শুন্য

শুন্য

পাঁচিলের ভাঙা ফাটল দিয়ে ভিতরে ঢুকে এল ছেলের দল। এই ফাটলটার আগে অবধি ওরা চারপাশে দেখে শুনে সাবধানে পা চালায়। কেউ দেখে ফেললে নিজেদের মধ্যে গল্প করার অছিলায় না দেখার ভান করে। ফাটলের সামনে এলেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। তখন এদের মধ্যে দু-একজন মাতব্বর আগে ফাটলের ভিতরে উঁকি মেরে দেখে নেয় ভিতর থেকে কেউ লক্ষ করছে কিনা। কেউ নেই দেখলে দ্রুত ইশারা করে সবাইকে ভিতরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে দেয়। তারপরেই ছোট দলটার মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। যে যাকে পারে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে আসে ভিতরে।

এদের মধ্যে মাধব নামে ছেলেটা একটু দুর্বল। তার উপরে কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত আমাশায় ভুগে শরীরটাও চালতার মতো শুকিয়ে গেছে। সেই ঢোকে সবার শেষে। ঢুকে খানিকক্ষণ জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাকিদের ধরতে সজোরে দৌড় মারে। ভিতরে ঢুকে আর গা ঢাকা দিতে হয় না ওদের। জমিদারবাড়ির ভিতরে ওদের উপর নজর রাখার কেউ নেই।

মাতব্বরদের একজন হল হরে। তার চেহারাটা একটু গাঁট্টাগোট্টা, তাছাড়া সে পড়াশোনাতেও চৌকশ। ভয়ানক স্মৃতিধর। বাকি ছেলেরা যখন তেরোর নামতার শেষের দিকে এসেই হোঁচট খায় তখন হরে গড়গড় করে তেইশ এমন কি সাতাশ অবধি বলে যেতে পারে। ফলে বাকি ছেলেপুলেদের তাকে নেতা বলে জ্ঞান করতে খুব একটা সম্মানে লাগে না।

আজ হরে ভিতরে ঢুকেই মাটি থেকে একটা লাঠি তুলে নিল। তারপর চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “আলো পড়ে গেচে, লুকাচুরি জমবে ভালো।”

সামনে দাঁড়ানো জনা চারেক ছেলের মধ্যে থেকে একটা প্রতিবাদের রেশ ওঠে, “না। ওতে তুই বারেবারে জিতে যাস। অন্য কিছু খেলা হবে।”

হাত তুলে গণ্ডগোলটা থামায় হরে। তারপর আশ্বস্ত করে বলে, “আমার আজ শরীরটা ভাল্লাগছে না। তোরা খেল, আমি দেখি।”

খানিক গাঁইগুই হল। শেষে লুকোচুরিই ঠিক হল। এখন মোমের শিখার শেষ প্রান্তের রঙে রেঙে খানিকটা সন্ধে নেমে পড়েছে। মহলের দিকের আলোগুলোও এই ফাঁকে জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ।

গোটা জমিদারবাড়িটা ঘুমন্ত পাহাড়ের মতো বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে শুয়ে আছে। তার গা থেকে একটু আগেই মরা রোদ নিভতে নিভতে একেবারে বিলীন হয়ে এসেছে। দক্ষিণের অন্দরমহলের ভিতরে কয়েকটা ঘর থেকে হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে ঘাস-পাতার আড়াল থেকে। স্যাঁতস্যাঁতে সন্ধ্যার গন্ধ নামছে বাতাসে। কান পাতলে শোনা যায় হালকা বাঁশির মতো হিস্হিস্ আওয়াজ। সাপের আওয়াজ কি? হতেও পারে…

এই ছেলেরা সাপে ভয় পায় না। ওদের কাছে সন্ধের জমিদারবাড়িটা এক অবাক বিস্ময়ের সন্ধান দেয়।

সারাদিন দু-পাঁচজন ট্যুরিস্ট ভিড় করে এখানে। পাঁচটায় সদরের দরজা বন্ধ হলে বাড়ির বাইরের দিকের এই পিছনের অংশটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সুযোগে সবার চোখ এড়িয়ে তার ভিতরেই দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে স্কুলফেরত ছেলেরা।

ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে সদরের দারোয়ান কাশীনাথ একবার দেখতে এসেছিল এদিকটা। এমনিতে জমিদারবাড়ির চত্তরে বিশেষ অনুমতি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়ার নিয়ম নেই কিন্তু কাশীনাথের সঙ্গে একরকম চুক্তি হয়ে গেছে এই বাচ্চাগুলোর।

এখানে কাছেপিঠে দোকান নেই। রোজ স্কুলের সামনে মনিহারি দোকান থেকে কাশীনাথের জন্যে বিড়ির প্যাকেট এনে দেয় এরা। কাশীনাথও বিড়ি পেয়ে খুশি হয়ে তাদের ঘণ্টাখানেক এখানে থাকার অনুমতি দেয়।

আজও তাদেরকে দেখে বিশেষ আপত্তি করে না কাশীনাথ। হরে বিড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিতে একবার ভারি গলায় বলে, “শীতকাল পল্লি এট্টু জলদি আসতি হয়, অন্দকারে তুমরা খেলা কর, আর কিছু হলে আমার সাক্রিটা যাক?”

হরে কান দেয় না কথাটায়। কাশীনাথ তার পাশে বসে পড়ে বিড়িতে একটা টান দেয়। তারপর কণ্ঠ নামিয়ে বলে, “মওলে ভূত আছে, তা জানো?”

একটা ফুৎকার করে হরে, “ওইসব ছেলে ভুলানো গল্প বলে লাভ নেই দাদু। আমাদের ইস্কুলে বলেছে ভূত বলে কিছু নেই।”

কথাটা মেনে নিতে পারে না বৃদ্ধ কাশীনাথ, গুনগুন করে বলে, “নাও যদি থাইকবে তালে আমি কারে দেকলুম?”

“তুমি আবার কী দেখলে?” অর্ধেক কৌতূহল দেখায় হরে।

“তা বললি তুমি বিসসেস করবে নে। একটা ম্যায়ছেলে ঘুরি বেরায় একনে। একদিন রাতে থাকলি দেকতি পাবে।”

বাকি অর্ধেক কৌতূহল জেগে ওঠে হরের। সেই সঙ্গে ভুরু দুটোও কুঁচকে ওঠে। কাশীনাথের দিকে ফিরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় অন্য একটা গলা পিছন থেকে শুনে ঘুরে তাকায়।

অন্দরমহলের বেড়ার থেকে খানিকটা দূরে যেখানে তারা বসেছে তার পিছন দিয়ে প্রাসাদের চাতাল পেরিয়ে দীঘির দিকে যাবার রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ওদের দেখতে পেয়ে আওয়াজ দিয়েছে একটা লোক। কাশীনাথ একে চেনে। বাড়ির উত্তরের মহলে কিছু অংশের মেরামতের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইনি এসেছেন। আপাতত উত্তর প্রাসাদের একটা ঘরেই রয়েছেন।

কাশীনাথকে বিড়ি টানতে দেখে মুচকি হেসে তিনি বললেন, “বাঃ, এখানেও ঘুষ-টুষের কারবার চলে দেখছি।”

বিড়িটা মুখ থেকে সরিয়ে একটা অপ্রস্তুত হাসি হাসে কাশীনাথ। তারপর ব্যাপারটাকে সামলে বলে, “আপনে ইদিকে সন্দেবেলা কেন আসেন বাবু? সাপের উৎপাত।”

“আমার আবার একটু সন্ধের হাওয়াটা না খেলে কাজে মন লাগে না। বিশেষ করে এখানে দীঘিটা দেখার পর থেকে তো আর লোভ সামলাতে পারি না।”

“রাইতে এট্টু তাড়াতাড়ি আইসবেন বাবু। কোতায় কি থাকে…”

“কী আবার থাকবে? ওসব ভূতের গল্প তুমি বাচ্চাদের শুনিও। বরঞ্চ গেটটা ফাঁকা রেখো না। ভিতরে ঢুকে কে কি হাতিয়ে নেবে।” বলতে বলতে পা চালিয়ে দীঘির দিকে চলে যায় লোকটা।

.

দুবলা মাধবকেই প্রথম চোর করা হয়েছে। বাকিরা গিয়ে লুকিয়েছে উত্তরের অন্দরমহলে। দীঘির পাড় বরাবর এগিয়ে যায় মাধব। পিছন থেকে বন্ধুদের ডাক তার কানে একটু একটু করে মিলিয়ে আসে।

এতক্ষণে আকাশে চাঁদ উঠেছে। দীঘির জলে ছায়া পড়েছে তার। ওপারের গাছগুলোর মাথা বেয়ে আঁধার নেমে আসছে পাড়ে। গা’টা ছম্‌ছম্ করে উঠল মাধবের। অবশ্য আর একটু কাছে আসতেই ভয়টা কেটে গেল।

দীঘির পাড়েই একটা লোক বসে আছে। দুটো হাত পিছনে ছড়িয়ে দুরের দিকে চেয়ে আছে একটানা। পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে একবার ঘুরে তাকাল লোকটা। মাধবকে দেখতে পেয়ে তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল।

বাকিদের ভালো জায়গা খুঁজে লুকাতে একটু সময় লাগবে। মাধব খুব একটা আপত্তি না করে এগিয়ে গেল। লোকটা মাধবের পিঠে একটা হাত রেখে বলল, “তোরা যে এখানে খেলতে আসিস, ভয় করে না?”

মাথা নাড়ে মাধব। মনে মনে এক থেকে চল্লিশ গুনতে শুরু করে। লোকটা একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বলে, “যদি এই জলে পড়ে যাস?”

“সাঁতার জানি আমি।” গুনতে গুনতেই জবাব দেয় মাধব।

“সে তো আমিও জানি। তাও ভয় লাগে।”

“কীসের ভয়?”

লোকটাকে একটু ভাবুক দেখায়, দূরে অদৃশ্য চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, “কি জানি, এই দীঘির পাড়টায় এলেই মনে হয় কে যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তোর মনে হয় না?”

আবার মাথা নাড়ে মাধব। একটু একটু ভয় যে তার লাগে না তা নয় কিন্তু বাইরের লোকের কাছে সেটা স্বীকার করে ফেললে আরও বেশি করে তার হাবাগোবা বলে বদনাম রটে যাবে।

লোকটা কিন্তু থামে না, যেন নিজেকেই বলছে, এইভাবে বলে যেতে থাকে, “খালি মনে হয় কেউ যেন জলের দিকে টানছে। এই বুঝি টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে দীঘির জলে।”

মাধবের গোনা শেষ হয়ে গেছিল, সে আর না দাঁড়িয়ে দৌড় দিল ভাঙা অন্দরমহলের দিকে। নরম ঘাসের উপর দিয়ে তার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল বেশ জোরে। ক্রমশ মিলিয়ে এল।

রাত আর একটু বেড়ে উঠতে জায়গাটা ছেড়ে ছেলের দল একে একে বাড়ি চলে গেল।

মহীতোষ কিন্তু দীঘির পাড় থেকে উঠল না। আজ যেন তাকে নেশা পেয়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। দূর গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়া এসে মাঝে মাঝেই ঢেউ খেলিয়ে দিচ্ছে জলের উপরে। তাছাড়া কি আশ্চর্য শান্ত জলটা! একটা মাছও কি নেই?

পিছনে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকাল মহীতোষ। এখন কে আসতে পারে? দারোয়ান কাশীনাথ? নাকি অন্য কেউ?

পিছন ফিরে কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না সে। শুধু দমকা হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে লাগল মুখে। চুল উড়িয়ে দিল। বহু দূর থেকে গুনগুন করে একটা গান ভেসে আসছে যেন। খুব করুণ সুরে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। ভারি চেনা লাগে সুরটা।

মাথা সামনে ঘুরিয়ে নিয়েছিল মহীতোষ। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হল কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে।

পিছনের জমিটা পুরোটাই ঘাসের। তার উপরে কেউ হাঁটলে ঠিক এরকমই শব্দ হবার কথা। কিন্তু কই? কেউ তো নেই।

উঠে দাঁড়ায় মহীতোষ। হাতের টর্চটা জ্বেলে একবার পুরো জায়গাটা দেখে নেয়। শুধু যে এই জায়গাটায় জনপ্রাণী নেই তাই নয়, এখানে একবার এসে দাঁড়ালে মনে হয় গোটা পৃথিবীটাই যেন আচমকা ফাঁকা হয়ে গেছে।

“কে ওখানে?”

একটা ঝোপ নড়ে উঠতে সেদিকে আলো ফেলে মহীতোষ। চারদিকটা ভালো করে দেখে একটা ছোট লাঠি খুঁজে নেয়। তার কাছে আপাতত দামি কিছু নেই। তাও কারও খারাপ উদ্দেশ্য থাকতেই পারে।

টর্চটা ঝোপের উপরে ধরে লাঠিটা উঁচিয়ে এগিয়ে যায় মহীতোষ। এখনও নড়ছে ঝোপের পাতাগুলো। কিছু একটা আছে ওখানে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। গুনগুন বাঁশির আওয়াজটা বেড়ে উঠেছে।

কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠিটা দিয়ে ঝোপের একটা ডালকে একপাশে চেপে ধরে মহীতোষ। তারপর এক ঝটকায় সজোরে একটা বাড়ি মারে তার উপরে। নাঃ কিচ্ছু নেই।

ঝোপের ভিতরে ছেলেদের ফেলে যাওয়া একটা বল চোখে পড়ল। অথচ একটু আগেই কাউকে এখানে হাঁটতে শুনেছে সে। গেল কোথায় তাহলে লোকটা?

মহীতোষ ভিতু নয়। তাই যদি হত তাহলে এই মুহূর্তেই সে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাসাদের দিকে দৌড় দিত। তার বদলে লাঠিটা আরও শক্ত করে ধরে সে জলের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল তার। মনে হল এতক্ষণ যেন জলের ভিতর থেকে মুখ তুলে কেউ তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সে ফিরে তাকাতেই মাথা নামিয়ে নিয়েছে। শান্ত জলের সেই জায়গাটায় এখন গোল হয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে…

এইবার সত্যিকারের ভয় লাগল মহীতোষের। জলের দিকে এক’পা এক’পা করে এগিয়ে গেল সে। সত্যি কেউ আছে এখানে। শুধু এই জলের ধারে নয়, এই প্রাচীন জমিদারবাড়ির আনাচে কানাচে, বিরাট সিমেন্টের থামে, শ্যাওলা ধরা শ্বেতপাথরের মূর্তিগুলোর নিশ্চল চোখে, জীবন্ত কিছু লুকিয়ে আছে সবার চোখের আড়ালে। খুন, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, অত্যাচারের যে গোপন উপাখ্যান – ইতিহাস তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে রাখে, আজ যেন তা উজাড় করে দেখাতে এতটুকু আপত্তি নেই তার।

মাছের ঘাই মারার মতো একটা গোল ঢেউ চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে দীঘির ঠিক সেই জায়গাটায় একটানা তাকিয়ে থাকল মহীতোষ। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় এখন একটু বেশি সজাগ হয়ে উঠেছে।

গোল ঢেউটার উপরে স্থির হয়ে রয়েছে টর্চের আলো। জলের উপরে ভেসে থাকা কয়েকটা খড়ের টুকরো সদ্য মিলিয়ে যাওয়া স্রোতের ধাক্কায় এখনও ভেসে চলেছে।

জলের উপর এসে পড়া তারার আলোর দিকে তাকিয়ে একটা ভাবনা এসে চেপে ধরল মহীতোষকে। আজ যে তারাগুলোকে সে জলের উপরে দেখছে তার বেশিরভাগই আজ মৃত। কোনো একসময় জীবিত ছিল তারা। পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব এত বেশি যে মানুষের চোখে যতদিনে সেই আলো গিয়ে পৌঁছায় ততদিনে তারা আলো শেষ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এই জমিদারবাড়িতে আজ থেকে দেড়শ বছর আগে যারা থাকত তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। তবু হয়তো তাদের জীবিত সময়ের আলো আজও ইতিহাসের বুক চিরে ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির আনাচে কানাচে…

এমন কি কিছু আছে? যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় না? এমন কিছু… যা যুগের পর যুগ সময়ের বেড়াজাল পেরিয়ে হিসেব রেখে যায় সমস্ত ভাঙা-গড়ার?

উত্তরটা একটু পরেই পেল মহীতোষ।

.

পরদিন সকালে মহিতোষকে না পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেল কাশীনাথ রোজ সকালে সে এখানেই চা রেখে যায়। আজ বাইরে থেকে কড়া নাড়তে গিয়ে খেয়াল হল দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ। মানে মহীতোষ এখনও দীঘির ধার থেকে ফেরেনি। রাতে কি ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?

ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে সন্দেহ আরও দৃঢ় হল কাশীনাথের। এত বেলা অবধি দীঘির ধারে শুয়ে থাকলে চোখে আলো পরেই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। এখনও তাহলে ফিরল না কেন?

চাটা রান্নাঘরেই রেখে এসে সিঁড়ি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কাশীনাথ। বাইরের চাতালে এখন সকালের রোদ মেলা বসিয়েছে। সেটা পার করে খানিকটা ধীর পায়েই সে দীঘির দিকে চলে এল। ঝকঝকে আয়নার মতো দীঘির জল নিস্তরঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। একটা ঢিমে হাওয়া বয়ে চলেছে ক্ৰমাগত

দীঘির পাড় ফাঁকা। মানুষজনের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। এতক্ষণে মনটা কেমন কুডাক ডেকে উঠল কাশীনাথের। তবে কি সকালে উঠে বাইরে কোথাও গেছেন? কিন্তু দেউড়ির দরজা তো এখনও খোলেনি কাশীনাথ। দরজা বন্ধ থাকলে লোকটা যাবে কোথায়?

অবশ্য জমিদারবাড়ি নেহাত ছোট নয়। অন্য কোনো মহলে গিয়ে থাকলে… নাঃ… কাশীনাথ মাথা নাড়ে। মহীতোষ বসুকে সে যতটা চিনেছে তাতে লোকটা সকালে উঠে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবার লোক নয়। তাহলে?

এবারে পিছনে তাকিয়ে কিছু লোকজনকে এদিকে আসতে দেখল কাশীনাথ। এরা এই বাড়িরই ভাড়াটে। সকালে দীঘির ধারে হাঁটতে আসেন। এদের মধ্যেও দেখা গেল না মহীতোষ বসুকে

সে আসতে যাচ্ছিল। এমন সময় দীঘির ধারে কিছু একটা জিনিসে চোখ পড়তে সে থমকে দাঁড়াল। দীঘির ঠিক ধারেই জলের ছাঁট লেগে মাটি নরম হয়ে আছে। তার উপরেই কয়েকটা আঁকিবুকি দাগ ফুটে আছে। যেন কাঁপা কাঁপা আঙুলের চাপে কিছু লিখে আবার মাটি লেপে দিয়েছে কেউ। তারপর সেই মাটির উপর আবার আঙ্গুল বুলিয়ে আঁকা একটা পাকানো গোল দাগ।… মশার ধুপের মতো।

একটা চিহ্ন।

লেখাটা থেকে একটু দূরেই একটা পায়ের ছাপ। দীঘির দিকে এগিয়ে গেছে ছাপটা। দীঘির নিটোল জলের উপরে গিয়েই মিলিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি।

কাশীনাথ ভালো লেখাপড়া জানে না। তার উপরে মাটি লেপে দেওয়ার লেখাগুলো আর কিছু দেখা যায় না। বরঞ্চ মশার ধুপের মতো চিহ্নটার মানে সে জানে। ছেলেবেলায় এ বাড়ির কোনো একটা জায়গায় এই চিহ্নটা দেখেছে সে। কোন জায়গায় সেটা আর মনে পড়ে না।

কিছু একটা মনে পড়তেই কয়েক পা পিছিয়ে এল কাশীনাথ… তার বৃদ্ধ বুকে একটা ভয়াবহ উত্তেজনার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্রমাগত….

সকালের রোদে মহীতোষ বসুর আঙ্গলের ছাপে তৈরি চিহ্নটা এখন জ্বলজ্বল করছে— প্রাচীন পৌরাণিক ধারণা অনুসারে যার অর্থ – পুনর্জন্ম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *