ছুটি কাটাল অনুপম
ছেলেবেলা থেকেই রাকাকে ভয় পেয়ে আসছে অনুপম। অথচ, শাস্ত্রমতে রাকাকে জন্মাতে দেখেছে সে। সেদিনের কথা অবশ্য ওর মনে নেই, তবে একটা দৃশ্য ওর স্পষ্ট মনে পড়ে। ষোলো নম্বর প্রভাত ঘোষ রোডের ওদের বাড়ির সামনের লনে ওরা দু-জন খেলছে। অনুপম তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে আর রাকা ক্লাস টু-তে। স্কুল-স্কুল খেলা। রাকা টিচার আর অনুপম ছাত্র। ভীষণ কড়া টিচার রাকা। অনুপমকে নানারকম শাস্তি দিচ্ছে আর সে বেচারি সব শাস্তি মাথা পেতে নিচ্ছে। আর দোতলার বারান্দায় অনুপমের মা সেই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন।
রাকার বাবা বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন দশ নম্বরে। মস্ত পণ্ডিত মানুষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন আর দেশে-বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। রাকার মা সেইজন্যে বছরে অনেকটা সময়ই তাঁকে ছাড়াই কাটাতে বাধ্য হতেন।
রোজ বিকেলে রাকা আসত ষোলো নম্বরের লনে খেলতে। আরও অনেক ছেলেমেয়ে আসত, তবে রাকার প্রতি অনুপমের মা-র একটা বিশেষ স্নেহ ছিল। তাঁর মেয়ে ছিল না। এই ফুটফুটে বাচ্চাটি তাঁর সেই অভাব কিছুটা পূরণ করেছিল। প্রায়ই দেখা যেত, অনুপমের মা-র পেটের ওপর বসে রাকা তাঁর দেওয়া চকোলেট চুষতে চুষতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে আর উনি মুগ্ধ বিস্ময়ে সেসব শুনে যাচ্ছেন।
এর ফলে অনুপম আর ছোটো ভাই রূপমকে রাকার অনেক অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হত। মাকে বলে লাভ নেই, কারণ তাঁর বিচারে রাকা সবসময়েই বেকসুর খালাস পেয়ে যেত। অনুপমের মাঝে মাঝে মনে হত ওর মা রাকাকেই ওর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। রাকার মা শান্ত, নির্বিরোধ মানুষ। তিনি অনুপমের মা-র মনের ব্যাপারটা বুঝতেন। সেজন্যে মাঝে মাঝে ‘মেয়েটাকে বেশি আস্কারা দিও না তো, শমিতা,’ বলা ছাড়া আর বিশেষ কোনো প্রতিবাদ করতেন না। তা ছাড়া, রাকা যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকে ততক্ষণ তিনি একটু অবসর পান— এটাও কম কথা ছিল না।
রাকা যখন আর একটু বড়ো হল, তখন তার প্রতাপ আরও বাড়ল। অনুপম তো দূরস্থান, ওর বাবা নির্মল মজুমদার পর্যন্ত তার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন। কে বলবে যে ভদ্রলোক একটা কোম্পানির দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেনারেল ম্যানেজার। রাকার সামনে একেবারে কেঁচো। আর অনুপম তো অনবরত ‘আঃ অনুপমদা, তুমি কিচ্ছু বোঝো না’ বা ‘অনুপমদা, তুমি একবারে বোকা’ বা ‘অনুপমদা, তুমি কিচ্ছু জানো না,’ শুনতে-শুনতে একেবারে জেরবার হয়ে গেল। সবাইকে বকে, ধমকে, তরিবত শিখিয়ে মজুমদার বাড়িটা সিধে করে রাখত রাকা।
অনুপমের মাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে এক রবিবার বিকেল বেলা চায়ের টেবিলে শমিতা বললেন, ‘রাকা তুই তো বড়োই হয়ে গেলি প্রায়। অনুপমকে বিয়ে কর-না, তাহলে সবসময় আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবি।’
শুনে নির্মল সমেত বাকি চারজনই প্রায় তাদের চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যাচ্ছিল। অবশ্য চারজনের পড়ে যাওয়ার কারণ চাররকম— নির্মল শঙ্কিত, রূপম সন্দিগ্ধ, অনুপম স্তম্ভিত। আর রাকা? রাকার হাসি আর থামে না।
কোনোরকমে হাসি সামলে বলল, ‘তুমি যে কী বলো মাসি! অনুপমদাকে বিয়ে করব কী! অনুপমদা তো একেবারে বাচ্চা ছেলে।’
শুনে অনুপম তো রেগেই গেল। বলল, ‘ওঃ আমি আমি বাচ্চা ছেলে আর তুই বুড়ি হাবড়ি না? তোকে কে বিয়ে করছে রে? আমি জঙ্গলে গিয়ে থাকব, তবু তোকে বিয়ে করব না।’
‘এঁঃ! জঙ্গলে গিয়ে থাকবে! সেদিন রামধনের গোরুটা মাথা নেড়েছিল বলে যা ছুট মেরেছিলে। গোরুকে যে ভয় পায় সে কখনো জঙ্গলে থাকতে পারে?’
‘ভয় পাব না তো কী? আমি তো ভেবেছিলুম গোরুটা শিং নেড়ে আমাকে গুঁতো মারতে আসছে। তোর জন্যেই তো। রামধন গোয়ালার বাগান থেকে সাদা জবা চুরি করতে বলেছিলি কেন? দিইনি তোকে সেই ফুল এনে?’
নির্মল বললেন, ‘তুই রামধনের বাগান থেকে ফুল চুরি করেছিস? তোকে ধরলে তো মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে দিত রে। আর ও-কাজ করিসনি।’
শমিতা মুচকি হেসে বললেন, ‘রামধন তো এখন বুড়ো হয়ে গেছে। তুমি যখন ওর বাগান থেকে ফুল চুরি করতে তখন তো ও জোয়ান ছিল, ওর বাবাও বেঁচে ছিল। ধরা পড়লে দু-জনে মিলে তোমাকে একেবারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দিত।’
অনুপম ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুমিও বাবা?’
নির্মল মুখে একটা অটল গাম্ভীর্য় রাখার প্রচণ্ড প্রয়াস করতে করতে বললেন, ‘উপায় ছিল না। তোর মা ওই ফুলই চাইত কিনা।’
অনুপম হাত-পা ছুঁড়ে বলল, ‘আমিও তো তাই। রাকা বলল।’
রাকা মুখ ভেংচে বলল, ‘এঃ রাকা বলল! জানো মাসি। সেদিন বললুম, অনুপমদা এই সুচটায় একটু সুতো ভরে দেবে? কত কী যে করল! থুতু লাগিয়ে সুতোটা ন্যাতপেতে করে দিল, দু-বার হাত থেকে সুঁচ ফেলে দিল, তারপর খোঁচা খেল, শেষটা সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল।’
শমিতা হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওরে, ও তো তাও চেষ্টা করেছিল। ওর বাবা হলে চেষ্টাই করত না।’
অনুপমের মাধ্যমিক পরীক্ষার পর হঠাৎ মজুমদার বাড়িতে অশান্তির কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। অনুপম যে সব ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল তা নয়, কিন্তু এটুকু জেনেছিল যে ওর বাবার কোম্পানিতে গণ্ডগোল বেধেছে। মাঝে-মাঝেই ওঁর বাড়ি ফিরতে দেরি হতে লাগল। একদিন একদল লোক লাল ঝাণ্ডা নিয়ে এসে বাড়ির সামনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ঢিল ছুড়ে জানলার কাচ ভেঙে দিল। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। ঘণ্টাখানেক বাদে পুলিশ এসে ভিড় সরাল। তার পরদিন থেকে ওর বাবা অফিসে যাওয়া বন্ধ করলেন। অনুপম শুনল ওদের কোম্পানিতে লক আউট। কিছুদিন বাদে নির্মল দিল্লি চলে গেলেন। শমিতা আর দুই ছেলেকে শ্যামপুকুরে ওদের মামাবাড়িতে রেখে গেলেন। যেদিন ফিরে এলেন, সেদিন দুপুর বেলা দুই ভাই জানতে পারল যে তারা বিদেশে যাচ্ছে বাবা-মার সঙ্গে।
শমিতা বললেন, ‘তোদের বাবার কোম্পানি কলকাতার অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ওঁকে আর তোদের সুধীরকাকুকে ওদের হংকং অফিসে ভালো পোস্টে অফার দিয়েছে। আমরা পরশু দিনই চলে যাচ্ছি। ভাগ্যিস আমাদের পাসপোর্ট করানো ছিল, তাই একসঙ্গেই যেতে পারব আমরা।’
‘আমার পড়াশুনোর কী হবে?’ জিগ্যেস করল অনুপম।
‘তুই ওখানেই পড়বি। তোর ছোটমামাকে বলে দিচ্ছি। ও তোর রেজাল্ট বেরুলে সব কাগজপত্র ওখানে পাঠিয়ে দেবে।’
সেই রকমই হল। পরদিন সন্ধে বেলা নির্মল আর শমিতা বেরিয়ে গেলেন। অনেক রাত্রে ফিরলেন চারটে সুটকেস নিয়ে। শমিতা কাঁদছিলেন কিন্তু নির্মলের মুখ ছিল গম্ভীর, বিষণ্ণ আর চিন্তিত। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এক সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পা বাড়াচ্ছিলেন নির্মল। তাঁর তো চিন্তিত হওয়ারই কথা।
অনুপম জানত যে, রাকারা তখন কলকাতায় নেই। একমাসের ছুটিতে ওর বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছিল পুরী বেড়াতে। কাজেই ওকে কিছু বলে আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
হংকং-এ গিয়ে শান্তশিষ্ট নিরীহ বাঙালি পরিবারটি হঠাৎ প্রচণ্ডবেগে ছুটতে শুরু করে দিল। ওদের বাবা নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবলভাবে নিজেকে লিপ্ত করে দিলেন। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না— তাঁকে অনেক কমবয়েসি অথচ হংকং অফিসের পুরোনো লোকেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। দুই ভাই গিয়ে ভরতি হল আন্তর্জাতিক স্কুলে। সেখানেও প্রবল প্রতিযোগিতা, নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। আর আত্মীয়-বান্ধবহীন বিদেশে একা বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠে শমিতাও একটা চাকরি নিয়ে নিলেন। ফলে, এই নতুন পরিবেশে, নতুন জীবনযাত্রায়, কলকাতার একটি দুই বিনুনি করা, স্কার্ট পরা বারো বছরের ফর্সা গোলগাল মেয়ে কোথায় হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝে শ্যামপুকুর থেকে অথবা দুর্গাপুরে নির্মলের দাদা-বউদির কাছ থেকে চিঠিপত্র আসে কিন্তু তাতে রাকার কোনো উল্লেখই থাকে না। আর চিঠি লেখার ব্যাপারে অনুপমের চিরকালই অনীহা। কাজেই সে যে রাকাকে চিঠি লিখবে, তাও হয়ে উঠল না। ফলে, রাকার কথা আর কারুর মনেই রইল না।
কিন্তু, সত্যিই কি তাই? স্মৃতি থেকে কিছু কি একেবারে মুছে যেতে পারে বা মুছে ফেলা যায়? স্মৃতির ভেতরে কিছু হারিয়ে গেলেই তা লুপ্ত হয়ে যাবে— এটা বোধ হয় ঠিক নয়।
হংকং থেকে এ লেভেল পাশ করে অনুপম চলে গেল ইংল্যান্ডে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্য। ওর মেধা ছিল, হংকং-এর স্কুলের চাপ মেধাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ফলে ওর পরীক্ষাগুলোর ফল বেশ ভালোই হয়েছিল। এ ছাড়া আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল। পড়াশুনোর ফাঁকে-ফাঁকে কোনো বদ নেশার ভেতরে না-গিয়ে ও স্বাস্থ্যচর্চা শুরু করেছিল। বডি বিল্ডিং নয়— ক্যারেটে, কুংফু জাতীয় নিরস্ত্র অবস্থায় আত্মরক্ষার কৌশলগুলো রপ্ত করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। ফলে ওর ভেতরে একটা শক্তির উদ্ভব হয়েছিল, যেটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যেত না। পেশিসর্বস্ব দৈত্যাকৃতি শরীর নয়, মাঝারি গড়নের দেহের ভেতর যে কতখানি ক্ষমতা গোপন ছিল সেটা যে ওর সঙ্গে আখড়ায় না-নেমেছে, তার পক্ষে সম্যক উপলব্ধি করা কঠিন ছিল।
বদ নেশা করুক বা না-করুক প্রকৃতি তো চুপ করে বসে থাকে না। জলে-স্থলে কত ছলে সে মায়াজাল গেঁথেই চলে, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন কর্ম। অনুপমও সেই জালে জড়িয়ে পড়েছিল প্রথমদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী স্বর্ণকেশী লিন্ডা লারসেন-কে দেখে স্বেদ, স্তম্ভন, মূর্ছা ইত্যাদি না-হলেও, বেশ ভালো মতোই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। ততোধিক ভালো মতোই প্রত্যাখাতও হয়েছিল। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হয়েছিল যে তার দুটো ফল হয়েছিল। প্রথমত আঘাতটা খুব গভীরে পৌঁছয়নি আর দ্বিতীয়ত ঠিক নির্বেদ উপস্থিত না-হলেও দিগ্বদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে এদিকে ঝাঁপ মারতে যাওয়াটা যে নির্বুদ্ধিতা সেটা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল।
দিগ্বদিকজ্ঞানলাভ মুলতুবি হয়ে গেল কয়েক মাস বাদেই। পড়াশুনোর চাপ এমন বাড়ল যে পাঠ্যক্রমের বাইরে অন্য কোনো ব্যাপারে জ্ঞানার্জনের সময়ই রইল না। সপ্তাহান্তে একটা সিনেমা হয়তো দেখা যেত, কিন্তু তাতেও বিবেকদংশনের হাত থেকে নিস্তার ছিল না।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এমএসসি করল অনুপম। তারপর একটা ইটালিয়ান কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে এল জাকার্তায়। এই কাজটা ওর পছন্দ হল কারণ এখান থেকে হংকং যাতায়াত করা খুব কষ্টসাধ্য বা ব্যায়সাপেক্ষ নয়। চাকরিটাও পাকা হল ছ-মাস বাদে। তার প্রায় বছর দেড়েক বাদে নির্মল ওকে ডেকে পাঠালেন।
নির্মল বললেন, ‘এই ছ-মাস আগে ঘুরে গেলি। আবার তোকে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হলুম। তোকে একবার কলকাতা যেতে হবে। ছুটি পাবি? আমি জানি, তোর এখন ভীষণ কাজের চাপ। তবুও…’
অনুপম বলল, ‘ছুটি পাওয়া কঠিন হবে। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। ব্যাপারটা কী? কলকাতা কেন?’
‘তোর ছোটোমামার ছেলে চিঠি লিখেছে। পত্রপাঠ আমাকে যেতে বলেছে। বাড়িটা নিয়ে কোনো গণ্ডগোল বেধেছে। লিখেছে, বাবা মারা যাওয়ার পর আমি সামলাতে পারছি না।’
‘কী গণ্ডগোল কিছু লিখেছে?’
‘বিস্তারিত কিছু লেখেনি। কিন্তু যা লিখেছে আমি তার ঠিক মানে বুঝতে পারছি না। লিখেছে যে আমাকে নাকি বাড়িটা বিক্রি করতে হবে। নইলে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমার বাড়ি। আমাকে সেটা বিক্রি করতে হবে— এর অর্থ কী তা তো বুঝতে পারছি না।’
‘আমার তো মনে হয় কারুর হয়তো বাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে। উনি ওটা কিনতে চান তাই ঝন্টুর ওপরে চাপ দিচ্ছেন। ও সেই চাপ সামলাতে পারছে না।’
‘আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু ও যে লিখেছে বাড়িটা বিক্রি করতে হবে— এই করতে হবেটা কেন? কীসের এই বাধ্যবাধকতা? মনে হচ্ছে এর মধ্যে আরও ব্যাপার আছে। তাই বলি কী, তুই যা। আমি বুড়ো হয়ে গেছি। হয়তো সবকিছু সামাল দিতে পারব না।’
‘ঝামেলা যখন, তখন বাড়িটা বিক্রি করে দিলেই হয়।’
কথাটা বলামাত্র নির্মল আর শমিতা দু-জনেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। নির্মল দৃঢ় গলায় বললেন, ‘না অনুপম, তা হয় না। আজ এই ন-বছর এই বিদেশে পড়ে আছি। একবারও যেতে পারিনি ঠিকই; কিন্তু স্বপ্ন দেখি যে আর পাঁচটা বছর কাটাতে পারলে রিটায়ার করে ওখানেই গিয়ে উঠব। ও-বাড়িতে আমার ঠাকুরদার কাছে শুনতুম ইতিহাসের কত গল্প, ওর লনে বাবার সঙ্গে ক্রিকেট খেলা হত, ওই বাড়িতেই তোর মাকে বিয়ে করে এনেছিলুম, তোরা বড়ো হলি। আজ সেইসব ভুলে এককথায় বাড়িটা বিক্রি করে দেব— তা হয় না। তোর যদি অসুবিধে থাকে তো বল। দরকার হলে আমি একাই যাব।’
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে অনুপম বলল, ‘না, না, আমার কোনো অসুবিধে নেই। আমি কালই জাকার্তা ফিরে গিয়ে ছুটি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় রওনা হচ্ছি।’
শমিতা বললেন, ‘হ্যাঁরে, তোর রাকাকে মনে আছে?’
‘রাকা? হ্যাঁ মা, মনে আছে। তোমার ইচ্ছে ছিল যে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, তাই না?’
‘হ্যাঁ। তুই যাচ্ছিস যখন, তখন ওদের একবার খোঁজ করে দেখিস।’
‘তা দেখব। তবে তোমার ইচ্ছেপূরণ হবে বলে তো মনে হয় না। সে যেন এতদিন তোমার জন্যে বসে আছে! কবে বিয়ে-থা হয়ে গেছে।’
‘তা হোক। তবু একবার খোঁজ নিস। আর তোরও তো বিয়ের বয়েস হল। দেখিস না, ওখানে যদি কাউকে তোর পছন্দ হয়। তোকে কিছু বলতে তো সাহস হয় না। তুই বিয়ে করবি, সেটা তোর ব্যাপার। তুই যাকে খুশি বিয়ে কর, আমরা কিছুই বলব না। তবে কী জানিস, বাঙালি মেয়ে বিয়ে করলে আর কিছু না-হোক, দুটো বাংলায় কথা বলে শান্তি পাবি।’
নির্মল হাত নেড়ে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। দিনরাত এই ইংরেজি বলতে বলতে জীবনটা একেবারে মরুভূমি হয়ে গেল। সেইজন্যেই তো কলকাতার আশায় বসে আছি। রিটায়ার করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাজার করব, কার্তিকের দোকান থেকে জিলিপি আর সিঙাড়া কিনে খাব আর বাড়ি ফিরে মৌরলা মাছের ঝোল দিয়ে একথালা ভাত মেরে দেব। ওই হারামদাজা রূপমটা যে একটা আমেরিকান মেয়ের পেছনে দৌড়ুচ্ছে— দুঃখ আছে ওর কপালে।’
হংকং থেকে জাকার্তার প্লেনে বসে অনুপমের মনে অনেক দিন আগে হারিয়ে যাওয়া রাকার স্মৃতিটা উঠে এল। সেই ফর্সা মোটাসোটা মেয়েটা ওর ওপরে অনেক দৌরাত্ম্য করেছে ঠিকই কিন্তু তাতে ওর কোনোদিনই খারাপ লাগেনি। ও বরং খুশিই হত। আচ্ছা, অনুপম কি রাকার প্রেমে পড়েছিল? প্রেম বলতে যা বোঝায় তা হয়তো সেই বয়সে ঠিক দানা বাঁধতে পারেনি, তবে রাকার প্রতি ওর যে একটা পক্ষপাতিত্ব গড়ে উঠেছিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। রাকা বললে যে কাজ— তা যতই কঠিন হোক না-কেন— অনুপম সানন্দে করত, অন্য কোনো মেয়ে বললে তা করত কি না সন্দেহ আছে।
রাকার এখন বয়েস কত হবে? বাইশ বোধ হয়। বিয়ে হয়ে গেছে কি না কে জানে? অনুপমকে দেখলে চিনতে পারবে কি এখন? ওর তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে এই ক-বছরে। সেই রোগাপটকা হাফপ্যান্ট পরা মাধ্যমিকের ছাত্র আর নেই। রাকাই বা এখন কেমন হয়েছে, তেমনই মোটাসোটাই আছে? তেমনই চঞ্চল আর ফূর্তিবাজ?
এসব প্রশ্নের যে উত্তরগুলো অনুপমের জন্য অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
এয়ারপোর্ট থেকে ঝন্টু অনুপমকে নিয়ে তুলল শ্যামপুকুরে। সেই বিশাল বাড়িটা আজ প্রায় ফাঁকা। মামারা সকলেই গত হয়েছেন। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইদের মধ্যে মাত্র দু-তিনজনই এ-বাড়িতে রয়েছে। বাকি সবাই বম্বে বা ব্যাঙ্গালোরে বা বিদেশে চলে গেছে, ফিরবে তার সম্ভাবনা কম।
ঝন্টু বলল, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে। তুই শুয়ে পড়। কাল সকালে তোকে প্রবলেমটা বলব।’
পরদিন সকালে প্রবলেমটা জানা গেল। ব্যাপারটা খুব গুরুতর বলে মনে হল না অনুপমের। যা ঘটছে তা হল— ষোলো নম্বর প্রভাত ঘোষ রোডের বাড়িটা হরিরাম বাজাজ বলে কলকাতার এক মস্ত প্রমোটার কিনে নিতে চান। তিনি সেখানে একটা মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাট বাড়ি তুলবেন। যত ফ্ল্যাট হবে তার মধ্যে পাঁচটা দেবেন নির্মল মজুমদারকে। খুব আধুনিক বাড়ি হবে। আগাগোড়া মার্বেল, দুটো লিফট, জেনারেটার ইত্যাদি। এক-একটা ফ্ল্যাট কমপক্ষে এগারো-শো স্কোয়ারফিট হবে। ঝন্টুর মতে এটা একটা অত্যন্ত ভালো লাভজনক প্রস্তাব। এটা অস্বীকার করাটা বোকামির চূড়ান্ত হবে।
অনুপম বলল, ‘এর জন্যে তুই আমাকে ডেকে আনলি? এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে চিঠিতে লিখে দিলেই হত। জবাব একটাই— নির্মল মজুমদার ও-বাড়ি বিক্রি করবেন না। খামোকা আমার দশদিনের ছুটি নষ্ট হল।’
ঝন্টু বলল, ‘শোন অনুপম, বিক্রি করব না বললেই হল না। তুই এই প্রোমোটারদের জানিস না। যে প্রপার্টির ওপর ওদের নজর পড়ে সেটা কবজা না-করা পর্যন্ত ওরা থামে না।’
‘আমার বাড়ি। আমি যদি না-বিক্রি করি তো কী করতে পারে এরা?’
ঝন্টু হাসল। বলল, ‘কী করতে পারে? কী করতে পারে না তাই জিগ্যেস কর। প্রথমত বাড়িতে, অফিসে লোক পাঠিয়ে, টেলিফোন করে ছোটোপিসি আর পিসেমশায়ের জীবন অতিষ্ঠ করে ছাড়বে। তাতে যদি না-হয়, তখন অত্যাচার শুরু করবে। তোদের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে তো দেবেই না, উলটে দরজা-জানলা সব খুলে নিয়ে যাবে। ইলেকট্রিক আর টেলিফোনের লাইন কেটে দেবে। আরও কত কী করবে তার সীমা নেই।’
অনুপম বলল, ‘বটে! তা বাবা-মা তো থাকেন হংকং-এ সেখানে কী করতে পারে এরা?’
‘আরে, হংকং তো কাছে। আমেরিকায় পর্যন্ত এদের গুণ্ডাবাহিনী আছে। এদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই। দরকার হলে খুনখারাপি করতেও এরা পিছপা হয় না।’
‘একটা সামান্য বাড়ির জন্যে এরা এত কিছু করবে?’
‘সামান্য বাড়ি? ওই বাড়ি থেকে কত টাকা লাভ হবে কল্পনা করতে পারিস?’
‘কত টাকা?’
‘একটা হিসাব কর। তোদের বাড়ির জমি হল দশ কাঠার একটু বেশি। ধর দশ কাঠা। তার মানে সাত হাজার দু-শো স্কোয়ারফিট। ওই রাস্তায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও হল তিন। তার মানে তুই যে বাড়ি তৈরি করবি ওখানে তার ফ্লোর এরিয়া হবে একুশ হাজার ছ-শো স্কোয়ারফিট। জমিটা তো কোনো দাম দিয়ে কিনছে না। তাহলে একুশ হাজার ছ-শো স্কোয়ারফিট তৈরি করতে যদি সাত-শো টাকা করে ধরিস তাহলে খরচা পড়ছে এক কোটি একান্ন লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। তোদের দেবে পাঁচটা ফ্ল্যাট মানে পাঁচ হাজার পাঁচ-শো স্কোয়ারফিট। তাহলে বিক্রি করার জন্য রইল কত? ষোলো হাজার এক-শো স্কোয়ারফিট। তোদের পাড়ায় এখন ফ্ল্যাটের দর যাচ্ছে খুব কম করে ধরলেও দু-হাজার টাকা স্কোয়ারফিট। তাহলে রোজগার হল কত টাকা? তিন কোটি বাইশ লক্ষ টাকা। প্রফিট কত? এক কোটি সত্তর লক্ষ আশি হাজার টাকা। এবার বল, এই টাকার জন্যে দু-চারটে খুন করা কি কোনো ব্যাপার?’
‘তুই বললি এটা আমাদের পক্ষে লাভজনক প্রস্তাব। কীভাবে?’
‘কীভাবে? পাঁচটা ফ্ল্যাটের দাম কত ভেবে দেখেছিস? এক কোটির ওপরে। কোনো ইনভেস্টমেন্ট বা ঝামেলা ছাড়াই। সেটা লাভজনক নয়?’
‘ইনভেস্টমেন্ট নেই কী বলছিস? এই প্রস্তাবে রাজি হলে বাবাকে যা ইনভেস্ট করতে হবে টাকায় তার হিসাব হয় না।’
‘সেটা কী?’
‘সে তুই বুঝবি না। এবার তুই অফিসে যা। আমি বাড়িটা একবার দেখে আসি।’
‘যা। কিন্তু ঢুকতে পাবি না। গেটে দরওয়ান বসিয়েছি। সে আমি সঙ্গে না থাকলে স্বয়ং বাজপেয়ীকেও ভেতরে ঢুকতে দেবে না। চিঠি লিখে দিলেও না। আর শোন, যেখানেই যাস ছ-টার মধ্যে এখানে ফিরে আসবি। বাজাজকে খবর দিয়েছি। সে আজ অফিসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যদি দেখাসাক্ষাৎ করতে হয় তো আজই করিয়ে দেব। ওকে যা বলার তুই-ই বলবি।’
ট্যাক্সি থেকে নেমে অনেকক্ষণ বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল অনুপম। বাড়িটা যেন কারুর আশায় চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে আছে। বন্ধ দরজা-জানলাগুলোর পেছনে কত হাসি, কত গান, কত আনন্দ যে ঢাকা পড়ে আছে সেটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। সামনের লনে বড়ো বড়ো ঘাস গজিয়েছে, পেছনের বাগানটা শুকিয়ে গেছে, তবু যেন তার হৃদপিণ্ডটা এখনও চলমান রয়েছে। সবকিছু একেবারে মরে যায়নি। বাড়িটা যেন সেই দিনের অপেক্ষায় বসে রয়েছে যেদিন তার দরজা-জানলাগুলো আবার খুলে যাবে, ভেতরে আলো জ্বলে উঠবে, কান্নাহাসির দোল দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা পুরোদমে আবার শুরু হয়ে যাবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুপম পেছন ফিরল। এবার যেতে হবে দশ নম্বরে। কিন্তু তার আগেই রাস্তার উলটোদিকের একটা বাড়ি থেকে একজন ভদ্রলোক ওকে ডাকলেন। পঞ্চাশের ওপরেই বয়েস হবে ভদ্রলোকের। মাথাভরতি টাক। কালো প্যান্ট, কালো টাই, সাদাশার্ট আর কালো কোট পরে ব্রিফকেস হাতে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলেন। বললেন, ‘আপনি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখছি। আপনাকে কি সুব্রত চ্যাটার্জি পাঠিয়েছেন?’
অনুপম বলল, ‘তা বলতে পারেন। সুব্রত চ্যাটার্জি আমার মামাতো ভাই।’
‘মামাতো ভাই? তার মানে আপনি কি নির্মলদার…?’
‘বড়ো ছেলে। আমার নাম অনুপম।’
‘আরে তাই তো! অনুপমই তো বটে! তুমি আমাকে চিনতে পারছ? আমি অ্যাডভোকেট পঙ্কজ পালচৌধুরি। আমাকে মনে আছে তোমার?’
‘নিশ্চয়ই মনে অছে পঙ্কজকাকু। আমরা যখন বাইরে যাই, তখন আপনি অনেক রোগা ছিলেন আর মাথাভরতি ছিল…।’
‘যাকগে, যাকগে। সেসব কথা মনে করিয়ে আর দুঃখ দিও না। শোনো অনুপম। তুমি কি আজ সন্ধে বেলা আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে? অনেক দরকারি কথা বলবার ছিল তোমার সঙ্গে।’
‘আজ তো পারব না কাকু। সন্ধে বেলা ঝন্টু মানে সুব্রত আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে বলেছে।’
‘তুমি কি তাহলে আজ দুটোর পর আমার সঙ্গে আলিপুর কোর্টে দেখা করতে পারবে? চার নম্বর বার লাইব্রেরি। ওখানে যাকে বলবে, সে-ই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবে।’
‘হ্যাঁ, তা যেতে পারি। আচ্ছা কাকু, দশ নম্বরের ব্যানার্জিদের কোনো খবর রাখেন?’
দু-জনে তখন পাশাপাশি হাঁটছিলেন। পঙ্কজ বললেন, ‘তা রাখি বই কী। তবে ওদের কোনো খবরই তো সুখের নয়। যাও না তুমি। ভারতীদি আছেন। ওঁর কাছেই সব খবর পাবে। আমি এখন তাহলে চললুম। দেরি হয়ে গেছে। তোমাদের সব খবরাখবর আজ দুপুরেই জেনে নেব, কেমন?’ বলে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে তাতে উঠে পড়লেন।
কোনো খবরই সুখের নয় এ কথার অর্থ কী? চিন্তিত, শঙ্কিত মনে অনুপম গিয়ে দশ নম্বরের বেল বাজাল। যিনি দরজা খুললেন, তাঁকে দেখে অনুপম একেবারে স্তম্ভিত।
এ কী চেহারা হয়েছে ভারতীমাসির! কাঠির মতো রোগা, দু-চোখের নীচে কালো ছায়া, মাথার চুল প্রায় ন্যাড়া করে কাটা, পরনে একটা আধময়লা থান।
ঘোলাটে চোখ তুলে ভারতী বললেন, ‘কে?’
অনুপম নিজের পরিচয় দেওয়ামাত্র ওকে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে উঠলেন ভারতী। বললেন, ‘অনুপম তুই! এতদিন পরে এলি? এতদিন একটা খবরও নিতে পারিসনি? বার বার ওর মুখে হাত বুলোন আর বলেন, ‘ইস! একেবারে শমিতার মুখটা বসানো।’
কান্নার বেগ কমলে আর ভারতীর কুশল প্রশ্ন শেষ হলে, অনুপম বলল, ‘মেসোমশাই তো চলে গেছেন, বুঝতেই পারছি। কী হয়েছিল?’
ভারতী বললেন, ‘সন্ন্যাস রোগ। প্রথম স্ট্রোকেই চলে গেলেন। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ছাত্ররা সঙ্গেসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যায়। জ্ঞান আর ফিরে আসেনি।’
‘কবে হল এই ব্যাপার?’
‘তোরা চলে যাওয়ার তিন বছর বাদে। রাকার মাধ্যমিকের তখন আর এক বছর বাকি।’
‘রাকা এখন কী করছে?’
প্রশ্নটা শুনে উদভ্রান্ত চোখে অনুপমের দিকে তাকালেন ভারতী। বললেন, ‘রাকা? সেই রাকা আর নেইরে? ও শেষ হয়ে গেছে।’ বলে আবার সজোরে কেঁদে উঠলেন।
‘শেষ হয়ে গেছে, মানে? রাকা নেই?’
কোনোরকমে কান্না থামিয়ে ভারতী বললেন, ‘না-না, বালাই ষাট। তবে না থাকারই মতো আছে। বেঁচে মরে আছে।’
‘ও কোথায়? কেউ কি ওর ওপরে অত্যাচার করছে?’
‘করছে বাবা। ওর ওপরে ভয়ানক অত্যাচার করছে। মেয়েটা আধমরা হয়ে রয়েছে, তাও কোনো নিস্তার নেই। আর এসব কথা কাউকে বলতে তো পারিনে। কেউ বিশ্বাস করবে না। তোকে বললুম। হয়তো তুই কিছু বুঝতে পারবি।’
‘কে ওর ওপরে অত্যাচার করছে মাসিমা?’
‘ওর স্বামী। আবার কে?’
‘কী করেন ওর স্বামী?’
‘কী আবার করবে? দু-বছর হল মরে গেছে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।’
শুনে অনুপম একেবারে স্তম্ভিত। একটু সময় লাগল ওর নিজেকে সামলে নিতে। বলল, ‘মরে গেছে? তবে যে বললেন, অত্যাচার করছে?’
‘তাই করছে বাবা। তোর হয়তো অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, তাই হচ্ছে।’
অনুপমের মনে হল অনেক শোকতাপ পেয়ে ভদ্রমহিলার মাথাটা গেছে। খুব সন্তর্পণে বলল, ‘আর একটু খোলসা করে বলবেন, মাসিমা?’
‘কী আর বলব? রাকার বাবা সারাজীবন শুধু ছাত্র পড়িয়েছেন, টাকাপয়সার কথা চিন্তাই করেননি। যখন চলে গেলেন, এই বাড়িটা আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি। খুব অর্থকষ্টে পড়েছিলুম তখন। দোতলাটা ভাড়া দিয়ে দিলুম। তাতে কিছুটা সাশ্রয় হল। এদিকে মেয়ে বড়ো হচ্ছে, তার বিয়ে দেব কী করে, সেই চিন্তায় অস্থির হলুম। রাকা যখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাশ করল, তখন অদ্ভুতভাবে একটা সম্বন্ধ এল। বউবাজারের নিত্যানন্দ মুখুজ্যেদের নাম শুনেছিস কি না জানি না। ওঁরা খুব শিক্ষিত পরিবার আর রঘুলাবাদের জমিদার। জমিদারি চলে গেছে কিন্তু চালচলন সেইরকম। ওঁদেরই ছোটোতরফের কৃষ্ণানন্দ মুখুজ্যের একমাত্র ছেলে নীলাঞ্জনের সঙ্গে সম্বন্ধ নিয়ে এল ওঁদেরই আরেক তরফের এক ছেলের বউ— সুমিত্রা। সে আবার আমার দূরসম্পর্কের ননদ। পণ লাগবে না, কিছু দিতে হবে না। সে তো আমার আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার অবস্থা।’
অনুপম জিগ্যেস করল, ‘কী কাজ করতেন এই নীলাঞ্জন?’
‘সে লাইব্রেরিয়ানশিপ পাশ করে কী একটা কলেজের লাইব্রেরিয়ানের কাজ করত। তবে ওদের যা সম্পত্তি তাতে চাকরি না করলেও চলত। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। পরে দেখা গেল, রাকাকে নীলাঞ্জন বাপের বাড়ি আসতে দিতে চায় না। কদাচিৎ সঙ্গে করে আনে, সঙ্গে করে নিয়ে যায়। একা আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাত্রেও থাকতে দিতে চায় না।
আমি প্রথম প্রথম ভাবতুম, আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার বলে হয়তো আসতে দেয় না। পরে জানতে পারলুম তা নয়। নীলাঞ্জনের ছিল প্রচণ্ড সন্দেহ বাতিক। সে সন্দেহ করত যে রাকা এমন সুন্দরী যখন তখন নিশ্চয়ই পাড়ার কোনো ছেলের সঙ্গে ভাব আছে। একা এলে বা রাত্রের অন্ধকারে ও যদি তার সঙ্গে পালিয়ে যায়। রাকার কারুর সঙ্গে ভালোবাসা আছে বা ছিল কি না জানবার জন্য প্রথম দিকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করত, পরে সোজাসুজি, তারপরে মারধোর। ছেলেটা চাকরি ছেড়ে দিল। দিনরাত রাকাকে পাহারা দেয়। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ হল। এমনকী আমার সঙ্গে কথা বললেও আড়ি পেতে শুনত।
অনেক বুঝিয়েছিলেন ওর বাবা-মা। কৃষ্ণানন্দবাবু তো অত্যন্ত ভালো লোক। ওঁর স্ত্রী প্রথমদিকে ছেলের দিকে টেনে কথা বলতেন। ছেলে যে বউকে বাপের বাড়ি যেতে দেয় না বা তার মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করতে দেয় না আর সবসময় তার ওপর খবরদারি করে তাতে তিনি খুশিই ছিলেন। পরে উনিও ভয় পেয়ে যান। ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয়, সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওঁদের কিছু করবার ছিল না। একমাত্র ছেলে, ছোটোবেলা থেকে শুধু আদরই দিয়ে এসেছেন, শাসন করেননি। তাই এই বয়েসে সে প্রশ্নই আর উঠতে পারে না।
অথচ, রাকা কী বলত জানিস? বলত, নীলাঞ্জন মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না। ওর ভেতরে দয়ামায়া ছিল, অন্যের দুঃখকষ্টে বিচলিত হত, তাদের সাহায্য করত। কিন্তু রাকা যে কষ্ট পাচ্ছে, তার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে, সেটা বুঝতেই পারত না। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ওর ঘরের চৌহদ্দির বাইরের জগৎটা ভয়ানক নোংরা। সেখানে যারা ঘুরে বেড়ায় তারা সবাই মানুষের মুখোশ পরা রাক্ষস, কেউ সৎ নয়, কেউ সরল নয়। অতএব সে যা করছে সেটা রাকার ভালোর জন্যেই করছে। রাকাকে সৎপথে রাখা এবং তার শরীরটাকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তো তার। অতএব সে সবসময় রাকাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখাই উচিত বিবেচনা করত। রাকা বলত, এটা একটা অসুখ, মনের অসুখ।’
অনুপম জিগ্যেস করল, ‘আপনি কী বলেন?’
‘আমি তো বলি যে এটা ওর স্বভাব। বাবা-মা সারাজীবন পুতুপুত করে রেখেছেন আর সেইজন্যে বাইরের জগৎটা সম্পর্কে ওর মনের ভেতরে একটা অবিশ্বাস আর আতঙ্ক জন্মে গেছে। অসুখ সারানো যায়, স্বভাব সারানো যায় না। ওই যে কথায় বলে না, স্বভাব যায় না মলেও। এর মতো খাঁটি কথা আর হতে পারে না।’
‘রাকা চলে এল না কেন বাড়ি ছেড়ে?’
‘তার দুটো কারণ ছিল। প্রথমত ভয়ে। ও জানত যে বেরিয়ে এলে নীলাঞ্জন ঠিক আসবে পেছনে পেছনে আর হয়তো রাগে উন্মাদ হয়ে ওকে মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে। আর দ্বিতীয়ত বাড়ি ছেড়ে যাবে আর কোথায়? আমার তো এই অবস্থা। দু-জনের চলবে কী করে? রাকা যে চাকরি নেবে তার উপায় নেই। শুধু হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাশ করে কোনো ভদ্রস্থ চাকরি আজকাল পাওয়া যায় না। আর নীলাঞ্জন যা ভাবত তার কিছুটা তো সত্যি। একটা সহায়-সম্বলহীন সুন্দরী মেয়ে এই শহরে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে? তাই সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। যুক্তি দিয়ে তর্ক করে নীলাঞ্জনকে বোঝাতে চেষ্টা করত। কোনো লাভ হয়নি।’
‘রাকা এখন কোথায় আছে?’
‘ওই বাড়িতেই। যাবে কোথায়? যেখানেই যায়, ওর পেছনে পেছনে নীলাঞ্জন গিয়ে উপস্থিত হয়।’
‘কী করে বোঝেন?’
‘ধর, ও আমাদের এই বাড়িতে এল। পাঁচ মিনিট যেতে-না-যেতেই ওর শরীরের কোথাও, হয় পেটে, নয় পায়ে, নয়তো মাথার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে। যতক্ষণ-না বাড়ি ফিরে যাবে ততক্ষণ চলতেই থাকবে।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’
‘দেখিয়েছি। নানারকম টেস্ট হয়েছে। কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু যে রাকাই যন্ত্রণা পায় তা তো নয়, অন্য লোকেও পায়। ও যদি বাজারে যায় সঙ্গে ওর শ্বশুর থাকেন, তখন যদি কেউ ওর দিকে একটু বেশি সময় তাকাল, তো ব্যস। সে লোকটা হয় পা পিছলে পড়ে হাত ভাঙবে, নয়তো বঁটিতে আঙুল কেটে রক্তারক্তি করবে, নয়তো তার মাথার ওপর টালি খসে পড়বে।’
অনুপম এবারে আর হাসি চাপতে পারল না। বলল, ‘মাসিমা, এই যুগে বসে আপনি এসব কথা বিশ্বাস করেন? এক কাজ করুন। আমাকে রাকার টেলিফোন নম্বরটা দিন। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।’
ভারতী বললেন, ‘তা দেব। কিন্তু সাবধানে থাকিস বাবা। তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না, জানি। এখন দ্যাখ, যদি রাকার সঙ্গে কথা বলতে পারিস।’
‘কথা বলতে পারব না বলছেন? ওকে টেলিফোন ধরতে দেবে না?’
‘ওর বাড়ির লোক দেবে। নীলাঞ্জন দেবে না। চেষ্টা করে দ্যাখ।’
প্রভাত ঘোষ রোডের মধুবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে প্রচুর পরিমাণে রাধাবল্লভী আর আলুর দম খেয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আলিপুর কোর্টের দিকে রওনা হল অনুপম। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ও ভাবছিল যে কী করুণ অবস্থা হয়েছে ভারতী মাসির। তাড়াহুড়ো করে রাকার বিয়েটা দিয়েই ভুল করেছিলেন ভদ্রমহিলা। ওকে অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করতে দেওয়া উচিত ছিল; তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াত না। যেসব ঘটনাগুলো বললেন তাদের কোনোটাই অতিপ্রাকৃত বলে মনে হল না অনুপমের। এদের প্রত্যেকটারই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বেচারি রাকা অকারণে কষ্ট পাচ্ছে। আজ সন্ধে বেলা ফোন করে দেখতে হবে ব্যাপারটার গুরুত্ব কতখানি।
আলিপুর কোর্টে অ্যাডভোকেট পঙ্কজ পালচৌধুরিকে খুঁজে বের করল অনুপম। ছোটো ছোটো নোংরা কাপে চা খেতে খেতে কথাবার্তা শুরু হল। কুশল প্রশ্নাদি শেষ করে পঙ্কজ বললেন, ‘তুমি হঠাৎ এখানে এসেছ কেন? তোমাদের বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করতে কি?’
মাথা নেড়ে অনুপম বলল, ‘প্রায় ঠিকই বলেছেন। আমি এসেছি বাড়িটার কোনো ব্যবস্থা না-করতে।’
পঙ্কজ হাসলেন। বললেন, ‘বুঝেছি। বাড়িটা বিক্রি করতে চাও না, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই বটে।’
‘পারবে বলে মনে হয় না। তেমন-তেমন সম্পত্তি হলে যারা বাড়িতে বাস করছে তাদেরই বের করে ছাড়ছে প্রোমোটাররা। তোমরা তো প্রবাসী। আটকাতে পারবে? এরা বড়ো বিপজ্জনক লোক।’
‘ঝন্টুও সে-কথাই বলছিল।’
গম্ভীর হয়ে গেলেন পঙ্কজ। বললেন, ‘কী করেন তোমার এই মামাতো ভাইটি?’
‘একটা জুটমিলের কলকাতার হেডঅফিসে চাকরি করে। পারচেস ডিপার্টমেন্টে।’
‘তোমাদের বাড়িটা কি উনিই দেখাশুনো করেন?’
‘হ্যাঁ। আগে ছোটোমামা, মানে ওর বাবা করতেন। বছরখানেক আগে ছোটোমামা মারা গেছেন। এখন ও দায়িত্ব নিয়েছে।’
‘দায়িত্বটা কী স্বেচ্ছায় নিয়েছেন না তোমার বাবা দিয়েছেন?’
‘বাবাই দিয়েছে। ও কোনো আপত্তি করেনি।’
‘তুমি হয়তো ভাবছ আমি কেন তোমাকে এত জেরা করছি, তাই না? কথাটা তোমাকে তাহলে পরিষ্কার করে বলাই ভালো। তোমার এই ভাইটি সম্পর্কে একটু সাবধানে থাকবে। বিশেষ কোনো কথা বলবে না। পেটের কথা মুখে আনবে না।’
‘ঝন্টুর সম্পর্কে সাবধানে থাকতে হবে? কেন?’
‘কিছু মনে কোরো না। তোমার মামা ছিলেন দেবতুল্য লোক। তোমার ভাইটি কিন্তু তা নয়। তার নানারকম বদ নেশা আছে। সেসব খবর তোমার সমস্ত জানা তো সম্ভব নয়।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘তার জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। তোমার ছোটোমামা গত হওয়ার পর একজন খুব সৎ আর ভদ্র প্রোমোটারকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলুম। অত্যন্ত অভদ্রভাবে উনি আমাদের প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েছিলেন। এমনকী আমি নির্মলদার ঠিকানা চেয়েছিলুম। তা-ও দেননি। অথচ, এই মাসতিনেক আগে সেই ভদ্রলোকই একটা বিরাট গাড়িতে করে হরিরাম বাজাজকে এনে বাড়িটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখালেন।’
‘এই লেনদেনে ঝন্টুর কিছু প্রাপ্তিযোগ আছে, এই তো?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেইজন্যেই বলছি, শুধু একজনের কথায় নেচো না। ভালো করে বাজিয়ে নাও। তোমার ওই বাড়ি কিন্তু সোনার খনি।’
‘ওটা আমাদের বসত বাড়ি।’
‘হ্যাঁ, তা তো বটেই। তবে সোনার খনির ওপরে বাড়ি থাকলে সেটা কি রাখা চলে? তবে হ্যাঁ, বিক্রি যদি নেহাত-ই না-করতে চাও এবং বাড়িটা বাঁচাতে চাও, তাহলে ওই সুব্রত চ্যাটার্জির ওপর নির্ভর কোরো না। হরিরাম তোমাদের কিছুতেই টিঁকতে দেবে না। বরং অন্য কোনো রাস্তার কথা ভাবো।’
‘কে এই হরিরাম বাজাজ? একে আপনি চেনেন?’
‘আমি আলিপুর কোর্টের উকিল। আমি ওকে চিনব না? হাড়ে-হাড়ে চিনি। এই কোর্টেই ওর নামে অন্তত পঞ্চাশটা কেস ঝুলছে। কাউকে টাকা নিয়ে ফ্ল্যাট দেয়নি। কোথাও একই ফ্ল্যাট তিনজনকে বেচেছে, কোথাও কর্পোরেশনের স্যাংশনের বাইরে কনস্ট্রাকশন করেছে, কোথাও ফ্ল্যাটে হেন দেব-তেন দেব বলে একগাদা টাকা নিয়ে সে-সব না-দিয়ে ভূসিমাল দিয়েছে। ওর কি গুণের কোনো শেষ আছে? কিন্তু কেউ ওর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারছে না। এত টাকা লোকটার। আইনের ও থোড়াই কেয়ার করে। যে ওর ল্যাজে পা দিয়েছে তাকে খুন করতেও ওর কোনো দ্বিধা নেই। করেছেও অনেক।’
‘এ তো ভয়ানক লোক দেখছি। ঝন্টু আমাকে হিসাব করে দেখাল যে আমাদের জমি থেকে প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকার প্রফিট ওঠানো যেতে পারে।’
পঙ্কজ বাধা দিয়ে বললেন, ‘এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা ওর হাতের ময়লা। ও অন্তত পাঁচ কোটি টাকা ফায়দা ওঠাবে ওখান থেকে। সিমেন্ট সরাবে, লোহা সরাবে, আমা ইঁট লাগাবে, ওঁচা টালি লাগাবে। তা ছাড়া, লেনদেনে যে কত কিছু করবে তার ইয়ত্তা নেই।’
‘চমৎকার! আপনি তাহলে কী করতে বলেন?’
‘দ্যাখো, বাড়িটা যদি বাঁচাতে চাও তাহলে হয় তোমরা এসে থাকো, তা না-হলে একজন কেয়ারটেকার বসাও। যেমন-তেমন কেয়ারটেকার হলে চলবে না। তাকে হরিরামের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো শক্তিমান হতে হবে। যাতে কেউ তাকে একটা চড় মারলে, সে উলটে পাঁচটা চড় কষাতে পারে।
‘এরকম লোক আমি পাব কোথায়? আমি তো এখানে কাউকেই চিনি না।’
‘আমাকে তো চেনো। আমি তোমাকে লোক দেব। নির্মলদার বাড়িটা রক্ষা করা আমারও কর্তব্য। আমার সন্ধানে এরকম কয়েক জন আছে। তারা আমার অত্যন্ত অনুগত। তাদের আমি কোনো-না-কোনো সময়ে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলুম। এখন তারা আমার কথায় ওঠে-বসে। তোমার বাবা যখনই কলকাতায় আসবেন তখনই ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমার। এখন যা ছিরি হয়েছে ওই বাড়ির! ঘাস কাটা হয় না, বাগানটা যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। আমি এসব একেবারে পালটে দেব। নির্মলদা একটা ঝকঝকে বাড়িতে ফিরে আসবেন।’
অনুপম যখন শ্যামপুকুরে ফিরল তখন পাঁচটা বাজে। ঝন্টুর ফিরতে তখনও দেরি আছে। ওর রান্নার লোক সাধুচরণের দেওয়া এককাপ চা নিয়ে টেলিফোনের সামনে বসল অনুপম। রাকাকে ফোন করাটা সেরে নেওয়া দরকার।
ফোন ধরল একটি নারীকণ্ঠ। প্রশ্ন হল, ‘কাকে চান?’
অনুপম বলল, ‘আমি কি একটু রাকার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
পুনরায় প্রশ্ন হল, ‘কে আপনি?’
‘আমি প্রভাত ঘোষ রোডের নির্মল মজুমদারের ছেলে অনুপম মজুমদার।’
টেলিফোনের ওপাশে যেন এক-শোটা সেতারের ঝংকার উঠল, ‘অনুপমদা। তুমি কোত্থেকে?’
তার পরেই গলাটা ভারী হয়ে এল, ‘আমরা তো ভেবেছিলুম তুমি বুঝি একেবারে হারিয়েই গেছ। আমার ফোন নম্বর পেলে কোত্থেকে? কবে এসেছ?’
‘তোর মা-র সঙ্গে দেখা করেছি আজ। উনি নম্বরটা দিলেন। এসেছি কাল রাত্রে।’
‘সব শুনেছ?’
‘হ্যাঁ। শুনেছি। তবে সবটা কি না জানি না। যা শুনেছি, সেটা কিন্তু মোটেই আনন্দজনক নয়।’
‘আনন্দ? আমার জীবন থেকে সব আনন্দ চলে গেছে, অনুপমদা। একটা অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে আছি। মাসি কেমন আছেন? মেসোমশাই? তোমরা?’
‘আমরা ভালো আছি।’ বলতে-বলতেই ফোনের মধ্যে একটা শব্দ শুরু হল। অনেকটা করাতকলে কাঠ চেরার আওয়াজের মতো। প্রথমে আস্তে, ধীরে ধীরে তার তীব্রতা বাড়তে লাগল।
অনুপম বলল, ‘এঁঃ! তোদের কলকাতার টেলিফোন একেবারেই যাচ্ছেতাই। এমন শব্দ হচ্ছে।’
গলা তুলে রাকা বলল, ‘কলকাতার টেলিফোনের দোষ নেই, অনুপমদা। ওটা আমার পরলোকগত স্বামীর কীর্তি! উনি আমাকে পরপুরুষের হাত থেকে রক্ষা করছেন।’
হঠাৎ অনুপমের মাথায় একটা প্ল্যান এল। বলল, ‘সেটা কোনো অন্যায় কাজ করছেন বলে তো মনে হয় না। সব স্বামীর, তা তিনি জীবিতই হন বা পরলোকগত হন, কর্তব্য হল তাঁদের স্ত্রীদের বদলোকেদের হাত থেকে রক্ষা করা। তোর স্বামী তো আমাকে চেনেন না। কাজেই তিনি যদি আমার সঙ্গে কথা বলতে তোকে বাধা দেন, তাহলে ভুল কাজ কিছু তো করছেন না।’
অদ্ভুতভাবে তৎক্ষণাৎ কাজ হল। আওয়াজের তীব্রতাটা কমে এল অনেকটা।
রাকা বলল, ‘না ভুল কাজ করছেন না! আমি তো একটা মানুষ, এইভাবে একটা বন্দী জন্তুর মতো বেঁচে থাকা সম্ভব?’
আওয়াজটা আবার বাড়তে শুরু করল।
অনুপম বলল, ‘তোর অসুবিধে হয়তো হচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী বল? দুনিয়াটা যে কত খারাপ সে বিষয়ে তোর কোনো ধারণাই নেই। এই তো আমাকেই দ্যাখ। বিদেশ থেকে এসে যে চক্করে পড়েছি— ভয়াবহ! আসতে-না-আসতেই। তুই চাস বা না চাস এই ভয়ংকর চক্র তোকে কেটে টুকরো টুকরো করার জন্য সবসময় বনবন করে ঘুরছে।’
আওয়াজটা আবার অনেকটা কমে গেল।
রাকা বলল, ‘একী! অনুপমদা! তুমি দেখছি একেবারে নীলাঞ্জনের মতো কথা বলছ।’
‘বলতেই হবে। তোর স্বামী বুদ্ধিমান পুরুষ ছিলেন। আর তুই-ই তোর মা-কে বলেছিস যে উনি ছিলেন সহৃদয় ভদ্রলোক। কাজেই উনি যা করছেন সেটা তোর ক্ষতি করার জন্য নিশ্চয়ই নয়।’
রাকা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, ‘বিদেশে থেকে তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে দেখছি!’
আওয়াজটা এখন আর প্রায় শোনাই যাচ্ছে না।
অনুপম বলল, ‘আমার বুদ্ধি কিচ্ছু লোপ পায়নি আর তোরও ঘটে কিছু বুদ্ধি আছে বলে জানতুম। একটু ভেবে দেখিস যে’, বলে আস্তে-আস্তে থেমে-থেমে বলল, ‘আমি যে তোর সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললুম তাতে তোর উপকার হল কি না।’
‘আমি কিছু ভেবে দেখব না। দেখতে চাই না।’
‘ছেলেমানুষি করিসনি। তোর সঙ্গে আমার একবার দেখা করা দরকার। এসব কথা টেলিফোনে হয় না। তোকে ভালো করে বোঝাতে হবে।’
‘আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি কাল সকালে টেলিফোন করো।’
‘তুই বেশি কথা বলিস না। আমি ওঁর সঙ্গে গিয়ে কথা বলব প্রথমে। তোর সঙ্গেও যা কথা তা ওঁর সাক্ষাতেই হবে— এই অনুমতিটা নিয়ে রাখিস।’
ক্ষীণকণ্ঠে জবাব এল, ‘তাই হবে, অনুপমদা।’
টেলিফোনটা রেখে চোঁ-চোঁ করে চা-টা শেষ করে ফেলল অনুপম। ওর বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা তখনও ধড়ফড় করছিল। চিতপাত হয়ে খাটে শুয়ে পড়ে মনে মনে বলল, ‘জিন্দাবাদ কৈতববাদ।’ তবে একটা সন্দেহ মনের মধ্যে রয়েই গেল— রাকা ইঙ্গিতটা ধরতে পারবে তো?
ঝন্টু ফিরল পৌনে ছ-টা নাগাদ। বলল, ‘তুই এসে গেছিস? চল তোকে বাজাজের অফিসে নিয়ে যাই। কাছেই অফিস।’
অনুপম বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া! ব্যস্ত হোসনি। চা-টা খা। আর ততক্ষণ তোকে ক-টা প্রশ্ন করি।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘আমি আজকে প্রভাত ঘোষ রোডে গিয়েছিলুম। সেখানে অ্যাডভোকেট পঙ্কজ পালচৌধুরির সঙ্গে দেখা হল। আলিপুর কোর্টের উকিল। তুই ওঁকে চিনিস?’
‘পঙ্কজ পালচৌধুরি? না তো। এরকম নামের কাউকে তো মনে করতে পারছি না।’
‘ভদ্রলোক না কি তোর কাছে একজন প্রোমোটারকে নিয়ে এসেছিলেন। তুই তাঁকে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছিলি।’
‘তা হতে পারে। গুচ্ছের প্রোমোটার, তাদের উকিল, কর্মচারী আর ফড়েরা এখানে এসেছে— তোদের বাড়ি নিয়ে কথা বলতে। আগে বাবা তাদের ঘাড়ধাক্কা দিত, এখন আমি দিই। এদের কাউকেই মনে করে বসে থাকিনি।’
‘এরা খবর পায় কী করে?’
‘এটা একটা প্রশ্ন হল? অমন একটা প্রপার্টি জলজ্যান্ত চোখের ওপর বছরের-পর-বছর তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে আর তার খবর এরা পাবে না? আজ থেকে নাকি? আজ অনেক বছর হল এরা আসছে আর ঘাড়ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে।’
‘এই বাজাজকে দিসনি কেন?’
‘দিতে গিয়েছিলুম। তখন দেখি আমারই ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা খসে যাওয়ার মতো অবস্থা।’
‘সে আবার কী?’
‘লোকটা খুব শান্ত গলায় আমাকে জানাল যে গ্লোব জুটমিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মি দয়াশঙ্কর টিকমানি ওঁর শ্যালক এবং তাঁকে বললে গ্লোবের পারচেস ডিপার্টমেন্টের জনৈক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়ের চাকরির ইতি হওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। আর, এতে যে ইউনিয়ন কোনো হস্তক্ষেপ করবে না সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। অতএব আমি যেন তাঁর এজেন্ট শ্রী পাঁচুগোপাল সাউ-এর সঙ্গে ব্যাকালাপ করি। তুই তো জানিস, এ বাজারে চাকরি গেলে কী অবস্থা হয়। তার ওপর নীলিমার বাবা-মা বিয়ের তারিখ স্থির করবার জন্য চাপাচাপি শুরু করে দিয়েছেন। কাজেই ঘাড় ধাক্কা না-দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলুম।’
‘তোকে টাকা অফার করেনি?’
‘তা-ও করেছে। এক লাখ টাকা কমিশন দেবে বলেছে। তবে পাঁচুগোপালের কাছে তার মালিকের গল্প যা শুনলুম তাতে ওই টাকাটা যে কাগজে কলমেই থাকবে আর আমার ব্যাঙ্কে কোনোদিনই ঢুকবে না, সে বিষয়ে দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশই নেই।’
‘আচ্ছা, যদি আমরা আমাদের বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার রাখি তাহলে কী হয়? বেশ পালোয়ান গোছের একটা লোক, যে বাড়ি পাহারা দেবে, বাজাজের আক্রমণ সামলাবে আর আমরা এলে বাড়িটা ছেড়ে দেবে।’
‘ছেড়ে দেবে? তুই গাধা নাকি রে? এরকম শাপভ্রষ্ট দেবতা আজ পৃথিবীতে কোথাও আছে?’
‘পঙ্কজ উকিল তো বললেন যে তাঁর সন্ধানে এরকম লোক আছে যে তাঁর কথা ঠেলতে পারবে না। ঠিক বাড়ি ছেড়ে দেবে।’
‘নাঃ! বিদেশে এত বছর কাটিয়ে তোর এখানকার হালচাল সব মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে দেখছি। তুই উকিলি প্যাঁচটা ধরতে পারলি না। পরে যদি বলে, বললুম তো। ছাড়ছে না। কী করি! তখন তুই কোথায় যাবি? বাজাজের প্রস্তাবে রাজি হলে অন্তত পাঁচটা ফ্ল্যাট পাবি। এক্ষেত্রে তোর বাড়িটা যাবে। একটা পয়সাও পাবি না। ভাবছিস কেস করবি? সে গুড়ে বালি। উকিলের সঙ্গে লড়ে জীবনেও পারবি না। পিসেমশাই রিটায়ার করে শান্তিতে থাকবেন, না কোট-কাছারি থানাপুলিশ করে বেড়াবেন? ওসব আইডিয়া ছাড়। এখন চল, বাজাজের সঙ্গে দেখা করে আসবি।’
‘বাড়ি আমার। বাজাজ খরিদ্দার। আমি কেন ওর কাছে যাব? আমি কি আলতা, সাবানের ফিরিওলা। দরকার হয় তো ও আসবে আমার কাছে।’
‘বেশ। আমি ফোন ধরিয়ে দিচ্ছি। তুই কথা বলে নে।’
বাজাজ বললেন, ‘আপনি যা বললেন অনুপমবাবু, সেটা বুদ্ধিমানের মতো কথা হল না। আজ কলকাতা শহরে অতবড়ো একটা সম্পত্তি রাখা যে কী খরচের ব্যাপার তা বোধ হয় আপনি জানেন না। বাড়ি পরিষ্কার রাখতে, সারাতে কত টাকা যে যাবে তার সীমা নেই। তার ওপর ট্যাক্স। ফতুর হয়ে যাবেন। কত বাঙালি ভদ্রলোক প্রথমে না-বলে পরে আমার কাছেই এসেছেন। আপনাদেরও আসতে হবে।’
অনুপম বলল, ‘বাড়ি পরিষ্কার রেখে সারিয়ে, ট্যাক্স দিয়ে ফতুর হয়ে আপনার কাছে যেতে সময় লাগবে হরিরামবাবু। আমার ছেলে হয়তো আপনার নাতির কাছে যাবে। কাজেই ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এখন কী লাভ?’
‘আপনাদের একটা সামাজিক কর্তব্যও তো আছে। কলকাতায় এত থাকবার জায়গার অভাব। সেখানে অতবড়ো একটা জমি আটকে রাখাটা অন্যায়।’
‘হরিরামবাবু, আপনি ওখানে ক-টা ফ্ল্যাট বিক্রি করবেন, ভাবছেন? দশটা? বারোটা? সেখানে যাঁরা আসবেন তাঁরা কেউই থাকবার জায়গার অভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে তো মনে হয় না। কাজেই ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা মুলতুবি রাখাই ভালো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আপনাদের ছ-টা ফ্ল্যাটই দেব। আপনার বাবার একটা দু-ভাই-এর দুটো। বাকি তিনটে ফ্ল্যাট বিক্রি করলে যা পাবেন তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। এটাই কিন্তু আমার শেষ প্রস্তাব। এবার খুশি তো?
‘ওরে বাবা! এ যে একেবারে কালনেমির লঙ্কাভাগ করে দিলেন আপনি। যাক, আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার বাবা এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না, এটা আপনি ধরে নিতে পারেন।’
হরিরাম বাজাজ এতক্ষণ খুব শান্ত, প্রায় ঘুমন্ত গলায় কথা বলতে যেন কষ্ট হচ্ছে, এইভাবে বাক্যালাপ করছিলেন। এইবার ওঁর কণ্ঠস্বরে একটু প্রাণের ছোঁয়া লাগল। বললেন, ‘রাজি না-হলে অবশ্য কিছু যায় আসে না। হরিরাম বাজাজ যা চায় সেটা সে নিয়ে থাকে। তবে তাতে কিছু খরচা আছে। সেটা পুষিয়ে নিতে আমার অফারটা হয়তো কমে যেতে পারে। সিধে আঙুলে যদি ঘি না-ওঠে তাহলে অন্য রাস্তা তো নিতেই হবে।’
‘ভালো কথা। আপনার যে রাস্তা খুশি আপনি নেবেন।’
সে রাত্রে হংকং-এ টেলিফোন করল অনুপম। নির্মল বললেন, ‘ঠিক কাজ করেছিস। আমি জীবনে কখনো অন্যায় শক্তির কাছে মাথা নীচু করিনি। তুইও করিস না। এক কাজ কর। এখানে চলে আয়। কী করবে বাজাজ? বাড়িটা দখল করে নেবে জোর করে? করলে করবে। তখন যদি লড়াই করতে হয়, তাই করা যাবে। তুই চলে আয়। আর বিপদে পড়লে ব্যারিস্টার পবিত্র গুপ্ত-র কাছে যাবি। আমার নাম করলেই হবে।’
অনুপম বলল, ‘তাই যাব। তবে ফিরব আর কয়েকটা দিন পরে। অন্য একটা প্রলেম আছে। সেটা মা-কে বলছি। মা-ই তোমাকে বলবে।’
রাকার কথা শুনে শমিতা বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে কী? তুই এক্ষুনি রাকার বাড়িতে যা। যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় ওকে উঠিয়ে নিয়ে শ্যামপুকুরের বাড়িতে নিয়ে আয়। ঝন্টুকে বলে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে ওকে যেন যত শিগগির সম্ভব হংকং-এ পাঠিয়ে দেয়। ততদিন ও সেজোবউদির কাছে থাকবে না-হয়।’
অনুপম হাসতে হাসতে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। অত ব্যস্ত হলে হয়? তোমাকে তো বললুম, ব্যাপারটা খুব সোজা নয়। আস্তে আস্তে এগোতে হবে, নইলে গণ্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা।’
মাঝরাতে ফোন এল আমেরিকা থেকে। রূপম মহা উত্তেজিত। বলল, ‘করেছিস কী দাদা! একদিকে ভয়ংকর ক্রিমিন্যাল অন্যদিকে বীভৎস ভূত! দুটো একসঙ্গে সামলাতে পারবি, না আমিও যাব?’
‘তুই এসে কী করবি? কোনো দরকার নেই। আমি একাই….’
‘আমি জানতুম। পুরো মজাটাই তোর চাই। শোন, আমি রেডি হয়ে থাকছি। যদি দেখিস ব্যাপার গুরুতর ফোন করবি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’
পরদিন ভোর বেলা পুলিশ এসে হাজির। একজন অফিসার আর দু-জন কনস্টেবল। অফিসার নিজের পরিচয় দিলেন শ্যামপুকুর থানার ওসি বলে।
ওসি বললেন, ‘আপনি গত পরশু রাত্রে হংকং থেকে কলকাতায় এসেছেন?’
অনুপম নির্বিকর মুখে বলল, ‘না।’
‘মিথ্যে কথা। আমাদের কাছে খবর আছে। দেখি আপনার পাসপোর্ট।’
‘আমি ভারতীয় নাগরিক। সবসময় পকেটে পাসপোর্ট নিয়ে ঘোরার কথা নয় আমার।’
‘আপনাকে এখুনি থানায় যেতে হবে। নীচে আমাদের গাড়ি আছে। আর এ-বাড়ি আমরা সার্চ করব। আপনি অনেক বেআইনি মাল এনেছেন হংকং থেকে।’
‘হংকং থেকে আসিনি যখন, তখন এই প্রশ্নই ওঠে না। আর বাড়ি সার্চ করতে ওয়ারেন্ট লাগে। সেটা এত তাড়াতাড়ি জোগাড় করে উঠতে পেরেছেন কি? আর থানায় আমি স্বেচ্ছায় যাব না। আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে হবে। তারও ওয়ারেন্ট তো আনেননি। কী ভেবেছে হরিরাম বাজাজ? আমি একটি মেষশাবক? এই ঝন্টু, তুই এই নম্বরে ফোন কর তো। ব্যারিস্টার পি কে গুপ্তকে ঘটনাটা বলবি। বলবি, নির্মল মজুমদারের ছেলের তরফ থেকে কথা বলছি।’
অফিসার বললেন, ‘ব্যারিস্টার দেখাচ্ছেন? ঠিক আছে। ভদ্রলোকের মতো যাবেন না যখন, তখন অ্যারেস্ট করেই নিয়ে যেতে হবে। আমি এবার ওয়ারেন্ট নিয়েই আসব। প্রস্তুত থাকবেন। পালাবার চেষ্টা করবেন না।’
‘আমি এখানেই থাকব। পালাবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।’
পুলিশ চলে যাওয়ার দশ মিনিট বাদেই ব্যারিস্টার গুপ্তর ফোন এল। বললেন, ‘কাল রাত্রেই আমি তোমার বাবার ফোন পেয়েছি। সব শুনেছি। এত তাড়াতাড়ি সব শুরু হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। তোমার কোনো ভয় নেই। যদি চাও তো ডিসি কে বলে আমি তোমার পুলিশ প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আর একটা কথা। আমি শ্যামপুকুর থানায় ফোন করেছিলুম। ওরা বলল, ওসি সকাল থেকে থানাতেই আছেন, কোথাও যাননি।’
ঝন্টু অফিসে যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘সাবধানে থাকবি। কাউকে ফ্ল্যাটের দরজা খুলবি না। কোথাও যাবি না। আর যদি কোথাও যাস, কোথায় যাচ্ছিস সেটা সাধুচরণকে জানিয়ে যাবি।’
কোথাও যাবি না বললে তো আর হয় না। ঝন্টু যাওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে অনুপম ফোন করল রাকার শ্বশুরবাড়িতে। ফোন ধরলেন কৃষ্ণানন্দবাবু। শান্ত, পরিশীলিত ভারী গলা। বললেন, ‘আমি বউমার কাছে শুনেছি যে আপনি ওর বাল্যকালের প্রতিবেশী এবং পরিচিত। আপনি ওর সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি অবশ্যই আসতে পারেন। কিন্তু এখানে এলে আপনার… ইয়ে… কিছু অসুবিধে হতে পারে। সে সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন?’
অনুপম বলল, ‘জানি।’
‘আপনি হয়তো এসব কথা বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আমরা করি। আর সত্যি কথা বলতে কী, করতে চাই। আমাদের একমাত্র সন্তান যে একেবারে চলে যায়নি, আমাদের কাছেই আছে— এই বিশ্বাসটা আমাদের বুড়োবুড়ির কাছে কত বড়ো সান্ত্বনা তা হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন।’
‘নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। আপনাদের ছেলে অত্যন্ত হৃদয়বান। তিনি যে অকারণে আমার কোনোরকম অসুবিধে হতে দেবেন না— এই বিশ্বাসও আমার আছে।’
কৃষ্ণানন্দবাবুর গলাটা এবার একটু তরল হল। বললেন, ‘তুমি, দেখছি যথেষ্ট সহৃদয় মানুষ। তুমি এসো বাবা। আজ বিকেলে, পাঁচটায়।’
সারা দুপুর অনুপম বাড়ির দলিলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে দেখল। কোথাও কোনো গলদ আছে কি না খুঁজে দেখল। পেল না। চারটে নাগাদ বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে বউবাজারের দিকে রওনা হল।
শিয়ালদার কাছাকাছি এসে ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘স্যার একটা নীলরঙের অ্যামবাসাডার আমাদের ফলো করছে বলে মনে হচ্ছে। গলিটলি দিয়ে বেরিয়ে যাব?’
অনুপম বলল, ‘না, দেরি হয়ে যাবে। আপনি যেমন যাচ্ছেন তেমনিই যান।’
বাড়িটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল। ঠিকানাটা বউবাজার স্ট্রিটের হলেও বাড়িতে ঢুকতে হয় একটা সরু কানাগলি দিয়ে কিছুটা ভেতরে ঢুকে। গলিটা নির্জন, যদিও সামান্য দূরেই বউবাজার স্ট্রিটের জনস্রোত বয়ে চলেছে।
অনুপম কলিং বেল বাজাতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, হাতে লাঠি, মাথার চুল একেবারে সাদা, বলিরেখাঙ্কিত বিষণ্ণ মুখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বললেন, ‘তুমিই অনুপম? ভেতরে এসো।’
দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে প্রকাণ্ড বসবার ঘর। একটা অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক সোফাসেট, একটা রাইটিং ব্যুরো, অনেকগুলো ছোটো ছোটো টেবিল, একটা আর্মচেয়ার আর দেয়ালে সম্ভবত পূর্বপুরুষদের কয়েকটা অয়েলপেন্টিং ঘরটা অলংকৃত করছে। এখানে আলো-হাওয়ার প্রবেশ বেশ সীমিত আর হয়তো সেইজন্যেই ঘর জুড়ে কেমন একটা ভ্যাপসা দম আটকানো গন্ধ।
কৃষ্ণানন্দবাবু বললেন, ‘তুমি বোসো। আমি বউমাকে ডেকে দিচ্ছি।’
অনুপম বলল, ‘না। আপনি রাকাকে ডেকে পাঠান। আপনি এখানেই থাকবেন। আপনার বউমার সঙ্গে যা কথাবার্তা তা আপনার সামনেই হবে।’ বলে একটা সিঙ্গল সোফার ওপর বসল। সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে হল যেন ওর পিঠের নীচে সোফার ভেতরে একটা মোটা সাপ কিলবিল করে নড়ছে। অন্য সময় হলে ও হয়তো চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠত। কিন্তু এরকমই কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল বলে, যথাসাধ্য নির্বিকার মুখে বসে রইল।
কৃষ্ণানন্দবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু বাদেই ফিরে এলেন। তাঁর পেছনে পেছনে এলেন একজন স্থূলকায়া বয়স্কা মহিলা আর তাঁর পেছনে রাকা। এই রাকা! সেই গোলগাল বাচ্চা মেয়েটির এত পরিবর্তন! এ যে অপূর্ব সুন্দরী! নাক-মুখ-চোখ-গড়ন— সব-ই যে নিখুঁত। ঊষার উদয়সম অনবগুণ্ঠিতা রাকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল অনুপম। কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পরেই সম্বিত ফিরে পেল। না-পেয়েও উপায় ছিল না। উঠে দাঁড়িয়েছিল অনুপম। ওর মনে হল ওর ট্রাউজার্সের ভেতরে দু-পা বেয়ে দুটো মাকড়সা জাতীয় জীব খড়খড় করে ওপরে উঠছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে প্রণাম করল বয়স্কা মহিলাকে।
মহিলা দু-জনও হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন অনুপমের দিকে। রাকার শাশুড়ি বললেন, ‘বেঁচে থাকো বাবা। দীর্ঘজীবী হও। চা খাবে তো? তুমি বসো। আমি চা করে আনি।’
অনুপম বলল, ‘না মাসিমা। চা খাব না। আমি অল্প সময়ের জন্য এসেছি। এখুনি চলে যাব। আপনি বসুন।’ তারপর রাকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই রাকা? তোকে তো চেনাই যায় না রে। কী সুন্দরী হয়েছিস তুই!’
রাকা হাসল। অসাধারণ হাসি। বলল, ‘তুমিও খুব হ্যান্ডসাম হয়েছ, অনুপমদা। একেবারে ফিলমস্টার মার্কা চেহারা।’
‘যা, যাঃ! ফাজলামি করিস না। আগে দুষ্টু ছিলি এখন ফাজিল হয়েছিস।’
মাকড়সা দুটোর ঊর্ধ্বগতি একটু কমল কিন্তু বন্ধ হল না। সবাই বসলে রাকা দু-টি নিরাভরণ হাত কোলের ওপর রেখে বলল, ‘কেমন আছ তোমরা? মাসি, মেসো, রূপমদা, তুমি?’
‘আমরা সবাই ভালো আছি। এবার শোন। আমি দশদিনের ছুটিতে কলকাতায় এসেছি। তোর কথা মা-কে ফোনে জানিয়েছি। তোর বিয়ে আর তার পরের ঘটনাগুলো আমরা কিছুই জানতুম না। তা, সে যাই হয়ে থাক না-কেন, মা তোকে একটা উপহার দিতে চান। আমাকে বলেছেন, তোকে জিগ্যেস করে এখান থেকে কিনে দিতে।’
ম্লান হাসল রাকা। বলল, ‘উপহার! আমাকে আর কী উপহার দেবে, অনুপমদা? তবে মাসির যখন ইচ্ছে তখন এইরকম একটা সবুজ পাড় মিলের শাড়ি কিনে দিও। কাজে লাগবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুপম বলল, ‘না, তা আমি দিতে পারব না। আচ্ছা, আমি যদি তোকে একটা রূপোর ফোটোফ্রেম দিই? তাতে তোর স্বামীর একটা ছবি লাগিয়ে রাখতে পারবি?’
বলতেই মাকড়সা দুটোর ঊর্ধ্বগতি বন্ধ হল। পিঠের নীচে সাপটার কিলবিল করাও স্থগিত রইল।
ঘাড় কাত করে রাকা বলল, ‘বেশ তাই দিও’ বলতে গিয়ে ওর ঠোঁটের কোণে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল। যে হাসির অর্থ একটাই। অনুপম বুঝল। ওর কাল রাতের ইঙ্গিতটা রাকা ধরতে পেরেছে।
অনুপম বলল, ‘এরকমভাবে কতদিন চালাবি, বল তো। পড়াশুনো শুরু কর না। বাড়িতে বসেই পড়। অন্তত বি এ-টা পাশ কর। একসময় না-একসময় তো তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।’
‘কোথায় নিজের পায়ে দাঁড়াব, অনুপমদা? কী হবে পড়াশুনো করে? বাড়ি থেকেই বেরুতে পারি না। একটা মেয়েদের গানের স্কুলে ভরতি হয়েছিলুম। সেখানে এমন উৎপাত শুরু করল যে লজ্জায় পালিয়ে এলুম।’
‘সেখানে নিশ্চয়ই কিছু অসৎ লোক ছিল। সেইজন্যেই তোর স্বামী তোকে বাধা দিয়েছেন। কিন্তু এরকমভাবে তো চলতে পারে না। আপনারা কিছু ভেবেছেন? আপনাদের অবর্তমানে রাকা কোথায় যাবে বা কী করবে?’
কৃষ্ণানন্দবাবু বললেন, ‘ভেবেছি বাবা। অনেক ভেবেছি, এখনও ভাবছি। কিন্তু কোনো সমাধানসূত্র খুঁজে পাইনি। আমাদের শরিকে শরিকে প্রবল ঝগড়াঝাঁটি। তাদের মধ্যে ও কোথাও আশ্রয় পাবে তা মনে হয় না। পেলেও সেখানে সসম্মানে থাকতে পারবে, তা মনে হয় না। ওর বাপের বাড়ি বা মামারবাড়ির দিকটাও ফাঁকা। যাঁরা আছেন তাঁদের কারুরই আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। ও এখন আমার মেয়ে। আমি আবার ওর বিয়ে দিতে চাই। কিন্তু পাত্র পাব কী করে? যে ক-জন কথাবার্তা বলতে এসেছিল, ভয় পেয়ে পালিয়েছে। নীলাঞ্জনকে দোষ দিই না, পরে জানতে পেরেছি তাদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল হয় আমার টাকা নয় ওর রূপ। একটা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর সংসার গড়ে তোলা কারুরই উদ্দেশ্য ছিল না। নিজের পায়ে না-দাঁড়াতে পারলে ও যে কোথায় যাবে জানি না। রাকা তোমার স্নেহের পাত্রী। দ্যাখো না, যদি ওর একজন উপযুক্ত পাত্র জোগাড় করে দিতে পারো।’ এই কথার মধ্যে রাকা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
অনুপম বলল, ‘আপনি কী বলেন মাসিমা?’
ভদ্রমহিলা কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। মাথা নেড়ে কিছু মন্তব্য করতে অস্বীকার করলেন। তাঁর চোখ ছলছল করে উঠল।
কৃষ্ণানন্দও উঠে দাঁড়ালেন। ডেকে বললেন, ‘এসো তো বউমা। আমরা অনুপমকে গলির মুখটা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
কলকাতায় তখন সন্ধ্যা নেমেছে। সদর দরজা খুলে দেখা গেল, গলিটা বেশ অন্ধকার। কেবল তার মুখের কাছটা বউবাজার স্ট্রিটের দোকানগুলোর উজ্জ্বল আলোয় কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। তিনজনে গলি দিয়ে দু-পা এগোতেই হঠাৎ চারজন লোক ওদের ঘিরে ফেলল। তাদের একজনের হাতে সাইকেলের চেন, অন্য তিনজনের হাতে লোহার রড। আরও দুটো লোক দেখা গেল নিঃশব্দে গলির মুখে এসে দাঁড়াল যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না-পারে।
চেনওয়ালা চেনটা ঘোরাতে ঘোরাতে অনুপমকে বলল, ‘এই যে চাঁদু! কলকাতায় এসে রংবাজি করছ, ভুলে গেছ এটা তোমার বিলেত নয়। আবার মেয়েছেলের সঙ্গে চক্করও চালাচ্ছ দেখছি। আজ তোমাকে এমন শিক্ষা দেব যে রংবাজি জীবনের মতো ভুলে যাবে?’
একজন রডওলা বলল, ‘মালটা কিন্তু খাপচু (খাসা) ওস্তাদ।’
কৃষ্ণানন্দবাবু বললেন, ‘একী? কে তোমরা?’
চেনওয়ালা বলল, ‘কে আমরা এখুনি দেখতে পাবে। অ্যাই আসগর, বুড়োটাকে চপ্পল (বাধা) দে তো।’
বলামাত্র দু-নম্বর রডওয়ালা কৃষ্ণানন্দবাবুর গলা ধরে তাঁকে দেওয়ালের গায়ে ঠেসে ধরল। শান্ত গলায় অনুপম বলল, ‘ওঁর গায়ে হাত দিও না। সাবধান করে দিচ্ছি।’
চেনওলা বলল, ‘ওরে আমার লাল্টুচাঁদ! উনি সাবধান করে দিচ্ছেন। ওরে তোরা সাবধানে থাকিস রে।’ চারজনে হেসে উঠল। ‘এই চিকনা, তুই আর ছোট্টু এই ধুরটাকে (লোকটাকে) কোটা করে ঝাড় (আচ্ছা করে পেটা)। ঠ্যাং ভেঙে দিবি, যেন হাঁটতে না-পারে। শালা, দোগলা (চরিত্রহীন)!’
অনুপম পূর্ববৎ বলল, ‘আমি আবার সাবধান করে দিচ্ছি। তোমরা চলে যাও।’
‘চোপ শালা! তখন থেকে সাবধান, সাবধান করছে।’
দু-নম্বর রডওয়ালা বলল, ‘ওস্তাদ, আমার পেটের ওপর কী কিলবিল করছে। সাপ না কি?’
‘কলকাতায় সাপ! হলে হবে। কামড়ালে দেখা যাবে। তুই বুড়োটাকে ধরে রাখ।’
বাকি দুই রডওয়ালা বলল, ‘আমাদেরও পায়ে কীসব সুড়সুড় করছে, ওস্তাদ।’
‘আরশোলা হবে। করুক। তোরা এটাকে ক্যালা (মার) আমি ততক্ষণ এই দো-তললিটার (বারাঙ্গনার) কদমা দুটোয় চারনি মেরে (চাপ দিয়ে) লি।’
অনুপম বলল, ‘এই শেষবার তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। পরে আমাকে দোষ দিও না।’
দুই রডওলা রড তুলে তেড়ে এল অনুপমের দিকে, আর চেনওয়ালা হাত বাড়াল আতঙ্কে মৃতপ্রায় রাকার দিকে।
হঠাৎ অনুপমের গলা দিয়ে একটা রক্ত জল করা হুংকার বেরিয়ে এল। একটা ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো শূন্যে লাফ দিয়ে উঠল সে। তারপর ওই সরু গলিটার মধ্যে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। একমিনিটও লাগল না। দেখা গেল তিন রডওয়ালা ঘাড় মুচড়ে তিনদিকে পড়ে আছে। তাদের মুখ রক্তাক্ত। হাত-পা গুলোর অবস্থাও খুব স্বাভাবিক নয় আর চেনওয়ালা অনড় হয়ে মাটিতে পড়ে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘মদনা’ কোল্কে ঝাড়, কোল্কে ঝাড় (পিস্তল চালা)।’ কে কোল্কে ঝাড়বে? গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ঘুরে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করতে-না-করতেই একটা লোহার রড ঘুরতে-ঘুরতে এসে তার মাথায় লাগল আর সে ‘বাপরে!’ বলে আর্তনাদ করে উলটে পড়ে গেল। ষষ্ঠজন বুদ্ধিমান লোক। সে আর দাঁড়াল না। সামনের ভিড়ে মিশে গেল।
অনুপম চেনওয়ালাকে কান ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। দেখা গেল, সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। একদিকে বেঁকে রয়েছে। তার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে অনুপম বলল, ‘তোমাদের নীল অ্যামবাসাডরটা আছে এখনও?’
লোকটা হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল। একটা ভাঙা দাঁত থুক করে মুখ থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘আর মারবেন না স্যার! যা বিলিতি মার মেরেছেন, তারপর আর দিশি চড়চাপড় মারবেন না। অ্যামবাসাডার স্যার? আপনি সেটাও জানেন? আছে স্যার।’
‘তোমার শাগরেদদের সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে, না আমি সাহায্য করব?’
‘পারব, স্যার। আপনি যান স্যার। আমরা ঠিক চলে যাব, স্যার!’
‘তাই যাও। আর এখানে যদি ভবিষ্যতে কখনো আসো, মনে রেখো, আমি তোমাদের জ্যান্ত চামড়া খুলে নেব।’
‘মনে রাখব, স্যার।’
রাকা আর অনুপম কৃষ্ণানন্দবাবুকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে এল। শুইয়ে দিল বড়ো সোফাটার ওপরে। রাকার শাশুড়িও দৌড়ে এলেন। বেশ কিছুক্ষণ শুশ্রূষার পর উঠে বসলেন ভদ্রলোক। স্ত্রীকে বললেন, ‘জানো মীরা, এই ছেলেটির জন্য শুধু যে আজ আমরা প্রাণে বেঁচে ফিরেছি তা নয়, আমাদের মানসম্ভ্রমও অক্ষত আছে। তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বাবা!’
অনুপম হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ একেবারেই জানাবেন না।’
রাকা বলল, ‘এ তো চীনাদের মারামারি। এটা কোত্থেকে শিখলে, অনুপমদা?’
‘খোদ চীনেদের কাছ থেকে। ওরা আমাকে একটা ব্ল্যাক বেল্ট উপহার দিয়েছিল।’
‘আজ নীলাঞ্জন বেঁচে থাকলে তোমাকে একেবারে হিরো বানিয়ে রাখত। ও তো দিনরাত টিভি-তে এই চীনেদের মারামারির সিনেমা দেখত। আমার মনে হত এসব সাজানো। আজ দেখলুম, তা নয়।’
‘না, একেবারেই তা নয়। এখন শোন। এই আক্রমণের আসল লক্ষ্য কিন্তু আমি। আমি যতদিন কলকাতায় আছি, ততদিন কোনোমতেই বাড়ি থেকে বেরুবি না।’ বলে কৃষ্ণানন্দবাবুকে সমস্ত ব্যাপারটা বলল।
কৃষ্ণানন্দ বললেন, ‘তুমি একা সামলাতে পারবে? পুলিশ কিন্তু তোমাকে খুব একটা সাহয্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। এরা স্থানীয় লোক, তুমি বিদেশে থাকো। কাজেই এদের এখানে যা ইনফ্লুয়েন্স তার কিছুই তোমার নেই। তারপর যা মনে হচ্ছে, এরা অতি বিপজ্জনক লোক।’
অনুপম বলল, ‘দেখি, কতদূর সামলাতে পারি। তবে একটা কথা কিন্তু আজ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়ে গেল। তা হচ্ছে, কোনো দেহধারী আক্রমণকারীকে একজন বিদেহীর পক্ষে বেশিক্ষণ আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাকে ভয় দেখিয়ে অস্বস্তিতে ফেলে হয়তো কিছুক্ষণ বাধা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যে স্থিরপ্রতিজ্ঞ গুণ্ডা তার পক্ষে এই ভয় বা অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না। এখনও পর্যন্ত যারা আপনার কাছে এসেছে তারা অসৎ হতে পারে কিন্তু অপরাধজগতের লোক নয়। তাদের চলাফেরা আলোতেই, অন্ধকারে নয়। কাজেই তাদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানো গেছে। কিন্তু আপনাদের অবর্তমানে যে শকুনের দল এসে এ বাড়ির ওপর পড়বে তাদের সকলেই না-হোক অনেকেই ভদ্রলোক হবে না। তাদের নীলাঞ্জন ঠেকাতে পারবেন কি? আপনারা কথাটা ভেবে দেখবেন।’
অনুপম যখন শ্যামপুকুর ফিরল, তখন প্রায় আটটা বাজে। ঝন্টু বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। ওকে দেখে ধমকে উঠল, ‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমি এদিকে চিন্তা করতে করতে অস্থির। সাধুচরণ বলল যে তুই নিজেই বেরিয়েছিস। ট্যাক্সি নিয়ে। কোথায় গিয়েছিলি?’
অনুপম খাটের ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আগে সাধুচরণকে এক কাপ চা দিতে বল, তারপর বলছি।’ চা খেতে খেতে রাকার সমস্ত কথা বলল অনুপম। তারপর জিগ্যেস করল, ‘রূপোর ফোটোফ্রেম কোথায় পাব বলতে পারবি?’
ঝন্টু হাত নেড়ে বলল, ‘দুত্তোর ফোটোফ্রেম! তুই কী আরম্ভ করেছিস? হরিরাম বাজাজকে সামলাতেই হিমশিম। এরপর কোত্থেকে নীলাঞ্জন মুখুজ্যের ভূত জুটিয়ে আনলি।’
‘আহা, আমি কি ইচ্ছে করে এনেছি নাকি? এসে গেলে কী করব?’
বিস্ফারিত চোখে ঝন্টু বলল, ‘কী করবি? দ্যাখ অনুপম ভূত গ্যাস খায় এরকম কথা আমি বাপের জন্মে শুনিনি। তুই ভাবছিস, গ্যাস খাইয়ে ভূত তাড়াবি? তুই একটি আস্ত পাঁঠা, বুঝলি? ওই কৃষ্ণানন্দবাবুকে ওঝা ডাকতে বল। ঝেড়ে ভূত ভাগিয়ে দেবে।’
‘তা হয় না। কৃষ্ণানন্দবাবু তো নীলাঞ্জনকে ভাগাতে চান না। অথচ রাকার একটা ব্যবস্থা করতে চান। আর ভূত গ্যাস খায় না তোকে কে বললে? তুই যে পুজো করিস, মন্ত্র বলিস, সেগুলো কী? দেবতাকে গ্যাস দেওয়া নয়? তা দেবতা যদি খেতে পারেন, অপদেবতা খাবে না এরকম কোনো আইন আছে? তুই একটা জিনিস বুঝতে পারছিস না— নীলাঞ্জন এতদিন, মানে জীবিত এবং মৃত অবস্থায় রাকার সঙ্গে যে ব্যবহার করে এসেছেন, সেটা সবাই নিন্দা করেছে, সমালোচনা করেছে। অথচ উনি জানেন উনি যা করছেন সেটাই ঠিক, যুক্তিযুক্ত। আজ আমার কাছে সমর্থন পেয়ে, আমার প্রতি নীলাঞ্জন যথেষ্ট…. ইয়ে হয়ে পড়েছেন, বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে একটা রফা হলেও হয়ে যেতে পারে।’
বলতে-না-বলতেই ফোন বাজল। বাজাজের ফোন। বললেন, ‘অনুপমবাবু আপনি আমার লোকেদের ড্যামেজ করিয়ে দিয়েছেন। এদের সারাই করতে আমার ভালোরকম পয়সা খরচ হবে। কাজেই পাঁচটাও নয়, তিনটে ফ্ল্যাট আপনারা পাবেন।’
অনুপম বলল, ‘বলেন কী? আপনার করুণা হৃদয়ে একেবারে গাঁথা হয়ে গেল যে!’
‘আমি কাল দুপুর বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি আমার প্রস্তাব না-মেনে নেন, তাহলে যা ঘটবে তার জন্য আমাকে দায়ী করবেন না!’
‘কী যে বলেন। তা কখনো পারি?’
বাজাজ দুম করে ফোন রেখে দিলেন। অনুপম তখন ব্যারিস্টার গুপ্তকে ফোন করে সব ঘটনাটা জানাল। ভদ্রলোক পুলিশ প্রোটেকশান না-নেওয়ার জন্য প্রথমে ওকে একটু বকাবকি করলেন। তারপর প্রশ্ন করে করে রাকার ব্যাপারটা জেনে নিলেন। সব শেষে জানালেন যে তাঁর সাহায্য নিতে অনুপম যেন কিছুমাত্র দ্বিধা না-করে; কারণ, উনি আর নির্মল বাল্যবন্ধু, এক স্কুল, এক কলেজ।
শুতে যাওয়ার আগে আবার ফোটোফ্রেমের কথাটা তুলল অনুপম। ঝন্টু বলল, ‘ও জিনিস তো তুই বউবাজারেই পাবি। দু-চারটে দোকান ঘুরলেই মনের মতো ফ্রেম পেয়ে যাবি।’
সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে দশটা নাগাদ বেরুল অনুপম। প্রথমে গেল বউবাজারে। একটা দোকানে ফ্রেম পছন্দ হল। সেটা পালিস করতে দিয়ে সন্ধে বেলা ডেলিভারি নেবে বলে চলে গেল আলিপুর কোর্টে। চার নম্বর বার লাইব্রেরিতে পঙ্কজ পালচৌধুরি অদ্ভুত ব্যবহার করলেন ওর সঙ্গে। প্রথমে তো চিনতেই পারলেন না। তারপর বেশ অভদ্রভাবেই ওকে বলে দিলেন যে তাঁর পক্ষে অনুপমকে কোনোরকম পরামর্শ দেওয়া সম্ভব নয়।
অনুপম জিগ্যেস করল, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো? পরশু দিন আপনি আমাকে সবরকমের সাহায্য করবেন বললেন। আর আজ একথা বলছেন। কেন?’
পঙ্কজ বললেন, ‘পরশু পর্যন্ত আমি জানতুম আপনি একজন ভদ্রলোক। আমার সাহায্যের আপনার দরকার আছে। আজ দেখছি, তার আর দরকার নেই।’
এইবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। অনুপম সহাস্যে বলল, ‘কী করে দেখলেন? বাজাজ দেখাল বুঝি? আমি যে একজন ভদ্রলোকের মতো মার খেয়ে দু-টি পা খোয়ানোয় রাজি না-হয়ে উলটে বাজাজের লোকদেরই মার দিয়েছি, সেটাই আপনাদের কাছে ঘোরতর অন্যায় বলে মনে হয়েছে, তাই না? ও-বাড়ির ওপর নজর রাখতে আপনাকে কত টাকা দেয় বাজাজ?’
রক্তচক্ষু করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও সামলে নিলেন পঙ্কজ পালচৌধুরি। বললেন, ‘আপনি চলে যান এখান থেকে। আমি আপনার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।’
নিউ মার্কেটে বাবা-মার জন্য কিছু কেনাকাটা করে সাড়ে চারটে নাগাদ ম্যাঙ্গো লেনে ঝন্টুর অফিসে চলে গেল অনুপম। বলল, ‘তুই কাজ সেরে পাঁচটার সময় বেরুবি তো? তখন তোকে বউবাজারে নিয়ে যাব। তারপর একটু এদিক-ওদিক ঘুরব।’
ঝন্টু বলল, ‘তুই খেপেছিস? ওই ভূতের বাড়িতে আমি যাব? নেভার। তুই তো বললি তোর সঙ্গে ভূতের ইয়ে হয়েছে? তা ইয়ে হোক বা না-হোক আমি যাচ্ছি না।’
অনুপম বিমর্ষ হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা ঢুকব না ভেতরে। বাইরে থেকেই ফ্রেমটা দিয়ে চলে আসব।’
‘তুই কবে ফিরবি বল তো? বাড়িটা যদি কিছু নাই করিস, তবে কেটে পড় না। ঝামেলা বাঁচে।’
‘নাঃ, কেটে পড়লে চলবে না। দুটো সমস্যা এখানে, তাদের সমাধান না-করে তো যেতে পারি না। দশদিনের ছুটির পুরোটাই কাটাতে হবে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, বোঝাই যাচ্ছে, বাজাজ একটা শেষ লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমি এখন কেটে পড়লে ও দুঃখ পাবে না? সেজোপিসি, ছোটোপিসিমা আর বাবার মামা পরিমলদাদু— এঁরা কলকাতায় আছেন। ওঁদের বাড়ি যাওয়া দরকার। ভাবছি কাল সারাদিনটা এই কাজের জন্য রাখব।’
সদর দরজা থেকেই ফ্রেমের প্যাকেটটা দিয়ে ফিরে এল দু-জনে। ঝন্টুর সঙ্গে পরিচয় হল কৃষ্ণানন্দবাবুর। তবে ওরা ভেতরে ঢুকতে চাইল না বলে তিনি বিশেষ ক্ষুণ্ণ হলেন, তা মনে হল না। এরকম ব্যবহারে তিনি অভ্যস্ত বলেই মনে হল। রাকা বেরুল না। তবে, একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল অনুপম যে ওদের পেছনে ফেউ লেগেছে।
পরদিন আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরে ছোটোপিসিমার বাড়ি রাত্রের খাওয়া সেরে অনুপম যখন শ্যামপুকুর ফিরল তখন রাত প্রায় দশটা। ওর মনে হচ্ছিল, আজ একটা কিছু ঘটবেই। অনেক চেষ্টা করেও ও ধরতে পারল না যে, কেউ ওকে ফলো করছে কি না? খুব সম্ভবত করছিল না। কেন? এটা কি ঝড়ের আগের থমথমে ভাব?
বাড়িতে ঝন্টু ছিল না। সাধুচরণ চিন্তিত মুখে রোয়াকে বসেছিল। বলল, ‘কিছুই বলে যায়নি— কোথায় গেছে বা দেরি হবে কি না। ছোটোদাদাবাবু তো এরকম কুখনো করেন না।’
অনুপম ঘরে ঢোকামাত্র টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাজাজের গলা, ‘এই যে অনুপমবাবু। বাড়ি ফিরেছেন? আপনাকে তো আর একবার কষ্ট করে বেরুতে হবে।’
‘কোথায় যেতে হবে?’ অনুপম জিগ্যেস করল।
‘সেটা একটা খুব ভালো জায়গা। আপনার মনের মতো জায়গা। সেখানে আপনার বান্ধবী মিসেস রাকা মুখার্জি, তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর আপনার ভাই সুব্রতবাবু আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ বাজাজের গলা নির্বিকার, নির্বিকল্প, যেন ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা বলছেন।
অনুপমের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। অনেক কষ্টে গলাটা অকম্পিত রেখে বলল, ‘কোথায়?’
‘সেটা গেলেই দেখতে পাবেন। নীচে সদর দরজায় আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার আপনাকে নিয়ে যাবে।’
‘যদি না-যাই?’
‘কাল সকালে ওই চারজনের লাশ অপনার সদর দরজার সামনে দেখতে পাবেন।’
‘ঠিক আছে। আমি আসছি।’
‘দেরি করবেন না। আর অস্ত্রশস্ত্র কিছু আনবেন না। তাতে আখেরে আপনারই ক্ষতি হবে।’
‘ঠিক আছে। অস্ত্রশস্ত্র আমার নেই, কাজেই সে প্রশ্নই ওঠে না।’
বাজাজ ফোনটা রাখামাত্র ব্যারিস্টার গুপ্তকে ফোন করল অনুপম। ওর কথা শুনে ভদ্রলোক রেগে আগুন হয়ে গেলেন। বললেন, ‘এতদূর স্পর্ধা হরিরামের। তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, জানো?’
অনুপম বলল, ‘ওর কথা শুনে মনে হল ষোলো নম্বর প্রভাত ঘোষ রোডের বাড়িতে। যদি তা না-হয়, উনিশ নম্বরের অ্যাডভোকেট পঙ্কজ পালচৌধুরিকে চাপ দিলে হয়তো জানতে পারবেন যে ও কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে চায়।’
‘ঠিক আছে। এটা লোকাল থানার ব্যাপার নয়। আমি হোম মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলছি। লালবাজারের সঙ্গেও যোগাযোগ করছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা তোমাদের কাছে পৌঁছে যাব। এই হরিরামের একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। টাকার জোরে শয়তানটা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।’
অনুপমের অনুমানই ঠিক। ওকে নিয়ে বাজাজের গাড়ি ষোলো নম্বরেই ঢুকল। রাত তখন এগারোটা। রাস্তা জনহীন। দু-একটা বাড়ির কয়েকটা জানলায় আলো জ্বলছে। তাদের মধ্যে একটা উনিশ নম্বর। ওদের বাড়ির গেট খুলে দিল একটা গুণ্ডামতন লোক। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। লনের সামনে গেট থেকে নেমে হেঁটে গিয়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়াল অনুপম। সঙ্গেসঙ্গে দরজাটা খুলে গেল। একটা লোক পেনসিল টর্চের আলো দেখিয়ে ওকে বসবার ঘরে নিয়ে ঢোকাল। ভেতরটা গুমোট হয়ে রয়েছে। একটা ভ্যাপসা গন্ধ, অনেকটা রাকাদের বাড়িতে ঢোকবার সময় যে গন্ধ পেয়েছিল অনুপম, সেইরকম। ওর একটু নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তবে সেটা টেনশনের জন্যও হতে পারে।
অনুপম ঘরে ঢোকামাত্র ফস করে একটা আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল ঘরের এক কোণে কৃষ্ণানন্দবাবু, তাঁর স্ত্রী আর রাকা মেঝের ওপর বসে আছে। তিনজনের মুখেই ভয়ংকর আতঙ্কের ছায়া। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঝন্টু। সে-ও ভয়ে আধমরা হয়ে রয়েছে। ঘরে একটা খালি বুককেস ছাড়া আর কোনো আসবাবপত্র নেই, জানলাগুলোয় ভারী পর্দা লাগানো হয়েছে যাতে কোনো আলো বাইরে না-যায়।
ঝন্টু বলল, ‘তুই এলি কেন? জেনেশুনে বাঘের গুহায় এসে ঢুকলি।’
অনুপম বলল, ‘কেন এসেছি, তুই তা বুঝবি না। তোরা এখানে এলি কী করে?’
‘পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরুনোমাত্র চার-পাঁচটা লোক আমাকে ঘিরে ফেলল। বলল, হরিরামবাবু ডাকছেন। এক্ষুনি যেতে হবে। কী করি। না গেলে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে। ওদের সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠলুম। দেখি দুটো গাড়ি। একটায় আমি আর দুটো লোক। বলল, আমাকে কৃষ্ণানন্দবাবুকে গিয়ে বলতে হবে যে তুই গুরুতর আহত, হাসপাতালে। রাকাকে একবার দেখতে চাইছিস।’
‘তুই বললি?’
‘না-বলে উপায় কী? আমার পেছনে দু-জন দাঁড়িয়ে। আমার পিঠে পিস্তল ঠেকানো। বলে দিয়েছিল, আমাকে খুন করতে ওদের এতটুকু অসুবিধে হবে না। আমার কথা শুনে কৃষ্ণানন্দবাবুর স্ত্রীও যেতে চাইলেন। হুড়মুড় করে ওঁরা বেরিয়ে এলেন। তারপর এইখানে।’
অনুপম বলল, ‘এই সামান্য বাড়িটার জন্য এত কাণ্ড করছে হরিরাম?’
একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর পেছন থেকে বলল, ‘কারণ আছে, অনুপমবাবু। আপনি যদি আমাকে অপমান না-করতেন আর আমার লোকগুলোকে না-মারতেন, তাহলে এত কাণ্ড করতে হত না। এখন আপনার একটা উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না-করলে তো চলছে না।’ বলতে বলতে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন হরিরাম বাজাজ। তাঁর সঙ্গে দু-জন লোক, তাদের হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। বোঝা গেল তারা হরিরামের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। লোকটা ছিপছিপে রোগা, ফর্সা রং, মেহেন্দি করা লাল চুল, চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা, পরনে সাদা রঙের স্যুট, সাদা রঙের জুতো, বয়েস চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। ‘শুনুন অনুপমবাবু। বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না। এখন আপনাকে যা বলব তা আপনাকে করতে হবে। এই মোবাইল ফোন নিন। হংকং-এ আপনার বাবাকে ফোন করুন। তাঁকে বলুন যে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার একজন লোক এই বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করার এগ্রিমেন্টের কাগজপত্র নিয়ে তাঁর কাছে যাবে। তিনি যেন দেরি না-করে কাগজগুলোয় সই করে দেন। ব্যাস। তাহলেই আপনার কাজ শেষ। আপনারা সবাই যে যার বাড়ি চলে যাবেন। এখন অবশ্য হংকং-এ অনেক রাত। তা বাবাকে না-হয় একটু কষ্টই দেবেন।’
অনুপম হাসল। বলল, ‘হরিরাম, আপনি বেশি কথা বলেন না হয়তো কিন্তু বেশি বাজে কথা বলেন। আমি বাবাকে ফোন করে দিলুম। কাগজে সই হয়ে গেল আর আপনি আমাদের ছেড়ে দিলেন যাতে আমরা একদৌড়ে থানায় গিয়ে এফ আই আর করতে পারি— এ গল্প আমাকে করে কোনো লাভ নেই। আপনার কার্যসিদ্ধি হলে আপনি আমাদের জীবিত থাকতে যে দেবেন না, এটা বুঝতে তো কোনো কষ্ট হয় না।’
‘বাঃ, আপনার তো বেশ বুদ্ধি আছে দেখছি। আমি ভেবেছিলুম আপনি শুধু মারামারিই করতে পারেন। এতই যদি বোঝেন, তাহলে এখানে কেন যে এলেন তা আপনিই জানেন। যাহোক, কার্যসিদ্ধি আমার হবেই। আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। যদি ফোন না-করেন তাহলে আমরা একের-পর-এক আপনার এই বান্ধবীটিকে রেপ করতে শুরু করব যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আমার কথা শুনছেন। যদি শোনেন তাহলে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আপনাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে আপনাদের খুন করবে আমাদের লোকেরা। আমরা আটজন আছি। আমাদের সকলের কাছেই রাইফেল বা রিভলভার আছে। কাজেই কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।’
অনুপম যথাসাধ্য শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি একটা কথা জেনে রাখুন, মি বাজাজ, যে ব্যরিস্টার পি কে গুপ্ত হোম মিনিস্টারের সঙ্গে একটু আগে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন এবং লালবাজারকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আপনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। আমাদের খুন করলেও আপনি বেরিয়ে যেতে পারবেন না। আপনার খেলা এবার শেষ।’
মৃদু হেসে বাজাজ বললেন, ‘আমাকে ব্লাফ দিয়ে কোনো লাভ হবে না অনুপমবাবু। আমার খেলা অত সহজে শেষ হবে না। ফোন করবেন কি না বলুন।’
‘করব। ফোনটা দিন?’
‘উঁহু। নম্বরটা বলুন। আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।’
অনুপম নম্বরটা বলল, বাজাজ বোতাম টিপে ডায়াল করে ফোনটা কানের কাছে ধরেই সেটা বিদ্যুদ্বেগে সরিয়ে নিলেন। ফোনের ভেতর থেকে যেন পাঁচটা কাঠচেরাই কলের আওয়াজ ছিটকে বেরিয়ে এল। বাজাজ দাঁতের ফাঁকে একটা অশ্লীল গালাগালি করে নম্বরটা রিডায়াল করলেন। আবার সেই একই ব্যাপার।
অনুপম চট করে রাকার মুখের দিকে তাকাল। দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে একটা ক্ষীণ হাসির আভাস।
বাজাজ বললেন, ‘উফ! এই ফোনগুলো কোনো কাজের নয়। ইয়াকুব, যা তো আমার গাড়িতে আর একটা ফোন আছে। নিয়ে আয়। ওটা জাপানি, গোলমাল হবে না। তাড়াতাড়ি যা।’
ইয়াকুব ‘ঠিক আছে’ বলে বেরুতে যেতেই একটা লোক দরজা দিয়ে মুণ্ডু বের করল। বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘হরিবাবু, ওপাশের বাথরুমের ভেতরে একটা লাশ। পচে গলে গেছে। দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না।’
‘লাশ তো কী হয়েছে? খালি বাড়ি দেখে পাড়ার কেউ ঢুকে ঝুলে পড়েছে। তুই যা, সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়া।’
‘তাই যাচ্ছি। আমার কিন্তু ভালো বোধ হচ্ছে না, হরিবাবু। আমার খালি মনে হচ্ছে, কে যেন আমার পেছনে পেছনে ঘুরছে। পিছন ফিরলে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’ বলে মুণ্ডুটা অদৃশ্য হল। আর সঙ্গেসঙ্গে দোতলায় একটা পৈশাচিক গর্জন উঠল, সেইসঙ্গে ভারী পায়ের দুপদুপ শব্দ। কতগুলো লোক আর্তনাদ করতে করতে দুড়দুড় করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে কয়েকটা গুলির আওয়াজ। দুপদুপ আওয়াজটা কিন্তু থামল না। সেটাও সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বসবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল।
এইবার হরিরাম বাজাজের মুখে আতঙ্কের ছায়া পড়ল। চিৎকার করে বললেন, ‘আরে কী হচ্ছে এসব? ইয়াকুব, মকবুল, দরজায় গুলি চালা।’
কে গুলি চালাবে? দু-জনের হাত এত কাঁপছে যে বন্দুক তুলতেই পারছে না। দরজার বাইরে আবার সেই পৈশাচিক গর্জন আর সঙ্গেসঙ্গে দুপ করে ঘরের আলোটা নিভে গেল। অনুপম এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল। তৎক্ষণাৎ আন্দাজে বাজাজের মুখ বরাবর একটা প্রচণ্ড লাথি চালাল। লাথিটা ঠিক জায়গাতেই লাগল বলে মনে হল। গাঁক করে শব্দ করে কেউ সশব্দে ধরাশায়ী হল, বোঝা গেল। পরমুহূর্তেই আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল, রক্তাক্ত মুখে বাজাজ এবং বাকি দু-জনও অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় পড়ে রয়েছে।
কথা হচ্ছিল ব্যারিস্টার গুপ্তর চেম্বারে বসে। গুপ্ত বলছিলেন, ‘আমরা বাজাজের বিরুদ্ধে কেবল ট্রেসপাসিং-এর চার্জ আনব। কিডন্যাপিং-এর চার্জ আনব না। তাহলে কৃষ্ণানন্দবাবুর কোর্টকাছারি করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তাতে হয়তো বাজাজের উপযুক্ত শাস্তি হবে না, তবে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কারণ বাজাজ আর তার লোকজন আর জীবনে কখনো ও-বাড়ির ছায়া মাড়াবে না। হানাবাড়িতে কে যাবে প্রাণ হাতে করে? বাজাজ তো আর জানে না যে ওর মুখের লাথিটা অনুপমের, ভূতের নয়। আর রাকা তো কাল অনুপমের সঙ্গে চলেই যাচ্ছে জাকার্তায়। সেখানে ওর জারিজুরি চলবে না। ওরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্মল বললেন, ‘এ সবই তোর জন্য হতে পারল, বিটু। দু-দিনের মধ্যে রাকা-অনুপমের বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, আমাদের হংকং থেকে আসার টিকিটের ব্যবস্থা— এতসব তুই না-থাকলে হত না।’
হাত নেড়ে গুপ্ত বললেন, ‘ওসব কিছু না। কলকাতায় সব সম্ভব। তবে হ্যাঁ, হোম মিনিস্টারও খুব সাহায্য করেছেন। আমার তো ভয় ছিল বিয়েটা। ভেবেছিলুম, ঝামেলা হবে।’
‘না, সে ভয় আর নেই। কৃষ্ণানন্দবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁর বোধ হয় ছেলের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ হয়। উনি তো বললেন যে নীলাঞ্জনের মূল যে সমস্যাটা ছিল সেটা ঈর্ষা নয়, সেটা রাকার শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির সম্ভাবনাটা দূর করা। সে যখন জীবিত ছিল তখন ঈর্ষাটাই বড়ো ছিল। তবে সেটা একটা দেহজ প্রতিক্রিয়া। দেহটাই যখন নেই, তখন সেটা আর থাকে কী করে? আজ সে নিশ্চিত যে অনুপম কোনোরকম অসদুদ্দেশ্য ছাড়াই রাকার ভার নিতে চায়। তার জন্য সে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখেও এগিয়ে যেতে পারে এবং রাকাকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো ক্ষমতা তার আছে। অতএব নীলাঞ্জনের এখন আর তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তা ছাড়া, আদতে সে একজন ভদ্রলোক। নিষ্প্রয়োজনে সে কারুর ক্ষতি করতে চায় না। ঈর্ষাটা একটা অসুখ। আজ তার শরীরের সঙ্গেসঙ্গে অসুখটাও পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেছে। এইসব কথা কৃষ্ণানন্দবাবু বলছিলেন। এই কথাগুলো তো এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে ঠিক আর এটাও ঠিক যে স্বভাব যায় না মলেও। আরও একটা কথা বললেন কৃষ্ণানন্দবাবু। সেদিনের প্রভাত ঘোষ রোডের বাড়ির ঘটনায় নীলাঞ্জন নাকি এত আনন্দ পেয়েছে, সেরকম এর আগে সে কখনো পায়নি।’
শমিতা বললেন, ‘ওদের ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন? রূপমের প্লেন তো নেমে গেছে দেড় ঘণ্টা হল। এতক্ষণ লাগে দমদম থেকে এখানে আসতে?’
নির্মল বললেন, ‘তা তো লাগবেই। কাস্টমসই কতক্ষণ নেয়, তার ঠিক আছে।’
বলতে-বলতেই অনুপম, রাকা আর ঝন্টু রূপমকে নিয়ে হইহই করতে করতে চেম্বারে ঢুকল। ঢুকেই রূপম বলল, ‘মা আমি একদিন বলিনি তোমার যে এই রাককুসী রাকা অতি ডেঞ্জারাস। একসময় ঠিক দাদার মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে। ঠিক তাই হল।’
শমিতা হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছি রূপম। রাকা এখন তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ। তাকে তুই-তোকারি করবে না। ভক্তিশ্রদ্ধা করবে আর কক্ষনো রাককুসী বলবে না।’
রাকা বলল, ‘আচ্ছা আমি তো না-হয় রাককুসী। তোমার ঘাড়ে যে আমেরিকান শাঁকচুন্নিটি চেপেছেন তাঁকে কবে দেখব, শুনি?’