তার চোখের তারায় – ১৭

সপ্তদশ অধ্যায়

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই এসে জড়ো হয়েছিল উত্তর প্রাসাদের ঘরে। এ ঘরের একদিকে সেই পুরানো টেবিলটা এখনও রাখা আছে। ড্রয়ারটা খোলা। মনে হয় যেন এইমাত্র তার ভিতর থেকে কিছু বের করে নেওয়া হয়েছে।

যাদেরকে ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে কারোরই আসতে বিশেষ অসুবিধা ছিল না। এক গিরিজা এবং ক্ষেত্রমোহন ছাড়া। তারা এ বাড়ির সবার সঙ্গে মেলামেশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। তাও আজ পুলিশের ডাকাডাকিতে রাজি হয়েছিলেন ক্ষেত্রমোহন। গিরিজা কিছুতেই আসতে চাননি। শেষ পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে এবং বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা হবে না কথা দেওয়ায় উঠে এসেছেন তিনি।

ঘরের চারপাশে প্লাস্টিকের আর কাঠের মিলিয়ে গোটা দশেক চেয়ার এনে রাখা হয়েছে। সেখানে মধুবাবু আর সনাতন আপাতত বসে আছে। বাকিরা কেউ বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন আবার কেউ গিয়ে দাঁড়িয়েছেন জানালায়। মালতী একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছোট তেপায়া টেবিলকে টেনে আনছিল ঘরের মাঝে। থেমে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিল সে। টেবিলটা ভারি।

“খেয়েদেয়ে একটু শুতে না শুতেই কি হুজ্জুতি।” নীলাদ্রি জিভ দিয়ে একটা আওয়াজ করে বলল। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শশাঙ্ক, সে নাকের ডগায় একবার হাত ঘষে বলল, “আমি তো বুঝতে পারছি না পুলিশের হঠাৎ এতদিন পরে আমাদের দরকার পড়ল কেন? ইনভেস্টিগেশান তো হয়ে গেছে।”

“ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম।” হতাশার সঙ্গে সঙ্গে বড়সড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল নীলাদ্রি। তারপর একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে পিঠ এলিয়ে বসে পড়ল। পা দুটো ছড়িয়ে দিল সামনে। একবার আড়মোড়া ভাঙল।

মিনিট খানেকের মধ্যে তুলিকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল সুনন্দা। চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে উপস্থিত সকলকে একবার দেখে নিয়ে নীলাদ্রির পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল। কাল দুপুর অবধি যা দরকার সেসব বাদ দিয়ে সব কিছুই স্যুটকেসে ঢুকিয়ে নিয়েছে সে।

টেবিলটাকে মাঝামাঝি টেনে এনে রাখল মালতী। ঘরের আলোগুলো জ্বালাই ছিল। এবার জানালাগুলো আর একটু ভালো করে খুলে দিল সে। ঘরের ভিতরটা আর একটু আলোয় ভরে উঠল।

দু’জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ঘরে ঢুকল পায়েল। সকালের থেকে এখন বেশ খানিকটা সভ্য দেখাচ্ছে তাকে। চোখে মুখেও একটু আগের উদ্বেগটা নেই। বরঞ্চ বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছে। কাঁধের ঝোলাটার ভিতরে কিছু একটা দেখে নিয়ে একটা আলাদা চেয়ার খুঁজে বসে পড়ল সে।

কেশব শর্মা আর মুকেশ খাসনবীশ টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঘরে বসা বাকি আটজনের দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় একবার শর্মা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কেউ বাকি নেই তো?”

সেরকম কোনো উত্তর এল না। আপত্তিও করল না কেউ। শর্মা টেবিলের ঠিক পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লেন। সে চেয়ারটা নীলাদ্রির চেয়ারের একদম কাছে। নীলাদ্রি একটু ফিসফিস করে বলল, “আমার একটু তাড়া আছে স্যার। মানে কোম্পানির একটা লেটার আসার কথা আছে। সেটার তাড়াতাড়ি উত্তর না দিতে পারলে…”

“দেখছি।” এককথায় উত্তর দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন শর্মা।

মধুবাবু এতক্ষণ সনাতনকে কি যেন বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। এবার তিনি খাসনবীশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো স্যার? নতুন করে কিছু হয়েছে নাকি?”

কথাটার উত্তর পাওয়া গেল না। এই সবার মধ্যে সুনন্দাকে বেশ চুপচাপ দেখাচ্ছে। তুলি আপাতত তার কোলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে আঙুলে করে চুল টেনে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। প্রতিবারই সেটা লক্ষ্য করে চুল সরিয়ে দিচ্ছে সুনন্দা।

ক্ষেত্রমোহন এতক্ষণ উসখুশ করছিলেন, এবার চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে বললেন, “আমার স্ত্রীর শরীরটা ভালো নেই। আমাদের মানসিক অবস্থা বুঝতেই পারছেন। একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলে ভালো হয় স্যার।”

মাথা নেড়ে আবার একই উত্তর দেন শৰ্মা, “দেখছি।”

এতক্ষণে বাইরে থেকে এক কনস্টেবলকে দিয়ে একটা যন্ত্র আনিয়েছেন খাসনবীশ। একটা স্লাইড প্রোজেক্টার। সঙ্গে একটা ল্যাপটপ। মাঝখানের টেবিলের উপরে সেটা রেখে এক্সটেনশান কর্ড দিয়ে দেওয়ালে কানেক্ট করা হল। উলটোদিকের দেওয়ালটা মোটামুটি খালি এবং সেদিকে কোনো চেয়ার রাখা হয়নি বলে স্ক্রিনের সাদা চৌকো অংশটা আপাতত সবার চোখে পড়ছে। খাসনবীশ ইশারা করতে ঘরের ছিটকানিটা লাগিয়ে দিয়ে এল মালতী। ঘরের সবার মধ্যে আবার একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হল। হাত তুলে এবার উঠে দাঁড়ালেন কেশব শর্মা। তার গলার স্বর এখন আরও খানিকটা গভীর শোনাচ্ছে। বিশেষ আসবাবপত্র নেই বলে শব্দের শেষদিকগুলো অল্প প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেরকম ভারি গলায় তিনি বললেন, “আপনাদের আজকে এখানে ডাকা হয়েছে পুলিশের তরফ থেকে কিছু জানানোর জন্যে নয়। বরঞ্চ আমরা চাই আপনারা আমাদের কিছু বলুন। এমন কিছু যা আপনাদের মনে হচ্ছে এই ঘটনার জট ছাড়ানোর একটা সূত্র আমাদের হাতে তুলে দিতে পারে। কারণ স্বীকার করতে আপত্তি নেই, এ ধরনের আজগুবি এবং ব্যাখ্যাহীন কেস এর আগে আমার জীবনে এসেছে বলে মনে করতে পারছি না।

সাধারণত পুলিশের কিছু কর্মপদ্ধতি আছে। খুন এবং আত্মহত্যা এই দুয়ের মধ্যেই সবার আগে যে ব্যাপারটা আমরা খতিয়ে দেখি তা হল মোটিভ। একমাত্র সাইকোপ্যাথ না হলে মোটিভ কিছু থাকবেই, সে যত গভীরেই হোক আমাদের কাছে সেটা খুঁজে বের করা বিশেষ অসুবিধার হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে আশ্চর্যের ব্যাপার হল হাজার অন্বেষণের পরেও কোনো মোটিভ খুঁজে পাইনি আমরা। এমনকি ময়না তদন্তের রিপোর্টে এও জানানো হয় যে নিহত অতীন নামের ছেলেটির ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ধস্তাধস্তিরও চিহ্ন নেই। তার শরীরে চেতনানাশক কোনো ওষুধও পাওয়া যায়নি। ফলে সত্যি কথা বলতে আমাদের কাছে একমাত্র ব্যাখ্যা হল একটি চোদ্দ বছরের সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের ছেলে একদিন সকালে আচমকাই দেওয়ালে মাথা ঠুকে আত্মহত্যা করেছে। যা আমাদের কাছে একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে…’

একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন শর্মা, “এই কেসে কেবলমাত্র একটিই লিড হাতে ছিল আমাদের। আমরা জানতে পারি আজ থেকে দশবছর আগে শশিভূষণ সরকার নামে এক মশলা ব্যাবসায়ী এ বাড়িতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে আসেন ও ফিরে যান। তিনি তার স্ত্রীর কাছে এই অতীন ছেলেটির জীবন সংশয়ের কথা বলেন। বলা বাহুল্য অতীনের বয়স তখন চার।

এর কয়েকমাসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন শশিভূষণ সরকার। অর্থাৎ দুটি মৃত্যু। দুটি অস্বাভাবিক মৃত্যু, সময়ের ব্যবধান দশ বছর। অথচ সমগ্রটা দেখলে মনে হয় যেন একই সূত্রে গাঁথা। আমরা এই লিডটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকি। তবে কি কিছু একটা জানতেন শশীবাবু? সেই জন্যেই কেউ আত্মহত্যার মতো করে সাজিয়ে খুন করেছে তাকে?

শশীভূষণ সরকারের মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশনের কাগজটা আর দোকানে পাওয়া যায় না। আমাদের ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়। খুনই করা হয়েছে শশীবাবুকে। কিন্তু কীভাবে? একটি ভিতর থেকে বন্ধ দরজা খুলে একটা মানুষকে খুন করে আবার কীভাবে দরজা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে?

এই ঘটনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা একটা নতুন লিড পাই। আজ থেকে দশ বছর আগে এ বাড়িতে এসে নলিনী ঘোষ নামে বাড়ির তৎকালীন এক বাসিন্দাকে সতর্ক করে যান শশীবাবু। এবং আবারও শশীবাবুর মৃত্যুর কিছুদিন আগে ইনিও আত্মহত্যা করেন। একই ভাবে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ এবং কড়িকাঠ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আবার নতুন এক লিড পাই আমরা। নব্বই-এর মাঝামাঝি এ বাড়ির লাগোয়া এক কুয়োতে পড়ে গিয়ে মারা যান এক ভদ্রলোক। অবশ্য এ ঘটনাটার সঙ্গে বাকি তিনটে ঘটনার কোনো যোগাযোগ নাও থাকতে পারে, কিন্তু তাও মনে হয় একটার পর একটা খুন যেন সুতো দিয়ে বুনে চলেছে কেউ। একটা খুন পৌঁছে দিচ্ছে আগের খুনের ঠিকানায় এবং খুনি থেকে যাচ্ছে অধরা… সে যেন অদৃশ্য… অজ্ঞাত…

তাহলে?”

এইখানে এসে নাটকীয় বক্তৃতা শেষ করলেন কেশব শর্মা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রুমাল বের করে মুছে নিলেন মুখটা। তারপর খানিকটা মাঝে দিকে সরে এসে বললেন, “এই অবস্থায় যেহেতু হার্ড এভিডেন্স আমাদের হাতে কিছুই নেই তাই আমাদের একমাত্র সম্বল হল সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখা। এমন কোনো পসিবিলিটি কি আছে যাতে এই সব ক’টা মৃত্যুকে একসঙ্গে গেঁথে দেওয়া যেতে পারে? আপনাদের মধ্যে থেকে একজন এ ব্যাপারে একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন। যদিও আগে থেকেই তিনি বলে দিয়েছেন যে কোর্টে কিছু প্রমাণ করতে পারবেন না। তার সমস্ত ধারণাটাই সম্ভাবনার উপরে দাঁড়িয়ে।

এছাড়া যখন কোনো উপায় নেই তখন আমরা ঠিক করেছি সেই সম্ভাবনাটুকু অন্তত আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদেরও শুনে নেওয়া দরকার। মিস রায়চৌধুরী…

চেয়ারে বসা পায়েলের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন কেশব শর্মা। সেই সঙ্গে ঘরের বাকি সদস্যরাও। নীলাদ্রির পা চেয়ারের নিচে ঢোকানো। তুলি এতক্ষণে সুনন্দার কোলের উপরে উঠে বসেছে। ক্ষেত্রমোহন দুটো হাত ভাঁজ করে জড়ো করে রেখেছেন বুকের কাছে…

একটু নড়েচড়ে বসল পায়েল। তারপর কাঁধের ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে বলল, “ইয়ে হয়েছে… পেন ড্রাইভটা খুঁজে পাচ্ছি না…

“বেশ… সেটা ছাড়াই বলুন না হয়…’

“না না, তা কী করে হয়? এত কষ্ট করে বানালাম…”

প্রায় আধমিনিট শান্তিনিকেতনি ঝোলা খোঁজার পর পেন ড্রাইভটা পেতে একটা হাসি ফুটে ওঠে পায়েলের মুখে, “পেয়েছি…”

ঝোলাটা চেয়ারের উপরে রেখেই উঠে দাঁড়ায় সে। তারপর এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপরে রাখা ল্যাপটপে পেন ড্রাইভটা গুঁজে দেয়। একটু পরেই দেওয়াল জুড়ে একটা ছবি ফুটে ওঠে। পুলিশের তোলা শশিভূষণ সরকারের দোকানের সেই ছবিটা। সেটার দিকে একবার তাকিয়ে বড় করে একটা দম নেয় পায়েল। তার গলার জোর খুব বেশি নয়, এতক্ষণ কেশব শর্মার বক্তৃতার পরে রীতিমতো মিনমিনে শোনায় তার গলা।

“আমি আসলে যে ক’দিন এখানে আছি রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। বলতে পারেন খানিকটা ভয়ে, এবং ঘুম না এলে মানুষের মাথায় কিছু আজগুবি খেয়াল আসে। আমারও তেমনই একটা খেয়াল এসেছে। আপনারা সবাই প্রায় আমার থেকে বড়। যদি কোথাও গণ্ডগোল দেখেন নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু তার আগে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। প্লিজ আমি যতক্ষণ কথা বলব কেউ কোনো কারণে এই ঘরের বাইরে যাবেন না। এমনকি ফোনগুলো পর্যন্ত পারলে বন্ধ করে পকেটে রেখে দিন।”

ফোন বন্ধ করার তোড়জোড় দেখা গেল না কারোর মধ্যে। পায়েল চারিদিকে একবার ঘুরে দেখে নিয়ে আর একটু আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে আবার বলতে শুরু করে, “শশীভূষণবাবু খুনের ব্যাপারে আমি প্রথম জানতে পারি সুনন্দাদির মুখে। তারপর খানিকটা জেনেছি অনলাইনে পুরনো কাগজ পড়ে আর খানিকটা পুলিশের বদান্যতায়। খুনের মোটিভ কী ছিল তা তো আপনারা এতক্ষণ শুনতেই পেলেন। আমি শুধু বলতে চাই খুনটা কীভাবে হল এবং কে করল।”

বেশ কিছুক্ষণ উসখুশ করছিলেন মধুবাবু। পায়েল তার দিকে ফিরে বলল, “যদিও অনেক দিন কেটে গেছে তাও আমরা এখানে যারা আছি তাদের মধ্যে আপনিই শশীবাবুকে ভালো করে চেনেন। তাকে দেখে কী মনে হয়েছিল আপনার মধুদা?”

মধুবাবু প্রথমে উঠে দাঁড়াবেন কিনা ঠিক করে উঠতে পারলেন না। শেষে দুটো হাত দিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে বসে বসেই বললেন, “মনে হয় একটু চিন্তায় ছিলেন। আমি নাথবাবু আসা অবধি অপেক্ষা করতে বলায় খুব একটা খুশি হননি। নলিনী ঘোষের সঙ্গে দেখা করার কথাটা বলতে গিয়ে মনে হয় একটু ইতস্তত করেন..।”

“আর এছাড়া কিছু বলেননি?”

“আর কিছু… কই না তো।” অবাক হয়ে যান মধুবাবু। এই মুহূর্তেই যেন মনে করার চেষ্টা করেন তিনি।

পায়েল এগিয়ে যায় মধুবাবুর দিকে, বলে, “ধরে নিলাম এতদিনের মাঝে কথাগুলো ভুলে গেছেন আপনি। বা ধরুন সামান্য অপরাধবোধে ভোগেন বলেই মনে করতে চাইছেন না।”

“কীসের অপরাধবোধ?” রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন মধুবাবু।

“তিনি যে জমিদারী দেখাশোনার ব্যাপারে এখানে এসেছেন এবং নলিনী ঘোষের সঙ্গে দেখা করেছেন সে কথা কাউকে বলতে বারণ করেছিলেন তিনি। সঙ্গে এও বলেছিলেন যে কথাটা লোক জানাজানি হয়ে গেলে তার প্রাণসংশয় অবধি হতে পারে। কিন্তু আপনি পেট পাতলা মানুষ। কথা আপনার পেটে চাপা থাকে না। আপনি কথাটা হাটে ছড়িয়ে দেন। এর কিছুদিন পরেই পরপর নলিনী ঘোষ এবং শশীবাবু খুন হওয়াতে আপনার টনক নড়ে। শশীবাবুর খবরটা হয়তো কাগজে পড়েছিলেন আপনি। আত্মহত্যা বা খুন যাই হোক না কেন সেটার পিছনে আপনারও যে খানিক ভূমিকা আছে বুঝতে পেরে আপনি এই মন্ত্রগুপ্তির কথাটা বেমালুম চেপে যান এরপর থেকে। এমনকি ক’দিন আগে পুলিশকে অবধি বলেননি।”

“আ… আমি…” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন মধুবাবু। পায়েল ততক্ষণে আবার সামনে ঘুরে গেছে। তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। একবার দু’জন পুলিশ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নিলেন পায়েল প্রজেক্টারের সামনে গিয়ে আবার বলতে শুরু করল

“অতএব ধরে নেওয়া যায় মধুবাবুর থেকেই শশীভূষণের কথাটা জানতে পারে খুনি। সে শশীভূষণকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে। কারণ ততদিনে সে এটুকু বুঝতে পেরেছে শশীভূষণ জীবিত থাকলে তার কোনো একটা কাজে বাধা পড়বে।”

আড় চোখে একবার পায়েলের মুখের দিকে তাকাল সুনন্দা। প্রথমে খুব একটা আত্মবিশ্বাস না পেলেও এখন বেশ সাবলীলভাবে কথা বলছে পায়েল। মেয়েটার একটু মনের জোরের অভাব আছে, সেটুকু পেয়ে গেলে ভিতরে গুণের অভাব নেই।

“এবার আমরা চলে আসি খুনের দিনের কথায়। আই মিন… খুনের রাতের কথায়।

কাগজ থেকে আমরা জানতে পারি যে সকাল দশটা নাগাদ কিছু কর্মচারী ও আশপাশের দোকানের লোকজন দরজা ভেঙে শশীভূষণের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেন। ব্যাপারটা দেখে স্বভাবতই তারা প্রথমে আত্মহত্যা বলে ধরে নেন। পুলিশ রিপোর্টেও সেই কথাই লেখা হয়। মজার কথা হল সেদিনই এলাকার অন্য ব্যবসায়ীরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে পুলিশ ব্যাপারটাকে জোর করে স্যুইসাইড বলতে চাইছে। কিন্তু কেন?

কেন এলাকার লোকেরা মনে করল শশীভূষণ আত্মহত্যা করেননি? এর কারণগুলো খুব সহজ। শশীভূষণ মারা যাওয়ার পর যারা তার ঘরে ঢোকে তারা এমন কিছু দেখে যাতে তাদের সন্দেহ হয় ব্যাপারটা বাইরে থেকে কেউ এসে করেছে। কিন্তু তাদের সমস্ত ধারণায় জল ঢেলে দেয় একটা কাঠের দরজা। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। জানালার গ্রিলের ভিতর দিয়ে ঢুকে মানুষ খুন করা সম্ভব নয়, তার উপর সেগুলোও ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে কীভাবে খুন করল আততায়ী?”

এইটুকু সময়ের মধ্যেই বন্ধ ঘরের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। পায়েলের কথাগুলোও হালকা প্রতিধ্বনি নিয়ে আছড়ে পড়ছে ঘরের প্রতিটা কোণায় কেউ কেউ হাতের আঙুল মটকাচ্ছে, কেউ অকারণেই ক্রমাগত গলা ঘাড়ের পিছনে হাত বুলিয়ে চলেছে। সেগুলো লক্ষ্য করে আর একটু আত্মবিশ্বাস পেল পায়েল। দেওয়াল ছেড়ে সুনন্দার দিকটায় এসে আবার বলতে শুরু করল সে–

“খুনের দিন সকালে শশীবাবুর দোকানে একটা কাণ্ড ঘটে। দোকানের প্রায় সব কর্মচারীরা টিফিন করতে যাওয়ায় যখন দোকান ফাঁকা হয়ে যায় তখন একটি ছিঁচকে চোর দোকানে হানা দেয়। দোকানের একমাত্র কর্মচারী তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। সম্ভবত রোজই ওই সময়ে সে ক্যাট ন্যাপ নিত।

এ থেকে একটা কথা ধরে নেওয়া যায় যে ওই ছিঁচকে চোরটি কখন টিফিন হয়, কখন কর্মচারী ঢুলতে থাকে এবং কখন দোকানের লোকেরা ফিরে আসে সেই সব জেনে-বুঝে আটঘাট বেঁধেই এসেছিল। কিন্তু চুরি করতে করতে একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় দোকানে লোক এসে পড়ে এবং তাদের দেখে সে পালিয়ে যায়।

এখানে আমার একটা সহজ প্রশ্ন আছে। আমি জানি না কেন কোনো কর্মচারী আর পুলিশের মাথায় এই সহজ ব্যাপারটা আসেনি।

একটা পাঁচ-ছ’জনের দলের দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করতে অন্তত আধঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগার কথা। অর্থাৎ আটঘাট বেঁধে আসা চোর প্রায় মিনিট পঁচিশেক সময় দোকানের ভিতরে কাটানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীদের দেখে যখন সে পালিয়ে যায় তখন একটি টাকাও তার পকেটে ছিল না। এমন কি একমুঠো লবঙ্গ অবধি খোয়া যায়নি। তাহলে এই পঁচিশ মিনিট দোকানের ভিতরে কী করছিল সে? যে লোক এত লক্ষ্য করার পর এত আটঘাট বেঁধে একটা মশলার দোকানের ক্যাশবাক্স ভেঙে চুরি করতে, আসবে সে পঁচিশমিনিট খালি দোকানের সরেজমিন করতে নষ্ট করবে ব্যাপারটা আমার কেন জানি না বিশ্বাস হয় না।

যাই হোক, চোর পালানোর পরে আবার দোকানের কেনাবেচা শুরু হয়। শশীবাবুর মুখ কিন্তু ভার হয়ে থাকে। দোকানে চোর ঢুকে পড়ায় তিনি মোটেই খুশি হননি।

“এসব জেনে আমরা কী করব?” ক্ষেত্রমোহন এতক্ষণ পরে প্রথম কথা বলে ওঠেন, “আমরা জানতে চাই আমাদের ছেলের কী হয়েছিল। ব্যাস। এ বাড়ি কার দখলে যাবে তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।”

“আপনার ছেলের ঠিক সেটাই হয়েছে যা সুনন্দাদির মেয়ের হয়েছিল। অন্যের দোষে প্রাণ গেছে তাদের।” গমগমে গলায় বলে পায়েল। তারপর ক্ষেত্রমোহনের দিকে ফিরে বলে, “সেদিন অ্যাক্সিডেন্টের পর একবার না হয় থামাতে পারতেন গাড়িটা। দেখতে পারতেন আদৌ মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। তখনও বাঁচান যেত কিনা? বলুন না, পারতেন না?”

“আপনাদের চোখের সামনে কী হচ্ছে এসব? এইসব নাটক দেখার জন্যে আমরা বসে আছি নাকি এখানে?” তীক্ষ্ণ উত্তেজিত গলায় কেশব শর্মার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন ক্ষেত্রমোহন। শর্মা কথাটায় খুব একটা পাত্তা দেন না, উলটে বলেন, “ওর দোষ নেই। আমরাই একটু ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছিলাম আর কি। আপনি খুব একটা সুবিধের লোক নন মিস্টার সেন। মাস তিনেকের জেল খেটেছেন যখন তখন জোর করে বধ্য জায়গায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে। এই ঘরটা আর একটু না হয় বিয়ার করলেন।”

ম্যাদা মেরে গেলেন ক্ষেত্রমোহন। পায়েল তুলির গাল টিপে এল এই ফাঁকে। এই সমস্ত ঘটনায় সেই সব থেকে বেশি মজা পাচ্ছে।

“এছাড়া সেদিন আর একটা ঘটনা ঘটে। রাতের দিকে।” ঘুরে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে পায়েল, “রাতে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সুধাংশু এবং বদ্রিনাথ নামে দু’জন কর্মচারী শশীভূষণকে একা রেখে বাইরে বেরিয়ে শাটার নামিয়ে দেয়। রোজ তারা একসঙ্গেই ফেরে কিন্তু সেদিন ফিরতে পারেনি। তার কারণ তারা বাইরে বেরনোর সঙ্গে-সঙ্গেই কারেন্ট চলে যায়। সুধাংশু মোমবাতি আনতে যায় এবং বদ্রিনাথ আর অপেক্ষা না করে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

সুধাংশু মোমবাতি কিনে এনে দেখে আলো ফিরে এসেছে। আবার শাটার তোলাতুলির ঝামেলা এড়াতে সুধাংশু জানালার সামনেটাতে মোমবাতিগুলো রেখে বাড়ি চলে যায়।

এ ঘটনাটায় অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন। শাটার বন্ধ করার ঠিক সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং হল এবং তার খানিক পরেই ফিরে এল। এবং ঠিক সেই সময়ে দোকানের ভিতরে কোনো মোমবাতিও ছিল না, এমনকি একটা ব্যাটারিচালিত আলোও না। এখন ভেবে দেখুন ব্যাটারিচালিত আলো একমাত্র সেই জায়গাতেই নেসেসারি যেখানে ঘনঘন লোডশেডিং হয়। একটা দরকারি জমজমাট দোকানে সেটা নেই মানে সেখানে রাতের বেলা খুব একটা কারেন্ট যায় না। কিন্তু সেদিন গেছিল।

তাহলে কি কারেন্ট যাওয়াটা স্বাভাবিক না?

যদি তাই হয়, তাহলে খামোখা একটা দোকানে মিনিট দশেকের জন্যে কারেন্ট অফ করে কী লাভ হতে পারে?”

একটু থেমে দম নিল পায়েল। গমগমে গলায় উচ্চারণ করল পরের শব্দটা, “অন্ধকার। ওই দশ মিনিট দোকানের ভিতরে খানিকটা অন্ধকারের দরকার পড়েছিল খুনির। ঘরের ভিতরে এমন কিছু একটা ছিল যেটা সে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল শশীভূষণের থেকে, এবং যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে কে সেটা আনতে পারে দোকানের ভিতরে?

সকালের সেই চোরকে মনে আছে? যে একটিও টাকা না হাতিয়ে অকারণে পঁচিশ মিনিট সময় নষ্ট করেছিল দোকানের ভিতরে? আসলে সে চুরি করতে আসেনি। এসেছিল মঞ্চ সাজাতে। রাতে যে ম্যাজিক সে দেখাতে আসবে তার জন্যে স্টেজ সাজাতে এসেছিল। এবং বলা বাহুল্য সে সফল হয়েছিল।”

এইবার শশাঙ্ক আর নীলাদ্রি দু’জনেই একটু নড়েচড়ে বসে। হাতঘড়ির দিকে তাকায় নীলাদ্রি। সুনন্দার কানে কানে কিছু যেন বলে। সুনন্দা ঘাড়- নাড়ে। তারপর নীলাদ্রি একটু জোর গলায় বলে, “আমার এখানে কোনো ভূমিকা নেই বিশ্বাস করুন। আমি এখানে এসেছি সবে দু’দিন হয়েছে। আমাকে এবার ছেড়ে দিন প্লিজ, আপনাদের যে খুনের তদন্ত করার আছে আপনারা করে নিন।”

এবার একটু হাসে পায়েল, “সত্যি কথা বলতে কি এতগুলো খুনের মধ্যে কে যে কোনটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেটা আমিও এখনও জানি না নীলাদ্রিদা। তবে এটুকু বলতে পারি আপনার স্ত্রী, আই মিন সুনন্দাদি ভয়ানকভাবে জড়িয়ে আছেন। বল না, জড়িয়ে নেই?”

সুনন্দা একবার চোখ তুলে তাকায় পায়েলের দিকে। তারপর আবার মাথা নামিয়ে নেয়। তার মুখ দেখে ভিতরে কি চলছে বোঝার উপায় নেই। রিমলেস চশমার ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে শুধু দেখা যায় স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছে চোখের মণিটা।

“তুমি শশীভূষণের খুনটা কীভাবে হল সেটা বল না হয়, কে জড়িয়ে আছে না নেই আমরা দেখে নেব।” কেশব শৰ্মা বললেন।

“বেশ…” কাঁধ ঝাঁকাল পায়েল। আমি সোজাসুজি সেদিন রাতের কথাতেই চলে আসছি, “রাত ওই সোয়া বারোটা নাগাদ দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় খুনি। উপরের কড়িকাঠে যেখানে ফাঁক ছিল সেখান দিয়ে লাফিয়ে সে নিচে নামে। নামার পর সে দরজা খোলে, শশিভূষণ সম্ভবত ঘুমিয়েছিলেন অথবা হিসেব নিকেশে ব্যস্ত ছিলেন। বাইরের আওয়াজ যেকোনো কারণেই হোক তার কানে যায় না। খুনি তাকে পেছন থেকে ধরে দোকানেরই এককোণে পড়ে থাকা একটা দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করে। বেশি তড়পানোর সময় পাননি শশিভূষণ। তার দেহ নিথর হয়ে এলে তাকে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেয় খুনি। আত্মহত্যা হিসেবে সাজানোর জন্যে পায়ের কাছে একটা উলটে পড়া টুল সাজিয়ে দেয়। যাতে দরজা দিয়ে ঢুকেই কারও মনে হয় ওতে লাথি মেরেই আত্মহত্যা করেছেন শশীবাবু। অন্তত ফার্স্ট ইম্প্রেশান সেটা হলেই চলবে। এরপর খুনি কিছু প্রাথমিক খোঁজাখুঁজি করে এবং কাগজটা না পেয়ে শশীভূষণ সেজেই বাড়িতে ফোন করে কাগজের কথা জিজ্ঞেস করে। কাগজটা হস্তগত করে আবার আগের মতোই দরজা আটকে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং দেওয়াল বেয়ে ফাঁক গলে শাটারের বাইরে বেরিয়ে আসে। মিশন কমপ্লিট।”

“কিন্তু দরজার ব্যাপারটা?” মুকেশ খাসনবীশ প্রশ্ন করে। গলাটা হালকা কেঁপে যায় তার।

পায়েল এতক্ষণ বকবক করে হাঁপিয়ে পড়েছে। সে আগের চেয়ারটায় বসে পড়ে বলে, “উফফ্… আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আপনারা বরঞ্চ এই ছবিটা দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করুন। আমি একটু জল খাই।”

ব্যাগ থেকে সবুজ জলের বোতল বের করে একটু জল খায় পায়েল। তারপর আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে বোতলটা। দেওয়াল জুড়ে এখনও ফুটে আছে শশিভূষণের দোকানের সেই ছবিটা। সবাই সেটার দিকে কিছুক্ষণ দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

‘পারলেন না?” হাতের উলটোদিক দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হতাশ গলায় বলে পায়েল, “বেশ আমি বলে দিচ্ছি না হয়। একটু মন দিয়ে লক্ষ্য করবেন।” ছবিটার কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হাত রাখে পায়েল। দরজার ছিটকানিটা দেখা যাচ্ছে। তখনও দেওয়ালের নির্দিষ্ট গর্তের ভিতর ঢুকে রয়েছে তার একটা দিক।

সেটার উপরে টোকা দিয়ে পায়েল বলে, “লোহার ছিটকিনি। তাতে সাধারণত তালা লাগানর একটা আংটা থাকে। ছিটকিনির হ্যান্ডেলটা তার ভিতরে ঢুকিয়ে দুটো গর্তের মাঝখান দিয়ে তালা ঢোকানো হয়। এখানে দেখুন ছিটকিনির হ্যান্ডেলটা আংটার ভিতরে ঢোকানো নেই। বরঞ্চ খানিকটা বাইরে বেরিয়ে আছে। অর্থাৎ হ্যান্ডেলটা ধরে পাশাপাশি সরালেই সেটা খুলে যাবে।

এটা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। রাত্রিবেলা আমরা সাধারণত হ্যান্ডেলটা তালার আংটার ভিতরে ঢুকিয়ে দিতেই পছন্দ করি। শশীবাবুও সেদিন তাই করতে গেছিলেন হয়তো। কিন্তু আংটার ভিতরে ঢোকেনি সেটা। বাইরেই বেরিয়ে থাকে। এই হল খুনির ট্রিক নম্বর ওয়ান।

এবারে এই ম্যাজিকের স্টেজ সাজানোর দিকে মন দেওয়া যাক, মানে আমাদের সেই চোরের পঁচিশ মিনিটের কাজ। সে মোট দুটো কাজ করেছিল। এক ইলেক্ট্রিকের পাওয়ার বোর্ডে উপরে নিচে একটা রিট্রিভার স্প্রিং লাগিয়ে দিয়েছিল। এ জিনিসটার কাজ খুব সিম্পল। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এর ভিতরের স্প্রিংটা একটু লাফিয়ে ওঠে। বাচ্চাদের খেলনার মধ্যে হামেশাই পাওয়া যায়। খেলনার রিমোট দিয়ে বেশ কিছুদূর থেকে কন্ট্রোলও করা যায় একে। স্প্রিং লাফিয়ে উঠলেই কি-বোর্ডের মেন স্যুইচে চাপ পড়বে এবং দোকানে অন্ধকার নেমে আসবে। উপরের স্প্রিং লাফালেই আবার চাপ পড়বে, এবার মেন উপরে উঠে আসবে। কারেন্টও ফিরে আসবে–ট্রিক নম্বর টু।

এর সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের যে গর্তে ছিটকানি ঢোকানো থাকে সেখানে সে ঢুকিয়ে দিয়েছিল একটা শক্তিশালী কিন্তু ছোট চুম্বক। ছিটকিনিটা তাই সেরাতে পুরোটা গর্তের ভিতরে ঢোকেনি। খানিকটা ঢুকে আটকে যায়, কিন্তু তাতে কার সন্দেহ হয় বলুন তো?

এরপর সে দরজার লোহার ছিটকিনিতে এক টুকরো তামার তার সাপের মতো জড়িয়ে দিয়েছিল। তারের দুটো প্রান্ত টেনে এনে দরজার নিচের ফাঁকের কাছে এনেছিল।”

“কিন্তু তা কী করে হয়?” কেশব শর্মা বলে ওঠেন। সেই সকালে সে এসব করে গেল আর লোকে সারাদিন দেখতে পেল না একটা তার জড়ানো আছে?

“অস্বাভাবিক নয়….” মুকেশ থমথমে গলায় বলে, “ওই দরজাটা সারাদিন হাট করে খুলে রাখা হত। দরজার ঠিক সামনেই রাখা থাকত মশলার বস্তা। ফলে দরজার পিছন দিকটা কারও চোখে পড়ার কথা নয়।”

পায়েল আবার বলতে লাগল, “এরপর সে সামান্য একটুখানি ফিজিক্সের জ্ঞান প্রয়োগ করেছিল। ছিটকিনিটা ছিল লোহার। অর্থাৎ দরজার তোলার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকা দুটো তামার তারের মধ্যে যেকোনো একটা দিয়ে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিলেই সেটা পরিণত হবে চুম্বকে। তারটা জড়ানো ছিল লোহার ছিটকিনির সঙ্গে তাই ছিটকিনিটাও কিছুটা চুম্বকের মতো ব্যবহার করবে। ওদিকে দেওয়ালের ফুটোয় আগে থেকেই চুম্বক রাখা ছিল। দুই চুম্বকের সমমেরু বিকর্ষণ করায় ছিটকিনিটা গর্ত থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। অর্থাৎ দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে তারের দুটো প্রান্ত বাইরে টেনে এনে কেউ যদি তারের একটা দিকে ব্যাটারির সাহায্যে বিদ্যুৎ সংযোগ করে তাহলেই ছিটকিনি খুলে যাবে। বন্ধ করার সময়ও একই নিয়ম, শুধু তখন বিদ্যুৎ সংযোগ হবে অন্য তারে। তাহলেই চুম্বকের মেরু পালটে যাবে। এবার তারা বিষমমেরু হওয়ায় একে অপরকে আকর্ষণ করবে। ফলে ছিটকিনি বাইরে থেকে আটকে যাবে গর্তে।”

গালে হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল সবাই, সবার যে মাথায় ঢুকেছে সেটা দেখে মনে হল না। তাও কেশব শর্মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। পায়েল তার আগেই আবার বলতে শুরু করল, “সকালে যারা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকেছিল তাদের মধ্যে খুনি নিজেও ছিল। প্রথমেই সিলিংয়ে ঝুলন্ত শরীর দেখে আত্মহত্যা নিয়ে একবিন্দু সন্দেহ হয়নি কারও। হওয়ার কথাও নয়। তারা পুলিশের লোক না। তাদের আতঙ্ক আর প্রাইমারি শকটা কাটতে কাটতেই খুনি ছিটকিনিটা দেখার অছিলায় তামার তার আর চুম্বকটা সরিয়ে নেয়। চুম্বক সরানোর জন্যে তাকে ছিটকিনিটা খুলতে হয়। কেননা সেটা ছিটকিনির মুখেই লাগানো ছিল। ভুল করে বা উত্তেজনার বশে সে হ্যান্ডেলটা আংটার ভিতরে ঢোকাতে ভুলে যায়। তাতে অবশ্য পরে সন্দেহ হয় না কারও। মিটার বোর্ড থেকে রিট্রিভার স্প্রিংটা সরিয়ে নিয়ে কোনো এক ফাঁকে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় সে। খেলা শেষ।”

কয়েক মিনিট কারও মুখে কোনো কথা ফোটে না। সমস্ত ব্যাপারটা এখনও অবিশ্বাস্য লাগছে কারও কাছে।

সুনন্দা একটু মুখ তুলে বলে, “তুলির জল তেষ্টা পেয়েছে। কারও কাছে একটা বোতল হবে?”

পায়েল নিজের ব্যাগ থেকে সবুজ বোতল বের করে এগিয়ে দেয়। তারপর বলে, “বাথরুমে যেতে চাইলে ঘুরে আসতে পারো। আমার দ্বিতীয় গল্প এবার শুরু হবে।”

“দ্বিতীয় গল্প মানে? এ ঘটনায় খুনি কে সেটা তো বললেন না।” উত্তেজিত গলায় বলে মুকেশ।

পায়েল এতক্ষণে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার একটু সরে এসে অল্প হেসে উত্তর দেয় সে, “এবাড়ির এক্স-সিকিউরিটি গার্ড, মতীন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *