তার চোখের তারায় – ৫

পঞ্চম অধ্যায়

“আসুন মিস সান্যাল। আলাপ করিয়ে দি, ইনি হলেন ক্ষেত্রমোহন সেন। আর ওঁর স্ত্রী গিরিজা। আর অতীন… তাকে দেখচি না…”

একটা কৃত্রিম হাসি মুখে ঝুলিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে সুনন্দা। তুলি একটু আগেই এসে ঢুকেছে। সে ছাড়া ঘরে পঞ্চম ব্যক্তি যিনি উপস্থিত আছেন তিনি শশাঙ্ক পালিত। ক্ষেত্রমোহন সেন এই জমিদারবাড়ির আর এক আবাসিক। এখানে আছেন তাও বছর দশেক হতে চলল। এনার কোনো এক পূর্বপুরুষ সহদেব দত্ত এবং লীলাবতী দত্তের আমলে এবাড়ির নায়েব ছিলেন। পরে সেই নায়েবের সাথেই জমিদারবাড়ির কারও বিয়ে হয়। ফলে একরকমভাবে ইনিও এই দত্তবংশেরই রক্ত বহন করছেন। সে প্রজন্ম শেষ হতে আর নায়েব রাখা হয়নি এ বাড়িতে। জমিদারী তখন থেকেই পড়ে আসতে শুরু করে।

গিরিজা বলে মহিলাটিকে এখনও দেখতে পায়নি সুনন্দা। বিছানার উপরে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। সুনন্দা তার দিকে তাকিয়ে একবার নমস্কার করেছিল। মহিলা কুতকুতে চোখে তাকে আপাদমস্তক জরিপ করে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যেই সুনন্দা বুঝেছে সে এখানে আসায় যেকোনো কারণেই হোক খুশি হননি গিরিজা সেন।

“আমার স্ত্রী আসলে একটু অসুস্থ।” গিরিজার দিকে একবার তাকিয়ে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন ক্ষেত্রমোহন, “লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা মিশতে চায় না। অতীন… ও অতীন… একবার এদিকে শোন্ বাবা।”

অতীন যার নাম সে ভিতরের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। সম্ভবত ক্ষেত্রমোহন-এর ছেলে। এর চেহারাটা খাপছাড়া রকম পরিপাটি। মাথার চুল মেপে বাঁদিকে সিতে করে সাজানো। এমনভাবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা আর চুল আঁচড়ায় না। পরনে একটা হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। বয়সে চোদ্দ কি পনেরোর বেশি হবে না। ঘরের বাইরে এসে সে সটান বাপের মুখে দিকে চেয়ে দাঁড়াল।

“মাকে সকালের ট্যাবলেট দিয়েছিলি?”

“দিয়েছিলাম।” কাটা কাটা উত্তর।

“তিরিশ এমজি তো?”

“হ্যাঁ। মেপে দিয়েছি।”

“বেশ করেছিস। আজ রাতে আর দিতে হবে না।”

ঘাড় নেড়ে আবার ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল অতীন। ক্ষেত্রমোহন সুনন্দার দিকে চেয়ে বলল, “চলুন আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি। ও আবার বেশি আওয়াজ পছন্দ করে না।”

“হ্যাঁ সেই ভালো।” কথাটা বলে বাইরের দিকে পা বাড়াল শশাঙ্ক।

আজ সকালেই দক্ষিণের প্রাসাদটা দেখে এসেছে সুনন্দা। আলাদা করে কিছু চোখে পড়েনি। উত্তরের প্রাসাদের সঙ্গে এর তেমন একটা কিছু পার্থক্য নেই। দু-একটা ঘরে লোকজন আছে। তারা কে, জমিদারবাড়ির সঙ্গে কীসের সম্পর্ক সেসব আর জিজ্ঞেস করেনি সুনন্দা। লোকগুলো এগিয়ে এসে আলাপ করার মতো নয়। দুটো প্রাসাদের মাঝে মিটার খানেকের একটা রাস্তা রাখা হয়েছে। সেখান দিয়ে পিছনে অন্দরমহল আর দীঘির দিকে যাওয়া যায়। উত্তরের অন্দরমহল আর তার আশেপাশের ঝোপঝাড়ে ছেয়ে যাওয়া জায়গাটাকে একটা কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেই বেড়ার বাইরে থেকে ভিতরে চোখ রেখে একটা ফুট পাঁচেক লম্বা খরিশের খোলস দেখতে পেয়েছে সুনন্দা। দেখেই বুকের ভিতরটা আটকে উঠেছে তার। সরু শুকনো ডালপালার ‘আড়ালেই কোথাও এখনও লুকিয়ে আছে হয়তো সাপটা। ইচ্ছা হলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরেও বেরিয়ে আসতে পারে সে।

মনটা সেদিক থেকে ফেরায় সুনন্দা, কিছু একটা বলছেন ক্ষেত্রমোহন, “আমার বৌয়ের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আসলে আমার এখানে থাকাটা ওর পছন্দ নয়।”

“পছন্দ নয় কেন?” সুনন্দা আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করে।

ক্ষেত্রমোহন ভুরু দুটো কপালের বেশ খানিকটা নিচ অবধি নামিয়ে আনেন, “আসলে আমি একটু ভ্যাগাবন্ড টাইপের ছিলাম। সংসার-টংসার নিয়ে অত মাথা ব্যথা ছিল না। বিয়ে করি বেশ দামড়া বয়সে। দোকানে হেল্পারের কাজ করেছি, ড্রাইভারি করেছি এমনকি খাবার-দাবারের দোকানও দিয়েছি কিছুদিন। বিয়ের পর থেকে গিরিজার শখ ছিল নিজেদের একটা ফ্ল্যাট কিনে কলকাতায় থাকা। সে আর হল কই? এখন ভরসা বলতে একমাত্র ওই ছেলে। বাপের পয়সা নেই, কিন্তু অতীন বেশ ব্রাইট স্টুডেন্ট।”

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে মাঝের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে লাগল তিনজনে তুলি আপাতত মালতীর সঙ্গে ফুল দেখছে। এখানে এসে থেকে একবারও মা-বাবার কথা বলেনি মেয়েটা। আজ সকালেই যোগেন্দ্র নাথ ফোন করেছিলেন। তুলির খবর নিচ্ছিলেন। সুনন্দার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন। সুনন্দা জানিয়ে দিয়েছে বেশ ভালোই আছে সে। আর তুলির মতো মিশুকে ভালো মেয়েও আর হয় না। কাল আর আজ একবারও শরীর খারাপ করেনি। শুধু মাঝে মধ্যে একদম কথা শুনতে চায় না।

অন্দরমহলের সীমানা পেরিয়ে আবার একটুখানি ঝোপঝাড় পড়ে। সেটার দিকে এগোতেই একটা কুয়ো চোখে পড়ল সুনন্দার। তবে এর উপরে গাছপালা গজিয়ে গেছে। চারপাশেও পুরু ঘাসের আস্তরণ। সম্ভবত আর ব্যবহার হয় না সেটা। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সুনন্দা জিজ্ঞেস করল, “এটা কি শুকনো?”

শশাঙ্কই উত্তর দিল, “তা আজ বহুকাল হল এরকমই পড়ে আছে। আমাদের ব্যবহারের কুয়োটা সামনের দিকে।”

সুনন্দা মনে মনে একটা সময় কল্পনা করার চেষ্টা করল। চারপাশের ঘাসগুলো হয়তো ছিল না তখন। সিমেন্টের চাতালটা ভেঙে পড়েনি। ওপাশের অন্দরমহলের ঝকঝকে গম্বুজে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ত। বাইরের ঘরে বসে গড়গড়া টানতেন ভূপতি দত্ত। তাজা তামাকের গন্ধে ভরে থাকত চারপাশটা। বাড়ির মেয়ে-বৌ এসে কুয়ো থেকে বালতি নামিয়ে জল তুলত। গমগম করত জায়গাটা।

কুয়োর পাশটা এখন আগাছায় ভরে গেছে। একটা সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা আছে সেটা। স্ল্যাব আর কুয়োর মুখের মাঝে যেটুকু ফাঁক ছিল সেটা ঢেকে গেছে শ্যাওলার আস্তরণে।

ঝোপটা পেরিয়ে আসতেই বিশাল চোখ জুড়ানো দীঘিটা দেখতে পেল সুনন্দা। জমিদারবাড়ির গোটা পিছন দিকটা ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে সেটা। ওপারে তাকালে ছোটখাটো কয়েকটা কুঁড়ে ঘর চোখে পড়ে।

দীঘির জলে এখন পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। একটু আগের খেয়ালটা আবার ফিরে এল সুনন্দার মাথায়। কুড়িজন গুপ্তঘাতকের শরীর ভেসে উঠেছে দীঘির জলে। আর ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেইখানে অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে কন্দর্প দত্ত… আর সেই নারীমূর্তি।

খোলা জলের উপরে দিয়ে হাওয়া বয়ে এসে সুনন্দার খোলা চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। সেগুলো বাঁধতে বাঁধতে সে বলল, “এ বাড়িতে একসময় ডাকাত পড়েছিল শুনেছি।”

শশাঙ্ক হাসল, “মধুবাবু বলেছেন তো? আরে লোকটার ওই এক দোষ গাকে পাবে ধরে ধরে ইতিহাস শোনাবে।

“দোষ কেন? আমরাই তো জানতে চেয়েছিলাম। ছোটোখাটো একটা মার্ডার মিস্ট্রি বলা যায়।”

“সেইসঙ্গে রিভেঞ্জ ড্রামা।” ক্ষেত্রমোহন বলে উঠলেন, “দিনু রায়ের ব্যাপারটা শুনেছেন তো?”

মাথা নাড়ে সুনন্দা। তারপর দীঘির ধার ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করে, “মার্ডার মিস্ট্রি বললেন বলে মনে পড়ল, সে মিস্ট্রি কিন্তু এখনও সল্ভড হয়নি।”

“কেন?” অবাক হল শশাঙ্ক।

“দিনু রায়ের মেয়েটাকে কে খুন করেছিল সেটা এখনও জানা যায়নি। মানে দিনু রায় সন্দেহ করেছিলেন যে জমিদারবাড়ির থেকেই কেউ, কিন্তু তারপর তো আর কিছু জানা গেল না।”

শশাঙ্ক কিছু বলতে যাচ্ছিল, ক্ষেত্রমোহন তার আগেই বললেন, “সন্দেহ খুব একটা অমূলক ছিল না মনে হয়। সে আমলে জমিদাররা অত পুলিশ টুলিশের ধার ধারত না। জমিদারবাবুর মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি, চাণক্য ঝোলাঝুলি করছে। ব্যাস! একটা মেয়েকে তুলে এনে খুন করতে কতক্ষণ লাগে?”

“সেসব ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটাকে বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গেছিল, আর লাশ গুম করাটাও ভূপতি বা নৃপতি দত্তের কাছে বড় ব্যাপার ছিল না। যার উপরে আমার রাগ তাকে খুন করে নিজের বাড়ির দরজায় তার লাশ বেঁধে রাখব কেন আমি? উঁহু… লাশের বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন জোর গলায় বলতে চেয়েছে, দেখ একটা খুন হয়েছে। বুঝতেই পারছ কে খুন করেছে…।”

“তাহলে আপনি বলছেন ভূপতি দত্তকে ফাঁসানো হয়েছিল?” শশাঙ্ক জিজ্ঞেস করল।

“কাকে ফাঁসানো হয়েছে বলা মুশকিল। তবে দিনু রায়ের আগেও জমিদারবাড়ির চরম শত্রু ছিল কেউ সেটা বোঝা যাচ্ছে।”

“সেটাও অস্বাভাবিক না। জমিদারদের বন্ধুর থেকে শত্রুই বেশি থাকত। “ বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলল না কেউ। দীঘির জল পাথরে বাধানো পাড়ে এসে লেগে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসছে। দু-একটা মাছ জলের উপর মুখ বাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কি যেন দেখেই আবার তির বেগে ডুব দিচ্ছে ভিতরে। এতক্ষণ কিছু একটা ভাবছিল সুনন্দা। মুখ ফিরিয়ে বলল,

“আচ্ছা এই ডাকাতিটা ঠিক কোন সময় নাগাদ হয়েছিল বলুন তো?”

“আপনি তো রীতিমতো গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করছেন।” কথাটা বলে কৌতুকে হেসে উঠলেন ক্ষেত্রমোহন। একটা লজ্জার রেশ ছড়িয়ে পড়ল সুনন্দার মুখে, “আসলে এখানে তেমন কিছু করার নেই তো, রান্নাবান্নাও সনাতনদা করে দেন। ফলে এইসব নিয়েই ভাবি সারাদিন।”

“বেশ, তো ভাবুন না। আমি আপনাকে একটা টাইমলাইন দিয়ে দিচ্ছি। ভাবতে সুবিধা হবে। সালগুলো যদিও একেবারেই আন্দাজে… তাও…”

শশাঙ্ক বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সুনন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “সকালের ফর্দর পিছন দিকটা ফাঁকা আছে। লিখে নিন ইচ্ছা হলে।” পেন সমেত কাগজটা হাতে নিয়ে দীঘির পাড়েই বসে পড়ল সুনন্দা। ক্ষেত্রমোহন বসলেন তার পাশে। শশাঙ্ক একটু দূরে ঘাসের উপরেই দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে লাগল।

খানিকটা হিসেব করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন ক্ষেত্রমোহন

“এই বাড়িটা কবে তৈরি তা আন্দাজেও বলা সম্ভব না। তবে ভূপতি দত্তের বাবা এটা ব্রিটিশ সরকারের থেকে লিখিয়ে নেন সম্ভবত ১৭৭০ নাগাদ। এবং তার পর থেকেই থাকতে শুরু করেন। তার বড় ছেলের নাম জানা যায় না। ধরে নিন তিনি জন্মেছিলেন সত্তরের আশেপাশেই।”

সাদা কাগজে ছোট ছোট করে লেখে সুনন্দা – আননোন; ১৭৭০।

“তার পাঁচবছর পর অর্থাৎ ১৭৭৫-এ ভূপতি, ১৭৮০ তে সন্ধ্যারানি ও ছোট ছেলে নৃপতি ১৭৮৫ নাগাদ। আবার বলছি সংখ্যাগুলো আন্দাজে আর দুই ভাইবোনের মধ্যে পাঁচবছরের ফাঁক রেখে।”

মাথা নাড়ে সুনন্দা। সত্যিকারের সাল তারিখ এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়।

“বড় ছেলে যার নাম জানা যায় না সে মারা যায় কম বয়সে। ধরে নিন ১৭৯০ এর কাছাকাছি। ভূপতি জমিদারী সামলাতে সামলাতে প্রথমবার বিয়ে করেন একটু তাড়াতাড়ি, ধরা যাক ১৮০৩। প্রথম স্ত্রী মারা যান একবছরের মধ্যে। তারপর আবার বিয়ে করেন ১৮০৪-এ ধরে নিন। কন্দর্পের জন্ম তাহলে দাঁড়াচ্ছে ১৮০৫-এর কাছাকাছি।

ভূপতির বোন সন্ধ্যারানির বিয়ে হয় কম বয়সে ১৮০২-১৮০৩ এর মধ্যে হয়তো দু’বছর পর তার প্রথম সন্তান হয়— লীলাবতী, তার গায়ে গায়েই সহদেব।”

হাত দেখিয়ে ক্ষেত্রমোহনকে একটু থামতে বলল সুনন্দা। মানে লীলাবতী জন্মাচ্ছে ১৮০৫ এর কাছাকাছি। ঠিক যে বছর মারা যায় মসক্রপ নামের সেই মেয়েটি। কাগজের উপরে কী যেন লিখল সুনন্দা। ভুরু দু’টো আশ্চর্য রকম কুঁচকে আছে তার। প্রায় মিনিট খানেক পর শব্দ ফুটল মুখে, “তারপর?”

নৃপতির বিয়ে হচ্ছে তাহলে ১৮১০। তার ছেলেমেয়ে হয়নি বলে দত্তক নেন তিনি চাণক্যকে। চাণক্যর জন্ম তাহলে ধরে নিন আঠেরোশো দশের আশেপাশে। তার প্রেমে পড়ার মতো বয়স হতে আরও বছর কুড়ি নিয়ে নিন— ১৮৩০। এই হল আপনার প্রশ্নের উত্তর— জমিদারবাড়িতে ডাকাতি ঘটে ১৮৩০। তখন ভূপতির বয়স ৫৫, সন্ধারানি ৫০, নৃপতি ৪৫, কন্দৰ্প ২৫, লীলাবতী ও সহদেব প্রায় ২৫।

পিছন থেকে এবার সামনের দিকে সরে আসে শশাঙ্ক। পাড়ের উপরে উবু হয়ে বসে পড়ে বলে, “কিছু বুঝলেন? “

সুনন্দার মুখ থেকে চিন্তার মেঘ কেটে যায়, “বোঝার আর কি আছে। আমার আসলে কৌতূহল হচ্ছিল একটু।” নারীমূর্তির কথা ইচ্ছা করেই চেপে গেল সে।

“আপনার কৌতূহল কোথা থেকে হচ্ছে সেটা কিন্তু আমি জানি। সেদিন যেভাবে মৃত্যুগুলোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন….”

“তার সঙ্গে এইসব জমিদারী ইতিহাসের সম্পর্ক আছে বলছেন?” কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।

“মে বি অর মে নট বি। কে বলতে পারে এই বাড়ির কোনো গোপন কুঠুরিতে হয়তো শুভ অশুভ এমন কিছু আছে যা এর আগেও মানুষ খুন করেছে।” গলায় রহস্য আনার চেষ্টা করে শশাঙ্ক।

“তা বলতে পারব না। তবে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে এখানে আসার পর থেকে।”

“কী কথা?” দুজনে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

পাড়ের উপরেই উঠে দাঁড়ায় সুনন্দা। তারপর দীঘির জলের উপর চোখ নিবদ্ধ রেখে বলে, “খুনের কথা জানি না। তবে মনে হয় এই দীর্ঘ আড়াইশো বছরের সাক্ষী হয়ে আছে কেউ। এই এত কান্না, শোক, মৃত্যু, উৎসব, যন্ত্রণা— কেউ দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কালের প্রবাহে বয়ে যাওয়া দুই শতাব্দীর গোপন ইতিহাস ধরা আছে তার চোখের তারায়। আজও আগের মতোই দেখে চলেছে সে। এখনও…”

বিরাট প্রাসাদগুলোর দিকে ফিরে কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল সুনন্দা। কিন্তু সে থেমে যায়। প্রাসাদের দিক থেকে মালতীকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। তার হাবেভাবে একটা অদম্য উত্তেজনা খেলা করছে। এক মুহূর্তের জন্যে সুনন্দার বুক কেঁপে ওঠে। দ্রুত পায়ে সে দীঘির পাড় ফেলে এগিয়ে যায়।

প্রায় দৌড়ে কাছাকাছি চলে আসে মালতী। সুনন্দার দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তুলিদিদির শরীর খারাপ করেছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছে, শিগগির চলুন।”

আর কোনো কথা শোনার জন্যে দাঁড়ায় না সুনন্দা। দ্রুত পায়ে দৌড় দেয় দক্ষিণের অন্দরমহলের দিকে। একটু আগে সেখানেই শশাঙ্কর ঘরে গিয়েছিল তুলি। ভিতরে মধুবাবু আর সনাতন ছিল। তার মধ্যেই কি হয়েছে তুলির? ভাবতেই সুনন্দার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।

শশাঙ্কের ঘরের দরজায় গিয়ে দু-তিনজন অচেনা লোককে চোখে পড়ল। এরাও হয়তো এই মহলেই থাকেন। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে শুনে দৌড়ে এসেছেন।

সবাইকে সরিয়ে বিছানার উপর ঝুঁকে পড়ল সুনন্দা। একটা বালিশের উপরে শুয়ে আছে তুলি। তার চোখ দুটো এখন খোলা। বুকটা মৃদু ওঠা-নামা করছে। বালিশের ঠিক পাশেই পড়ে আছে ইনহেলারটা। সারাক্ষণ সেটা তুলির পকেটেই থাকে।

সুনন্দাকে আসতে দেখে তার দিকে একবার মুখ ফেরাল তুলি। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটল না। গোটা মুখ লাল রঙে ভরে গেছে। একটু একটু করে যেন ফ্যাকাসে হচ্ছে চামড়াটা।

“এখন ঠিক লাগছে মা?” তুলির কপালে একটা হাত রেখে নিচু গলায়- জিজ্ঞেস করল সুনন্দা।

কয়েক সেকেণ্ড পরে উপরে নিচে মাথা নাড়াল তুলি। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বা পাশের জানালাটার দিকে তাকাল।

“ভাগ্যিস ঘরে খুরাম ছিল।” মাটির উপরে বসে থাকা একটা মাঝবয়সী ছেলের দিকে চেয়ে বলল মালতী।

ছেলেটা হালকা মাথা নাড়াল, “আমি তো পে… হিসি করতে গেছিলাম বাইরে… এসে দেখি…”

সুনন্দা লক্ষ করল ছেলেটার বয়স বেশ কম। সম্ভবত এ বাড়ির কোনো শরীকের ছেলেপুলে হবে। সে খুরামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এসে কী দেখলে?”

খুরাম ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, “দেখি দিদি খুব হাত পা ছুঁড়ছে। আর শ্বাস নিতে পারছে না।”

মুখ ঘুরিয়ে নিল সুনন্দা। তারপর আবার তুলির কানের কাছে মুখ এনে বলল, “কী হয়েছিল তুলি? ভয় পেয়েছিলে?”

এই মুহূর্তে তুলি যেন অনেকটা পালটে গেছে। তার চোখ মুখ আশ্চর্যরকম স্থির, ঠোঁট দুটো শুধু কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। সেই রকম কাঁপাকাঁপা ঠোঁটেই আলতো করে উচ্চারণ করেছিল সে, “একজন এসেছিল। চলে গেছে।”

“কে এসেছিল?” উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে সুনন্দা।

“একটা মেয়ে। মুখ দেখতে পাইনি। মুখ ঢাকা ছিল।”

‘কী বলছিল সে?”

এ প্রশ্নের আর উত্তর দেয় না তুলি।

সুনন্দা খুরামের দিকে তাকাতে সে অর্থবহ মাথা নাড়ায়।

সুনন্দা তাকিয়ে দেখে শশাঙ্ক আর ক্ষেত্রমোহন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। তাদের ভিতরে আসতে ইশারা করে তুলির মাথায় আর একবার হাত রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে সুনন্দা।

পায়েলকে এতক্ষণে চোখে পড়ে তার। স্নান খাওয়া সেরে উত্তরের প্রাসাদের দিক থেকে এদিকে আসছে সে। সুনন্দাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ায়। তারপর অন্দরমহলের দিকে একবার উঁকি মেরে দেখে বলে, “কি হয়েছে গো? এত লোক কেন?”

“তুলির শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।” মুখ নামিয়ে বলে সুনন্দা।

“শ্বাসকষ্ট! এমনি, এমনি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল।

“নাঃ, কেউ এসেছিল ওর ঘরে।”

“সে আসতেই পারে, তার জন্যে শ্বাসকষ্ট হবে কেন?”

“একটি মেয়ে… তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল। খুরাম ঘরে ঢুকে দেখতে পাানি তাকে।”

তীক্ষ্ণ চোখে সুনন্দার দিকে তাকায় পায়েল, “কাপড়ে মুখ ঢাকা মেয়ে….! এটা তো…”

“জানি” পায়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দেয় সুনন্দা, কাল আমরা এখানে আসার পরেই তুলিকে কেউ ডেকেছিল। উত্তরের অন্দরমহলের দিক থেকে। আমার মনে হয় দু’জন একই।”

“দিস ইস টারনিং টু স্পুকি। ভূতের গল্প মনে হচ্ছে।”

সুনন্দা এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার সে পায়েলের চোখে চোখ রেখে বলল, “ভূত হোক বা অন্য কিছু। আমি তাকে ছেড়ে দেব না। আজ ওর কিছু একটা হয়ে গেলে…” আচমকাই সুনন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে উrঠছে। মুখের শিরাগুলোয় রং ধরতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। সেটা দেখে এক মুহূর্তের জন্যে ভয় লাগে পায়েলের। দ্রুত সুনন্দার একটা হাত ধরে ফেলে সে বলে, “তুমি একটু শান্ত হও। এরকমও তো হতে পারে যে ও ভুল দেখেছে, বা ঘুমের ঘোরে দেখেছে। হাজার হোক ও একটা বাচ্চা মেয়ে।”

“হ্যাঁ। বাচ্চা, একদম রিন্টির মতো।” আগের মতো শক্ত গলাতেই কথাটা বঙ্গল সুনন্দা।

“রিন্টি কে?” নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল পায়েল।

“আমার মেয়ে। বেঁচে নেই।”

“ওঃ সরি… আসলে…’

“জাস্ট শাট আপ।“

এতক্ষণে সুনন্দার গলার কঠিন ভাব মুছে গিয়ে একটা চাপা কান্নার রেশ ফুটে ওঠে, “আট বছর বয়স ছিল রিন্টির। বাবার হাত ধরে সকালের বাজার করতে গেছিল। তখনও ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি। রাস্তার উলটোদিক দিক থেকে এসে একটা গাড়ি ধাক্কা মারে ওদের। নীলাদ্রি একটু দূরে ছিটকে পড়ে। রিন্টিকে চাপা দিয়ে চলে যায় গাড়িটা।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামে সুনন্দা। একফোঁটা জল তার চোখ থেকে গড়িয়ে গালের উপরে নেমেছিল। আঁচলের একটা প্রান্ত ধরে সেটা মুছে নিয়ে মুখ তুলে তাকায়।

পায়েল এতক্ষণ ধরেই ছিল তার হাতটা। এবারে হাতটা কাঁধে রেখে বলে, “তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, জানো?”

“কী কথা?” ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা।

“টেবিলটা খুঁজে পেয়েছি আমি।”

“মানে সেই ছবির টেবিলটা!” পলকের মধ্যে সুনন্দার গলায় একটু আগের উত্তেজনাটা ফিরে আসে।

“ইয়েস, দ্যাট টেবিল। যে ঘরে নলিনী ঘোষ সুইসাইড করেছিল সেখানেই রাখা ছিল।”

“ড্রয়ারটা ছিল?”

“ছিল। কিন্তু তার ভিতরে একটা আয়না ছাড়া কিছু ছিল না।”

“আয়না! কীরকম আয়না?”

“সেটা বড় কথা না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল অনেক টানাটানির পরেও ড্রয়ারের পুরোটা খোপ থেকে খুলে বেরিয়ে আসছিল না।”

“তো? তাতে কী হল?”

“তাতে হল এই যে আমি বুঝতে পারলাম ড্রয়ারের উপরের কাঠে এমন একটা কিছু আটকান আছে যেটা ড্রয়ারের শেষ প্রান্তটাকে খুলে বেরিয়ে আসতে বাধা দিচ্ছে। আয়নাটা আর একবার ওখানে চিত্ত করে রাখতেই ড্রয়ারের উপরের দিকের কাঠটা দেখতে পেলাম।”

“কী ছিল সেখানে? “

“ইয়েস। কী ছিল ওখানে।”

পাকেট থেকে একটা পুরনো মরচে ধরা বড়সড় চাবি বের করে দেখাল পায়েল। তারপর চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, “একবার এদিকে এসো তো।”

“কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা।

“ওই কুয়োটার কাছে।”

“কিন্তু কেন?”

সুনন্দার কোনো কথা আর শুনল না পায়েল। দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল কুয়োটার দিকে। সুনন্দা বুঝল তাকে আর বাধা দিয়ে লাভ নেই। ভারি জেদি

মেয়েটা। যেটা একবার মাথায় চাপল তো সেই নিয়েই মেতে থাকবে।

কাছে পৌঁছাতে সুনন্দা বুঝল কুয়োটা সে আগে যতটা ভেবেছিল তার তুলনায় বেশ খানিকটা ছোট। মাটির উপরে একটা মানুষের কোমর সমান উঁচু সেটা। সাবধানে পা ফেলে কাছে যেতে হয়। দু’জনের পায়েই চটি। সাপ না হোক পোকামাকড় কামড়ে দিলেও রক্ষা থাকবে না।

কুয়োটার সামনে পৌঁছে সেটাকে আর একবার ঘুরে ফিরে দেখল পায়েল। তারপর একবার স্ল্যাবটার উপরে হাত রেখে পিছন ফিরে বলল, “এটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে।”

“কী হবে তাতে?” এবার বেশ বিরক্ত হয় সুনন্দা। মেয়েটা যেন বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।

“আহা, শোনোই না আমার কথা।” পায়েল কাতর আবেদন জানানোর চেষ্টা করল।

“যতক্ষণ না বলছ চাবিটা কীসের ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না।”

এক পলকে পায়েলের ঠোঁটে একটা শয়তানী হাসি খেলে গেল, “বেশ, সব বলব, কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা পাজেলের উত্তর দিতে হবে।”

“আর ভালো লাগে না… যাক গে, বল কী পাজেল।”

“পাজেলটা এই স্ল্যাবের নিচে। হাত লাগাও।”

অগত্যা হাত লাগাল সুনন্দা। স্ল্যাবটা ভীষণ ভারি। সেটা তুলে সরানো দূরের কথা ঠেলে খানিকটা ফাঁক করতেই কালঘাম ছুটে গেল দু’জনের। মাঝে কয়েকবার থেমে দম নিল সুনন্দা। পায়েলের কিন্তু ধৈর্য্যে ঘাটতি নেই। মহামূল্য কিছু রত্ন রাখা আছে যেন স্ল্যাবের নিচে। সরালেই সব জ্বলজ্বল করে উঠবে।

শেষে ইঞ্চি পাঁচেক ফাঁক হতে সূর্যের আলো সেই অন্ধকারের ভিতরে গিয়ে পড়ল। সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল পায়েল। তারপর একপাশে সরে এসে নাটকীয় ভঙ্গীতে বলতে লাগল

“উনিশশো বিরানব্বই শাল। স্থান এই জমিদারবাড়ি। একটা বছর তিরিশের লোক। হাইট এই ধর তোমার কি আমার মতোই হবে। একদিন সকালে তার ডেডবডি আবিষ্কার করা গেল এই কুয়োর ভিতরে। উপর থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মারা গেছে সে। কুয়োর পাঁচিলে রাখা ছিল একটা মদের বোতল আর একটা গ্লাস। ভদ্রলোককে শেষ দেখা গেছিল আগের দিন বিকেলে। একটা ব্যাগ নিয়ে দীঘির দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। কী মনে হয়? কীভাবে পড়ে গেল লোকটা?”

সুনন্দা একটুও না ভেবে বলল, “এত খুব সহজ। মদ খেয়ে মাথার ঠিক ছিল না। কুয়োর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তেমন উঁচু তো নয়, নিচে পড়ে গেছে।”

“কিন্তু কেন? লোকটা যদি জানে কুয়োটা পরিত্যক্ত তাহলে কাছে এসে দাঁড়াবে কেন?”

“কেন?”

“তুমি কেন এসে দাঁড়ালে?”

“তুমি ডাকলে বলে।” কথাটা বলেই মাথা নাড়ে সুনন্দা, “না পায়েল। জোর করে ব্যাপারটাকে খুন বলতে চাইছ। তবে একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না।”

পায়েল কপালের ঘাম মুছে ব্যাগের ভিতর থেকে জলের বোতলটা বের করে এগিয়ে দিল সুনন্দার দিকে, “জল খাও। যা হাওয়া দিচ্ছে, আমারও গলা শুকিয়ে গেছে।”

বোতলটা হাতে গিয়ে এক ঢোক জল গলায় ঢালল সুনন্দা। সত্যি একটু আগের দৌড়াদৌড়িতে গলা শুকিয়ে গেছে তার।

দ্বিতীয় ঢোক ঢালতে যাবার আগেই থেমে গেল সুনন্দা। একটা আতঙ্ক মিশ্রিত চিৎকার শোনা গেছে। বোতলটা তার হাতে দিয়ে কুয়োর স্ল্যাবের ফাঁকে চোখ রেখেছিল পায়েল। তার গলা থেকেই বেরিয়ে এসেছে আওয়াজটা। এক ঝটকায় চোখে সরিয়ে নিল সে–“নিচে কিছু একটা আছে।”

“কী আছে?” সুনন্দার বুকটাও দুরুদুরু করতে শুরু করেছে।

“জানি না।” খানিকটা পিছিয়ে এল পায়েল। সুনন্দা মনে জোর এনে কুয়োর ফাঁকের কাছাকাছি চোখটা নিয়ে গেল। হাতের বোতলটা পাঁচিলের উপরে রেখে অন্ধকারের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। নাঃ… সূর্যের আলোর ছটা ভিতরের লতাগুল্মের খানিকটা আলোকিত করে রেখেছে। সেখানে তাকিয়ে স্থির নীরবতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

মুখ ফিরিয়ে পায়েলের দিকে তাকাল সুনন্দা। অবাক হয়ে গেল। মেয়েটা হাসছে। একটু আগে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল কিন্তু এখন তার রেশ মাত্ৰ নেই তার মুখে। বরঞ্চ তার বদলে একটা পরিতৃপ্তির হাসি।

“কী হল? কিছু নেই তো…” হতবাক গলায় বলল সুনন্দা।

“তুমি বোতলটা খেয়াল কর। কোথায় রেখেছ?”

বোতলটা এখনও পাঁচিলের উপরে রাখা আছে। একটু আগেই ভিতরটা দেখার সময় সেটা ওখানে রেখেছিল সুনন্দা

পায়েল আগের মতোই হাসতে হাসতে বলল, “যে লোক কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে মদ খাচ্ছে সে যদি পা পিছলে পড়ে যায় তাহলে তার হাতে ধরা গ্লাসও নিচে গিয়ে পড়বে। গ্লাস পাঁচিলের উপরে কিন্তু লোকটা নিচে মানেই লোকটা পা হড়কে পড়েনি। বরঞ্চ নিচে কিছু একটা চোখে পড়েছিল তার। সেটা দেখতে গিয়েই পা হড়কে যায় বা কেউ ঠেলা মারে পিছন থেকে। আমি সিওর না। তবে এক্ষেত্রে শুধু মদ যে দায়ি নয় সেটা জানি।”

সুনন্দার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা এখনও কাটেনি। সে কাটা কাটা উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু নিচে কী দেখেছিল বল তো?”

“যাই দেখুক না কেন, সেটা আর এখানে নেই।”

কুয়োটা ছেড়ে আবার প্রাসাদের দিকে হাঁটতে লাগল দু’জনে। একটু আগের মেঘটা এতক্ষণে নিকষ কালো হয়ে এসেছে। দূরে নারকেল আর তালগাছের মাথাগুলোতে ছাই রঙের খেলা শুরু হয়েছে। তিরতির করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে একটা।

“আজ রাতটা মালতীকে বলবে তুলির কাছে থাকতে?”

“কেন? আমি থাকব না নাকি?”

“প্লিজ। আমি একা পারব না। বিশ্বাস করো, আমার ভীষণ ভূতের ভয়।”

“কী পারবে না?” কথাটা জিজ্ঞেস করে থেমে গেল সুনন্দা, পায়েলের দুটো কাঁধ ধরে বেশ জোর গলায় বলল, “এই মেয়ে, খুলে বল তো কী হয়েছে? আর চাবিটাই বা কীসের?”

“মেটাফোরিকালি বলতে গেলে রহস্যের। আর আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে একটা দরজার।”

“কোন্ দরজার?”

“এলিজাবেথ মসক্রপের সমাধির। এন্ড উই আর ব্রেকিং দ্যাট টুনাইট।”

*****

সন্ধের দিকে আচমকা মেঘ ঘন হয়ে এল। মালতী তড়িঘড়ি গিয়ে রাতের রান্নার জন্যে আনাজ কাটতে বসেছিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার আকাশটা দেখে নিয়েই বঁটি ছেড়ে উঠে পড়ল সে। লাল চাদর গায়ের উপর টেনেছে আকাশটা। একটু পরেই ঝড় শুরু হবে। শনশন্ করে হাওয়া দিচ্ছে। দোতলার জানালাগুলো বন্ধ করতে ছুটল মালতী।

আজ সন্ধে থেকে তুলিকে সে নিজের কাছেই রেখেছে। সুনন্দা আর পায়েল ঘরের ভিতর ঢুকে কি নিয়ে যেন আলচনা শুরু করেছে। রাতে নাকি সবাইকে না জানিয়ে কোথায় একটা যাবে। তুলি থাকবে মালতীর কাছে। এই এক সমস্যা তার। কেউ জোর করলে সে কিছুতেই না বলতে পারে না।

এতক্ষণ তুলি বাইরের বারান্দাতে খেলছিল। তাকে আর খেলতে দেওয়া চলবে না। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগার ধাত আছে মেয়েটার। মালতী ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল বারান্দাটা খালি। তুলি নেই সেখানে।

“তুলি… এই তুলি….” জোর গলায় তুলিকে ডাকল মালতী। ঝড়ের হাওয়া এতক্ষণে বেড়ে উঠছে। সেটাই বয়ে নিয়ে গেল ডাকটাকে। কারও সাড়া পাওয়া গেল না।

“কোথায় গেল আবার… উফফ্” শাড়িটা কোমরে গুঁজে দুহাতে দূরে আসা’ ধুলো থেকে চোখ আড়াল করে সিঁড়ির দিকে এগোলো মালতী। মেয়েটা কি তবে নিচে নেমে গেছে?

কয়েকটা সিঁড়ি নিচে নেমে থেমে গেল মালতী। ঝড়ের মধ্যে আর একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। উপর থেকে আসছে, ছাদের দিক থেকে। কান্নার আওয়াজ তুলির কান্নার আওয়াজ।

দ্রুত সেদিকে ছুটল মালতী। উপরের সিঁড়ির কাছে পৌঁছে অবাক হল সে। এই সিঁড়ি থেকে নয়, ছাদে ওঠার আর একটা বাঁকানো লোহার সিঁড়ি আছে সেখান থেকে আসছে আওয়াজটা। তবে কি সেটা দিয়ে ছাদে উঠতে গেছিল তুলি?

লোহার ভাঙা সিঁড়িটার নিচে আসতেই তুলিকে দেখতে পেল মালতী। ভাঙা-জায়গাটা দিয়ে নিচে পড়ে আছে মেয়েটা। আপাতত তার কান্নার শব্দ ফিকে হয়ে এসেছে। এক হাতে নিজের হাঁটুর উপরে হাত বুলাচ্ছে সে। অল্প চিরে গিয়ে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। মালতী দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়।

“কী করছিলে এখানে?” একটা হাত হাঁটুর নিচে রেখে প্রশ্ন করে মালতী। কাটাটা খুব একটা বেশি নয়। তবে মেয়েটা মাথায় আঘাত পেয়েছে নিশ্চয়ই।

“জামাটা…” চোখের জল মুছতে মুছতে বলে তুলি।

লোহার সিঁড়িটা যেখানে ছাদের দরজায় গিয়ে মিশেছে সেখানে তাকিয়ে একটু অবাক হয় মালতী। সত্যি একটা জামা আটকে আছে দরজার মাথায়। হয়তো দুপুরে শুকোতে দেওয়া হয়েছিল। কোনো ভাবে ঝড়ে উড়ে এসে আটকেছে দরজার মাথায়। জামাটা নিতেই ছাদের দিকে যাচ্ছিল তুলি। সিঁড়িটা যে মাঝপথে গিয়ে ভেঙে গেছে সেটা সে আগে অন্ধকারে দেখতে পায়নি। ফলে সিঁড়ির ভাঙা ধাপটায় পা রাখতে গিয়ে নিচে এসে পড়েছে।

“তোমাকে জামাটা কে আনতে বলেছে? বদমাইশ মেয়ে… আমাকে ডাকতে পারোনি?” মৃদু তিরস্কারের গলায় বলে মালতী।

“ডাকতে গেলে তো জামাটা ও নিয়ে নিত।”

“কে নিয়ে নিত?” দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে মালতী।

তুলি আর কিছু উত্তর দেয় না। মালতী এক মুহূর্তের জন্যে ছাদের দরজার দিকে তাকায়। অনেকক্ষণ আগে মূল সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এই লোহার সিঁড়ি দিয়ে এ বাড়ির কেউ ছাদে ওঠে না। তবে এদিকের দরজাটা কোনো কারণে খোলাই আছে দেখল। খোলা দরজার দিকে তাকাতেই মালতীর হৃৎপিণ্ড এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে যায়। একটা ছায়া— অল্প টিমটিমে আলোতেও বেশ বোঝা যায় কেউ একটা সরে গেল ছাদের দরজা থেকে। এতক্ষণ যেন ওখানে দাঁড়িয়েই লুকিয়ে নজর রেখেছিল ওদের উপরে।

“কে ওখানে?”

কেউ সাড়া দেয় না। ঝড়ের শনশন্ শব্দের তেজ আরও বেড়ে ওঠে। তুলিকে নিয়ে সুনন্দার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে মালতী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *