অন্ধকার
ঘরের উপরের কড়িকাঠের কাছাকাছি একটা ফুট দুয়েকের খুপরি। এ ঘরে আসা যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। আজ বহুবছর একটানা বন্ধ থাকার পরে খুলে গেছে সেটা। সেখান থেকেই লাফিয়ে নিচে নেমে এল মেয়েটা। তার অন্ধকারে ডুবে থাকা শরীর মেঝের উপরে এসে পড়তেই ফাঁকা ঘরের প্রতিটা কোণায় প্রতিধ্বনি শোনা গেল। ঘরটা যেন মহাবিশ্বের কোনো ফাঁকা প্রাণহীন গ্রহ। হাহাকারের মতো শোনাল প্রতিধ্বনিটা।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল সে। হাত দিয়ে কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করল। দীর্ঘ, সুঠাম শরীর তার।
দেওয়াল জুড়ে লম্বা লম্বা কালচে দাগ- পোড়া আগুনের ছাপ। ভালো করে লক্ষ করে বোঝা যায় আগুনের কালো ছোপের মধ্যে কয়েকটা দীর্ঘ সাদা দাগও লেগে আছে দেওয়ালে। যেন নখ দিয়ে কেউ চেরার চেষ্টা করেছে দেওয়ালটা।
কী হয়েছিল এখানে?
কিছু একটা খুঁজে নিয়ে হাঁটুর ঠিক সামনে একটা মোমবাতি জ্বালে মেয়েটা। কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে, মোমের শিখাটা কিছুক্ষণ থরথর করে কাঁপার পর আস্তে আস্তে শক্তি পায়। সোজা শিখায় জ্বলতে থাকে সেটা। এ ঘরে বাতাস কম। যেটুকু আছে তাও কয়েক দশকের পুরনো। আগুন জ্বালানোর তেজ বহুকাল হলো হারিয়েছে তারা।
শিখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই চোখ বুজে ফেলে মেয়েটা। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে। একটা মন্ত্র— ভাষাটা চেনা যায় না।
নিস্তব্ধ ফাঁকা ঘরের দেওয়ালে সুরের বোল তোলে সেই মন্ত্র। যেন পৃথিবীর গভীরতম কোনো গহ্বরে লুকানো কোনো মন্দির থেকে বহু মানুষের মন্ত্রপাঠের শব্দ ভেসে আসছে।
মানবসভ্যতার থেকে প্রাচীন, নিষিদ্ধ কোনো মন্ত্ৰ…
মিনিট খানেক সেইভাবে কেটে যায়। ক্রমে ভারি হয়ে উঠছে ঘরের বাতাস কোথা থেকে হালকা বাঁশির শব্দ আসছে।
উলটোদিকের দেওয়ালে মেয়েটার ছায়া স্থির। একটুও কাঁপছে না। একটা ঘন ধোঁয়া জড় হচ্ছে ঘরের চারপাশে। ক্রমশ ঘরের ঠিক মাঝখানে জমাট বাঁধছে ধোঁয়াটা। একটু একটু করে বড় হচ্ছে। বাঁশির আওয়াজটা আসছে সেই জমাট বাঁধা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝখান থেকে… সম্মোহনী বাঁশি। ধোঁয়াটা জীবন্ত।
ধীরে ধীরে মেয়েটাকে ঢেকে ফেলছে ধোঁয়াটা। পা বেয়ে উঠে আসছে বুকে, তারপর গলায়, মাথায়… দেবতার শিরস্ত্রাণের মতো মেয়েটার মাথার পিছনে গোল একটা চক্র তৈরি করেছে ধোঁয়াটা। এখন বাঁশির সুর আরও স্পষ্ট, ভালো করে কান পাতলেই বোঝা যায় কী বলতে চাইছে সুরটা
মেয়েটার মুখটুকুনি ছাড়া সমস্তটাই কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। আরও আরও বেড়ে উঠেছে বাঁশির শব্দ।
হঠাৎ চোখ খুলল মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল মোমবাতিটা। এবার সেই বাঁশির আওয়াজের সঙ্গে শোনা যাচ্ছে আর একটা শব্দ… মেয়েটা মৃদু হাসছে… ক্রুর, শয়তানী হাসি। তার অন্ধকারে ঢাকা মুখটা আর দেখা যাছে না। শুধু দুটো চোখের তারা আলো ছাড়াই যেন জ্বলছে। একটা সাদা জ্যোতি বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়…
সময়ের সীমানা পেরিয়ে, নক্ষত্রের আলোর মতো গোটা মহাকাল ফুটে উঠছে তার চোখের তারায়…