সপ্তম পরিচ্ছেদ
[ লেখকের দেশপ্রেম। লেখক মহারাজার কাছে সুবিধাজনক একটা প্রস্তাব পেশ করল কিন্তু মহারাজা তা প্রত্যাখ্যান করলেন। রাজনীতি সম্বন্ধে মহারাজার অজ্ঞতা। সে দেশ শিক্ষা ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ। তাদের আইন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক পার্টি ।]
সত্যবাদীতার প্রতি আমার তীব্র আসক্তি না থাকলে আমি আমার কাহিনীর এই অংশ লিখতাম না। আমার দেশের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য শুনে আমি অন্তরে ক্রোধান্বিত হলেও আমাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। এই সব মন্তব্য শুনে আমি নিজেও যেমন দুঃখবোধ করেছিলাম আমার পাঠকগণও নিশ্চয় সেইরকম দুঃখবোধ করবেন কিন্তু মহারাজা প্রতিটি বিষয়ে এত কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু, সহৃদয় ও কৃতজ্ঞ যে তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমি এড়িয়ে গেছি তবে যেগুলোর উত্তর দিয়েছি তাতে আমার দেশকে সর্বদা বড় করেই দেখিয়েছি, কোথাও ছোটো করবার চেষ্টা করি নি। অবশ্যই দেশ বা দেশবাসীর কিছু ত্রুটি থাকতে পারে, সেগুলো আমি কখনই বড় করে দেখাই নি এবং আমার দেশের যা কিছু ভালো তা আমি সব সময়েই সামনে ধরেছি। যদিও সেই মহান সম্রাট আমার সবকিছু শুনে প্রভাবিত হন নি, তাঁর দৃষ্টিতে আমাদের ভালো তাঁর কাছে মন্দ মনে হয়েছে।
কিন্তু এই রাজাকে ক্ষমা করা যেতে পারে কারণ তিনি পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিহীন হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছেন। নিজের দেশ ছাড়া অন্য যে কোনো দেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞ এবং অন্য দেশের কোনো পরিচয়ই তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয় । ফলে তার মনের প্রসারতা না থাকতেই পারে, যে কোনো দেশের সবই দোষ নয়, গুণও আছে। যাঁরা উদার হৃদয় হয় তাঁরা দোষ বর্জন করে গুণ বড় করে দেখেন কিন্তু রাজার অন্য দেশ ও অন্য মানুষ সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাই তাঁর মন একটা সংকীর্ণ ক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারে, অতএব তাঁর এই মনোভাব মেনে না নেওয়াই ভালো।
আমি যা বলেছি তার সমর্থনে কিছু বলব এবং সীমাবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা কী ক্ষতি করতে পারে তাও আমি দেখাব তবে তা হয়তো অনেকে বিশ্বাস করবে না। মহারাজার অনুগ্রহ লাভ করবার আশায় আমি তাঁকে একটি আবিষ্কারের কথা বললাম। যে আবিষ্কার অন্তত ‘তিন চারশ’ বৎসর পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁকে বললাম একরকম চূর্ণ আছে যাতে একটা আগুনের ফুলকি পড়লেই সেটি দপ করে জ্বলে উঠবে এবং তখন বাজ পড়ার চেয়েও জোের শব্দ হতে পারে। ঐ চূর্ণ একটি পেতল বল রেখে যদি তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয় তাহলে বলটি সশব্দে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অনেক দূরে নিক্ষিপ্ত হবে।
তবে সবই নির্ভর করবে ফাঁপা নল বা বলের আকারের ওপর। খুব বড় একটা বল এইভাবে নিক্ষেপ করলে একটা পুরো সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারে, খুব মজবুত দেওয়ালকে মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে, হাজার লোক সমেত জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে। আর বলের সঙ্গে একটা শেকল লাগিয়ে দিল জাহাজের পাল ও মাস্তুল কেটে দ্বিখণ্ডিত করে মানুষজনকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। আমরা যখন কোনো শহর অবরোধ করি তখন একটা বড় লৌহবলের ভিতর ঐ চূর্ণ ভর্তি করি এবং নলের ভিতর।সেই বল রেখে ঐ চূর্ণে আগুন লাগিয়ে সেই বল অবরুদ্ধ শহরের উপর ফেলি। শহরে সেই বল পড়ে ফেটে যায়, বাড়ি ঘরদোর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়, বল ফেটে লোহার যেসব।টুকরো তীব্র গতিতে ছিটকে পড়ে তার আঘাতে মানুষের তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হয়, শরীর চূর্ণ বিচূর্ণ হয় ।
আমি মহারাজাকে বললাম কী উপাদান এবং কত ভাগ মিশিয়ে সেই চূর্ণ তৈরি করতে হয় তা আমি জানি। উপাদানগুলোও সহজে পাওয়া যায় এবং ঐ ফাঁপা নল ও বল, আমি মহারাজার মিস্ত্রিদের নির্দেশ দিয়ে তৈরি করিয়ে দিতে পারি। নল ও বল মহারাজার দেশের প্রচলিত মাপ মতোই হবে। এই ধরুন দু’শ ফুট লম্বা আর বিশ বা তিরিশ ফুট ব্যাসের। আর বড় করবার দরকার হবে না। বলও সেই অনুপাতে তৈরি হবে। ঐ ফাঁপা নলের ভেতর উপযুক্ত পরিমাণ চূর্ণ ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালে যে কোনো শহরের সবচেয়ে মজবুত দেওয়াল ও বাড়িঘর উড়ে যাবে। কোনো শহর যদি মহারাজার।অবাধ্য হয় তাহলে পুরো শহরটাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়। মহারাজা আমার প্রতি যে অনুগ্রহ দেখিয়েছেন এবং আমাকে আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছেন তারই প্রতিদানে আমি বিনীতভাবে ও কৃতজ্ঞচিত্তে আমার প্রস্তাব পেশ করলাম।
আমার প্রস্তাব ও ধ্বংসের বিবরণ শুনে ও যন্ত্রের কার্যকারিতা উপলব্ধি করে মহারাজা রীতিমতো অবাক ও ভীত হলেন। আমাদের মতো ক্ষুদ্র একটা পোকা কী করে এমন। ভীষণ ও ভয়ঙ্কর একটা ধারণা কল্পনা করতে পারে ভেবে তিনি বিস্মিত! কী সাংঘাতিক! যে মানুষ প্রথম এই রকম মারাত্মক অস্ত্র আবিষ্কার করেছে সে নিশ্চয় একটা শয়তান। তিনি বললেন চারুকলা, কোনো শিল্প বা কলাকৌশলের আবিষ্কারের প্রতি তিনি আগ্রহী I কিন্তু এমন একটা অস্ত্র প্রয়োগ করা অপেক্ষা তিনি তাঁর অর্ধেক রাজত্ব ত্যাগ করতে রাজি আছেন এবং আমার যদি প্রাণের ভয় থাকে তাহলে আমি যেন এ বিষয়ে দ্বিতীয় বার আর উল্লেখ না করি ।
মহারাজার অনেক গুণ, তিনি জ্ঞানী, বিদ্বান, বহুবিষয়ে চর্চা করেন, সুশাসক, অমায়িক, প্রজানুরঞ্জনকারী কিন্তু যেহেতু তিনি একটা সীমাবদ্ধ স্থানে বাস করেন, অন্য জগতের অস্তিত্বই জানেন না, অন্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, নেই কোনো ভাবের আদান প্রদান, সেইজন্যে তিনি সংকীর্ণমনা। নিজের দেশ ছাড়া আর কিছু তিনি জানেন না। ইনি যদি ইউরোপের রাজা হতেন তবে তিনি অন্য মানুষ হয়ে যেতেন, জ্ঞানের পরিধি অনেক বাড়ত, রাজার যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার, যার দ্বারা তিনি সুশাসক হতে পারেন, সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারেন, এইসব ক্ষমতা ও গুণ তিনি অর্জন করতে পারতেন। আমি মহারাজাকে ছোটো করতে চাই না। কিন্তু পাঠকদের কাছে তিনি মর্যাদা লাভ করতে পারবেন না। তবুও রাজার একদিকে জ্ঞান যেমন প্রচুর অজ্ঞানতা তেমনি সীমাহীন । রাজা হিসেবে তিনি রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করেন নি, কারণ এ দেশে সে সুযোগ নেই । ইউরোপ হলে ভিন্ন হত।
একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে মহারাজাকে আমি বলছিলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজ্য পরিচালনা সম্বন্ধে ইউরোপে প্রচুর বই আছে । এ কথা শুনে তিনি উৎসাহিত হলেন না উপরন্তু আমাদের বিষয়ে তাঁর নিচু ধারণা জন্মাল। রাজার উত্তম কূটনৈতিক হওয়া উচিত। এ কথা মানতেও মহারাজা প্রস্তুত নন। রাষ্ট্রের কোনো গোপনতা রক্ষার দরকার নেই, সবকিছুর তাৎক্ষণিক সমাধান করে ফেলাই ভালো। তার জন্যে কিছু সাধারণ জ্ঞান, কিছু বুদ্ধি, কিছু উদারতা থাকলেই যথেষ্ট। তবে বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনা অব্যশই থাকা দরকার। আর দরকার সাহস। এই সব গুণ থাকলেও উত্তম শাসক হওয়া যায়,এই হল মহারাজার ধারণা। তিনি বলেন যে ব্যক্তি একই জমিতে একবার শস্য ফলাতে পেরেছে সেই ব্যক্তি সেই জমিতে আবার শস্য ফলাতে পারবে। তারাই মানব চরিত্র যথাযথ বুঝতে পারে এজন্যে কোনো রাজনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না।
মুশকিল হল এই যে এই সব দৈত্য সদৃশ্য মানুষদের শিক্ষানীতি ত্রুটিযুক্ত, ওদের শুধু শেখানো হয় নীতিজ্ঞান, ইতিহাস, কাব্য ও গণিত। এই সব বিষয়ে ওদের নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। দৈনন্দিন জীবন যাপন করার পক্ষে বিষয়গুলো উপযোগী। ওরা কৃষি ও ফসলের কিছু উন্নতি করেছে, কারিগরী বিদ্যাও কিছু আয়ত্ত করেছে, কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারছে না। শুধু মাত্র এই কয়েকটি বিদ্যা আয়ত্ত করে আমরা সন্তুষ্ট থাকিতে পারি না। উচ্চ স্তরের কোনো ধ্যানধারণা বা অতিপ্রাকৃত বিষয়েও আমি তাদের আকৃষ্ট করতে পারি নি, বোঝাতে পারি নি যে এসবেরও প্রয়োজন আছে।
ওদের বর্ণমালার সংখ্যা বাইশটি। মজার বিষয় যে ওদের যে কোনো প্রচলিত আইন বাইশটি শব্দের মধ্যেই আবদ্ধ। কয়েকটি মাত্র ঐ সংখ্যা অতিক্রম করেছে। আইন অবশ্য সহজ ভাষাতেই লেখা। শব্দ বিন্যাসে কোনো জটিলতা নেই, কিন্তু সেই আইনের অন্যরকম ব্যাখ্যাও যে হতে পারে এ জন্যে ওরা মাথা ঘামায় না। কারণ ওরা বেশি মাথা ঘামাতে প্রস্তুত নয়। যদিও বা কেউ সাহস করে কোনো আইনের প্রতিবাদ করতে চায় তা সেটি সর্বোচ্চ অপরাধরূপে বিবেচিত হবে। কি দেওয়ানী কি ফৌজদারী মামলায় যে রায় দেওয়া হয়, পরবর্তী কোনো মামলার তার নজির কেউ উল্লেখ করে না। বিচারক মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দেন।
এরা মুদ্রাযন্ত্রের ব্যবহার জানে, ছাপাখানা আছে, বই আছে কিন্তু ওদের পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। মহারাজার পাঠাগার সবচেয়ে বড় কিন্তু বইয়ের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করবে না। বারশ ফুট লম্বা একটি গ্যালারিতে বইগুলো সাজানো আছে । আমি ইচ্ছামতো বই নিয়ে পড়তে পারতাম, সে স্বাধীনতা আমার ছিল । মহারানির কাঠের মিস্ত্রী একটা যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছিল। সেটা রাখা হল গ্লামডালক্লিচের একটা ঘরে।
যন্ত্রটা অনেকটা মইয়ের মতো, পঁচিশ ফুট উঁচু, পঞ্চাশ ফুট লম্বা, অনেকগুলা ধাপ আছে। যন্ত্রটা একজায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরানো যেত। যে বই আমি পড়তে চাইতাম। সেই বই দেওয়ালে একটা তাকে আটকে রাখা হত আর সেই মই যন্ত্রে উঠে সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে পড়তে আরম্ভ করতাম। মই-এর উপরের ধাপে একধার থেকে বইয়ের লাইনগুলো পড়তে পড়তে লাইনের শেষে পৌঁছতাম। এইভাবে কয়েকটা লাইন পড়া হলে পরেরটায় আসতাম। এরপর বইয়ের এক পাতার সব কটা লাইন পড়তে পড়তে নিচে নেমে আসতাম । তারপর আবার ওপরে উঠে পাতা উলটে পড়তে আরম্ভ করতাম । বইয়ের পাতাগুলো ছিল পিচবোর্ডের মতো মোটা আর এক একটা পাতা আঠার থেকে কুড়ি ফুট লম্বা। পাতা উলটাতে আমাকে দুটো হাতই লাগাতে হত।
ধাপে আমি ওদের অনেক বই পড়ে ফেললাম। বিশেষ করে ইতিহাস ও নীতিজ্ঞানের বই। এদের লেখার ধরন স্পষ্ট, বা লেখবার তা সোজাসুজি লিখেছে, অবান্তর একটা শব্দ বা কোনো অলঙ্কার ব্যবহার করে নি। বক্তব্যের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই ফলে ভাষার কোনো স্বাদ নেই ৷ নীতিজ্ঞানের যেসব বই তার মধ্যে আমি একখানা বই দেখেছিলাম গ্লামের ঘরে। বইখানা গ্রামের গভরনেসের। মহিলার বয়স হয়েছে রীতিমতো গম্ভীর, নিজেও নীতিজ্ঞান ও ভক্তিতত্ত্ব সম্বন্ধে বই লেখেন। বইখানা মানুষের নানা দুর্বলতা নিয়ে লেখা তবে যেভাবে লেখা তা পুরুষদের আকৃষ্ট করে না। পাঠকদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা বেশি। এদের লেখক নীতিজ্ঞান সম্বন্ধে কী লেখে আমার তা জানার আগ্রহ হল।
পড়ে দেখলাম লেখক ইউরোপীয় নীতিবাগীশ লেখকদের মতোই উপদেশ বিতরণ করেছেন, ব্যাখ্যাগুলাও প্রায় সেই রকম। লেখক বলেছেন মানুষ এক অসহায় জীব, মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে না, ঝড় ঝঞ্ঝা, হিংস্র বন্য পশু ইত্যাদি থেকে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। মানুষ পশুর কাছে পরাভূত, কত পশু আছে তারা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। কত পশুর গতি মানুষের চেয়েও বেশি। কারো অধিকতর দূরদৃষ্টিও আছে তারা আবার মানুষ অপেক্ষা পরিশ্রমী। তিনি লিখছেন যে প্রকৃতি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে, তার প্রাচুর্য ক্রমশ কমে আসছে, পূর্বে প্রকৃতি অধিকতর প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী মানুষ বা জীবজন্তুর জন্ম দিতে পারত কিন্তু এখন তা পারে না। এটা ভাবা অন্যায় হবে না যে পূর্বে মানুষের আকার বড় ছিল, দৈহিক গঠন আরো মজবুত ছিল। সেকালে প্রকৃতি দৈত্য ও অতিকায় জীবজন্তুর জন্ম দিতে পারত। এই রাজ্যের মাটির নিচে অনেক বিশাল আকারের খুলি বা কঙ্কাল, হাড় ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
বর্তমানে মানুষের আকার ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে এবং তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের আকৃতি আরো বড় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরো কঠিন হওয়া উচিত ছিল। কারণ বর্তমানে দুর্ঘটনা-ক্রমে একটা টালি খসে পড়ে আমাদের মাথা জখম করে ফেলতে পারে । দুষ্ট ছেলের ঢিলের আঘাতে কাতর হয়ে পড়ি, এমন কি ছোটো নদীতেও আমরা ডুবে যাই। লেখক এইরকম কিছু যুক্ত উপস্থিত করেছেন এবং কীভাবে এইসব বিপদ এড়িয়ে মানুষ জীবন যাপন করতে পারে তার জন্যে কিছু নৈতিক উপদেশ দিয়েছেন। প্রকৃতি নিয়ে নীতিজ্ঞান বা বাকবিতণ্ডা আমার তেমন পছন্দ হল না। তাছাড়া এসব তর্কেরও শেষ নেই। আমরা প্রকৃতিকে দেখি উদার দৃষ্টি দিয়ে কিন্তু এদেশের মানুষ দেখে সংকুচিত দৃষ্টিতে।
সামরিক বিভাগ নিয়ে ওদের অনেক গর্ব। মহারাজার আছে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার পদাতিক সৈন্য এবং বত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য। কিন্তু এটাকে ঠিক সামরিক বাহিনী বলা চলে না। কয়েকটি শহরের ব্যবসাদার ও গ্রামের কৃষকদের নিয়ে বাহিনী গঠিত, তাদের সেনাপতি মনোনীতি করা হয় কোনো অভিজাত পরিবারের কোনো ব্যক্তিকে এবং কারো কোনো বেতন নেই। এরা উত্তম কুচকাওয়াজ করতে পারে এবং শৃঙ্খলা মেনে চলে, শুধু এইজন্যে তাদের উত্তম যোদ্ধা বলা যায় না। ওদিকে প্রত্যেক কৃষক তাদের জমিদারের অধীন এবং ব্যবসাদাররা তাদের শহরের নিয়ন্ত্রণাধীন। সামরিক বিভাগে সৈন্য ভর্তি করার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম আছে বলে মনে হয় না। শহরের কাছে কুড়ি ফুট চৌকো একটা মাঠে এই লোরক্রগ্রুড শহরের ফৌজকে আমি প্রায়ই কুচকাওয়াজ করতে দেখেছি। এই ফৌজে প্রায় পঁচিশ হাজার পদাতিক ও ছয়হাজার অশ্বারাহী সৈন্য আমি দেখে থাকব। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না। কারণ বিরাটাকার শরীর নিয়ে ওরা যে মাঠে কুচকাওয়াজ করছিল এবং যারা দূরে ছিল তাদের যথাযথ ভাবে গণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। একজন অশ্বারোহী যে ঘোড়াটির উপর বসে আছে সেই ঘোড়াটি প্রায় নব্বই ফুট উঁচু। আমি দেখছি আদেশ পাওয়া মাত্রই এই অশ্বারোহী বাহিনী একসঙ্গে তাদের তলোয়ার সড়াৎ করে বার করে আন্দোলিত করতে লাগল । এমন বিস্ময়কর দৃশ্য চাক্ষুষ না দেখলে কল্পনা করা যায় না। মনে হয় যেন আকাশে বিশ হাজার বিদ্যুৎ একসঙ্গে ঝলসে উঠল।
কৌতূহলের বিষয় যে এ দেশের রাজা যার সঙ্গে অন্য কোনো দেশের যোগাযোগ একেবারেই নেই সে দেশের লোক একটা সৈন্যবাহিনী এবং তাদের সামরিক কুচকাওয়াজের কল্পনা কী করে করতে পারে? এ বিষয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে ও বই।পড়ে আমি কিছু জানতে পেরেছিলাম। এরাও আমাদের মতো সেই ব্যধিতে একদা ভুগেছিল, যে ব্যধির প্রভাবে রাজা চান প্রজাদের বশে রাখতে আর প্রজা চায় রাজাকে সরিয়ে নিজেরা বা নিজেদের মনোনীত ব্যক্তির হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে নিতে বা দিতে ।
দেশের তিনটি দল মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবার চেষ্টা করলে প্রচলিত আইনের সাহায্যে তাদের দাবিয়ে দেওয়া হয়। শেষ বিদ্রোহ ঘটেছিল বর্তমান মহারাজার দাদার আমলে। কিন্তু তিনি দক্ষতার সঙ্গে সেই বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন। তখন থেকে সামরিক বাহিনীকে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হচ্ছে।