বিদেশে দৈবের বশে
আজ থেকে বছর পনেরো আগে আমাকে একবার যেতে হয়েছিল বিরৌলি নামে উত্তরপ্রদেশের একটি ছোটো শহরে। রামনগর থেকে যে রাস্তাটা কাঠগুদামের দিকে গেছে, তার মাঝামাঝি প্রায় একটা জায়গায় বিরৌলি। প্রায় মানে, একটা ছোটো রাস্তা দিয়ে মাইল দুয়েক একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বড়ো রাস্তা থেকে বিরৌলি নজরে পড়ে না। তবে, জানি না, আজ হয়তো ওসব জায়গার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
বিরৌলি কিন্তু তীর্থযাত্রীদের কাছে একেবারে অপরিচিত নয়। একটা উষ্ণ প্রস্রবন আছে এখানে, আর আছে মৃত্যুঞ্জয় শিবের মন্দির। প্রতি বছর মাঘ মাসে একটা বড়ো মেলাও হয়। তবে যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় বড়ো একটা দূরের যাত্রী এখানে আসত না, কারণ কাঠগুদাম বা রামনগর দু-জায়গা থেকেই এখানে আসা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। একটিমাত্র হাড় জিরজিরে বাস সকালে কাঠগুদাম থেকে রামনগর গিয়ে বিকেলে ফিরে আসত। তাও রোজ নয়, মাঝে মাঝেই সেটা বিগড়ে যেত। তা ছাড়া ছিল এক্কা। সেটাতে অতটা পথ যাওয়া যে কী কষ্টকর অভিজ্ঞতা, সে শুধু যে গেছে সেই বুঝেছে। জঙ্গলেও ভয় ছিল, জন্তু জানোয়ারেরও, মানুষেরও।
তবু কাছেপিঠের থেকে যাত্রী আসত। তাই, বিরৌলিতে ধর্মশালা ছিল, বেশ কিছু দোকান পাট ছিল, একটা ছোটো হোটেলও ছিল— ওরিয়েন্টাল লজ, প্রোঃ হরিদয়াল চতুর্বেদী। এ ছাড়া ছিল একটা টি বি স্যানাটোরিয়াম। হোটেলটা স্যানাটোরিয়ামের রুগির আত্মীয়দের আশ্রয়স্থল ছিল।
বিরৌলিতে আমার গন্তব্যস্থল ছিল এই স্যানাটোরিয়াম। আমি তখন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে ওই অঞ্চলটা কভার করছিলুম। স্যানাটোরিয়ামের রেসিডেন্ট ডাক্তার ছিলেন কলকাতার লোক— ডা ফুলচাঁদ সরোগি। তাঁর জন্ম লেখাপড়া প্রভৃতি সবই কলকাতায়, বাংলা বলতেন পরিষ্কার। উনি যখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন, তখনই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও হয়েছিল, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে নয়, রুগি হিসেবে। খানিকটা তাঁর ভরসাতেই আমার বিরৌলিতে যাওয়া।
রামনগর রোডের ওপর বিরৌলি মোড়ে নেমে টাঙ্গা করে শহরে যখন গিয়ে পৌঁছলুম, তখন বেলা প্রায় বারোটা। ভোর চারটেয় বেরিয়েছি, তার ওপর বাসটা দু-বার রাস্তায় খারাপ হওয়ায় সব যাত্রীদের সঙ্গে আমাকেও ঠেলতে হয়েছিল সেটাকে; ফলে ক্লান্তিতে শরীর প্রায় অবসন্ন তখন। হসপিটালে তখনই না-গিয়ে সোজা চলে গেলুম ওরিয়েন্টাল লজে। সেখানে মালপত্র রেখে, স্নান খাওয়া সেরে একটু লম্বা হতেই ঘুমিয়ে পড়লুম। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা আর বেশি বাকি নেই। ঘরের দরজায় তালা মেরে, ব্যাগ হাতে তখনই ছুটলুম হসপিটালের দিকে।
হসপিটালটা শহর থেকে একটু বাইরে, মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। পথটাও ভারি সুন্দর। একটা ছোট্ট নদীর তীর ধরে ধরে যেতে হয়। হটস্প্রিংয়ের জলটা এই নদীতেই এসে মেশে। নদীর ওপারে একটা গ্রাম। এপারে জনবসতিহীন রুক্ষ মাঠ। এই মাঠেরই অন্যপ্রান্তে নটবরলাল মেমোরিয়াল টি বি হসপিটাল; সংক্ষেপে এন এম এইচ। কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা বেশ বড়ো একতলা হলদে রঙের বাড়ি, সামনে বাগান। তার থেকে কিছুটা দূরে পাঁচ-ছ-খানা একতলা বাংলো ধরনের বাগানওলা বাড়ি— সেগুলো ডাক্তারদের কোয়াটার্স।
হসপিটালে গিয়ে শুনলুম ডা সরোগি ছুটি নিয়েছেন, তবে কোয়াটার্সেই আছেন। তখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে হানা দেওয়া গেল। অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পর সন্তর্পণে দরজা খুললেন ডাক্তার। খুবই চিন্তিত মুখ, আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন, কিন্তু খুশি হলেন কি না বুঝতে পারলুম না। নীরবে হাত নেড়ে ভেতরে আসতে বললেন। ডা সরোগি কোনোকালেই খুব হাসিখুশি লোক ছিলেন না, কিন্তু এতটা গম্ভীরও তাঁকে কোনোদিন দেখিনি।
সাদামাটা পরিচ্ছন্ন বসবার ঘর। একটা বেতের চেয়ারে বসে গড়গড় করে অনেক কথা বলে গেলুম। আমার তার পেয়েছেন কি না, শরীর কেমন আছে, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কোথায়, ইত্যাদি। ভদ্রলোক চুপ করে বসে সব শুনলেন। চোখ দু-টি কিন্তু অন্যমনস্ক। বললেন, ‘তার করেছিলেন নাকি? পাইনি তো। স্ত্রী ভেতরে আছেন, ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে। ভালোই আছে সব। তা কী মনে করে?’
আমি বললুম, ‘ডাক্তারসাহেব, মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে আপনি খুব চিন্তিত আছেন। আমি যে কী মনে করে এসেছি, তা তো আপনার জানাই আছে। তবে আজ সে কথা থাক। কাল বলা যাবে-খন।’ তারপর একটু চুপ করে থেকে বললুম, ‘যদি রাগ না-করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘কী কথা?’
‘আপনার যদি কোনো সমস্যা এসে থাকে আর সেটা যদি নিতান্ত ব্যক্তিগত না-হয়, তাহলে আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আমি আপনার বহুদিনের পরিচিত, সেই ভরসাতেই এ কথাটা বললুম।’
ডাক্তার আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘মিস্টার রায়, সত্যিই আপনি বোধ হয় আমাকে সাহায্য করতে পারেন। করবেন?’
আমি মাথা নেড়ে বললুম, ‘করব। আপনি আমার বোনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন, আমি…’
ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন, ‘না, না, ওসব কিছু নয়! তবে চট করে হ্যাঁ বা না বলে বসবেন না। আগে আমার প্রবলেমটা শুনুন, তারপরে যা স্থির করার করবেন।’
আমি বললুম, ‘বেশ তো! বলুন।’
ডাক্তার বললেন, ‘দেবেন্দ্র গর্গের নাম শুনেছেন? আপনার অবশ্য না-শোনারই কথা। ভদ্রলোক লখনউ-এর একজন নামজাদা কনট্রাক্টর, কোটিপতি লোক। মাস দুয়েক আগে ভদ্রলোক আমাদের এই হসপিটালে ভরতি হন। তখনই অবস্থা খুব সঙ্গীন। কোনোরকমে ঠেকা দিয়ে রাখা গিয়েছিল, সামান্য উন্নতিও হয়েছিল। গতকাল ভোররাত্রে হঠাৎ মারা গেলেন। সিজার অফ হার্ট। কিছু করার ছিল না।
ভদ্রলোক বিপত্নীক, দুই ছেলে। বিনয়কুমার আর অশোককুমার। একজনের বয়েস বাইশ, অপরজন চব্বিশ হবে। গোড়ার দিকে খুব ঘনঘন আসত, ইদানিং আসা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। ব্যাবসার ব্যাপার ফেলে রাখা যায় না।
দেবেন্দ্র মারা যেতে আমি লখনউতে ওদের বাড়িতে ফোন করি। শুনলুম অশোক গেছে আমেরিকায়, বিনয় কলকাতায়। মুনশিজি বললেন যে উনিও তক্ষুনি রওনা হতে পারছেন না, অতএব আমি যেন মৃতের সৎকার করে অস্থি রেখে দিই, যাতে ছেলেরা এসে সেটা সংগ্রহ করতে পারে।
এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। আমার এখানে তো আর কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু দাহ করতে গিয়েই হল প্রবলেম।
ভদ্রলোকের হাতে ছিল একটা দামি সোনার ঘড়ি, আর দু-হাতে গোটা চারেক আংটি— সেগুলোরও অনেক দাম। কাজেই ডেডবডি ওয়াশ করার আগে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো খোলাই।
এ ছাড়াও ওঁর দু-হাতে কনুইয়ের ওপর দুটো বড়ো বড়ো মাদুলি ছিল, সে দুটোই একইসঙ্গে খোলানো হয়। সব ক-টা জিনিস নিয়ে আমি আমার অফিস ঘরে লোহার সিন্দুকে রেখে চাবি দিয়ে দিই। মাদুলি দুটো পকেটেই ছিল, ভেবেছিলুম নদীর জলে ফেলে দেব।
মৃতদেহ শ্মশানে পাঠিয়ে আমার বাড়ি আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। স্নান করতে যাবার আগে পকেট থেকে সব জিনিসপত্র বের করতে গিয়ে মাদুলি দুটো বেরিয়ে আসে। আমার স্ত্রী তখন সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওঁর হাতে মাদুলি দুটো দিয়ে বললুম, ”এগুলো এখন রেখে দাও, পরে নদীতে ফেলে দেব-খন।”
বেশ বড়ো বড়ো দু-টি মাদুলি, কালো কার দিয়ে বাঁধা। আমার স্ত্রী সে দুটো নিতে গিয়ে অসাবধানে হাত থেকে ফেলে দেন। অমনি দুটোরই পাশদুটো খুলে গিয়ে ভেতর থেকে বড়ো বড়ো চারটে হিরে বেরিয়ে আসে, যাদের এক-একটারই দাম কয়েক লাখ টাকা। বুঝতে পারলুম, দেবেন্দ্র গর্গ এমার্জেন্সির জন্য ওগুলো নিজের সঙ্গে রেখেছিলেন। নিজের লোকেদের বা আত্মীয়স্বজনের ওপরেও খুব আস্থা বোধ হয় ছিল না।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘হিরেগুলোর অত দাম আপনি কী করে বুঝলেন?’
ডা সরোগি হাসলেন। বললেন, ‘আমি ডাক্তার হতে পারি, কিন্তু আমার বংশ তো ব্যাবসাদারের বংশ। আমি মিসফিট বলে ব্যাবসায় ঢুকিনি, কিন্তু হিরে দেখলে চিনতে পারব না সেটা তো কোনো কাজের কথা নয়।’
আমি বললুম, ‘সে তো বটেই। তারপর কী হল?’
‘সেখানে আমরা দু-জন ছাড়াও, আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে রামদুলারী উপস্থিত ছিল। সে সেখানে না-থাকলে হয়তো কোনো বিপদই হত না, কিন্তু থেকেই যত গণ্ডোগোল বেধেছে। যদিও রামদুলারী অনেক বছর আমাদের বাড়িতে আছে ঠিকই, তবে সে খুব সৎ নয়, তার কিছু হাতটান আছে এটা আমরা জানি। শুনেছি, ওর বয়ফ্রেন্ড হচ্ছে গুলাব রাই; এই অঞ্চলের নামকরা ডাকাত। ভাবটা নাকি সম্প্রতি হয়েছে। কানাঘুসোয় শোনা, সত্যি-মিথ্যে জানা নেই।’
আমি প্রশ্ন করলুম, ‘এসব জেনেশুনেও অমন কাজের লোক ছাড়িয়ে দেননি?’
ডাক্তার মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না। তার প্রথম কারণ, মেয়েটি আমাদের কাছে অনেক দিন আছে। দ্বিতীয় কারণ, সে অত্যন্ত এফিসিয়েন্ট। তৃতীয় কারণ, তার সম্বন্ধে যা কিছু শুনেছি, তার সব-ই গুজব। চতুর্থ কারণ, গুলাব রাই আমার রুগি, আমার কোনো ক্ষতি সে করবে না বলেই এতদিন বিশ্বাস ছিল।
এসব অঞ্চলের কথা তো আপনি জানেন। ডাকাতরা বেশ ওপনেলি ঘুরে বেড়ায়, স্থানীয় লোকেরা তাদের হিরো ওয়ার্শিপও করে থাকে। সত্যি কথা বলতে কী, গুলাবকে নিয়ে বিরৌলির মানুষ বেশ অহংকার বোধ করে থাকে। পুলিশ রেড হলে খবর চলে আসে আগের থেকে। গুলাবকে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়, তার হাইড-আউটে খাবারদাবারও পৌঁছে যায়।
তা এই গুলাবকে আমি অনেক দিন থেকেই চিকিৎসা করে আসছি। কিশোর বয়েসে ওর প্লুরিসি হয়েছিল, তারপর থেকে বুকটা খুব সুস্থ নয়। নিশ্বাসের কষ্ট আছে। আর এ অঞ্চলের সকলের মতো যক্ষ্মা রোগটাকে বেজায় ভয় পায়। কাজেই মাঝে মাঝে সে আসে আমার কাছে। অত্যন্ত বিনয়ী, শান্ত প্রকৃতির লোক। আপনি দেখলেই চিন্তাই করতে পারবেন না যে, সে একটা দুর্দান্ত ডাকাত আর ভারত সরকার তার মাথার দাম ঘোষণা করেছেন পাঁচ হাজার টাকা।
এতদিন ভাবতুম গুলাব আর যারই ক্ষতি করুক, আমার করবে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে ধারণা ভুল।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেন?’
‘সে কথাই বলছি। রামদুলারী হিরেগুলোকে দ্যাখে এবং উত্তেজনার বশে বলে ফেলা আমার মন্তব্যগুলোও সে শোনে। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে বলি যে খেয়ে উঠেই আমাকে এগুলো নিয়ে গিয়ে হসপিটালের সিন্দুকে রেখে আসতে হবে। বলে, ব্যাপারটা রিয়ালিস্টিক করবার জন্যে আমি হসপিটালে ফিরে গিয়ে বেশ জোরে জোরে শব্দ করে সিন্দুক খুলি, কিন্তু হিরেগুলো ওখানে রাখার পরিবর্তে সোনার ঘড়ি এবং আংটিগুলোও বাড়ি নিয়ে চলে আসি।’
আমি আঁতকে উঠে বললুম, ‘সর্বনাশ! করেছেন কী? গায়ে পড়ে এই ভয়ংকর ঝামেলা নিজের বাড়িতে এনে তুলেছেন?’
ডাক্তার গম্ভীর হলেন। বললেন, ‘হুঁ, আমার স্ত্রীও সে কথাই বলছেন বটে। কিন্তু কর্তব্যবোধ বলছে, আমি ঠিক কাজই করেছি। এই হাসপাতালে দেবেন্দ্রজির অপরিসীম দান আছে এবং আমি মনে করি তাঁর মূল্যবান জিনিসগুলো তাঁর উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেওয়াই আমার কর্তব্য, জেনেশুনে ডাকাতের হাতে তুলে দেওয়া নয়।’
আমি বললুম, ‘ঠিক আছে, আপাতত আপনার কথাই মেনে নিলুম, পরে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা যাবে। কিন্তু তার পরের ঘটনা বলুন।’
‘আমি বাড়ি ফিরে এসে দেখলুম, যা সন্দেহ করেছি তাই ঘটেছে— রামদুলারী অদৃশ্য হয়েছেন। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলুম, হাসপাতালে কাল রাত্রে ডাকাত পড়েছিল। দারোয়ানের হাত-পা-মুখ বেঁধে সিন্দুকের দরজা কেটে ফেলা হয়েছিল অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাস দিয়ে। ভেতরে হাজার খানেকের কিছু কম টাকা ছিল। সেটা গায়েব হয়েছে। রুগিরা কেউ টের পায়নি, নার্সরাও নয়। আর পাবেই বা কোত্থেকে। এসব ব্যাপারে এ অঞ্চলে কেউ টের পায় না, পেতেও চায় না।
এখন আমার সন্দেহ, শুধু সন্দেহ কেন, স্থির বিশ্বাস যে আজ রাতে আমার বাড়িতে ডাকাত পড়বে। গুলাবের লোভের কাছে তার কৃতজ্ঞতাবোধ যে হার মানবে তাতে সন্দেহ নেই। এ যে অনেক টাকা।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘পুলিশে খবর দেননি?’
‘দিয়েছি। পুলিশ আসেনি, কালও আসবে কি না সন্দেহ। কাজ শেষ হলে তবেই আসবে বোধ হয়। গুলাবেরও তো সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে চলা প্রয়োজন, তাই না? আসলে পুলিশের ওপর আমার ভরসা নেই, তা তো বুঝতেই পারছেন। তাই আজ সারাদিন বসে বসে বন্দুক পরিষ্কার করেছি। বিনা বাধায় গুলাবকে ঢুকতে দেব না।’
আমি বললুম, ‘বেশ করেছেন! অকারণে এমন ভয়ংকর বিপদ নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন। এবার তাহলে বলুন, আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘হিরেগুলো আপনাকে পাচার করতে হবে।’
‘সর্বনাশ! বলে যান।’
‘আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে…’
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘সর্বনাশ বলা আমার স্বভাব। বললুম তো, বলে যান। আপনার প্ল্যানটা শুনি।’
‘দেখুন, আপনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। আপনার সঙ্গে অনেক ওষুধের স্যাম্পল থাকে। তার যেকোনো একটা কৌটোর মধ্যে ভরে আপনি হিরেগুলো এখান থেকে বাইরে নিয়ে যান।’
‘আপনি আমায় বিশ্বাস করেন? গুলাবের লোভ যে আমাকে পেয়ে বসবে না, তার কোনো স্থিরতা আছে কি?’
‘না, তা নেই। তবে আপনি গুলাব নন। এত দামি হিরে আপনি কখনো হজম করতে পারবেন না, ধরা পড়ে যাবেন।’
‘বেশ, বুঝলুম যে আমার প্রতি আপনার আস্থার কারণ আমার সততা নয়, আমার অপদার্থতা।’
ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ডাকাত হিসেবে, ভদ্রলোক হিসেবে নয়।’
‘কিন্তু একটা অসুবিধে আছে যে। আমার ব্যাগ তো আনিনি এখন; সেটা পড়ে আছে হোটেলের ঘরে।’
ডাক্তার একটু ভেবে বললেন, ‘আনেননি ভালোই হয়েছে। আপনি এই অন্ধকারে হিরেগুলো নিয়ে নদীর ধার দিয়ে ফিরতেন— সেটা ভালো হত না। এক কাজ করা যাক। হোটেল থেকে আপনার মালপত্র আনিয়ে নিচ্ছি আর এখানে একটা থাকার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। আজ রাতটা এখানেই কাটান, কাল সকালে আমি আপনাকে বাস রাস্তায় পৌঁছে দিয়ে আসব।’ বলে টেলিফোন তুলে হসপিটালের কেয়ারটেকারকে ডেকে পাঠালেন।
কেয়ারটেকার রোগা লম্বা মাঝবয়সী একটি লোক, প্রকাণ্ড গোঁফ, মাথাভরতি ঝাঁকড়া চুল। এককালে নাকি মিলিটারিতে ছিল, নাম হরিরাম গোয়েল।
ডাক্তার হরিরামকে হোটেল থেকে আমার সব মালপত্র এনে দিতে বললেন আর প্রশ্ন করলেন, ‘সাত নম্বর কোয়ার্টারটা তো খালি হয়েছে, তাই না? উনি ওখানেই থাকবেন। আমার এখানে ডিনারের পর ওখানে গেলে ওঁকে দরজাটা খুলে দিও। ইনি আমার পুরোনো বন্ধু; দেখো যেন কোনো অসুবিধে না-হয়।
হরিরাম ডাক্তার সরোগির কথা শুনে একটু কেমন চোখে যেন তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
হরিরাম চলে গেলে আমাকে বললেন, ‘আমার বাড়িতে আপনাকে রাখলুম না, কারণ আমার বিশ্বাস ওরা আজ রাতে আমার বাড়িতে হানা দেবে। অন্য বাড়িতে আপনাকে সম্ভবত অ্যাটাক করবে না, কারণ এত দামি হিরে আমি হাতছাড়া করব এটা ওরা বোধ হয় মানতে পারবে না। আর দ্বিতীয় কারণ, ওবাড়ির সদর দরজায় কোলাপসিবল গেট আছে, যেটা এখানে অন্য কোনো বাড়িতে নেই। সেটা একটা বাড়তি প্রোটেকশন। তার পরেও যদি দ্যাখেন ওরা আপনাকে অ্যাটাক করেছে, তাহলে হিরেগুলো দিয়েই দেবেন। অকারণে রিক্স নেবেন না।’
আমি বললুম, ‘বেশ, তাই হবে। তবে আপনিও অকারণে রিস্ক নেবেন না, আপনার সঙ্গে বউদি আছেন, তাঁর কথাটা মনে রাখবেন।’
সাত নম্বর বাড়িটা ডাক্তারদের কলোনির একপ্রান্তে। একপাশে দিগন্তবিস্তৃত রুক্ষ মাঠ, সামনে বেশ কিছুটা দূরে নদী। সামনে সুন্দর বাগান। আমি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে হরিরামকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এ বাড়িতে কেউ থাকে না?’
হরিরাম মাথা নেড়ে বলল, ‘না। অনেক দিন হল সাত নম্বর ডাক্তারের পোস্ট খালি পড়ে আছে, তাই বাড়িটাও খালিই পড়ে থাকে। দু-একজন গেস্ট এলে বা রুগির আত্মীয়স্বজন এলে কখনো-সখনো তাঁদের এখানে জায়গা দেওয়া হয়।’
কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকলুম। দেখলুম, বাইরের বড়ো ঘরটায় একটা খাট পাতা রয়েছে। পাশে টেবিলে জল, একছড়া কলা আর একটা বড়ো মোমবাতি রাখা আছে। মশারি খাটানো। ঘরের একপাশে আমার ব্যাগ, বিছানা আর সুটকেশ গুছিয়ে রাখা। বুঝলুম, আমার কোনোরকম অসুবিধে যাতে না-হয়, তার সব বন্দোবস্তই করা আছে।
কেবল একটা জায়গায় খটকা লাগল। আমি বহু জায়গায় ঘুরেছি, বহু জায়গায় থেকেছি, দীর্ঘকাল অব্যবহৃত ঘরেও বাস করেছি, কিন্তু এ বাড়িটা অনেক দিন খালি পড়ে আছে সেরকম আমার মোটেই মনে হল না। অব্যবহারের সোঁদা গন্ধ তো নেই-ই, বরং মানুষের বাস করার গন্ধই প্রবল। হরিরামকে জিজ্ঞেস করেই ফেললুম, ‘এ বাড়িতে কি সম্প্রতি লোক ছিল?’
হরিরাম বলল, ‘হ্যাঁ, এক বাবু এখানে কিছুদিন ছিলেন। রুগির আত্মীয়। কাল রাত্রে চলে গিয়েছেন।’ বলে আমাকে নমস্কার করে বিদায় নিল। আমি কোলাপসিবল গেটে তালা মেরে ঘরে দোর দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বসলুম। রাতটা মোটামুটি জেগেই কাটাতে হবে সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না।
পকেট থেকে ডা ফুলচাঁদ সরোগির দেওয়া ট্যাবলেটের কৌটোটা বের করে আমার স্যাম্পেলের ব্যাগের ভেতরে রেখে দিলুম। হিরেগুলো ডাক্তার আমায় দেখিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বার দেখবার আর ইচ্ছে হল না। এই কয়েকটা স্বচ্ছ কঠিন পাথরের টুকরোর জন্য মানুষ কী করে অমানুষে পরিণত হতে পারে, সিগারেটে টান দিতে দিতে সে দার্শনিক তত্ত্ব নিয়েই চিন্তা করছিলুম। এমন সময় বাইরে একটা গর্জন শুনে চমকে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলুম।
মানুষের গলা। কে যেন বাইরে হিন্দিমিশ্রিত উর্দুতে এই হসপিটাল আর তার ম্যানেজমেন্টের যাবতীয় লোককে গাল পাড়ছে। এ তো ডাকাত হতে পারে না। ডাকাত এমন চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে আসবে কেন? আমার হৃৎপিণ্ডটা এতক্ষণ গলার কাছে এসে ধড়ফড় করছিল, অনেক কষ্টে ঢোক গিলে সেটাকে স্বস্থানে পাঠিয়ে ঘরের দরজায় ছিটকিনি খুলে অল্প একটু ফাঁক করে দেখতে গেলুম।
ঘরের আলো বাইরে যেতে এবার যাবতীয় গালাগালি আমার দিকে ধেয়ে এল। দেখি, কোলাপসিবল গেটের বাইরে এক বেঁটেখাটো বৃদ্ধ ভদ্রলোক পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পাজামা পরা, হাতে সরু ওয়াকিং স্টিক, সচিৎকারে জানতে চাইছেন যে আমি কে, কোন আক্কেলে আমি তাঁর ঘর দখল করেছি, সেই শুয়ারের বাচ্চা হরিরাম কত টাকা ঘুস খেয়েছে আর আমি সেই ভদ্রলোককে সারারাত বাগানেই দাঁড় করিয়ে রাখতে চাই কি না।
আমাকে খুব তাড়াতাড়ি কতগুলো ডিসিশন নিতে হল। প্রথমত, রাত তখন বেশি নয়, সাড়ে আটটা হবে, সামনে হসপিটালে আর পাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে, কাজেই আমার অতিথিটি ডাকাতি করতে এসেছেন বলে মনে হল না। দ্বিতীয়ত, ভদ্রলোক এতই সৌম্যদর্শন এবং অভিজাত যে তাঁকে ডাকাতের চর বলেও মনে হল না। তৃতীয়ত, যদি চর হনও, তাহলেও বৃদ্ধকে ঘরের মধ্যে কাবু করা আমার পক্ষে কঠিন হবে না। চতুর্থত, ভদ্রলোক এমনই ক্রুদ্ধ যে স্পষ্টত সেটা অভিনয় নয়, নিশ্চিয়ই ওঁর বক্তব্য আমার শোনা উচিত। কাজেই কোলাপসিবল গেটের চাবি হাতে আমি দরজা খুলে বারান্দায় এলুম।
আমাকে দেখতে পেয়ে ভদ্রলোক যেন একটু শান্ত হলেন। আমার শার্ট আর ট্রাউজার্স পরিহিত চেহারা দেখে বিশুদ্ধ ইংরাজিতে বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমি ভেবেছিলুম, হরিরামের কোনো বন্ধু বুঝি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমাকে দয়া করে ভেতরে আসতে দিন।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘আপনি কি এখানে থাকেন? হরিরাম বলল যে যিনি এখানে ছিলেন, তিনি কাল রাত্রে চলে গিয়েছেন?’
শুনে ভদ্রলোক আবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘উঃ, হরিরামের মতো এরকম একটা নির্বোধ লোক যে কেন জেলে না-থেকে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, কে জানে। আমি গিয়েছিলুম কাঠগুদামে। আমার স্ত্রী এখানে রুগি হিসেবে আছেন। কাল ভোরে তাঁকে ডিসচার্জ করার কথা। তো, আমাকে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? তা ছাড়া, আমার মালপত্র রয়েছে এখানে। আমি তাকে বললুম যে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আর অমনি সে ধরে নিল যে আমি ঘর ছেড়ে চলে গেলুম? এমন একটা গাধা আর আপনি দ্বিতীয় দেখেছেন?’
আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে ভেতরে নিয়ে এলুম। ভদ্রলোক বললেন, ‘দরজায় ভালো করে তালা দিন, জায়গাটা ভালো নয়।’ বলে ভেতরে চলে গেলেন। আমিও ওঁর পেছন পেছন গেলুম। দেখি, ভেতরে যেটা আসলে বেডরুম, সেখানে সত্যিই ওঁর মালপত্র সব রাখা আছে, বিছানা করা আছে, কেবল মশারিটা ওপরে তোলা, নামানো নেই।
ভদ্রলোক সহাস্যে বললেন, ‘দেখুন, হরিরামটা ঘরের ভেতরে পর্যন্ত ঢোকেনি। যাক, আমি স্নান করে আসছি, তারপরে আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে-খন।’
ভদ্রলোকের বয়েস ষাটের একটু ওপরেই হবে। টকটকে ফর্সা গায়ের রং, মাথার চুল সব সাদা, কিন্তু অত্যন্ত মজবুত শরীর। বেঁটে, কিন্তু এ বয়েসেও যথেষ্ট শক্তি রাখেন, সেটা বোঝা যায়। পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে ওঁর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চেহারাটি সত্যিই দেখবার মতো। আর অত্যন্ত মার্জিত, শিক্ষিত এবং অভিজাত চেহারা।
একটি ছোটো হুইস্কির বোতল ছোটো টেবিলটার ওপর রেখে আমার সামনে সোফার ওপর আরাম করে বসলেন। বললেন, ‘চলবে নাকি?’
আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালুম। বললুম, ‘একা একা রাত কাটাতে হবে ভয় ছিল। আপনাকে পেয়ে যা আনন্দ হয়েছে, তার ওপর ওটা আর চড়াতে চাই না। অতিরিক্ত আনন্দও খারাপ।’
শুনে ভদ্রলোক হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বাঃ, আপনি তো বেশ কথা বলেন। যাহোক, আমাদের পরিচয়টা কিন্তু এখনও হয়নি। আমার নাম, অজিত আচার্য, এলাহাবাদী।’
আমি বললুম, ‘আমার নাম জ্ঞানব্রত রায়। আমি কলকাতায় থাকি।’
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক ভারি খুশি হলেন মনে হল। হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বাঙালি?’
আমি বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি?’
‘আমিও বাঙালি, যদিও আমরা চার পুরুষ এলাহাবাদের বাসিন্দা। আমার ঠাকুর্দার বাবা গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে এলাহাবাদে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু তাই বলে আমরা কিন্তু বাঙালিত্ব ছাড়িনি। আমাদের বাড়িতে বাংলা বইয়ের বিরাট লাইব্রেরি আছে, প্রতি বছর আমরা অনেক টাকার বই কিনে থাকি। বাংলা ভাষার চর্চা রীতিমতো হয়। বাংলা ভাষার হেন বড়ো সাহিত্যিক নেই, যিনি আমাদের বাড়িতে একবার-না-একবার পায়ের ধুলো দেননি। আসলে কী জানেন, হিন্দি উর্দু বলতে আমাদের কোনো কষ্ট হয় না, কিন্তু বাংলায় কথা বলে যে আনন্দ পাই, তার কোনো তুলনা হয় না।’
আমি বললুম, ‘আপনি বাংলার বাইরে থাকেন বলেই বোধ হয় বাংলা ভাষাকে এত ভালোবাসেন। কই, আমরা তো তেমন বাসিনে।’
‘নিশ্চয়ই বাসেন, অবশ্যই বাসেন। বাংলা ভাষাকে ভালো না-বেসে কেউ থাকতে পারে? বিশেষত, বাংলা যার মাতৃভাষা? আমি তো বিদেশে কোনো বাঙালিকে দেখলে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পড়ি। যখন মিলিটারিতে ছিলুম…’
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘আপনি মিলিটারিতে ছিলেন নাকি?’
‘শুধু আমি কেন? আমরা চার পুরুষই মিলিটারি বলতে পারেন। আমার ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন মিলিটারি অ্যাকাউন্টসে। বাদবাকি সবাই মিলিটারিতে লড়াই করেছি।’
‘এতক্ষণে বুঝলুম, আপনার এমন সুন্দর স্বাস্থ্যের কারণটা কী? মিলিটারি ডিসিপ্লিন। আচ্ছা, আপনি কোথায় লড়াই করেছেন?’
‘সে সব কথা বলব আপনাকে। কিন্তু যে কথাটা বলছিলুম সেটা আগে শেষ করে নিই। এই মিলিটারিতে থাকার সূত্রে আমি বহু জায়গায় ঘুরেছি— বর্মা, মালয়, সিঙ্গাপুর, কাশ্মীর, গোয়া, কঙ্গো, সাইপ্রাস। সর্বত্র কী দেখেছি জানেন? দেখেছি, সব জায়গাতেই একটি-না-একটি বাঙালি পরিবার, আর সব জায়গাতেই তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে আমাকে প্রীতির সূত্রে গেঁথেছেন। কারোর কাছ থেকে কখনো আমাকে বিমুখ হয়ে ফিরে আসতে হয়নি।’
‘বলেন কী? কঙ্গো বা সাইপ্রাসেও বাঙালি পরিবার দেখেছেন?’
‘নিশ্চয়ই। কিনসাসায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, নাম প্রদ্যোৎ ঘটক। ইস্টবেঙ্গলের লোক, পাকিস্থান হবার পর ভাসতে ভাসতে ওখানে গিয়ে উঠেছেন। কী করেন তিনি জানেন? রেকর্ড, ম্যাগাজিন আর আইস ক্রিমের একটা দোকান চালান। খুব জোর চলে।’ বলে ভদ্রলোক ঝাঁক বেঁধে একের পর এক তাঁর নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলে যেতে লাগলেন।
রাত যত বাড়তে লাগল তাঁর গল্পগুলোও ততই বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর হতে লাগল। তাদের কতটা সত্যি, কতটা মনগড়া, তা বলার সাধ্য আমার নেই, কিন্তু ভদ্রলোকের গল্প বলার ক্ষমতা এতই চমৎকার যে আমি সেসব চিন্তা না-করেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর গল্প শুনতে লাগলুম।
হঠাৎ গল্প থামিয়ে ভদ্রলোক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওরে সর্বনাশ! এ যে রাত প্রায় একটা! এতক্ষণ বকবক করলুম, থামিয়ে দেবেন তো মশাই! চলুন, চলুন, শুয়ে পড়া যাক। কাল সকালে আবার আমার অনেক কাজ।’ বলে সোফা থেকে উঠে পড়লেন।
আমিও আড়মোড়া ভেঙে উঠতে উঠতে বললুম, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। শুয়ে পড়া যাক।’
বলতে না-বলতেই হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দে বাইরের কোলাপসিবল গেটটা খুলে গেল। আমি ভয়ানক আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলুম, ‘একী? গেটে তো তালা দেওয়া ছিল। খুলল কী করে?’
আচার্যমশাই সহাস্যে বললেন, ‘তালা দিয়ে কেউ কোনোদিন চোর ঠেকাতে পেরেছে? তালা হল গে চোরের প্রতি একটা ক্ষীণ অনুরোধ রে বাবা, এটা আমার ঘর, তুমি এখানে ঢুকো না। নেহাত অলস চোর ছাড়া সে অনুরোধ কেউ রাখে?’
আমি কিছু বলার আগেই দরজায় দড়াম দড়াম করে শব্দ হল। বাইরে মোটা গলায় ধমকের সুরে হিন্দিতে প্রশ্ন হল, ‘ভেতরে কেউ আছে?’
আচার্যমশাই ততোধিক ধমকের সুরে গর্জন করলেন, ‘হ্যাঁ, আছে। তোর বাবা!’
আর তৎক্ষণাৎ বাইরে একটা ভয়ংকর শব্দ হল, সেটা গালাগালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে।
আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে বললুম, ‘করছেন কী? ওরা ডাকাত, ওদের চটাচ্ছেন?’
আচার্য বললেন, ‘আরে, রাখুন মশায় ডাকাত। আমিও ব্রিগেডিয়ার আচারিয়া, ওদের ডাকাতি বের করছি।’
বলতে বলতেই দরজায় একটা প্রচণ্ড লাথি পড়ল, খিলটা মট করে ভেঙে দরজাটা হাট করে খুলে গেল, আর সাক্ষাৎ যমদূতের মতো একটা লোক দু-হাতে একটা রাইফেল ধরে লাফ দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে এল। এই যদি গুলাব রাই হয় তবে একে যে কী অবস্থায় ডাক্তার সরোগি শান্ত আর বিনয়ী দেখেছেন, তা তিনিই জানেন। বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল একটা লাল রুমাল দিয়ে বাঁধা, পরনে খাকি শার্ট আর প্যান্ট, বুকের ওপর আড়াআড়ি বাঁধা গুলির স্ট্র্যাপ, পায়ে রাইডিং বুক, এক মুখ দাড়ি-গোঁফ আর ঘন ভুরুর নীচে একজোড়া নিষ্ঠুর চোখ— এই তার বিনীত চেহারার লক্ষণ।
লোকটি স্পষ্টতই ঘরের মধ্যে একজন লোক আশা করেছিল। আমাদের দু-জনকে দেখে একটু থতমত খেয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ‘ঘরের ভেতরে দুটো লোক আছে রে, বুলকি! তৈরি থাক।’
আচার্য বিদ্রুপের ভঙ্গিতে লোকটার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী, গুলাব রাই, হিরে নিতে এসেছ? তা ওই নিমকহারাম গোয়েলের বাচ্চা হরিরাম তোমাকে সব খবর দিয়েছে, আর আমি যে এখানে আছি, সেটা আর বলেনি বুঝি?’
আমি তো আচার্যের কথা শুনে আর দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত। গুলাবও খানিকটা তাই। তবে তা খুব কম সময়ের জন্যে। চট করে সামলে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কে রে তুই বুড়ো? তুই আছিস তো কী হয়েছে? আগে তো তোকে গুলি করে মারব, তারপর ওই কলকাত্তিয়া বাবুর পেট চিরে হিরে বের করে নিয়ে যাব। কোন শালা ঠেকাতে পারে, দেখি।’
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই আচার্যমশাই আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘হিরে নিবি? তুই? তবেই হয়েছে! বাড়ি গিয়ে মার কোলে শুয়ে পড়, আর তোর বাপকে পাঠিয়ে দে তবে যদি কিছু হয়। ও, তোর তো আবার বাপের ঠিক নেই।’
বলতেই গুলাব রাই উন্মত্ত ক্রোধে ফেটে পড়ল যেন। চিৎকার করে বলল, ‘শালা বুড়ো শুয়োর, আজই তোর শেষ দিন!’ বলে বিদ্যুদ্বেগে রাইফেল ওঠাল।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। ব্রিগেডিয়ার আচার্য অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এক ঝটকায় রাইফেলটা গুলাবের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার সেই বিরাট শরীরটা অবলীলক্রমে দু-হাতে মাথার ওপর তুলে দরজার ওপর ছুড়ে মারলেন। ঠিক সেইসময় আর একজন ডাকাত, হয়তো বুলকি, গুলাবের চিৎকার শুনে একটা দেশি পিস্তল হাতে ভেতরে ঢুকছিল; গুলাবের শরীরটা একবস্তা আলুর মতো তার মুখের ওপর গিয়ে পড়ল। সে বেচারী পিস্তল-ফিস্তল ফেলে গাঁক করে একটা শব্দ করে সশব্দে ধরাশায়ী হল। গুলাব পড়ল তার ঘাড়ে। আর ব্রিগেডিয়ার আচার্য একটা চিতা বাঘের মতো লাফ দিয়ে দু-জনের ওপরে গিয়ে পড়লেন।
তখন বাইরে বারান্দায় শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ বেধে গেল। ক-জন ডাকাত যে বাইরে ছিল, তা তখনও জানি না। কিন্তু বোঝা গেল, আচার্যমশাই তাদের কাউকেই বিশেষ সুবিধে করতে দিচ্ছেন না। কারণ নানা রকমের দুমদাম শব্দ এবং আর্তনাদের মধ্যে তাঁর সহর্ষ এবং ছাপার অযোগ্য গালিগালাজ শুনতে পাচ্ছিলুম। কিন্তু আমি যে বাইরে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করব, তার ক্ষমতা আমার তখন ছিল না। আমি খাটের ওপর বসে কেবল থরথর করে কাঁপতে লাগলুম।
কিছুক্ষণ বাদে বাইরে সব শান্ত হয়ে গেল। ব্রিগেডিয়ার সহাস্যে ঘরের মধ্যে ঢুকে যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে বললেন, ‘ব্যস, গুলাব রাইয়ের খেলা শেষ। আর আপনার ভয় নেই।’
কোনো ক্রমে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল, ‘আপনি সব কথাই জানেন? নিশ্চয় ডাক্তার সরোগি আপনাকে পাঠিয়েছেন। আর আমি কিনা ভাবছিলুম যে দরকার হলে আপনাকে সহজেই কায়দা করে ফেলা যাবে।’
শুনে ভদ্রলোক হা হা করে উঠলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি সবকথাই জানি। আর আমাকে কায়দা করা অত্যন্ত কঠিন, রায় মশাই। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে ব্রিটিশ আর্মির কাছে কমান্ডো ট্রেনিং নিতে হয়েছিল আমাকে। আর পরে আমায় ইন্সট্রাক্টররাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছিল।’
আমি কোনোরকমে মুখে হাসি এনে বললুম, ‘তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আপনার লাগেনি তো?’
‘আরে, না, না। এরা তো সব ছেলেমানুষ। আমার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা জাপানিদের সঙ্গে, যারা ক্যারাটে লড়াইয়ে ভুবন বিখ্যাত।’
আমি হাতজোড় করে বললুম, ‘কী উপকার যে আমার করলেন। আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন। কী করে এ দেনা শোধ করব, জানি না।’
একটা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘এটা একটা কোনো দেনাই নয়, রায় মশাই। বিদেশে বাঙালি যদি বাঙালিকে না-দেখে তো, কে দেখবে বলুন? আমি যা করেছি— এটাই তো আমার কর্তব্য ছিল, তাই না? থাক, আর কথা বাড়াবেন না, এবার শুয়ে পড়ুন।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কিন্তু ওরা? মানে, ডাকাতগুলো তারা কোথায় গেল?’
ব্রিগেডিয়ার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে পড়ে আছে সব ক-টা। কাল সকালের আগে জ্ঞান ফিরবে না। অতএব চিন্তার কোনো কারণ নেই, আপনি শুয়ে পড়ুন।’ বলে ভদ্রলোক ভেতরে শোবার ঘরে চলে গেলেন।
একটু পরেই বাইরে লোকজনের উত্তেজিত গলার আওয়াজ পেলুম। ডাক্তার সরোগি আমার নাম ধরে ডাকছেন, তাও শুনতে পেলুম। আমি তাড়াতাড়ি বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলুম। দেখি, পাঁচটা ষণ্ডামার্কা লোক বিভিন্ন ভঙ্গিতে দুমড়ে মুচড়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে!
ডাক্তার সরোগি যে কখন বন্দুক বগলে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, বুঝতেই পারিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘এ কী কাণ্ড মিস্টার রায়! এ যে গুলাবের দল! এসব আপনি করেছেন?’
আমি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘আমি? না, না, আমি করব কেন? করেছেন ব্রিগেডিয়ার আচার্য। তাকে তো আপনিই পাঠিয়েছেন, তাই না?’
ডাক্তার সরোগি কিছুক্ষণ বোবা দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ‘ব্রিগেডিয়ার আচার্য! উনি এ বাড়িতে ছিলেন বটে, কিন্তু গতকাল রাত্রে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এসব উনি করেছেন, আপনি নিজের চোখে দেখেছেন।’
আমি যেন আচার্য মশাইয়ের প্রসন্ন, নির্মল হাসিটি মনের মধ্যে শুনতে পেলুম। ঘাড় নেড়ে বললুম, ‘না, বোধ হয় বুঝতে ভুল হয়েছিল।’
এমন সময় হরিরাম ছুটতে ছুটতে এল। বলল, ‘মিসেস উমা আচার্য এইমাত্র মারা গেলেন। ডাক্তারসাহেব, আপনাকে এখনই একবার হাসপাতালে যেতে হবে।’