লিলিপুটদের দেশে – ৭

সপ্তম পরিচ্ছেদ

[ লেখক জানতে পারলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং তাঁকে শীঘ্রই অভিযুক্ত করা হবে। তিনি রেফুসকু দ্বীপে পালিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁর অভ্যর্থনার বিবরণ ।]

এই রাজ্য ত্যাগ করার বিবরণ জানাবার পূর্বে আমার বিরুদ্ধে দু’মাস ধরে যে ষড়যন্ত্র চলছিল সে বিষয় পাঠকদের জানানো আমার উচিত। আমি আমার জীবনে কখনো রাজা বা রাজসভার সংস্পর্শে আসি নি কারণ আমার সে যোগ্যতা ছিল না। আমি একজন বিত্তহীন সাধারণ নাগরিক অতএব রাজসভায় কী করে যেতে পারি? রাজা বা মন্ত্রীদের অনেক কেলেঙ্কারি ও মুখরোচক প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের কাহিনী শুনেছি। তবে এই সব ব্যাপার যে আমাকে সম্পূর্ণ নতুন এক দেশে প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং সেই ভিন্নধর্মী দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে তা আমি কোনোদিন ভাবি নি, কল্পনাও করতে পারি নি। কোথায় ইউরোপ আর কোথায় ক্ষুদে মানুষদের বিচিত্র দেশ লিলিপুট।

ব্লেফুসকু দ্বীপের সম্রাটের আমন্ত্রণে আমি যখন সেই দেশে যাবার তোড়জোড় করছি। ঠিক সেই সময়ে রাজসভার একজন দামি ব্যক্তি (ইনি একবার সম্রাটের বিষনজরে পড়েছিলেন, তখন আমি তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম) আমার বাড়িতে গোপনে বন্ধ পালকি চেপে এলেন। বাইরে যে পাহারায় ছিল তাকে বলল আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় কিন্তু নাম বলল না।

খবর পেয়ে আমি তখনি বাইরে এলাম এবং এহেন একজন অভিজাত ব্যক্তিকে এত রাত্রে দেখে অবাক হলাম। যাহোক পালকিবাহকদের সরিয়ে দিয়ে আমি সেই অভিজাত ব্যক্তিকে পালকি সমেত আমার কোটের পকেটে ভরে নিলাম এবং আমার একজন বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকে বলে দিলাম যে আমার শরীর ভালো নেই, আমি ঘুমোতে যাচ্ছি, কেউ যেন বিরক্ত না করে। ঘরে ঢুকে বেশ করে দরজা বন্ধ করে মহামান্য অতিথিকে পকেট থেকে বার করে তাঁকে টেবিলে যথারীতি বসিয়ে আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাঁর পাশে বসলাম। সৌজন্যে বিনিময়ের পর লক্ষ করলাম যে আমার অতিথি বিশেষ ভাবে চিন্তিত। আমি তাঁকে তাঁর এই উৎকণ্ঠার কারণ জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন যে তিনি যা বলবেন তা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। কারণ ব্যাপারটির সঙ্গে আমার সম্মান এমন কি আমার জীবনের নিরাপত্তাও জড়িত। তিনি যা বললেন তা শুনে আমি বিস্মিত । তিনি চলে যাবার পর আমি তাঁর কথাগুলো লিখে রেখেছিলাম।

তিনি আমাকে বললেন, আপনাকে জানানো দরকার যে কয়েকজন অতি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে রীতিমতো সক্রিয় এবং তাঁরা আপনাকে ধ্বংস করতে কৃতসংকল্প। সম্রাটের কাছে ওরা গুরুতর অভিযোগ করেছে এবং দু’দিন হল সম্রাট কী করবেন তা স্থির করে ফেলেছেন। তিনি লিখিত নির্দেশ জারি করবেন ।

আপনি জানেন যে আপনি এখানে আসার প্রায় গোড়া থেকেই স্কাইরিস বলগোলাম (গালবেত অর্থাৎ নৌবহরের প্রধান এ্যাডমিরাল) আপনার সাংঘাতিক শত্রু । এই শত্রুতার ঠিক কী কারণ তা আমি জানি না তবে ব্লেফুসকুতে আপনার অসামান্য সাফল্যের পর আপনার প্রতি ওর ঘৃণা যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। হয়তো সে মনে করে এ্যাডমিরাল রূপে তার কৃতিত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে। স্কাইরিস আপনার আর এক শত্রু কোষাধ্যক্ষ ফ্লিমন্যপের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কেউ বা কারা আপনার নামের সঙ্গে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে কলঙ্ক রটিয়েছিল, সেই থেকে ফ্লিমন্যাপ আপনার ওপর খাপ্পা। প্রধান সেনাপতি লিমটক, চেম্বারলেন লালকন এবং বিচারপতি বালমাফ, তিন জন মিলে রাজদ্রোহিতা এবং আরো কিছু সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র জুড়ে আপনার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ-পত্র সম্রাটের কাছে পেশ করেছে।

আমি তো জানি আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং এসবের কিছুই আমি জানি না। তবুও তিনি যতটুকু বললেন তা শুনে আমি জ্বলে উঠলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শান্ত করলেন। তাঁর তখন ভয় আমি ক্ষেপে গেলে এখনি হয়তো সবকিছু ধ্বংস করে দেব। তিনি বললেন, এক সময়ে আপনি আমার যথেষ্ট উপকার করেছেন সেজন্যে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে সতর্ক করে দিতে এসেছি। আপনার বিরুদ্ধে ওরা যে অভিযোগ পত্র তৈরি করেছে তার একটা নকল আমি আপনার জন্যে সংগ্রহ করে এনেছি। আমি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে একটি আপনার জন্যে এনেছি, ধরা পড়লে আমার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমি সেই অভিযোগ পত্রটি ভালো করে পড়লাম। আদালতে উকিল যেভাবে বিচারকের কাছে মামলার আবেদন পত্র পেশ করে বা বিধান সভায় বিধায়করা যেভাবে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পেশ করে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রটিও সেইভাবে রচিত হয়েছে।

কুইনবাস ফ্লেস্ট্রিন (পাহাড়-মানুষ)-এর বিরুদ্ধে

অভিযোগের বিভিন্ন ধারা:

১ নং ধারা :

যেহেতু মহামান্য সম্রাট ক্যালিন ডেফার পুন তাঁর রাজ্যে এমন একটি বিধিবদ্ধ আইন প্রচলিত করেছেন যার দ্বারা যে কেউ রাজপ্রাসাদের সীমানার মধ্যে মূত্রত্যাগ করলে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে এবং দণ্ডনীয় হবে এবং তৎসত্ত্বেও উক্ত কুইনবাস ফ্রেস্ট্রিন আইন লঙ্ঘন করে তাঁর প্রিয় মহিষীর কক্ষসমূহে অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণের অজুহাতে অত্যন্ত হীন, জঘন্য ও অশোভনীয় ভাবে মূত্রত্যাগ করেছে এবং তদ্বারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে অতএব ইত্যাদি, ইত্যাদি।

২ নং ধারা :

উক্ত কুইনবাস ফ্রেস্ট্রিন ব্লেফুসকু দ্বীপ থেকে সমুদয় রণতরী আটক করে লিলিপুটের রাজকীয় বন্দরে নিয়ে এসেছিল। আমাদের সম্রাট তখন তাকে আদেশ দিলেন যে ব্লেফুসকু রাজ্যের বাকি সব জাহাজগুলো তুমি আটক করে নিয়ে এস। উক্ত দ্বীপকে সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে রূপান্তরিত করে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে শাসন করবার প্রস্তাব করলেন। মহামান্য সম্রাট উক্ত পাহাড়-মানুষকে আদেশ করলেন উক্ত দ্বীপের কিছু একটা সমস্ত নির্বাসিত বিগ-এনডিয়ান এবং উক্ত রাজ্যের সমস্ত মানুষকে হত্যা করতে যারা বিগ-এনডিয়ানদের সংশ্রব ছাড়তে রাজি হবে না। কিন্তু তখন ঐ পাহাড়-মানুষ ফ্লেস্ট্রিন মহামান্য সম্রাটের এই পবিত্র আদেশগুলো বিশ্বাসঘাতকদের মতো প্রত্যাখ্যান করে বলল যে একদল নির্দোষ ও দুর্বল মানুষদের হত্যা করতে তার বিবেকে বাধছে।

৩ নং ধারা :

যেহেতু আমাদের মহামান্য সম্রাটের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করতে ব্লেফুসকু থেকে শুরু একদল রাষ্ট্রদূত এসেছিল তখন উক্ত ফ্লেক্ট্রিন সেই বিদেশে রাষ্ট্রদূতগণের সঙ্গে যারা আমাদের শত্রু বলে পরিগণিত এবং যারা তাদের রাজার ভৃত্য ব্যতীত আর কিছু নয়, আমাদের দেশের প্রতি বিশ্বাসহানী করে মেলামেশা করেছিল এবং তাদের সান্ত্বানা দিয়েছিল বলেও প্রকাশ ।

৪ নং ধারা :

উক্ত কুইনবাস ফ্লেক্ট্রিন যার কর্তব্য একজন অনুগত প্রজার মতো এদেশে বাস করা সে তা না করে ব্লেফুসকু রাজ্যের সম্রাটের কাছে যাবার ব্যবস্থা করছে। যদিও আমাদের মহমান্য সম্রাট তাকে মৌখিক সম্মতি জানিয়েছে কিন্তু কোনো লিখিত অনুমতি দেন নি। তথাপি সে আমাদের সম্রাটের মাত্র মৌখিক সম্মতির বলে আমাদের শত্রুর দেশে যেতে চাইছে এবং তদ্বারা সে উক্ত শত্রু-সম্রাটকে পরোক্ষভাবে সান্ত্বানা দেবে এবং তার পরাজয়ের গ্লানি দূর করতে সহায়ক হবে।

এছাড়া আরো কয়েকটি ধারা কিন্তু সেগুলো এখানে অবান্তর। আমি শুধু গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোই তুলে ধরলাম। বিদায় নেবার আগে উক্ত ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন যে আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগপত্রটি নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে তার মন্ত্রী বা পরামর্শদাতাদের সঙ্গে যে আলোচনা সাপেক্ষে হয়েছিল তাতে সম্রাট আপনার পক্ষ নিয়ে অনেক তর্ক করেছিলেন, আপনি দেশের অনেক উপকার করেছেন, দেশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করেছেন এবং আপনার জন্যে সামান্যতম ক্ষতি সহ্য না করেও শত্রুকে অনায়াসে পরাজিত করতে পারা গেছে।

কিন্তু কোষাধ্যক্ষ ও উক্ত এ্যাডমিরাল এতদূর শয়তান যে ওরা সম্রাটকে বলল যে আপনি যখন রাত্রে নিদ্রা যাবেন তখন আপনার বাড়েিত আগুন লাগিয়ে আপনাকে পুড়িয়ে মারা হবে এবং সেনাপতি কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত থাকবে তারা আপনার মুখে ও হাতে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করবে। ওরা আরো স্থির করেছে যে আপনার কয়েকজন ভৃত্য মারফত আপনার শার্টে ও বিছানার চাদরে গোপনে একরকম তরল তীব্র বিষ মিশিয়ে রাখবে, আপনি সেই শার্ট পরে বিছানায় শুলে শরীর এমন জ্বালা করবে যেন মনে হবে আপনি আপনার দেহের চামড়া ছিড়ে ফেলে দেন। ভীষণ কষ্ট পেয়ে আপনি মারা যাবেন।

মুখ্য সচিব রেলড্রেসার যে আপনার একজন বন্ধু বলে নিজেকে প্রচার করে তাঁকে সম্রাট আপনার সম্বন্ধে মতামত ব্যক্ত করতে বলেছিলেন। রেলড্রেসার অবশ্য সম্রাটের ভয়ে আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। তিনি বলেছিলেন পাহাড়-মানুষের অপরাধ হয়তো গুরুতর কিছু তবুও তার প্রতি দয়া প্রকাশ করার অবকাশ আছে এবং দয়া ও ক্ষমাই তো হল রাজার ধর্ম। আর এই দয়া ও ক্ষমার জন্যেই তো আমাদের সম্রাট বিশ্বনন্দিত।

পাহাড়-মানুষ যে আপনার বন্ধু এ কথা সারা দেশ জানে, আপনি তাকে উচ্চ উপাধিও দিয়েছেন তাই হয়তো সে প্রশ্রয় পেয়ে এমন কিছু করেছে যা আপনার মনে আঘাত দিয়েছে তবুও আপনি তাকে যদি শাস্তি দেন তাহলে প্রাণে মারবেন কেন? আপনি বরঞ্চ তাকে শাস্তি স্বরূপ অন্ধ করে দিন তাহলে তার প্রতি সুবিচারও করা হবে অথচ আইন ভঙ্গের অপরাধে তাকে শাস্তিও দেওয়া হবে এবং আপনার উদারতায় সকলে প্রশংসাই করবে। অন্ধ হয়ে গেলেও তার দৈহিক শক্তি অক্ষুণ্ন থাকবে এবং সম্রাটের আদেশে কাজও করতে পারবে। মুখ্য সচিব সম্রাটকে আরো বুঝিয়েছে যে শত্রুর জাহাজগুলো টেনে আনবার সময় পাহাড়-মানুষের ভয় ছিল শত্রুর তীর বিধে সে বুঝি অন্ধ হয়ে যাবে । এখন অন্ধ হলে সে আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাকে আমাদের চোখ দিয়েই দেখতে হবে, তাকে আমরা যে দেখাব সেই তাই দেখবে।

কিন্তু মন্ত্রণা-সভা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নি। এ্যাডমিরাল বলগোলাম তো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, মুখ্য সচিব এ কী বলছেন? একটা বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে? উক্ত ভদ্রলোক আমাকে বলতে লাগলেন, আপনি যেসব উপকার করেছেন তা এখন আপনার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আপনি মূত্রত্যাগ করে ওদের ডুবিয়ে মারতে পারেন। কিংবা রাজপ্রাসাদটাই নষ্ট করে দিলেন? আপনি শত্রুপক্ষের জাহাজগুলো ধরে এনেছেন কিন্তু সেগুলো তো আবার ফিরিয়েও দিয়ে আসতে পারেন। কে আপনাকে বাধা দেবে?

বলগোলামরা বলতে চায় যে মনে মনে আপনি একজন বিগ-এনডিয়ান, শত্রুপক্ষের সমর্থক অতএব আপনি রাজদ্রোহী এবং আপনার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কোষাধ্যক্ষর ঐ একই মত। সে বলে, শয়তানটাকে বাঁচিয়ে রেখে কী হবে? ওকে ছোট ছোট পুষতেই তো আমাদের রাজকোষ শূন্য হয়ে আসছে এবং আর কিছু দিন পরে ওকে খাওয়াবার জন্যে আর এক কপর্দকও সিন্দুকে পড়ে থাকবে না। তাকে অন্ধ করে দিলেও তো খাওয়াতে হবে। অন্ধ লোককে দিয়ে বেশি কাজও করানো যাবে না। বসে বসে খাবে আর ঘুমোবে আর আরো মোটা হবে আরো খেতে চাইবে, খেতে না পেলে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তখন কানা মানুষ ক্ষেপে গিয়ে, কী ক্ষতি করবে কে জানে? অতএব আপনি যে একজন ঘোরতর অপরাধী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে অপরাধ করেছেন তার আর ক্ষমা নেই আর বিষয়টি তলিয়ে দেখবার বা পুনর্বিচার করবার আর অবকাশও নেই, অতএব আপনার একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

উক্ত ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, আমাদের মহামান্য সম্রাট কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে । তিনি বললেন, মানুষটাকে যে কোনো সময়ে অন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু আর কেউ অন্য কোনো শাস্তির কথা বলতে পারেন নি? তখন আপনার বন্ধু ঐ মুখ্যসচিব নতুন প্রস্তাব করলেন, কোষাধ্যক্ষ মহাশয় বলছেন যে পাহাড়-মানুষকে খাওয়াতে রাজকোষের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং পাহাড়-মানুষকে খাওয়াতে গিয়ে আমরাই হয়তো আমি অনাহারে মারা যাব। তাহলে আমার একটা অন্য প্রস্তাব আছে, পাহাড়-মানুষের আহারের বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হোক তাহলে সেও ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে। তাছাড়া কম খেতে খেতে তার খাবার ইচ্ছোও কমে যাবে, সে দুর্বল হতে থাকবে, মাঝে মাঝে হয়তো অজ্ঞানও হয়ে যাবে এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে। যখন মারা যাবে তখন স তো হাড্ডিসার মৃতদেহ পচে গলেও তেমন দুর্গন্ধ নির্গত হবে না। আরো একটা কথা । তখন তো সে অনেক রোগা হয়ে গেছে, পাঁচ ছ হাজার লোক লাগিয়ে দিলে তারা ওর লাশটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে গিয়ে দূরে কোথাও মাটিতে টুকরোগুলো পুঁতে দেবে। তাহলে দেহ এক জায়গায় পড়ে থেকে পচে গিয়ে রোগ ছড়াতে পারবে না আর তার কংকালটা তার স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা দেখে অবাক হবে।

মুখ্য সচিবের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত একটা ফয়সালা হল । আপনাকে অনাহারে রাখার জন্য প্রস্তাবটা গোপন রাখা হয়েছে কিন্তু আপনাকে অন্ধ করার প্রস্তাব খাতায় লেখা হয়ে গেছে। এই প্রস্তাবে একমাত্র এ্যাডমিরাল হল সম্রাজ্ঞীর লোক, তাঁর আজ্ঞাবাহী। সম্রাজ্ঞী আপনার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। আপনি যে ভাবে প্রাসাদে তাঁর কক্ষগুলোর আগুন নিবিয়েছেন শুধু বেআইনী নয় তাঁদের মতে ঘৃণ্য। এই কারণে সম্রাজ্ঞী সেই রাত্রি থেকেই আপনার প্রতি বিরূপ ।

আপনার প্রিয় বন্ধু সেক্রেটারি মশাই আর তিন দিনের মধ্যে আপনার কাছে আসবেন এবং আপনার প্রতি অভিযোগের ধারাগুলি পড়ে শোনাবেন। তিনি আরও জানাবেন যে আমাদের মহামান্য সম্রাট আপনার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন নি শুধু আপনার চক্ষু দুটি বাজেয়াপ্ত করা হবে। আশা করা হচ্ছে যে আপনার প্রতি সম্রাটের এই অনুগ্রহ কৃতজ্ঞচিত্তে মেনে নেবেন এবং আপনার চক্ষুদ্বয় বাজেয়াপ্ত করতে সম্রাটের কুড়িজন সার্জন যখন আসবেন তখন আপনি শুয়ে পড়বেন। সার্জনরা তীক্ষ্ণ তীর দিয়ে আপনার চক্ষুর মণিতে আঘাত করে সম্রাটের আদেশ পালন করবেন। উক্ত ভদ্রলোক বললেন আপনি কী ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন সে আপনই স্থির করবেন, তবে আমি অপরের সন্দেহ এড়িয়ে যেভাবে এসেছি সেইরূপ গোপনে অবিলম্বে ফিরে যেতে চাই। উনি চলে গেলেন এবং আমি আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে লাগলাম। মন বিক্ষিপ্ত, নানা সন্দেহ।

আমি লক্ষ করেছি যখনি কোনো রাজা স্বয়ং বা তাঁর মন্ত্রীদের পরামর্শে কোনো কিছু ব্যক্তিকে দণ্ডবিধান করেন তখনি তাঁরা একটা লম্বা বক্তৃতা দেন যে আসামীর অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় তাকে লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা সে মৃত্যুদণ্ড, বেতমারা বা আজীবন নির্বাসন যাইহোক না কেন। সম্রাট যে অত্যন্ত দয়াবান, এই কথাটা সাড়ম্বরে প্রচার করা হয় এবং শাস্তি যত বেশি নিষ্ঠুর হয় বক্তৃতাও তত বেশি লম্বা হয়। সব ক্ষেত্রে দোষ যে সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশিত হয় তাও নয়। আমি কোনোদিনই কোনো রাজদরবারে প্রবেশ করতে পারি নি, সে যোগ্যতাও আমার ছিল না অতএব রাজাদের কখন কী মর্জি হয় এবং তাঁদের দৃষ্টিতে কোনটা কড়া আর কোনটা কোমল সে বিচার করবার বুদ্ধিও আমার ছিল না তবে আমার ক্ষেত্রে আমার জন্যে সম্রাট যে শাস্তি নির্ধারণ করেছেন তার কোথায় সম্রাটের দয়া প্রকাশ করা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারলাম না। যাহোক আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের ধারাগুলো পড়ে আমার মনে হয়ছিল যে এদের বিচারে আমি হয়তো অপরাধ করেছি যদিও আমার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন এবং সেজন্যে আমি প্রশ্ন করতে পারি যে আমার অপরাধ কি ক্ষমার অযোগ্য? যাহোক আমার অবর্তমানে আমার বিচার করে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, শত্রু পক্ষও প্রবল এবং শাস্তি হয়তো আমার মেনে নেওয়া কর্তব্য।

তথাপি আমি মনে মনে জানি যে আমি যতক্ষণ মুক্ত আছি ততক্ষণ এরা আমার কিছুই করতে পারবে না, আমি এখনি প্রতিবাদ করতে পারি, বাধা দিতে পারি, ক্ষতি করতে পারি এবং তা করলে ওদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। আমি গোটাকতক পাথর ছুঁড়ে শহরটাকে ধ্বংস করে দিতে পারি কিন্তু এই সর্বনাশা কাণ্ড করতে আমার মোটেই ইচ্ছে হল না কারণ আমার মুক্তির জন্যে আমি সম্রাটের কাছে শপথ নিয়েছি এবং তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট আনুকূল্যও পেয়েছি এবং তিনি দেশের সর্বোচ্চ যে ‘নারডাক’ উপাধি দ্বারা আমাকে সম্মানিত করেছেন তারও তো একটা মর্যাদা আছে। তা সত্ত্বেও আমাকে যে সম্রাট ও তাঁর পরমার্শদাতাগণ আরোপিত শাস্তি মেনে নিতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই।

অবশেষে আমি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে অতি উৎসাহে এবং আমার অভিজ্ঞতার অভাবে আমি যে সব কাণ্ড করেছি এবং আমাকে সেজন্যে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা আমি মানব না। আমার স্বাধীনতা এবং আমার দুই চোখ আমি হারাতে চাই না। অন্য দেশে দেখেছি যে আসামীর প্রতি দণ্ডবিধানের আগেই তার উপর নির্যাতন চালানো হয় এবং আমার ক্ষেত্রে তেমন কিছু করাও হয় নি। এখন আমি মুক্ত ও স্বাধীন।

আমি তো একটা কাজ করতে পারি এবং সেজন্যে সম্রাট আমাকে মৌখিক সম্মতিও দিয়েছেন। আমি আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ব্লেফুসকু দ্বীপে চলে যেতে পারি। তাই করা উচিত  এবং তা করতে হবে তিন দিনের মধ্যেই কারণ এই তিন দিনের মধ্যে আমাকে শাস্তি দেওয়া হবে । আমার প্রতি যে দণ্ডবিধান করা হয়েছে তা তো আমি জানি না এবং সরকারিভাবে আমাকে জানানও হয় নি অতএব আমি যেন শাস্তি এড়াবার ভয়ে পালিয়েও যাচ্ছি না। এই মত স্থির করে আমি আমার সেই বন্ধু মুখ্য সচিবের নামে একখানি চিঠি লিখে রাখলাম যে আমি আজ সকালে ব্লেফুসকু দ্বীপের সম্রাটের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেই দ্বীপে যাচ্ছি । তাঁর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে আমি দ্বীপের সেই অংশে গেলাম যেখানে নৌবহর রাখা আছে। আমি সবচেয়ে বড় মনোয়ার যুদ্ধ জাহাজাটা বেছে নিলাম, তাতে একটা দড়ি বাঁধলাম এবং যাতে ভিজে না যায় এজন্যে আমি সব পোশাক খুলে জাহাজটার ওপর (শুধু আমার বিছানার চাদরটা বগলদাবা করে রাখলাম) জড়ো করে রেখে নোঙর তুলে জাহাজটাকে টানতে টানতে ব্লেফুসকু দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করলাম।

গোড়ায় জল কম ছিল, হেঁটে চললাম তারপর জল যখন বেশি তখন সাঁতার কাটি এই ভাবে ব্লেফুসকু দ্বীপের রাজবন্দরে পৌঁছলাম। ঐ দ্বীপের লোকেরা আমার আগমন অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে ওরা ভয় পেল না। রাজবাড়ি যাব শুনে দুজন পথ প্রদর্শক দিল । রাজধানীর উদ্দেশে যাত্রা করলাম। দ্বীপের যা নাম রাজধানীরও তাই নাম ।

পথ-প্রদর্শক দুজনকে আমার হাতে তুলে নিয়েছিলাম। রাজবাড়ির ফটকের দু’শ গজের মধ্যে এসে আমি আমার পথ প্রদর্শক দুজনকে নামিয়ে দিয়ে তাদের বললাম, কোনো একজন সচিবকে খবর দিয়ে বল আমি বাইরে সম্রাটের আদেশের জন্যে অপেক্ষা করছি।

এক ঘণ্টা পরে সাড়া পেলাম। রাজপরিবারসহ সম্রাট স্বয়ং এসেছেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। সঙ্গে এসেছেন দরবারের সভাসদগণ । আমি একশ গজ এগিয়ে গেলাম। সম্রাট ও তাঁর সঙ্গীগণ ঘোড়া থেকে নামলেন, সম্রাজ্ঞী ও মহিলারা নামলেন তাঁদের গাড়ি থেকে । আমার বৃহৎ শরীর দেখে তাঁরা যে ভয় পেয়েছেন আমার মনে হল না । সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর হস্ত চুম্বন করবার জন্যে আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম। সম্রাটকে আমি বললাম যে আমি তাঁর কাছে আসব কথা দিয়েছিলাম। এখন আমি পরাক্রমশালী সম্রাটের দর্শন পেলাম এবং তাঁর কোনোরকম সেবা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। এদেশে আসবার জন্যে আমার সম্রাট আগেই তাঁর সম্মতি জানিয়েছিলেন কিন্তু আমাকে যে শাস্তি দেওয়া হবে সেসব কথা আমি উচ্চারণ করলাম না। কারণ আমাকে তো কিছু জানানো হয় নি অতএব এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকাই ভালো। আমি যে সব জেনেশুনেই এই দ্বীপে পালিয়ে এসেছি এমন কোনো ধারণা আমার সম্রাট করতে পারবেন না। কিন্তু আমি বোধহয় ভুল বুঝেছিলাম।

ব্রেফুসকু দ্বীপের সম্রাট ও জনগণ আমাকে কীভাবে অভ্যর্থনা করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণী জানিয়ে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না তবে মহান সম্রাট তাঁর উদারতা অনুযায়ীই আমাকে সমাদর করেছিলেন। এখানে আমি বাড়ি পাই নি, অসুবিধা হচ্ছিল। শোবার ব্যবস্থাও নেই, বিছানার চাদর জড়িয়ে মাটিতেই শুতে হল, এসব অসুবিধার কথাও এখন মুলতুবি থাক ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *