ব্রবডিংনাগদের দেশে – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

[ লেখক কয়েকটি দুঃসাহসিক ঘটনার সমম্মুখীন। এক অপরাধীর প্রাণদণ্ড । নৌচালনা বিদ্যায় লেখক তাঁর জ্ঞানের পরিচয় দেন। ]

আমি যদি আমার ক্ষুদ্র দেহের জন্যে কয়েকটি হাস্যস্পদ দুর্ঘটনায় না পড়তাম তাহলে আমি এদেশে আনন্দেই থাকতে পারতাম। কয়েকটি দুর্ঘটনার উল্লেখ করছি। গ্লামডালক্লিচ আমাকে মাঝে মাঝে আমার বাক্স-ঘর সমেত প্রাসাদের বাগানে নিয়ে যেত । কখনো সে আমাকে ঘর থেকে বার করে নিজের হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াত আবার কখনো আমাকে নিচে নামিয়ে দিত! সেই বেঁটে বামনকে তখনো মহারানি বিদেয় করে দেয় নি।

সেই সময় আমি একদিন বাগানে বেড়াচ্ছি, বেঁটেও বেড়াচ্ছে। বাগানে একটা বেঁটে আপেল গাছ ছিল। আমরা বেড়াতে বেড়াতে যখন সেই আপেল গাছের তলায় গেছি তখন আমার কি দুর্বুদ্ধি হল আমি সেই বেঁটে আপেল গাছের সঙ্গে তুলনা করে বেঁটে বামনের প্রতি একটা মন্তব্য করলাম। আর যায় কোথায়! আমি তখন ঠিক সেই আপেল গাছের তলায় । বেঁটে ছুটে গিয়ে গাছটায় এমন নাড়া দিল যে দশ বারটা আপেল ঝুপঝাপ করে পড়ল । এক একটা আপেল আমাদের বিস্টল ব্যারেলের সমান, সেই একটা আপেল ধপাস্ করে আমার পিঠে পড়ল আর আমিও পড়লাম মুখ থুবড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আর কোথাও আঘাত লাগে নি। এজন্যে বেঁটেকে শাস্তি দেবার কথা উঠতে আমি তাকে ক্ষমা করতে বললাম কারণ আমিই ওকে ক্ষেপিয়েছিলাম।

আর একদিন। আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসতে পারে। গ্লামডালক্লিচ আমাকে বাগানের ছোটো একটি সবুজ মাঠে ছেড়ে দিয়ে তার গভরনেসের সঙ্গে এদিকে ওদিকে বেড়াচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হল। ওরে বাবা! সে কী শিলা! মস্ত বড়! এক একটা শিলা টেনিশ বলের মতো আঘাত করে আমার গায়ে সজোরে পড়তে লাগল। আমি কোনো রকমে একটা ঝাঁকড়া লেবু গাছের তলায় আশ্রয় নিলাম কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত যে আঘাত লেগেছিল তাতে আমি এমনই কাহিল হয়ে পড়েছিলাম যে বাড়ি থেকে দশ দিন বেরোতে পারি নি । আশ্চর্য হবার কিছু নেই সে দেশের প্রাকৃতিক সব কিছু বিরাট। এমন কি আকাশ থেকে ভূপাতিত শিলাগুলোও । ইউরোপে যে শিলা পড়ে তার চেয়ে এখানকার এক একটা শিলা আঠারশ গুণ বড়। কৌতূহলী হয়ে আমি ওখানকার শিলা মেপে দেখেছিলাম।

ঐ বাগানেই আমার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন আমার ছোট্ট নার্স আমাকে বাগানে এনে রাপদ মনে করে একটা নিভৃত জায়গায় ছেড়ে দিল। এইভাবে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ আমি মাঝে মাঝে করতাম যাতে আমি নিভৃতে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। গ্লাম সেদিন আর বাক্সটা আনে নি, মিছেমিছি বয়ে এনে কী হবে, বাগানে আমাকে বাক্স থেকে বার করে দিত হয় তো, তার চেয়ে হাতে করে নিয়ে যাওয়াই ভালো। আমাকে বাগানের সেই নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিয়ে গ্লাম তার গভরনেস ও আরো কয়েকটি মহিলার সঙ্গে বাগানের অন্য এক অংশে চলে গেল । গ্লাম বেশ একটু তফাতেই তখন চলে গেছে। আমি চিৎকার করে ডাকলেও সে শুনতে পারে না। এমন সময় একজন বড় মালির একটা স্প্যানিয়েল কুকুর কোথা থেকে এসে হঠাৎ বাগানে ঢুকে পড়েছে এবং আমার গন্ধ পেয়ে আমার কাছে সোজা চলে এসেছে। সে আমাকে টপ করে মুখে তুলে নিয়ে দৌড়ে তার মনিবের কাছে গিয়ে আমাকে আস্তে নামিয়ে দিয়ে লেজ নাড়তে লাগল।

সৌভাগ্যক্রমে কুকুরটি শিক্ষিত, সে যদিও তার দাঁত দিয়েই আমাকে তুলে নিয়েছিল তবুও আমার একটুও আঘাত লাগে নি কিংবা আমার পোশাক কোথাও ছেঁড়ে নি যদিও আমি ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিলাম। বেচারা মালি আমাকে চিনত এবং আমার প্রতি সে বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। কুকুরের কাণ্ড দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। মহারানির কানে উঠলে চাকরি তো যাবেই, সাজাও পেতে হবে। সে আমাকে আস্তে আস্তে হাতে তুলে নিয়ে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করল কিন্তু আমি তখন এতই ভয় পেয়েছি যে মুখ দিয়ে কথা সরছে না। স্বাভাবিক হতে কয়েক মিনিট সময় লাগল, তখন সে আমাকে আমার নার্সের কাছে নিয়ে গেল। ইতোমধ্যে আমার নাসও যেখানে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল সেখানে ফিরে এসেছে এবং আমাকে সেখানে দেখতে না পেয়ে ও ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভয় পেয়ে গেছে। মালিও সেই সময়ে সেখানে পৌঁছল। আমাকে নিয়ে তখন সব শুনে মালিকে খুব বকাবকি করল সে। তবে গ্লাম সমস্ত ব্যাপারটা চেপে গেল কারণ মহারানির কানে উঠলে সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। আমিও চাই না যে ব্যাপারটা আর কেউ জানুক কারণ এদের তুলনায় ছোটো হলেও আমার মতো একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে কুকুর মুখে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেটা আমার পক্ষে লজ্জার কথা। এই দুর্ঘটনার ফলে গ্লামডালক্লিচ আমাকে একা তো দূরের কথা বাইরের নিয়ে গেলেও আমাকে আমার ঘরের বাইরে বার করত চাইত না বা চোখের আড়াল করত না।

আমার এরকমই ভয় ছিল তাই কয়েকটা দুর্ঘটনা তাকে বলি নি। ঘটনাগুলো ঘটেছিল যখন গ্লাম আমাকে ছেড়ে দিত। একদিন আমি একা বাগানে বেড়াচ্ছি এমন সময় আকাশে উড়ন্ত একটা চিল আমাকে ঠিক নজর করেছে আর নজর করা মাত্রই আমার দিকে ছোঁ মেরেছে । আমি তাড়াতাড়ি আমার ছোরা বার করেছি কিন্তু তা দিয়ে কি বিশাল চিল আটকানো যায় । ও ঠিক ওর নখ দিয়ে আমাকে তুলে নিত কিন্তু কাছেই ছিল একটা লতা গাছের মাচা। আমি তার নিচে আশ্রয় নিয়ে কোনোরকমে নিজের প্রাণ রক্ষা করলাম । আর একবার। ছুঁচো মাটি খুঁড়ে গর্ত করবার সময় মাটি বার করে একটা ঢিবি তৈরি করেছে। ঢিবিটা নতুন, আমি বুঝতে পারি নি। কৌতূহল বশে তার মাথায় উঠতে গেছি কিন্তু নরম মাটির ভিতর ঢুকে গেছি। জামাকাপড় ময়লা হয়ে গেল। কারণ স্বরূপ গ্লামের কাছে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল। আর একবার একটা শামুকের খোলার সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে পা ভেঙেছিলাম। আমারই দোষ, দেশের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে বাগানে পায়চারি করছিলাম সেই সময়েই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

আমি যখন বাগানে একা একা বেড়াতাম তখন অনেক ছোটো ছোটো পাখি আমাকে গ্রাহ্য না করে আমার খুব কাছেই নেচে নেচে পোকামাকড় বা অন্য কোনো খাদ্য খুঁজে বেড়াত, আমার অস্তিত্বই তারা স্বীকার করত না। তা এজন্যে আমি আনন্দিত হতাম, না অনুতপ্ত হতাম, তা বলতে পারি না। গ্লাম ব্রেকফাস্ট করতে আমাকে কেক দিয়েছিল, তারই একটা টুকরো আমার হাতে ছিল। একটা থ্রাশ পাখি সেই টুকরোটা ঠোঁটে করে তুলে নিল, আমাকে একটুও ভয় করল না। পাখিগুলো ধরবার চেষ্টা করলে তারাই আমাকে তেড়ে আসত, হাতে বা আঙুলে ঠুকরে দিত। তাই আমি আর তাদের কাছে যেতাম না, তারাও আমাকে অগ্রাহ্য করে পোকা বা শামুক খুঁজে বেড়াত। কিন্তু একদিন আমি একটা মোটা কাঠ হাতের কাছে পেয়ে সেটা একটা লিনেট পাখিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম। ভাগ্যক্রমে কাঠটা পাখিটাকে আঘাত করল, পাখিটা পড়ে গেল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দুহাত দিয়ে পাখিটার গলা ধরে যেন যুদ্ধে জিতেছি এইভাবে আমার নার্সের কাছে ছুটে গেলাম। আঘাত পেয়ে পাখিটা হতচেতন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে আমার গায়ে মুখে ডানার ঝাপটা দিতে লাগল। নখ দিয়ে আঁচড়াবারও চেষ্টা করতে লাগল তখন আমি ওটাকে দূরে ধরে রইলাম। কাছেই একজন ভৃত্য ছিল, সে পাখিটাকে আমার হাত থেকে নিয়ে ঘাড় মটকে মেরে ফেলল। মহারানি আদেশ দিলেন পাখিটা রান্না করে পরদিন আমার ডিনারের সঙ্গে দিতে । আমার যতদূর মনে পড়ছে লিনেট পাখিটা আকারে ইংল্যান্ডের একটা রাজহাসের সমান হবে।

রানির সহচরীরা প্রায়ই গ্লামডালক্লিচকে তাদের কক্ষে যেতে বলত এবং আমাকে সঙ্গে নিয়েই যেতে বলত। আমি যেন খেলনার সামগ্রী। আমাকে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবে। তারা প্রায়ই আমাকে কোলে করে ঘুরে বেড়াত। আমার খুব খারাপ লাগত, বিরক্তি বোধ করতাম । সত্যি কথা বলতে কি তাদের গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোত । এই সকল অভিজাত মহিলাদের এমন অপবাদ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয় এবং তাদের আমি শ্রদ্ধাও করি কিন্তু আমি ওদের তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও ওরা আমার তুলনায় বিরাট। অতএব ওদের দেহের সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ আমার নাকে তীব্রভাবে আঘাত দেবেই। অথচ এই সকল মহিলাদের দেহের গন্ধ তাদের প্রিয়জনকে পীড়িত করে না, ঠিক যেমন আমাদের দেশে আমরা আমাদের তুল্য ব্যক্তিদের দেহের গন্ধ টের পাই না। তবে এই মহিলারা দেহে যখন সুগন্ধ লাগাতেন তখন বদ গন্ধ দূর হত বটে কিন্তু সেই সুগন্ধও আমার নাকে তীব্র আঘাত করত এবং আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম।

আমার মনে পড়ছে লিলিপুটদের দেশে এক গ্রীষ্মের দিনে সবে ব্যায়াম শেষ করেছি সেই সময় আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এসেছিল। সে অভিযোগ করল আমার গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। আমার গায়ের গন্ধের জন্যে আমি দায়ী নই কিন্তু এখানে যেমন এই দৈত্যদের গন্ধ আমার নাকে লাগছে ঠিক তেমনি লিলিপুটদের নাকেও আমার গায়ের গন্ধ আঘাত করেছিল। তবে মহারানির বা আমার নার্স গ্লামডালক্লিচের দেহের গন্ধ, আমাকে পীড়িত করে নি বরঞ্চ ইংরেজ মহিলাদের মতোই তাদের দেহ থেকে সুবাসই নির্গত হত।

আমার নার্স যখন আমাকে মহারানির এই সকল সহচরীর কাছে নিয়ে যেত তখন আমার খুব অস্বস্তি হত । বাগানের ঐ পাখিদের মতো ওরা আমাকে ছোটো হলেও মানুষ বলে গ্রাহ্যই করত না। ভাবত আমি বোধহয় দেওয়ালের একটা টিকটিকি বা ওদের পোষা বিড়াল । খেলনা মনে করে ওরা আমাকে তাদের সামনে সব সময় বসিয়ে রাখত। এ আমি সহ্য করতে পারতাম না, তাদের অত্যন্ত কুশ্রী মনে হত। দেহের অসমান জমি, এখানে ওখানে খানা খন্দ, এখানে একটা তিল ওখানে একটা আঁচিলের ঢিবি। কারো হাত পা ভরতি লোমের জঙ্গল । তাছাড়া তাদের পুরো দেহটাও আমি অত কাছ থেকে দেখতে পেতাম না, নাকে শুধু গন্ধটাই আঘাত করত। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল একটি ষোড়শী তবে শান্ত নয়, হরিণের মতো চঞ্চলা। আমাকে দু আঙুলে টপ করে তুলে নিয়ে তার বুকের ওপর ঘোড়ায় চড়ার মতো করে বসিয়ে দিত। এ ছাড়া আমাকে নিয়ে কত রকম খেলা করত, আমি তার বিবরণ দিলে পাতা ভরে যাবে, পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এতদূর বিরক্ত হয়েছিলাম যে গ্লামডালক্লিচকে বললাম আমাকে যেন ঐ চঞ্চলা ষোড়শীর কাছে নিয়ে না যায়, কোনো একটা ছুতো করে যেন এড়িয়ে যায়।

আমার নার্সের গভরনেসের ভাইপো একদিন এসে একজন আসামীর প্রাণদণ্ড দেখবার জন্যে ওদের দুজনকে অনুরোধ করল। সেই আসামী ঐ ভাইপোর এক ঘনিষ্ঠ পরিচিত ব্যক্তিকে খুন করেছে । গ্লামডালক্লিচ কোমল হৃদয়া, এসব দৃশ্য তার ভালো লাগে না, সহ্য করতে পারে না, তবুও সেই যুবক চাপাচাপি করল । আমি নিজে যদিও এসব দৃশ্য দেখতে অনিচ্ছুক তথাপি আমার কৌতূহল হল, অসাধারণ কিছু দেখার আশায়। নির্ধারিত স্থানে গিয়ে দেখলাম একটা মাচা বাঁধা হয়েছে, তার ওপরে একটা চেয়ারে আসামীকে বসানো হয়েছে। ঘাতক এসে চল্লিশ ফুট লম্বা একটা তলোয়ার দিয়ে এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে কাটা গলা দিয়ে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরাতে লাগল, ভার্সাইয়ের ফোয়ারা তার কাছে তার মেনে যায়। মঞ্চ থেকে আমি এক মাইল দূরে ছিলাম কিন্তু বিরাট মাথাটা যখন মঞ্চের নিচে আওয়াজ করে পড়ল, আমি চমকে উঠেছিলাম।

মহারানি আমার সমুদ্রযাত্রার গল্প শুনতে ভালোবাসতেন কিন্তু আমি যখন একা বসে নিজের কথা ভাবতাম রানি তখন আমার বিষণ্নতা দূর করবার জন্যে আমার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতেন । একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি নৌকো চালাতে, পাল তুলতে, বা দাঁড় টানতে পারি কিনা। তাহলে একটু দাঁড় টানতে পারলে ব্যায়াম করাও হবে, মনটাও ভালো থাকবে। আমি বললাম এসব বিদ্যা আমার জানা আছে। যদিও আমার চাকরি ছিল জাহাজের সার্জন বা ডাক্তাররূপে তবুও আমাকে অনেক সময় জাহাজে নাবিকের কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না এখানে আমার মাপমতো নৌকো কোথায় পাওয়া যাবে? যেখানে এদের ক্ষুদ্রতম নৌকোটি আমাদের একটা বড় যুদ্ধ জাহাজের সমান আর যদিও আমার জন্যে একটা নৌকো জোগাড় হয় তাহলে সে নৌকো আমি চালাব কোথায়? এ দেশের বিশাল নদীতে সে নৌকো টিকবে না। কিন্তু রানি দমে যাবার পাত্রী নন। তিনি বললেন আমি নৌকোর নকশা করে দিলে তার ছুতোর মিস্ত্রি নৌকো বানিয়ে দেবে এবং আমার নৌকো চালাবারও তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।

ওঁরা আমাকে খেলনার পুতুল মনে করেছেন। খেলনার পুতুল কথা বলে না কিন্তু আমি কথা বলি তাই মেয়েদের আমাকে নিয়ে এত মাতামাতি। মিস্ত্রি এল। লোকটি বেশ কুশলী। আমার নির্দেশ অনুসারে সে দশ দিনের মধ্যে সব সাজসরঞ্জামসহ সুন্দর একটা নৌকো বানিয়ে দিল যাতে আটজন ইউরোপীয়ান বসতে পারে। নৌকো শেষ হতে রানি এতদূর খুশি হলেন যে তিনি নৌকোটা কোলে নিয়ে রাজাকে দেখাতে ছুটলেন। রাজাও খুশি হয়ে উৎসাহের সঙ্গে বললেন পরীক্ষা করবার জন্যে ওকে নৌকোয় বসিয়ে ঐ ছোটো চৌবাচ্চাটায় ভাসিয়ে দাও। কিন্তু সেই চৌবাচ্চাটা এত ছোটো যে আমি দুহাতে দুটো দাঁড় টানবার মতো জায়গা পাচ্ছিলাম না। কিন্তু মহারানি অন্য একটা পরিকল্পনা আগেই স্থির করে রেখেছিলেন। তিনি মিস্ত্রিকে আদেশ করলেন আমার জন্যে তিনশ ফুট লম্বা আর পঞ্চাশ ফুট চওড়া একটা চৌবাচ্চা বানিয়ে দিতে, দেখো কোথাও যেন ফুটো থাকে না। চৌবাচ্চা শেষ হতে প্রাসাদের বাইরের দিকে একটা বড় ঘরে রাখা হল এবং জল ভর্তি করা হল। ছিদ্র ছিল শুধু একটা, জল ময়লা হয়ে গেলে সেই ছিদ্র দিয়ে জল বার করে ছিদ্রপথ বন্ধ করে দেওয়া হত। দুজন পরিচারক সহজে আধ ঘণ্টার মধ্যে সেই কাঠের চৌবাচ্চায় জল ভর্তি করে দিত। মহারানি ও তাঁর সহচরীদের এবং আমার নিজেরও মনোরঞ্জনের জন্যে আমি সেই চৌবাচ্চায় নৌকো চালাতাম। এত ক্ষুদে মানুষ এমন সুন্দরভাবে নৌকো চালাচ্ছে দেখে রানি ও মহিলারা দারুণ কৌতুক বোধ করতেন।

সময় সময় আমি পাল তুলে দিয়ে হাল ধরে থাকতাম আর মহিলারা তাঁদের পাখা দিয়ে বাতাস দিতেন। মহিলারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে, তাদের হাত ব্যথা করতে থাকলে বালক ভূতরা ফুঁ দিত। পাল ফুলে উঠে নৌকো তরতর করে চলত আমি ইচ্ছামতো নৌকো এদিক ওদিক চালাতাম। আমার নৌবিহার শেষ হয়ে গেলে গ্লামডালক্লিচ নৌকোটিকে তুলে জল ঝেড়ে সেটিকে তার ঘরে একটা পেরেক টাঙিয়ে শুকোতে দিত। এই নৌকো চালানোর ব্যাপারে একদিন এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটল যে আর একটু হলেই আমি মরে যেতাম। চৌবাচ্চায় নৌকা ভাসানো হয়েছে। গ্লামের গভরনেস আমাকে নৌকোয় বসিয়ে দেবার জন্যে যত্নসহকারে দু আঙুলে আমাকে উঠিয়ে নিলেন আর ঠিক সেই সময়ে আমি তার আঙুল ফসকে পড়ে গেলাম। তার মানে তার আঙুল থেকে চল্লিশ ফুট নিচে । অত নিচে পড়ে গেলে আমার গতর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত কিন্তু আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে গভরনেসের কোমরের বেল্টে কয়েকটা মাথার কাঁটা গোঁজা ছিল, সেই একটা পিনে আমার শার্ট আটকে গেল, আমি শূন্যে ঝুলতে থাকলাম ও প্রাণে বেঁচে গেলাম। গ্লামডালক্লিচ কাছেই ছিল সে ছুটে এসে আমাকে উদ্ধার করল।

আর একদিন আমার একটা ঘটনা ঘটল। একজন ভৃত্যের কাজ ছিল প্রতি তৃতীয় দিনে চৌবাচ্চাটি টাটকা জল দিয়ে ভর্তি করা। সেদিন সে বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিল তাই তার বালতিতে যে একটা জ্যান্ত ব্যাঙ ছিল তা সে দেখতে পায় নি। অতএব জলের সঙ্গে ভেক মহারাজ আমার চৌবাচ্চায় আশ্রয় নিল। ব্যাঙটা জলের নিচে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে ছিল কিন্তু যেই আমাকে সমেত নৌকো জলে ভাসিয়ে দিল ব্যাঙও অমনি বসবার একটা জায়গা দেখতে পেয়ে নৌকোর উপর উঠে পড়ল। ফলে নৌকো একদিকে ঝুঁকে পড়ল । নৌকো বুজি উলটে যায়, ভারসাম্য বাজায় রাখবার জন্যে আমি নৌকোর অপর দিকে ঝুঁকে পড়লাম। যাতে না নৌকো উলটে যায়। ব্যাঙ তখন নৌকোর মধ্যে লাফালাফি আরম্ভ করল আর সেই সঙ্গে তার গায়ের ময়লা আমার মুখে ও জামা প্যান্টে লাগিয়ে দিতে লাগল । ব্যাঙ বড় বিশ্রী প্রাণী, দেখল ঘৃণা করে। গ্লামকে বললাম আমি একাই ওর মোকাবিলা করব। আমি একটা দাঁড় নিয়ে ওটাকে পেটাতে আরম্ভ করলামএবং শেষ পর্যন্ত ব্যাটাকে তাড়াতে পারলাম। সে নৌকো থেকে লাফ মেরে নিচে নামল।

সে রাজ্যে আমি সবচেয়ে যে বিপদে পড়েছিলাম তা হল রন্ধনশালার এক কর্মীর একটি পোষা বাঁদরের জন্যে। গ্লামডালক্লিচ আমাকে তার ঘরে বন্ধ করে রেখে কোনো কাজে গেছে বা কারো সঙ্গে দেখা করতে গেছে। সেদিন বেশ গরম ছিল ঘরের জানালা খোলা ছিল। আমি ছিলাম আমার বড় বাক্স ঘরে, বেশির ভাগ সময়ে সেই ঘরে থাকতাম। আমার ঘরের দরজা জানালাও খোলা ছিল। বড় বাক্স-ঘরের ছোটো ঘরটা বেশি আরামদায়ক, হাত পা বেশ স্বচ্ছন্দে খেলানো যায়। টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে নানা চিন্তা করছি এমন সময় মনে হল গ্লামের ঘরের জানালায় কিছু একটা লাফিয়ে পড়ল আর সেটা জানালার এদিকে ওদিকে লাফালাফি করছে। আমি ভয় পেলেও চেয়ার থেকে না উঠে সাহস করে জানালার দিকে চেয়ে দেখলাম জানোয়ারটা এদিক থেকে ওপর নিচে লাফালাফি করতে করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আমার বাক্স-ঘরের সামনে এসে পড়ল।

আমার ঘরটা তার পছন্দ হল, বুদ্ধিমান মানুষের ভঙ্গিতে সে আমায় ঘরের দরজা ও জানালার ভেতর দিয়ে দেখতে লাগল। আমি আমার বাক্স-ঘরের যতদূর পারলাম ভেতর দিকে ঢুকে গেলাম কিন্তু বাঁদরটা তখন সব কটা জানালার ভিতর দিয়ে ঘরের ভিতরটা নজর করতে লাগল আর আমার ভয়ও তত বাড়তে লাগল। আমার উপস্থিত বুদ্ধি বলল খাটের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে এবং আমি তাও হয়তো পারতাম। কিন্তু বাঁদরটা উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে কিচিমিচি করতে করতে আমাকে ভালো করেই দেখে ফেলল।

বিড়াল যেভাবে ইঁদুর ধরে বাঁদরটাও সেইরকম কায়দা করে একটা হাত আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিল । আমি যদিও নিজেকে বাঁচাবার জন্যে বাঁদরটাকে এড়াবার চেষ্টা করছি এবং আমার স্থান পরিবর্তন করছি কিন্তু বাঁদরও তেমনি আমার নাগাল পাবার চেষ্টা করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তারই জয় হল। সে আমার কোর্টের একটা প্রান্ত ধরে ফেলল আর কোট তো ওদের সিল্কের তৈরি অতএব বেশ মজবুত ও মোটা, ছিঁড়ল না। বাঁদর আমার সেই কোট ধলে আমাকে ঘর থেকে টেনে বার করল। ধাই মা যেমন ভাবে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার জন্যে কোলে নেয় বাঁদরটা আমাকে সেই ভাবে তার ডান দিকের উরুতে তুলে নিল । আমি ইউরোপেও দেখেছি বাঁদর তার বাচ্চাকে এইভাবে কোলে তুলে নেয়। আমি হাত পা নেড়ে নিজেকে মুক্ত করবার যত চেষ্টা করি বাঁদরটা আমাকে ততই চেপে ধরে।

আমি বুঝলাম চুপচাপ থাকাই ভালো নইলে আমার হাড়গোড় ভাঙবে। সে তার অপর হাত দিয়ে আমার গায়ে মৃদুভাবে হাত বোলাচ্ছিল, সে আমাকে অপর কোনো বাঁদরের বাচ্চা ভেবে নিয়েছিল। বাঁদরটাকে কেউ গ্রামের ঘরে ঢুকতে দেখেছিল কিন্তু দরজা বন্ধ ছিল তাই তারা ঘরের দরজায় সামনে এসে চেঁচামেচি করছিল বা দরজা খোলবার চেষ্টা করছিল। গোলমাল শুনে বাঁদরটা যে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, আমাকে নিয়ে হুপ্ শব্দ করে লাফিয়ে সেই জানালায় উঠল তারপর জানালা থেকে ছাদে, ছাদ থেকে লাফ মেরে পাশের বাড়ির ছাদে, আমাকে কিন্তু উত্তমরূপে ধরে আছে। আমি শুনতে পেলাম সেই দৃশ্য দেখে অর্থাৎ আমাকে বাঁদর নিয়ে যাচ্ছে দেখে সবাই চিৎকার করে উঠল। বেচারি গ্লাম তো মূৰ্চ্ছা যাবার উপক্রম। প্রাসাদের এই দিকটায় মহা সোরগোল পড়ে গেল, ভৃত্যেরা মই আনতে ছুটল, নিচে প্রাঙ্গণে কয়েক শত মানুষ জমায়েত হয়েছে।

বাঁদরটা আমাকে নিয়ে একটা বাড়ির ছাদের কিনারায় বসে আছে, আমাকে এক হাতে ধরে আছে আর অপর হাত দিয়ে আমাকে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করছে। আমি খাব না কিন্তু সে একটা থলি থেকে কী সব খাদ্যবস্তু বার করে আমার মুখে গুঁজে দিচ্ছে। নিচে যারা জমায়েত হয়েছে তাঁরা বাঁদরের রকম-সকম দেখে কৌতুক অনুভব করছে, হাসছে। তাদের দোষ দিতে পারি না, দৃশ্যটা উপভোগ করবার মতো যদিও ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, বুক ঢিব ঢিব করছে। নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হচ্ছে। বাঁদরটাকে তাড়াবার জন্যে কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়তে আরম্ভ করল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিষেধ করা হল কারণ সেই ঢিলের আঘাত আমাকে জখম করতে পারে।

এদিকে ছাদের চারদিকে মই লাগিয়ে মানুষ উঠে পড়েছে। বাঁদর দেখল তাকে এখনি ঘেরাও হতে হবে তখন সে আমাকে ছাদের একটা ঢালির ওপর আস্তে আস্তে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। মাটি থেকে পাঁচশত গজ উপরে বসে আমি তখন ভয়ে কাঁপছি। এখন অন্য ভয়, হাওয়ায় না আমাকে উড়িয়ে নিচে ফেলে দেয়। হাওয়া না ফেললেও আমি যেভাবে কাঁপছি বা নিচের দিকে চেয়ে আমার মাথা ঘুরছে তার ফলে নিচে পড়ে না যাই। মনের এই সঙ্কটজনক অবস্থায় সব শক্তিও নিঃশেষ, নড়বার ক্ষমতাটুকুও নেই। শেষ পর্যন্ত আমার নার্সের একটি ছোকরা পরিচারক আমার কাছে এসে আমাকে তার প্যান্টের পকেটে তুলে নিল এবং নিরাপদে নাময়ে আনল।

এদিকে আর এক বিপদ। বাঁদর আমার মুখে যেসব খাদ্যবস্তু গুঁজে দিয়েচিল আমি গিলতে পারি নি, গলায় আটকে আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম। গ্লাম আমার অবস্থা বুঝতে পেরে একটা সুচের মাথা দিয়ে কতকগুলো খাদ্যবস্তু বার করতে আমি বমি করে ফেললাম । এবার আমি স্বস্তি বোধ করলাম। কিন্তু সেই জঘন্য জীবের আদরের ঠেলায় আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, পাঁজর ও শরীরের অন্য স্থানে বেদনা বোধ করছিলাম।

আমি শুয়ে পড়লাম, পনের দিন লাগল বিছানা ছাড়তে সুস্থ হতে। মহারাজা, মহারানি ও রাজদরবারের সভাসদরা আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রায়ই খোঁজখবর নিতেন। এই সময়ে মহারানি নিজেও কয়েকবার আমার শয্যাপার্শ্বে এসেছিলেন। বাঁদরটাকে মেরে ফেলা হল এবং এই রকম কোনো জানোয়ার রাজপ্রাসাদে আনা বা রাখা নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

সুস্থ হয়ে উঠে আমি মহারাজাকে তাঁর দয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানাতে গেলাম। তিনি আমাকে সুস্থ দেখে আনন্দিত হলেন এবং ভাগ্রক্রমে আমি যে বিপদ থেকে মুক্ত হতে পেরেছি সেজন্যে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। বাঁদরটা যখন আমাকে ধরে নিয়ে গেল তখন আমার মনোভাব কী রকম হয়েছিল, বাঁদরটা আমাকে যা খেতে দিয়েছিল সেটা কী রকম, ছাদের ওপর তাজা হাওয়া কি আমার ক্ষিধে বাড়িয়েছিল? এমন সব মজার মজার প্রশ্ন করতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন আমার নিজের দেশে বাঁদর আমাকে আক্রমণ করলে আমি কী করতাম? আমি বললাম ইউরোপে বাঁদর নেই, কেউ হয়তো কৌতূহল বশে এনে পোষে, খাঁচায় বন্ধ করে রাখে আর যদিও বা আমাকে আক্রমণ করত, তারা এত ছোটো যে দশ বারটা বাঁদরের সঙ্গে আমি একাই মোকাবিলা করতে পারতাম। আর এখানকার বিশাল বাঁদরটা যেটা একটা হাতির সমান, যখন আমাকে ধরবার জন্যে আমার ঘরের ভেতর তার হাতটা ঢুকিয়েছিল তখন আমি ভয়ে আমার ছোরার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। নইলে ছোরা দিয়ে তার হাতে বার বার খোঁচা দিলে সে হয়তো যত তাড়াতাড়ি হাত ঢুকিয়েছিল তত তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিত। এই কথাগুলো আমি বেশ জোর দিয়েই বলেছিলাম, ভাবটা এমন যেন আমি কারো পরোয়া করি না।

কিন্তু আমার সাহসিকতাপূর্ণ এই বক্তৃতা মহারাজা বা তাঁর আমাত্যদের ওপরে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না উপরন্তু সকলেই বেশ জোরে হেসে উঠল। আমাত্যগণও এভাবে হেসে ওঠায় আমি ব্যথিত হলাম। মহারাজার সামনে এভাবে হাসা অন্যায়, তাঁকে অসম্মান করা হয়। ইংল্যান্ডে এমন ঘটনা হয় না, এমন কি আমার চেয়ে নিম্নস্তরের ব্যক্তিরা আমার সামনে এভাবে হাসতে সাহস করবে না। ওরা নিশ্চয় ভেবেছিল ক্ষুদে মানুষটা বাঁদরের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে খুব বড় বড় কথা বলছে তো! আমিও বোধহয় তাই মনে মনে জ্বালা বোধ করছিলাম।

আমি মহারাজা ও মহারানিকে প্রতিদিন কিছু অসম্ভব গল্প শোনাতাম, গ্লাম বোধহয় আমার দুষ্টুমি বুঝতে পারত কিন্তু সে তো আমাকে খুব ভালোবাসত তাই রানি যদি আমার সেই সব অসম্ভব গল্প শুনে কিছু মনে করেন তাই সে রানিকে বলে রেখেছিল যে তাঁকে আনন্দ দেবার জন্যে ও কিছু মজা করবার জন্যেই আমি এই সব গল্প বলি । বেচারি গ্লামের শরীর কিছু খারাপ হয়ে পড়েছিল তাই হাওয়া বদলাবার জন্যে তাকে তার গভরনেসের সঙ্গে শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরে যা অতিক্রম করতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, তেমন একটা জায়গায় পাঠানো হল। একটা মাঠে চলনপথে গাড়ি থামিয়ে ওরা নামল। গ্লামডালক্লিচ আমার বাক্স-ঘর নিচে নামিয়ে দিল। আমি বাক্স থেকে বেরিয়ে এলাম, একটু চলে ফিরে হাত পা ছাড়িয়ে দিতে চাই আর কি? পথে এক জায়গায় গোবর ছিল। ভাবলাম এটা লাফ মেরে ডিঙিয়ে যাওয়া যাক। লাফ মারবার জন্যে আমি দৌড় লাগালাম এবং জায়গা বুঝে লাফ দিলাম কিন্তু হায়! বিচারে ভুল করেছিলাম, লাফ ছোটো হয়ে গিয়েছিল ফলে পড়লাম গোবরের মাঝখানে, আমার হাঁটু ডুবে গেল। কোনোরকমে গোবর থেকে বেরিয়ে এলাম, দুপায়ে গোবর লেগে গিয়েছিল, একজন সহিস তার রুমাল দিয়ে আমার দুই পা মুছিয়ে দিল। যতটা পারল সে পরিষ্কার করে দিল কিন্তু গ্লাম আমাকে আমার বাক্স ঘরের মধ্যে বন্ধ করে দিল এবং প্রাসাদে না ফেরা পর্যন্ত আর বার করল না। প্রাসাদে ফিরে গ্লাম আমার দুর্দশার কাহিনী রানিকে বলতে ভুলল না এবং সেই সহিসও রঙ চড়িয়ে আমার লাফ মারার গল্পটি বলল। অতএব আমাকে নিয়ে সর্বত্র কয়েক দিন ধরে বেশ হাসাহাসি চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *