ভূত ভবিষ্যৎ
আমাদের পাড়ায় বাড়ি করা ইস্তক নিয়মিত আমাদের ক্লাবে আসেন এককালে এম পি আর বিখ্যাত উকিল চিত্তপ্রসাদ রায়। খিটখিটে বুড়ো, সারাজীবন রাজনীতি করে আর চোর-জোচ্চর ঘেঁটে ঘেঁটে মনে হয় সারা পৃথিবীটার ওপরেই হাড়ে হাড়ে চটে আছেন। কথাবার্তা প্রায় বলেনই না। সন্ধে বেলা এসে আর এক বুড়ো, ডাক্তার চন্দ্রমাধব চৌধুরির সঙ্গে দাবা খেলেন আর আমরা বেশি হইহল্লা করলে অত্যন্ত বিরক্ত চোখ করে তাকিয়ে থাকেন।
আমার বড়োমামাও উকিল। একদিন আমার কাছে আমাদের ক্লাবের গল্প শুনতে শুনতে চিত্তপ্রসাদ রায়ের নাম করতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘চিত্ত উকিল তোদের ক্লাবে যান আর তোরা তাঁর জীবনের গল্পগুলো শুনিসনি এখনও? কী গাধা রে তোরা! উনি তো এখনও বার লাইব্রেরিতে গেলে সবাই আমরা সব কাজ ফেলে ওঁকে ধরি গল্প বলার জন্য।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কিন্তু আমরা তো জানি বুড়ো ভয়ানক খিটখিটে। কথাই বলেন না প্রায়।’
বড়োমামা বললেন, ‘খিটখিটে তো বটেই। কিন্তু ভালো করে যদি চেপে ধরিস, দেখবি কীসব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ওর জীবনে ঘটেছে। সেগুলো সত্যি কী মিথ্যে জানি না, কিন্তু শুনতে বড়ো মজা লাগে।’
ভালো কথা। পরদিনই রায়মশাইকে চেপে ধরা হল। প্রথমটা দাবা খেলায় বাধা পড়ায় চটে গিয়েছিলেন খুব, কিন্তু পরে রাজি হলেন।
বললেন, ‘কীসের গল্প আপনারা শুনতে চান?’ উনি আমাদের সবাইকেই আপনি করে সম্বোধন করতেন।
আমরা সমস্বরে বললুম, ‘ভূতের।’
উনি বললেন, ‘বেশ। ভূতের গল্পই বলছি—’
অনেক দিন আগে, তা প্রায় পঞ্চাশ বছর তো হবেই, আমার সঙ্গে একটি ভূতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আজ্ঞে না, আমি গাঁজা খাই নে, তবে হ্যাঁ, আমার অভিজ্ঞতার কথাটা এতদিন কাউকেই বলে উঠতে পারিনি বটে। যদিও সাহস করে তখন বলে উঠতে পারলে আর সকলে সে কথাটা বিশ্বাস করলে, এ নিয়ে যে মহাহাঙ্গামা হয়েছিল সেসব কিছুই হত না। কিন্তু বলতে পারিনি, কারণ আমি ভালো করেই জানতুম যে আমার কথা কস্মিনকালেও কেউ বিশ্বাস করবে না, লালমুখো ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তো না-ই। সে যুগে আমরা ভূতকে ভয় পেতুম না, যত-না পেতুম এইসব মহাপ্রভুদের। কাজেই চুপ করে ছিলুম।
তাহলে সে গল্প আজকে বলছি কেন? এ গল্প তো সেদিনও কেউ বিশ্বাস করত না, আজও কেউ করবে না। কিন্তু এর মধ্যে একটা তফাত আছে। আজ আমার কোনো কথাই কেউ বিশ্বাস করে না, বুড়োর মাথায় ভীমরতি হয়েছে বলে উড়িয়ে দেয়। এই তো সেদিন বড়ো ছেলেরে বউকে বললুম, ‘বউমা, এই যে হরদম সিনেমা দেখে আর হোটেলে খেয়ে খোকার পয়সার শ্রাদ্ধ করছ, তা না-করে এবার কিছু কিছু জমাতে আরম্ভ করো! ওই তো তিনটে রক্ষেকালীর মতো মেয়ে, সকলেই তো বাপের রূপ আর তোমার গুণ পেয়েছেন। ওদের বিয়ে দিতে যে ভিটেমাটি বন্ধক দিতে হবে— সে কথাটা ভেবে দেখেছ?’ বলতেই সে কী হুলুস্থুল বেধে গেল। পাশের ঘর থেকে শুনলুম আমার শ্রীমান বলছেন, ‘আহা, অত আপসেট হওয়ার কী হয়েছে! বাবার ভীমরতি হয়েছে বই তো নয়! না-হলে নিজের অমন ফুটফুটে নাতনিদের কেউ অমন কথা বলে?’ অর্থাৎ বাপের সুপুত্তুর আমার শ্রীমাই যখন সত্যি কথা বললে মেনে নেয় না, তখন আর অন্যে পরে কা কথা? কাজেই এখন আর ভয় পাইনে, যা বলব নির্ভয়ে বলব।
বলছিলুম, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমার সঙ্গে একটি ভূতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেটা ছিল কার্তিক মাস, সন্ধের দিকে ঘোর-ঘোর করে এসেছে, এমনি সময় ঠাকুরগঞ্জের বড়ো হাটের একটা চায়ের দোকানে— না, না, আমরা দু-জনে যে সেখানে চা খেতে ঢুকেছিলুম, তা নয়। ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলি।
আমার তখন বছর চব্বিশ বয়েস। কলকাতা থেকে ওকালতি পাশ করে আমাদের গ্রাম দুসুতিতে এসে বসেছি। সকাল বেলা বারো মাইল দূরে জেলাসদর মাখলাগঞ্জে যাই, জজ কোর্টের বাইরে গাছতলায় বসে বসে মাছি তাড়াই। সন্ধে বেলা ফিরে এসে বাপের হোটেল। দু-একটা যা কেস আসে, তাই নিয়েই সারদিন মেতে থাকি।
আর করি কংগ্রেস। দেশের দুঃখদুর্দশা তখন মনকে বড়োই পীড়া দিতে শুরু করেছে, চিত্তে আর সুখ নেই। কাগজে কাগজে সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা লিখি, কেউ ছাপে, কেউ ছাপে না। মোটামুটি নিস্তরঙ্গ জীবন, তবে মনে সব সময়েই আশা, কিছু একটা ঘটবে, এমন একটা কিছু যা জীবনটাকে উলটোপালটা করে দেবে।
সেইটেই ঘটে গেল সেই কার্তিক মাসে, ঠাকুরগঞ্জের বড়ো হাটে। সেই ভূতের সঙ্গে যদি দেখাটা না-হত, তাহলে আজ আমার কী অবস্থা হত, কে জানে।
যার ভূত, সে-ও বোধ হয় বুঝতে পারেনি যে ব্যাপারটা এরকম ঘটবে। বুঝতে পারলে হয়তো অন্যরকম ব্যবহার করত। তবে সে বেচারি বুঝবেই বা কোত্থেকে? সে তো ভূত, ভবিষ্যতের কথা তার জানার কথা নয়।
আসলে, তার সঙ্গে তো আমার শত্রুতা ছিল না, বরং আমি তার মানে তার ইহলোকের আত্মীয়দের উপকারই করতে গিয়েছিলুম। আর সেকথা যে সে জানত না, তাও নয়।
সে লোকটা যখন বেঁচেছিল, তখন তার সঙ্গে আমার বেশ ভাবই ছিল। লোকটার চেহারা ছিল দশাশই, মাথায় ঝাঁকড়াঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো দিনে-রাতে ভগবান জানেন কীসের ঘোরে লাল হয়েই থাকত; কুচকুচে কালো মুখে সেই লাল চোখ যেন জ্বলন্ত আগুনের ভাঁটা। ওর আসল নাম ছিল নকুল; কিন্তু সবাই ওকে ডাকত ভীমে বাগদি বলে। কিন্তু মানুষটা ছিল অত্যন্ত নিরীহ, কারোর সাতে-পাঁচে থাকত না। গাঁয়ের শ্মশানের পাশে তার বিঘে দুই জমি ছিল, নেহাত শ্মশানের পাশে বলেই বোধ হয় জমিদারবাবুর সেদিকে হাত পড়েনি, আর তার এক ধারে ছিল তার কুঁড়ে ঘর। ওই জমি থেকে সে যা পেত তাতে তার একার পেটই চলত না তো সংসার। বাকিটা সে এর-ওর মাল বয়ে, জমিদারবাবুর ফাইফরমাশ খেটে ভাগচাষ করে পুষিয়ে নিত।
কিন্তু লোকটার একটা দোষ ছিল। সে সবসময় সত্যি কথা বলত। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করত, আমাদের মতো কাগজে ছদ্মনামে লিখে নয়, চিৎকার করে। সে কারণে সবাই তাকে অল্পবিস্তর সমঝে চলত। জমিদারবাবুর লাঠিয়ালরাও ভীমে বাগদিকে আসতে দেখলে রাস্তা ছেড়ে দিত। ওদের মুখেই শুনেছিলুম যে ভীমে নাকি একাই খালি হাতে পঁচিশটা লোকের মহড়া নিতে পারত। ক্ষ্যাপা মোষ আর ক্ষ্যাপা ভীমে নাকি একই স্তরে ভয়াবহ ব্যাপার ছিল।
ভীমের বউ কিন্তু হিড়িম্বা ছিল না মোটেই। সে ছিল শান্ত, নরমসরম, ভীরু প্রকৃতির মেয়ে। ভীমের সঙ্গে যে তার বয়সের বিরাট তফাত ছিল তা নয়, কিন্তু তাকে দেখাত অনেক কমবয়েসি। সে এত নীচু গলায় কথা বলত যে, মা-মাসিমারা বলতেন, ‘ময়না বউ এত আস্তে কথা বলে যে অনেকসময় বোঝা যায় না সে কথা বলছে না-সুপুরি চিবুচ্ছে।’ দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামীটিকে নিয়ে শান্তিতেই ছিল।
আমার কিন্তু খুব ছোটোবেলা থেকেই কেমন ধারণা ছিল যে ভীম হচ্ছে ডাকাত। পাড়ার সব ছেলেরই বোধ হয় সেরকম ধারণাই ছিল। কাজেই, ভীম যখনই আমাদের বাড়িতে আসত, আমি সুযোগ বুঝে তার কাছে গিয়ে আবদার ধরতুম, ‘ভীমদা, একটা গল্প বলো না। তুমি রণ-পা চড়তে পারো?’ ভীম ইঙ্গিতটা বুঝত। তারপর বানিয়ে বানিয়ে রোমহর্ষক সব ডাকাতির গল্প বলত। গল্পের খোঁজ পেয়ে পাড়ার আরও ছেলেমেয়েরা জুটে যেত। আস্তে আস্তে আমাদের মনে ভীমে বাগদি একজন মহাবীর হিরোয় পরিণত হয়ে গেল।
বড়ো হয়ে যখন বুঝতে শিখলুম যে ভীম আসলে অত্যন্ত সৎ লোক, ডাকাতি তো দূরস্থান, না-খেপলে কোনো মারদাঙ্গার মধ্যেও থাকে না পর্যন্ত, তখন বোধ হয় একটু দুঃখই হয়েছিল। শত হোক একটা হিরো, সে কিনা জমিদারের কথায়ও লাঠি সড়কি ধরে না! কিন্তু তাকে কোনোদিন অশ্রদ্ধা করতে পারিনি। ভীমের এমন একটা ঋজু সারল্য অথচ দৃঢ় চরিত্রবল ছিল যে তাকে ভয় হয়তো আর করিনি, কিন্তু সম্ভ্রম করেছি।
আমার পিতৃদেব ছিলেন ডাক্তার, হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করে বেশ নাম করেছিলেন, ভালো পসার ছিল, অনেক দূরের গ্রাম থেকেও রুগিরা আসত। ফলে, প্রায় সারাবছরই আমাদের বাড়িতে দীয়তাং ভূজ্যতাং লেগেই থাকত। দুঃস্থ, নিরাশ্রয় আত্মীয়স্বজন সবসময় বাড়ি ভরতি থাকত। অনেক সময় তো আমাদেরই বাইরের ঘরে ফরাশ পেতে রাত কাটাতে হত। সেটা যে খুব মন্দ লাগত তা নয়, কিন্তু পড়াশুনোর বেজায় ক্ষতি হত।
তখন আমি একটা উপায় বের করলুম। ছুটিছাটার দিন হলেই বইপত্তর বগলে করে শ্মশানঘাটে চলে যেতুম। সেখানে নির্জন ঘাটে বসে পড়াশুনো করতুম। একেবারে তিনদিনের পড়া হয়ে যেত।
সেইসময় মাঝেমাঝে ভীম এসে আমার কাছে বসত। তখন পাশার দান উলটে গেছে। আমি তখন তাকে নানা দেশবিদেশের কথা, বড়ো বড়ো মনীষীদের কথা বলতুম, সে চুপ করে বসে বসে শুনত আর মাঝে মাঝে বিস্ময়মুগ্ধ চোখ তুলে আমার দিকে তাকাত।
আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলুম, ‘আচ্ছা ভীমদা, তোমার গায়ে এত শক্তি, তুমি সেটাকে কাজে লাগাও না কেন? এই জন না-খেটে তুমি যদি বাবুদের বাড়ি লেঠেলের কাজ নাও, তাহলে তো কত পয়সা রোজগার করতে পারো, জমিজমা করতে পারো। কিন্তু তা করো না কেন?’
ভীম শুনে মৃদু হাসত। বলত, ‘দাদা, জীবনে পয়সা আর জমিজমাই কী সব? আমার যা দরকার সে তো ভগবান জুটিয়েই দেছেন, এর বেশি নিয়ে আমার কী হবে বলো তো? তার চেয়ে এই তো সুখে আছি। আর লেঠেলের চাগরি? সে আমার পক্ষে করা সম্ভবই লয়। বড়ো লোংরা কাজ গো দাদা! তুমি ছেলেমানুষ, জানবে কোত্থেকে। ওরা করে না দুনিয়ার হেন দুষ্কর্ম লেই।’
‘আহা, ওরা তো নিজের ইচ্ছেয় করে না। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। জমিদার বলছে তাই করছে। দুষ্কর্মে পাপ যদি কিছু হয় তো সে জমিদারের, ওদের কী?’
‘দাদা, জমিদার আমার জমির মালিক, সে তো দু-ছটাক মাটি বই লয়। কিন্তু, আমার মালিক অন্য। সে সবার মালিক, জমিদারেরও মালিক। যে জমিদার তার আপন মালিকের কথাই শোনে না, সে জমিদারের কথা আমি শুনব কেনে? অমন জমিদারের চাগরি করতে আমার বয়ে গেছে।’
তা, এমন লোকের সে-যুগে, এবং এ-যুগেও, সমাজে নিশ্চিন্তে বাস করা সম্ভব ছিল না। যে কুসংস্কার আর অশিক্ষার নারকীয় আগুন সমাজকে ঘিরে পরমানন্দে জ্বলছিল, তাকে বুক ফুলিয়ে অমান্য করে গা বাঁচিয়ে থাকতে পারা কি সম্ভব? সে আগুনে হাত পুড়তে বাধ্য। আর হলও ঠিক তাই।
সেই আগুন যে বহন করে এনেছিল, সে দুসুতির জমিদার পঞ্চানন মল্লিকের ছোটোছেলে হরচন্দ্র মল্লিক। হরচন্দ্র আমার চেয়ে ছ-বছরের ছোটো ছিল, কিন্তু দুনিয়াদারিতে আমি ছিলুম তার কাছে শিশু। ষোলো বছর বয়সে তিনি মদ ধরেছিলেন, আঠারো বছর বয়েসে মণ্ডল পাড়ার সতীশখুড়োর কচি নাতবউটাকে ফুসলিয়ে বের করে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলেন। হরচন্দ্রর মা কনকশশী যে কী মন্ত্রে সতীশখুড়োর মুখ বন্ধ করেছিলেন তা জানি না, তবে দু-মাস না-পুরোতেই সতীশখুড়ো আবার ধূমধাম করে নাতির বিয়ে দিলেন, তারপরে আবার হরচন্দ্র গাঁয়ে এসে উদয় হল। এল কিন্তু একাই; সঙ্গে যে মেয়েটি ছিল সারা গাঁ তার কথা একবার মনেও করল না। যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবেই হরচন্দ্র বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আর গাঁ-সুদ্ধ লোক আগুনে পুড়তে পুড়তেও চুপ করে বসে রইল, যেন সর্বস্ব না-পুড়ে যায় সেই আশায়।
ভীম কিন্তু খেপে গিয়েছিল। হরচন্দ্রর কান ধরে উঠোনে দশ পাক দৌড় করানো উচিত, সে-কথা দুমদুম করে গিয়ে বলে এল কনকশশীকে। কনকশশী বললেন, ‘নিশ্চয়ই, দৌড় তো করানোই উচিত। তুই কিছু ভাবিসনি নকুল, আমি ওকে এমন শাস্তি দেব যা ও জীবনেও ভুলতে পারবে না।’ ভীম শুনে খুশি হয়ে ফিরে চলে এল।
কনকশশী যে কী শাস্তি দিয়েছিলেন তা অবশ্য কেউ জানে না, তবে হরচন্দ্র বেশ দাপটের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতে লাগল। কিন্তু হরচন্দ্রের হাসিটা যেন আর আগের মতো লাগছিল না, কোথায় একটা গোলমাল হয়ে গেছে বলে নজরে পড়ছিল। তবে হরচন্দ্র গাঁয়ের কোনো ছেলের সঙ্গেই কথা বলত না আর আমরা সকলেই ওকে এড়িয়ে চলতুম বলে ব্যাপারটা কী হয়েছে তা তখুনি জানা গেল না।
জানা গেল মাসতিনেক বাদে।
সেদিন রাত অনেক হয়েছে। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ। সকলেই শুয়ে পড়েছে, কেবল আমি জেগে জেগে একটা মামলার ব্রিফ তৈরি করছিলুম আর বাবা ভেতরের উঠোনে মোড়া পেতে বসে তামাক খেতে খেতে মার সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় শুনতে পেলুম আমাদের চাকর তুলসী এসে বাবাকে বলছে, ‘জমিদারবাবুর ছোটোছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এয়েচেন।’
বাবার বিস্মিত গলা শুনলুম, ‘জমিদারবাবুর ছেলে? এত রাতে!’ বলে পায়ে খড়ম জোড়া গলিয়ে উঠে গেলেন।
অনেকক্ষণ বাদে খড়মের আওয়াজেই বুঝলম যে বাবা ফিরে এসে আবার মোড়ায় বসলেন।
মা-র গলা পেলুম, ‘কীগো জমিদারবাবুর ছেলে এসেছিল কেন?’
বাবা চুপ।
মা আবার সেই প্রশ্নই করলেন, বাবা তখনও চুপ।
আমি আর থাকতে পারলুম না, জানলা দিয়ে উঁকি মারলুম। হ্যারিকেন লন্ঠনের আলোয় দেখি বাবার মুখ ঘৃণায়, লজ্জায় এবং বোধ হয় বিবমিষায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। কোনো প্রচণ্ড অন্তর্দাহে মুখ দিয়ে আর কোনো কথা সরছে না।
আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। হরচন্দ্র কী খবর নিয়ে এসেছিল? বাবা শান্তিপ্রিয়, ভীরু প্রকৃতির লোক ছিলেন; যেকোনোরকম গোলমাল সযত্নে এড়িয়ে চলতেন। জমিদারের সঙ্গে কাজিয়া করার কথা তো চিন্তাই করতেন না। তাঁকে জমিদারের ছেলে স্বয়ং গভীর রাত্রে এসে কী কথা বলে গেল, যাতে তাঁর মুখের ভাব এমন হতে পারে?
এর উত্তর পেলুম আরও সাতদিন পরে।
সেদিন ভোর বেলা অন্যান্য দিনের মতো সদরে রওনা হয়েছি। গ্রাম ছাড়িয়ে একটুখানি যেতেই দেখি উলটোদিক থেকে একটা ছোটোখাটো শোভাযাত্রা আসছে। রীতিমতো বাদ্যাভাণ্ড সহকারে। দুটো ঢাকি, একটা সানাই বাজানেওয়ালা, একটা কাঁসি আগে আগে, তার পেছনে জমিদারের খাস লেঠেলদের একটা দল আর তাদের মাঝখানে নায়েব দেবনারায়ণ মিত্তির আর একজন দশাশই কাপালিক সন্ন্যাসী। নায়েব দেবনারায়ণকে দেখলে চিরকাল আমার ছুঁচোর কথা মনে পড়ে। বিনয়ে কুঁজো হয়েই আছেন, চিঁচিঁ করে ছাড়া কথা কন না, কিন্তু সুযোগ পেলেই গলায় দাঁত বসাতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই। কিন্তু সন্ন্যাসীকে দেখে মনে হল যেন সাক্ষাৎ যমদূত, ভক্তি হওয়া তো দূরস্থান, এঁকে দেখলে পুলিশ ডাকতে ইচ্ছে করে। এরকম ভয়াবহ, কদর্য, উৎকট চেহারা বড়ো একটা দেখা যায় না।
আমি রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ালুম। ইতিমধ্যে দেবনারায়ণ আমাকে দেখতে পেয়েছেন। এগিয়ে এসে বললেন, ‘এই যে বাবা চিত্তপ্রসাদ, সদরে চললে বুঝি?’
অনাবশ্যক প্রশ্ন। আমি উত্তর না-দিয়ে ঘাড় নাড়লুম।
নায়েবমশাই বলে চলেছেন, ‘বেশ বাবা, এসো গিয়ে। তবে বেশি দেরি করো না যেন। একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
আমি একটু বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘কেন?’
‘বাঃ, আজ যে তোমাদের বাবুর বাড়ির নেমন্তন্ন।’
‘কেন? কীসের নেমন্তন্ন?’
‘বাঃ জানো না বুঝি? হরচন্দ্র বাবাজি যে আজ দীক্ষা নেবেন, তাঁর ধর্মকর্মে মতি হয়েছে। এই তো গুরুদেবকে নিয়ে যাচ্ছি। মস্ত বড়ো তান্ত্রিক সাধু, সম্প্রতি হিমালয় থেকে নেমে এসেছেন।’
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো আমার কাছে সব রহস্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। হরচন্দ্র যে কী সংবাদ নিয়ে এসেছিল এবং কেন বাবার মুখ অমন বিকৃত দেখেছিলুম সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেল। আর সঙ্গেসঙ্গে আমার সর্বাঙ্গ একটা অসহ্য ঘৃণায় কণ্টকিত হয়ে উঠল।
হরচন্দ্র যে সংবাদ নিয়ে এসেছিল, তা তার নিজের রোগের— সে রোগ উপদংশ। আর এ-ও বুঝলুম দীর্ঘস্থায়ী হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসার ওপর নির্ভর না-করে দ্রুত আরোগ্য হওয়ার আশায় সে যে পথ গ্রহণ করতে যাচ্ছে তার চেয়ে জঘন্য নারকীয় পথ আর দ্বিতীয় আছে বলে জানা নেই। সেইজন্যেই এই ধর্মকর্ম, সেইজন্যেই এই তান্ত্রিক বাবাজি।
আসলে, হরচন্দ্র যে পথ নিতে যাচ্ছিল সেটা কোনো একটা চিকিৎসাই নয়, সেটা আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটা বীভৎস কুসংস্কার। সেই কুসংস্কার বলে যে, উপদংশ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যদি কোনো একটি নিষ্পাপ কুমারী মেয়ের সতীত্বনাশ করে তাহলে সে ওই রোগমুক্ত হতে পারে। কিন্তু সেটা ইংরেজ আমল, কথা নেই বার্তা নেই একটি কুমারীকে ধরলেই তো হল না। ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব ব্যাপারটা রোগের চিকিৎসা বলে নাও ধরতে পারেন; তা ছাড়া, লোক জানাজানিরও একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তার বদলে যদি ধর্মের ভেক নিয়ে তার আড়ালে এই কুৎসিত অভিচার করা যায় তাহলে সাহেবকে বোঝানো যেতে পারে, লোকের সভক্তি শ্রদ্ধাও আকর্ষণ করা যেতে পারে।
ভাবতে ভাবতে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। এর কি কোনো প্রতিকার নেই? এই ভণ্ডামি, দুর্বৃত্ততা, ধর্মের নামে মহাপাপ বন্ধ করার কি কোনো উপায় নেই?
আমার এই প্রশ্নের মূর্তিমান উত্তর হয়ে সেদিন বিকেলে বাবা তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাখলাগঞ্জে এসে হাজির। জজ কোর্টে আমাকে খুঁজে বের করে বললেন, ‘শোনো চিত্তপ্রসাদ, আমার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। তাই ভাবছি কিছুদিনের জন্য তোমাদের মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসব। জলবায়ুর একটা পরিবর্তন দরকার। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে। তোমার জামাকাপড় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।’
বুঝতে পারলুম, এই দীক্ষাগ্রহণ ব্যাপারটা যে কী সেটা বুঝতে বাবার বিন্দুমাত্রও অসুবিধে হয়নি এবং সেই কলুষিত অনুষ্ঠান বন্ধ করার কোনো উপায় না-পেয়ে তিনি সেটা বর্জন করাই মনস্থ করেছেন। শরীর তাঁর বহুদিনই খারাপ, হঠাৎ আজকেই জলবায়ুর পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ল?
তবু আমি একটু আপত্তি করতে গিয়েছিলুম, কিন্তু বাবার রক্তচক্ষু দেখে আর কথা কইবার সাহস হল না।
মামাবাড়ি থেকে গ্রামে ফিরে এসে শুনি হুলুস্থুল কাণ্ড। ভীম খুন হয়ে গেছে, পুলিশ হরচন্দ্রকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের কথা শুনে হরচন্দ্রকে দায়রায় সোপর্দ করে দিয়েছেন, তবে তাকে জামিনও দিয়েছেন।
আমি ঘটনা শুনেই ছুটলুম ভীমের বাড়িতে।
গিয়ে দেখলুম ময়না বউ একেবারে পাথর; এমনিতেই আস্তে কথা বলে, তখন তো গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরুচ্ছে না। ময়নার দুটো ছেলে বাইরে বসেছিল, তাদের জিগ্যেস করলুম, ‘কী হয়েছিল রে?’
তারাও চুপ। মনে হল, কেউ যেন তাদের গলা টিপে রেখেছে।
আমি আবার চাপাচাপি করতেই এবার ঘরের পেছন থেকে একটা পুরুষের গলা শুনতে পেলুম। যে লোকটি বেরিয়ে এল, তাকে আমি চিনতুম। সে ভীমের শালা, সুবল। জমিদারবাড়িতে সুবল লেঠেলের কাজ করত।
সুবল বলল, ‘তুমি ঘরে যাও দাদা, কিচ্ছু হয়নি। ওরা ছেলেমানুষ, ওদের ওপর জুলুম করছ কেন?’
আমি বললুম, ‘সুবল, আমি উকিল, তোমার ভগ্নীপোতের বন্ধু। সে খুন হয়েছে। সে খুনের কিনারা করার বা কেন খুন হয়েছে সেকথা জানার হক আমার আছে।’
সুবল মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি উকিল হও আর যাই হও, তোমাকে তো এখানে কেউ ডাকেনি। তুমি তোমার নিজের কাজে করগে যাও। নকুল বদামি করতে গিয়ে ছোটোবাবুর ত্রিশূলে গেঁথে মারা গেছে। ছোটোবাবু শ্মশানে তপিস্যে করছিলেন, তাঁর ভৈরবীকে নকুল তুলে নিতে গেছল।’
সুবলের কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে এল। চিৎকার করে বললুম, ‘সুবল, তোর মুখ যে খসে যাবে রে, হারামজাদা। নিজের ভগ্নীপোতের সম্বন্ধে এত বড়ো মিথ্যে কথাটা বললি কী করে?’
সুবল হলদে ছোপধরা দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘সত্যি-মিথ্যে আদালতে প্রমাণ হবে গো দাদা। তুমি তো উকিল, সাক্ষী বোঝো? আমরা গাঁ সুদ্ধ লোক সাক্ষী, ছোটোবাবু দেবতুল্য মানুষ। আর নকা ব্যাটা তো ছোটোলোক, সে তাড়ি খেয়ে বে-এক্তেয়ার হয়ে বদামি করবে না তো করবে কে?’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘তোর বোনটা যে বিধবা হল, তার কথা ভেবেও কি তোর মিথ্যে কথাগুলো বলতে আটকাল না, সুবল?’
‘হেঁঃ, আমার কথা কে ভাবে তার নেইকো ঠিক, তো বোন। তবে বোনের কথা ভেবেছি বলেই এতগুলো কথা বললুম। আর তুমিও তোমার নিজের কথা ভাবো গো দাদা, অন্যের বোন, অন্যের বিধবা বউয়ের কথা অত চিন্তা করোনি। বিপদে পড়বে।’
সেকথা আমারও অজানা ছিল না। কাজেই ভীমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলুম দুসুতি থানায়।
থানার অফিসার ইনচার্জ মহেশ ধর দেখি অগ্নিগর্ভ শমীবৃক্ষ হয়ে বসে রয়েছেন। আমি গিয়ে ভীমের কথা পাড়তেই ফেটে পড়লেন। মহাচেঁচামেচি করে বললেন, ‘যান মশাই, আপনারা মানুষ না অন্য কিছু? ভীমেকে আমি খুব ভালো করে চিনতুম আর ওই হরচন্দ্রকেও চিনি। সেই হরচন্দ্রকে বাঁচাতে আপনারা সকলে মিলে মিথ্যে সাক্ষী দিতে যাচ্ছেন? আপনাদের মশাই নরকেও স্থান হওয়া উচিত নয়।’
মহেশ ধরের তখন নিতান্তই অল্পবয়স, আমারই সমান হবেন, সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন। কাজেই তখনও তিনি ভয়ানক অন্যায় দেখলে বিচলিত হয়ে পড়তেন, অসংগত ব্যাপার দেখলে শোধরাবার চেষ্টা করতেন। এরকম একটা ব্যাপারে যে তিনি একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বেন তাতে আর আশ্চর্য কী।
অনেক কষ্টে মহেশকে শান্ত করে জিগ্যেস করলুম, ‘কী হয়েছিল, বলুন তো?’
গোমড়া মুখে মহেশ বললেন, ‘কী আবার হয়েছিল। ওপারের চালতাডাঙা গাঁয়ের গোষ্ঠ ভটচাযের তেরো বছরের মেয়ে ছায়াকে তুলে এনে শ্মশানে ভৈরবী করে বসিয়েছিলেন হরচন্দ্র আর তার গুরুদেব। বুঝতেই পারছেন মেয়েটাকে বলি দেওয়ার কথা। সে বোধ হয় গোড়ায় সে কথাটা ধরতে পারেনি, পরে ব্যাপার বুঝে চান করার ফাঁকে দে দৌড়। কিন্তু সেই অজানা জায়গা, তার ওপরে শ্মশান, কতদূরে আর যাবে। ধরা পড়ে গেল, যখন ওকে জোর করে আবার ধরে নিয়ে যাচ্ছিল গুরু-শিষ্যে মিলে, মেয়েটা তখন চ্যাঁচাতে শুরু করে। ভীমে সেই চিৎকার শুনে মূর্তিমান বেরসিকের মতো সেই ভৈরবী-চক্রে এসে উপস্থিত। মেয়েটাকে নিয়ে ভীমে হয়তো চলে যেতেও পারত, কিন্তু বোধ হয় হরচন্দ্রকে একটু উপদেশ দেওয়ার আশায় এক মুহূর্তের জন্য ফিরে দাঁড়িয়েছিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই হরচন্দ্র ধুনির মধ্যে পড়ে থাকা লাল হয়ে ওঠা ত্রিশূলটা এক ঝটকায় ভীমের বুকে আমূল বসিয়ে দেয়। ভীমে এক হাতে মেয়েটাকে ধরে ছিল, তাই পুরো বাধাও দিতে পারেনি। সঙ্গেসঙ্গে মারা যায়।
ভীমের পেছনেই ছিল ওর বড়ো ছেলে মদন। সেই দৌড়ে এসে আমাকে খবর দেয়।
আমি গিয়ে দেখি বাবাজি আর হরচন্দ্র ভাগলবা। ময়না সেই মেয়েটা আর ছোটো ছেলেকে দু-হাতে আগলে স্বামীর দেহ পাহারা দিচ্ছে। দেখে আমার চোখে জল এল, জানেন, সেই ধুনির আগুনে সেদিন সেই নীচু জাতের গরিব মেয়েটার ভঙ্গিতে যেন সাক্ষাৎ ভগবতীর চেহারা দেখেছিলুম। সে দৃশ্য কোনোদিন ভুলব না।
ওদের কাছে সবকথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ জমিদার বাড়ি গিয়ে হরচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করলুম। কনকশশী ঠাকুরণ অনেক ভজানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকী জড়োয়ার হারও অফার করেছিলেন, কিন্তু আমি ফিউরিয়াস। ধরে পরদিন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সামনে খাড়া করে দিলুম। সাহেবও কেস দায়রায় পাঠিয়ে দিলেন।’
আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তারপর?’
‘তারপর? তারপর আর কী? কনকশশী তাঁর ভেলকিবাজি দেখাতে শুরু করেছেন। গোষ্ঠ ভটচাযের কাছে গিয়েছিলুম। সে তো আকাশ থেকে পড়ল। বলল, আমার মেয়ে তো তার কনকপিসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। সেখানে কিছুদিন থাকবে বলে। ইতিমধ্যে একদিন সে তার হারাদাদার সঙ্গে শ্মশানে বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানে এক ব্যাটা মাতাল বাগদি তাকে আক্রমণ করে। ভগবানের অসীম দয়া যে সে ব্যাটা পা পিছলে একটা ত্রিশূলের ওপর পড়ে মারা যায়। তা না-হলে যে কী হত!
বুঝতেই পারছেন, কনকশশী আমার আগেই ওখানে পৌঁছে গেছেন। বাপের দরখাস্তের ওপর ছায়াকে ছেড়ে দিতে হল। সে এখন কনকশশীর কাছেই আছে। আর গোষ্ঠকে যদি দেখেন! তার গোয়ালে নতুন গোরু এসেছে, বাড়ির চালে নতুন খড় লাগছে, বউয়ের অঙ্গে নতুন শাড়ি! আবার শুনছি, কনকশশী নাকি তাঁকেই বাড়ির পুরোহিত করবেন।
কাজেই কিচ্ছু হবে না মশাই, কিচ্ছু হবে না। তবু, আমি লড়ে যাব। পাবলিক প্রসিকিউটার রমণীমোহন দস্তিদার কেস ওপন করবেন, তবে তাঁরও বিশেষ কোনো আশা নেই। সাক্ষী কোথায়? গাঁ-সুদ্ধ লোক সাক্ষী দেবে যে ভীমে ছিল পাজির পা ঝাড়া, কয়েক জন হয়তো প্রত্যক্ষদর্শীও জুটে যাবে।’
আমি জিগ্যেস করলুম, ‘ময়না? সে কিছু বলবে না?’
‘কোত্থেকে বলবে? দুই ছেলের গলায় তো শড়কি ঠেকান দেওয়া রয়েছে। আর, আপনি তো নিজেই দেখে এলেন। এ অবস্থায় সে কখনো সত্যি কথা বলতে পারবে মনে হয় আপনার? একমাত্র মদন আছে, ডাকাবুকো ছেলে। কিন্তু সে তো বাচ্চা ছেলে, হরচন্দ্রের ব্যরিস্টার রামজীবন মুখুজ্জের জেরার সামনে দাঁড়াতে পারবে?’
তা কি কখনো পারে? রামজীবন মুখুজ্জে হাসতে হাসতে কেসটাকে তছনছ করে দিলেন, সবাই অসহায়ভাবে বসে বসে তাই দেখল। মদনের দু-চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে লাগল, কিন্তু বৃথাই। ময়নার মুখ দেখে মনে হতে লাগল যেন একটু একটু করে তার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ হয়তো তার মনেও ক্ষীণ একটা আশা ছিল, তা না-হলে সে রোজ এতটা পথ ভেঙে মামলা শুনতে আসবে কেন? আর, তার আরও কষ্ট হচ্ছিল বোধ হয় এই জন্যে যে এতগুলো লোকের সামনে তাকে মিথ্যে কথাগুলো বলতে হল যখন তার সমস্ত মন প্রাণ বোধ হয় হাহাকার করে সত্যি কথাগুলোই বলতে চাইছিল।
সাক্ষীসাবুদ শেষ হলে জজসাহেব যখন জুরিদের কেসটা বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন, তখনই বুঝতে পারলুম জুরিদের উত্তর কী হবে। আমি আর সেকথা শোনবার জন্যে অপেক্ষা না-করে বাড়ির দিকে রওনা দিলুম।
ঠাকুরগঞ্জ মাখলাগঞ্জ থেকে মাইল ছয়েক দূরে, আমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে। জায়গাটা খুব ছোটো, কয়েকটা মাত্র বাড়ি ছিল। তবে হপ্তায় দু-বার এখানে মস্ত হাট বসত রাস্তার ধরে, সে হাট বেশ বিখ্যাত ছিল। আর একটা জিনিস ছিল যেটা সে-যুগে এখনকার মতো দেদার দেখা যেত না, তা হচ্ছে একটা পার্মানেন্ট চায়ের দোকান। অবিশ্যি দোকান বলতে সাইনবোর্ড টাঙানো, চেয়ার টেবিলওয়ালা ঝকঝকে ঘর কিছু নয়, একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় ছোটো একটা খড়ের চালা আর তার সামনে দুটো লম্বা বাঁশের বেঞ্চি— এই। তবে হাটের দিন ছাড়াও, রোজই দোকানটা খোলা থাকত। কয়েকটি আধা-শহুরে খদ্দের ছিল, কখনো-সখনো দু-একজন গ্রাম্য ভদ্রলোক এখানে এসে বসতেন।
এই চায়ের দোকানেই আমার সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল।
আগেই বলেছি, তখন কার্তিক মাস, সন্ধে হয়ে এসেছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে যখন দোকানটার সামনে এসে পড়েছি, হঠাৎ মনে হল কে যেন আমাকে ডাকল, ‘চিত্ত দাদা গো!’ গলার স্বর একেবারে ভীমে বাগদির মতো।
আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল।
ফিরে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখলুম, তাতে শাস্ত্রমতে দাঁতকপাটি লাগা উচিত ছিল, নিদেনপক্ষে রাম নাম জপতে জপতে ভড়কানো ঘোড়ার মতো দৌড় লাগানো উচিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি মোটেই ভয় পাইনি। অবাক হয়েছিলুম, কিন্তু পালানোর কথা মনেই হয়নি।
দেখলুম, চায়ের দোকানের সামনের দুটো বেঞ্চির একটার ওপর ভীমই বসে রয়েছে। আধো অন্ধকারে ভুল দেখেছিলুম, তা নয়। কারণ ভীমের গায়ের কুচকুচে কালো রং কেমন যেন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছিল, আর একটা অদ্ভুত নীলাভ রূপোলি আভায় তার সর্বাঙ্গ খুব অল্প চকচক করছিল। কাজেই তার মুখ-চোখ সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলুম, ভুল হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তা ছাড়া, তার উলটোদিকের বেঞ্চিতে যে তিন-চারজন খদ্দের বসেছিলেন তাদেরও চিনতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না।
আমি ফিরে দাঁড়াতেই ভীম বা ভীমের প্রেত হেসে উঠল। গলাটা চেরা চেরা আর ট্রাংককলে টেলিফোনের মধ্যে যেমন শোনায় তেমনই, কিন্তু ভীমের গলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হাসতে হাসতে ভীমে বলল, ‘কী গো দাদা, মন খারাপ করে কোথায় চললে?’
আমি অবাক হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে ভীম আবার বলল, ‘কী হল গো, দাদা? মদনের কষ্ট দেখে দুঃখ হয়েছে? ময়নার চোখে জল দেখে বুকে বেজেছে? দুঃখ করো কী দাদা! জগৎটা বড়ো সহজ লয় গো, তুমি ছেলেমানুষ, এতগুলো বদমাইশের সঙ্গে পারবে কেনে?’
আমি বলতে গেলুম, ‘তোমার আর কী? তুমি তো মরে ভূত হয়েছ, বেঁচেছ। কিন্তু আমার তো পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়নি। আমার বুকে জ্বালা ধরবেই; তার তুমি বুঝবে কী?’
কিন্তু তার আগেই শুনি ভীম আবার হাসছে। বলল, ‘ভাবছ আমার রাগ হয় না? হয় দাদা, হয়। মায়ার বাঁধন কি অত সহজে কাটে? তবে কিছু করিনে কেন? ওই যে, জন্ম-জন্মান্তরের শিক্ষে, ভগমান আছেন। দুষ্টু লোকের শাস্তি দেবেন উনিই, তাই অপিক্ষে করে থাকি। তবে ওঁর শাস্তি তো আমাদের শাস্তির মতো লয়। কোথা দে আসে কোথা দে যায়, অনেক সময় বোঝাই যায় না। লয়তো, এই যে এত বড়ো একটা অন্যায় হল, তার কেষ্ট-বিষ্টুদের একবার দ্যাখো। বাজনা বাজিয়ে নাচতে নাচতে আসছে। আর ওই দ্যাখো, নাটের গুরু হরচন্দর আর তা মা জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ইদক পানে আসছে। কী ফূর্তি! গাড়ি চালাচ্ছে হরচন্দর নিজে আর চাবুক চালাচ্ছে ঘোড়াগুলোর ওপর অনবরত। লোকটা পশু হে, পশু।’
ভীমের কথা শুনে আমি মাখলাগঞ্জের দিকে তাকালুম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলুম না। আবার শুনি মৃদু হাসির শব্দ। ভীমে বলল, ‘একটু মজা করব গো, দাদা। ঘোড়া দুটোকে একটু উসকে দেব। যা চাবুক খেয়েছে, তাতে ওদের একটু বেতালা নাচা দরকার।’
ভীমের কথার মধ্যেই শুনতে পেলুম প্রচণ্ড জোরে ছুটে আসা ঘোড়ার খুরের দূরাগত শব্দ। একটু বাদেই সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দুটো পর্বতাকার ওয়েলার ঘোড়ার অবয়ব ফুটে উঠল। উন্মত্তের মতো ছুটে আসছে তারা, মুখ দিয়ে উঠছে সাদা ফ্যানা আর তাদের সঙ্গে লাগানো জুড়ি গাড়িটার কোচোয়ানের সিটে বসে তাদের পিঠে পৈশাচিক হিংস্র আনন্দে চাবুক চালাচ্ছে হরচন্দ্র। ভেতরে ছিলেন কনকশশী, তাঁকে অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না।
গাড়িটা যখন হাটের কাছাকাছি চলে এসেছে, হঠাৎ ভীমে উঠে দাঁড়াল। তারপর গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত হ্যা হ্যা হ্যা আওয়াজ করতে করতে ছুটে গেল গাড়িটার দিকে। আমার তৎক্ষণাৎ মনে হল, আরে লোকটা তো এখুনি চাপা পড়ে গুঁড়ো হয়ে যাবে; সে যে ভূত সেকথা মনেই পড়ল না। তাই আমিও তার পিছু পিছু ‘আরে, আরে, এই, এই’ করতে করতে দৌড়লুম। কিন্তু সেটা বোধ হয় কয়েক পা মাত্র।
হরচন্দ্র আর কনকশশীর তালগোল পাকানো দেহ দুটো যখন গাড়ির তলা থেকে বের করা হল, তখন তাদের আর চেনা যায় না। ওরকম বীভৎস ভয়ংকর মৃত্যু তার পরে বা আগে আর কখনো দেখিনি!
তার পরদিন ভোর বেলা পুলিশ এসে আমাকে গ্রেপ্তার করল। অভিযোগ কী? না, আমি নাকি শত্রুতার বশবর্তী হয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার সামনে দৌড়ে গিয়ে তাদের চমকে দিয়েছি আর তারই জন্যে তারা খানায় পড়ে কনকশশী আর হরচন্দ্রের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এটা নাকি আমার পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল। তা না-হলে যে আদালতের শেষ পর্যন্ত রোজ বসে থাকতুম, সেদিন, যেদিন রায় বেরুবার দিন, শেষপর্যন্ত না-থেকে হঠাৎ সাত-তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে আসব কেন? ঠাকুরগঞ্জের চায়ের দোকানের মালিক গুপিকান্ত আর তার চার-পাঁচজন খদ্দের বলেছে যে সেদিন সন্ধে বেলা আমি এসে দোকানের সামনে কিছুক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলুম, যেন কারও অপেক্ষা করছিলুম। আর যেই জুড়ি গাড়িটা দেখা দিয়েছে, অমনি ‘এই এই, আরে-আরে’ করে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে তার সামনে দৌড়ে যাই। তারপরেই ঘোড়া আর গাড়ির খানায় পতন হয়। অতঃপর প্রশ্ন, কনকশশী আর হরচন্দ্রের সঙ্গে আমার কী শত্রুতা থাকতে পারে? তারও উত্তর পাওয়া গেছে। মৃত নকুল বাগদির স্ত্রী ময়নার প্রতি নাকি আমার কু-দৃষ্টি আছে। সুবল সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছে, আর তারই জন্যে ময়নাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যেই আমার এই ভয়ংকর অভিযান।
আমি মহেশ ধরকে বললুম, ‘এরচেয়ে হাস্যকর কথা আর কিছু হতে পারে?’
মহেশ বললেন, ‘আমি কী বলব বলুন? হাস্যকর অভিযোগ হোক বা না-হোক, আমি নাচার। জমিদারমশাই স্বয়ং সদরে গিয়ে বড়োকর্তার কাছে অভিযোগ লিখিয়েছেন; আমি তাঁর নির্দেশে এসেছি। তবে অভিযোগটা যদি সত্যি হয়, আমি বলব, শাবাশ!’
আমি বললুম, ‘বলবেন না, শাবাশটা বাজে খরচা হবে।’
কেস উঠল জেলা জজ সিসিল অ্যামবলার সাহেবের এজলাসে। অ্যামবলার সাহেব দুদে সাহেব। প্রকাণ্ড লাল মুখটা যেন সবসময় রেগে টং হয়েই আছে। তাঁকে কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি, এমনকী মেমসাহেবের সঙ্গে বেড়াবার সময়ও মুখের ভাব নরম হতে দেখেনি। এ হেন সাহেবের কাছে ভীমের ভূতের কথা বলার কোনো মানে হয়? ফাঁসি তো দেবেই, তার আগে হয়তো পাগলা গারদে পাঠাবে। তার বদলে অন্য কথা ভাবতে হবে।
বাবা আমার উকিল লাগিয়ে ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত সনাতন সিংগিকে।
সনাতন বললেন, ‘হুজুর! আমার দু-চারটে ঘোড়া দেখা আছে, আপনারও যে নেই তা নয়। এখন বলুন তো, ছুটন্ত ঘোড়ার সামনে একটা লোক যদি দৌড়ে যায়, সে কি ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে, না পিষে ছুটে চলে যায়? আসলে, আমার মক্কেল ঘোড়া দুটোকে লাফিয়ে উঠতে দেখে ছুটে গিয়েছিল গাড়ির আরোহীদের বাঁচানোর জন্যে। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে যায় যে চায়ের দোকানের খদ্দেররা ঠিক বুঝতে পারেনি যে ঘোড়া লাফানোর পরে সে দৌড়িয়ে ছিল। তারা আবছা অন্ধকারে ভেবেছিল যে সে দৌড়োনোর পরে ঘোড়া লাফিয়েছিল।’
অর্থাৎ ধপ করে পড়েছিল, না পড়ে ধপ করেছিল?
পাবলিক প্রসিকিউটার ব্রজেন্দ্রনাথ দাস বললেন, ‘হুজুর, আমার পরম পণ্ডিত বন্ধু ঘোড়া সম্পর্কে যা বললেন, আমি তা মেনে নিতে পারছি না। তিনি যে ঘোড়া দেখেছেন তা কলকাতার ঘোড়া। তারা ছুটন্ত লোক দেখলে ভয় পায় না। কিন্তু নিহতদের ঘোড়া দুটো গ্রাম্য ঘোড়া। তারা ভয় পেতেই পারে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
আদালত ঘোড়ার আলোচনায়, সমালোচনায়, ব্যাখ্যায় যেন আস্তাবলে রূপান্তরিত হল। অ্যামবলার সাহেবের মুখ লাল থেকে আরও লাল হতে হতে যখন ফাটো ফাটো হয়েছে, তখন দুই উকিল তাঁদের বক্তব্য শেষ করলেন।
পরদিন রায়।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুটি। প্রথম, ইচ্ছাকৃত নরহত্যা, নিহত হরচন্দ্র। দ্বিতীয়, অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা, নিহত কনকশশী। অ্যামবলার সাহেব প্রথম অভিযোগ থেকে আমাকে অব্যাহতি দিলেন বটে, কিন্তু দ্বিতীয় অভিযোগে সাত বছর শ্রীঘর বাসের আদেশ দিয়ে বসলেন।
বাবা বললেন, ‘আমরা আপিল করব।’ সনাতনও সজোরে মাথা নাড়লেন।
কিন্তু তখন আমার কীরকম একটা নির্বেদ উপস্থিত হয়েছিল। আমি বললুম, ‘কী লাভ হবে আমাদের আপিল করে? আমি এটুকু বুঝেছি যে সমাজে সৎভাবে, অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই করে, বাঁচতে হলে যা দরকার তা হল প্রচুর টাকা। এত টাকা যা অন্যায়াকারীর টাকার চেয়েও বেশি। তা তো আপনার নেই। আপনি যদি আরও লড়াই করতে চান, তাহলে আপনার যা অছে সেটুকু তো যাবেই, হয়তো বাড়ি ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হবে। তার চেয়ে বরং আমাকে জেলেই যেতে দিন। সাতটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। জীবনে সাতটা বছরের কী দাম আছে?’
বাবার আদালতে সেবার আমার আপিল ডিগ্রি পেয়ে গেল।
কিন্তু, এই জেলে যাওয়াই আমার সমস্ত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এখানেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে দীক্ষা, রাজনৈতিক কার্যকলাপের আরম্ভ। আজ যে আমাকে সকলে দেশনেতা বলে মানে, সেই নেতৃত্বের দিকে প্রথম পদক্ষেপ এই জেলেই।
দু-বছর সাজা মুকুব হয়ে পাঁচ বছর বাদে যখন জেল থেকে বের হলুম, তখন আমি একজন শুধু রাজনীতিবিদই নয়, একজন হবু অতিশয় বিখ্যাত আইনজ্ঞও বটে; বলা বাহুল্য, আমার এই দুটো পরিচয়ই ছিল পরস্পর নির্ভরশীল।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। হাতকড়া পরিয়ে যেদিন আমাকে প্রথম জেল গেটে ঢোকানো হচ্ছিল, সেদিন হঠাৎ চোখ পড়ে গেল গেটের ধারে একটা বটগাছের তলায়। দেখি, ভীম দাঁড়িয়ে আছে। সেই ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে রং আর সর্বাঙ্গে একটা চকচকে নীলাভ রুপোলি আভা। করুণ মুখে ভীম আমার হাতকড়ার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু মুখ তুলে যখন আমার মুখের দিকে তাকাল, তখন যেন মনে হল তার দু-চোখে একটা অদ্ভুত আলো চকচক করছে।
দেখে প্রথমে তো রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। কেন বাপু! তোমার জন্যেই তো আমার আজ এই দশা! কিন্তু একটু পরেই রাগটা চলে গেল। মনে মনে ভাবলুম, রাগ করে আর কী হবে? ভীম কী আর জেনে করেছে কিছু? ভূত যদি ভবিষ্যতের কথা জানতই, তাহলে তো কথাই ছিল না।
আজও মাঝে মাঝে সেই অদ্ভুত আলোটার কথা মনে পড়ে আর ভাবি, ভীম কী সত্যিই ভবিষ্যতের কথা কিছু জানত না?