তার চোখের তারায় – ৪

চতুর্থ অধ্যায়

“কিন্তু তা কী করে হয়?” বিছানার একপ্রান্তে বসে অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সুনন্দা। চার্চ থেকে ফেরার পর থেকেই একটা ছটফটানি খেলা করছে তার শরীরে। তুলিকে এতক্ষণে স্নান করাতে নিয়ে গেছে মালতী। পায়েলের ব্যাগটা বিছানার মাঝখানে পড়ে আছে। সে নিজে বসে আছে মেঝেতে। খাটের পায়াতে হেলান দিয়ে।

প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে পায়েল, তারপর বলে, “আমি জানি না। বাট অল দ্যা ইমপ্লিকেশানস আর দেয়ার।”

“কী করে বলছ তুমি?” পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে আনে পায়েল। ফেরার সময় সেই পেন্টিংটার একটা ছবি তুলে এনেছে সে। সেটা এগিয়ে দেয় সুনন্দার দিকে, “ভালো করে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবে।”

আগেই ছবিটা ভালো করে দেখেছে সুনন্দা। কিন্তু আলাদা করে কিছু চোখে পড়েনি। ছবির একমাত্র আশ্চর্যের ব্যাপার হল মহিলাকে অবিকল পায়েলের মতো দেখতে। তাও আর একবার চোখ বুলিয়ে ঘাড় নাড়ে সুনন্দা, “নাঃ, আমি তো কিছু পাচ্ছি না।”

মেঝে থেকে উঠে এসে তার পাশে বসে পায়েল। তারপর ছবির একটা বিশেষ জায়গায় পিঞ্চ করে জুম করে।

যে টেবিলটার উপরে হাত দিয়ে বসে আছে মহিলা সেই টেবিলের সার্ফেসের ঠিক নিচেই একটা ড্রয়ার রাখা আছে। এতক্ষণে সুনন্দার চোখে পড়ল সেই ড্রয়ারের ডালার ঠিক উপরে ছোট করে কিছু নম্বর লেখা আছে! সেই সঙ্গে একটা চিহ্ন। চিহ্নটা চিনতে পারল সুনন্দা। এলিজাবেথ মসত্রুপের সমাধির উপরে ঠিক এই চিহ্নটাই ছিল। বড়সড় চেহারার একটা পদ্মফুল

“কিন্তু তার মানেই এটা ওই মেয়েটা…”

“নম্বরগুলো চিনলে না?”

“নম্বর…” চিহ্ন ছেড়ে এবার নম্বরের দিকে চোখ রাখে সুনন্দা। ভালো করে তাকাতেই সেগুলো চিনতে পারে সে। হ্যাঁ, শুধু মাঝে একটা দাগ নেই বলে এতক্ষণ চোখ এড়িয়ে গেছিল। ১৭৯৯১৮০৪। এলিজাবেথ মসক্রপের জীবনকাল ১৭৯৯-১৮০৪।

“কিন্তু এতেও তো পরিষ্কার হয় না কিছু। কেউ লিখে দিতেই পারে।”

এবার ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ে পায়েল। ঘরের ভিতর পায়চারি করতে করতে বলে, “আমারই ভুল। মসোলিয়ামের সামনে একটা ব্যাপার গুলিয়ে ফেলেছিলাম।”

“কী ব্যাপার?”

“প্রাচীন বাইবেলের রীতি অনুযায়ী পদ্মফুল মহাকাশের চিহ্ন বটে। কিন্তু সব ধরনের পদ্ম নয়।”

“তাহলে কীরকম পদ্ম?”

“পদ্মের পাপড়ি যদি বন্ধ থাকে তাহলে বোঝায় শক্তি। খোলা ফুলে যদি আটটা পাপড়ি দেখা যায় তাহলে মহাকাশ। বৌধ্য রীতি অনুযায়ী পদ্ম হল পবিত্রতা। মানুষের আদর্শ জীবনের মতো। তার পা ডুবে থাকবে পাঁকে, কিন্তু মন থাকবে নির্মল। আর পদ্মের যদি তিনটে পাপড়ি দেখা যায় তাহলে তার মানে হল…”

“কী?”

“রেসারেকশান কিংবা পুনর্জন্ম। “

“ধ্যাত্।” সুনন্দার মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির আওয়াজ বেরিয়ে আসে, “অন্য সব কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া যায় কিন্তু এই পুনর্জন্ম একটু বাড়াবাড়ি।”

“তুমি শান্তি দেবীর কথা শুনেছ?”

“সেটা কে?”

“নব্বই বছর আগের একটা ঘটনা, বলা যায় একটা মানুষ। তিনি কে রিসারেক্টেড ছিলেন সেটার অকাট্য প্রমাণ আছে।”

“কীরকম?”

বিছানার উপরে পিঠ এলিয়ে শুয়ে পড়ে পায়েল। তারপর একটা বড়সড় শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে–“শান্তি দেবী জন্মেছিলেন উনিশশো ছাব্বিশ নাগাদ। দিল্লীর এক গ্রামে। তো মেয়ের যখন চার বছর বয়স তখন সে এক অদ্ভুত দাবি করে বসল তার আসল বাড়ি নাকি মথুরায়। সেখানে তার ঘরদোর সংসার এমনকি স্বামীও আছে।

দিল্লি থেকে মথুরার দূরত্ব প্রায় দেড়শ কিলোমিটার এবং চার বছর বয়সে শান্তি দেবী দিল্লি ছেড়ে কোথাও যাননি। যাই হোক, ওইটুকু বয়সের বাচ্চা মেয়ে এমন নানা দাবিই করে থাকে। ফলে মা বাবা অতটা গুরুত্ব দেননি।

আসল গোলমালটা শুরু হল একটা ঘটনা থেকে। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শান্তিদেবীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষমেশ পুলিশ যখন তার খোঁজ পেল তখন সে সবে মথুরা যাবে বলে ট্রেন ধরছে।

সে যাত্রা বকাবকি করে বাড়ি নিয়ে আসা গেল কিন্তু মেয়েকে কিছুতেই আটকানো যায় না, সে ক্রমাগত বলে চলেছে তার স্বামীর নাম কেশবনাথ এবং একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেবার মাত্র দশদিন পরে নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল। বাড়িতে মা বাবা পাত্তা না দিতে স্কুলে গিয়েও এইসব বলাবলি শুরু করল। এমনকি মথুরার ভাষায় সে কথা অবধি বলতে পারত।

শেষ পর্যন্ত স্কুলের হেডস্যারের নজরে পড়ে ব্যাপারটা এবং তিনি নিজে মথুরাতে চিঠি লিখে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন সেখানে সত্যি কেশবনাথ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন। ন’বছর আগে তার স্ত্রী লুগড়ি দেবী সন্তান জন্ম দেবার দশদিন পরে মারা গেছেন।

চিঠির জবাব পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কেশবনাথকে দিল্লি আসতে বলেন। ইচ্ছা করে শান্তিদেবীকে বলা হয় যে কেশবনাথ নিজে পারেননি বলে ভাইকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা শান্তিদেবী কেশবনাথকে চিনে ফেলেন।

এরপর তাকে মথুরা নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরিবারের বাকি সদস্যদেরও মুখ দেখে নাম বলে দেন শান্তিদেবী, এমনকি স্বর্গগত ঠাকুমা পর্যন্ত। লুগড়ি দেবী মৃত্যুর আগে স্বামীকে দিয়ে বেশ কিছু প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন। সেগুলো কেশবনাথ পালন করেননি বলে তাকে ধমক পর্যন্ত দেন। অথচ সেগুলো কারো জানার কথাই নয়।

সেযুগে ব্যাপারটা ভাইরাল হয়। এমন কি মহাত্মা গান্ধী এই ঘটনার তদন্তের জন্যে কমিশন তৈরি করে দেন। তবে বুঝতেই পারছ ভারতের রাজনীতিতে তখন টালমাটাল সময়। ফলে এই তদন্ত আর বেশিদূর এগোয়নি।

শান্তিদেবী মারা যান উনিশশো সাতাশিতে। একষট্টি বছরের জীবনে তিনি বিয়ে করেননি। এর মধ্যে আরও বেশ কয়েকবার কমিশন বসে, জিজ্ঞাসাবাদ হয় কিন্তু এ রহস্য অন্ধকারেই ঢেকে থাকে।”

“অবাক কাণ্ড তো।” বিস্ময়ে এতক্ষণের প্রসঙ্গটা কিছুক্ষণের জন্যে মুছে গেল সুনন্দার মাথা থেকে।

“পুনর্জন্ম সত্যি না মিথ সেটা পরের কথা, কিন্তু আমার মনে হয় না আর্টিস্ট এখানে পুনর্জন্ম বোঝাতে চেয়েছেন।”

“কেন?”

“ছবিটা জমিদার পরিবারকে উপহার হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল। তখনকার দিনে পুনর্জন্ম কোনো লজ্জার কথা ছিল না। ফলে সে কথাটা ছবির মধ্যে কৌশলে লুকিয়ে রাখার দরকার ছিল না। আর্টিস্ট পরবর্তী প্রজন্মকে কিছু একটা বলতে চেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সেটা গোপন কিছু। গসিপ না।

“মানে বলছ ওটা মেটাফোর? কিন্তু পুনর্জন্ম মানে আর কী হতে পারে?“

“সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।” পায়চারি থামিয়ে বলল পায়েল। চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে মুখে। বিছানায় পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিয়ে কিছু একটা বের করতে গিয়েও থেমে গেল। একটা লাজুক হাসি হেসে বলল, “বলছি, একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না?”

“খাও। শুধু তুলি থাকলে খেও না। ওর হাঁপানি আছে।”

ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরালো পায়েল। তারপর আবার মাটিতে বসে পড়ে বলল, “সব ব্যাপারটা কেমন যেন গুলিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মাথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার।”

মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে আবার কি যেন দেখতে দেখতে সুনন্দা বলল, “তোমার কথা ঠিক ধরলেও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।”

“একটা ব্যাপার! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, বল কি ব্যাপার?”

“এলিজাবেথ মসত্রুপকে আমরা কল্পনা করেছিলাম যেরকম, এই মহিলা মোটেই তার ধারে কাছে না। গায়ের রং ফর্সা বলা যায় কিন্তু সাহেব তো নয় বোঝাই যাচ্ছে… আর?”

“আর কী?”

“যদি ধরেই নি ইনিই সেই এলিজাবেথ। তাহলে ওই সমাধির ভিতরে কে শুয়ে আছে?”

“সেটা বোঝার একটাই উপায় আছে।” ধোঁয়ার একটা বড়সড় রিং ছেড়ে বলল পায়েল।

“কী উপায়?”

“ওই মসোলিয়ামের ভিতরটা একবার খুলে দেখা।”

“পাগল? এমনিতেই ফাদার দেখে ফেলে কী ভাবছেন কে জানে?”

“আচ্ছা তুমি কোনোদিন প্রেয়ার শুনেছ? মানে রবিবার যেটা হয়?”

“না। তবে চার্চে আগেও গেছি।”

“কাল তো রবিবার। চলো ঘুরে আসি।”

“বাবা! তুমি এত ধার্মিক জানতাম না তো।”

“উঁহু, পিয়ানোটা বেশ লেগেছে আমার। ওটা শুনতে ইচ্ছা করছে।”

“চলো তাহলে। আমার তো কাজ নেই। তুলিও বাড়িতে বসে বোর হয়।” পায়েল আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দরজার কাছে মধুবাবুকে চোখে পড়ল। তাড়াহুড়ো করে সিগারেটটা বিছানার নিচে ছুঁড়ে ফেলল পায়েল। তবে বিছানার উপরে সিগারেটের প্যাকেটটার কথা খেয়াল ছিল না তার। সুনন্দা সেটার উপরে একটা বালিশ ছুঁড়ে ফেলে তার উপর আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, “এইতো মধুবাবু, আপনার কথাই হচ্ছিল।”

“আমার কথা।” একটু অবাক হলেন মানুষটা, “আমাকে শশাঙ্ক পাঠাল! ও বাজারে যাচ্ছে আপনাদের কিছু কেনাকাটা আছে কিনা জিজ্ঞেস করল।”

“না না, ওসব না। অন্য কারণে দরকার।”

“বেশ। একটু দাঁড়ান।” কথাটা বলে বারান্দায় গিয়ে দূরের দিকে হাত দেখিয়ে কি যেন বলে দিলেন মধুবাবু। তারপর আবার ফিরে এসে দরজার কাছেই মেঝের উপরে বসে পড়লেন। সুনন্দা এতক্ষণে সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রেখেছে। সেও বিছানা থেকে মেঝের উপরে নেমে এল।

“এবার বলুন কী বলবেন।” দেওয়ালে পিঠ রেখে বললেন মধুবাবু। “শশাঙ্কদা বলছিলেন এ বাড়ির ইতিহাস নাকি অনেকটা জানেন আপনি সেটাই জানতে ইচ্ছে করছে আর কি।”

“ইতিহাস বলতে ওই যতটুকু এদের মুখে শুনেছি আর কি। আমার আসলে কলেজে হিস্ট্রিটা সাবজেক্ট ছিল, তাই…” হাতদুটো পায়ের উপরে রাখলেন মধুবাবু। পরনে এখনও সেই একই ইউনিফর্ম। ছিটের প্যান্ট আর হাফ শার্ট।

“সেটুকুই বল না।” পায়েল বলে উঠল।

“বাবা!” একটু অবাক হলেন মধুবাবু, “তোমার আবার এদিকে আগ্রহ হল কবে থেকে? আগে তো যতবার বলতে গেছি কানই দাওনি।”

“এবার একটু বড় হয়েছি না।”

মধুবাবু হেসে উঠলেন। তারপর হাত দিয়ে পায়ের উপরে আলগা চাপড় মারতে মারতে বললেন, “আমি যা জানি সেটা বলতে পারি কিন্তু তার আগে একটু ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার জমিদারীর ইতিহাস। বেশি না, অল্প।”

দু’জনের কেউ আর কিছু বলল না। তবে মধুবাবু বুঝলেন কারও অসম্মতি নেই। তিনি আর একটু আরাম করে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“বাংলার জমিদার বলতে মোটামুটি দু’রকমের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভের আগের আর পরের। ১৭৬৫ তে দেওয়ানী লাভের পর আগের নবাব আমলের বেশিরভাগ জমিদারী নিলাম হয়ে যায়। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

এই জমিদাররা কৃষি-অর্থনীতির একটা স্তম্ভ ছিল নবাবী আমলে। তারা লোপ পেতে সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। কোম্পানি প্রথমে পাঁচশালা বদোবস্ত চালু করে। ফলস্বরূপ কৃষকরা ভয়ানক আর্থিক সংকটে পড়ে।

উপায় নেই দেখে লর্ড কর্নওয়ালিস পাঁচশালার বদলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আগের নিলাম হওয়া কিছু জমিদারী এবং ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করে পাওয়া কিছু জায়গা জিরে জমা করে করে নতুন কিছু বাঙালী ধনী  া কের উদ্ভব হয়। এদের উপর কোম্পানি ভার দেয় খাজনা আদায়ের। এদেরকে বলা হত গাতিদার। বলা বাহুল্য খাজনায় কারচুপি, চাষিদের শোষণ আর কোম্পানির প্যায়দারি করে এরা ফুলে ফেঁপে উঠে নব্য জমিদারে পরিণত হয়।

এইসব নব্য জমিদার আর কোম্পানির অসহ্য অত্যাচার ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ১৭৭০ নাগাদ বাংলায় মন্বন্তর দেখা দেয়।

দত্তদের ঠিক কোন্ পূর্বপুরুষ কোথাকার নিলামে এই জমিদারবাড়ি কিনেছিলেন তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে এটুকু ধারণা করা যায় কিনেছিলেন ওই ১৭৭০/১৭৭২ নাগাদ। তর্কের খাতিরে ধরে নাও সেই গাতিদারের নাম অজ্ঞাত দত্ত। এবং তার মেজো ছেলে হল আমাদের এই ভূপতি দত্ত।

“মেজোছেলে বলতে? তার আরও ভাইবোন ছিল?”

“আমি যতদূর শুনেছি ভূপতি দত্তরা মোট চার ভাইবোন ছিল। তাদের মধ্যে তিনজনের নাম জানা যায়। বড়জনের নাম জান। না যাওয়ার কারণ তিনি অতি অল্পবয়সে মারা যান। আমার ধারণা কুড়ির আগে।”

‘কীভাবে মারা যান?” গল্প শুনতে শুনতে প্রশ্ন করে পায়েল।

“শোনা যায় তিনি নাকি কোম্পানিকে কর দিতে অস্বীকার করেন। সরাসরি সংঘর্ষেও নাকি গেছিলেন। ফলে পরিবারের কেউই তাকে সরিয়ে দেয়

“সেকি! কেন?”

“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এক ভাই রাগালে গোটা গাতিদারিই হাতছাড়া হতে পারে। অগত্যা…”

“সাংঘাতিক।” বিড়বিড় করে বলে সুনন্দা।

“ফলে তার কোনো কীর্তিকাহিনির কথা বংশের ইতিহাসে লেখা নেই। ইতিহাসের এই এক লেখা। যারা তাবেদারি করল তাদের নাম জিইয়ে রেখেছে এতকাল।”

যাক গে, বড় ভাই মারা যাবার পর ভূপতি ছিল নেক্সট টু কিন। ফলে তারপর সে-ই জমিদারীর দায়িত্ব পায়, বিয়ে করে। বিয়ের অল্প কিছুদিনের পরে স্ত্রী মারা যায়। তার কিছুদিন পরে আবার বিয়ে করেন ভূপতি। ভূপতির ছেলেপিলের কথায় পরে আসছি।

এর পরের ভাই হল নৃপতিপ্রসাদ দত্ত। এনার কোনো ছেলেপুলে হয়নি। একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। সে ছেলের নামটি ছিল খাসা— চাণক্য। জমিদারবাড়ির সেই সময়ের দেওয়ান ছিলেন দিনু রায় বলে জনৈক ব্যক্তি। চাণক্যের সঙ্গে দেওয়ান দিনু রায়ের মেয়ের প্রেম হয়। সে প্রেম পরিণতি পায় কিনা জানি না। কিন্তু মেয়েটিকে একদিন সকালে দীঘির ধারে মৃত এবং সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায়। কে বা কারা এ কাজটি করে তা আর জানা যায় না। এই নিয়ে কিছু জল ঘোলা হয় কিন্তু খুনি ধরা পড়ে না।

এছাড়া আর এক বোন ছিল এদের – সন্ধ্যারানি। যিনি সম্পর্কে আমাদের পায়েল রায়চৌধুরীর ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমার মা, হেঁহেঁ… তার বিয়ে কার সঙ্গে হয়েছিল আমি জানতাম কিন্তু এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না।

ভূপতির দ্বিতীয় পক্ষের একটি ছেলে হয়। কন্দৰ্প দত্ত। এই কন্দৰ্প দত্তকে নিয়ে একটা বড়সড় গণ্ডগোল আছে।”

‘কীরকম গণ্ডগোল?”

একটু ইতস্তত করেন মধুবাবু। খানিক চুপ করে থেকে বলেন, “এ কথাটা যে আমি বলেছি সেটা বাইরে কাউকে বলবেন না। বাকি কথাগুলো বলতেই পারেন। কিন্তু এটা না।”

“বেশ, আমরা মুখে কুলুপ আঁটছি।”

দেওয়াল থেকে পিঠ তুলে বাকি কথাগুলো বলতে শুরু করলেন মধুবাবু, “লোকে বলে ছেলেটি নাকি প্রকৃতিস্থ ছিল না। মানে জন্মের সময় থেকেই কিছু একটা গোলমাল ছিল তার মাথায়। তখন এখানের চারিদিকে জঙ্গল। বেশিরভাগ সময় নাকি সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কখনও পুকুর ধারে গিয়ে চুপ করে বসে থাকত। জমিদার বাড়ির ছেলের এইসব আচরণ মোটেই সাধারণ ব্যাপার ছিল না।

ঠিক এইসময়ে একদিন বাড়িতে ডাকাত পড়ে। মাঝরাতে আচমকাই দা, কাটারি, খড়গ নিয়ে জনা বিশেক লোক সদর দরজা খুলে ঢুকে পড়ে। ভূপতি দত্তের জমিদারীর ঠাঁটবাট তখনও ছিল। ঠাকুর দালানে একপাল লেঠেলের দল তখন ঘুমাচ্ছিল। তাদেরকে ঘুমের মধ্যেই কুপিয়ে খুন করে ডাকাতরা। প্রাসাদে লুটপাট করে তারা উত্তরের অন্দরমহলের দিকে ছুটে যায়। কন্দৰ্প রাতের দিকটা দীঘির ধারেই ঘোরাফেরা করত। তাকে দেখতে পেয়ে ডাকাতরা তার দিকেই ছুটে যায়। ভূপতি তখন জানেন মৃত্যু আসন্ন। ইস্টদেবতার নাম জপ করতে থাকেন তিনি। বাড়িময় কান্নার রোল পড়ে যায়। সেই সব ছাপিয়ে শোনা যায় ডাকাতদলের উল্লাস। কিন্তু সেখানেই শেষ…”

কথা বলতে বলতে থেমে যান মধুবাবু। গলা শুকিয়ে গেছে তার। সুনন্দা অধৈর্য হয়ে বলে, “শেষ মানে? তারপর কী হল?”

“তারপর কী হল সেটা বলা ভারি মুশকিল। তবে ডাকাতদের চিৎকার আচমকা থেমে যেতে বাড়ির লোকজন ছুটে এসে দেখেন ডাকাতরা গায়েবু এবং দীঘির একপাশে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে কন্দৰ্প। সঙ্গে সঙ্গে দীঘিতে লোক নেমে তাদের বেশিরভাগের মৃতদেহ উদ্ধার করে। দু-একজনের তখনও হুঁশ ছিল।

“ডাকাতদের ঠিক কী হয়েছিল তা জানা যায় না। কন্দৰ্প তেমন শক্তিধর নয় যে কুড়িজন মানুষকে একাই ঘায়েল করে ফেলবে। ডাকাতদের মধ্যে একজন নাকি পরদিন সকাল অবধি কোনোরকমে টিকে ছিল। সে বারবার একটি নারীমূর্তির কথা বলছিল।”

“নারীমূর্তি!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। তেমনই শুনেছি। তার মাথা থেকে পা অবধি নাকি অন্ধকারে ঢেকেছিল। মাথায় ঘোমটার মতো কুয়াশার কাপড়। তার মুখের দিকে তাকালে শুধু চোখের তারা দুটো দেখা যায়। অন্ধকারের মধ্যে দুটো উজ্জ্বল জ্বলন্ত চোখ। সেই সাথে নাকি বাঁশির আওয়াজ শুনেছিল কেউ কেউ। তবে ডাকাতরা নেশা-ভাঙ করত। খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত না। মরার আগে অস্পষ্ট জবানবন্দী, তার উপরে সেটা আবার দু’শো বছরেরও বেশি লোকমুখে ঘুরেছে। ফলে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো মানে নেই।”

“মাথায় কুয়াশার ঘোমটা ব্যাপারটা সম্ভবত হ্যালুসিনেশান”, পায়েল বলে, “বাকিটা মেনে নিতে আপত্তি নেই। অনেক লোকেই নাকি মরার আগে মৃত্যুকে দেখতে পায়। এও অনেকটা সেরকম… মেটাফরিকাল ইভিল…”

“না পায়েল” ঘাড় নাড়ে সুনন্দা। “মাথায় কুয়াশার ঘোমটার ব্যাপারটা শয়তানের চিহ্ন নয়, বরঞ্চ উলটোটা। যিশুখৃস্টের মাথায় কাঁটার মুকুট ছিল। হিন্দু মিথোলজি অনুযায়ী সমস্ত দেবতার মাথার চারপাশেই একটা বলয় থাকে। সেই বলয়টাই আসলে তার মহত্ব বা শক্তি নির্দেশ করে। গঙ্গার কথা জানো তুমি?”

পায়েল ঘাড় নাড়ে, মধুবাবু হেসে বলেন, “ও আর জানবে কী করে। ঠাকুমা-দিদিমা না থাকলে ওসব গল্প বলবে কে?”

সুনন্দা বলে, “গঙ্গানদী আগে মর্ত্যে নয়, স্বর্গে বইত। ব্রহ্মা সেখানে বন্দি করে রেখেছিলেন তাকে। শেষে একদিন তিনি গঙ্গাকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। আকাশ বেয়ে এঁকে বেঁকে গঙ্গানদী সাপের মতো নেমে আসতে লাগল পৃথিবীর দিকে। কিন্তু মুশকিল হল সে নদীর তেজ তখন এত বেশি যে সে পৃথিবীতে যেই মুহূর্তে আছড়ে পড়বে তখনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই সংকট থেকে পৃথিবীকে বাঁচান শিব। তিনি গোটা গঙ্গানদীটাকে তার জটায় ধারণ করেন। তারপর জটার একটা গিঁট খুলে দেন আর সেখান থেকে সরু শান্তধারায় গঙ্গা নেমে আসে। অর্থাৎ গঙ্গার সমস্ত শক্তি জমা থাকে শিবের জটায়… তেমনই আমাদের এই নারীমূর্তির শক্তিও কুয়াশার মতোই তাকে ঘিরে থাকত। “

“আর সেই শক্তিতেই কুড়িজনের ডাকাত দলকে ডুবিয়ে মারে সে?” সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে পায়েল।

“এছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যাও তো নেই।” সুনন্দা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল।

“আরও একটা জিনিসের ব্যাখ্যা নেই।” পায়েলের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মধুবাবু হাসলেন। কিছু একটা কথা এক্ষুনি বলতে যাচ্ছিলেন তিনি পায়েল ধরে ফেলায় থেমে গেলেন।

“ডাকাতরা চোর নয় যে চুপিচুপি লুট করতে আসবে। কেউ কেউ আগে থেকে জানিয়ে আসত। আসার আগে চিৎকার করে বাড়ির লোককে জাগিয়ে দিত। মারপিট হত। সেদিন লেঠেলদেরকে খুন করে ওরা। তাও ঘুমের মধ্যে। পাশের লোক খুন হলেই আরেক জনের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ লেঠেলদের আগে থেকেই বেহুঁশ করে রাখা হয়েছিল। ইট ওয়াস এন ইনসাইড জব। আর মোডাস অপারেন্ডি দেখে এদের ডাকাত নয়, এসাসিনেটার মনে হয়।”

“ইয়েস। গুপ্তঘাতক।” পায়ের উপরে জোরে থাবড়া মারলেন মধুবাবু, “আর ইনসাইড জবটি কে করেছিলেন বলতে পারবে?”

এক মুহূর্ত সময় নেয় পায়েল, পরক্ষণেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, “নায়েব দিনু রায়।”

“পারফেক্ট। তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিলেন চাণক্য দত্তের জীবন থেকে তার মেয়েকে সরাতে তাকে জমিদারবাড়ির কেউই খুন করেছে। ফলে প্রতিশোধ নেবার জন্যেই গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা জানাজানি হবার পরেই দিনু রায় পালিয়ে যান। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

একবার আড়মোড়া ভাঙলেন মধুবাবু। বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমারও একবার কলকাতা গেলে হত। এখানের কাজে আটকে গেলাম।” কথাটা বলে কি মনে পড়তে বললেন, “ওঃ, ওদিকের বাকিদের সঙ্গে আপনার আলাপই করানো হয়নি। আসুন না একবার।”

সুনন্দার মুখে এতক্ষণের ছায়াটা মুছে গেল, “হ্যাঁ, স্নান করে যাচ্ছি সবাই মিলে।”

“বেশ, আমিও তবে উঠি।”

মাটি থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন মধুবাবু। তাকে পিছন থেকে একবার ডেকে উঠল পায়েল, “আচ্ছা শুনুন না।”

“হ্যাঁ বলুন।” ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মধুবাবু।

“মসক্রপ নামের সঙ্গে এ বংশের কোনো সম্পর্ক আছে?”

মধুবাবুর ভুরু দু’টো কুঁচকে এল। কি যেন ভেবে তিনি বললেন, “জমিদারী আমলে এ বাড়িতে সাহেবদের যাওয়া আসা ছিল সে তো জানা কথা। কিন্তু ও নাম তো শুনিনি। কেন বল তো?”

“না এমনি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নামিয়ে নিল পায়েল। মধুবাবু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।

“মসক্রপকে নিয়ে খুব ভাবনায় পড়েছ দেখছি।” হাসিমুখে কথাটা বলে সুনন্দা। তারপর মেঝে থেকে উঠে ঘরের জানালার গিয়ে দাঁড়ায়।

“কিছুতেই হিসেব মিলছে না, বুঝলে? কোথায় যেন গিয়ে সব ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছে। ধরে নিলাম আশেপাশের কোনো সাহেব কলোনিতে পাঁচ বছরের মেয়ে এলিজাবেথ মসক্রপ মারা গেল। তাকে কবর দেওয়া হল সমাধিতে। তার বহুবছর পরে লীলাবতী দেবীকে ছবি উপহার দিল চার্চ। কিন্তু ছবির মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্মের কথা বোঝাতে চাইল কেউ। কে?… আচ্ছা… একটা কথা এতক্ষণ ভেবে দেখিনি জানো?”

“কী কথা?”

“সেকালের আর্টিস্টরা সাধারণত মডেলকে দেখে ছবি আঁকত। ধর পুনর্জন্মের কথা যে লোকটা জানত সে কোনোভাবে জানতে পারে যে লীলাবতীর ছবি আঁকা হবে এবং কোনো একটা নির্দিষ্ট টেবিলের উপরে হাত রেখে বিশেষ একটা পোজে ছবি আঁকাবেন। তিনি কোনো এক ফাঁকে আগে থাকতে টেবিলের উপরে এই চিহ্নগুলো এঁকে দেন। আর্টিস্ট ছবি আঁকার সময় প্রায় সবকিছুর সঙ্গে টেবিলের লেখাগুলোকেও কপি করেন। কপি নাও করতে পারতেন। সেটুকু চান্স নিতেই হত লোকটাকে। ছবি আঁকার পর তিনি দেখলেন ছবিতে সংখ্যা আর সংকেতগুলো রয়েছে। ব্যস… কাজ শেষ…” গালে হাত দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল সুনন্দার। এই সম্ভাবনাটার কথা এতক্ষণ সে নিজেও ভেবে দেখেনি।

“এবং সেটা যদি হয় তাহলে সে টেবিল এখনও এ বাড়িতে থাকতে পারে।”

“না থাকার সম্ভবনাই বেশি।”

“তা ঠিক। তবে সেটা পেলে আশা করি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাব।”

“কী করে?”

“টেবিলের সংকেতগুলো ড্রয়ারের উপরে আঁকা হয়েছিল। হয়তো ড্রয়ারের ভিতরে রাখা ছিল কিছু। নাহলে খামোখা পুনর্জন্মের সংকেত এঁকে তো কোনো লাভ দেখতে পাচ্ছি না।”

“আগে টেবিলটা তো পাও তারপর তার ড্রয়ার।”

সুটকেস থেকে জামাকাপড় বের করছিল সুনন্দা। মালতী তুলিকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে গলায় পাউডার মাখতে লাগল তুলি। সুনন্দা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পায়েল মালতীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা এ বাড়ির পুরনো ফার্নিচার কী হল বলতো?”

মালতী তুলির চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “কিছু একতলার দালানে পড়ে আছে। আর কিছু ওদিকের ঘরে রেখেছে।”

“দালানে টেবিল টাইপের আছে কিছু? বেশ বড়সড়, কালো রঙের?” একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল মালতীর মুখে, “থাকলেও সে আর এদ্দিনে ব্যাবহার করা যাবে না। ভেজে বারোমাস। কাঠ পচে ঝুরো হয়ে গেছে।”

“হুম।”

মাটি থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল পায়েল। আকাশটা এতক্ষণে একটু কালো করে এসেছে। বিকেলের দিকে হয়তো কালবৈশাখী আসবে। আর একটা সিগারেট ধরাল সে। এখানে আসার এই একটা সুবিধে। ইচ্ছেমতো সিগারেট খাওয়া যায়।

বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের দিকটা পরিষ্কার চোখে পরে। সেখানে স্তুপ করে ফেলা আছে পুরনো কাঠের জিনিসপত্র। দেখতে দেখতে একটু আগের সেই সিমেন্টের ভিতর থেকে আসা আওয়াজটার কথা মনে পড়ল তার। সত্যি কি কারও গলার আওয়াজ ছিল সেটা? নাকি উত্তেজনার বসে হাওয়ার শব্দকেই মানুষের গলা বলে ভুল করেছিল?

আরও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর নেই। কে সেই আপাদমস্তক ঢাকা নারীমূর্তি? এলিজাবেথ মসগ্রুপের কফিনে কে শুয়ে আছে? কে সেকথা জানতে পারল? কাকে জানাতে চাইল? শশিভূষণ সরকারকে কে খুন করল? করলই বা কীভাবে?

সমস্ত ব্যাপারটা একটা অসম্ভব কঠিন ধাঁধার মতো। পায়েলের মন বলল, এই সব ঘটনার পিছনে একটা সুতো আছে। একটাই সুতো। সেই সুতো ধরে হাঁটতে থাকলে একটাই জায়গায় পৌঁছানো যাবে।

সেই সুতোটাকেই নিজের বুকে আগলে রেখেছে ইতিহাস। কিছুতেই দেখাতে চাইছে না। হয়তো একটা ঘটনা, অথবা একটা চরিত্র। তাকে আবিস্কার করতে পারলেই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে সব কিছু।

বারান্দা ধরে বাকি ঘরগুলোর সামনে ঘুরতে লাগল পায়েল। পুরনো কাঠের দরজাগুলোর বহু জায়গা উইতে ফোঁপরা করে দিয়েছে। দু’শো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই দরজাগুলো। কত মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সময়ের বিবরণ লেখা আছে এদের খাতায়।

একটা দরজার ফাঁকে চোখ রাখল পায়েল। পুরনো আলনা চোখে পড়ল। আলনার পিছনেই জানালা। সে জানালা এখন বন্ধ। দরজার ফাঁকে মুখ রেখে নিজের নাম ধরে ডাকল সে

“পায়েল…”

কয়েকবার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। তারপর মিলিয়ে গেল নামটা। মনে মনে একটু হেসে পাশের দরজায় সরে এল। আবার দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। আগের ঘরটার সঙ্গে এটার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু আলনাটা নেই এখানে।

পাশের আরেকটা দরজায় চোখ রাখতে গিয়ে একটু থমকে গেল পায়েল। এ দরজাটা সে চেনে। বছর চারেক আগেই এ ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন এক গেস্ট। তার বডিটা ঝুলছিল সিলিঙ থেকে।

মালতী এতক্ষণে পায়েলের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ঘরটা সে এড়িয়েই চলে। এখন পায়েলকে ভিতরে চোখ রাখতে দেখে তার বুকটা কেঁপে উঠল।

“কী করছ গো দিদি, কোনো মানে হয়?”

দরজার উপর দুটো হাত রেখে পাল্লার ফাঁকে চোখ রাখল পায়েল। প্রথমেই চোখ গেল উপরের দিকে। সিলিঙটা ফাঁকা

নিচে তাকাতেই এক ঝটকায় পায়েলের পা কেঁপে গেল।

এ ঘরের জানালার সামনেও আলনা নেই। তার বদলে আছে একটা সেগুন কাঠের বড় টেবিল। এ টেবিলটা পায়েল চেনে।

মুহূর্তে পিছন ফিরে মালতীর দিকে তাকাল সে। একটু থমকে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী। পায়েল গলার উত্তেজনাটা চেপে রেখে বলল, “এ ঘরের চাবি কার কাছে থাকে?”

“মধুদা।”

“একটু নিয়ে এসো তো, তাড়াতাড়ি।”

মিনিট দশেক পরে চাবি নিয়ে ফিরে এল মালতী। পায়েল এতক্ষণ ছটফট করছিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। এক ঝটকায় চাবিটা নিয়েই সে খুলে ফেলল তালাটা।

কোনোদিকে না তাকিয়ে গিয়ে দাঁড়াল টেবিলটার সামনে। তার হাবভাবে অবাক হয়ে গেল মালতী। সেও ঝুঁকে পড়ল।

চিনতে ভুল হয়নি পায়েলের। ড্রয়ারের উপরে সেই চেনা সংখ্যাগুলো। হাতের মোবাইলটার ছবিটা খুলে মিলিয়ে নিল। এই সেই টেবিল। কোনো ভুল নেই।

পায়েলের হাত কাঁপছিল। একবার ড্রয়ারটা ধরে জোরে টান দিল সে। ড্রয়ার খুলল না। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে আটকে গেছে।

“ছাড়, আমি দেখছি।” পায়েলকে সরিয়ে মালতী এবার হাতলটা ধরে টান দিল। ভারি কাঠের ভিতর থেকে একটা যন্ত্রণাময় শব্দ বেরিয়ে এল। সময় সহজে তার রহস্য খুলতে দিতে চায় না।

একটা হাত ড্রয়ারের পাশে রেখে আবার টান দিল মালতী। এবার একটু খানি ফাঁক হল সেটা। আধ ইঞ্চি সেই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরের খানিকটা অন্ধকার চোখে পড়ল।

“ড্রয়ারের উপরের দিকে শক্ত কিছু একটা আটকে আছে। তাই খোলা যাচ্ছে না।” হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের মনেই বলে পায়েল।

“কী আছে গো ভিতরে?” তার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মালতী।

“একটা রহস্যের চাবি।”

কথাটা বলে গায়ের সমস্ত জোর একত্র করে টান দিল পায়েল। তীব্র ঘর্ষণের একটা আওয়াজ করে খুলে গেল ড্রয়ারটা। পায়েল আর মালতী দু’জনেই ঝুঁকে পড়ল তার উপরে।

একটা পুরনো জং লাগা আয়না শোয়ানো আছে ড্রয়ারের ভিতরে। হাত দিয়ে তুলে সেটা সরিয়ে ফেলল পায়েল। তারপর আবার তাকাল ড্রয়ারের দিকে।

ড্রয়ার ফাঁকা।

“পেলে কিছু?” মালতী ব্যাগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল।

পায়েলের ঠোঁটের কোণে একটা চেরা হাসি খেলে যায়, “পেয়েছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *