অখিলবাবুর মৃত্যুরহস্য
অখিলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মধুসূদনপুর মহকুমা আদালতের উকিল। যেমন শকুনের মতো চেহারা তেমনি শকুনির মতো বুদ্ধি। অত্যন্ত ঘুঘু লোক। দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারেন বলে তাঁর খ্যাতি ছিল। যত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীই থাক না-কেন, একজন খুনীকে অনায়াসে মেষশাবকের মতো নিরীহ বলে প্রমাণ করে দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। ফলে তাঁর যেমন প্রচণ্ড পসার তেমনি রোজগার ছিল। লোকে বলে, স্বনামে-বেনামে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ নাকি পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ।
ছোটোবেলা থেকেই অখিলবাবুর স্বভাবচরিত্র একটু গোলমেলে হয়ে পড়েছিল। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার, সর্বজনশ্রদ্ধেয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। অথচ, হেন দোষ নেই যা অখিলবাবুর ছিল না। মদ্যপান থেকে গোমাংসভক্ষণ তো সামান্য ব্যাপার, যেকোনোরকম নৈসর্গিক বা অনৈসর্গিক দুষ্কর্মে তাঁর কোনোরকম আপত্তি ছিল না। তবে, অত্যন্ত সাবধানে থাকতেন যাতে ধরা না-পড়েন। তাঁর ক্রিয়াকর্মের কথা তাঁর স্ত্রী বন্দিতাকে কোনোদিন জানতে দেননি। তাঁর প্রতি বন্দিতার অগাধ বিশ্বাস আর আস্থা ছিল। স্বামীকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলে মনে করতেন।
অখিলবাবুর জীবনের শেষ মক্কেলের নাম আকবর মণ্ডল। নিত্যানন্দপুরের দুর্দান্ত ডাকাত। হেন খারাপ কাজ নেই যা সে করেনি। তার ভয়ে আশেপাশে পাঁচটা গ্রাম তটস্থ হয়ে থাকত। তারই গ্রামের রাবেয়া খাতুনকে তার স্বামী এনায়েতের সামনে ধর্ষণ করে তাকে গলা টিপে খুন করেছিল সে। এনায়েত আর সহ্য করতে না-পেরে থানায় গিয়ে এজাহার দিয়েছিল। সেই অপরাধে তাকেও খুন করেছিল আকবর। পুলিশ দেখল যে ব্যাপরটা বেশি রকমের বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, আকবর তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা আকবরকে অ্যারেস্ট করে ৩০২ ধারায় মামলা দায়ের করে দিল। আকবরের আত্মীয়রা অখিলবাবুকে সেই মামলা চালানোর ভার দিল।
অখিলবাবুর কাছে এটা নিতান্তই সামান্য ব্যাপার। রাবেয়াকে ধর্ষণের একমাত্র সাক্ষী ছিল এনায়েত। সে আর নেই, কাজেই সেই অপরাধ যে কে করেছিল সেটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা অসম্ভব। এও বোঝা যাচ্ছে এনায়েতের যেকোনো কারণেই হোক ধারণা হয়েছিল যে আকবরই সেই কাণ্ডটি করেছে। অতএব, সে থানায় এজাহার দিয়ে ফেরার সময় আকবরকে দেখতে পেয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল। তখন, আত্মরক্ষা করতে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকবর তাকে খুন করে ফেলে। এই যুক্তির ওপরে তার খালাস হয়ে যাবারই কথা।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু গোলমাল বাধাল নিত্যানন্দপুরের লোকেরা। তাদের যে আকবরের ওপরে এতটা রাগ জমে ছিল আর সেই রাগে যে তারা একযোগে আকবরের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এগিয়ে আসবে সেটা অখিলবাবু বুঝতে পারেননি। সরকারপক্ষের সাক্ষী এনায়েতের প্রতিবেশিনী আনোয়ারা খাতুন। সে স্বামী পরিত্যক্তা, রাবেয়ার পাশের বাড়িতে একা থাকে। ঘটনার রাত্রে ভয়ে ঘর থেকে বের হয়নি বটে কিন্তু সে যা শুনেছিল তা আকবরের অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ। তাকে কাঁদিয়ে ছাড়লেন অখিলবাবু। প্রমাণ করে দিলেন যে সে একটি সন্দেহজনক নষ্টচরিত্রের স্ত্রীলোক, যার একটি কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু সে যে সত্যি কথা বলছে এটা বুঝতে শ্রোতাদের কোনো অসুবিধে হল না।
পরের সাক্ষী রাবেয়া খাতুনের বারো বছরের কাজের লোক মাসুম। ঘটনার সময় সে ওই বাড়িতেই ছিল। সেও সত্যি কথা বলবে বলে মনে হল অখিলবাবুর। তাকে কব্জা করা হয়তো কঠিন হবে না। কিন্তু জজসাহেবের সহানুভূতি যে তার দিকেই যাবে তার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
সে রাত্রে আকবরের ছোটোভাই সিরাজকে ডেকে পাঠালেন অখিলবাবু। সিরাজ তার দাদার মতো না হলেও, নানা রকমের ছোটোবড়ো অপরাধের সঙ্গে ভালোভাবেই যুক্ত ছিল। পরামর্শ করে ঠিক হল যে মাসুমের বাবাকে ভয় দেখিয়ে তার সাক্ষী দেওয়ানো বন্ধ করতে হবে। মাসুমের বাবা দরিদ্র দিনমজুর। সে সিরাজের বিরুদ্ধে যেতে সাহস পাবে না।
পরদিন সকালে অখিলবাবু যা খবর পেলেন তাতে খুবই দমে গেলেন তিনি। মাসুমের বাবা সিরাজের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সে ভয়তো পায়ই নি, উলটে তার পাড়ার লোকজন ডেকে এনে মহা হইচই বাধিয়ে তুলেছিল। সিরাজকে একরকম ল্যাজ গুটিয়ে ওখান থেকে পালাতে হয়েছিল।
সেদিন কী একটা পুজো উপলক্ষ্যে কোর্ট বন্ধ ছিল। সারা সকাল অখিলবাবু অস্থিরভাবে পায়চারি করলেন। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল যে এই প্রথম তাঁকে হেরে যেতে হবে। একজন গরিব দিনমজুরই যেখানে ভয় পাচ্ছে না আর কথা শুনছে না, সেখানে অন্য সাক্ষীদের ভাঙানো কি সম্ভব হবে? ব্যাপারটা তাঁর কাছে অসহ্য অপমান বলে মনে হতে লাগল। এদিকে সিরাজের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে বসে আছেন। হেরে গেলে সে-ই কি ছেড়ে কথা কইবে? অতএব, দুপুর বেলা তিনি আবার সিরাজকে ডাকলেন।
অখিলবাবু বললেন, ‘দ্যাখ সিরাজ, যদি দাদাকে বাঁচাতে চাস তাহলে যেভাবেই হোক, সাক্ষীদের মুখ তোকে বন্ধ করতেই হবে। সওয়াল করে জিততে পারব কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। জজসাহেবটা অতিবাজে লোক, ঘুস খায় না, মেয়েছেলের দোষ নেই, মদ পর্যন্ত খায় না। তার ওপরে প্রচণ্ড বদরাগী। একেবারে যাচ্ছেতাই। ওকে হাত করা যাবে না। কাজেই টাকা দিয়ে হোক, ভয় দেখিয়ে হোক, যেভাবে হোক, এই কাজটা তোকে করতেই হবে। দরকার পড়লে দু-একজনকে হাপিস করে দিবি।’
সিরাজ একগাদা পানখাওয়া এবড়োখেবড়ো দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে, চ্যাটার্জীবাবু সেই ব্যবস্থাই করছি। আজ রাতের মধ্যেই ওই পাকটি (বেশ্যা) আনোয়োরাটাকে ফাঁড়িয়ে দিচ্ছি (মেরে ফেলছি) আর মাসুমকে এমন ভসকাব (মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব) যে ওর বাপও ওকে চিনতে পারবে না। আমার সঙ্গে টক্কর দেবার মজা টের পাবে। তখন দেখবেন আর কেউ সাহস দেখাতে এগিয়ে আসবে না। কেন কি, এমন কেউ অছে যে শালা জানের পরওয়া করে না? সব শালারা সুড়সুড় করে গর্তের ভেতরে গিয়ে যদি না-ঢুকেছে তো কী বললুম আপনাকে।’
সিরাজ চলে যাবার পরেও স্বস্তি পেলেন না অখিলবাবু। ভেবে ভেবে তাঁর মাথা গরম হয়ে উঠল। সন্ধে বেলা বন্দিতাকে বললেন, ‘একটু ঘুরে আসছি। কয়েক জন লোকের সঙ্গে দেখা করা দরকার।’
বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন শহরের অন্যপ্রান্তে কাঠগোলা বাজারের বেশ্যাপল্লীতে তাঁর রক্ষিতা কাকলি বিশ্বাসের বাড়িতে। শরীর ও মন দুটোকেই একটু শান্ত করা দরকার।
রাত আটটা নাগাদ সেলফোনে খবর পেলেন যে আনোয়ারা খুন হয়েছে। এইবার খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন অখিলবাবু। সিরাজ তাহলে কথা রেখেছে। কাকলি অনেকক্ষণ ধরেই তাঁর গোমড়া মুখ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। এতক্ষণে সেই মুখে হাসি ফুটল। ভাবলেন, ঘণ্টাখানেক ফূর্তি করে উঠে পড়বেন।
একটু বাদে এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল যার জন্য অখিলবাবু একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ দরজায় প্রবল কড়া নাড়ার শব্দ হল। তারপরে দুমদাম লাথি। দরজা ভেঙে যায় আর কী! অখিলবাবুর মনে হল নির্ঘাত পুলিশ এসেছে। তিনি লাফ দিয়ে উঠে জামাপ্যান্ট পরতে শুরু করে দিলেন। কাকলি কোনোরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে এইরকম একটা ভাব করে দরজাটা খুলে দিল। সঙ্গেসঙ্গে ময়লা জামাকাপড় পরা গুণ্ডামতন একটা লোক হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকেই তার গলা টিপে ধরল। হুংকার দিয়ে বলল, ‘হারামজাদী, ভেবেছিলি তোকে খুঁজে পাব না, তাই না? উকিলের সঙ্গে আশনাই করে বেঁচে যাবি ভেবেছিস?’
কাকলি খাবি খেতে খেতে বলল, ‘তুমি… তুমি ঠিকানা পেলে কী করে?’
‘একটা বোরখাপরা মোসলমান মেয়ে দিয়েছে আর কোন সময় তোদের একসঙ্গে পাওয়া যাবে তাও বলেছে। এখন আগে তোকে মারব, তারপর ওই শালা উকিলের পেট ফাটাবো।’
শুনেই অখিলবাবু জামাটা প্যান্টের ভেতরে গুঁজতে গুঁজতে এক লাফে দরজা পেরিয়ে ছুট লাগালেন। জুতোটা পর্যন্ত পরবার সময় পেলেন না। গোলমাল শুনে তখন একদল লোক সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছিল। তাদের ধাক্কা মেরে ঠেলে কোনোরকমে নীচে নেমে রাস্তায় এসে পড়লেন। গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে দেখেন যে তাড়াহুড়োয় মানিব্যাগ, হাতঘড়ি, ফোন আর গাড়ির চাবি কাকলির ঘরে ফেলে এসেছেন। তখন আর সেখানে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। যত শিগগির সম্ভব পালাতে হবে। কাকলির হাসব্যান্ড যদুলাল বিশ্বাস ডেঞ্জারাস মার্ডারার। সে এসে পড়ল বলে। ধরতে পারলে একটা একটা করে হাত-পা ছিঁড়ে নেবে। এদিকে রাস্তায় একটাও রিকশা নেই। এখানে কেউ তাঁকে চেনেও না যে তাঁকে আশ্রয় দেবার ঝুঁকি নেবে। কাজেই, সোজা রাস্তায় না-গিয়ে অখিলবাবু কাঠগোলা বাজারের পেছন দিয়ে মহিষবাথানের মাঠের ভেতর দিয়ে হন হন করে হাঁটতে শুরু করে দিলেন।
অনেকটা দূরে মুনশিপাড়ার আলো দেখা যাচ্ছিল। একবার ওখানে গিয়ে পড়তে পারলে আর ভয় নেই। মহিষবাথানের মাঠ তাঁর চেনা জায়গা। ছেলেবেলায় এখানে অনেকবার এসেছেন বুনো কুলের সন্ধানে। তাঁর জীবনের প্রথম প্রেমিকা, তাঁদের বাড়ির ঝি, গিরি; তাঁকে এখানে নিয়ে আসত ভালোবাসা শেখাবার জন্য। তখন তাঁর ষোলো বছর বয়েস। কাজেই দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় যে ঠিক চলে যেতে পারবেন, তাতে অখিলবাবুর সন্দেহ ছিল না। একমাত্র ভয় সাপের। তবে কিনা, যদুলাল বিশ্বাস আরও ভয়ংকর। অবশ্য এই অচেনা অন্ধকার মাঠে আসতে সে সাহস পাবে কি না সেটাই প্রশ্ন।
দ্রুতবেগে হাঁটতে হাঁটতে অখিলবাবু ভাবতে লাগলেন— একটি মুসলমান মেয়ে যদুলালকে খবর দিয়েছে। সে কে রে, বাবা? যদুলাল থাকে কৈলাসপুর কলোনিতে। সেখান থেকে কাঠগোলা বাজারে বাসে আসতে কমপক্ষে দু-ঘণ্টা লাগার কথা। ট্যাক্সি করে সে আসবে না, কিপ্টে নাম্বার ওয়ান। তাহলে, সেই মেয়েটি তাকে জানাল কখন? এখানে তো তাঁর আসবার কথা ছিল না, সেটা হঠাৎই ঠিক করেছিলেন। সেকথাটাই বা সেই মেয়েটি জানাল কীভাবে আর যদুলালকে খবরটাই বা দিল কী করে? সে নিজে গিয়েছিল? সেটা অসম্ভব। টেলিফোনে? তাহলে সে যে বোরখা-পরা মেয়ে সেটা যদুলাল জানল কী করে? যদুলালের কি টেলিফোন আছে? সেরকম কথা তো শোনেননি কখনো।
ভাবতে ভাবতে আর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অখিলবাবু দেখলেন, একটু দূরের মাঠের মধ্যে একটা ছোটো দু-কামরার একতলা বাড়ি। তার একটা ঘর অন্ধকার আর অন্যটায় আলো জ্বলছে। লণ্ঠনের ম্লান হলদেটে আলো খোলা জানলা আর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। এখানে আবার এই বাড়িটা হল কবে? এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে থাকেই বা কে? ডাকাত-ফাকাত নয় তো? ডাকাত হলে সে তাঁর মক্কেল হতে পারে। কিন্তু মহিষবাথানের ভেতরে এরকম খোলা জায়গায় কোনো ডাকাত থাকে বলে তো শোনেননি কখনো। কৌতূহল সামলাতে না-পেরে বাড়িটার দিকে গুটিগুটি এগিয়ে গেলেন।
কাছাকাছি আসতেই একটা গোঙানির শব্দ পেলেন অখিলবাবু। এতে তাঁর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। যথাসাধ্য চুপিসাড়ে খোলা জানলাটার নীচে গিয়ে ডিঙি মেরে ভেতরে উঁকি মারলেন। যা দেখলেন তাতে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। প্রায় নিরাভরণ দরিদ্রলাঞ্ছিত ঘরে একটি খাটিয়ার ওপরে একটি নিরাবরণ সুঠাম নারীদেহ উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে। তার ঘন কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছে খাটিয়ার থেকে মেঝের ওপর। কিন্তু তার শরীরে বেশ সদ্য আরোপিত ধারালো অস্ত্রের রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন। কেবল গোঙানির শব্দ ছাড়া তার সর্বাঙ্গে আর কোনোরকম প্রাণের লক্ষণ নেই। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে কেউ তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। প্রথমটায় সে কতটা সার্থক হয়েছে সেটা অবশ্য বোঝবার উপায় নেই কিন্তু দ্বিতীয়টায় সে হয়নি সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যাকে মৃত ভেবে লোকটা চলে গেছে, সে কোনোরকমে বেঁচে রয়েছে— বোধ হয় অখিলবাবুর আসবার অপেক্ষায়।
অখিলবাবুর শরীরে রিরংসা সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়াল। যেকোনো কারণেই হোক, মেয়েটির পড়ে থাকার ওই দৃশ্যটা তাঁর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিল। কাকলির ঘরে তাঁর শরীরের তৃষ্ণা কিছুই মেটেনি। এই সুযোগে সেটা মিটিয়ে না-নেবার কোনো কারণই নেই। তিনি ব্রাহ্মণসন্তান, কারুর উচ্ছিষ্ট ছোঁন না, সেটা ঠিক। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কোনোদিন কোনো সন্দেহ নেই যে নারীদেহ সবসময়েই পবিত্র, তা কখনোই উচ্ছিষ্ট হয় না। প্রমাণ, যে পঞ্চকন্যাকে স্মরণ করলে পুনর্জন্ম হয় না, তাঁরা কেউই ঠিক গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। আসলে, তাঁর জন্যে এ হেন যোগাযোগ একমাত্র ঈশ্বরই সৃষ্টি করতে পারেন। সেটা অস্বীকার করে তো তাঁকে ছোটো করা যায় না।
হঠাৎ তাঁর মনে হল, মেয়েটির যা অবস্থা, তাতে অখিলবাবুর উপরিটা সে সামলাতে পারবে তো? টেঁসে যাবে না তো? তা গেলে যাবে। তার তো মরে যাবারই কথা। মরেই গেছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। অখিলবাবু তো নিমিত্তমাত্র। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিলে আইনত কোনো দোষ হয় না। তবে, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। সেই ধারালো অস্ত্রওলা লোকটা যদি আবার ফিরে আসে, তাহলে গোলমাল। অখিলবাবু ঘরে ঢুকে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলেন।
একটু বাদেই অখিলবাবুর আর্তনাদ জানলা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল— ‘এ কী, এ কী, কে তুমি? তুমি বেঁচে আছ? সিরাজ যে বলল সে তোমাকে…’
তারপরেই একটা প্রাণফাটা হাহাকার মহিষবাথানের নিস্তব্ধ অন্ধকারটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।
পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে অখিলবাবু ডাকাতের হাতে নিহত হয়েছেন, কারণ তাঁর মানিব্যাগ, হাতঘড়ি, ফোন আর সদ্য কেনা বাটার হাশপাপি জুতো নিখোঁজ। কিন্তু কতগুলো খটকা তাদের রয়েই গেছে। যেমন, মহিষবাথানের বিশাল মাঠের মধ্যিখানে রাত্রি বেলা অখিলবাবু গিয়েছিলেন কেন? তাঁর গাড়িটা মধ্যমগ্রামের কাছে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ওই জায়গায় তিনি গেলেন কীভাবে? ডাকাত বা ডাকাতেরা তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে প্রায় উলঙ্গ করে একটা বাবলা গাছের নীচে ফেলে রেখে গিয়েছিল। তা করতেই পারে। কিন্তু অমন বীভৎসভাবে আঁচড়ে কামড়ে, চোখদুটো উপড়ে দিয়ে, কানদুটো ছিঁড়ে ফেলে, মুখটা প্রায় চেনার অযোগ্য করে রেখে গেল কেন? এহেন নৃশংসতার কি প্রয়োজন ছিল?