তার চোখের তারায় – ৮

অষ্টম অধ্যায়

“আর দে নাটস? একটা বাচ্চা ছেলে কী করে সুইসাইড করতে পারে? তাও এইভাবে।”

“খুনই বা কীভাবে হতে পারে?”

“তাও সেটার চাইলে একটা এক্সপ্লানেশান দেওয়া যায়। পোস্টমর্টেমে কী ছিল এমন? যা দেখে সুইসাইড বলছে ওরা?”

“তা জানি না। তুমি কাল আসছ তো?”

“ইচ্ছা তো তাই আছে।”

“বেশ, আর এসব নিয়ে বেশি ভেব না। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তুলি শুধু একটু শকে আছে।”

“হ্যাঁ, ওকে একটু সাবধানে রেখো। ও বাড়িতে বাচ্চারাও সেফ নয় দেখছি।”

ফোনটা রেখে দেয় সুনন্দা। নীলাদ্রি নিজেই ফোন করেছিল আজ। তখনই খবরটা জানাতে হল। এ বাড়িতে এতগুলো মৃত্যু হয়েছে পরপর, নীলাদ্রিই আগে বারণ করেছিল নাথদের কাজটা নিতে। জেদটা সুনন্দারই ছিল। কিন্তু তাদের থাকতে থাকতে যে আর একটা মৃত্যু হবে সেটা আগে ভাবতে পারেনি সে।

সকালের নতুন ছাদ। পায়েল একটু দূরে মেঝের উপরে বসে কাল রাতের ডায়েরিটা মন দিয়ে দেখছে। একটু দূরে পায়রার ঘরের সামনে দানা ছড়াচ্ছে তুলি। কাল রাতে এ বাড়ির কারও ভালো ঘুম হয়নি। দেহ সৎকার করা, ঘাটের কাজ ইত্যাদিতেই সময় কেটে গেছে। নিচের ঘরে বাইরে থেকে তালা দিয়ে ছাদে চলে এসেছে সুনন্দা। সকাল থেকে একগাদা জামাকাপড় নিজে হাতে কেচেছে সে। সদ্য চান করে উঠে একটা গামছা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায়। গামলা থেকে কাপড় তুলে নিংড়াতে নিংড়াতে বলল, “আমি শুধু ভাবছি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী লেখা আছে?”

উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, সেটা দেখে তুমি কিছু বুঝবে না? তাই না?”

“আমি ইংলিশের স্টুডেন্ট, বায়োলজির না।” ডায়েরির দিকে মন দিয়েই উত্তর দেয় পায়েল।

“অন্তত এটুকু তো বুঝবে কেন সুইসাইড বলছে?”

এবার সে মুখ একটা একটা পেন থুতনিতে ঠেকিয়ে বলল, “কি জানি কেন বলছে, আমার কি মনে হয়েছিল জানো আগে?”

“কী?”

“কেউ ওকে ড্রাগড করে কাজটা করেছে। সেই জন্যেই স্ট্রাগলের চিহ্ন নেই। কিন্তু সুইসাইড মানে শরীরে মাদকও পাওয়া যায়নি।”

এইবার কাপড়গুলো মেলতে লাগল সুনন্দা, “আমারও ভারি আশ্চর্য লাগছে। ধরে নিলাম কোনো কারণে অতীন ঠিক করল সে সুইসাইড করবে। কিন্তু তার জন্যে সাতসকালে উঠে রান্নাঘরে এসে মাথা ঠুকতে যাবে কেন? কাছে পুকুর আছে, দীঘি আছে। ঝাঁপ দিতে পারত।”

“দড়ি কলসি নিয়ে যাবে বলছ? তাতে লাভ হত না। অতীন সাঁতার জানত।”

“সে তুমি যাই বল। মাথা ঠুকে সুইসাইডটা কেমন যেন লাগছে আমার।”

“শুধু সেটা না, আর একটা জিনিস মিলছে না আমার।”

“কী বলতো?” শেষ কাপড়টা রোদ্রে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা। “হোয়াই রান্নাঘর? এ বাড়িতে ঘরের শেষ নেই। কিছু কিছু ঘর এতদূরে যে লোকজনের শুনতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। তাছাড়া রান্নাঘরে ভর্তি বাসন কোসন। কোনোভাবে একটা খসে গেলেই দূর থেকে সেটা শোনা যাবে। সেটা সুইসাইডের জন্যেও ভালো না, খুনের জন্যেও নয়। এতকিছু থাকতেও রান্নাঘরটাই বেছে নিল কেন?“

পায়েলের পাশে এসে এবার বসে পড়ল সুনন্দা। একবার মুখ তুলে তুলিকে দেখে নিল। তারপর আবার নিচে তাকিয়ে বলল, “আজব কাণ্ড! এ বাড়িতে যেই মারা যাক না কেন, সেগুলো খুন আর আত্মহত্যার মাঝামাঝি ঝুলে থাকছে।”

এবার পেনের ঢাকাটা খুলে নিয়ে নিজের ডায়েরির পিছনের একটা পাতা মেলে ধরল পায়েল। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে কী যেন লিখতে লাগল। স্বগতোক্তির মতো বলল, “আমাদের হাতে রইল তাহলে ছ’টা খুন। এ)- সিক্সটিফোরে সিঁড়ি থেকে পড়ে, বি) – সেভেন্টি সিক্সে জলে ডুবে, সি) – নাইন্টি টুতে কুয়োয় পড়ে, ডি)— দু’ হাজার আটে সিলিং থেকে ঝুলে, ই) – দু’ হাজার আটেই দোকানের সিলিং থেকে ঝুলে, এফ)— দু’ হাজার আঠেরোতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে। সব দশকেই একটা করে খুন, এক্সসেপ্ট এইট্টিস। খুনি কী করছিল তখন? মিস্টার ইন্ডিয়া দেখছিল?

ধরে নিলাম তার নাম— এক্স। এখন প্রশ্ন হল এক্স কি কন্সট্যান্ট নাকি ভেরিয়েবেল? সেও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যাচ্ছে?”

“আমার তো তাই মনে হয়। এত বছর ধরে একটা মানুষের পক্ষে খুন করা সম্ভব না। কেউ তার স্টাইলগুলোকে কপি করে তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।”

“আচ্ছা এই টাইমলাইনে কিছু গ্লিচ চোখে পড়ল তোমার? মানে যেখানে প্যাটার্নটা প্রায় মেলেনি?”

উত্তরটা সুনন্দার ঠোঁটের উপরেই ছিল, “হ্যাঁ, দুটো। ছ’টার মধ্যে পাঁচটা খুন হয়েছে এ বাড়িতে, মানে বাড়ির চৌহদ্দিতে আর কি। একমাত্র শশিভূষণ সরকার মারা গেছেন তার নিজের দোকানে। আর একটা হল দু’ হাজার আটেই দু’টো খুন হয়েছে। এই খুনি সাধারণত এত তাড়াতাড়ি খুন করে না।”

“হুম… এ থেকে দুটো জিনিস বোঝা যায়। এক, কোনো একটা কারণে খুনটা করা ভীষণ দরকারি হয়ে পড়েছিল। দুই, খুনগুলো সে নিতান্তই ইচ্ছা হয় বলে করে না। তার একটা লজিকাল রিসেন আছে। হি ইজ নট আ সাইকোপ্যাথ।”

“শশিভূষণ সরকারকে খুন করার কারণটা স্পষ্ট। জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে লোকটা যদি এখানে এসেই থাকতে শুরু করে তাহলে কিছু একটা জেনে যেতে পারে সে। সেটা খুনির পক্ষে সুবিধের হবে না।”

ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পায়েল উঠে পড়ল মেঝে থেকে। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল ছাদের কিনারায়। তার দিকে এগিয়ে এল তুলি হেসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে পায়েল বলল, “পুলিশরা কী জিজ্ঞেস করছিল রে তোকে?”

ছাদের পাঁচিলের কিনারায় হাত দিয়ে তবলা বাজাতে বাজাতে সে বলল, “জিজ্ঞেস করছিল কাল রাতে কে বিছানা থেকে তুলে এনেছিল?”

“তুই কী বললি?”

“বললাম জানি না।”

পায়েল সুনন্দার দিকে একবার চোখ তুলে বলল, “এখানে একটা ঝামেলা হবে মনে হচ্ছে। মালতীকে জিজ্ঞেস করলে ও তো বলে দেবে। কী বলবে ভেবেছ?”

“ভেবেছি বলব তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে, আমি সঙ্গ দিচ্ছিলাম।”

“মানে! আমার নামে চালাবে?” রাগত স্বরে বলে পায়েল।

“ভেবে দেখ, সিগারেট খাওয়াটা বড় পাপ না কবর ভাঙা? তাছাড়া কথাটা একেবারে মিথ্যেও না।”

“সারারাত সিগারেট খাচ্ছিলাম এটা অতি বড় নেশারুও বিশ্বাস করবে না।”

“সেই সঙ্গে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করছিলে।”

হেসে ফেলে পায়েল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “নেশারু ও চরিত্রহীন বলে বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে আমাকে। তারপর তুমি অ্যাডাপ্ট করো।” এবার সুনন্দাও পাঁচিলের পাশে উঠে আসে। তারপর ডায়েরিটার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওটা কিছু পড়তে পারলে?”

“না।” মাথা নাড়ে পায়েল, “ভাষাটা পড়া যাচ্ছে না।”

সুনন্দা মুখ বেকায়, “ভারি যে বলছিলে ইংলিশের স্টুডেন্ট।”

“আরে!” প্রতিবাদ করে পায়েল, “একবার খুলে তো দেখো। ভাষাটা আদৌ ইংরাজি নয়। অন্তত শুরুর দিকে খানিকটা হলেও দশ বারো পাতা পরে কীসব আজগুবি লিখেছে।”

খাতাটা হাতে নিয়ে সাবধানে পাতা উলটাতে থাকে সুনন্দা। প্রথমে সাদা পাতার উপরে মেয়েটার ডাক নাম লেখা আছে–বেথ।

তারপরের পাতায় পুরো নামটা। সেটা দেখিয়ে পায়েল বলে, “দেখো, পুরানো ইংরাজির স্ক্রিপ্ট। তখন দু’ রকম এস হত। একটা সাধারণ এস আর একটা এফের মতো দেখতে লং এস। কোথায় কোন এস হবে তার ডিফাইণ্ড কিছু নিয়ম ছিল। যেমন একসঙ্গে যদি দুটো এস থাকে তাহলে প্রথমটা লং হবে পরেরটা সর্ট হবে। মসক্রপ বানানটা দেখ, একটা এস এফের মতো দেখতে। তবে যে সময়ে এটা লেখা হয়েছে তখন লং এসের ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। তাও বাবা মা মেয়েকে লং এস শিখিয়েছেন মানে বাবা-মা একটু কনজারভেটিভ বলা যায়।”

“বাবা! আর?” লং এস’টা দেখতে দেখতে বলে সুনন্দা।

“মেয়েটা সম্ভবত বাঁহাতি ছিল।”

“সেটা কী করে বুঝলে?”

“যারা ডান হাতি তারা জেনারেলি স্ট্রোক দেয় বাঁদিক থেকে ডানদিকে। বাঁহাতিরা ডানদিক থেকে বাঁদিকে।”

ভালো করে লেখাগুলো দেখে ব্যাপারটা বুঝল সুনন্দা, বলল, “এখানে বর্ণগুলোর ডানদিকে কালি বেশি মোটা করে পড়েছে বাঁদিকে কম। তাই বলছ বাঁহাতি। বেশ, আর?”

“মেয়েটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। মানে আই এর মাথাগুলো লক্ষ কর। সাধারণত এই বয়সের বাচ্চারা আই এর মাথার পুটকিটা গোল্লা পাকায়। এই মেয়েটা বড়দের মতো ডট দিয়েছে। বর্ণগুলো সামান্য বাঁদিকে হেলানো। যেদিক থেকে লিখছে সেদিকেই যদি বর্ণ হেলে থাকে তার মানে লেখক একটু আত্মকেন্দ্রিক, লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে না। আর একটা ব্যাপার ভারী ইন্টারেস্টিং, জানো? এইখানে দেখ ডিজিট লিখতে শিখছে… ওয়ান টু থ্রি ফোর… কিন্তু গণ্ডগোল বুঝতে পারছ?”

ডায়েরিটা মন দিয়ে দেখে সুনন্দা বলে, “উঁহু… নাতো….

“আমরা বাঙালিরা যখন ইংরাজি ডিজিট লিখতে শিখি তখন আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের শেখায় যে বাংলার সাত-এর মতো করে ইংরাজি নাইন লিখতে। ফলে আমরা নয়ের নিচের আঁকড়াটা বাঁকিয়ে দিই না। সোজা থাকে। নেটিভ ইংলিশ স্পিকিংদের নয় সবসময় নিচের দিক বাঁকানো থাকে। এলিজাবেথ মসক্রপের নাইনগুলো সোজা… এর মানে কী হতে পারে?”

“হতে পারে যে তাকে ডিজিট লেখা শিখিয়েছিল সে ছিল বাঙালি, তাই শিক্ষককে নকল করতে গিয়ে তারও নাইন সোজা হয়ে যায়।”

আবার কিছুক্ষণ পাতাগুলো ওলটাচ্ছিল সুনন্দা। এবার সে থেমে গিয়ে বলল, “বেশিরভাগই ছাড়া ছাড়া শব্দ। যেন নতুন করে শব্দগুলো লিখতে শিখছে। ওয়াটার, বল্‌ এইসব।”

পায়েল কিছু উত্তর দেয় না। সে মন দিয়ে দেখে চলেছে পাতাগুলো। হলদে থেকে তামাটে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা। বেশিরভাগ পাতাই কোণের দিক থেকে ক্ষয়ে গেছে। কোথাও কোথাও লেখা এতই হালকা হয়ে গেছে যে পড়াই যায় না ভালো করে।

দশ-পনেরোটা পাতা ওলটানোর পরে থমকে যায় সুনন্দা। লেখাগুলো আর বর্ণ নয়। বরঞ্চ তার বদলে কিছু দাগ টানা হয়েছে লাইন জুড়ে। কিছু কিছু দাগ একই রকম দেখতে। মনে হয় যেন অন্য কোনো ভাষায় লেখা হয়েছে বাকি ডায়েরিটা। শেষের দিকে কয়েকটা পাতা দেখতেই একটা খটকা লাগে সুনন্দার।

“এই জায়গাটা দেখ। লেখাগুলো আরও ঝকঝকে। যেন অল্প কয়েকদিনে অনেকটা বড় হয়ে গেছে সে।”

অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখেও ভাষাটা চেনা মনে হল না সুনন্দার। সে লেখাগুলোর উপরে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কী লিখেছে বল তো? “

“কী জানি। আমার চেনা লাগছে না।”

“আমারও।”

“অথচ লেখাগুলো উদ্ধার করতে না পারলে আর এক পাও এগোতে পারব না আমরা।”

“এমনভাবে বলছ যেন তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মার্ডারগুলো সল্ভ করার।”

“মার্ডারগুলো নিয়ে আমার অত মাথা ব্যাথা নেই। সেসব পুলিশে সামলাবে। আমি খালি মসক্রপের গল্পটা জানতে চাই।”

আরও কয়েকটা পাতা উলটে আবার থেমে যায় পায়েল, ডায়েরিটা আড় করে ধরে বলে, “এখানে দেখো, কয়েকটা ছবি আঁকা আছে, মানে লিখতে শেখার পরপরই সে ছবি আঁকা শিখেছিল।”

“তাই তো…” ছবিগুলো মন দিয়ে দেখে সুনন্দা। ছাড়া ছাড়া অস্পষ্ট ছবি! ভালো করে দেখলে মনে হয় যেন মাটির উপরে একটা গর্ত। গর্তের ভিতরটা বারবার কালি ঘষে গোল করা। অর্থাৎ অন্ধকার! কখনও আবার বাড়ি, পুকুরপাড়, মানুষজন। একটা গ্রামের ছবি যেন। তবে সব কটা ছবির বিশেষত্ব হল সেগুলো সবই অসম্পূর্ণ। যেন ছবির কয়েকটা জায়গা কেউ ইচ্ছা করেই আঁকেনি। একটা কুঁড়ে ঘরের মাথার উপরে একটা গাছ উঠেছে, কাণ্ড, কিছুটা ডালপালা সবই আছে তার কিন্তু গাছের মাথার দিকে অনেকটা কেউ খাবলে নিয়ে ছবিটা সাদা করে দিয়েছে। পুকুরের মাঝে কিছু কিছু জায়গায় যেন আচমকাই জল নেই। সেখানটা ফাঁকা।

“এরকম আঁকল কেন বলতো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল। “বুঝতে পারছ না? আমি কিন্তু বুঝেছি।” দাঁতের ফাঁকে হাসতে হাসতে বলে সুনন্দা, “কোনো দৃশ্য আমরা দেখার পর থেকেই ভুলে যেতে থাকি? ফলে আঁকতে গেলে কিছু কিছু জায়গায় কি দেখেছি কিছুই মনে পড়ে না? ভাবো…”

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে উত্তর দেয় পায়েল, “স্বপ্ন। হ্যাঁ… কোয়াইট পসিবেল। সেকালের বিশ্বাস অনুযায়ী খারাপ স্বপ্ন লিখে বা এঁকে রাখলে সেটা আর ঘটে না। তাই হয়তো বেথ স্বপ্নগুলো এঁকে রাখত। কিন্তু এই স্বপ্নট। তো প্রায় দু’ পাতা অন্তর আঁকা আছে… মানে কী এটার?”

সুনন্দা লক্ষ করে সত্যি পাতায় পাতায় সেই কালো গর্তের ছবিটা আঁকা রয়েছে। অর্থাৎ বারবার এই একই স্বপ্নটা দেখত মেয়েটা। গর্তের সঙ্গে কি চেনা কিছুর মিল রয়েছে?

“রিকারিং ড্রিম। হয়তো তেমন কোনো মানে নেই। কিন্তু তাও…” কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় পায়েল। এইমাত্র অন্যমনস্কভাবে একটা পাতা উলটেছে সে। নতুন পাতায় আবার সেই গর্তের ছবি কিন্তু এবার একটু বদলেছে সেটা। ভিতরে কালি ঘষে আগের মতোই অন্ধকার করা হয়েছে, কিন্তু এবার তার ভিতরে অন্ধকার ছাড়াও আরও কিছু দেখা যাচ্ছে একটা হাত। গর্তের ভিতর থেকে কেউ হাত বাড়িয়েছে। “স্পুকি” পায়েল নিজের মনেই বলে। ছাদের ধার থেকে তুলিকে নিয়ে একটু সরে আসে সুনন্দা। তারপর ভাবুক গলায় বলে, “হয়তো একটু বেশি ভাবছি বলে, কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে দুটো ঘটনা কোনো জায়গায় গিয়ে একটা আরেকটার সঙ্গে মিলে গেছে।”

“মানে বলছ এ বাড়ির খুন আর মসক্রপ?”

মাথা নাড়ে সুনন্দা। আঁচল দিয়ে তুলির মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, “দুটোর একটা সল্ভ করতে পারলেই আর একটা সল্ভ হয়ে যাবে। কিন্তু ….”

“এ বাড়িতে খুনগুলো হবার সময় যারা বাড়িতে ছিল তারা কেউ ঝেড়ে কাশছে না। অন্তত অন্য কারও মুখে ঘটনাগুলো শোনা গেলেও একটা লাভ হত।”

সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল সুনন্দা। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “সেরকম লোক একজন আছে বটে, এ বাড়ির লোক না। তবে জানে অনেক কিছু আসার দিন আমরা এখানে একটা হোটেলে খেতে গেছিলাম, তার ম্যানেজার। নাম দেখেছিলাম মাধব চৌধুরী।”

“সে এখানকার সম্পর্কে জানল কী করে?” ভিতরের দিকে সরে এসে প্রশ্ন করল পায়েল।

“ছোটবেলায় এ বাড়িতে খেলতে আসত। তখনই ওই ডুবে যাওয়ার ব্যাপটারটা হয়। তারপর থেকে খেলা বন্ধ হয়ে যায়।”

“ব্যাস! একেই দরকার আমার। হোটেলের নাম বল।”

“সে বলছি। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।”

“কীরকম সমস্যা?”

“বাড়িতে একটা এতবড় কাণ্ড ঘটে গেছে। এরপরেও তোমাকে এসব কথা খুলে বলবে কিনা সন্দেহ।”

“আলবাত বলবে। বয়স কীরকম লোকটার?”

“এই বছর পঁয়তাল্লিশেক হবে।”

“মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে, মেয়ে দেখলেই হুড়হুড় করে বলবে। নামটা বলো তুমি।”

*****

মনসা হোটেলের ভিতরে তাকাতেই ম্যানেজারকে চোখে পড়ল। চেহারা দেখে মনে হয় মাঝবয়সের একটু বেশিই গড়িয়ে গেছে। চোখের নিচের চামড়া খুলে পড়েছে। এখন দুপুর বলে ব্যস্ততা একটু বেশি। তবে সেসব কর্মচারীদের। ইনি টাকাপয়সা মিটিয়েই চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিচ্ছেন। রুমালে একবার মুখ মুছে ভিতরে ঢুকে এল পায়েল। তাকে দেখে খানিক দূরের একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন ম্যানেজার। পায়েল তাতে না বসে ম্যানেজারের ঠিক পাশের একটা টেবিলেই বসে পরে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

“আপনাকে কী দেব?” পাশ থেকে এক বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করতে পায়েল খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল। তারপর ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে একবার ঘড়ি দেখে বলল, “আপনারা সারা দুপুর খোলা রাখেন তো?”

“দুপুরেই তো ব্যাবসা।” গম্ভীর মুখে কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ম্যানেজার।

“আসলে আমার বিকেলের দিকে আসতে হবে আবার। আপনাদের এদিকে খাবারের দোকান তো খুব একটা দেখছি না।”

“হ্যাঁ, রেস্তোরাঁ বলতে এই আমরাই। বাদবাকি যা আছে তা তো মুখে দেওয়ার যোগ্য নয়। আসুন না যখন হোক, রাত অবধি খোলাই আছে। বললে বাড়ি গিয়ে দিয়েও আসবে। কুড়ি টাকা এক্সট্রা লাগবে তাতে।”

“না না, আসলে আমি ওই জমিদারবাড়িতে একটা কাজে এসেছিলাম। বিকেল অবধি স্টে করতে হবে। খেতেও বলেছিল। কিন্তু বুঝতেই পারছেন একটা ট্র্যাডেজি হয়ে গেছে।”

বিমর্ষ মাথা নাড়লেন ম্যানেজার। আর কিছু বললেন না। পায়েল এতক্ষণে বুঝেছে কাজটা খুব একটা সহজ নয়। লোকটা মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে না মনে হয়। ভারী ভালো মানুষ। কিন্তু পায়েলের একটু অসহায় লাগল। “ঠিক কী হয়েছে বলুন তো?” জলের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে পায়েল জিজ্ঞেস করল।

জিভে একটা আওয়াজ করে সুইচ টিপে পায়েলের মাথার উপরের পাখাটা চালিয়ে দিয়ে ম্যানেজার বললেন, “ওই আপনি যদ্দুর জানেন আমিও তদ্দুরই জানি। একটা বাচ্চা ছেলে দেওয়ালে মাথা ঠুকে পড়ে গেছে।”

“অদ্ভুত ব্যাপার যাই বলুন, এরকম একটা বাড়িতে দুর্ঘটনা… ভাবাই যায় না।”

টোপটা দিয়ে আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল পায়েল।

“এটা কি প্রথম নাকি?” লোকটা পায়েলের দিকে ঘুরিয়ে নিল চেয়ারটা। মনে মনে হাসল পায়েল। কিন্তু মুখে আসতে দিল না সেটা, “মানে! আগেও হয়েছে?”

“আমার নিজের চোখের সামনে হয়েছে।”

“বলেন কি! ঠিক একই ঘটনা!” পায়েল এতক্ষণে বুঝেছে লোকটাকে কামিনী কাঞ্চন দিয়ে বধ করা যায়নি ঠিকই কিন্তু তৃতীয় একটি ফলায় তিনি ধরা পড়েছেন –গসিপ।

এতক্ষণে পায়েলের খাবার এসে গেছে ডিম টোস্ট আর চা। বেয়ারা চিনির ডিবে তুলে ধরে বলল, “চিনি দেব?”

“দাও, তিন চামচ। আমার আবার মিষ্টির উপর একটা ফ্যাসিনেশান আছে।”

“তখন আমি নিতান্তই ছোট, বুঝলেন? বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যা হয় আর কি। পুরনো জমিদারবাড়ি। তার উপরে চারিদিক কেমন অন্ধকার। একটু গা ছমছমও করে। ওখানেই গিয়ে লুকোচুরি খেলতাম আমরা। অন্য জায়গায় খেলতে গেলে লোকের দেখে নেবার ভয়। তাই আমরা উত্তরের অন্দরমহলের দিকে খেলতাম। যে চোর হত সে দীঘির পাড়ে গিয়ে দীঘির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকত। চল্লিশ অবধি গুণত। ততক্ষণে আমরা অন্দরমহলের ভিতরে লুকিয়ে পড়তাম। তো একদিন আমি চোর হয়েছিলাম আর সেই লোকটা দীঘির ধারে বসে জলের দিকে কিছু দেখছে। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ডাকল। আমি কাছে যেতে কীসব যেন বলেছিল। আমি অত মন দিয়ে শুনিনি। চল্লিশ গুণতে ব্যস্ত ছিলাম তো। ভারি মজা হত সেই সময়ে। তো তার পরদিন সকালেই শুনলাম জলের উপরে লোকটার লাশ পাওয়া গেছে।” লোকটা থামতে পায়েল তৎক্ষণাৎ কিছু উত্তর দিল না। লোকটার থেকে যতটা জানা যাবে বলে ভেবেছিল তার কিছুই জানা গেল না। সে বিমর্ষ হয়ে আবার খাবারে মন দিল। নাঃ ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোনো মুশকিল। ডেড এণ্ড। লোকটা আবার কীসব বলতে শুরু করেছে, পায়েল অতটা কান দেয়নি এতক্ষণ। “তবে শেষের দিকে আমরা আর লুকোচুরি বেশি খেলতাম না। অন্য খেলা, খেলতাম।”

“কেন?” একটু আগে আগ্রহ দেখিয়েছিল, এখন নিরুত্তাপ দেখালে কিছু বুঝে ফেলতে পারে লোকটা। সেজন্যেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশ্নটা করে।

লোকটা একটু হেসে বলে, “সে কারণটাও ভারি অদ্ভুত। লুকোচুরি খেললে হরে সবসময় জিতে যেত।”

“কী করে?” অন্যমনস্কভাবেই প্রশ্নটা করে পায়েল।

“সে এমন কোথাও একটা লুকাতো যে কেউ খুঁজে পেত না।”

“সে কি! কী করে?” হাতের চামচটা প্লেটের উপরে রেখে ঘুরে বসে পায়েল।

“সেইটাই সে বলতে চায়নি আমাদের। ওই অন্দরমহলের গলিঘুপচি এমনিতেই অন্ধকার। ভালো করে ভিতরটা দেখা যায় না। অন্য সবাই কেউ সিঁড়ির নিচে লুকাতো, কেউ দোতলার ভাঙা দরজার আড়ালে। হরে ছিল টকটকে ফর্সা, তাকে অন্ধকারে খুঁজে নেওয়া সহজ। কিন্তু সে ব্যাটা এমন কোনো জায়গা জানত যেখানে লুকিয়ে থাকলে খুঁজে বের করা মোটেই সহজ না। প্রথম প্রথম আমরা তাকে খুব জোরজার করতাম বলে দেওয়ার জন্যে, কিন্তু সে কিছুতেই বলতে চায়নি। তাই আমরা রেগে গিয়ে লুকোচুরি খেলাই বন্ধ করে দিলাম।”

“ওঃ…” আর কথা না বলে খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এল পায়েল। উত্তেজনায় একটু বেশি টাকাই টিপ দিয়ে ফেলেছে বেয়ারাটাকে। অনেকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিল বেয়ারাটা। বাইরে এসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুনন্দার নম্বরটা ডায়াল করল পায়েল। তুলি প্রথমে ফোন ধরল, তারপর সুনন্দা।

“দিদি, তোমার আশেপাশে মধুবাবু বা শশাঙ্কদা আছে?”

“একটু দূরে আছে। কেন বলতো?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল সুনন্দা “ওদের মধ্যে যাকে হোক জিজ্ঞেস করো এখানে আশেপাশে হরি বা হারাধন নামের বছর পঁয়তাল্লিশের কেউ আছে কিনা। হরিনাথ, হরিপ্রসাদ সবু চলবে।”

“কিন্তু কেন?”

‘ধুর বাবা, আগে জিজ্ঞেস কর। পরে বলছি।”

“শুধু নাম? সারনেম জানো না?”

“নাঃ।”

কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে আওয়াজ এল না। দূরে ক্ষীণ কথাবার্তা শোনা গেল তারপর পায়ের আওয়াজের পর আবার সুনন্দার গলা পাওয়া গেল, “তিনজন আছে। হরিনাথ, বলহরি আর হারান। হারানের ভালো নাম মধুদা জানে না।”

“এদের মধ্যে কার গায়ের রং ফর্সার দিকে?”

“উফ, সেটা তো আগে বললেই হত।” কথাটা বলে আবার দূরে যায় সুনন্দা। পায়েল হাসে। গায়ের রং ফর্সাটা মানুষের পার্মানেন্ট অ্যাট্রিবিউট না। এই গ্রাম্য রোদে জ্বলে লোকটা এখন যদি কালো হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে প্রথমেই সে ফিল্টার হয়ে যাবে। গায়ের রঙটা প্রায়োরিটি না।

“তিনজনের কেউই ফর্সা নয়। তবে হরিনাথ নাকি একসময়ে খানিক ফর্সা ছিল বলা যায়।”

“বেশ। এ যেখানে থাকে সে জায়গাটা আমাকে মেসেজ করে পাঠাও জলদি। আমি পরে ফোন করছি।”

“কিন্তু হয়েছেটা কী? এরা কারা?”

ওদিক থেকে উত্তর আসার আগেই ফোনটা কেটে যায়। সুনন্দা মধুবাবুর থেকে জায়গাটা জেনে নিয়ে মেসেজ করে দেয়। তারপর আবার ভিতরের ঘরে ঢুকে আসে।

*****

আগের দিনের পুলিশ অফিসারদের মধ্যে একজন আজ আবার এসেছেন। গিরিজাকে এতক্ষণ প্রশ্ন করা হচ্ছিল। তিনি তেমন কিছু উত্তর দিতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে কথা বলতে বলতে কপাল চাপড়াচ্ছেন। ক্ষেত্রমোহন বসে আছেন তার পাশে। স্ত্রীর কাঁধে একটা হাত রেখে আগলে রেখেছেন তিনি। সুনন্দা বিছানায় তার পাশে বসে পড়ে একটা হাত গায়ে, মাথায় বুলিয়ে তাকে সামলানোর চেষ্টা করল।

পুলিশ অফিসারটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা তাহলে এই বিল্ডিংয়ের একতলায় ছিলেন?”

সুনন্দা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।

“কোনো আওয়াজ শোনেননি রাতে? মানে দেওয়ালে মাথা ঠোকার আওয়াজ তো অনেকদূর যাবার কথা। বিশেষ করে আপনারা তখন সদ্য ঘুমিয়েছেন হয়তো।”

“আমি কোনো আওয়াজ পাইনি।”

ইন্সপেক্টার আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। সুনন্দা এবার নিজে প্রশ্ন করল, “আমি বুঝতে পারছি না আপনারা এটাকে সুইসাইড বলছেন কী করে? শুধু বাসনপত্র তোলপাড় হয়নি বলে?”

“খুন তো আমাদেরও প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছিল। ছেলেটা শুয়েছিল দোতলায়। রান্নাঘর একতলায়। এতটা রাস্তা সে একা আসেনি। হয় কেউ ডেকে এনেছিল নাহলে কোনো শব্দ শুনেছিল। কিন্তু আপনারা যখন কিছু শোনেননি তার মানে ডেকেই এনেছিল কেউ। আজ আমরা ওর মায়ের থেকে জানলাম ছেলেটি স্লিপ ওয়াকিং করত। এমনও হতে পারে রাতে দরজা খোলা পেয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে সে। এবং তারপর খুনি দেখতে পায় ছেলেটিকে। আমাদের এটা ভাবারও যথেষ্ট কারণ আছে যে খুনির কোনো নির্দিষ্ট টার্গেট ছিল না। তার একটা লাশের দরকার ছিল শুধু।”

“তাহলে আত্মহত্যা বলছেন যে।”

“প্রধান কারণ দুটো। এক, মাথার একই জায়গায়, প্রিসাইস্লি একই পয়েন্টে বার চারেক ব্লো হয়েছে। যেটা খুনের ক্ষেত্রে হয় না। বডি তার স্বাভাবিক নিয়মে একটু আশেপাশে হবেই। আর দুই ভিক্টিমের মাথার পিছনের চুলে কোনো ডিস্টারবেন্স ছিল না। অর্থাৎ পিছন থেকে কেউ ধরে ছিল না তাকে।”

“এমনও তো হতে পারে রান্নাঘরে কিছু পাড়তে গেছিল সে। নিচে পড়ে গেছে।”

“তাহলে চারটে ব্লো আসবে কী করে?”

নিজের বোকামিটা বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে নেয় সুনন্দা। ক’দিন হল তার মাথাটা একদম কাজ করতে চাইছে না। এটুকু বেশ বুঝতে পারছে এ বাড়িতে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একটা বিষণ্ণতা এসে ঘিরে থাকবে তাকে। বিশেষ করে তুলি তো চোখের আড়াল হলেই আতঙ্ক ধরে যায় বুকের মাঝে।

পায়েল কাছে পিঠে থাকলে তাও খানিকটা শান্তি পাওয়া যায়। মেয়েটার বয়স অল্প তবু তার মধ্যে কোথাও একটা ভরসা করার মতো জায়গা আছে! কাল নীলাদ্রি এসে গেলে হয়তো একটু দূরে দূরে থাকবে সে। তখন আবার কি নতুন করে ভয় লাগবে সুনন্দার?

এইসব ভাবতে ভাবতে বাইরের দালানে বেরিয়ে এল সে। এখন আর কেউ নেই প্যাসেজে। রান্নাঘরের সামনের জায়গাটা খালি। অথচ কাল সারাদিন কত লোক গিজগিজ করছিল। গিরিজার হাহাকারে সমস্ত জায়গাটা যেন ঝাপসা ওয়ে আসছিল বারবার। অথচ আজ কি শান্ত।

নিজের মেয়ের কথা মনে পরে সুনন্দার। রিন্টি মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন মুখ খুলতে পারেনি সে। একফোঁটাও কাঁদেনি। স্থবির পাথরের মতো বসেছিল। আগুনে খুব ভয় পেত রিন্টি। বলেছিল বড় হয়ে মায়ের মতো ইন্ডাকশান ওভেন কিনে রান্না করবে। গ্যাস জ্বালাবে না। অথচ কয়েক মুহূর্তে তার গোটা শরীরটা ছাই হয়ে গেল চুল্লির আগুনে। চুল্লির ভিতর যেতে কি ভয় পেয়েছিল রিন্টি?

ঘণ্টাখানেক চাতালেই বসেছিল সুনন্দা। ভাবনার মাঝে কোথায় ডুবে গেছিল নিজেরই খেয়াল ছিল না। আচমকা পিঠে একটা হাত এসে পড়ায় চমকে ফিরে তাকাল সে–পায়েল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি সুনন্দা। বুকের ভিতরের উত্তাপটা নেভানো মোমের মতো কমে আসছে। একটু হেসে সুনন্দা বলল, “ব্যাপার কী তোমার? কাকে খুঁজছিলে এত?”

“সে বলছি। কিন্তু তুমি কী ভাবছিলে?” সুনন্দার পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল। তার জামার গলার কাছটা ঘামে ভিজে গেছে।

“ভাবছিলাম যে তুমি মেয়েটা খুব ভালো।”

“বাবা! কি বলছ গো?” একটু অবাক হয় পায়েল।

“হ্যাঁ, শুধু একটু বেশি সিগারেট খাও। আর মাথায় খানিকটা ছিটও আছে। সেই সঙ্গে একটুখানি বুদ্ধি।”

চাপা শব্দ করে একবার হেসে ওঠে পায়েল। হাসলে ভারি সুন্দর দেখায়। তাকে। গোটা মুখ জুড়ে ছড়ানো খোলা হাসি। কাজলপড়া চোখের একপ্রাপ্ত ঝিকমিকিয়ে ওঠে সেই হাসির সঙ্গে।

“এবার বলতো লোকটাকে কী কারণে দরকার? ম্যানেজারের থেকে কিছু পেলে?”

“যা চাইছিলাম সেটা পাইনি তবে অন্য একটা জিনিস পেয়েছি। উইচ আই থিঙ্ক ইজ আ ফ্রুটফুল বারগেন।”

“কী পেলে আবার?”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে চারিদিক দেখে নিয়ে পায়েল বলে, “তোমাদের উত্তরের অন্দরমহল, যার ভিতর থেকে তুলিকে কেউ ডাকছিল, সেখানে যতদূর সম্ভব একটা হিডেন প্যাসেজ আছে।”

“অ্যাঁ! সে আবার কী!” চমকে ওঠে সুনন্দা।

“ইয়েস। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কিছু ছেলেপুলে সেখানে লুকোচুরি খেলতে আসত। তার মধ্যে একজনের কাছে হদিস ছিল সেই প্যাসেজের। সম্ভবত কো-ইন্সিডেন্টালি সে সেটা খুঁজে পেয়েছিল।’

“কে পেয়েছিল?”

“এই যে হরিনাথ ঘোষ। লোকটা এই শহরেই থাকে। ক্রেডিট গোস টু মধুবাবু।”

“তো তুমি দেখা করেছিলে তার সঙ্গে?”

“করেছিলাম।” পায়েলের গলায় হতাশার ছাপ

“কী বললেন তিনি?”

“বললেন, কিস্।”

“মজা না করে সত্যিটা বলবে?”

“আরে মজা করিনি। ভদ্রলোক বছরতিনেক হল এলঝাইমারসে ভুগছেন। আমি প্রশ্নটা করতে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকলেন, তারপর বললেন ওই, কিস। এখন সেটা কিসমিস নাকি কিস্তি নাকি বুড়োর সত্যি চুমু খাওয়ার আচ্ছা হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না।”

“তাহলে এখন উপায়?”

সুনন্দার কাঁধে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াল পায়েল, “উপায় এখন একটাই। একটা খেলা খেলতে হবে। যেভাবে হরিনাথ জায়গাটা বের করেছিল সেভাবে আমাকেও বের করতে হবে।”

“কিন্তু ওখানে যে কিছু থাকবেই তার কি মানে আছে?” চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে সুনন্দা।

“তা জানি না…” স্বগতোক্তি ফুটে ওঠে পায়েলের গলায়, “বাট সামওয়ান ওয়ানটস টু প্লে হাইড-অ্যাণ্ড-সিক।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *