পোকা
দুপুর বেলা কল্যাণী থেকে তাঁর ছোট্ট ফিয়াট গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিলেন ড. সুরেশ্বর দেবগুপ্ত। এখন বিকেল হয়ে এসেছে। নশীগঞ্জে পৌঁছতে আরও দশ-পনেরো মিনিট লাগবে। রাস্তার যা অবস্থা তাতে কপাল ভালো থাকলে, যাকে বলে, প্রশস্ত দিবালোকে পৌঁছনো সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে, আলো কম হলেও কোনো অসুবিধে নেই। সঙ্গে টর্চ তো আছেই।
ড. সুরেশ্বর দেবগুপ্তকে এ তল্লাটে সকলেই চেনে। তিনি একজন নামজাদা কৃষিবিজ্ঞানী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে ডিএসসি করেন। ওদেশে দীর্ঘদিন অধ্যাপনাও করেছেন। আপাতত, তিনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বিভাগের প্রধান।
তবে এ ছাড়াও তাঁর সমাজসেবী বলে আর একটা পরিচয় আছে। চাষের জমির উর্বরতা বা উৎপাদনক্ষমতা কী করে বাড়ানো যেতে পারে, তা নিয়ে নদীয়া জেলার চাষিদের তিনি সবসময় উপদেশ দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। দূর দূর গ্রামের ভেতর চলে গিয়ে সকলকে একত্রিত করে আর তাদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের সমস্যা সমাধান করবার জন্যে তিনি বছরের সব সময়েই তৈরি। এই কারণে, এই পণ্ডিত মানুষটিকে সকলেই শ্রদ্ধা করে থাকে।
আপাতত ড. দেবগুপ্ত একটা গভীর সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে আছেন। সমস্যাটা একটা পোকা। মাজরা পোকার মতো এটা ফসলের ভয়ংকর ক্ষতি করে থাকে। তবে অনেক বেশি তাড়াতাড়ি। খুব ছোটো ছোটো কালো পোকা, বছর দুয়েক হল এদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। এদের প্রথম দেখা যায় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কতগুলো দ্বীপে। তারা যে কোত্থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তা কেউ জানে না। এক বছরের মধ্যে সবুজ দ্বীপগুলো মরুভূমিতে পরিণত হয়। তারপর সেখান থেকে তারা আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা যেখানেই দেখা দিয়েছে, সেখানেই শুধু ফসল নয়, গাছপালা, ঘাস— এককথায় যা কিছু সবুজ সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ধনী দরিদ্র কোনো দেশই রেহাই পাচ্ছে না। কোথাও কোথাও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। ভারতবর্ষে এদের প্রথম দেখা যায় পাঞ্জাবে। তারপর বিহার। এবার নদীয়ার নশীগঞ্জের সুভাষ মণ্ডলের ধান খেতে সম্ভবত তারাই এসে গেছে।
মজা হচ্ছে, এই পোকাগুলোর এখনও কোনো নাম দিয়ে উঠতে পারেনি বৈজ্ঞানিকরা। তার কারণ, অনেক চেষ্টা করেও এই পোকাগুলোর একটাকেও মারা তো দূরস্থান, ধরাই যায়নি আজ পর্যন্ত। অদ্ভুত এদের ক্ষমতা। কোনো কীটনাশক ওষুধে এদের মারা যায় না, তা সে ওষুধ যত বিষাক্তই হোক না-কেন। এদের ফুটদশেকের মধ্যে কোনো মানুষ এলেই এরা চোখের নিমেষে মাটিতে পড়ে এত নীচে চলে যায় যে আর ধরা যায় না। টবে লাগানো গাছে এরা আসে না। রোবোট পাঠিয়েও কোনো লাভ হয়নি। হয়তো সেই যন্ত্রগুলোর মধ্যে কিছু না-কিছু মানুষের গন্ধ থেকেই যায়। একমাত্র দূর থেকে টেলিফোটো লেন্সে এদের ছবি তোলা গেছে। সেই ছবিগুলো থেকে এটুকু বোঝা গেছে যে তারা অপার্থিব নয়। এ ধরনের অন্যান্য পোকাদের সঙ্গে তাদের সামান্য হলেও মিল আছে। সুভাষ মণ্ডল আর নশীগঞ্জের চাষিরা এদের নাম দিয়েছেন— কালোজিরে।
নশীগঞ্জে পৌঁছে ড. দেবগুপ্ত দেখলেন যে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে বহু লোক রাস্তার দু-ধারে অপেক্ষা করছে। তারা সবাই তাঁকে পঞ্চায়েত অফিসে নিয়ে গেল। অফিস ঘরে সবার জায়গা হল না। কাজেই সকলে বারান্দায় আর তার সামনে মাঠের ওপর দাঁড়াল। সবাই নিশ্চুপ। এতগুলো মানুষ, অথচ কোনো গোলমাল নেই। শুধু কয়েক জন নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সবাইকে চিন্তিত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
ড. দেবগুপ্তর জন্যে একটা চেয়ার এনে বারান্দায় রাখা হল বটে, কিন্তু তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন।
সুভাষ মণ্ডল বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, এঁরা সকলেই চাষি, আশেপাশের দশটা গ্রাম থেকে এসেছেন। এঁরাও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমাদের গ্রামের চাষিদের যে সর্বনাশ হচ্ছে, তার হাত থেকে বোধ হয় এঁরাও রক্ষে পাবেন না। তাই আমরা সবাই আপনার সঙ্গে কথা বলে এই ভীষণ বিপদ থেকে কীভাবে বাঁচতে পারব, সেটা জানতে চাই।’
ড. দেবগুপ্ত বললেন, ‘আগে আপনাদের এই গ্রামের অভিজ্ঞতার কথা শুনি। একটু জোরে বলবেন যাতে ওঁরা সবাই শুনতে পান।’
সুভাষ মণ্ডল বললেন, ‘আপনি তো জানেন ডাক্তারবাবু যে আমাদের খেতে কালোজিরে ধরেছে। এই পোকা যে কী ভয়ংকর তা বলে বোঝানো যাবে না। আপনি এখানে আসবার পথে তো দেখেছেন যে মাত্র দিন দশেকের মধ্যে খেতের পর খেত কীভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলন্ত ধানগাছগুলো মরে গিয়েছে। খেতের ধারে যত গাছ ছিল, সেগুলোর শুধু পোড়াকাঠের মতো কাণ্ডটুকু দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তো আজ না-খেয়ে শুকিয়ে মরবার রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের উদ্ধারের বোধ হয় আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু যাদের খেতে এখনও এই পোকা লাগেনি, তাদের বাঁচাবার কি কোনো ব্যবস্থাই করা যায় না?
ড. দেবগুপ্ত বললেন, ‘পোকাগুলো কোথা থেকে এল জানেন?’
—’না ডাক্তারবাবু, জানি না।’
—’পোকাগুলো মারবার কি কোনো চেষ্টা হয়েছে?’
—’হ্যাঁ, হয়েছে। বাজারে যত পোকা মারার ওষুধ পাওয়া যায়, সে সব ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি।’
—’পোকাগুলো কি ওড়ে, না মাটির ওপর দিয়ে চলে?’
—’যতদূর মনে হয়, এগুলো ওড়ে না। মাটির তলা দিয়ে চলে। প্রথম আমার খেতে লেগেছিল একধারে। তারপরে ভেতরে ছড়িয়েছে। সেখান থেকে আমার পাশে বংশীবদনের খেতে আমার খেতের দিক থেকেই পোকা ধরল, পরে ভেতর দিকে গেল। পোকাগুলো যদি উড়ত তাহলে এরকম হত না।’
—’পোকাগুলো আপনারা দেখেছেন?’
—’দেখেছি। বেশ কিছুটা দূর থেকে, হ্যাজাকের আলোয়। গাছের গায়ে কালো কালো দাগ। সেগুলো নড়েচড়ে, কখনো বাড়ে, কখনো কমে। আসলে ওই দাগগুলো একটা নয়, অজস্র পোকার পিণ্ড। তারা যে কী তাড়াতাড়ি গাছের সবুজ অংশটা খেয়ে ফেলে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
ড. দেবগুপ্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনারা বুঝতেই পারছেন যে শুধু আপনারা নন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আজ ভীষণ বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এইভাবে চলতে থাকলে, আর কয়েক বছরের মধ্যেই সর্বত্র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। বিদেশে টবে ধানগম লাগিয়ে কিছু সুরাহার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সে আর কতটুকু? সমস্ত সবুজ খুইয়ে সারা পৃথিবী যদি মরুভূমি হয়ে যায়, তখন টবের ধানগমে কতজনকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে? এর থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা হল পোকাগুলোকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়া। এরজন্যে, যেভাবেই হোক, কয়েকটা পোকা আমাদের ধরতেই হবে। নইলে গবেষণা করে এদের মারণাস্ত্র বের করা যাবে না। আমি জানি, এদের ধরা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে আপনাদের। কীভাবে করবেন, আমি জানি না। তবে করতে পারবেন আপনারাই যাঁরা মাটির কাছাকাছি আছেন। না করলে, আমরা সকলেই শেষ হয়ে যাব। আজ নয়তো কাল। বলুন, আপনাদের কোনো প্রশ্ন আছে?’
চুপ করলেন ড. দেবগুপ্ত। যত লোক জমায়েত হয়েছিল, তাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। একটু পরে ড. দেবগুপ্ত বললেন, ‘আপনারা আজ থেকেই কাজে লেগে যান। চেষ্টা শুরু করলে একটা না-একটা রাস্তা ঠিক বেরিয়ে আসবে। শুনেছি, রাত গভীর না-হলে পোকাগুলো বেরয় না। কাজেই এখন কিছু সময় আছে আমাদের হাতে। আমি এখানে সারারাত থাকব। কাল সকালে আপনারা কতটা সফল হলেন বা কার কী প্রস্তাব আছে এ ব্যাপারে, আমাকে জানাবেন। মনে রাখবেন, একটা পোকা। একটা পোকা পেলেও আমার চলবে। তাহলেই তাদের মারবার উপায় বের করতে পারব।
পঞ্চায়েত প্রধান আর অন্যান্য গণ্যমান্য গ্রামবাসীরা ড. দেবগুপ্তকে অনেক অনুরোধ করলেন তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে আর কিছু খেয়ে নিতে। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। সবাইকে বললেন, বাড়ি থেকে চলে যেতে কারণ তাঁর কিছুক্ষণ একা থাকার দরকার ছিল। আর বললেন, কাজ শুরু করবার আগে রাত ন-টায় সকলে যেন পঞ্চায়েত অফিসের সামনে জমায়েত হন।
সবাই চলে গেলে পঞ্চায়েত অফিসের বারান্দার আলোর নীচে চেয়ার টেনে বসে চিন্তা করতে লাগলেন ড. দেবগুপ্ত। সত্যিই কি কোনো রাস্তা পাওয়া যাবে? পৃথিবী থেকে মানুষকে অবশ্যম্ভাবী বিলুপ্তি থেকে বাঁচান কি সম্ভব? ড. দেবগুপ্ত সাধারণত আশাবাদী কিন্তু আজ যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছেন তাতে আশা করাটা নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো আলো দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ, তাঁর বার বার মনে হচ্ছিল যে, এই সমস্যার সমাধান আছে। কিন্তু, সোজা রাস্তায় এই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
তবে, আশা ছাড়লে চলবে না। কত আবিষ্কার যেগুলো মানুষের অসীম মঙ্গল করেছে তাদের অনেকগুলোই তো ঘটেছে অবিশ্বাস্য অপ্রত্যাশিত যোগাযোগের ফলে। সেসব যোগাযোগকে বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এক্ষেত্রে কি সেরকম কিছু ঘটবে না?
যে স্যাকারিন অসংখ্য ডায়াবেটিক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে সেটা তো আবিষ্কৃত হয়েছি অদ্ভুতভাবে। এর আবিষ্কর্তা ১৮৭৯ সালে কোলটার নিয়ে গবেষণা করতে করতে একদিন ভুল করে হাত না ধুয়ে খেতে বসেছিলেন। খেতে গিয়ে দেখলেন যে সব খাবারই মিষ্টি লাগছে। তার কারণ খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কৃত হল স্যাকারিন। পেসমেকার কত যে হৃদরুগিকে নতুন জীবন দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ আমেরিকান গবেষক গ্রেটব্যাচ একটা বাক্স থেকে যদি একটা ভুল রেসিস্টার না-তুলতেন, তাহলে হয়তো পেসমেকার আজও অনাবিষ্কৃতই থেকে যেত। আর পেনিসিলিনের কথা তো সবাই জানে। খোলা জানলা দিয়ে উড়ে আসা একটা সামান্য ছত্রাক ড. আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংকে দিয়ে গেল এমন একটি ওষুধের সন্ধান যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ তরুণ সৈনিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল সেপটিসিমিয়া থেকে।
ভাবতে ভাবতে ড. দেবগুপ্তর মনে হল তাঁর এরকম চিন্তা করা ঠিক নয়। যে ঘটনাগুলোর কথা তাঁর মনে আসছিল, সেগুলো নেহাতই দুর্ঘটনা। তিনি যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক অথচ তিনি বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর না-করে অনৈসর্গিক বা অলৌকিক পথে সমাধান খুঁজছেন! আমাদের শাস্ত্রে বলে, সর্বনাশ সমুৎপন্ন বলে পণ্ডিত ব্যক্তি অর্ধেক বিজ্ঞান ত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু তিনি তো বিজ্ঞানকে পুরোপুরি ত্যাগ করবার কথা ভাবছেন। এ তো একটা চূড়ান্ত অধঃপতন। অথচ, যা পরিস্থিতি, তাতে এরকম একটা ঘটনা ছাড়া মানুষ যে ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগোচ্ছে তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কি? বৈজ্ঞানিকভাবে উদ্ধারের রাস্তা খুঁজে পেতে বোধ হয় অনেক সময় লাগবে। অত সময় পাওয়া যাবে তো?
ড. দেবগুপ্ত কিন্তু একাগ্রচিত্তে চিন্তা করতে পারছিলেন না। চিন্তা করবার কি উপায় আছে? সন্ধে হতে না-হতেই চারদিকের অন্ধকার থেকে উড়ে আসা অসংখ্য পোকা তাঁকে উত্যক্ত করে মারছিল। কিন্তু, বারান্দার আলোটা যে নিভিয়ে দেবেন তারও উপায় নেই। কারণ আলোর সুইচটা পঞ্চায়েত অফিসের ভেতরে আর তার দরজায় তালা দেওয়া। কত রকমের পোকা যে তাঁর গায়ে-হাতে-মুখে-মাথায় এসে পড়ছিল তার ইয়ত্তা নেই। ছোটো ছোটো ঘেসো মশা থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো গুবরে পোকা পর্যন্ত। শেষপর্যন্ত আর সহ্য করতে না-পেরে ড. দেবগুপ্ত গ্রামের বাইরে স্টেট হাইওয়ের ওপর রাখা তাঁর গাড়িতে গিয়ে বসবেন স্থির করলেন।
এইসময়ে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।
একটা পোকা অনেকক্ষণ ধরে ড. দেবগুপ্তের মাথার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল। পোকাটা একটু অদ্ভুত। সেটা একটা বেশ বড়োসড়ো গঙ্গাফড়িঙের মতো। বড়ো দুটো ডানা যেন চকচকে রুপোলি মাকড়শার জাল দিয়ে তৈরি। তার শরীরটা ধূসর বা কালো বা সবুজ নয়, লাল। তার ওড়বার ভঙ্গিটি ভারি সুন্দর, হালকা হাওয়ায় উড়ে যাওয়া ফুলের পাপড়ির মতো সুললিত আর সুষম। অন্য পোকাদের জ্বালাতনে সেটাকে যে ভালো করে দেখবেন, তা আর হয়ে ওঠেনি।
ড. দেবগুপ্ত যেই উঠতে যাবেন, এই পোকাটা একটা বঙ্কিম রেখায় উড়ে এসে তাঁর চেয়ারের হাতলের ওপরে বসল। ড. দেবগুপ্ত ভালো করে তাকিয়ে যা দেখলেন তাতে তাঁর মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল। কালোজিরের কথাটাই আর মনে রইল না।
তিনি দেখলেন যে পোকাটার ছ-টা পায়ের জায়গায় চারটে, যেন দুটো হাত আর দুটো পা। আর তার ইঞ্চি তিনেক শরীরটা ঠিক একটা লাল শাড়ি পরা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের মতো। পোকাটা দু-দিকে ডানা ছড়িয়ে দু-পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে।
ড. দেবগুপ্তর প্রথমেই মনে হল, আরে এটা যে একটা পরি। তাহলে কি তিনি স্বপ্ন দেখছেন? কারণ আজকের বিজ্ঞানের যুগে পরি বলে তো কিছু থাকতেই পারে না। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের রূপকথাতেই এদের কথা আছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে তারা যে কাল্পনিক নয় সেটা মনে করবার তো কারণ নেই। কিন্তু তার পরেই তাঁর মনে পড়ল যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল একসময়ে তাঁর বাগানে বক্সক্যামেরায় পরিদের ছবি তুলেছিলেন। সেটা সবাই হেসে উড়িয়ে দিলেও কোডাক কোম্পানি কিন্তু অনেক পরীক্ষার পর সেই ছবিগুলো জাল নয় বলে রিপোর্ট দিয়েছিল। তা ছাড়া, স্যার আর্থারের মতো মানুষের কতগুলো জাল ছবি দেখিয়ে লোককে বোকা বানানোর মনোবৃত্তি থাকার কথাও নয়। তবে কি তিনি জেগেই আছেন আর যা দেখছেন তা সত্যি? তা হতে পারে না। এটা আসলে একটা দুর্লভ বিরল জাতের পোকা, বিজ্ঞানীরা এখনও এর খোঁজ পাননি। বোধ হয়, এই পোকাগুলো দেখেই পরিদের কল্পনা করা হয়েছিল।
ড. দেবগুপ্তর চিন্তায় বাধা পড়ল। তাঁর মনে হল, সরু রিনরিনে গলায় পোকাটা যেন তাঁকে বলছে, ‘অত কী ভাবছ? এখন তো তোমার শুধু কালোজিরে নিয়ে ভাবা উচিত। আর কয়েক বছরের মধ্যেই তো সমস্ত পৃথিবীটা মরুভূমি হয়ে যাবে। গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তখন কোনো কিছু বেঁচে থাকতে পারবে? মানুষ তো যাবেই, সমস্ত জীবজন্তু, পোকামাকড় কিচ্ছু বেঁচে থাকবে না। হ্যাঁ, সমুদ্রের তলায় প্রাণ হয়তো থাকবে কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীটা শ্মশান হয়ে যাবে। আজ এই যে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তোমরা সৃষ্টি করেছ, তার হাত থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খোঁজা ছাড়া অন্য চিন্তা করবার কোনো দরকার আছে কি?’
অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে ড. দেবগুপ্ত বললেন, ‘এই দুস্বপ্ন আমরা সৃষ্টি করেছি? সে আবার কী?’
‘তা নয়তো কী? প্রশান্ত মহাসাগরের বিকিনি দ্বীপে একের পর এক যে হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়েছ তোমরা, তার পারমাণবিক বিকিরণের ফলে ওই দ্বীপের নিতান্ত নিরীহ একশ্রেণির পোকার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত জৈবিক পরিবর্তন হয়ে এই ভয়ংকর কালোজিরের সৃষ্টি হয়েছে। ওই দ্বীপে তো কোনো কিছুই টিঁকে ছিল না। কাজেই খাবারের খোঁজে সমুদ্রের জলে ভেসে ভেসে এরা আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এই দুঃস্বপ্নকে তোমরা তৈরি করেছ, এখন এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে আর এই সবুজ গ্রহটাকে বাঁচাতে গেলে তোমাদেরই এদের ধ্বংস করতে হবে।
‘কিন্তু করব কী করে? এদের তো ধরাই অসম্ভব। এদের ধরতে পারলে তবে না এদের ধ্বংস করার উপায় বের করা যাবে? কিন্তু, যা মনে হচ্ছে তাতে তো মানুষ তার কোনো যন্ত্রপাতি দিয়েই এদের ধরতে পারবে না।’
‘না, তা পারবে না। তবে, যদি এদের ধরতে পারা যায়, এদের নির্মূল করবার পদ্ধতি তোমরা বের করতে পারবে তো ঠিক? সেই প্রযুক্তি তোমাদের এখানে আছে? এদের যদি আবার বিদেশে পাঠাতে যাও, তাহলে কিন্তু সব বৃথা হবে। কারণ, এদের এক-একটা দু থেকে তিনদিনের বেশি বাঁচে না আর তার মধ্যেই প্রবলবেগে বংশবৃদ্ধি করে যায়।’
‘তবে কি একটা মরা কালোজিরেও পাওয়া যাবে না?’
‘না, সেটাও সম্ভব নয়। কারণ একটা মরলেই অন্যগুলো সঙ্গেসঙ্গে সেটাকে খেয়ে ফ্যালে। তাহলে বলো, এখানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবে?’
ড. দেবগুপ্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘নিশ্চয়ই পারব। আমাদের ল্যাবরেটরিতে সবাই তৈরি হয়ে রয়েছে।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আমরা তোমাদের সাহায্য করব। পৃথিবী থেকে সবুজ চলে গেলে তোমরা তো বাঁচবেই না, আমরাও বাঁচব না। কাজেই প্রাণের দায়ে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা তোমাকে কালোজিরে ধরে দেব।’
‘ধরবে কী করে? ওদের কাছাকাছি গেলেই যে ওরা মাটির নীচে লুকিয়ে পড়ে।’
‘সেটা মানুষ গেলে। আমরা তো মানুষ নই, ওদের মতো পোকাই। আমাদের ওরা ধর্তব্য বলে মনে করে না। আর একটা কথা বলে রাখি। আমরা দেখেছি, যা কিছু আমাদের কাছে প্রাণঘাতি বিষ, তাতে ওদের কিছুই হয় না; উলটে ওদের শক্তি বেড়ে যায়। আর যা কিছু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য, যেমন সূর্যের আলো, অক্সিজেন বা ভিটামিন, সে সব ওরা সহ্য করতে পারে না।’
বলেই সেই অদ্ভুতদর্শন পোকাটা একটা আশ্চর্যসুন্দর বক্ররেখায় উড়ে বাইরে অন্ধকারের মধ্যে চলে গেল।
অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন ড. দেবগুপ্ত, তারপর যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। তাঁর মনে হল যে, যা দেখেছেন সেটা যতই স্পষ্ট হোক না-কেন, স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। তবে, কি তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন? এরকম অলীক চিন্তা তো তাঁর মতো বৈজ্ঞানিকের মনে আসা উচিত নয়।
হঠাৎ একটি বাচ্চার গলা শুনে সোজা হয়ে বসলেন ড. দেবগুপ্ত। দেখলেন, আধময়লা ছিটের ফ্রক আর পুরোনো লালরঙের একটা গরমজামা পরা একটি মেয়ে বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে একগাল হেসে বলল, ‘ডাক্তার দাদু, তোমার নস্যির কৌটোটা যে মাটিতে পড়ে গেছে গো।’
বলে সে একটা কাচের ছোটো শিশি ড. দেবগুপ্তর দিকে এগিয়ে দিল। পরিষ্কার শিশিটা, তার ভেতরে আধখানা ভরে রয়েছে কালো কালো গুঁড়ো গুঁড়ো মতন কিছু। কম্পিত হাতে শিশিটা নিলেন ড. দেবগুপ্ত। চোখের সামনে তুলে দেখলেন গুঁড়োগুলো জীবন্ত। তারা শিশিটার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে, পরস্পর ঠেলাঠেলি করছে।
রাত দশটার সময় গ্রামের লোকেরা পঞ্চায়েত অফিসের সামনে এসে দেখল, বারান্দায় চেয়ারটা খালি পড়ে রয়েছে। ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলল, ‘ডাক্তারবাবুর গাড়িটাও তো দেখছি না।’
আর একজন বলল, ‘আসবার সময় যেন ডাক্তারবাবুর গাড়িটা দেখলুম। খুব জোরে হুশ করে বেরিয়ে গেল।’