মেঘমালা

মেঘমালা

আমি সরকারদের রোয়াকে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলুম। আমার চারদিকে নানারকম শব্দ আর সেইসঙ্গে একটা তালগোল পাকানো স্রোত বইছিল, যার কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে দু-একটা শব্দ কানে আসছিল। যেমন কেউ একজন বললেন, ‘কেমন পাথরের মতো বসে আছে দেখুন, মনে হয় দেহে প্রাণ নেই।’ তার উত্তরে কোনো একটি নারীকণ্ঠ বলল, ‘তাতো হবেই। যা বাঁচা বেঁচেছে ছেলেটা।’ কে একজন মোটা গলায় ঘোষণা করলেন, ‘মিরাকল, মিরাকল!’ কিন্তু আমি একথাগুলোর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলুম না। এগুলো কি আমার সম্বন্ধেই বলা হচ্ছে? আমি কিছু চিন্তা করতে পারছি না। আমার মনটা যেন অসাড় হয়ে গেছে।

আসলে এসব কথাগুলো আমার মনে কোনোরকম দাগই কাটতে পারছিল না, কারণ আমি তখন আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে আমাদের বাড়িটার কথা ভাবছিলুম। বাড়িটা আর নেই। একটু আগেও যেটা আমার আশ্রয় ছিল সেটা তখন একটা প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসস্তূপের মতো আমার সামনে পড়ে আছে। পাড়ার লোকেরা আর দমকল কর্মীরা বড়ো বড়ো ইটের চাঙড় সরিয়ে মৃতদেহ খুঁজছে। ফুটপাথের ওপর চাদর ঢাকা দিয়ে চারটে মৃতদেহ পাশাপাশি রাখা আছে। আমি জানি ওরাই ছিল, আর কেউ নেই। কিন্তু সে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে না। কী হবে বলে?

আমি শুধু বাড়িটার কথা ভাবছিলুম।

এমন কিছু আহামরি বাড়ি তো ছিল না। ষোলো নম্বর জানকীনাথ চাটুজ্জে স্ট্রিটে দশকাঠা জমির ওপর এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন আমার ঠাকুরদাদা উনিশ-শো চল্লিশ সালে, যে বছর আমার বাবার জন্ম হয়। মাঝারি চারটে ঘর নিয়ে একতলা তুলেছিলেন। কোনো আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না, কোনো চাকচিক্যও ছিল না। উনিশ-শো পঁয়ষট্টিতে বাবার বিয়ে হয়েছিল। তখন দোতলায় দুটো ঘর তোলা হয়। সত্তর সালে আমার জন্ম। সেই তখন থেকে আর একটু আগে পর্যন্ত, এই চব্বিশ বছর ওই দুটো ঘরই ছিল আমার রাজত্ব। সে রাজত্বে বিলাসিতা ছিল না, তবে সুখ ছিল। আমাদের ঘরের সামনে ছিল খোলা ছাদ। সেখানে বিকেল হলে মা মাদুর পেতে বসত। গোধূলির ম্লান আলোয় চাপা শান্ত গলায় মা কখনো গানের পর গান গাইতো, কখনো সঞ্চয়িতার কবিতা পর পর মুখস্থ বলে যেত। মার মুখেই আমি প্রথম শুনেছিলুম, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।’ মা গানটা কখনোই শেষ করতে পারত না, গলা বুঁজে আসত। শুনেছি, এই গানটা না কি বাবার খুব প্রিয় গান ছিল।

আমার বাবাকে আমার খুব আবছা মনে পড়ে। একজন দীর্ঘদেহী মানুষ একটা শুকনো গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে আমার সঙ্গে তরোয়াল খেলছেন— এ-ছবিটা আমার মনে আছে। তাঁর ফোটোগ্রাফ যা দেখেছি তাতে দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ তো বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁর শান্ত সজল চোখদুটো তাঁর মেধা আর ব্যক্তিত্বের একটা পরিচয় দিত। বাবা কলকাতার একটা নামজাদা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। মা না কি তাঁর ছাত্রী ছিল। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসে ব্লাড ক্যান্সারে বাবা মারা যান। ঠাকুরদাদা আর ঠাকুমা দু-জনেই তখন জীবিত। ঠাকুরদাদার বয়েসও তখন ভয়ংকর রকমের বেশি নয়। বোধ হয় পঁয়ষট্টি হবে। তাঁর শরীর ও মন, দুই-ই শক্ত ছিল, নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলেন। তবে ঠাকুমা পারেননি। দু-বছর পরেই ক্যানসার রোগে মারা যান।

তখন আমাদের সংসারে শুধুমাত্র তিনজন লোক। কিংবা আড়াইজন। মা স্কুলে পড়ানো শুরু করল। সে যুগে স্কুলে পড়ানো টাকাপয়সার দিক থেকে একেবারেই লোভনীয় ছিল না; বরং তার পরিমাণ এতই কম ছিল যে ঠাকুরদাদার পেনশনের টাকা যোগ দিয়েও তিনজনের সংসার চালানো কঠিন ব্যাপার ছিল। ফলে মাকে একটা টিউশনি নিতে হয়েছিল। শুনেছি, ঠাকুরদাদা না কি আবার চাকরির চেষ্টায় নেমেছিলেন, কিন্তু পরে হাল ছেড়ে দেন। তাঁর প্রৌঢ়ত্ব আর সামান্য একটা এমএ ডিগ্রি জীবনযুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ তাঁকে দেয়নি। ফলে, তিনি আমাকে মানুষ করার দুরূহ চেষ্টায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

লড়াই করে গেল মা— অবিশ্রান্ত, ক্ষান্তিহীন; কিন্তু সেজন্য কোনোদিনও মাকে বিষণ্ণ বা বিরক্ত হতে দেখিনি। অবসন্ন দেখেছি কিন্তু নিজের ভাগ্যকে কখনো অভিসম্পাত দিতে শুনিনি। কেবল আমার যখন জন্ডিস হয়ে খারাপের দিকে গেল, ডাক্তারবাবু মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলেন, কেবল সেদিন মা-কে দেখেছিলুম বাবার ছবির দিকে হাতজোড় করে তাকিয়ে অশ্রুবিসর্জন করতে।

আমি কিন্তু মার কথা ভাবছি না। ঠাকুরদাদা বা বাবার কথাও নয়। আমি ভাবছি বাড়িটার কথা আর মেঘমালার কথা। মেঘমালার কথা ভাবতে গেলে, এসব কথা অবশ্য এসেই যায়। আমি যদি জন্ডিস হয়ে মরতে না-বসতুম, তাহলে হয়তো কোনোদিনই আমার মেঘমালার সঙ্গে দেখা হত না।

আমার তখন পনেরো বছয় বয়েস। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই সময় আমার জন্ডিস হয়েছিল। ডাক্তারবাবু জবাব দেওয়া সত্ত্বেও মরিনি, বেঁচে উঠেছিলুম। কিন্তু, নড়াচড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঘর থেকে বেরুনোই বারণ ছিল। তখন আমার পড়ার টেবিলটা ঠাকুরদাদার ঘর থেকে আমাদের ঘরে এনে রাখা হল। একটা নতুন চকচকে টেবিল ল্যাম্পও এল। এমনকী নীল রঙের চৌখুপি ডিজাইন করা একটা টেবিল ক্লথ পর্যন্ত পাতা হল।

টেবিলটা রাখা হয়েছিল উত্তর দিকের জানলাটার পাশে। সে জানলাটা জন্মাবধি আমি কখনো খোলা দেখিনি। সেটা যে খোলা যায় তাই কখনো আমার মনে হয়নি। এবার মিস্ত্রি ডেকে জানলাটাও খুলে দেওয়া হল।

জানলাটা বন্ধ করে রাখার অবশ্য একটা কারণ ছিল।

স্বাধীনতার পরের বছর, পূর্ব বাংলা থেকে ঠাকুরদাদার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় এসে এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সপরিবারে। তাঁর নাম ছিল প্রদীপ কুমার ঘোষ। প্রায় একবস্ত্রে এসেছিলেন, কোলে তিনমাসের একটি মেয়ে। উত্তরদিকের একটা ঘরে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেখানে প্রায় একটানা আঠাশ বছর থেকে পঁচাত্তর সালে অন্যত্র চলে যান। সে বছরই আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল।

ঘোষ পরিবারের আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কারণে অবশ্য বাবার মৃত্যু হয়নি। প্রদীপবাবুর বড়ো ছেলে ব্যাঙ্গালোরে ভালো চাকরি পেয়ে তার বাবা, মা আর ছোটো বোনকে সেখানে নিয়ে চলে যান। তাঁদের কাউকেই আমার মনে পড়ে না। আমি কেবল তাঁদের ফোটোই দেখেছি। প্রদীপবাবুর বড়ো মেয়ের ওই বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল।

এখন অবশ্য ইতিহাস। কথা হচ্ছিল, উত্তর দিকের দোতলার জানলাটা বন্ধ থাকার কারণ নিয়ে; তবে এসব ইতিহাস একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়। আসলে আমাদের বাড়ির একতলায় একটাই বাথরুম ছিল। সেটা দুটো পরিবারের একসঙ্গে ব্যবহার করায় ঠাকুমার আপত্তি ছিল। তখন ঠাকুরদাদা উত্তর দিকের খালি জমিটায় একটা কুয়ো খুঁড়ে দেন আর একটা কলঘর বানিয়ে দেন। ফলে ওই উত্তরের জমিটা ঘোষ পরিবারের মহিলাদের যাবতীয় সাজকর্মের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। সেইসব কাজকর্মের মধ্যে চান করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা ইত্যাদি সব-ই ছিল। যখন দোতলা উঠল তখন আব্রু রাখার জন্য উত্তর দিকের জানলাটা সবসময়ের জন্য বন্ধই রাখা রইল। না-রাখলে সেটা অন্যায় হত, কারণ প্রদীপবাবুর বড়ো মেয়ের বয়েস তখন সতেরো আর ছোটো মেয়ের চোদ্দো। এরপর যখন বাবা মারা গেলেন, ঘোষ পরিবার একতলাটা খালি করে চলে গেলেন, তখনও জানলাটা বন্ধই রইল। সেটা খোলার কথা কারুর মনেই এল না।

জানলা খুলে দিতেই মনে হল যেন ঘরটা অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি অনেকক্ষণ গরাদ ধরে বাইরে তাকিয়ে চুপটি করে বসে রইলুম। দৃষ্টিটা অনেকদূর পর্যন্ত যাচ্ছিল। পেছনের জমিটা বেশ বড়োই, তার মাঝখানে একটা কুয়ো, চারদিক বাঁধানো, সামনে বাথরুম। এত বছরের অব্যবহারে সবই জীর্ণ হয়ে এসেছে। বাথরুমের দরজা নেই, ছাদ নেই, কুয়োর ধারে ধারে আগাছার জঙ্গল। ঠাকুরদাদা বললেন, ঘোষেরা চলে যাবার পর ওদিকে আর কেউ যায়নি, কিছুটা অভ্যাসবশতঃ, কিছুটা উৎসাহের অভাবে। জমিটার একপাশে কয়েকটা নারকেল গাছ আর কাঁঠালি চাঁপার গাছ আর অন্যপাশে বাথরুমের সিঁড়ির ধারে একটা কদম গাছ। আমার সমস্ত দৃশ্যটা বড়ো ভালো লাগল। মনে হল, আমার এখানে সময় কাটানোর কোনো সমস্যাই হবে না। গাছে ফুল আছে, পাখি আছে, পাতাগুলোর হাওয়ায় দোলা আছে, কুয়োর চারদিকে শুকনো পাতার ঘুরে ঘুরে ওড়া আছে, কাঠবেড়ালির ব্যস্তসমস্ত যাতায়াত আছে— এসব দেখতে দেখতেই তো আমার সারাদিন কেটে যাবে। আমার একটা সবুজ রেলিসনে বাঁধানো ডায়েরি ছিল। সেটাতে আমি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতুম আর বিশেষ যত্ন সহকারে লুকিয়ে রাখতুম। মাকেও দেখাতুম না। সেদিন আমি একটা লম্বা কবিতা লিখে তার দেড় পাতা ভরিয়ে ফেললুম।

প্রথম প্রথম এখানে বেশিক্ষণ টেবিলে বসে পড়াশুনো করতে দেওয়া হত না। বিকেল হতে না-হতেই শুয়ে পড়বার হুকুম হত। তখন ভরা গ্রীষ্মকাল, কাজেই আমি যখন টেবিল ছেড়ে উঠতুম তখনও আকাশে আলোর অভাব থাকত না। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসতে লাগল, আমার পড়াশুনোর সময়ও ততই বাড়তে লাগল। সন্ধে হয়ে গেলে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিতুম। দারুণ ভালো লাগত সেই আলোয় পড়তে, কোনোদিকে তাকাতুম না।

মাধ্যমিক তখন আরও এগিয়ে এসেছে। রাত তখন ন-টা হবে। কোনো একটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চিন্তার করছিলুম। হঠাৎ দৃষ্টিটা নীচের দিকে পড়ায় বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। স্পষ্ট দেখলুম, ভাঙা বাথরুমের সিঁড়ির ওপর কদম গাছটার নীচে একটি অল্পবয়সি মেয়ে বসে রয়েছে। তার পরনে একটা ছিটের ফ্রক। ফর্সা গায়ের রং। পায়ের ওপর পা তুলে, হাঁটুর ওপর কনুই রেখে, গালে হাত দিয়ে সে যেন আমার দিকেই চেয়ে বসে আছে। তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না বটে; কিন্তু ঘাড় বাঁকানোর ভঙ্গিমা দেখে সন্দেহ থাকে না যে তার নজরটা আমার দিকেই।

এইসময় ওই পোড়ো জমিতে কিশোরী মেয়ে? নির্ঘাৎ ভূত! আমি আতঙ্কে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালুম। সঙ্গেসঙ্গে মূর্তিটা মিলিয়ে গেল। আবার বসলুম, তখন দেখি পুনরায় সেই ছবি সেই জায়গায়। তখন খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখি, জানকীনাথ চাটুজ্জে স্ট্রিট আর অনন্ত চৌধুরি লেনের দু-টি রাস্তার আলো আর আমার ঘর থেকে বেরুনো টেবিল ল্যাম্পের আলো গাছের ডালে আর পাতায়, বাথরুমের ভাঙা দেওয়াল আর সিঁড়ির খাঁজে পড়ে আলোছায়ায় এই দৃষ্টিবিভ্রমটি তৈরি করেছে। আমি যেখানটায় বসে আছি কেবল সেখান থেকেই এই ব্যাপারটাকে একটি মেয়ে বলে মনে হচ্ছে, অন্য কোনো জায়গা থেকে নয়।

বেজায় মজা লাগল। তাকিয়ে দেখি একটা হঠাৎ হাওয়ায় গাছের পাতা কাঁপছে আর ঠিক যেন মেয়েটিও দুলে দুলে হাসছে।

বাঃ, এতো বেশ। একে তো আমার বন্ধু করা যেতে পারে। পড়াশুনো করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ব তখন এর সঙ্গে কথা বলা যাবে। প্রাণের বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আমার কেউ নেই। অথচ অনেক কথা জমে ওঠে যা কারুর কাছে বলতে ইচ্ছে করে। তাদের সবকথা আবার মা বা ঠাকুরদাদাকে বলা যায় না। সে সব কথা তো এর সঙ্গে বলা যাবে।

আমি তাকে বললুম, ‘তুমি আমার বন্ধু হবে?’

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হব বই কী। সেই জন্যেই তো কখন থেকে ডাকছি তোমাকে।’

‘বটে? তুমি তাহলে আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ড।’

মেয়েটি হাসল। বলল, ‘তাই না কি?’

আমি বললুম, ‘জানো, আমি কবিতা লিখি? কিন্তু কাউকে দেখাতে লজ্জা করে যদি তারা হাসে। অথচ সে কথাগুলো তো আমি বলতে চাই, তার মানে কাউকে শোনাতে চাই। তুমি শুনবে আমার কবিতা?’

সে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই শুনব।’

‘বেশ। কিন্তু, তোমার তো একটা নাম থাকা দরকার। কী নাম তোমার?’

‘নাম তুমিই দাও না। যা তোমার পছন্দ।’

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললুম, ‘নাঃ, একটাও ভালো নাম মনে আসছে না। পরে ভেবে নাম ঠিক করব।’

‘দ্যাখো, আমি প্রায়ই তোমাকে কবিতা শোনাই। কোনো ভালো জিনিস পড়লে তোমাকে বলি। তুমি মাথা নাড়ো, কথা বলো, কিন্তু তোমার মুখ দেখতে পাইনে।’

‘আমার মুখ কীরকম বলে ভাব তুমি? হয়তো দেখবে তুমি যেরকম ভাব আসলে সেটা ঠিক সেরকমই।’

‘তাই? তাহলে বলি? তোমার তো দেখছি কোঁকড়া চুল, আমার মার মতো নয়। এবারে তোমার ভুরু দুটো একটু মোটা হলে ভালো হয়। খুব সরু ভুরু আমার একেবারে ভালো লাগে না।’

‘তোমার মার মতো?’

‘ঠিক বলেছ। কিন্তু চশমা থাকলে চলবে না। চোখদুটো কালো মতো হবে, বাদামি বা নীল নয়। নাকটা সিধে সরল হওয়া চাই আর ঠোঁটদুটি মাঝারি— খুব মোটাও নয়, সেটা বিচ্ছিরি লাগে, খুব পাতলাও নয়, সেটা দেখলে ভয় করে।’

‘কী আশ্চর্য, সব মিলে গেল যে! এতো একেবারে আমারই বর্ণনা।’

‘সত্যি? তাহলে তোমার নামও আজকে ঠিক করে ফেলি?’

‘কী নাম?’

‘মেঘমালা। আমি তোমার নাম দিলুম মেঘমালা। তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগন বিহারী।’

‘লেখাপড়া কিছু নেই না কি? পরীক্ষার আর বাকি কত?’

‘বেশি নয়। তবু, তোমার নামটা আবিষ্কার করে প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে। আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা।’

‘ঢের হয়েছে। এখন ”তুমি আমারই তুমি আমারই” বলে চিৎকার জুড়ো নো যেন।’

‘তা কখনো পারি? ঠাকুরদাদা ছাদে পায়চারি করছে। শুনলে এসে কান মুলে দেবে।’

‘কী, খুব তো নার্ভাস হয়ে পড়েছিলে, তাই না?’

‘সত্যিই তাই। ভেবেছিলুম অঙ্কে জীবনে পাশ করতে পারব না।’

‘কত পেলে?’

‘সে অনেক। এখন দু-বছর তো নিশ্চিন্ত, তারপরে আবার দেখা যাবে।’

‘কোথায় পড়বে? কলেজে?’

‘নাঃ, আমার পুরোনো স্কুলেই। সেখানে সবাই আমাকে জানে। ফ্রিতে পড়তে পাই। তা ছাড়া এখানে মাস্টারমশাইদের কাছে যখন খুশি যেকোনো প্রবলেম নিয়ে যেতে পারি, কলেজে তো আর তা পারব না।’

‘স্কলারশিপ পাবে না কলেজে পড়লে?’

‘পেতে পারি। কী দরকার? একই তো পড়া, একই পরীক্ষা। কলেজে পড়ায় অহংকারটুকু ছাড়া আর তফাত কোথায়? আমার এত অহংকার নেই। আমি স্কুলেই পড়ব।’

বছরখানেক বাদে একদিন খাবার ঘরে মা বলল, ‘বাবা, আর একটা টিউশনি নেব ভাবছি। সপ্তাহে দু-দিন, এক-শো টাকা। কাছেই।’

ঠাকুরদাদা মাথা নীচু করে খাচ্ছিলেন। খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘নিজের ওপর বড়ো বেশি প্রেশার নিচ্ছ মা। সামলাতে পারবে?’

‘পারব বাবা। প্রেশার কিচ্ছু নয়। কাছেই তো।’

ঠাকুরদাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি জানি এই এক-শো টাকাটা আজ আমাদের বড়ো বেশি দরকার। তবে তার জন্য… আচ্ছা বউমা, একটা কাজ করলে হয় না?’

‘কী বাবা?’

‘দ্যাখো, আমি যদি উত্তরের জমিটার বাথরুম আর কুয়োটা সারিয়ে ফেলি আর প্রদীপদের ঘরটা আর আমার বসবার ঘরটা একসঙ্গে করে ভাড়া দিই, তাহলে তো অনেক সাশ্রয় হতে পারে। আমার একটা আলাদা বসবার ঘরের তো কোনো দরকার নেই। আমার একটা ঘরই যথেষ্ট। আর এই ছিয়াত্তর বছরের বুড়োর প্রায় কোনো বন্ধুই আর জীবিত নেই। থাকার মধ্যে আছে কেবল অবিনাশ। সে যখন আসবে, আমরা শোবার ঘরেই বসব।’

‘বাথরুম আর কুয়োটা সারাতে খরচ কত লাগবে?’

‘তা হাজার পাঁচ-ছয় তো লাগবেই। তবে খরচের জন্য তুমি চিন্তা করো না। আমি মাড়োয়ারির দোকানে ধার নেব। ভাড়ার টাকা থেকে শোধ দিয়ে দেব। কারুর কোনো গায়ে লাগবে না।’

‘না।’ মা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল।

ঠাকুরদাদা করুণ মুখ তুলে বললেন, ‘না? না কেন, বউমা?’

‘প্রথমত টাকা ধার আপনি করতে পারবেন না। সারাজীবন মাথা উঁচু করে থেকেছেন। চরম বিপদের দিনেও কারোর কাছে নত হতে দেখিনি আপনাকে। আর আজ এই বয়েসে আপনি গিয়ে মাড়োয়ারির কাছে হাত পাতবেন? আমি জীবিত থাকতে তা হতে দেব না, বাবা। তা ছাড়া, ভাড়া দেবেন কাকে? সবাই প্রদীপকাকার মতো ভালো লোক নয়। কীরকম ভাড়াটে আসবে কে জানে? আপনি নীচে একেবারে একা থাকেন।’

‘আমাকে কে কী করবে, বউমা? করবেই বা কেন?’

‘না, না, আমি করার কথা বলছি না। হই হট্টগোল তো হতে পারে। দোতলায় যদি একটা বাথরুম থাকতো তো আপনাকে ওপরে নিয়ে যেতুম।’

‘ও বাবা, তাহলে আমার মর্নিং আর ইভিনিং ওয়াকের কী হবে?’

‘কেন, ছাদে?’

‘না বউমা। জীবনের শেষে এসে পড়েছি। পৃথিবীটা আরও সংকীর্ণ হলে সইতে পারব না।’

‘তাহলে যেমন চলছে, তখনই চলুক, বাবা। আমি টিউশনিটা নিয়েই নিই।’

ঠাকুরদাদা কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। শেষপর্যন্ত ধরা গলায় বললেন,

‘যা ভালো বোঝো, করো।’ বলে উঠে চলে গেলেন।

ঠাকুরদাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, আমি বললুম, ‘মা, আমার একটা চাকরি হয় না? আমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছি, মাধ্যমিক পাশ।’

মা সশব্দে হেসে উঠল, ‘মাধ্যমিক পাশ? বাপরে। তোর জন্যে তো সবাই অফিস সাজিয়ে বসে রয়েছে! যা না, কোথাও গিয়ে ঢুকে পড়।’

‘ঠাট্টা নয় মা। বলো না, আমি একটা চাকরি নিই?’

‘কী চাকরি নিবি তুই? ওই তো টিংটিঙে স্বাস্থ্য, তোকে তো কেউ কুলির কাজও দেবে না। রিকশাও টানতে পারবি না।’

‘তুমি শুধু ঠাট্টা করছ। আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে চাইছিলুম।’

‘তা তো বুঝতেই পারছি। তবে বলি শোন, আমাকে যদি সাহায্যই করতে চাস তাহলে মন দিয়ে পড়াশুনো কর। তোর থাকার মধ্যে আছে ওই মাথাটা। সেটাকে কাজে লাগা। তারপর, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমাকে দোতলায় ছাদের পাশে একটা বাথরুম করে দিবি। তাহলেই যথেষ্ট সাহায্য হবে। তখন আমি আরও বুড়ো হয়ে যাব, রাতবিরেতে সিঁড়িভাঙার কষ্ট আর সহ্য করতে হবে না।’

সেই বাথরুম আর কোনোদিনও তৈরি হবে না।

সেদিন রাত্রে পড়ার টেবিলে এসে বসলুম। মা মৃদু হাসল। বোধ হয় ভাবল যে ওঁর কথাটা আমার মনে ধরেছে। আসলে, আমি কিন্তু পড়তে বসিনি। বসেছিলুম, মেঘমালার সঙ্গে কথা বলতে।

টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলুম। মেঘমালাকে বললুম, ‘খুব বেঁচে গেছ, জানো? ঠাকুরদাদা যে প্ল্যান করেছিলেন তাতে তোমার এখানেই ইতি হত।’

মেঘমালা গম্ভীর মুখে বলল, ‘হলে হয়তো ভালোই হত। তোমার মার এই উদয়াস্ত পরিশ্রমের একটা সুরাহা হত। কী চেহারা হয়েছে ওঁর, দেখেছ? কত বয়েস হবে তোমার মার? চল্লিশ? অথচ, এখনই মাথার চুলে কীরকম পাক ধরেছে।’

‘দাঁড়াও না। আগে আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নিই, তারপরে দেখবে কে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আর কার মা চাকরি-বাকরি ছেড়ে ওই ইজিচেয়ারটায় বসে কেবল বই পড়ে আর গান শোনে।’

‘তার আর বাকি কত?’

‘অনেক। অন্তত বছর সাতেক তো বটেই। বড়ো ভয় হয় মা কি অতদিন এই বোঝা টেনে বেড়াতে পারবে?’

‘কোথাও বাইরে যাও না। ছুটিতে তো সবাই বেড়াতে যায়, তোমরাও যাও।’

‘বেড়াতে অমনি গেলেই হল? খরচ আছে না? আর মা ঠাকুরদাদাকে ফেলে কোথাও যাবে না। আমাদের যদি কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতো, তাহলে হয়তো তাদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া যেত। বাইরে নয়, কলকাতাতেই। ধরো, বালিগঞ্জে কিংবা যাদবপুরে। তাহলেও একটা পরিবর্তন হত।’

‘কেউ নেই?’

‘একেবারে নেই তা নয়। আছে। আমার মামা আছেন দু-জন, আরও কারা সব আছেন মার দিকে। বাবার দিকটা অবশ্য একেবারে ফাঁকা। আমি শ্রী দেবপ্রিয় দত্ত ঈশ্বর দীপক দত্তের একমাত্র সন্তান। আবার ঈশ্বর দীপক দত্ত ছিলেন শ্রী দিননাথ দত্তের একমাত্র সন্তান। শুনেছি দিননাথও নাকি তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন।’

‘চমৎকার! কিন্তু তোমার মামারা তো কখনো আসেন না।’

‘নাঃ, কক্ষনো না। শুনেছি মার বিয়েতে না কি ওঁদের আপত্তি ছিল। ওঁরা বাবাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। ফলে, বাবা আমার মামাবাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর মামারা না কি এসেছিলেন, কিন্তু মা তাঁদের চৌকাঠ পেরুতে দেয়নি। ধুলো পায়ে বিদেয় দিয়েছিল।’

‘বাঃ, এরকম করলে কি আত্মীয়তা থাকে?’

‘কখনো নয়। আমি কোনোদিনও মামাবাড়ি যাইনি। শুনেছি, উলটোডাঙায় ওঁদের বিরাট বাড়ি, বর্ধমানের কোনো গ্রামে অনেক জমিজমা।’

‘তার মানে ওঁরা তো বেশ বড়োলোক। তোমার মাকে সাহায্য করতে পারেন না?’

‘পারেন হয়তো। কিন্তু মা কি সাহায্য নেবে? কক্ষনো নয়।’

‘তোমার বাবা-মার বিয়েতে ওঁরা কেন আপত্তি করেছিলেন, জানো?’

‘ঠাকুরদাদার মুখে শুনেছিলুম, বাবা গরিব কলেজ লেকচারার বলে ওঁদের আপত্তি ছিল। ওঁদের ইচ্ছে ছিল মা-র একজন খুব বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হোক। মা বেঁকে বসেছিল। কিছুতেই রাজি হয়নি।’

‘তোমার খুব মামাবাড়ি যেতে ইচ্ছে করে, না?’

‘হ্যাঁ। করে। ট্রেনে চড়ে যাব, সারাদিন শুধু খাব আর মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াব। জানো, আমি জীবনে একবারই বাইরে গিয়েছিলুম। গয়ায়। ঠাকুরদাদা গিয়েছিলেন বাবার পিণ্ড দিতে, আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি না কি ট্রেনের বাইরে পাহাড় দেখে মাকে বলেছিলুম, ‘মা, মা, ওগুলো কি সত্যিকারের পাহাড়?’ তাই শুনে ট্রেনসুদ্ধু লোকের কী হাসি। কী হল? গম্ভীর হয়ে গেলে যে! কী ভাবছ?’

‘ভাবছি, আমিও তোমারই মতো। কোথাও যাইনি কোনোদিন। শুধু এই খানেই আটকা পড়ে গেছি। এই বাড়ির এই কোণাটায়।’

মেঘমালা আজ কিন্তু মুক্তি পেয়েছে। আমাদের বাড়িটা আর তাকে আটকে রাখতে পারল না।

এরপর থেকে ঠাকুরদাদা যেন কেমন পালটে গেলেন। আমি ওঁর নাম দিয়েছিলুম পোলোনিয়াস কিন্তু কখন যেন ওঁর কথার স্রোত ক্রমশ কমে এল। হাস্যোজ্জ্বল চোখদুটো মাঝে মাঝেই দেখি বিষণ্ণ। ইংরেজি কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ওঁর মাধ্যমেই অথচ সে ব্যাপারেও ওঁর উৎসাহ আর তেমন দেখি না।

একদিন মেঘমালাকে বললুম, ‘ঠাকুরদাদাকে দেখলে বড়ো ভয় করে। ওঁর মনটা ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।’

মেঘমালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অসম্ভব নয়। উনি যে সংসারে কোনো সাহায্য করতে পারছেন না, সেই যন্ত্রণাটা ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।’

‘হ্যাঁ। আর তার ওপরে কানে কম শুনছেন। সেটাও কম দুঃখের কথা নয়। হয়তো এইসব মিলিয়ে কেমন যেন সকলের কাছ থেকে, সব কিছুর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন— এটা তো ভালো নয়।’

উচ্চ মাধ্যমিকের মাস ছয় আগে আমার ভয়টাই সত্যি বলে প্রমাণিত হল। ঠাকুরদাদা ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল কিন্তু মার অশ্রুহীন নির্নিমেষ দু-টি চোখের দিকে তাকিয়ে আর কাঁদতে পারলুম না। যথাসাধ্য নির্বিকার মুখে সমস্ত কাজ করে গেলুম।

সেদিন থেকে অনেকদিন পর্যন্ত প্রায় রোজ রাত্রে মেঘমালার সঙ্গে ঠাকুরদাদার কথা আলোচনা করতুম। আলোচনা আর কোথায়? কেবল আমিই বলে যেতুম আর মেঘমালা শুনে যেত। মা মাঝে মাঝে বলত, ‘চুপ করে বাইরে তাকিয়ে কী ভাবিস অত?’

আমি মাথা নেড়ে বলতুম, ‘কিছু না মা।’ মা বুঝতে পারত না যে আমি চুপ করে থাকি না, অনর্গল কথা বলে যাই।

‘ঠাকুরদাদার কথা ভাবিস?’

আমি আবার মাথা নাড়তুম, ‘না, মা। কিছু না।’

আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভরতি হলুম।

মা বলল, ‘হ্যাঁরে, পারবি তো?’

আমি হেসে বললুম, ‘কেন পারব না, মা? তুমি দ্যাখোই না, কীরকম রেজাল্ট করি।’

‘তোর রেজাল্ট নিয়ে আমি ভাবি না। আমি ভাবছি কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গিয়ে ভুল করলি না তো? তোর ঠাকুরদাদা বলতেন, তোর না কি সাহিত্যে খুব ন্যাক। আমাকে বলতেন, ওকে ইংরেজি সাহিত্য পড়িও। দেখবে ও একদিন খোকনের মতো ডাকসাইটে অধ্যাপক হবে।’

‘দূর, দূর ওসব বাদ দাও তো। আজকাল সাহিত্য কেউ পড়ে? আমার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কোনো অসুবিধে হবে না, দেখো তুমি। তা ছাড়া তুমি তো আছই। যখনই কিছু ফাঁকা সময় পাব, তোমার কাছে সাহিত্য পড়ে যাব।’

‘পাগল নাকি? আমি ইশকুলের মাস্টারনি। আমার কাছে কী পড়বি তুই?’

‘তুমি যা যা বাবার কাছে পড়েছিলে তাই পড়াবে আমাকে। আর ওই বইগুলো। ওগুলোর ওপর আমার বড়ো লোভ। ওদের কিছু কিছু আমি পড়েছি। বেশ শক্ত। দেখেছি মার্জিনে তোমার আর বাবার নোট। ওগুলো পড়িও আমাকে।’

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। বলল, ‘কী জানি, মনে হচ্ছে তোকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দিয়ে বোধ হয় ভুলই করলুম।’

‘কিচ্ছু ভুল করোনি। আমি ইঞ্জিনিয়ার না-হলে দোতলার বাথরুমটা বানাবে কে?’

মা হেসে উঠল। বলল, ‘তুই ওকথা মনে করে বসে আছিস?’

‘নিশ্চয়ই। তুমি কিচ্ছু ভেব না মা। আমি ইঞ্জিনিয়ারিংও পড়ব, সাহিত্যও পড়ব। একটা ইউনিভার্সিটিতে অন্যটা এখানে। তুমি আছ আর ওই বইগুলো আছে। তবে আবার চিন্তা কীসের?’

আজ মা নেই, বইগুলোও গেল। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাদের একটাকেও আর বোধ হয় উদ্ধার করা যাবে না।

মাসদুয়েক বাদে সন্ধে বেলা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে পড়ার টেবিলে বসে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালতেই দেখি মেঘমালা খুব ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে আছে। বলল, ‘ব্যাপারটা কী বলোতো? তোমাকে যে আজ বেজায় খুশি খুশি দেখাচ্ছে।’

‘আছে, আছে। ব্যাপার গুরুতর।’

‘বলে ফ্যালো।’

‘আজ একটা যা কাণ্ড হয়েছে। আমাদের ফ্যাকাল্টির আজ সোশ্যাল ছিল। আমার স্কুলের বন্ধু প্রিয়ব্রত চ্যাটার্জী, ওর কথা তো তোমাকে বলেছি, কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ সোশ্যালের মধ্যে মাইকে অ্যানাউন্স করল, এখন গান শোনাবে ফার্স্ট ইয়ারের দেবপ্রিয় দত্ত। আমি অনেক আপত্তি করলুম কিন্তু কেউ আমার কথাই শুনল না, জোর করে স্টেজে তুলে দিল।’

‘গাইলে?’

‘গাইলুম। মার কাছে শেখা দুটো গান। একটা, বিরহ মধুর হল আজি আর অন্যটা দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি।’

‘শ্রোতারা ঢিল মারেনি?’

‘বাজে বোকো না। ঢিল মারবে! প্রচণ্ড হাততালি দিল। ফাংশনের শেষে কতলোক এসে আমকে কনগ্র্যাচুলেট করে গেল।’

‘তারপর?’

‘তারপর আবার কী? তারপর বাড়ি চলে এলুম।’

‘উঁহু! তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারপরেও আরও কিছু আছে। তাই না?’

‘হ্যাঁ, আছে। সত্যিই আছে। আমাকে যারা কনগ্র্যাচুলেট করে গেল তাদের মধ্যে একজনকে কিছুতেই, কী বলব মন থেকে সরাতে পারছি না। বার বার তার চোখদুটো মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসছে। এত শান্ত, গভীর আর সুন্দর চোখদুটো!’

‘বটে? কী নাম?’

‘স্রগ্ধরা, স্রগ্ধরা রায়চৌধুরি। আমাদেরই ইয়ারে; তবে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে।’

‘স্রগ্ধরা? এঁঃ বড্ড কটমট নাম!’

‘হ্যাঁ, তা একটু ঠিকই। কিন্তু স্রগ্ধরা মানে জানো? একটা সংস্কৃত ছন্দের নাম। যেমন মন্দাক্রান্তা, ভুজঙ্গপ্রয়াত বা শার্দূলবিক্রীড়িত তেমনই। শুনলুম, ওরা তিনবোন। গায়ত্রী, মালিনী আর স্রগ্ধরা— তিনটেই ছন্দের নাম।’

একটা ঝোড়ো বাতাস উঠল। দেখি মেঘমালা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। আমি একটু রেগেই গেলুম। বললুম, ‘অত হাসির কী আছে?’

‘ভাবছি, জোর বেঁচে গেছ। ভাগ্যিস ওর বাবা ওর নাম শার্দূলবিক্রীড়িত রাখেননি। তাহলে তোমার যে কী অবস্থা হত!’

‘কেন, কী হত?’

‘জীবনেও ওকে কোনোদিন একটি চিঠি লিখে উঠতে পারতে না। ভাঙা কলমে কি আর চিঠি লেখা চলে?’

‘ফের বাজে কথা। আমার বাংলা বানানে যথেষ্ট, যাকে বলে, ব্যুৎপত্তি আছে। তবে কিনা, আমি ওকে কোনোদিন চিঠি লেখার কোনো সুযোগই পাব না। আমাকে পাত্তাই দেবে না।’

‘খুব সুন্দরী?’

‘তেমন কিছু নয়। মোটামুটি বলতে পারো। তা নয়, স্রগ্ধরা ভীষণ বড়োলোক পরিবারের মেয়ে। প্রকাণ্ড একটা গাড়ি চড়ে কলেজে আসে। প্রিয়ব্রত বলল, ওর বাবা না কি বম্বের একজন প্রচণ্ড নামকরা ডাক্তার।’

‘মেয়েটা খুব চালিয়াত বুঝি?’

‘না না, একেবারেই নয়। পোশাক-আশাক বা চালচলন, কোনোটাই ঠিক বড়োলোকসুলভ নয়। বরং, খুব সাধারণ। কেবল ওই গাড়িটা ছাড়া।’

‘পাত্তা দেবে না বলছ?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

ঠাকুরদাদা চলে গেলেন সংসারে একজন লোক কমে গেল অথচ মার পরিশ্রম কমল না। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যে এত খরচ, কে জানতো? তার ওপর আমাদের বাড়িটা কলকাতা কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে চলে এল, যে-জন্য অনেকটা ট্যাক্স বেড়ে গেল। সেইসঙ্গে ইনফ্লেশন তো আছেই। ফলে, আর টিউশনিগুলো ছাড়া সম্ভব হল না। আমি একতলাটা ভাড়া দেবার কথা আবার তুলেছিলুম, মা এবারেও রাজি হল না। বুঝলুম, ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে মায়ের মনে একটা বাধা আছে অথবা ভয়— যদি ভাড়াটে ভালো না-হয়! চারদিকে নানারকম কাহিনিও তো কানে আসত। একদিন আমিও টিউশনি করব বলেছিলুম। মা তাতেও রাজি হল না। উলটে রেগে গেল। বলল, ‘যতটুকু সময় পাও পড়াশুনো করো। টিউশনি করে সময় নষ্ট করো না। ফাজলামোর একটা সীমা আছে।’

মাকে সাহায্য করার চেষ্টা করাটা নাকি ফাজলামো!

‘দ্যাখো মেঘমালা, তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। তোমার ওই ফ্রক পরা চেহারাটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার শাড়ি ধরো।’

‘কেন শাড়ি পরলে তোমার কী সুবিধে?’

‘তাহলে তোমার সঙ্গে অনেক কথা বলা যায় যা বড়োদের সঙ্গে ছাড়া আলোচনা করা চলে না। ফ্রক পরা মেয়েদের সঙ্গে তো নয়ই।’

‘বেশ, আমার শাড়ির ব্যবস্থা তুমিই করে দাও।’

‘হ্যাঁ, তাই করছি। এই যে, সে জন্যে আজ ঘুড়ির কাগজ কিনে এনেছি।’

‘ঘুড়ির কাগজ দিয়ে কী হবে?’ মেঘমালা উদবিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল।

‘দ্যাখোই-না কী করি।’ বলে আমি একটা হলুদ পাতলা কাগজ আমার টেবিল ল্যাম্পের পেছনে লাগিয়ে দিলুম। একটু এদিক-ওদিক করতে হল। তারপরেই যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই হল। দেখি মেঘমালার পরনে হলদে রঙের ছাপা শাড়ি আর গায়ে কালো ব্লাউজ। ফর্সা রঙে খুব মানিয়েছে।

বললুম, ‘আরিব্বাস, দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে!’

মেঘমালা লাজুক হাসল। বলল, ‘সত্যি?’

‘একেবারে। এটা তো হলুদ কাগজ, এ ছাড়া লাল আর সবুজ রঙের কাগজও এনেছি। এখন থেকে তুমি এক একদিন এক এক রঙের শাড়ি পরবে।’

মা বলল, ‘টেবিল ল্যাম্পের পেছনে একটা ফনফনে কাগজ লাগিয়েছিস কেন রে?’

আমি বললুম, ‘সে তুমি বুঝবে না মা। একে বলে রিফ্লেক্টর। এতে টেবিলের ওপর আলোর ডিস্ট্রিবিউশনটা বেটার হয়, সেটা রেগুলেটও করা চলে।’

মা হাত নেড়ে বলল, ‘কী জানি বাপু। এমন জিনিস জন্মে দেখিনি। ওরে তোর যদি সুবিধে হয়, যা ভালো বুঝিস করিস।’

মা বই পড়ার মধ্যে ফিরে গেল। আমি আর মেঘমালা চোখে চোখে হাসলুম।

ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরীক্ষাটা বেশ ভালোই হল।

আমি মাকে প্রণাম করে প্রাইজের বইগুলো হাতে দিলুম। বললুম, ‘কী মনে হচ্ছে, মা? আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে ভুল করেছিলে?’

মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোর সত্যিই পড়তে ভালো লাগছে, না রে?’

‘হ্যাঁ মা, খু-উ-ব।’

‘কী বই দিলে?’

‘খুলে দ্যাখো।’

‘ও বাবা, এ যে সব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ওপর।’

‘তবে তুমি কী ভেবেছিলে? কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ অস্কার ওয়াইল্ড অথবা কালেকটেড শর্ট স্টোরিস অফ ও’ হেনরি  দেবে? সে সব বই দিলেই অবশ্য তুমি খুশি হতে কিন্তু এগুলোও কম কাজের নয়। এসব বই তো পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। অথচ, এগুলো সারাজীবন কাজে লাগবে। সেটা কম কথা নয় বলো?’

মা উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘পয়সার কথা কেন অত চিন্তা করিস, দেবু? আমি যেন কখনো না-শুনি যে দামের কথা ভেবে তুই কোনো দরকারি বই কিনিসনি।’

সেদিন সন্ধে বেলা মা ছাদে বসে গাইল, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’

‘জানো মেঘমালা, আমার মনে হয় আমার মধ্যে বোধ হয় মস্ত বড়ো একটা ফাঁক আছে। তা না-হলে আমি কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি না কেন? আমার বেশিক্ষণ আড্ডা মারতে ভালো লাগে না, দলবেঁধে পিকনিকে যাওয়ার নামে কান্না আসে, হিন্দি সিনেমা তো কোনোদিনই সবটা দেখে উঠতে পারি না; অথচ, এসবের মধ্যেই সবাই কত আনন্দ খুঁজে পায়। আমি সবার সঙ্গেই থাকি, আড্ডাও মারি, গান গাই, সিনেমায় যাই কিন্তু এত লোকের মধ্যে থেকেও আমার কেবল নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। এটা বড়ো কষ্টকর।’

‘তোমাকে কিন্তু এই স্বভাবটা কাটিয়ে উঠতে হবে। ছোটোবেলা থেকে এই বাড়িতে একা একা থেকে নিঃসঙ্গতাটা তোমার মনের একেবারে ভেতরে ঢুকে গেছে।’

‘আমি তো কাটিয়ে উঠতেই চাই। এ কি আমার ভালো লাগে, বলো? প্রত্যেক দিন কত রকমের নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভূতি। মনের ভেতরে কথার পাহাড় জমে উঠছে। মাকে কত বলব? আর সবকথা বলা যায় না। তোমাকেই বলি। তবু মনে হয়, কেউ যদি ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকত যাকে মনোভার নামিয়ে দিতে পারতুম তাহলে বোধ হয় অনেক হালকা হওয়া যেত।’

‘বুঝেছি।’

‘কী বুঝেছ?’

‘বুঝেছি, যে তুমি প্রেমে পড়েছ। একগলা জল। স্রগ্ধরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘খুলে বলো।’

‘কী বলব? সেই ফাস্ট ইয়ারের সোশ্যালের পর মাঝে মাঝেই ওর সঙ্গে দেখা হয়। ভেবেছিলুম খুব বড়োলোকের মেয়ে, আমাকে বোধ হয় পাত্তাই দেবে না। কিন্তু তা নয়; বরং আমার সঙ্গে বেশ আগ্রহের সঙ্গে কথা বলে। আমাকে দূর থেকে আসতে দেখলে নিজেই এগিয়ে আসে। হাসে। আর সেই হাসিটা কিন্তু লোক-দেখানো নয়।’

‘বলো কী? ভয়ানক ব্যাপার দেখছি।’

‘না না, তেমন ভয়ানক কিছু নয়। ওর ব্যবহারটা খুবই স্বাভাবিক; কেবল আমারই বুকের ভেতর অস্বস্তি হতে থাকে।’

‘অস্বস্তি কেন?’

‘খালি মনে হয় কথাটা যেন এখনই শেষ না-করে। এখনই যেন চলে না-যায়।’

‘তার মানে, এই একজনই আছে যার সান্নিধ্যে তোমার নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে আর মনে হয় না, তাই না?’

‘না, না আরও দু-জন আছে। তুমি আর মা। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। আর স্রগ্ধরার ব্যাপারটা আলাদা। সত্যিই, ওর কাছে আমাকে কখনোই একা বলে মনে হয় না। আর আমি দেখেছি আমাদের দু-জনের ব্যাকগ্রাউন্ড যতই ভিন্ন হোক না-কেন, ওর পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে আমার পছন্দ-অপছন্দের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য মিল আছে।’

‘হুঁ! কিন্তু স্রগ্ধরা তোমার সম্বন্ধে কী ভাবে সে ব্যাপারে কোনো বিস্তৃত সংবাদ পেয়েছ কি?’

‘নাঃ, কিছু না। তা, সে যাই ভাবুক না-কেন, আমাকে তো বন্ধু বলে স্বীকার করেছে। সেটাই তো যথেষ্ট।’

‘যথেষ্ট কী? কী জানি।’

সেকেন্ড ইয়ারটা কাটল নিস্তরঙ্গভাবে। ক্লাস করি, পড়াশুনো করি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারি, গান গাই। তার মধ্যে স্রগ্ধরাও থাকে, কিন্তু বাইরে কারোরই কোনো চিত্তবৈকল্যের লক্ষণ দেখা যায় না। আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলুম যে এই মেয়েটিরই প্রেমে পড়ে গেছি, উদ্ধারের আশা নেই, কিন্তু স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সীমাটা পার হতে চাইছিলুম না।

মেঘমালাকে বললুম, ‘এই তো বেশ আছি। রোজ দেখা হচ্ছে। গল্প করছি। আর কী চাই, বলো? এর বেশি কিছু চাইতে গেলে যদি এটুকুও যায়, তাহলে কি সেটা কোনো কাজের কথা হবে?’

মেঘমালা বলল, ‘তুমি আসলে একটি এক নম্বরের ভীতুরাম। সাহসে বুক বেঁধে এগিয়ে যাও।’

‘ইমপ্র্যাকটিক্যাল কথা বললে তো হবে না। এগিয়ে যাও, না? এগিয়ে যাবটা কোথায়? ধরো, আমি সাহসে বুক বেঁধে স্রগ্ধরাকে গিয়ে বললুম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ তখন যদি সে বলে ‘শুনে অত্যন্ত খুশী হলুম। তা, আমাকে কী করতে হবে? তখন আমি কী বলব?’

‘খুব সহজ। বলবে হে মা ধরণী, দ্বিধা হস্ত হও, আমি তোমার ভেতরে সেঁধুই।’

‘চমৎকার! মা ধরণীকে আর দ্বিধা হবেন না। বরং, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছেলেগুলো কোদাল দিয়ে কবর খুঁড়ে আমাকে জ্যান্ত পুঁতে দেবে। আর স্রগ্ধরা পাশে দাঁড়িয়ে চ্যাটাস চ্যাটাস করে তালি বাজাবে।’

‘তাহলে আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলা কেন? যেমন চালাচ্ছ, তেমনি চালিয়ে যাও। আর শোনো, অনেকদিন তো এই হলুদ শাড়িটা পরা হল, এবার একটা লাল শাড়ির ব্যবস্থা করো।’

থার্ড ইয়ারে গোড়ার দিকে একটা ঘটনা ঘটল যেটা আমার কাছে নিতান্তই আশাতীত ছিল। আমি বাবার বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা বিরাট বাংলা অভিধান আবিষ্কার করলুম। বইটা উলটেপালটে দেখতে দেখতে মনে হল, দেখিতো স্রগ্ধরা কী শুধুই একটা নাম, নিরর্থক শব্দমাত্র, না এর কোনো মানে আছে। দেখে যা জানতে পারলুম তাতে একটা কবিতা না-লিখে আর থাকা গেল না। কবিতাটা এরকম—

স্রগ্ধরা সে তো ছন্দের নাম, নিতান্ত এক শব্দ,
এতদিন এই কথাটাই ছিল অন্তরে উপলব্ধ।
আজকে হঠাৎ হাতে এসেছিল অভিধান এক মস্তো,
ঢাউস শরীর চামড়া বাঁধানো, ওঠাতে ব্যতিব্যস্ত।
দেখে মনে হল, পাতা উলটিয়ে দেখিতো এটা কী সত্যি,
স্রগ্ধরা শুধু শব্দই, কোনো মানে নেই একরত্তি?
কথাটা যখন পাওয়া গেল, দেখি এতো বড়ো আশ্চর্য!
জানাই ছিল না ‘স্রগ্ধরা’-এর মাঝে এত তাৎপর্য।
স্রক মানে মালা, স্রগ্ধরা তাই মাল্যধারিণী কন্যে।
আজ জানি, মনে প্রতীক্ষা ছিল এই মালাটারই জন্যে।

কবিতাটা একটা খাতার পাতায় লিখে ফেলা গেল। স্রগ্ধরার থার্ড পিরিয়ডে কোনো ক্লাস নেই জানতুম। আমি ক্লাস কেটে ওকে খুঁজে বের করলুম কেমিস্ট্রি ল্যাবের পেছনের বারান্দায়। সেখানে একা একটা উঁচু টুলে বসে নিবিষ্ট চিত্তে চিনেবাদাম খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ল্যাবের ভেতরে কাউকে বাইরে আসার জন্যে হাত নেড়ে ডাকাডাকি করছিল। আমাকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার? তুমি এখানে? ক্লাস নেই?’

আমি বললুম, ‘দুত্তোর ক্লাস। বাল্মীকির মুখ দিয়ে যখন ফস করে একটা কবিতা বেরিয়ে গিয়েছিল তখন তিনি কি করেছিলেন জানো?’

‘না তো!’

‘আশ্রমের ক্লাস-ফ্লাস বন্ধ করে সাত কাণ্ড রামায়ণ লিখে তবে ক্ষ্যান্ত দিয়েছিলেন।’

‘বেশ করেছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার ক্লাস পালানোর সম্পর্কটা কোথায়? তুমিও কি সাতকাণ্ড রামায়ণ লিখবে না কি?’

‘আলবাত!’

‘আলবাত? কী সর্বনাশ! তুমি কি কবিতা লিখছ না কি?’

‘লিখছি মানে? লিখে ফেলেছি।’

‘বলো কী? কই দেখাও।’

আমি খাতাটা স্রগ্ধরার হাতে দিয়ে বললুম, ‘দ্যাখো, মারধর দিও-না যেন।’

স্রগ্ধরা হাসতে হাসতে কবিতাটা পড়তে শুরু করল। কিন্তু যে দশ লাইনের কবিতাটা পড়তে আধ মিনিটও লাগে না, দেখি সেটা পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে। আর, ওর মুখের হাসিটা আস্তে আস্তে পালটে গিয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। কানদুটো আর নাকের ডগাটা লাল হয়ে উঠল। আমি যে মনে মনে একটু উদবিগ্ন হচ্ছিলুম না, তা নয়, কিন্তু ওর মুখের ভাব দেখে কোনো প্রশ্ন করতেও সাহস হচ্ছিল না।

স্রগ্ধরা অনেকক্ষণ ধরে কবিতাটা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতাটা বন্ধ করল। তারপর, বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা কাঁধের ঝোলাটার ভেতর ভরে ফেলল।

আমি বলে উঠলুম, ‘আরে, ওকী হল? খাতাটা যে আমার।’

স্রগ্ধরা টুল থেকে উঠে দাঁড়াল। বারান্দার রেলিঙের ওপর ঝুঁকে পড়ে যেন নীচে কিছু দেখতে দেখতে বলল, ‘কবিতাটা যে আমার। সেটা যে খাতায় লেখা তার ওপর তোমার কোনোই অধিকার নেই।’

‘সে কী কথা? আমার তিনটাকা দিয়ে কেনা খাতাটা।’

‘তা হোক। ও খাতা এখন আমার কারণ এই কবিতাটা আমার।’ বলে স্রগ্ধরা রেলিঙের ওপর আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘শোনো, এরপর থেকে আমার নাম নিয়ে যে সব কবিতা লিখবে, সেগুলো আরও সিরিয়াসলি লিখবে, বুঝেছ? কোনোরকম ছ্যাবলামোর চিহ্ন যেন না-দেখি। আর লেখামাত্র সেগুলো আমাকে দেখাবে, আর কাউকে নয়, বুঝেছ?’

‘সিরিয়াস কবিতা লিখতে গেলে সেগুলো যদি প্রেমের কবিতা হয়ে পড়ে?’

‘ভেতর থেকে যদি আসে, তাহলে তাই হবে।’

‘মার লাগাবে না তো?’

‘সেটা কীরকম কবিতা হল, তার পর নির্ভর করবে। আজকেরটার মতো হলে, ভয় নেই।’ বলেই পেছন ফিরে কেমিস্ট্রি ল্যাবের বিশাল গহ্বরের ভেতরে ঢুকে গেল। সেদিন সারাদিন আমার আর ক্লাস করা হল না। স্রগ্ধরাকেও কোথাও দেখতে পেলুম না। বিকেল বেলা যখন বাড়ি ফিরছি, দেখি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সিঁড়ির ওপর ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চারদিকে সবাই কথা বলছে কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল ওর কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। এমনকী আমাকেও লক্ষ করল না।

মেঘমালা গম্ভীর মুখে আমার সবকথা শুনল। বলল ‘ভালো করছ কী?’

‘জানি না, সত্যিই জানি না।

‘পড়াশুনোর যদি এই কারণে ক্ষতি হয়, মা-কে হয়তো উলটোপালটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। তিনি তো তোমাকে বিশ্বাস করবার জন্যেই তৈরি হয়ে আছেন। কিন্তু, নিজেকে বোঝাতে পারবে কি?’

‘বোধ হয় না। আমি জানি, প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার সুযোগ বা সময় আর যারই থাক, আমার নেই। কিন্তু আমি কী করব? যখন প্রথম শুনেছিলুম যে ঘোর প্রেম অন্ধ রাহু প্রায় জীবন যৌবন গ্রাসে, তখন ভেবেছিলুম এসব কবিসুলভ বাড়াবাড়ি। আজ বুঝেছি, মোটেই তা নয়। কী করব, বলো? সবসময় ওর কথা মনে হয়। ক্লাসে কনসেনট্রেট করার যতই চেষ্টা করি না-কেন, মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। এর হাত থেকে বাঁচি কী করে?’

‘আমার কি মনে হয় জানো? তুমি এ-প্রশ্নের জবাব স্রগ্ধরাকেই জিজ্ঞেস করো। দ্যাখোই না ও কী বলে।’

আমি সেই সিদ্ধান্তই নিলুম।

এর দু-তিনদিন পরে আমি একটা অফ পিরিয়ডে ক্যান্টিনে বসেছিলুম একা। স্রগ্ধরা ওর ক্লাসের কয়েক জন ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভেতরে এল। আমি স্রগ্ধরাকে ডাকলুম। বললুম, ‘একটু এদিকে আসবে। একটা কথা আছে।’

আমার মুখের ভাবে বোধ হয় কিছু একটা ছিল। সৌরভ বলল, ‘এই যে! স্রগ্ধরা তোকে বোধ হয় দেবপ্রিয় প্রেম নিবেদন করবে।’

কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠল, কেবল স্রগ্ধরা হাসল না। আমিও না।

স্রগ্ধরা একটু উদবিগ্ন মুখে আমার সামনে এসে বসল। ক্যান্টিনে তখন এমন গোলমাল চলছিল যে আমার কথা যে অন্য টেবিলের কেউ শুনতে পাবে না তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তবুও গলাটা নীচু করে বললুম, ‘সৌরভ প্রায় ঠিকই বলেছে। তোমাকে আজ আমার কয়েকটা কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন। কথাগুলে প্রেম সংক্রান্ত, প্রেম নিবেদন কি না জানি না।’

স্রগ্ধারা গম্ভীর কিন্তু ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘কী কথা?’

‘দ্যাখো তোমার কাছে আমার একটা কনফেশন করবার আছে। আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। আমার সম্পর্কে তোমার কী মনোভাব আমি জানি না। তবে এটুকু জানি যে তুমি আমাকে অন্তত বন্ধু বলে স্বীকার করো। সেই বন্ধুত্বের জোরে আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’

‘বলো।’

‘আমার বোধ হয়, তোমার প্রেমে পড়া আমার উচিত হয়নি।’

‘কেন?’

‘আমার ব্যাকগ্রাউন্ড বোধ হয় তোমার জানা নেই। আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমার মা স্কুলে পড়িয়ে উদয়াস্ত টিউশনি করে আমাদের সংসার চালান। উত্তর কলকাতার একটা গলির মধ্যে একটা প্রাচীন বাড়ি ছাড়া আমাদের নিজস্ব বলতে এ জগতে আর কিছুই নেই। এমনকী আত্মীয়স্বজন বলতে যা বোঝায়, তা-ও নেই।’

স্রগ্ধরার গলাটা কঠিন শোনাল। বলল, ‘তুমি কী বলতে চাইছ? আমার বাবা খুব বড়োলোক, আমি গাড়ি চড়ে ঘুরি, তাই…’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘না না না, একেবারেই তা নয়। তুমি গরিব, বড়োলোক, পাগল, ছাগল যাই হও না-কেন, আমার সমস্যাটা তা নয়। আমার সমস্যাটা অন্যত্র।’

‘কোথায় তোমার সমস্যা?’ স্রগ্ধরার গলাটা তখনও কঠিন।

‘সমস্যাটা কোথায় জানো? আমি তোমার প্রেমে পড়ে একেবারে পাগল হয়ে গেছি। দিন নেই রাত নেই, খালি তোমার কথা ভাবি। অঙ্ক না-করে, গাদা গাদা কবিতা লিখে চলেছি। ক্লাসে বসে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি, এমনকী ড. বিকাশ গাঙ্গুলির ক্লাসেও কনসেনট্রেট করতে পারছি না।’

‘তা, প্রেমে পড়লে ওরকম হয়েই থাকে। আমারও হচ্ছে।’ স্রগ্ধরার গলাটা এইবার তরল শোনাল।

আমি লাফিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলুম। গত দু-তিনদিন ধরে যে ডায়ালগগুলো মুখস্থ করেছি সেগুলো পুরোটা না-বলে তো হাসতে পারি না। কম্পিত কণ্ঠে বললুম, ‘বটে? কিন্তু আমার তো এরকম হলে চলবে না।’

‘তুমি চলবে না বললে তো হবে না। এরকম হবেই, হতে বাধ্য।’

‘কিন্তু আমার যে একজন ভদ্রমহিলাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। তিনি যে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আমি বড়ো হব, টাকাপয়সা রোজগার করব। তা না-হলে তাঁর এই দীর্ঘ পরিশ্রম যে ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমি যদি পড়াশুনো ঠিকমতো না-করতে পারি, তাহলে আমি তো তাঁর সব আশা, সব স্বপ্নই ব্যর্থ করে দেব। এদিকে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। পড়েই গেছি। এটা একটা অবধারিত আর অপরিবর্তনীয় ঘটনা। এখন তুমি বলো কী আমার কর্তব্য, কী আমি করতে পারি। তুমি অবশ্য একটা থিয়েটারি ঢঙে হাত নেড়ে বলতে পারো, ”আমাকে ভুলে যাও দেবপ্রিয়, মনে করো আমি তোমার কেউ নই” ইত্যাদি আর সেই সঙ্গে ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস। সেটা ভুলে যাও। এ ছাড়া অন্যকোনো উপদেশ যদি দিতে পারো তো দাও।’

স্রগ্ধরা স্মিতমুখে অনেকক্ষণ টেবিলের ওপরে রাখা নুন-গোলমরিচের ডাব্বাদুটো নাড়াচাড়া করল। তারপর বলল, ‘তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলবার আগে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডটাও তোমার জানা দরকার। সেটা বলি শোনো।’

স্রগ্ধরা যা বলল তাতে বুঝলুম চূড়ান্ত বা নির্ভেজাল সুখ বলে বোধ হয় কিছু হয় না, বা হতে পারে না। যেখানে সুখ ছাড়া কিছু থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই সেখানেও অকারণে, ঘূণপোকার মতো নিঃশব্দে এমন একটা কিছু এসে ঢোকে যা মানুষের ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দেবার চেষ্টা করতে শুরু করে দেয়।

স্রগ্ধরার বাবারা দুই ভাই আর এক বোন। বোনই সবার বড়ো, স্রগ্ধরার বাবা মাঝখানে। স্রগ্ধরার ঠাকুরদাদা পশ্চিমবঙ্গ সরকারে বড়ো অফিসার ছিলেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বম্বের এক বড়ো কোম্পানির চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে। দুই ছেলেই বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাশ করেছিল। বড়ো ছেলে মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করল আর ছোটো ছেলে ল-কলেজ থেকে উকিল হয়ে বেরুল। এইসময় হঠাৎ ওই যে বললুম— অকারণে সংসারে দুর্যোগ দেখা দিল। স্রগ্ধরার ঠাকুরদাদা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন আর তার কয়েক মাসের মধ্যে গেলেন ঠাকুমা। দুই ছেলের তখন পসার জমার কোনো লক্ষণই নেই। এদিকে মারা যাবার ঠিক আগে স্রগ্ধরার ঠাকুমা তাঁর বড়ো ছেলের বিয়েও দিয়েছেন। সেই ঘোর বিপদের দিনে স্রগ্ধরার পিসিমা ওর বাবাকে বম্বেতে একটা চাকুরি জুটিয়ে দিয়ে ওঁকে ওখানে নিয়ে গেলেন। কলকাতার বাড়িতে ওর কাকা রইলেন একা। এরপর আস্তে আস্তে বম্বের নামিদামি ডাক্তারদের মধ্যে স্থান করে নিলেন বাঙালি ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরি। কিন্তু ছোটো ভাই মুক্তেশ্বর রায়চৌধুরির কপাল খুলল না। ব্রিফলেস উকিল হয়ে তিনি যেই তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। কিন্তু তাই বলে যে তাঁর কোনোরকম অর্থাভাব হল তা নয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দাদা ছোটোভাইকে টাকা পাঠাতেন। আর তারপর যখন বিশ্বেশ্বরের অনেক টাকা হল, তখন তাঁর সব ইনভেস্টমেন্টেরই দেখাশোনা করবার দায়িত্ব পেলেন ছোটোভাই। ফলে, মুক্তেশ্বরের বেশ দু-পয়সা হল যার বেশিরভাগটাই, স্রগ্ধরার মতে দাদাকে ঠকিয়ে করা। ইতিমধ্যে তিনি বিয়েও করেছেন। শ্বশুরবাড়ি মানিকতলায়, শ্বশুরমশাই হরশঙ্কর মল্লিক দুঁদে উকিল আলিপুর কোর্টে সবাই ওঁকে এক ডাকে চেনে।

মুক্তেশ্বর হরশঙ্করের মেয়েকে বিয়ে করলেন বটে কিন্তু তাঁর জুনিয়ারদের মধ্যে ঠাঁই পেলেন না। দেমাকি, ঠমকি, কটূভাষিণী গৃহিণীকে সামলাতে সামলাতে তাঁর মুক্তকচ্ছ অবস্থা হল।

এদিকে পুনরায় বিপদ। স্রগ্ধরার জন্মের বছর পাঁচেক বাদে ওর মা-র একটা অদ্ভুত অসুখ করল যেটা সচরাচর দেখা যায় না। এই অসুখের একটা বহির্লক্ষণ হচ্ছে, মুখে গলায় চাকা চাকা আমবাতের মতো বেরুনো। নোনা জায়গায় বিশেষত সমুদ্রের ধারে এ অসুখের তীব্রতা বাড়ে, খুব কড়া ওষুধেও কোনো কাজ হতে চায় না। তখন ডাক্তার রায়চৌধুরি একরকম নিরুপায় হয়েই ছোটো দুই মেয়েকে দিয়ে স্ত্রীকে কলকাতায় রেখে এলেন। বড়ো মেয়ে গায়ত্রী রইল তাঁর কাছে। সে তখন সিনিয়র স্কুলে পড়ছে, তাকে সেখান থেকে না-সরানোই উচিত বলে বিবেচিত হল। মালিনী যখন স্কুল লেভেল পাশ করল তখন সেও বম্বে ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল। কিন্তু স্রগ্ধরা কলকাতা ছাড়তে পারল না। কারণ, ও যখন স্কুল ছাড়ছে, ততদিনে ওর মা প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছেন। ভীষণ মোটা হয়ে গেছেন, হাঁটাচলা করতে পারেন না বললেই হয়, পঞ্চাশ পেরুতে না-পেরুতেই বৃদ্ধত্ব যেন নানাদিক দিয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। এ অবস্থায় তাঁকে একা কাকা-কাকিমার হাতে ফেলে রেখে স্রগ্ধরা বম্বে যেতে চাইল না। ভরতি হল আমাদের ইউনিভার্সিটিতে।

এখন ওর মার স্থবিরত্ব আর বাবার প্রবল কর্মব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে স্রগ্ধরার কাকা আর কাকিমা ওর জীবনটা নিয়ন্ত্রণ করবার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন। ওঁদের দুই ছেলে, মৃগাঙ্ক আর মৃত্যুঞ্জয়। মৃগাঙ্গ ইন্দোরে চাকরি করে আর মৃত্যুঞ্জয় আছে আমেরিকায় গায়ত্রীর কাছে থেকে পড়াশুনো করে। ফলে দু-জনের সম্মিলিত দৃষ্টি এখন এসে পড়েছে স্রগ্ধরার ওপর। সে কী বই পড়বে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে মিশবে— তার সব কিছুর মধ্যে দু-জনের, বিশেষত কাকিমার শ্যেনদৃষ্টি এসে পড়তে শুরু করেছে।

স্রগ্ধরা বলল, ‘জানি না কেন হঠাৎ ওঁদের ধারণা হয়েছে যে কো-এডুকেশনে পড়লে আমি খারাপ হয়ে যাবই।’

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘খারাপ মানে কী?’

‘খারাপ মানে, বাজে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করব, লেখাপড়া না-করে ছেলেদের সঙ্গে সিনেমায় যাব তারপর হয়তো একটা লুচ্চা লোফারের সঙ্গে ইলোপই করে বসব।’

‘এই মরেছে!’

‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘না, না, ভয় পাচ্ছি এই জন্যে যে ওঁরা আমাকে ঠিক কী দৃষ্টিতে দেখবেন তাতো বলা যায় না। মানে, লুচ্চা লোফার তো একটা রেলেটিভ টার্ম, তাই না? যেমন ধরো, যাঁকে সারা বাংলার সাহিত্যজগৎ অমর কথাসাহিত্যিক বলত, সেই শরৎচন্দ্রকে না কি তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ লুচ্চা লোফার ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারতেন না।’

‘ঠিক কথা। কাকিমার কিছু আদর্শ বন্ধুকে আমি দেখেছি, তাদের আমার লুচ্চা লোফার ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। অতএব, একটা ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো যে ওদের কাছ থেকে তুমি ওই বিশেষণটি ছাড়া আর কিছুই পাবে না।’

‘অত্যন্ত সুসংবাদ! তারপর?’

‘এখন তুমি বুঝতেই পারছ যে কাকা-কাকিমার চক্রব্যূহ থেকে যদি আমাকে বেরিয়ে আসতে হয় তাহলে আমাকে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, একটা চাকরি পেতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

‘তোমার বাবা?’

‘তার ধারণা, মুক্তার মতো ছেলে আর ভূভারতে নেই— এত সৎ, এত সরল! আর বউমা-র তো কোনো তুলনাই হয় না। ওরা দু-জনে যে কী দারুণ অভিনেতা সেটা দেখেছি আমি। কিন্তু, আমার কথায় বাবার বিশ্বাস টলবে না। ওদের বিরুদ্ধে যদি আমি যাই, বাবা আমাকে সমর্থন করবে না তা আমি জানি।’

‘তোমার দিদিরা?’

‘বড়দি তো বায়োকেমিস্ট্রি ছাড়া আর জগতে যে দ্বিতীয় কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে তাই জানে বলে মনে হয় না। বিয়েও করেছে তেমনই এক সাহেবকে। যেমন ডক্টর চার্লস ও’হারা তেমনি তাঁর গিন্নি ডক্টর গায়ত্রী ও’হারা। দু-জনে একসঙ্গে কাজ করছে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে। ওদের একটাই কথা, কোনো প্রবলেম হলেই এখানে চলে আসবি। আর ছোড়দি আছে আটলান্টায়। সে আবার আর এক পাগল। বিয়ে করেছে এক মারাঠিকে— নাগেশ্বর দওাত্রেয় আপ্তে। দু-জনে মিলে পারফরমিং আর্টস না কী-সব নিয়ে দিনরাত্রি লড়ে যাচ্ছে, নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। কিন্তু আশ্চর্য, ওদেরও বক্তব্য একটাই। এখানে চলে আয় সব ঠিক হয়ে যাবে। আরে! চলে আয় বললেই হল নাকি? মাকে কে দেখবে? আমি চলে গেলে স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী বলে হয়তো কিছুদিন জিইয়ে রাখবে। কিন্তু সেটা বেশিদিন নয়। ওরা বলে, এটা নাকি আমার বাড়াবাড়ি। আমি তা বলি না। যতদিন যাচ্ছে, অবস্থা যেন আরও দম আটকানো হয়ে আসছে।’

‘তোমার পিসিমা পিসেমশাই কী বলেন?’

‘কিছুই না, কারণ দু-জনের কেউই আজ আর বেঁচে নেই। আমার এক পিসতুতো দাদা আছে। নাম শুনে থাকবে হয়তো, সমীর বরাট। বম্বের ফিলম প্রোডিউসার। একমাত্র সমীরদাই তার ছোটোমামার স্বরূপ খানিকটা জানে। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই নেই। আমার বাবার ধারণা যারা বায়োস্কোপ করে তারা হচ্ছে জগতের নিকৃষ্টতম জীব। কাজেই সেই জীব যাকে পছন্দ করবে না সে যে আসলে অত্যন্ত ভালো লোক তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।’

‘সেকী? সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন… আর্ট ফিলম…’

‘সব্বাই, সব্বাই খারাপ। বায়োস্কোপ মানেই স্বভাব নষ্ট, চরিত্র নষ্ট, মদ্যপান ইত্যাদি ইত্যাদি। জানো বাবা, যদি কাউকে ‘হৃদয় বেদনা বহিয়া প্রভু এসেছি তব দ্বারে’ গানটি গাইতে শোনে তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে পাকড়াও করে অপারেশন টেবিলে ফেলে বাইপাস সার্জারি করতে শুরু করে দেবে। একমাত্র ওটাই বাবার কাছে আর্ট, আর কিছু নয়।’

আমার প্রবল হাসির মধ্যে সৌরভ এসে ধপাস করে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। বলল, ‘দেখালি বাবা। প্রেম নিবেদন তো তিনটে কথায় হয়, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তা, এর মধ্যে এত বক্তব্য আসে কোত্থেকে আর এত হাসিরই বা কী আছে?’

আমি বললুম, ‘দ্যাখ, যা বুঝিস না তা নিয়ে একদম মাথা ঘামাবি না। প্রেম নিবেদন অত সহজ নয়, বুঝলি? তুই ব্যাটা সিলেটি বাঙাল, এখনও জিভের আড় ভাঙেনি, প্রেম বলতে ফ্রেম বলিস, তুই এসবের কী বুঝবি? আগে উচ্চারণ ঠিক কর, তারপর পাঞ্চালী সান্যালকে একবারও না-থেমে প্রেম নিবেদন করে ওঠ, তখন এ ব্যাপারে তোর সঙ্গে আলোচনা করব।’

স্রগ্ধরা বলল, ‘ঠিক কথা। আর মনে রাখবি, পাঞ্চালী কিন্তু বেজায় বদরাগী। তাকে যদি ”ফ্রিয়ে ফাঞ্চালী” বলে ডেকেছিস তো তোর দফা কিন্তু গয়া। ওর নোট টুকে পরীক্ষা পাশ করা একদম বানচাল হয়ে যাবে।’

সৌরভ অত্যন্ত চিন্তিত মুখে গাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘তোদের বাবা-মায়ের কি খেয়ে দেয়ে আর কোনো কাজ ছিল না? এরকম সব বীভৎস বীভৎস নাম রেখেছেন কেন, এ্যাঁ? যেমন তোর তেমনি পাঞ্চালীর আর গাধা অনিরুদ্ধটা যার পেছনে দৌড়ুচ্ছে— কী যেন নাম— শর্মিষ্ঠা। যেমন কঠিন বানান তেমনি কঠিক উচ্চারণ। আমার বয়ে গেছে তোদের প্রেম নিবেদন করতে। আমাদের পাড়ায় উমা, চাঁপা, রমা, শ্যামারা সব রয়েছেন, আমি তাঁদের কাছেই যাব।’

স্রগ্ধরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, তাই যাস। এখন আগে ক্লাসে তো চল।’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছুটির পর গেটের কাছে দাঁড়িও।’

ছুটির পর গেটের কাছে দাঁড়ালুম। স্রগ্ধরা এসে আমার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে বলল, ‘বাড়ি গিয়ে খুলো এখানে নয়।’ বলে এক দৌড়ে গাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পর্যন্ত অপেক্ষা অবশ্য করা গেল না। বাসেই চিঠিটা পড়ে ফেললুম। আমার জীবনের সেই প্রথম প্রেমপত্র। আহা, প্রেমপত্রের কী ছিরি! না-আছে কোনো সম্বোধন, না-আছে কোনো সমাপ্তি। একটার পর একটা পয়েন্ট এক দুই করে নম্বর দিয়ে লেখা; যেন কোনো কেমিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের রিপোর্ট।

পয়েন্ট এক, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।

দুই, ভালোবেসে মাথা খারাপ করলে চলবে না। বেঁচে থাকার তাগিদে দু-জনকেই পড়াশুনো চালিয়ে যেতেই হবে।

তিন, আমাদের ব্যাপারটা যথাসাধ্য আড়ালে রাখতে হবে, নইলে প্রবল বাধা আসার সম্ভাবনা।

চার, পড়াশুনোর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে দুশ্চিন্তা বা অবিশ্বাস। এ দুটোর কোনোটাই আমাদের মধ্যে আসা উচিত নয়; যেহেতু আমরা কেউই নির্বোধ, অশিক্ষিত, অপরিশীলিত বা যুক্তিহীন চঞ্চলমতি নই। আমরা পরস্পরকে জানি, বেশি দূরেও থাকি না। অতএব এই ঘটনাগুলো না-ঘটাই উচিত।

পাঁচ, লেকের ধারে হাত ধরাধরি করে বসে ঝালমুড়ি না-খেলে ভালোবাসা জমে না— এটা আমি বিশ্বাস করি না। বোধ হয় তুমিও না। অথচ, আমাদের অন্যান্যদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর হতে হবে। কারণ তোমাকে আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে যা আর কাউকে আমি বলতে চাইনি কোনোদিন, তোমার অনেক কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করে যা অন্য কেউ আমাকে বলুক আমি তা চাই না কখনো। তার জন্যে আমাদের কিছুটা সময় বের করে নিতে হবে। সেটা ক্লাস পালিয়ে করা চলবে না (পয়েন্ট দুই পশ্য)। সেটা কোনো অস্বাভাবিক উপায়ে করলে চলবে না যাতে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় (পয়েন্ট তিন পণ্য)। অতএব, আমি ঠিক করেছি যে কাল থেকে যে কোনো একটা ছুতো দেখিয়ে গাড়িটা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসা বন্ধ করে দেব। একেবারে বন্ধ করলে সেটা লোকের সন্দেহ জাগাবে। বিপাশা সিনেমা পর্যন্ত এসে ছেড়ে দেব, সেখানে তুমি অপেক্ষা করবে। আমরা হেঁটে আসব। ফেরার সময়ও গাড়িটা ওখানেই দাঁড়াতে বলব। ছুটির পর এখান থেকে হেঁটে যাব। আমার মনে হয় আমাদের এই সময়টাই আপাতত যথেষ্ট হবে।

ছয়, এখান থেকে বিপাশা পর্যন্ত রাস্তায় যা ভিড় তাতে আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারব। তার পরেও যদি কিছু বলার থাকে সেটা চিঠি দিয়ে জানালেই হবে।

সাত, ছুতোটাও ভেবে রেখেছি। (পয়েন্ট পাঁচ পণ্য) বলব মোটা হয়ে যাচ্ছি। রোজ হাঁটা দরকার।

মেঘমালা বলল, ‘ওরে ব্বাবা, একী মেয়ে না কম্পিউটার?’

আমি মাথা চুলকে বললুম, ‘বোধ হয় দুই-ই। কিন্তু সেটা তো বড়ো কথা নয়। এই কাকাটাকে সামলাই কী করে? আমার কী রকম সন্দেহ হচ্ছে ইনি এই অক্ষম আমার বক্ষ ভেদ করে লক্ষ মুখ দিয়ে রক্তপান না-করে ছাড়বেন না।’

‘ওসব নিয়ে এখন মাথা ঘামিও না তো। সেরকম অবস্থা হলে তখন দেখা যাবে। আপাতত, ভেবে দ্যাখো, তুমি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। তাই না?’

‘ঠিক তাই, মেঘমালা। আমার এখন চীৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে— সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দন ফুলহার, তুমি অনন্ত নব বসন্ত অন্তরে আমার…’

ব্যবস্থাটা ভারি চমৎকার হল। বিপাশা থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পথটা আমরা রোজ দু-বেলা হাঁটি। আমাদের চতুর্দিকে উচ্ছ্বসিত জনস্রোত, অন্তহীন কোলাহল অথচ সেসব আমাদের স্পর্শই করে না। আমার মনে হয় যেন এক নির্জন রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি, আমার সর্বাঙ্গ ঘিরে শুধু স্রগ্ধরার অস্তিত্ব— ওর হাসি, ওর কথা বলা। রোজ বাড়ি ফিরি পরিপূর্ণ মন নিয়ে। এটুকু বুঝি যে ফুল গাছের গোড়ার অতিরিক্ত জল দিলে সেটা যেমন শুকিয়ে যায়, তেমনি আমাদের সম্পর্কটা এর বেশি ঘনিষ্ঠ করতে গেলে সেটা বিষিয়ে উঠতে পারে।

আমরা যা করছিলুম সেটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ না নির্বোধ কৃচ্ছ্রসাধন, তা আমার জানা নেই, কিন্তু থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে উঠতে আমাদের দু-জনেরই কোনো কষ্ট হল না। বরং আমার কপালে একটা স্কলারশিপ জুটে গেল।

মাকে বললুম, ‘এবার টিউশনি দুটো ছেড়ে দাও মা। তোমার ওই শনি দুটো তোমাকে যা টাকা দেয় আমার স্কলারশিপ তাদের চেয়ে অন্তত তিরিশ টাকা বেশি। তাহলে তুমি কেন ছাড়বে না বলো?’

মা বলল, ‘আচ্ছা রে বাবা, তাই হবে। আমিও আর পারছিলুম না, জানিস। বয়েস তো হল, সেটা মাঝে মাঝে টের পাই।’

সেদিন রোববার। সকাল থেকে শুনছি দূরে সানাই বাজছে। আমাদের গলিটা যে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে সেই ক্রেসেন্ট অ্যাভেনিউতে কোনো বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে বোধ হয়। সানাই শুনলে আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। মা-ও দেখলুম বই পড়া বন্ধ রেখে বিষণ্ণ উদাস দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

তখন বোধ হয় এগারোটা বাজে। হঠাৎ শুনি নীচের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মা বলল, ‘দেখতো কে এল এই সময়? নিশ্চয়ই খবরের কাগজওলা। টাকা নিতে এসেছে।’ আমি নীচে নেমে দরজা খুলে দেখি সামনে সহাস্যবদনে স্রগ্ধরা দাঁড়িয়ে। আমি পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলুম। বললুম, ‘একী কাণ্ড! তুমি? কোত্থেকে?’

স্রগ্ধরা বলল, ‘হ্যাঁ আমিই, ওই যে সানাই বাজছে শুনছ? ওই বাড়ি থেকে।’

‘ব্যাপারটা কী?’

‘কিছুই নয়। ওটা আমার মাসির বাড়ি, মার মামাতো বোন। আজ আমার মাসতুতো দাদার বিয়ে। সেই উপলক্ষ্যে কাল রাত্রি থেকে এখানে আছি।’

‘আমাদের বাড়িটা কে দেখিয়ে দিল?’

‘কেউ না। আজ সকালে কে যেন বললে, জানকীনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিট এত কাছে, অথচ সেখানকার কেটারারকে অর্ডার না-দিয়ে কেন বাগবাজারের কোনো এক পার্টিকে অর্ডার দেওয়া হল? আমি অমনি মাসিকে গিয়ে বললুম কাছেই আমার এক বন্ধু আছে, তার সঙ্গে চট করে দেখা করে আসছি। ঠিকানাটা তো জানাই ছিল, কাজেই…’

‘কেউ বাধা দিল না?’

‘দূর! এটাতো আমার মাসির বাড়ি। কাকার এখানে কোনো অর্ডারই চলবে না।’

‘একটা খবর দিয়ে আসতে হয়। এরকম ছেঁড়া গেঞ্জি আর ময়লা পাজামা…’

‘তোমাকে খুব ভালো দেখাচ্ছে।’

‘বাজে কথা বলো না। কিন্তু তোমাকে যা দেখাচ্ছে না, দারুণ। কলেজে যে কী কতগুলো ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ছোপওয়ালা সালওয়ার কুর্তা পরে যাও। এই চন্দন রঙের শাড়িটায় তোমাকে যা দেখাচ্ছে ভাবা যায় না।’

‘চুপ করো।’

‘সত্যি কথা বলব তাতে ভয় কী মশায়?’

এমন সময় দোতলা থেকে মার গলা শুনলুম, ‘কে এল রে, দেবু? কার সঙ্গে কথা কইছিস?’

আমি জোরে জোরে বললুম, ‘একজন এসেছে মা। আমি তাকে ওপরে নিয়ে আসছি।’

‘কে এসেছে?’ বলতে বলতে মা সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল। আমার পেছনে পেছনে স্রগ্ধরাকে আসতে দেখে বলল, ‘ওমা, এ কে রে?’

‘ঘরে চলো মা। বলছি।’

মা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল। বুঝলুম, এক, চশমা পরতে আর দুই ঘরটাকে চটপট একটু গুছিয়ে তুলতে।

আমি ঘরে ঢুকে স্রগ্ধরাকে এগিয়ে দিয়ে এক নিশ্বাসে বলে গেলুম, ‘মা এ স্রগ্ধরা। স্রগ্ধরা রায়চৌধুরি। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কেমিস্ট্রিতে এমএসসি-র ফার্স্ট ইয়ার। বিএসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। আমি ওকে বিয়ে করব।’

আমার শেষ কথাটা যখন বলা হচ্ছে স্রগ্ধরা তখন নীচু হয়ে মা-কে প্রণাম করছিল। কাঁইমাঁই করে উঠল, ‘ওমা, দেখুন না, কী সব আজেবাজে কথা বলছে।’

মা হো হো করে হেসে উঠল। স্রগ্ধরাকে আশীর্বাদ করে হাত ধরে খাটে নিজের পাশে বসাল। বলল, ‘স্রগ্ধরা? কী সুন্দর নাম। হ্যাঁরে দেবু, তুই ওকে বিয়ে করবি? তা, ও তোকে করবে কি না খোঁজ নিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ, নিয়েছি। করবে বলেছে।’

স্রগ্ধরা আবার কাঁইমাঁই করে উঠল, ‘কী খারাপ লোক!’

মা হাসতে হাসতে বলল, ‘যা বলেছিস, একদম বিচ্ছিরি। তা হ্যাঁরে, তোর বাবা মা জানেন?’

স্রগ্ধরা মাথা নীচু করে নীরবে ঘাড়া নাড়ল।

‘জানেন না না? বাধা আছে?’

‘আছে মা, ভীষণ বাধা।’

আমি বললুম, ‘মা, তুমি হয়তো ওর বাবার নাম শুনে থাকবে। বম্বের বিখ্যাত সার্জন ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরি, মিডলটন স্ট্রিটে কিংসটন কোর্টে ওঁর ফ্ল্যাট।’

মা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘বুঝেছি।’ বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

বোধ হয় নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁরে, ভালো করে সব কিছু ভেবে দেখেছিস তো?’

আমি কিছু বলবার আগেই স্রগ্ধরা বলল, ‘হ্যাঁ মা, যতদূর সম্ভব, সবরকম সম্ভাবনার কথাই ভেবে দেখেছি। সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত আছি। তবে, আমার কাকা উকিল। তাঁর বুদ্ধি যে কখন কোন পথে চলে তার সন্ধান পাওয়া খুব মুশকিল।’

মার মুখে একটা মৃদু হাসি ফিরে এল। বলল, ‘যুদ্ধ করতে পারবি?’

‘পারব মা, নিশ্চয়ই পারব।’

‘বড়ো কষ্ট।’

‘আমি জানি। আমি সেজন্য নিজেকে তৈরি করে রাখছি।’

‘যদি হেরে যাস…’

স্রগ্ধরা মা-কে কথাটা শেষ করতে দিল না। বলল, ‘কখনো হারব না মা। আপনি দেখবেন। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন।’

আমি বললুম, ‘মা তোমাকে আশীর্বাদ কী করে করবে? মা তো ইন্টারেস্টেড পার্টি। মার আশীর্বাদ আদালত গ্রাহ্য নয়।’

‘ফের বাজে কথা। আদালত গ্রাহ্য হোক বা না-হোক তাতে আমার বয়ে গেল।’

মা স্মিত মুখে বলল, ‘করব রে বাবা করব। তোদের আশীর্বাদ করব না-তো করব কাকে? তবে কী জানিস, তোদের যুদ্ধজয়টা বোধ হয় আমি দেখে যেতে পারব না।’

‘একথা কেন বলছেন মা?’

‘কী জানি। কেন যেন মনে হচ্ছে খেলার সাথীর বিদায়দ্বার খোলবার সময় হয়ে এসেছে। তা সে কথা বাদ দে। তোদের বিজয়-উৎসবের জন্য আমার আশীর্বাদ একটা রাখা আছে। দেবুর বাবা আমাকে কোনোদিন কিছু কিনে-টিনে দেয়নি জানিস। খেয়ালও ছিল না, পয়সাও ছিল না। কেবল, আমাদের বিয়ের দশম বার্ষিকীতে একটা সোনার আংটি অর্ডার দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল। তারপর মিনে করে আমার নাম লেখা ছিল।’ বলতে বলতে মার মুখে একটা ছেলেমানুষি লাজুক হাসি ফুটে উঠল। সেটা আমার আলমারির বাঁ-দিকের ড্রয়ারে রাখা আছে একটা লাল রঙের বাক্সের ভেতর। দেবু, সেটা তুই ওকে দিস। সেটাই আমার আশীর্বাদ।’

মার সেই আশীর্বাদ আমি রাখতে পারিনি। তবে আমি জানি মা এজন্য কখনোই আমার ওপরে রাগ করতে পারবে না।

রাস্তায় বেরিয়ে স্রগ্ধরা বলল, ‘তোমার মা-র গায়ে কী সুন্দর গন্ধ।’

আমি বললুম, ‘ওটাই তো মা-র গুণ।’

‘তার মানে?’

‘জানো না? আমাদের শাস্ত্রে সব কিছুর এক-একটা গুণ বলা আছে। যেমন, দুধের গুণ সাদা রং, আকাশের গুণ শব্দ, তেমনই পৃথিবীর গুণ গন্ধ।’

‘বুঝেছি।’ বলে স্রগ্ধরা চুপ করে গেল। গলির মোড় পর্যন্ত আর কোনো কথা বলল না। সেখান থেকে আমি ফিরে চলে এলুম।

শুনতে পেলুম মোটা গলায় কে যেন আবার ঘোষণা করলেন, ‘প্রভিডেন্স! প্রভিডেন্স!’ এবার গলাটা চিনতে পারলুম। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে থাকেন। ভোলানাথ পাইন। অতিরিক্ত পড়াশুনো করতে করতে মাথাখারাপ মতো হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরোন না, খালি বই পড়েন। তখন বেরিয়েছেন, বোধ হয় বাধ্য হয়ে।

আমার দৃষ্টিটা অল্প অল্প পরিষ্কার হয়ে আসছিল। আমার সামনে দেখলুম দাঁড়িয়ে আছেন অনুভা কাকিমা। বলছেন, ‘এভাবে এখানে বসে থাকিসনে, দেবু। আমাদের বাড়ি চল। একটু কিছু মুখে দে।’

আমি মাথা নাড়লুম।

অনুভা কাকিমা বললেন, ‘কেন, না কেন? রাত্রে ভাত জুটেছিল প্লেনে? আর জুটলেই বা কী? এখনই পুলিশ এসে পড়বে। তারপর কাল সারাদিন কি আর কোনো খাওয়া জুটবে? চল দেবু, আমার সঙ্গে আয়।’

আমি আবার মাথা নাড়লুম। ভদ্রমহিলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লেন। এই অনুভা কাকিমাই আমার জীবনে প্রথম ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের খবর নিয়ে এসেছিলেন।

ক্রেসেন্ট অ্যাভেনিউতে বাস থেকে নেমে আমাদের বাড়িতে আসতে হলে অনুভা কাকিমার বাড়ির সামনে নিয়ে আসতে হয়। কাকিমার স্বামী উমাশঙ্কর হাজরা রেলে ভালো চাকরি করেন। প্রায়ই তাঁকে বাইরে বাইরে থাকতে হয় আর তখন কাকিমা বাড়ির সামনে রোয়াকে বসে থাকেন আর যাবতীয় পথচারীকে ডেকে ডেকে গল্প করেন।

আমার যখন ফোর্থ ইয়ার প্রায় শেষ হয়ে আসছে, সেই সময় একদিন উনি আমাকে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময় ডাকলেন। আমি হাসি মুখেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিলুম, তখন বুঝিনি হাসিটা ক্ষণস্থায়ী হবে।

কাকিমা বললেন, ‘হ্যাঁরে দেবু, তোর মা-র দিকে একবার চোখ তুলে দেখেছিস কখনো?’

আমি হাসতে হাসতেই বললুম, ‘কেন কাকিমা, কী হয়েছে? মাকে না-দেখে উপায় আছে?’

‘ছাই আছে। কী চেহারা হয়েছে অর্পণার তোর কি নজরেও পড়ে না? কবে একদিন ধপ করে পড়বে আর মরে যাবে। তখন বুঝবি।’

আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। বললুম, ‘আমাকে বলুন কাকিমা, আপনি কী দেখেছেন?’

‘দেখব আবার কী? একটা রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ, ভালো করে হাঁটতে পারে না, রোজ বাস থেকে নেমে দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপায়। তোর মা-কে এবার কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বল, দেবু।’

‘ঠিক বলেছেন কাকিমা। এবার সামার ভোকেশনে মা-কে বাড়ি থেকে বেরুতেই দেব না।’

‘দুত্তোর সামার ভেকেশন! কাল থেকে… অপর্ণাকে যদি বাঁচাতে চাস তো কাল থেকেই ছুটি নিতে বল।’

মেঘমালাকে বললুম, ‘কী করি বলোতো? মা যে কোনো কথাই শুনছে না। ডাক্তার দেখাতে চাইছে না। বলছে, অনুভাদির মাথা খারাপ। ওঁর কোনো কথাই না কি কানে তোলার মতো নয়। বেশি কিছু বললে রেগে যাচ্ছে।’

মেঘমালা বলল, ‘অনুভা কাকিমা একটু পাগলাটে ঠিকই কিন্তু একথাটা যা বলেছেন সেটা ভুল নয়। আচ্ছা, তোমার মামাদের খবর দিতে পারো না?’

‘তবে তো অশান্তির চূড়ান্ত হবে।’

‘আচ্ছা, উনিশ নম্বরের কবিতা মাসিকে একবার বলে দ্যাখো না। ওঁর সঙ্গে তোমার মার কিন্তু খুব ভাব। দু-জনেই স্কুলটিচার তো আর প্রায় সমবয়সি।’

‘ঠিক বলেছ। আমি কালই কবিতা মাসির বাড়ি যাব।’

কবিতা মাসি আর তাঁর স্বামী পবিত্র ঘটক, দু-জনেই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর কবিতা মাসি জিজ্ঞেস করল, ‘তোর পরীক্ষা কবে শেষ হবে, দেবু?’

আমি বললুম, ‘আর মাসখানেক বাকি আছে।’

‘পরীক্ষা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাক। তার আগে হাজার চ্যাঁচালেও তোর মা কোনো কথাই শুনবে না। সামার ভেকেশন শুরু হলেই আমরা সবাই মিলে অপর্ণাদিকে চেপে ধরব। আসলে, তুই না বললেও আমরা তাই করতুম। আমরা এ বছরের গোড়া থেকেই তোর মার শরীরের অবস্থা যে ভালো নয়, সেটা লক্ষ করছি। ভেবেছিলুম, তোকে না-জানিয়ে ওকে প্রথমে ডাক্তার দীপঙ্কর গুপ্তের কাছে নিয়ে যাব। দীপঙ্করদা তোর মেসোর ছেলেবেলাকার বন্ধু। আমরা বললে সব কাজ ফেলে দেখে দেবে। কিন্তু, অনুভাদির পেটে তো কোনো কথা থাকে না। যেহেতু তোকে বলতে বারণ করা হয়েছিল, অতএব তোকেই আগেভাগে ডেকে কথাটা না-বলে আর পারল না।’

‘কী হবে কবিতা মাসি?’

‘কী আবার হবে? ঠিকমতো চিকিৎসা করলে সব অসুখ সেরে যাবে। তবে কী জানিস, অ্যানিমিয়া সারতে দেরি হয়। বড়ো পাজি রোগ। ডাক্তার যা যা বলবে সব মেনে চলবি। ফাঁকি দিলে হবে না।’

‘আমি একটুও ফাঁকি দেব না। দেখো তুমি।’

‘তবে আর কী? বাড়ি যা তো। পরীক্ষার পড়া তৈরি কর ভালো করে। এখন ওটাই তোর প্রথম আর প্রধান কর্তব্য।’

পবিত্র মেসো আমাকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি বলছি তোর মা একদম সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

‘ব্লাড ক্যান্সার! মা আর বাঁচবে না, স্রগ্ধরা। আমি যে মাকে বলেছিলুম, দোতলায় একটা কলঘর করে দেব যাতে বুড়ো বয়সে মাকে সিঁড়ি ভাঙতে না-হয়। সেটার কী হবে? আমার মনে হচ্ছে, ডাক্তারটাই ভুয়ো। যেদিন দেখলো, তারপর দিন থেকেই মা-র শরীর দেখতে না-দেখতে ভেঙে পড়ল। নিশ্চয়ই এতে ডাক্তারবাবুর কোনো হাত আছে। জানো স্রগ্ধরা, তবু যখন মা-কে আমার রেজাল্টের কথা বললুম, মা যে কী অদ্ভুত একটা হাসি হাসল!’

স্রগ্ধরা নিঃশব্দে আমার সামনে বসে আমার এই অসংলগ্ন প্রলাপ শুনে গেল। একবারও আমাকে সহানুভূতি জানানোর বা সন্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল না। কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নেবার চেষ্টা করল না। আমার কথার স্রোত শেষ হবার অনেক পরে স্রগ্ধরা জিজ্ঞেস করল, ‘টাকাপয়সার কী ব্যবস্থা করলে? খরচ তো অনেক।’

‘মার স্কুল থেকে প্রভিডেন্ড ফান্ডের পুরো টাকাটা তুলে দিয়েছে। ছাত্রী আর টিচারেরা চাঁদা তুলে অনেক টাকা দিয়েছে। তাতে অনেকটা খরচ মেটানো গেছে। কিন্তু আরও অনেক দরকার হবে। মা-র গয়নাগুলো বোধ হয় বিক্রি করতেই হবে। নেই-ও তো তেমন কিছু। ঠাকুরদাদার সব ক-টা ফার্নিচার আর আমার প্রাইজের বইগুলো বিক্রি করেও বেশ কিছু টাকা পেয়েছি।’

‘বইগুলো বিক্রি করে দিলে? আমাকে দিলে না কেন? আমি কিনতুম।’

‘দূর পাগল! ওগুলো তো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বই। তোমার কী কাজে লাগবে?

স্রগ্ধরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি কী করতে পারি?’

‘কী আর করবে? একদিন গিয়ে মা-কে দেখে এসো। মা তোমার কথা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে।’

‘যাব। মাসির বাড়ি যাবার নাম করে। কাকিমার ইদানীং আমার ওপরে নেকনজরটা বেড়েছে। কোথাও যাব বললে হাজারটা প্রশ্ন করে। সেদিন দেখি আমার ড্রয়ার খুলে আমার বন্ধুদের চিঠিগুলো পড়ছে। আমি চীৎকার করাতে উলটে আমাকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দিল। সেইসঙ্গে কাকা আর মাও যোগ দিয়েছিল। যাক গে। যাব, শিগগিরই যাব। ছুটির মধ্যে যদি খবর পেতুম তাহলে আগেই চলে যেতুম।’

স্রগ্ধরা এল পরের রোববার বিকেলে। মা-র বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মা-র কঙ্কালসার চেহারার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলল।

মা ওর হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বলল, ‘কাঁদছিস কেন? আয়, পাশে বস। আমার চেহারা দেখে কান্না পাচ্ছে, না রে? মাথায় একটাও চুল নেই। জানিসনে বুঝি, কেমেথেরাপি করলে সব চুল উঠে যায়?’

স্রগ্ধরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি কিচ্ছু জানতে চাই না। মাত্র কয়েক মাস আগে আপনাকে কীরকম দেখে গেলুম। আর আজ…’

মা ক্ষীণ হাসল। বলল, ‘দূর বোকা, যে কাঁদে সে কখনো লড়াই করতে পারে? তোরা না এখন লড়াই করছিস?’ তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার চেহারা তো খারাপ হবেই। যে রোগে ধরেছে।’

‘আপনি জানেন?’

‘কেন জানব না? দেবুর বাবাও তো এই রোগেরই শিকার হয়েছিল। নিজে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা পেয়েছে অথচ সারাক্ষণ হাসিমুখে আমাকে শুধু সাহস জুগিয়ে গেছে। খালি বলত, ”আমি চলে যাচ্ছি বলে দুঃখ করবার কী আছে? যারা থাকছে তাদের কথা ভাব। ভয় পেও না, সাহস হারিও না, ধৈর্য হারিও না।” ভয় আমি পাইনি জানিস? ধৈর্যও হারাইনি। কিন্তু ওই ওটাকে নিয়ে আমার চিন্তা। ও বড়ো সেনসেটিভ, বড়ো সেন্টিমেন্টাল। একটা অবলম্বন ছাড়া ও থাকবে কী করে?’

মা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিল। তারপর বলল, ‘দেবু, তুই একটু নীচে যা তো। আমাদের মেয়েদের মধ্যে কিছু কথা আছে।’

‘মা কী বলল তোমাকে?’ আমি রাস্তায় বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলুম।

স্রগ্ধরা বলল, ‘সে কথা তোমাকে আমি বলব। রাগ কোরো না। মা আমাকে বললেন তোমাকে বলতে যে ওঁর চিকিৎসা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

‘তার মানে?’

‘মার ধারণা চিকিৎসা করে কোনো লাভই হবে না, কেবল টাকা খরচই হবে। মা ভাবছেন যে তুমি ধার করে ওঁর চিকিৎসা চালাচ্ছ। আমাকে বললেন, আমিও যাব আর ছেলেটা তখন গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে।’

‘তুমি কী বললে?’

‘আমি বললুম, চিকিৎসা করে কোনো লাভ হয় না, আপনার এ ধারণা ভুল। তা ছাড়া এই চিকিৎসা তো কেবল রোগ সারাবার জন্য নয়, যন্ত্রণা লাঘবের জন্যও। আর এই চিকিৎসা চললে আপনার ছেলের যন্ত্রণাও তো কিছু কমে।’

‘মা কী বলল?’

‘সেই এক কথা। এত খরচ! অথচ সবই নিরর্থক।’

আমি ঘরে ফিরে এসে মাকে ওষুধ খাওয়ালুম কিন্তু কোনো কথা বললুম না। ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলুম। মা বলল, ‘কথা বলছিস না কেন রে? রাগ করেছিস আমার ওপর?’

আমি খট করে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘কারণ আজ আমি বুঝতে পেরেছি যে তোমরা সবাই স্বার্থপর, অহংকারী। যেমন তুমি তেমন ঠাকুরদাদা। তোমার এত পরিশ্রম, এত কষ্ট, এত দুঃখের ভেতর দিয়ে যাওয়া, সেসব আমাকে ভালোবাসার জন্যে নয়, তোমার আত্মম্ভরিতার জন্য, অহংকারের জন্য। অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নেব না, শুধু আমিই দিয়ে যাব— এটা অহংকার নয়? তোমার ছেলেও তোমাকে কিছু দিতে পারে না, মা?’ বলে আমি বাইরে তাকালুম। দেখি মেঘমালা কাতর চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে।

মেঘমালা বলল, ‘একী করছ তুমি? মাকে কষ্ট দিচ্ছ? এই অবস্থায়, এমন সময়ে?’

আমার আরও কিছু বলবার ছিল। বলতে পারলুম না, চুপ করে গেলুম। মাও কোনো কথা বলল না। মুখ দেখে বুঝলুম, যন্ত্রণা পাচ্ছে। সেটা আমার কথায় না রোগের, সেটা বুঝতে পারলুম না।

সেরাত্রে একটা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীটা একটু ঠান্ডা হল। আর যেন তারই জন্য মার অবস্থা হঠাৎ ভালোর দিকে মোড় নিল। আমি মেঘমালাকে বললুম, ‘স্রগ্ধরা বেশ পয়মন্ত আছে, কী বলো? যেদিন এল, তার পরদিন থেকেই, দ্যাখো না মার কী রকম উন্নতি হচ্ছে।’

মেঘমালা হাসল। বলল, ‘এখনই অনেক কিছু ভেবে বসো না। দ্যাখো না, ডাক্তার গুপ্ত কী বলেন?’

ডাক্তার এলেন আরও তিন-চারদিন পরে। মাকে বললেন, ‘এই তো অর্পণাদি, দিব্যি সেরে উঠছেন দেখছি।’

মা ম্লান হাসল। কোনো কথা বলল না।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ডাক্তারবাবু বললেন, ‘দেবু, তোমার মা এখন হয়তো শরীরে সামান্য বল পাবেন। তার জন্যে দেখো, যেন কোনোরকম পরিশ্রম না-করে বসেন।’ আমার সঙ্গে ছিল ভোলানাথকাকার ভাইপো রামেন্দু। বলল, ‘আপনি ভাববেন না ডাক্তারবাবু। অর্পণাকাকি গায়ে জোর পাচ্ছে অথচ পরিশ্রম করছে না— এটা যতই অসম্ভব ব্যাপার হোক না-কেন, আমরা সবাই মিলে সেটা সম্ভব করব। কি বলিস দেবু?’

আমি কিছু বলবার আগেই ডাক্তারবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই চেষ্টাই করো তোমরা।’ ওঁর মুখটা কিন্তু গম্ভীর হয়েই রইল।

মার শরীরের উন্নতি অবশ্য চলতেই থাকল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিশ্বকর্মা পুজোর দু-একদিন আগে সন্ধে বেলা পাড়ার মহিলারা দল বেঁধে এলেন মার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। আমি কবিতা মাসি আর পদ্মা মাসিকে আড়ালে ডেকে বললুম, ‘মাকে বেশি কথা বলিও না যেন।’

শুনে দু-জনেই রেগে গেল। বলল, ‘সে তোকে ভাবতে হবে না। এক তো অনুভাদিকে নিয়ে চিন্তা। ওকে আমরা সামলাব।’

তা সামলালো ঠিকই। ছাদে মাদুর পেতে বসল সবাই। কবিতা মাসি মা-কে বলল, ‘অপর্ণাদি, আজ আমরা কেবল গান গাইব। খুশির গান, আনন্দের গান। বলো, তুমি কী গান শুনতে চাও।’

মা মৃদু হেসে বলল, ‘সব গানই তো আনন্দের। বেশ, তা হলে প্রথমে শোনাও, ”পথ এখনও শেষ হল না”।’

পদ্মা মাসি গাইল। ওর আশ্চর্য সুন্দর গলা। আমি ঘরের ভেতর থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিলুম মা যেন গানে ডুবে যাচ্ছে। যখন গাওয়া হচ্ছে ‘ছায়ায় ফেরা ধূলায় চলা মনের কথা যায় না বলা’ মা তখন পথের শেষে কাকে যেন কতদিনের মনের কথা বলবার প্রতীক্ষায় তন্ময়।

প্রতীক্ষাটা যেন বড়ো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ। পুজোর যখন আর দিন দশেক বাকি, মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। তিন দিনের মধ্যে বুঝতে পারলুম সময় হয়ে এসেছে।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ডাক্তার গুপ্ত একটু আগেই বিষণ্ণ মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। মার খাটের পাশে একুশ নম্বর বাড়ির গোপাদি একটা চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে চেয়েছিল। গত বছর গোপাদির বাবা শিবপদ রক্ষিত মারা গেছেন। গোপাদি বোধ হয় সেই কথাই ভাবছিল। রামেন্দু গেছে ডাক্তারবাবুকে গাড়িতে তুলে দিতে। ওর ফিরে আসতে তখনও একটু দেরি আছে।

ঘরের মধ্যে সে সময় কেবল মার কষ্ট করে নিশ্বাস নেবার একটা যন্ত্রণাক্ত শব্দ।

আমি মেঘমালাকে বলছিলুম, ‘এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেল, মেঘমালা? এই তো, গত সপ্তাহেই ভাবছিলুম, মা বোধ হয় এ যাত্রা সেরেই উঠল। আর আজ?’

মেঘমালা বলল, ‘সব তো শেষ হয়নি। ডাক্তারবাবু একটা ইঞ্জেকশন তো দিয়ে দিয়েছেন। দ্যাখো না, তাতে কী হয়।’

‘কিছু হবে না, মেঘমালা, কিছু হবে না। আমি আর কিছুই আশা করি না।’

‘কেন করো না? এই তো গোপাদি একটু আগে বলছিল, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আশা ছাড়বে কেন?’

হঠাৎ গোপাদি ডেকে উঠল, ‘দেবু, শিগগির আয়।’

আমি একলাফে পড়ার টেবিল থেকে উঠে মার খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখি, মার নিশ্বাসের যন্ত্রণার শব্দ আর নেই, বেশ স্বচ্ছন্দে প্রায় স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ মার চোখদুটো খুলে গেল। আমরা দু-জনেই মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলুম না; কারণ, কোনো সন্দেহ ছিল না যে সেই চোখের দৃষ্টি আমাদের জন্যে নয়। সামনের দেওয়াল ভেদ করে কোথায় চলে গেছে কে জানে! আস্তে আস্তে মার শীর্ণ মুখে একটা কিশোরীসুলভ মিষ্টি লাজুক হাসি ফুটে উঠল। ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট গলায় মা বলে উঠল, ‘একী, তোমার দেখছি একটুও পরিবর্তন হয়নি! ভালো আছো?’ তারপরেই মা-র চোখদুটো থেকে দৃষ্টি চলে গেল।

শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেল। নিয়মভঙ্গের দু-দিন পরে আমার ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে আমাদের বাড়ির একতলায় পাড়ার বড়োদের সভা বসল। সেখানে অবশ্য আমার বয়সি দু-চারজন বন্ধুরও স্থান হল।

উমাশঙ্কর কাকা বললেন, ‘এ বাড়িতে তুই একেবারে একা থাকবি কী করে? তার চেয়ে তুই আমাদের বাড়িতে চল। নীচের একটা ঘর তো খালিই আছে। পাশের ঘরে চঞ্চল আছে। তোর একা লাগবে না।’

আমি বললুম, ‘না কাকা। এ বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না।’

ভোলানাথ কাকার বড়দা সুধীর জ্যাঠামশাই বললেন, ‘সে তো ঠিকই, পিতৃপিতামহের ভিটে ছেড়ে যাবে কোথায়? কিন্তু বাবা দেবপ্রিয়, তোমার অন্নসংস্থানের কী ব্যবস্থা হবে? রামেন্দুর কাছে শুনলুম তুমি না কি তোমার প্রায় সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করে মার চিকিৎসা চালিয়েছ। এ অবস্থায় তোমার চলবে কী করে? পড়াশুনোও তো চালাতে হবে?’

উমাশঙ্কর কাকা বললেন, ‘অন্নসংস্থান কোনো একটা ব্যাপারই নয় সুধীরদা। আমার বাড়িতে দু-বেলা উনিশটা করে পাত পড়ে। সেখানে যদি একটা বাড়ে তাতে কারুরই কিছু যাবে-আসবে না।’

মাথা নাড়লেন সুধীর জ্যাঠামশাই। বললেন, ‘ওর বাবা দীপককে হয়তো তোমার মনে নেই। কিন্তু দীননাথবাবুকে তো দেখছ। এই বংশের ছেলে স্বেচ্ছায় পরান্নে প্রতিপালিত হবে, তা আমার বিশ্বাস হয় না।’

আমি বললুম, ‘এটা কোনো সমস্যাই নয়, জ্যাঠামশাই। আমি একটা স্কলারশিপ পাই। তাতেই চালিয়ে নেব।’

শুনে সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। পবিত্র মেসো বললেন, ‘এই বাড়ি মেনটেন করে কলেজের খরচা চালিয়ে তোর রোজকার বাসে যাতায়াতের পয়সা পর্যন্ত থাকবে না। তোর কোনো ধারণাই নেই। শোন, তোকে কিছু রোজগার করার ব্যবস্থা করতেই হবে।’

আলোচনা চলল অনেকক্ষণ। অবশেষে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হল যে আমাদের বাড়ির একতলাটা ভাড়া দেওয়া হবে। ভাড়াটে জোগাড় করার ভার নিলেন উমাশঙ্কর কাকার পাশের বাড়ির রতন দে মশাই। তাঁর না কি একজন জানাশোনা ভালো দালাল আছে। আরও স্থির হল, আমার আইন আদালত সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার দেখে দেবেন সুধীর জ্যাঠামশাই; আর কবিতা মাসির রাধুনি সরমাদি সকালে আর রাত্রে কোনো একসময় এসে আমাকে কিছু রান্না করে দিয়ে যাবে।

মেঘমালা বলল, ‘তোমার যেন সবই অদ্ভুত! লোকে ভাড়াটে বললে বোঝে একটা পরিবার, স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে। তা নয়, এগুলো সব কী?’

আমি বললুম, ‘কেন এই তো ভালো। স্বামী স্ত্রী হলে রাতবিরেতে ক্যাঁও ম্যাঁও করে ঝগড়া আর বাচ্চাকাচ্চা থাকলে— এই যে মামুর কাথে এত্তু লক্ষ্মী হয়ে থাক, আমরা এত্তা সিনেমা থুড়ি তোমার ছোত্ত পুতুল কিনে এক্ষুনি আসছি। যতো সব ঝামেলা।’

‘তাই বলে রঙের গোডাউন?’

‘রঙের গোডাউন কী দোষ করল? রতনকাকার বন্ধু তো বেশ ভালো লোকই দিয়েছেন। কোনো ঝুটঝামেলা নেই, সবাই নিঃশব্দে কাজ করে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার এই পেছনের উঠোনে কেউ পা দিতে পারবে না, আমার শর্তটা তো মেনে নিয়েছেন তুষারবাবু।’

‘কী জানি বাপু। ওই তুষার তরফদার লোকটাকে আমার একদম ভালো লাগে না। কীরকম যেন একটা বাঁদর বাঁদর চেহারা।’

‘চেহারা যেমনই হোক, অত্যন্ত ভদ্রলোক। আমি তো ওঁর হাঁটুর বয়িসি অথচ দ্যাখো না কী রকম সম্মান দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আর চারজন লোক যে বাড়িতে আছে, কাজকর্ম করছে, টেরই পাওয়া যায় না। আজ এই তিনমাসে কোনোরকম গোলমাল বা চ্যাঁচামেচি এমনকী জোরে কথা বলা পর্যন্ত শুনিনি। মাঝে মাঝে কী একটা কেমিকেলের গন্ধ আসে, এ ছাড়া আর তো কোনো গণ্ডগোল নেই।’

‘স্রগ্ধরা কী বলছে?’

‘কী আর বলবে? ওর ওপর এখন প্রচণ্ড চাপ। ঝুলির বাইরে বেড়াল বেরিয়ে এসেছে। সেটি ওর কাকিমার ভাই-এর ছেলে। তার সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই উঠে-পড়ে লেগেছে।

‘ছেলেটা কেমন?’

‘আর বোলো না। এই প্রশ্ন করেছিলুম আমি। শুনে স্রগ্ধরা মার মার করে তেড়ে এল। বলল, ছেলে যেমনই হোক-না, তাতে আমার কী? সে হিরের টুকরো হতে পারে, নোবেল প্রাইজও পেয়ে থাকতে পারে, আমার সে খবরে তো কোনো দরকার নেই। আমি এই দেবপ্রিয় দত্তকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না, ব্যাস।’

‘তোমার পরিচয় কি এখনও জানানো হয়নি?’

‘না। স্রগ্ধরা বলছে, আমার পরিচয় জানলে ওর কাকা আর কাকিমা মিলে আমাকে বিপদে ফেলবে। ওরা নাকি পারে না হেন কাজ নেই। তাই, একেবারে শেষ পর্যন্ত আমার নাম বা পরিচয় উহ্য রাখার চেষ্টা করে যাবে।’

‘এইভাবে কতদিন চালাবে বা চালাতে পারবে?’

‘এ তো আর কয়েকটা মাস। তারপর পাশ করে বেরিয়ে একটা চাকরি যদি পেয়ে যাই, তখন দেখা যাবে কী করা যায়। আর স্রগ্ধরাও যদি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। ততদিন এই ভাবেই চলুক।’

মা বলেছিল, যুদ্ধে বড়ো কষ্ট। ফাইনাল পরীক্ষা যত এগিয়ে আসতে লাগল, কথাটা যে কত সত্যি তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলুম। তবে আমার আর কী কষ্ট? আসল যন্ত্রণা পেতে শুরু করল স্রগ্ধরা। সব তো খুলে বলত না, তবে মুখ দেখে টের পেতুম অত্যাচার কতখানি বেড়েছে। বিপাশা সিনেমার কাছে গাড়ি রাখা বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো ড্রাইভার বাতিল হয়ে একটা সাক্ষাৎ শকুনের মতো দেখতে নূতন ড্রাইভার এল। সে ব্যাটাছেলে স্রগ্ধরাকে ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সেখানেই বসে থাকত ও না-বেরুনো পর্যন্ত। আমাদের দেখা হত কেমিস্ট্রি ল্যাবের বারান্দায়। প্রিয়ব্রত আর সৌরভ নীচে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারটার দিকে নজর রাখত।

স্রগ্ধরা বলল, ‘ওরা বুঝেছে যে আমি একটা চাকরি জোগাড় করলেই ওদের মুঠোর বাইরে চলে যাব। তখন আর টাকার জন্য কাকার কাছে হাত পাতব না। কাজেই পরীক্ষার আগেই আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য ওরা উঠে-পড়ে লেগেছে। বড়দি আর ছোড়দিকে ওরা হিসাবের মধ্যে ধরে না। ওরা জানে বাবার যত টাকা সবই ওদের কুক্ষিগত হবে যদি এই বিয়েটা ওরা দিতে পারে। আমি স্বনির্ভর হলে ওদের এই জোর খাটানো তখন আর চলবে না আর তখন যদি মা-কে ওরা নেগলেক্ট করে তাহলে তার ব্যবস্থাও আমি নিতে পারব।’

‘তোমার মা কী বলছেন?’

‘মা ভাবতেই পারছে না যে আমি চাকরি-বাকরি করে মা-র ভার নিতে পারব কোনোদিন। মা ভাবছে, সারাজীবনই এদের ওপর নির্ভর করতে হবে। কাজেই এদের সব ব্যাপারেই সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে, এদের সব কথাই বিশ্বাস করছে।’

‘তোমার যে একটি লুচ্চা লোফার লাভার আছে সেটা কি ওঁরা সন্দেহ করেছেন?’

স্রগ্ধরা ক্ষীণ হাসল। বলল, ‘করেননি আবার? লোফারটির পরিচয় জানবার জন্য হেন চেষ্টা নেই যা করেননি।’

‘পরিচয়টা জানিয়ে দাও না। ওরা আমার কিছু করতে পারবে না।’

‘জানাব। পরীক্ষাটা হয়ে যাক। তবে অত কনফিডেন্ট হয়ো না। কাকিমা আর তার বাপের বাড়ি যে কী জিনিস, সেটা যখন টের পাবে তখন বুঝবে।’

খুব অশান্ত মন নিয়ে পরীক্ষা দিলুম। মা চলে যাওয়ার পর প্রথম একমাস একেবারে পড়ায় মন দিতে পারিনি। সন্ধে হলেই টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে মেঘমালার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতুম। মা-র কথা, ঠাকুরদাদার কথা। এই অনর্গল স্মৃতিচারণ অনেকদিন ভোররাত্রি পর্যন্ত চলত। শেষপর্যন্ত দেখলুম, এরকম করলে চলবে না। এই নিশ্ছিদ্র নিঃসঙ্গতা কাটানোর একমাত্র উপায় পড়াশুনোয় মন বসানো। স্রগ্ধরাও বার বার সেই কথাই বলত। বলত, পড়াশুনো যদি না-করো, তাহলে তোমার মা-র স্মৃতিকে অপমানই করা হবে। কাজেই জোর করে পড়তে শুরু করলুম। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি রাত ন-টায় বন্ধ হয়। আমি শেষ পর্যন্ত ওখানে বসে থেকে লাস্ট বাস ধরে বাড়ি ফিরতুম। ফলে পরীক্ষা খুব খারাপ হল না। তবে যতটা ভালো হওয়া উচিত ছিল ততটা নিশ্চয়ই নয়।

পরীক্ষার ঠিক আগে ইউনিভার্সিটির কয়েকটা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছিল। পরীক্ষার পর তাদের সব কটাতেই সিলেকটেড হয়েছি বলে খবর পেলুম। চাকরি নিলুম মনট্রেক্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড বলে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে। এখানে আমার প্রধান কারণ ছিল যে এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ড. বিকাশ গাঙ্গুলি আমাদের ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং লোকচারার ছিলেন। ড. গাঙ্গুলিকে আমরা সকলেই একজন আদর্শ মানুষ আর আদর্শ ইঞ্জিনিয়ার বলে মনে করতুম।

প্রথম দিন অফিসে গিয়েই স্রগ্ধরাকে টেলিফোন করলুম। ওর পরীক্ষাও তখন শেষ, জানি বাড়িতেই থাকবে। ফোন প্রথমে ধরলেন একজন মহিলা। রুক্ষ গলা রুক্ষ মেজাজ। পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে বললুম, ‘বলবেন আমি দেবপ্রিয় দত্ত কথা বলছি। ওর বন্ধু।’

স্রগ্ধরা ফোন ধরল। জিজ্ঞেস করলুম, ‘পরীক্ষা কেমন হল?’

‘খারাপ।’

‘পাশ করবে তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘মনোসিলেবলে কথা বলছ যখন তার মানে একজন পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘শোনো, আমি মনট্রেক্সে জয়েন করেছি। আমার ফোন নম্বর গাইডে পাবে। সুযোগ পেলে ফোন কোরো। আর বেশি যদি কেউ বাড়াবাড়ি করে তো সোজা আমার কাছে চলে এসো। রেজাল্ট না-বেরুনো পর্যন্ত চাকরিটা কনফার্মড হবে না। তবে পাশ আমি করবই, কনফার্মেশন কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভয় কোরো না কেমন?’

খুব ক্ষীণ গলায় উত্তর এল, ‘আচ্ছা।’

মেঘমালা বলল, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে? তোমাকে ভয়ানক উত্তেজিত দেখছি।’

আমি বললুম, ‘উত্তেজিত মানে? আমি একেবারে ক্ষেপচুরিয়াস। জানো আজ কী হয়েছে? ড. গাঙ্গুলি বিকেল বেলা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বললেন, জনৈক মুক্তেশ্বর রায়চৌধুরি আর তাঁর শালক শিবশঙ্কর মল্লিক আজ সকালে তাঁর কাছে এসেছিলেন। তাঁরা বলছেন যে আমি নাকি একজন ভয়ংকর শয়তান ক্রিমিনাল। কাজেই আমাকে যেন পত্রপাঠ চাকরি থেকে বিদেয় দেওয়া হয় এবং ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

‘তোমার বিরুদ্ধে তাঁদের কী অভিযোগ?’

‘অভিযোগ হচ্ছে যে আমি হা-ঘরে হা-ভাতে বংশের ছেলে। টাকার লোভে ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরির মেয়েকে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি এবং আমার মা-র যখন অসুখ করে তখন তার চিকিৎসা চালানোর জন্য তাকে দিয়ে তার মা-র গয়না চুরি করিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছি।’

‘ড. গাঙ্গুলি কী বলেছেন?’

‘ড. গাঙ্গুলি তাদের কেবল ঘাড় ধাক্কা দিতে বাকি রেখেছেন। বলেছেন, দেবপ্রিয়কে আমি চিনি, তার সম্বন্ধে এসব কথা যদি দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করা হয় তাহলে আমি দরওয়ান ডাকব। এমনকী উনি স্রগ্ধরার সঙ্গে সরাসরি কথাও বলতে চেয়েছিলেন। ওরা বলেছে, এই ঘটনা ধরা পড়ে যাওয়ায় স্রগ্ধরা ভয়ানক আপসেট— সে কারুর সঙ্গে দেখা করছে না।’

‘উনি তোমাকে কী উপদেশ দিলেন?’

‘সাবধানে থাকতে বলেছেন। উনি বলছেন এরা দু-জনেই গুণ্ডাশ্রেণির। করতে পারে না এমন কাজ নেই। যেমন ধরো, পুলিশে খবর দিতে পারে। পুলিশ আসবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে, হয়তো থানায় ধরে নিয়ে যাবে এবং যতরকমভাবে সম্ভব হেনস্থা করবে। কোনো কিছুই প্রমাণ হবে না ঠিকই কিন্তু বদনামটা ঠিকই হবে। এর ফলে অন্য কোথাও হলে তৎক্ষণাৎ চাকরি চলে যেত। সেটা অবশ্য মনট্রেক্সে হবে না। উনি বলেছেন, শোনো ভয় নেই, এসব শয়তানির মোকাবিলা করার জন্য আমি তোমাকে সবরকমভাবে সাহায্য করব।’

‘তোমার সবকথা ওঁকে বলেছ?’

‘হ্যাঁ বলেছি। আমার কী মনে হচ্ছে জানো? ওরা স্রগ্ধরার মা-র গয়নাগুলো সরিয়েছে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। টাকাকে টাকা আসবে, আমারও থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেওয়া সম্ভব হবে।’

‘ওরা কি পুলিশে খবর দেবে?’

‘দেবে তো বটেই। হয়তো দিয়ে দিয়েছে। মনট্রেক্সে সুবিধে হবে না ঠিকই কিন্তু ডাক্তার রায়চৌধুরিকে তো কনভিন্স করতে হবে।’

‘তাহলে কী করবে?’

‘কী আবার করব। যেমন চলছে তেমনই চালিয়ে যাব। যুদ্ধ করতে যখন নেমেছি তখন ভয় পেলে চলবে কেন? এখন শুধু ভাবতে হবে স্রগ্ধরাকে কীভাবে বের করে আনা যায়।’

স্রগ্ধরা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। যখন ফোন করি, অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনি। কোনো ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা যে এরকম ভাষা ব্যবহার করতে পারেন তা আমার কল্পনার অতীত ছিল। চিঠি লিখি, জবাব আসে না। স্রগ্ধরার মাসির বাড়িতে ফোন করলুম। ওরা বললেন, স্রগ্ধরার খুব অসুখ, ডাক্তার ঘর থেকে বেরুতে বারণ করে দিয়েছে।

এরকম দু-সপ্তাহ চলল। তারপর স্রগ্ধরার মাসিকে ফোন করে সবকথা বললুম। ভদ্রমহিলা আমার সবকথা শুনলেন না। বললেন, ‘তোমাকে আমি চিনি না। তবে তোমার সম্পর্কে মেজদি, মানে স্রগ্ধরার মা-র মুখে অনেক খারাপ কথা শুনেছি। আবার, তোমাদের পাড়ার পারমিতা ভট্টাচার্য আমার ছোটো মেয়ের খুব বন্ধু। সে আবার তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যাক, এসব ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না। তবে, তুমি যে বললে যে ওরা স্রগ্ধরাকে আটকে রেখেছে, তা আমি বিশ্বাস করি না। তা হলেও, আমি খোঁজ নেবার চেষ্টা করব।’

এই ফোনের দিন চারেক পরে সন্ধে বেলা আমাদের বাড়িতে একটি ছেলে এল। উনিশ-কুড়ি বছর বয়েস হবে। সে দেখলুম বেশ উত্তেজিত। বলল, ‘স্রগ্ধরাদি আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে ফোন করেছিল। আমি ধরেছিলুম। আমাকে বলল, ওরা মেজমাসির গয়না সরিয়ে ফেলেছে আর বলছে যে সেগুলো নাকি স্রগ্ধরাদি আপনাকে দেবার জন্য চুরি করেছে। আর বলেছে যে ওরা ওকে ফোন করতে দিচ্ছে না, বাড়ি থেকে বেরুতে দিচ্ছে না। দুপুর বেলা ফাঁক পেয়ে ফোনটা করেছে। ফিসফিস করে কথা বলছিল। আর আপনাকে জানাতে বলেছে যে ওরা পুলিশে খবর দেয়নি। মেসোমশাইকে বলেছে যে পারিবারিক কেচ্ছা প্রকাশ না-করার জন্যই দেয়নি। কিন্তু ওঁকে জানিয়েছে যে আপনি অতি বদমাশ লোক, আপনার বাড়িতে বোমা বানানোর ফ্যাক্টারি আছে। ওরা একটা খুব খারাপ ষড়যন্ত্র কিছু করেছে। স্রগ্ধরাদি বলেছে, আপনি যেন কিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও গিয়ে থাকেন।’

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে ছেলেটি হাঁপাতে লাগল। আমি বললুম, ‘তুমি যে স্রগ্ধরার মাসতুতো ভাই, তাতো বুঝতেই পারছি। কিন্তু, তুমি আমাকে কষ্ট করে খবরটা যে দিতে এলে সেকথা তোমার মা জানেন? তাঁর কিন্তু ধারণা আমি অতি বদলোক।’

‘মা-র কথা বাদ দিন। ওদের সব ক-টা বোনের মাথায় গণ্ডগোল আছে। তবে আমি জানি আপনি খারাপ লোক নন।’

মেঘমালা বলল, ‘কী দরকার এখানে থাকার? একটা মেস-টেস জোগাড় করে নিতে পারো না? সেখানে গিয়েই না-হয় থাক কিছুদিন।’

আমি বললুম, ‘পাগলের মতো কথা বোলো না তো। কিছুদিন। কিছুদিন মানে কতদিন? কবে ওরা কী করবে তার ভয়ে আমি বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব?’

‘অন্তত তোমাদের রেজাল্ট বেরুনো পর্যন্ত। স্রগ্ধরা এমএসসি পাশ করে গেলে তখন কী আর ওকে আটকে রাখতে পারবে?’

‘কেন পারবে না? এখন যেমন, তখনও তেমনি পারবে। ওরা যা করতে পারে করুক। আমি ভয় পেয়ে পালাব না।’

‘গোঁয়াতুর্মি হচ্ছে কিন্তু।’

‘হোক। তবু যাব না।’

‘আমার কিন্তু ভয় করছে। মনে হচ্ছে, কী যেন একটা ভীষণ ব্যাপার হতে যাচ্ছে।’

‘কী আবার হবে? তেমন হলে, ছেড়ে যাব তীর মাভৈঃ রবে।’

এটা দিন সাতেক আগেকার কথা। তার দু-দিন পরেই কোম্পানির কাজে আমাকে মাদ্রাজ যেতে হল। কাজকর্ম সেরে কাল বিকেলে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলুম, দেখি মহা গণ্ডগোল বেধে গেছে। টার্মিনাল বিল্ডিং লোকে লোকারণ্য, সবাই তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছে। ব্যাপার কী? জানা গেল সকাল থেকে সারা দেশে একসঙ্গে তিন তিনটে বম্ব স্কেয়ার হয়েছে তিনটে এয়ারপোর্টে, ফলে সমস্ত ফ্লাইট ডিলেড। আমার প্লেন যে কখন আসবে তার কোনো স্থিরতা নেই। হাপিত্যেশ করে বসে রইলুম। প্লেনে ওঠার ডাক এল রাত সাড়ে এগারোটায়, ছাড়তে ছাড়তে বারোটা। দমদমে নামলুম রাত আড়াইটেয়। মাদ্রাজ এয়ারপোর্টেই বসে থাকার সময় তিনজন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে একটা ট্যাক্সিতে উঠে ক্রেসেন্ট অ্যাভেনিউ-র মোড়ে এসে নামলুম যখন তখন রাত তিনটে।

ওভারনাইট ব্যাগটা হাতে করে আমাদের গলিতে ঢুকতে যাব, পেছন থেকে একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম, ‘দাঁড়াও। যেও না।’

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি মোড়ের মাথায় ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেঘমালা। পরনে হলুদ রঙের ছাপা শাড়ি আর কালো ব্লাউজ।

আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এ কী করে সম্ভব? মেঘমালা কি তাহলে! আমি কম্পিত কণ্ঠে বললুম, ‘একী তুমি? এ যে অসম্ভব অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’

মেঘমালা দৃঢ় গলায় বলল, ‘অবিশ্বাস্য হোক বা না-হোক, দাঁড়িয়ে যাও। ওদিকে যেও না। কী চিন্তা যে হচ্ছিল! কেন এত দেরি করে সবাই? বলছি না, যেও না।’

‘কেন মেঘমালা? বাড়ি যাব না?’

‘না। ওদিকে বিপদ। ভীষণ বিপদ। তর্ক কোরো না, যা বলছি তাই করো।’

‘কীসের বিপদ? বাড়ি আমি যাবই। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’ বলতে বলতেই আমাদের পাশ দিয়ে দু-টি ছেলে মোটর সাইকেলে চড়ে গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে ক্রেসেন্ট অ্যাভিনিউ দিয়ে চলে গেল।

মেঘমালা উত্তেজিত গলায় বলল, ‘নম্বরটা নিয়েছ? ওই মোটর সাইকেলের?’

‘না তো। কেন?’

‘পরে জানবে। আমি নিয়েছি। লিখে নাও।’ বলে একটা নম্বর বলল।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ডায়েরি বের করে নম্বরটা লিখে নিলুম। লিখতে লিখতেই একটা হালকা হাসির শব্দ শুনলুম। মেঘমালা বলল, ‘আচ্ছা, এবার যাও। ক্যাবলা!’

আমি মুখ তুলে আর কাউকে দেখতে পেলুম না। আর ঠিক সেইসময় কে যেন আবার আমাকে পেছন থেকে ডাকল। পুরুষের গলা। দেখি তিন নম্বর বাড়ির অমলেন্দু মুখার্জী। অমলদা বাটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন আর সারা বছর সকাল সাড়ে তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরোন। কটার সময় ফ্যাক্টরি শুরু হয় কে জানে!’

অমলদা বললেন, ‘একী দেবু, তুই এসময় হাঁ করে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে? কোত্থেকে ফিরছিস বুঝি? কিছু হারিয়েছে?’

আমি বললুম, ‘না অমলদা। আচ্ছা, এইমাত্র দুটো ছেলে মোটর সাইকেল করে গেল, দেখেছ?’

‘দেখেছি। তোদের বাড়ির দিক দিয়েই এল।’

‘ওরা কারা? এত রাতে এপাড়ায়?’ আমি কেবল এটুকুই বলতেই হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে চারদিক থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি চমকে উঠে দেখলুম আমাদের বাড়ির ওপরে একটা গাঢ় কমলা রঙের আগুনের গোলা আকাশের দিকে উঠে গেল। তারপর সমস্ত দিক থেকে কেবল কাচ ভেঙে পড়ার আওয়াজ।

আমি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে দেখলুম আমার চোখের সামনে আমাদের বাড়িটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে গেল। আমি মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলুম। বোধ হয় অমলদাই আমাকে উঠিয়ে সরকারদের রোয়াকে বসিয়ে দিলেন।

অনুভা কাকিমা ঘ্যানঘ্যান করে আমাকে কিছু খেয়ে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করে যাচ্ছে, হঠাৎ ভিড় ঠেলে চঞ্চলদা এগিয়ে এল। বলল, ‘দেবু, ওঠ। তোকে এবার থানায় যেতে হবে। দারোগাবাবু ডাকছেন।’

থানায় আমার সঙ্গে কিন্তু কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করা হল না। দারোগাবাবু অসংখ্য জেরা করলেন, সেটা না-করাটাই অস্বাভাবিক হত। আমার পেছনে পেছনে অমলদাও এল। ভোরের আলো ফুটতে এল রামেন্দু। বলল, ‘জ্যাঠামশাই আসছেন। তোর কোনো ভয় নেই।’

রামেন্দুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থানায় এলেন আর একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এঁকে আগে কোনোদিন দেখিনি। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, স্যুট পরা, টাইটা ঢিলে হয়ে বুকের ওপর ঝুলছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক থানায় ঢুকেই ওসি-র চেম্বারে চলে গেলেন।

একটু বাদে আমার ওসি-র চেম্বারে ডাক পড়ল। সেখানে ঢুকে দেখি টেবিলের চারদিকে বেশ কয়েক জন পুলিশের হোমরাচোমরা বসে রয়েছেন। একজন অফিসার তখন স্যুট পরা ভদ্রলোককে বলছেন, ‘ছেলেদুটো মোটর সাইকেল থেকে যে বোমাটা ছুড়েছিল সেটা মারাত্মক রকমের কিছু নয়। উদ্দেশ্য ছিল দুটো— এক, দেবপ্রিয় দত্তকে ভয় পাওয়ানো আর দুই, সে যে বোমা নিয়ে কারবার করে সেটা পুলিশের কাছে প্রমাণ করার একটা রাস্তা তৈরি করা। ওরা যেটা জানতো না যে দেবপ্রিয়বাবু তখন বাড়িতে নেই আর রঙের ড্রামের ওপর বোমা ফাটালে সেটা এক্সপ্লোড করতে পারে? সম্ভবত তরফদার ওখানে রঙের সঙ্গে কিছু কিছু বেআইনি কেমিকেলও রাখত যেগুলো আগুন লাগলে ড্রাম সুদ্ধু ফেটে যেতে পারে। আমার ধারণা এই দুটো ব্যাপারই আনফরচুনেটলি একসঙ্গে ঘটে; যে কারণে অত বড়ো একটা এক্সপ্লোশন হয়। আর ফরচুনেটলি, দেবপ্রিয়বাবু তখন ছিলেন না, থাকলে তাঁরও তরফদারের অবস্থা হত।’

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন কী করবেন? দেবপ্রিয়কে কি অ্যারেস্ট করবেন?’

অফিসারটি ভয়ানক লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘না, না, স্যার, সে কী কথা? উনি আমাদের কাছে সবকথাই বলেছেন। মোটর সাইকেলটার নম্বরও দিয়েছেন। ওঁর তো কোনো দোষ নেই। ওঁরই বাড়ি ভাঙল, ওঁর দিকেই বোমা ছোড়া হল, আর আমরা ওঁকেই অ্যারেস্ট করে ফেললুম— এতটা ইয়ে আমরা নই। এই যে দেবপ্রিয়বাবু মোটর সাইকেলের নম্বরটা দিয়ে আপনি দারুণ কাজ করছেন কিন্তু। আপনার এজাহার নেওয়া তো শেষ হয়েছে। এবার আপনি বাড়ি যেতে পারেন।’

কথাটা শুনে আমার ভীষণ হাসি পেল। বললুম, ‘বাড়ি যাব? কার বাড়ি?’

নবাগত ভদ্রলোক আমার দিকেই চেয়ে ছিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তুমি এখন আমার বাড়িতে যাবে।’

‘আপনার বাড়িতে? কে আপনি?’

‘আমার নাম ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরি। আমার ছোটো মেয়ে স্রগ্ধরা থানার বাইরে গেটের পাশে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি এখন গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলো। আমি একটু বাদেই আসছি।’

আমি এক দৌড়ে থানার বাইরে এলুম। দেখি একটা গাছের তলায় পরিচিত গাড়িটা রয়েছে আর তার পেছনের জানলার ফ্রেমে স্রগ্ধরার উদবিগ্ন মুখ সুহাস রায়ের আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নেমে এল।

আমি খাবি খেতে খেতে বললুম, ‘তোমার বাবা… ভেতরে…কী করে…’

স্রগ্ধরা এগিয়ে এসে আমার একটা হাত ধরল। বলল, ‘বাবা কাল রাত দুটোর সময় হঠাৎ কাউকে না-জানিয়ে বম্বে থেকে চলে এসেছে। প্লেন আসতে দেরি হয়েছিল। বাড়ি এসেই সোজা কাকার ঘরে। আমিও পেছনে পেছনে গিয়েছিলুম। বাবা কাকিমাকে ওর স্টিলের আলমারি খুলতে বলল। খোলামাত্র বাবা একগাদা শাড়ির ভেতরে একবার মাত্র হাত ঢুকিয়ে মা-র হারানো গয়নাগুলো বের করে আনল। তারপর কাকা আর কাকিমাকে সে কী ভয়ানক গালাগালি! বাবাকে কখনো এত রেগে যেতে দেখিনি। কাকা বলল, ‘যা করেছি সেটা হয়তো অন্যায় হয়েছে কিন্তু সেটা তোমার মেয়ের ভালোর জন্যই করেছি।’ তখন তো একেবারে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। বাবা বলল, ‘আমার মেয়ের ভালোর জন্য তুমি একটা নিরাপরাধ ছেলের সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলে? তাকে জেলে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করছিলে? এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরোও দু-জনেই।’ তখন জানতে পারলুম কাকার নিউ আলিপুরে একটা আর যাদবপুরে দুটো ফ্ল্যাট আছে। সে নিয়েও এক চোট হল। যার এক পয়সা রোজগার নেই তার এসব হয় কী করে ইত্যাদি। কর্তা-গিন্নি কাল রাত্রের মধ্যে আউট। এই সব করতে ভোর হয়ে গেল।’

‘কিন্তু আমার ব্যাপারটা জানলে কী করে?’

‘কাকা আর কাকিমা বেরিয়ে যেতেই বাবা ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘তুই এক্ষুনি দেবপ্রিয়ের বাড়ি যা। ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। ও হয়তো এতক্ষণে আর বেঁচে নেই। তবে ওর যদি কিছু হয় আমি এদের ছেড়ে দেব না।’ তারপর কী ভেবে দেখলুম নিজেও গাড়িতে উঠে পড়ল।

তোমাদের বাড়ির অবস্থা দেখে তো আমাদের হয়ে এসেছিল। পাড়ার লোকেদের মুখে জানতে পারলুম তুমি এখানে। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেছ।’

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, একচুলের জন্যেই।’ মনে মনে বললুম, ‘কার জন্যে সে শুধু আমিই জানি— সেই মেঘমালা এখন কোথায়? জানি না। সেকি আমার জন্যে কোথাও অপেক্ষা করে আছে? হয়তো নয়। কবে আবার দেখা হবে কে জানে। ওই বাড়ি আমি আবার একদিন বানাব, তবে সে তখন আর আসবে না। তার সবকথা আমি স্রগ্ধরাকে বলব। বিশ্বাস করবে কি না জানি না। যদি বিশ্বাস করে তবে আমাদের দু-জনের মধ্যে সেও থাকবে। শেষ দিন পর্যন্ত। আর যদি না-করে, তাহলেও মেঘমালা থাকবে একান্ত আমার সন্ধ্যাস্বপনবিহারী চিরকালের জন্য।

স্রগ্ধরা আমার হাত নেড়ে দিয়ে বলল, ‘কী ভাবছ?’

‘ভাবছি তোমার বাবা এতসব খবর পেলেন কী করে?’

স্রগ্ধরা বলল, ‘সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। গাড়িতে ওঠো, বলছি। আচ্ছা, তুমি কি মেঘমালা বলে কাউকে চেনো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *