যেন গোলমালটা আর থামতেই চায় না। রোজই পত্রিকা খুললে সূর্যকুমারের ছবি, তিনি শোকে কাঁদছেন, রাগে কাঁপছেন, মাথার চুল ছিঁড়ছেন। যত্তোসব! কিন্তু শেষপর্যন্ত যখন তড়িৎ বাড়ি ছেড়ে উধাও হল, তখন যেন কেমন একটু ভড়কে গেলেন শশধরবাবু। যাওয়ার আগে তাঁকে একটা চিঠি লিখে গেল, ‘কাকাবাবু, হিমানীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে চললুম। আপনি আমাকে যে খ্যাতির মধ্যে এনে ফেলে দিয়েছেন, তার মধ্যে থেকে কোনো কাজই করা যায় না, তা সে গোপনেই হোক বা প্রকাশ্যেই হোক। যতদিন না সেই নরখাদককে খুঁজে বের করে স্বহস্তে তার মাথাটা ধড় থেকে ছিঁড়ে ফেলছি, ততদিন ফিরব না। সশ্রদ্ধ নমস্কার জানবেন।’
এরকম গোঁয়ার্তুমির কোনো মানে হয়? কী সর্বনেশে সব কথা! শশধরবাবু ভাবলেন, কিছুদিন তাহলে বিশ্রামই নেওয়া যাক। দেউকিপুরের বাড়িটা বহুদিন দেখাশোনা করা হয় না। অতবড়ো বাড়ি, কয়েকটা মালি, আর চাকরের ভোগে লাগছে। ওখানে গিয়ে কিছুদিন অজ্ঞাতবাস করলে, বিশ্রাম পেয়ে শরীরটা চাঙ্গা হবে আর কেউ হঠাৎ কোনো কিছু করে বসতে পারবে না। তড়িৎ ছেলেটা যেন একটু কেমন। ওকে কিছুই বিশ্বাস নেই। কী করতে যে কী করে বসে! মাস দু-তিনেক বাদে সব যখন ঠান্ডা হয়ে যাবে, তখন আবার কাজে নামা যাবেখন।
কিন্তু তারমধ্যেই আবার এই ঝামেলা।
আজ সকালে স্টেশনের পাশে চায়ের দোকানে তড়িৎকে দেখে তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন শশধরবাবু। স্বাভাবিকভাবেই কী মনে হয়? তড়িৎ সব জেনে গেছে এবং তাঁকে তাড়া করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। পরে, তড়িতের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছেন যে, না ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।
আসলে, শ্রীমান গিয়েছিলেন তারকেশ্বর। সেসব ভালো কথা। আজকালকার ছেলেপুলে, ঠাকুর দেবতায় ভক্তিটক্তি হওয়া ভালো। সেখানে গিয়ে সে ঠাকুরের সামনে হত্যে দেয়। কে নাকি তাকে বলেছে, হত্যে দিলে স্বপ্নে ঠাকুর দেখা দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দেন। হুঁ! যেমন তড়িৎ, তেমনি তার বন্ধুবান্ধব। ঠাকুরের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, হত্যে দিল আর তিনিও ছুটলেন তার সমস্যার সমাধান করতে! এসব কি হয় নাকি? কক্ষনো হয় না। তড়িতের বেলায়ও হয়নি। মাঝখান থেকে বেচারির পকেটটি সাফ হয়ে গেছে। ক্যাবলাকান্ত জানে না, ধর্মস্থানে সাবধানে থাকতে হয়। সে যাহোক। মানিব্যাগ যে খোয়া গেছে, সেটা সে আবিষ্কার করে শ্যাওড়াফুলি যাওয়ার বাসে উঠে মাঝ রাস্তায়। কন্ডাক্টর স্বাভাবিকভাবেই এখানে নামিয়ে দিয়েছে। এখন হাতঘড়ি বাঁধা দিয়ে নিতাই সামন্তের কাছে কিছু পয়সা নিয়ে বসে বসে চা খাচ্ছিল। শশধরবাবুকে দেখে তো ছোকরা যেন আকাশের চাঁদ মুঠোর মধ্যে পেল।
শশধরবাবু ওর সামনে বসে সাবধানে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল তোমার তড়িৎ? আর কতদিন এরকমভাবে ঘুরে বেড়াবে? বাড়ি ফিরে চলো। পুলিশ ঠিক সেই লোকটাকে খুঁজে বের করবে। তা ছাড়া আমি তো পুলিশমহলের সকলকেই বলে রেখেছি। চেষ্টার কেউ ত্রুটি করবে না।’
তড়িৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, কাকাবাবু। ওঁরা এগোবেন নিয়মমাফিক। তাতে দেরি হবে। কিন্তু আমি তো দেরি করতে পারি না। বেশি দেরি করলে হয়তো তাকে আর ধরা-ছোঁয়াই যাবে না।’
‘কী আশ্চর্য! তাই বলে তুমি এমনিভাবে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াবে?’
তড়িৎ মৃদু হাসল। বলল, ‘না কাকাবাবু, আর বেশিদিন ঘুরে বেড়াব না। মনে হচ্ছে পথের শেষে এসে প্রায় পৌঁছে গেছি।’
শশধরবাবু ভ্রূকুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলেন, ‘তার মানে?’
‘মানে, এমন একটা সূত্রের সন্ধান পেয়েছি যে, সেই শয়তানটার পরিচয় পেতে আর বেশি বাকি নেই। সে লুকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তার গোপন বাসের সন্ধান আমি এবার বের করবই।’
শশধরবাবুর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠল। বললেন, ‘একটু খোলসা করে বলো, বাবা তড়িৎ।’
‘কী জানেন কাকাবাবু, একজনের সন্ধান পেয়েছি, যে নিজের চোখে সেই হত্যাকাণ্ডটা দেখেছে।’
‘বলো কী? কোথায় থাকে সে?’
‘অনেক দূরে কোথাও থাকে। সেখানেই প্রথমে যাব।’
মানে, মুস্তাফা আর কী। হুঁ, যাওয়াচ্ছি তোমায়, চটপট প্ল্যান ঠিক করে ফেললেন শশধরবাবু। এসব ব্যাপারে তাঁর মগজ খুব দ্রুত কাজ করে থাকে। বললেন, ‘অনেক দূরে তো, যাবে কী করে? যেতে পয়সাকড়ি লাগবে না?’
তড়িৎ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘কী জানি লাগবে কি না!’
‘না-না, ওসব ছেলেমানুষি করো না। বিনা টিকিটে যেতে গিয়ে খুনি ধরা তো হবেই না, উলটে জেলে পচতে হবে। তার চেয়ে বরং এক কাজ করো। আজ সন্ধে বেলা আমার বাড়িতে চলে এসো, তোমায় কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দেব। তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারবে।’
কৃতজ্ঞতায় তড়িতের গলা বুজে এল প্রায়। বলল, ‘আপনি আমায় আবার ঋণী করলেন, কাকাবাবু। তবে চিন্তা করবেন না, আপনার সব ঋণ আমি কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করে দেব।’
‘আরে, না, না। ওসব কিছু নয়। তুমি তাহলে সন্ধে বেলা এসো। তোমাকে এখুনি নেমতন্ন করতে পারতুম, কিন্তু আমাকে এখুনি একবার শ্যাওড়াফুলি যেতে হচ্ছে, সেখানে ইলেকশন সংক্রান্ত কিছু কাজ আছে, সেটা সেরেই আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব।’
তড়িৎ মাথা নেড়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব, কাকাবাবু। সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যেই চলে যাব। আজকাল আর দিনের বেলা কাজ করার তেমন উৎসাহ পাই না, তাই এখন একটু এদিক-ওদিক কোথাও গিয়ে গড়িয়ে নেব। তারপর যাব। কোথায় বাড়িটা আপনার?’
শশধরবাবু ওঁর বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘দেখো, পথ হারিয়ে ফেলো না যেন। বাড়িটা ঘন বাগানের মধ্যে তো, তাই দিনের বেলায়ই ভালো করে কারোর নজরে পড়ে না। রাত্রি বেলা তোমার আবার খুঁজে পেতে অসুবিধে না-হয়।’
তড়িৎ বলল, ‘না, না রাত্রি বেলা আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আপনি এমন চমৎকার ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছেন যখন, দেখবেন চোখ বুজে হলেও চলে যাব।’
শশধরবাবু মনে মনে বললেন, ‘হ্যাঁ, চোখ বুজেই যাবে। তবে সে চোখ আর খুলতে হবে না।’
এরপর আর দেরি করা চলে না। শশধরবাবু সঙ্গেসঙ্গে ট্রেন ধরে চলে গেলেন শ্যাওড়াফুলি। সেখান থেকে ফোন করে জমরু আর শোভারামকে তক্ষুনি রওনা হয়ে যেতে বললেন মুস্তাফার বালিয়া জেলার গ্রামের দিকে। সঙ্গে দুটো স্টেনগান নিয়ে নিতে বললেন, যাতে ফসকানোর কোনো সুযোগ না-থাকে। একেবারে গুলি করে যেন ঝাঁঝরা করে দেয়। তারপর বাড়ি ফিরে এসে চাকর-মালিদের ছুটি দিয়ে দিলেন। মুস্তাফার ভুল আর দ্বিতীয় বার করতে রাজি নন তিনি। এমনকী, যে কবরে তড়িৎকে চাপা দেবেন, সেটা পর্যন্ত নিজে খুঁড়েছেন, যাতে কারোর মনে কোনোরকম সন্দেহ না-জাগতে পারে।
এইবার সমস্ত কিছু রেডি। কেবল নিমন্ত্রিতটির আসবার অপেক্ষা। বেচারা জানে না, যাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসছে। তা না-হলে এ-বাড়ি সে জীবনে কোনোদিন খুঁজে পেত না।
কিন্তু সব কিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি ক্রমাগত শশধরবাবুর মনের মধ্যে খচখচ করে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত ভয় গলার কাছে একটি কঠিন পিণ্ডের মতো দানা বেঁধে উঠছে। বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট চলেছে সমানে। নীচের তলার ঘরগুলোর মধ্যে সেই হাওয়ার গুমরে ওঠা হাহাকার শশধরবাবুর বুকের মধ্যে একটা বরফ-শীতল ভারের মতো ক্রমশ চেপে বসছে। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, কোথায় যেন কী একটা ভয়ানক গোলমাল হয়ে গেছে। কিন্তু কী যে হয়েছে, কিছুতেই সেটা ধরতে পারছেন না।
শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে দুত্তোর বলে শশধরবাবু ট্রানজিসটারটা খুলে দিলেন। বাংলায় খবর শুরু হয়ে গেছে। আজেবাজে যত ভ্যাজভ্যাজানি। কে যে এসব খবর শোনে, কে জানে!
সিঁড়ির ঘড়িতে টং করে সাড়ে সাতটা বাজল। একটু বাদেই বাগানের দরজাটা খড়খড় করে খুলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। বাগানের নুড়ি বিছানো রাস্তার ওপর একটি ভারী পদশব্দ এগিয়ে আসছে।
এইবার। এইবার অ্যাকশন।
শিকার দেখলে একটা ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন প্রথমে ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়, তেমনিভাবে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে গেলেন শশধরবাবু, কিন্তু পারলেন না। একটা ভয়ংকর আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে ধপ করে বসে পড়লেন।
কারণ, রেডিয়োর সংবাদপাঠক তখন বলছেন, ‘আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা সূর্যকুমার, আজ সকালে পরলোক গমন করেছেন। তারকেশ্বর স্টেশনের বাইরে রেললাইনের ধারে তাঁর মৃতদেহ আজ পুলিশ আবিষ্কার করে। তাঁর মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি, তবে পুলিশের ধারণা এটা হত্যাকাণ্ড নয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, কিছুদিন পূর্বে তাঁর স্ত্রীর রহস্যময় মৃত্যুর পর তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।’
বাইরে তখন ঝোড়ো হাওয়া যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। আর পায়ের শব্দটা এগিয়েই আসছে, এগিয়েই আসছে।