মায়াকানন

মায়াকানন

বিশ্বরূপ রায় আর দেবেন্দ্র ভট্টাচার্য শাকিলা বাজার থেকে জামশেদপুরে ফিরছিলেন। শাকিলা বাজারে একটা মিনি স্টিল প্লান্ট বসবে, তার টেন্ডার নিয়ে কথাবার্তা বলবার জন্যে কোম্পানি ওঁদের পাঠিয়েছিল কলকাতা থেকে। জামশেদপুর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ভোর বেলা বেরিয়েছিলেন, আলাপ-আলোচনার পর শাকিলা বাজার থেকে যখন বেরুতে পরলেন তখন বিকেল হয়ে গেছে।

জামশেদপুর থেকে শাকিলা বাজারের রাস্তাটা ভালো নয়। ভাঙাচোরা তো বটেই, ডাকাতেরও ভয় আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার রঘুনাথ সিং সেজন্য কোনো অ্যাটাচিকেস বা স্যুটকেস সঙ্গে নিতে বারণ করেছিল। সেইসঙ্গে দু-জনের পকেটে হাজার খানেক করে টাকা রাখতে বলেছিল যাতে ডাকাতে ধরলে সেটা দিয়ে পার পাওয়া যায়। বাকি কাগজপত্র সব ফাইলে নিতে বলেছিল।

শাকিলা বাজারে যাওয়ার সময় কোনো গণ্ডগোল হয়নি। ফেরার পথে গোলমাল শুরু হল। বেশ চলছিল ট্যাক্সিটা, হঠাৎ ভানুপুরার জঙ্গলের মাঝামাঝি এসে গাড়িটা একটা ঝাঁকানি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

দেবেন্দ্র চাপা গলায় বলল, ‘দেখলেন তো স্যার! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়।’

বিশ্বরূপ বললেন, ‘যা বলেছ। আজ কপালে দুঃখ আছে।’

ইতিমধ্যে রঘুনাথ সিং গাড়ি থেকে নেমে বনেট খুলে কীসব করছিল। অনেক ধস্তাধস্তির পর যখন স্টার্ট দিল তখন ইঞ্জিন চালু হল বটে কিন্তু তার ভেতরে একটা বিকট ঘটঘট শব্দ শুরু হল। আর পেছনের পাইপ দিয়ে গল গল করে কালো ধোঁয়া বেরুতে লাগল।

রঘুনাথ বলল, ‘ইঞ্জিনের ভেতরে কিছু ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে। না-খুললে বোঝা যাবে না।’ বলে সাবধানে গাড়িটা চালু করল। গাড়ি চলতে শুরু করল ঠিকই কিন্তু একেবারে শম্বুক গতিতে, নানা রকমের শব্দ করে আপত্তি জানাতে জানাতে।

দেবেন্দ্র বলল, ‘এরচেয়ে আর বেশি জোরে চালানো যাবে না?’

রঘুনাথ মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, বেশি চাপাচাপি করলে একেবারে বসে যাবে। সামনেই রানিজির দোকান। আপনারা ওখানে বসে চা-টা খান। আমি গাড়ি রেখে হেঁটে আগে চলে যাব। ভানুপুরার বস্তি ওখান থেকে মাইলদুয়েক। সেখান থেকে লোকজন নিয়ে আসব।’

‘রানিজি কে?’

রঘুনাথ সিং হাসল। বলল, ‘আমি ঠিক জানি না। যতদিন এ রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছি, ততদিন ওঁকে দেখে আসছি। আমার বাবাও তাই দেখেছেন। কত বয়েস কেউ জানে না। কবে থেকে দোকান চালাচ্ছেন তা-ও আর কারুর মনে নেই।’

দেবেন্দ্র শঙ্কিত মুখে বিশ্বরূপকে বলল, ‘ব্যাপার কিছু বুঝলেন স্যার?’

বিশ্বরূপ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘ব্যাপার বুঝে দরকার নেই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিলেই হবে।’

ট্যাক্সি যখন ঘটাং-ঘটাং করতে করতে রানিজির দোকানে পৌঁছল, তখন রাত হতে আর বেশি বাকি নেই। জঙ্গলের মাথায় সূর্যাস্তের বিলীয়মান আলোর কিছুটা রয়ে গেছে বটে কিন্তু তার তলায় জমাট অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। ঘরে-ফেরা পাখিদের চ্যাঁচামেচিও প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। রঘুনাথ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করামাত্র নিস্তব্ধ জঙ্গল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

রাস্তার ধারেই রানিজির দোকান। যাওয়ার সময় কারুরই নজরে পড়েনি। না পড়বারই কথা। শ্যাওলাধরা ইটের দেওয়াল আর ধূসর হয়ে আসা টিনের চালের ছোট্ট ঘরটা চারিদিকের বড়ো বড়ো গাছ আর ঝোপঝাড়ের সঙ্গে যেন মিলেমিশে রয়েছে। ঝাঁপ বন্ধ থাকলে জঙ্গলের থেকে তাকে আলাদা করা কঠিন ব্যাপার।

এখন অবশ্য নজরে পড়ল। দূর থেকে দেখা গেল, সাদা শাড়ির ওপর খয়েরি রঙের চাদর মুড়ি দেওয়া এক বৃদ্ধা মহিলা হারিকেন জ্বেলে দোকানের বাইরে আসছেন। উদ্দেশ্য, ঘটাং ঘটাং শব্দটা কেন হচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করা।

রঘুনাথ সিং দোকানের সামনে গাড়ি রেখে নেমে গেল। বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাকে নমস্কার করে ঠেট হিন্দিতে বলল, ‘নমস্তে রানিজি। আপনার একটু সাহায্যের দরকার।’ বলে কী ঘটেছে তা সবিস্তারে জানাল।

লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল বৃদ্ধার লোলচর্ম দন্তহীন মুখে একটা অত্যন্ত মধুর হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে রানিজি সওয়ারি দু-জনকে নেমে আসতে আহ্বান করলেন।

বিশ্বরূপ গাড়ি থেকে নেমে রঘুনাথকে বললেন, ‘তুমি, এই অন্ধকারে যেতে পারবে তো? কোনোরকম বিপদ-আপদ হবে না তো?’

রঘুনাথ প্রশ্নটা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। জানোয়ারকে ভয় পাই না, ভয় মানুষের। তাহলে, আমি গাড়িটা নিয়েই যাচ্ছি। সারানো হলেই নিয়ে চলে আসব।’ বলে রানিজিকে বলল, ‘আপনি তো একটু বাদে দোকান বন্ধ করবেন। ওঁদের একটু ভেতরে থাকতে দেবেন!’

রানিজি একটু ইতস্তত করে কাঁপা-কাঁপা গলায় হিন্দিতে বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে তাড়াতাড়ি এসো। নইলে এঁদের লাড়োয়া বিস্কুট আর চা খেয়ে রাতের খাওয়া সারতে হবে।’ তারপর অতিথিদের বাংলায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’

দোকানের সামনে ঢোকার পথের আধখানা জুড়ে একটা মাটির উনুন। একপাশে একটা প্রাগৈতিহাসিক কাচের আলমারি। তার ভেতরে কয়েকটা কাচের বোয়ামে চা, চিনি, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি। অন্যপাশে একটা হাইবেঞ্চ আর একটা নীচু বেঞ্চ। পেছনের দেওয়ালে একটা টিনের দরজা।

অসুস্থ গাড়িটা আর্তনাদ করতে করতে আর প্রচুর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে গেলে রানিজি অতিথিদের ভেতরে এনে বসালেন। বললেন, ‘চা খাবেন তো? সেইসঙ্গে কেক?’

দেবেন্দ্র বলল, ‘আপনি তো ভারি চমৎকার বাংলা বলেন!’

রানিজি হাসলেন। বললেন, ‘শুধু বাংলা কেন, আমি আরও পাঁচ-ছটা ভাষায় কথা বলতে পারি। আমার এখানে নানা প্রদেশের ড্রাইভাররা আসে। তাদের কথাবার্তা শুনে শুনে শিখে নিয়েছি। অনেক বছর তো হল এখানে।’

‘এই জঙ্গলের মধ্যে একা দোকান চালাচ্ছেন, ভয় করে না আপনার?’

‘কীসের ভয়? বাঘ-ভাল্লুক তো নেই। মাঝে মাঝে চিতাবাঘ এসে পড়ে। এই উনুন দেখলে তারা আর কাছে আসে না। আর চোরডাকাত? আমার কাছে কী যে চুরি করবে? এই দোকানের গেলাস বা ডিশ চুরি করতে পারে অবশ্য, তবে তাতে তাদেরই পরদিন চা জুটবে না।’

‘এই সেরেছে। তাঁরাও আসেন নাকি এখানে?’

‘নিশ্চয়ই। এই এলাকাটা দিনের বেলা পুলিশের, রাত্রি বেলা ডাকাতের। কোনো অসুবিধে নেই। কেউ কারুর অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না। আর ডাকাতরা আমার দোকানের খদ্দেরদের কখনো বিরক্ত করে না।’ বলে পলকাটা দুটো গেলাসে প্রায় সাদা চা আর একটা প্লেটে দুটো কেক হাইবেঞ্চের ওপর রাখলেন রানিজি।

দেবেন্দ্র অবশ্য একথায় যে খুব একটা আশ্বস্ত হয়েছে তা মনে হল না। সন্ত্রস্ত মুখে চায়ে চুমুক দিতে লাগল।

বিশ্বরূপ জিগ্যেস করলেন, ‘কত বছর এখানে আছেন রানিজি?’

‘সে কি আর মনে আছে? অনেক বছর।’

‘তবু? সে সময়কার কোনো ঘটনা আপনার মনে পড়ে?’

রানিজি একটা নীচু টুলের ওপর বসেছিলেন। মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়ে আসছে।’

বিশ্বরূপের হাত থেকে চায়ের গেলাসটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বলেন কী? সে তো উনিশ-শো পঁয়তাল্লিশ কী ছেচল্লিশ হবে। তার মানে আজ থেকে প্রায় চুয়ান্ন বছর আগে! ওরে বাবা! এখন আপনার বয়েস কত?’

‘কত হবে? আশি বোধ হয়।’ বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রানিজি উঠে দাঁড়ালেন। খালি গেলাসগুলো নিয়ে পেছনের দরজা খুলে বাইরে অন্ধকারে বেরিয়ে গেলেন একটা লণ্ঠন নিয়ে। আওয়াজে বোঝা গেল বালতি থেকে জল নিয়ে গেলাসগুলো ধোওয়া হচ্ছে।

বিশ্বরূপ বিড়বিড় করে হিসাব করছিলেন, ‘আশি বছর। তার মনে ছাব্বিশ বছর বয়েসে দোকান দিয়েছিলেন।’

একটু বাদেই রানিজি ফিরে এলেন। বিশ্বরূপ জিগ্যেস করলেন, ‘এইখানে চুয়ান্ন বছর আগে দোকান দিয়েছিলেন? তখন খদ্দের আসত?’

‘কেন আসবে না? বরং বেশি আসত। আগে রকসৌল বা বাঘা যাওয়ার এটাই রাস্তা ছিল। এখন নতুন রাস্তা হয়েছে। গাড়ি-ঘোড়া কমে গেছে।’

‘আপনি কি ভানুপুরার বাসিন্দা?’

রানিজি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মাথা নীচু করে বিষণ্ণ মুখে আবার টুলের ওপরে গিয়ে বসলেন। দেবেন্দ্র গলা নামিয়ে বলল, ‘স্যার! আমরা বোধ হয় ওঁর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছি।’

বিশ্বরূপ চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘চোপ! কথায় কথায় তোমার এই কাব্যি করার অভ্যেসটা ছাড়ো তো। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিলে কী করতে, হ্যাঁ?’

ম্লান হেসে রানিজি বললেন, ‘ওকে বকবেন না। সত্যিই তো, আমাদের অতীতের স্মৃতিগুলো বেদনাদায়কই তো বটে।’

আবার হাঁ হয়ে গেলেন বিশ্বরূপ। বললেন, ‘আপনি যা বললেন তাতে বুঝলুম যে আপনি ভানুপুরার বাসিন্দা নন এবং আপনি বাঙালি। কারণ, ট্রাক ড্রাইভারদের বাক্যালাপ শুনে আপনি যে ভাষায় কথা বললেন, সে ভাষা শেখা যায় না। আর আপনি যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন তাতেও সন্দেহ নেই। তাহলে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এরকম চায়ের দোকান কেন দিয়েছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়েসে? আপনি কি বিপ্লবী ছিলেন?’

রানিজি সহাস্যে বললেন, ‘বিপ্লবী? না, না, সেরকম কিছু নয়। দোকান দিয়েছিলুম পেট চালানোর জন্যে।’

‘পেট চালানোর জন্য! এই জঙ্গলে? দুনিয়ায় আর জায়গা ছিল না?’

রানিজি বললেন, ‘উপায় ছিল না।’ বলে উদাস হয়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বিশ্বরূপ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘দেখুন, অতিরিক্ত কৌতূহল বা কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনুসন্ধিৎসা যে অত্যন্ত অন্যায়, একটা সামাজিক অপরাধ তা আমি জানি। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেউ বেশি প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলে আমি ভয়ানক রেগে যাই, গালাগালি করি পর্যন্ত। তা সত্ত্বেও আপনার অতীত জীবনের ইতিহাস জানবার ইচ্ছেটা চেপে রাখতে পারছি না। আপনার ভাষা বলে দিচ্ছে যে আপনি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মানুষ। অথচ এরকম একটা জায়গায় এরকম একটা দোকান দিয়ে অর্ধশতাব্দী কাটিয়ে দিলেন যে, তার কারণটা না-জানতে পারলে আমার রাতের ঘুম, দিনের খাওয়া ইত্যাদির বেশ অসুবিধে হতে পারে।’

বৃদ্ধার মুখে একটা ছেলেমানুষি হাসি ফুটে উঠল। উজ্জ্বল চোখে বললেন, ‘বলেন কী? সে তো ভালো কথা নয়।’

‘নয়ই তো।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রানিজি বললেন, ‘আপনারা বুদ্ধিমান লোক। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি এখানে অজ্ঞাতবাস করছি। যে কারণে অজ্ঞাতবাস শুরু করেছিলুম সেটা বোধ হয় শেষ হয়ে যায়নি। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই ভাবেই হয়তো আমাকে কাটাতে হবে। কাজেই, আমার জীবনের ইতিহাস আপনাদের বলা আমার বিপদ ডেকে আনতে পারে, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তা পারে যদি না-আপনি আমাদের যা বলবেন সেটা এই ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে কখনোই না-যায়। আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। আমরা ভদ্রলোক। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের অপকার করা আমাদের স্বভাব নয়।’

দেবেন্দ্র বলল, ‘আপনি যা বলবেন, সেটা আমরা গল্প বলেই ধরে নেব। এই অন্ধকারেই তো জোনাকি রঙে গল্প তৈরি হয়।’

বিশ্বরূপ আবার চোখ পাকিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে রানিজি বললেন, ‘তা ঠিক। বিশেষত আজ আমার জীবনের সব লেনদেনই যখন ফুরিয়েছে, তখন আর বাধা কোথায়? আমার এখানে যারা আসে তাদের ভীষণ তাড়া। আমাকে তারা লক্ষই করে না। আজ আপনাদের যে অবস্থায় এখানে আসতে হল, তাতে মনে হচ্ছে কেউ হয়তো চাইছে যে আমার ভেতরে জমে ওঠা কথার ভার কিছুটা কমিয়ে দেওয়াই দরকার।’

কুড়ি বছর বয়েসে বি এ পাশ করবার পর ভাগলপুরের বিখ্যাত উকিল প্রফুল্লচন্দ্র মজুমদারের ছোটোছেলে প্রমথেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। বাবা-মা আমার ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন। বড়ো হয়েছিলুম পাকপাড়ায় মামাবাড়িতে। আমার বিয়ে দিয়ে তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

প্রমথেশ ভাগলপুরের ভিক্টোরিয়া স্কুলে ইংরেজির টিচার ছিলেন। ভাগলপুর ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু আর বাংলায় কবিতা লিখতেন ‘প্রমথ’ ছদ্মনামে। ওঁর অনেক কবিতাই সে যুগে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

আমাদের বিয়ের বছরচারেক বাদে প্রফুল্লচন্দ্র হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। তখন সে যুগের আইনানুযায়ী তাঁর সমস্ত সম্পত্তির ভার নিলেন তাঁর বড়োছেলে অভয়চরণ। তিনি আর তাঁর পরের ভাই হরিচরণ ছিলেন প্রমথেশের বৈমাত্র ভাই। তাঁরা নিজেদের বেলা কী করেছিলেন তা জানি না, তার রোজগার কমে গেছে এই অজুহাতে প্রমথেশের মাসোয়ারা বন্ধ করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে হেঁশেলও আলাদা হয়ে গেল।

তখন বড়ো দুঃসময়। যুদ্ধের বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, খাদ্যাভাব, কালোবাজারিদের স্বর্ণযুগ। স্কুলের সামান্য মাইনেতে দিন চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। আমাদের সংসারে তখন আমার শাশুড়ি আর আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে সাড়ে তিনজন। ছেলের জন্য চিন্তা ছিল না। হরিচরণ নিঃসন্তান ছিলেন। সে সারাদিন তার মেজোমার কাছেই থাকত। কিন্তু আমাদের দু-বেলা খাওয়া জোটাই কঠিন হয়ে পড়ল।

উপায়ান্তর না-দেখে উনি কলকাতায় চলে গিয়ে মিলিটারিতে নাম লেখালেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে চলে যেতে হল আফ্রিকায়। তারপর থেকে টাকা আসত ঠিকই কিন্তু তাতে সুখ কিছু বাড়ল না। তাঁর প্রত্যেকটি চিঠিতেই বোঝা যেত যে যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আর নৃশংসতা তাঁকে কী ভীষণ মানসিক দুঃখে ক্লিষ্ট করছে। মাঝে-মাঝে মনে হত বুঝি সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে ফিরে আসবেন।

বছরখানেক বাদে আহত হয়ে দেশে ফিরে এলেন। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে ইটালিতে যেতে বলা হল। যাওয়ার আগে সাতদিনের ছুটিতে বাড়ি আসার অনুমতি পেলেন। ইতিমধ্যে হরিচরণ মারা গেছেন। আমার ছেলে প্রায় পাকাপাকিভাবেই তার মেজোমার কাছে থাকছে।

উনি যেদিন এলেন তার পরদিন সকালে আমাকে বললেন, ‘আমি আর ফিরে যাব না।’ কিন্তু ফিরে যাব না তো বললেই হয় না। ডিসচার্জড না-হলে কারুর সৈন্যবাহিনীতে ফিরে না-যাওয়া গুরুতর অপরাধ। আর্মি এসে কান ধরে নিয়ে যাবে তারপর ভয়ানক শাস্তি। এসব উনি জানতেন কিন্তু কিছুতেই ওই অমানুষিক নারকীয়তার মধ্যে ফিরে যেতে রাজি হলেন না।

নিরুপায় হয়ে আমরা নকুলেশ্বর রাই-এর কাছে গেলুম পরামর্শ করতে। নকুলবাবু ভিক্টোরিয়া স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন আর ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ভানুপুরার জমিদারবাড়ির ছেলে, প্রচণ্ড গান্ধীবাদী, অনুগ্রহ নারায়ণ সিং-এর কাছের মানুষ আর ভাগলপুর আর তার আশেপাশের এলাকার প্রভাবশালী নেতা ছিলেন নকুলবাবু। দু-জনের ঘনিষ্ঠতার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল কবিতা। নকুলবাবু ওঁর কবিতার গভীর অনুরাগী ছিলেন।

সব শুনে নকুলবাবু বললেন, ‘আমি ওকে দোষ দিই না। ও একজন কবি। ওই হিংস্রতার মধ্যে ও কখনো বাঁচতে পারে? এখন একমাত্র উপায় পালিয়ে যাওয়া। এতে নীতিগত কোনো অন্যায় নেই কারণ বেআইনি দখলদার ইংরেজ রাজত্বের প্রতি আনুগত্যের কোনো প্রতিজ্ঞারই কোনো মূল্য নেই। কিন্তু পালানো সহজ হবে না। সেজন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার দিন আসন্ন। আর কয়েক বছর মাত্র। তারপর স্বাধীন ভারতের সৈন্যবাহিনী ওকে কখনো শাস্তি দেবে না। কাজেই সেদিন পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।’

আমরা জিগ্যেস করলুম, ‘কী ব্যবস্থা করবেন?’

একটু ভেবে নকুলবাবু বললেন যে ভানুপুরার জঙ্গলের ভেতরে ওঁদের একটা এক কামরার ছোটো বাড়ি আছে। ওঁর কোনো পূর্বপুরুষ ওটা বানিয়েছিলেন শিকার পার্টির বিশ্রামগৃহ হিসেবে। এ ছাড়া ওই বাড়িটা থেকে এক মিনিটের হাঁটাপথে আর-একটা ছোট্ট ঘর আছে। সেটা ঝোপঝাড়, লতাপাতা আর বড়ো বড়ো গাছে এমনভাবে ঢাকা যে জানা না-থাকলে কারুর সাধ্যি নেই সেটা খুঁজে বের করে। নকুলবাবু লজ্জিতভাবে জানালেন যে ওঠা ছিল তাঁর পূর্বপুরুষদের লীলাকক্ষ। আজ ওই ঘর দুটোর কথা প্রায় সকলেই ভুলে গেছে।

ব্যবস্থাটা এইরকম হল যে, সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে বাড়িটাতে পৌঁছানো যায়, তার ওপর আড়াআড়ি করে এই দোকানটা তৈরি হল। উদ্দেশ্য, কেউ যদি বাড়িটাতে যেতে যায় তাহলে তাকে এই দোকানের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। দিনের বেলা হলে আমাকে ডিঙিয়ে, রাত্রি বেলা হলে দরজা ভেঙে। অর্থাৎ নিঃশব্দে বা অগোচরে যাওয়া যাবে না। বাড়িটা তো এখান থেকে কাছেই। কাজেই বাড়িতে যে-ই থাকুক, সে টের পেয়ে যাবে। তখন, পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে ছোটো ঘরটার মধ্যে আশ্রয় নিতে পারবে।

দোকানটা তৈরি হতে সময় লাগল দিন পাঁচেক। এর মধ্যে ঘর দুটোও সাফ হয়ে গেল। সাত দিনের দিন গভীর রাত্রে আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে গেলেন নকুলবাবু। তার পরদিন থেকে সিধা পাল্লু শাড়ি পরে, দু-হাতে একগাদা লালসবুজ কাচের চুড়ি পরে, একগলা ঘোমটা টেনে আমি দোকনদারি শুরু করলুম। ততদিনে আমার লোকাল ভাষাটা বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নকুলবাবু মাঝে মাঝে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন, জিনিসপত্র দিয়ে যেতেন আর ‘প্রমথ’-র কবিতা নিয়ে যেতেন ছাপানোর জন্যে। কেউ কোনো সন্দেহ করল না। সবাই জানল, নকুলবাবু তাঁর এক গরিব দেহাতি রক্ষিতাকে দোকান দিয়ে বসিয়েছেন। এই গুজবের কয়েকটা ভালো ফল হল এই যে, নকুলবাবুর পরিবার তাঁর বিলাসব্যসনহীন দেশভক্তি ছেড়ে এই পুরুষসুলভ স্বভাবিক ব্যবহারে অত্যন্ত খুশি হল আর ডাকাত বা বাজে লোকেরা আমাদের বিরক্ত করা থেকে বিরত রইল। কারণ ভানুপুরায় রাইপরিবারের রক্ষিতাকে ঘাঁটানোর ফল যে কী ভয়ানক হতে পারে, তা তারা বিলক্ষণ জানত।

এরমধ্যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। আমাদের বিপদ কিন্তু কাটল না। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যদের খুঁজে বের করতে আর্মি আরও বেশি করে উঠেপড়ে লাগল। তারপর দেশ স্বাধীন হল কিন্তু পালানো সৈন্যদের ক্ষমা করা হল না। এই সময় নকুলবাবু মারা গেলেন। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগ ছিল তা-ও প্রায় ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আমাদের আর অজ্ঞাতবাস থেকে মুক্তি হল না।’

দেবেন্দ্র রুদ্ধনিশ্বাসে বলল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কিছু নেই। এখানেই রয়ে গেলুম। কোথায় বা যাব? বাপের বাড়ি বলে তো কিছু নেই। আমাদের ছেলেও আমাদের চেনে না। সে জানে তার বাবা-মা তার ছেলেবেলায় মারা গেছে। নকুলবাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন, তার খোঁজখবর পেতুম। এখন সে যে কোথায় আছে, কী করছে জানিও না। আমার স্বামীও হঠাৎ অথর্ব হয়ে পড়লেন, ‘তাঁকে নড়ানো-চড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ল।’

‘অথর্ব হয়ে পড়লেন কেন?’

‘শারীরিক আর মানসিক দু-দিক দিয়েই ওঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে ওঁকে একটা প্রবল মানসিক অবসাদ আচ্ছন্ন করে ফেলল। তার কারণ কিছুটা অনুশোচনা, কিছুটা অপরাধবোধ, কিছুটা ভয় আর কিছুটা আমার জন্য চিন্তা। আমি আর নকুলবাবু অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পারিনি। সেইসঙ্গে আফ্রিকার যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া আঘাতটা, যেটা কখনোই পুরোপুরি সারেনি, তাঁকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করে দিল। তার ওপরে বছরের-পর-বছর ধরে নিশ্ছিদ্র নির্জনতা তাঁকে কেমন যেন জুবুথুবু করে ফেলেছিল। নকুলবাবু মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই উনি একেবারে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়লেন। এখন সারাদিন ওই যাকে বললুম লীলাকক্ষ সেখানে চুপ করে পড়ে থকেন। সারাদিনে একবার খান। আমি রাত্রে দোকান বন্ধ করে ওঁর জন্য খাবার নিয়ে যাই। কারুর সঙ্গে দেখা করেন না। কেউ দেখা করতে গেলে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকেন। নকুলবাবুর খাস-চাকর বুদ্ধিনাথ দু-একবার ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। লাভ হয়নি।’

‘আপনার কলকাতায় যেতে ইচ্ছে করে না? জীবনের কুড়িটা বছর তো ওখানে কাটিয়েছিলেন।’

‘নাঃ! একেবারেই ইচ্ছে করে না। এই তো বেশ আছি। কোনো অসুবিধে তো নেই। আর প্রমথেশকে ছেড়ে যাবই বা কী করে? তাকে তো নড়ানো যাবে না। তা ছাড়া, ড্রাইভারদের কাছে যা শুনি তাতে মনে হয় আমার দেখা কলকাতা আর নেই। গত ষাট বছরে তার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে।’

মাথা নেড়ে বিশ্বরূপ বললেন, ‘হ্যাঁ, সেকথা ঠিক।’

‘এবার আমাকে যেতে হবে।’ বলতে বলতে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন রানিজি।

বিশ্বরূপ বললেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। রাত হয়েছে প্রমথেশবাবু অপেক্ষা করে আছেন। আপনি দোকান বন্ধ করে দিন, আমরা বাইরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। রঘুনাথ এসে পড়বে এখুনি।’

রানিজি বললেন, ‘না, না, তা কখনো হয় নাকি? আপনারা ভেতরেই থাকবেন। রঘুনাথ কখন আসবে তার কি কোনো স্থিরতা আছে? তবে সে আসবে। আমি তাকে জানি, সে কথার খেলাপ করে পালিয়ে যাবে না। আপনারা বেঞ্চ দুটোর ওপর শুয়ে পড়ুন। ওই কোণে কুঁজোয় জল আছে, আলমারিতে কেক-বিস্কুট আছে। খিদে পেলে খেয়ে নেবেন। দামটা ওই উনুনের পাশে রেখে দেবেন। বাইরের ঝাঁপটা ভেতর থেকে তার দিয়ে আটকানো থাকবে। রঘুনাথ এলে সেটা খুলে বেরিয়ে যাবেন। ঝাঁপটা নামিয়ে দিতে ভুলবেন না যেন। আমি পেছনের দরজাটা বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যাব। ওদিক দিয়ে বেরুতে পারবেন না।’

বিশ্বরূপ কৃতজ্ঞভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা আপনি যেরকম বললেন, সেরকমই করব।’

বিশ্বরূপের কথা শেষ হওয়ার পরেও রানিজি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, ‘আর একটা কথা। স্থানীয় লোকেরা এই জঙ্গলটাকে জাদু জঙ্গল বলে। এখানে নাকি রাত বাড়লে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে।’

দেবেন্দ্র আবার রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘কীরকম ঘটনা?’

‘আমি যদিও এতবছরে কখনো শুনিনি, তবে লোকে বলে নানারকম গান শোনা যায়, জঙ্গলের ভেতর থেকে ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসে, ভেসে আসে হাসির আওয়াজ। যদি সেরকম কিছু শোনেন, ভয় পাবেন না আর কোনোমতেই ঘর থেকে বেরুবেন না। গাড়ির আওয়াজ পেলে আর রঘুনাথের গলা শুনলে তবেই ঝাঁপ খুলবেন।’

বিশ্বরূপ হেসে বললেন, ‘ভয় পাব না। কিন্তু, আপনি ভয় না-পেয়ে থাকেন কী করে?’

‘ওই যে বললুম, আমি কখনো কিছু শুনিওনি, দেখিওনি।’

ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দেবেন্দ্র বলল, ‘জাদু জঙ্গল! মানে মায়াকানন! চমৎকার।’

বিশ্বরূপ হাইবেঞ্চের ওপর শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। দেবেন্দ্রর ঠেলা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ঘড়িতে দেখলেন রাত তখন দশটা।

দেবেন্দ্র হাঁসফাঁস করে বলল, ‘শুরু হয়ে গেছে, স্যার, মায়াকাননের মায়া। শুনতে পাচ্ছেন?’

বিশ্বরূপ বললেন, ‘হ্যাঁ পাচ্ছি। একটা গান। রবীন্দ্রসংগীত। মোটা, পুরুষালি গলা। কী গান? হ্যাঁ। সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি, নন্দন ফুলহার, তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার। তাই না?’

‘হ্যাঁ, স্যার। ঠিক তাই।’

‘ঘাবড়িও না। মনে হচ্ছে, প্রমথেশবাবু গাইছেন।’

‘প্রমথেশবাবু? এ কী স্যার নব্বুই বছরের বুড়োর গলা? এ তো কোনো জোয়ান লোককেও লজ্জা দেবে। কী অসাধারণ গলার কাজ, শুনেছেন? মনে হচ্ছে যেন কোনো বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে। তবুও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।’

‘এতে অত অবাক হওয়ার কী আছে? নব্বুই বছর বয়েস হলেই কারুর গলা মিনমিনে হয়ে যাবে, এরকম কোনো কথা নেই। আমার ঠাকুরদার আশি বছর বয়েসেও বাজখাঁই গলা ছিল। ভোর বেলা গোয়ালার সঙ্গে তাঁর ঝগড়া শুনে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙত।’

বিশ্বরূপ আরও কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু একটা ক্ষীণ জলতরঙ্গের মতো হাসি তাঁর কথা বন্ধ করে দিল। একটু চটুল, অত্যন্ত মধুর কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আঃ! হয়েছে, হয়েছে একটু আস্তে। দোকানে লোক আছে।’

উত্তরে পুরুষকণ্ঠ গান থামিয়ে বলল, ‘থাকুক গে।’ বলে আবার শুরু করল, ‘নীল অম্বর চুম্বনরত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত…’

মুখের ওপর হাত বুলিয়ে বিশ্বরূপ বললেন, ‘এ তো রানিজির গলা নয়। মনে হচ্ছে, ওঁর সঙ্গে একটি অল্পবয়সি মেয়েও থাকে। থাকতেই পারে।’

দেবেন্দ্র বলল, ‘থাকতেই পারে কী স্যার? রানিজি যাই বলুন না-কেন, আমি এ রহস্য ভেদ না-করে যাচ্ছি না।’

‘রহস্যভেদ করবে কী করে? ও দিকে তো যেতে পারবে না। পেছনের দরজা তালা বন্ধ আর চারদিকে দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড় আর জঙ্গল।’

‘রাস্তা একটা আছে, স্যার। এই ঘরে ঢোকার সময় দেখেছি, পেছন থেকে একটা কাঁচা ড্রেন বেরিয়ে এসেছে একপাশ দিয়ে। ওখানে বোধ হয় একটা কুয়ো আছে। তার জল রাস্তার ধারে নয়ানজুলিতে ফেলবার জন্য ওটা কাটা হয়েছে। ওই ড্রেনের ভেতরে পা দিয়ে দিয়ে ঝোপঝাড় সরিয়ে ওপাশে চলে যাওয়া যাবে বোধ হয়।’

‘ড্রেনের ভেতরে পা দিয়ে দিয়ে? জুতোর বারোটা বাজবে!’

অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে দেবেন্দ্র বলল, ‘এইসময় আপনি জুতোর কথা ভাববেন স্যার?’

ত্রয়োদশীর চাঁদ তখনও মধ্যগগনে আসেনি। তার স্নিগ্ধ নরম আলোয় জঙ্গলটাকে মায়াকানন বলেই মনে হচ্ছিল। গানটা ততক্ষণে থেমে গেছে কিন্তু তার ‘লহ হৃদয়ের ফুলচন্দন’ যেন জ্যোৎস্নাধারার সঙ্গে মিশে তখনও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। জঙ্গলের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে-আসা কোনো রাতজাগা পাখির ডাক ছাড়া চারদিক তখন নিস্তব্ধ। রোমাঞ্চিত শরীরে বিশ্বরূপ আর দেবেন্দ্র সরু পায়েচলা পথ দিয়ে এগিয়ে চললেন।

রানিজির ঘরটা দোকান থেকে কুড়ি-পঁচিশ গজের ভেতরে। একটা অতিকায় মহীরূহের নীচে ছোট্ট একতলা বাড়ি। তার একটা আধখোলা দরজার ভেতর থেকে প্রদীপের হলদেটে আলো বেরিয়ে আসছিল। দু-জনে বাড়িটার কাছাকাছি আসতে দরজার পেছনে কারুর উপস্থিতি লক্ষ করা গেল। ওঁরা তাড়াতাড়ি পথের ধারে একটা ঝোপের পেছনে আত্মগোপন করলেন।

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। একহাতে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ আর অন্যহাতে কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা থালা নিয়ে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে দু-জনেই স্তম্ভিত। একটি পূর্ণযৌবনা মেয়ে, পরনে তার লাল-সাদায় ডুরে শাড়ি। তার স্নিগ্ধ পেলব মুখের ওপর প্রদীপের আলো একটা অপার্থিব, অনির্বচনীয় দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। সে সুন্দর কী অসুন্দর এই কথাটাই কারুর মনে এল না। কম্প্রবক্ষে, নেত্রপাতে, স্মিতহাস্যে সে চলেছে লজ্জিত বাসরশয্যায়।

বিস্ময়ে বিমূঢ় দুই গোপন দর্শকের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে মেয়েটি একটা স্তূপাকার ঝোপের সামনে দাঁড়াল। প্রদীপের আলোয় দেখা গেল, ঝোপের সামনে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ পেশিবহুল শরীর, পরনে ধুতি, অনাবৃত বুকের ওপর দু-টি পুরুষালি হাত আড়াআড়ি ভাবে রাখা। তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত রহস্যময় চটুল হাসি।

মেয়েটি তাঁর সামনে গিয়ে যেন গান গেয়ে উঠল, ‘এ সখি কি পেখঁলু এক অপরূপ শুনইতে মানবি স্বপন স্বরূপ।’

বিশ্বরূপ ফিসফিস করে বললেন, ‘এই মরেছে! এ আবার কী ভাষায় কথা বলছে?’

দেবেন্দ্র আবার বিমর্ষ হয়ে কানে কানে বলল, ‘ব্রজবুলী, স্যার।’

‘বটে? কী বলল বুঝলে?’

‘হ্যাঁ, স্যার। বলল একী অপরূপ রূপ দেখলুম! সখি তোর শুনলে মনে হবে যেন সে একটা স্বপ্ন।’

‘ঠিক। আমরা স্বপ্ন দেখছি না তো, ভটচায?’

‘না, স্যার। একেবারে বাস্তব। আপনার গায়ে চিমটি কেটে দেখব, স্যার?’

‘না, খবরদার!’

ইতিমধ্যে স্বপ্নস্বরূপ তাঁর নায়িকাকে একটি দীর্ঘ চুম্বন করেছেন। নায়িকার খোঁপা খুলে ঘনকৃষ্ণ মেঘের মতো আলুলায়িত কুন্তল ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর পিঠের ওপরে। সেই অত্যন্ত ব্যক্তিগত, অপ্রকাশ্য আশ্লেষ দৃশ্য কোনো ভদ্র সন্তানের গোপনে দেখা অন্যায় কিন্তু বিশ্বরূপ আর দেবেন্দ্রর মনে হচ্ছিল যেন ওঁরা কোনো ইংরেজি সিনেমার একটি মধুর রোমান্টিক দৃশ্যের অভিনয় দেখছেন। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটা তখন অবাস্তব। বটিচেলি বা রদাঁর শিল্পকর্মের মতো দৃশ্যটা এতই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন আর মনোগ্রাহী যে প্রথম রসের প্রাবল্য সত্ত্বেও ওঁরা চোখ ফেরাতে পারলেন না এবং তারপরে যখন নায়ক-নায়িকা আলিঙ্গবদ্ধ হয়ে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য ঘরটার মধ্যে ঢুকে গেলেন তখনও তাঁরা ন যযৌ না তস্থৌ হয়ে রইলেন।

বিশ্বরূপ বললেন, ‘এবার বোধ হয় আমাদের চলে যাওয়া উচিত, না কি বলো ভটচায?’

দেবেন্দ্র বলল, ‘যাব স্যার, শেষ দৃশ্যটা দেখেই চলে যাব।’

দেবেন্দ্রর কথায় বিশ্বরূপ অসন্তুষ্ট হলেন বলে একেবারেই মনে হল না। দু-জনে ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একটা ক্ষীণ আলোর রেখার দিকে উদবেল হৃদয়ে তাকিয়ে রইলেন।

একটু পরেই আবার মন্দ্রকণ্ঠে গান শোনা গেল, ‘তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে…’ গানের শেষে কিছু টুকরো টুকরো হাসি, পায়েলের ক্ষীণ ঝংকার, কিছু সুখের চাপা আর্তনাদ। তারও বেশ কিছু পরে ঝোপের ভেতরে আলোটা বিস্তৃততর হল। একটু বাদে নায়িকা বেরিয়ে এলেন। আঁচল দিয়ে মুখের আধখানা ঢেকে ত্রস্ত এবং সামান্য অসংলগ্ন পদক্ষেপে গিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। যখন দরজা বন্ধ করছেন তখন পেছনে আলো থাকার জন্য তাঁর মুখটা দেখা গেল না মোটে, কিন্তু এটুকু বোঝা গেল যে তাঁর মাথার সব চুল সাদা— ঠিক রানিজির মতো।

তার প্রায় পরমুহূর্তেই বাড়ির ভেতরের আলোটা নিভে গেল। তবে ঝোপের ভেতরে আলোটা জ্বলতেই লাগল।

দেবেন্দ্র ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন, স্যার?’

বিশ্বরূপ বললেন, ‘আমি দেখতে চাই ওই ঝোপের পেছনে ঘরটার ভেতরে কে আছে।’

‘যাবেন না, স্যার। আপনি যা দেখবেন, তা আপনার ভালো লাগবে না। আপনি সহ্য করতে পারবেন না।’

‘আমারও মনে হয় ভালো লাগবে না। কিন্তু ঠিক সহ্য করতে পারব। দ্যাখো তুমি।’

‘নাটক শেষ হয়ে গেছে, স্যার। এখন পর্দা তুলে তার পেছনে যা দেখবেন তাতে কিন্তু সুর কেটে যাবে। চলুন, আমরা ফিরে যাই।’

‘না ভটচায। নাটক এখনও শেষ হয়নি। তুমি থাকো। আমি একাই যাচ্ছি। বলে নীচু হয়ে পা টিপে-টিপে ঝোপটার দিকে এগিয়ে গেলেন বিশ্বরূপ। বোধ হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর শরীর আলোটাকে আড়াল করল। তার পরেই ছিটকে সরে এলেন। তাড়া-খাওয়া বানরের মতো চার হাত-পায়ে হুড়মুড় করতে করতে ছুটে এসে দেবেন্দ্রর পাশে আছড়ে পড়লেন। তাঁর মুখের প্রতিটি রেখা তখন একটা চরম বিভীষিকায় বিকৃত হয়ে রয়েছে।

দেবেন্দ্র দু-হাতে তাঁকে ধরে বলল, ‘বললুম স্যার, সহ্য করতে পারবেন না!’

বিশ্বরূপ খাবি খেতে খেতে বললেন, ‘পালাও, ভটচায, পালাও। ওটা যদি এখন বেরিয়ে আসে?’

দেবেন্দ্র বিশ্বরূপকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কেউ আসবে না, স্যার। চলুন, আমরা চলে যাই।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চলো। ওহ! কী বীভৎস, কী ভয়ংকর!’

বিশ্বরূপকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে যেতে দেবেন্দ্র বলতে লাগল, ‘কোনো ভয় নেই স্যার! আমরা তো ওঁদের কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে ওঁরাই বা আমাদের ক্ষতি করবেন কেন? ওঁরা দু-জনে ওঁদের পরস্পরের প্রতি তীব্র ভালোবাসায় নিজেদের একটা জগৎ তৈরি করেছেন। সে জগৎ আমাদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে। প্রতি রাত্রে যখন সে জগৎটা তৈরি হয় তখন সেই অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বে আমাদের জানা স্থান-কাল-জীবন-মৃত্যু সবকিছুই অন্য এক স্তরে চলে যায়। সেখানে তখন কে জীবিত বা কে মৃত, কে তরুণ বা কে বৃদ্ধ সেটা বোধ হয় অর্থহীন হয়ে পড়ে। হয়তো সময় এগিয়ে আসে বা পেছিয়ে যায়। বোধ হয় অনেকটা স্বপ্নের মতো। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন সেটাই বাস্তব। কিন্তু যখন জেগে উঠি তখন তা আর বাস্তব থাকে না। সারাদিনের দৈন্যের সঞ্চয়ই তো রাত্রের সেই স্বপ্নের আযোজন করে। সময়ের ওপর থেকে তারার আলোয় যিনি নির্নিমেষে চেয়ে আছেন, তাঁর খোলসটা দেখে তাঁকে ভয় পাবেন না, স্যার। তিনি প্রেমিক, তিনি কবি। তাঁর প্রতি অবিচার কবেন না।’

রঘুনাথ যখন এল তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘যদি অপরাধ না-নেন তো একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করব?’

বিশ্বরূপ পেছনের সিটে চোখ বুজে পড়েছিলেন। চোখ না-খুলেই বললেন, ‘কী প্রশ্ন?’

‘এই জঙ্গলটাকে স্যার, লোকে বলে জাদু জঙ্গল। এখানে নাকি সূর্য ডুবে গেলে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। আপনারা সেরকম কিছু কি দেখলেন?’

বিশ্বরূপ আর দেবেন্দ্র সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘না, না! সেরকম কিছু আমরা দেখিওনি, শুনিওনি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *