তৃতীয় পরিচ্ছেদ
[ লেখককে রাজসভায় ডেকে পাঠানো হল। চাষী কর্তার কাছ থেকে রানি তাকে কিনে নিলেন এবং রাজার সামনে তাকে হাজির করলেন। লেখক সম্রাটের পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। প্রাসাদে লেখকের থাকবার ঘর ঠিক করে দেওয়া হল। সে অচিরে রানির প্রিয়পাত্র হল। লেখক নিজদেশের সম্মান রক্ষায় তৎপর। রানির বামনের সঙ্গে তার বিবাদ। ]
কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচুর পরিশ্রমের ফলে আমার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকল। আমাকে দেখিয়ে কর্তার যত আয় হয় ততই তার লোভ বেড়ে যায়। এদিকে আমার ক্ষিধে কমতে থাকে, রোগা হয়ে যাই, হাড় বেরিয়ে পড়ে। কর্তাও আমার স্বাস্থ্যের অবনতি লক্ষ করেছিল এবং ধরে নিয়েছিল আমি শীঘ্র মারা যাব তাই তিনি ভাবলেন ইতোমধ্যে যত পারেন তত টাকা তুলে নেবেন। তিনি যখন এইরকম ভাবছেন তখন স্পারডাল অর্থাৎ ভদ্রদূতের আগমন হল। তিনি কর্তাকে আদেশ করলেন যে রানি ও তাঁর সখিবৃন্দের চিত্তবিনোদনের জন্যে আমাকে অবিলম্বে রাজসভায় হাজির করতে হবে। যারা আমাকে এর মধ্যে দেখেছিল তাদের মধ্যে কেউ নিশ্চয় রানির কাছে আমার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিল । আমি কেমন, কী খাই, বা কথা বলি কিনা, ওদের ভাষা জানি কিনা, ইত্যাদির বিবরণ শুনেই হয়তো মহারানি আমাকে দেখবার জন্যে আগ্রহী হয়েছিলেন। আমাকে রানির সামনে হাজির করা হল। রানি ও তাঁর সহচরীরা আমার আচরণে মুগ্ধ। আমি রানির সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তাঁর পদচুম্বন করতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে টেবিলে তুলে দেওয়া হল। রানি তাঁর কড়ে আঙুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি আঙুলটি দুহাতে ধরলাম ও অগ্রভাগে আমার ওষ্ঠ স্পর্শ করলাম। রানি আমাকে আমার দেশ ও আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন, আমি যথাযথ স্পষ্ট করে ও সংক্ষেপে তার।উত্তর দিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি রাজপ্রাসাদে বাস করতে রাজি কি না। আমি কোমর বেঁকিয়ে মাথা নিচু করে মহারানিকে বিনীতভাবে বললাম আমি আমার কর্তার দাস কিন্তু আমার যদি স্বেচ্ছায় কাজ করার অধিকার থাকত তাহলে আমি নিশ্চয়।মহারানির সেবায় নিজেকে নিবেদন করে গৌরব বোধ করতাম। মহারানি তখন আমার কর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে কর্তা আমাকে ভালো দামে বিক্রী করতে রাজি আছে কি না। কর্তা তো ভেবেছিলেন আমি বড়োজার আর মাসখানেক বাঁচব অতএব আমাকে বেচে যা পাওয়া যায় তাই লাভ এবং আমার জন্যে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দাবি করল । এই অর্থ কর্তাকে অবিলম্বে দিয়ে দেওয়া হল। এক একটি স্বর্ণমুদ্রার আকার আটশত ময়ডোরের সমান। ইউরোপের তুলনায় এদেশের সব কিছুর আকার বিরাট তাই ইউরোপের চড়া সোনার দামের হিসেব করলে এখানকার এক একটি স্বর্ণমুদ্রার দাম ইংল্যান্ডে হাজার গিনিতে বিক্রয় হবে। এখন আমি মহারানির দাস। সাহস করে তাকে বললাম, গ্লামডালক্লিচ নামে এই মেয়েটি বরাবর আমাকে অত্যন্ত যত্ন ও করুণার সঙ্গে আমার দেখাশোনা করেছে এবং সে আমার আচার ব্যবহারের সঙ্গে সুপরিচিত। মহারানি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে গ্লামকে আমার নার্স ও শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত করতে পারেন।
মহারানি আমার আবেদনে সাড়া দিলেন। আমার প্রাক্তন কর্তাও রাজি হল কারণ মেয়ে রাজ বাড়িতে থাকবে আর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে। গ্লামও তার আনন্দ ঢাকতে পারল না, সেও খুব খুশি। আমার প্রাক্তন কর্তা এবার বিদায় নেবেন, আমাকে বললেন, তোমার ভালো ব্যবস্থাই করে গেলাম। আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নিচু করে তাকে বিদায় জানালাম।
রানি আমার দুর্বল শরীর লক্ষ করলেন এবং চাষী কর্তা চলে যাবার পর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। চাষী এখন আর আমার কর্তা নয়, আমি তার কাছে কোনো কাজ বা কথার জন্যে দায়ী নই তাই আমি রানিকে বললাম কী ভাবে সেই চাষী আমাকে তার ক্ষেতে হঠাৎ কুড়িয়ে পায় এবং আমার জন্যে সে যা করেছে তার প্রতিদানে আমাকে রাজ্যের প্রায় অর্ধেক দেশে দেখিয়ে ও বিক্রী করে অনেক গুণ বেশি লাভ করেছে।
এজন্যে আমাকে এত বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে যে আমার চেয়ে দশগুণ শক্তিশালী একটা প্রাণী মারা যেতে পারত। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কসরৎ দেখাতে দেখাতে আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, আর কিছুদিন পরে হয় আমি অথর্ব হয়ে পড়তাম বা মারা যেতাম তা নইলে আমার চাষী কর্তা আপনার কাছে আরো অনেক বেশি দাম দাবি করত, এত সস্তায় ছাড়ত না। কিন্তু তখন মহারানির আশ্রয়ে আমার আর নিষ্ঠুর ব্যবহারের ভয় নেই । মহারানি সর্বগুণসম্পন্না, দয়াবতী, প্রজাদের হিতকারী, তুলনাহীনা।
অতএব আমি মনে করি আমার মৃত্যুভয় আর থাকবে না বলতে কি মহারানির কোমল ব্যবহার ও কথাবার্তা আমার মধ্যে নবজীবন সঞ্চার করেছে। আমি ছোটাখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেললাম, কিছু দ্বিধা কিছু ত্রুটি হয়তো ছিল। আমাকে যখন।রাজপ্রাসাদে আনা হচ্ছিল তখন কী করে কথা বলতে হবে কী রকম আচরণ করতে হবে এসব গ্লামডালক্লিচ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। যে দেশের যে রীতি তা তো মানতে হবে।
আমার বাচনভঙ্গিতে যে ত্রুটি ছিল মহারানি সে সব গ্রাহ্য করলেন না, এমন ক্ষুদে মনুষ্যাকৃতি একটা জীব পরদেশের ভাষায় এমন চমৎকার সব কথা বলছে তাই শুনে তিনি চমৎকৃত । তিনি আমাকে তার নিজের হাতে তুলে নিলেন তারপর আমাকে নিয়ে চললেন মহারাজের ঘরে। মহারাজা তখন তাঁর খাস কামরায় বিশ্রাম করছিলেন। মহারাজাকে দেখতে মহারাজার মতোই । বেশ একটা রাজকীয় গাম্ভীর্য আছে এবং সারা মুখটায় বিশেষ একটা সৌন্দর্য আছে । রানির হাতে ক্ষুদে কী একটা পড়ে আছে সেজন্যে তিনি সেদিকে তেমন মন দেন নি। তাছাড়া আমি মহারানির হাতে উপুড় হয়ে শুয়েছিলাম তাই তিনি বললেন, তুমি আবার কবে থেকে এসপ্লাকনাক পুষতে আরম্ভ করলে? মহারানি মুচকি হাসলেন অর্থাৎ মহারাজাকে বলতে চাইলেন তোমাকে অবাক করে দিচ্ছি। তারপর আমাকে তুলে মহারাজার সামনে ছোটো একটা গোলাকার টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে মহারাজাকে আমার পরিচয় দিতে বললেন। আমি অল্প কথায় আমার পরিচয় পেশ করলাম। গ্লামডালক্লিচ খাসকামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। সে আমাকে তার চোখের আড়াল করতে চায় না। তাকে ভিতরে আসতে দেওয়া হল এবং আমি যা বলেছিলাম তার সমর্থনে তার বাবা আমাকে ক্ষেতে কুড়িয়ে পাওয়ার পর থেকে যা কিছু ঘটেছিল সব বলল ।
মহারাজা তাঁর রাজ্যের যে কোনো সুশিক্ষিত ব্যক্তি অপেক্ষা কম শিক্ষিত নন। তিনি দর্শন পড়েছেন এবং গণিতে বিশেষ পারদর্শী। কিন্তু যখন আমি আমার দুপায়ে সোজা হয়ে চলতে আরম্ভ করলাম তখন ভেবেছিলেন আমি বুঝি দমদেওয়া একটা ঘড়ি (সে দেশে তখন সবেমাত্র ভালো ঘড়ি তৈরি হচ্ছে), কোনো কুশলী কারিগর তৈরি করেছে। কিন্তু যখন তিনি আমার ভাষণ শুনলেন তখন তিনি রীতিমতো অবাক। তিনি বুঝলেন আমি কোনো একটা ভাষায় কথা বলছি যদিও সে ভাষা তাঁর অজানা। আমি তাঁর দেশে কী ভাবে এলাম তা তাঁকে বললাম কিন্তু তিনি বোধহয় বিশ্বাস করতে পারলেন না । তিনি বোধহয় ভাবলেন যে আমাকে চড়া দামে বিক্রি করবার জন্যে গ্লামডালক্লিচ ও তার বাবা একটা কাল্পনিক কাহিনী খাড়া করে এবং সেই কাহিনীটি ওরা ওদের ভাষায় বলতে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। এই ভেবে তিনি আমাকে জেরা করতে আরম্ভ করলেন । কিন্তু তিনি আমার কাছ থেকে যুক্তিপূর্ণ উত্তরই পেতে থাকলেন। অবশ্য এদেশের ভাষা আমি তখনো উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে পারি নি, আমার উচ্চারণে ত্রুটি ছিল যা রাজসভায় উচ্চারণ করার অনুপযুক্ত।
আমি জীবটা কেমন সেটা স্থির করবার জন্যে মহারাজা তাঁর তিনজন মহামান্য পণ্ডিতকে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা এসে আমাকে দূর থেকে, কাছ থেকে, উল্টে পাল্টে নানাভাবে পরীক্ষা করে বললেন যে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে আমার জন্ম হয় নি ৷ আমি যে পৃথিবীতে কী করে বেঁচে আছি তাও তাঁরা বুঝতে পারছেন না। কারণ আমি দ্রুতগামী নই, গাছে উঠতে পারি না, গর্ত খুড়তে পারি না। তাঁরা আমার দাঁতগুলো উত্তমরূপে পরীক্ষা করলেন এবং সাব্যস্ত করলেন যে আমি সর্বভূক। কিন্তু অধিকাংশ চতুষ্পদ প্রাণী বা ছোটোখাটো জীব যথা ইঁদুর যেভাবে জীবন ধারণ করে আমার সে ক্ষমতাও নেই এবং আমি যদি শামুক বা কিছু পোকা-মাকড় না খাই তাহলে আমি বেঁচে থাকব কী করে? তাঁরা এজন্যে নানারকম যুক্তি ও তথ্য পেশ করলেন। একজন পণ্ডিত বললেন আমি এখনো ভ্রূণ অবস্থায় আছি, অস্বাভাবিকভাবে আমার জন্ম হয়ে গেছে, ঠিক সময়ে আমার জন্ম হলে আমি ওঁদের মতোই দীর্ঘাকৃতি হতাম। কিন্তু অপর দুই পণ্ডিত তাঁর এই যুক্তি বাতিল করে দিলেন। তাঁরা বললেন আমার হাত পা, অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক এবং আমার বেশ বয়সও হয়েছে, এই পৃথিবীতে বেশ কিছু দিন বেঁচে আছি। তাঁরা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে আমার কাটা দাড়ি পরীক্ষা করে এই রায় দিলেন। তাঁরা বললেন আমি বামন নই কারণ বামনরাও এত খাটো হতে পারে না। রানির যে প্রিয় বামনটি আছে, যে নাকি এই রাজ্যে সর্বাপেক্ষা ছোটো আর উচ্চতা তিরিশ ফুট । শেষ পর্যন্ত তাঁরা সাব্যস্ত করলেন আমি প্রকৃতির খেয়াল।
তাঁরা এইরূপ সাব্যস্ত করার পর আমি প্রার্থনা করলাম আমাকে কয়েকটা কথা বলতে দেওয়া হোক। অনুমতি পেয়ে মহারাজাকে বললাম আমি যে দেশ থেকে এসেছি
সে দেশে আমার মাপ অনুযায়ী লাখ লাখ নরনারী আছে এবং সেদেশের বাড়ি ঘর জীবজন্তু গাছপালা সেই মাপ অনুযায়ী ঠিক। আপনাদের দেশে আপনারা যেমন দীর্ঘকায় তেমনি আপনাদের গাছপালা ও জীবজন্তুও বিরাটকায়। মহারাজা আপনার রাজ্যে যেমন
প্রজাদের অনেক অধিকার আছে আমাদের দেশেও অনুরূপ অধিকার আমরাও ভোগ করি । আপনার পণ্ডিতগণ যা সাব্যস্ত করলেন তা ঠিক নয়। পণ্ডিতেরা অবশ্য আমার কথা মানলেন না, বিদ্রূপের হাসি হাসলেন। তাঁরা মন্তব্য করলেন আমার সেই কর্তা চাষী আমাকে ভালোভাবেই শিখিয়ে দিয়েছে! মহারাজার মন কিন্তু তার পণ্ডিতগণ অপেক্ষা যুক্তিবাদী, তাঁর বোধশক্তি প্রখর। তিনি পণ্ডিতদের বিদায় দিয়ে সেই চাষীকে ডেকে পাঠালেন। সৌভাগ্যক্রমে চাষী তখনো নগর ছেড়ে চলে যায় নি। মহারাজা তাকে নিজে পৃথক ভাবে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, পরে তার কন্যা ও আমাকে ডাকলেন।
সকলকে নানা প্রশ্ন করে তাঁর সম্ভবত বিশ্বাস হল আমি সত্য কথাই বলছি। তিনি মহারানিকে আদেশ দিলেন যে আমার জন্যে যেন বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। আমার দেখাশোনার জনে গ্লামডালক্লিচ থাকবে কারণ মহারাজা আমাদের দুজনের মধ্যে স্নেহের সম্পর্ক লক্ষ করেছিলেন। গ্লামের জন্যে রাজপ্রাসাদের মধ্যে পৃথক কক্ষ ঠিক করে দেওয়া হল, তার শিক্ষার জন্যে একজন গভরনেস নিযুক্ত করা হল, তাকে পোশাক-পরিচ্ছদ পরানো ও তার প্রসাধনের জন্যে আরো একজন মহিলাকে নিযুক্ত করা হল। এছাড়া ছোটোখাটো কাজের জন্যে দুজন পরিচারিকাও নিযুক্ত করা হল। কিন্তু আমার সব কাজ গ্লাক করবে । রানি তাঁর আসবাব প্রস্তুতকারককে আদেশ দিলেন আমার বাসযোগ্য একটি বাক্স তৈরি করে দিতে কিন্তু তার মধ্যে শয়ন ব্যবস্থা ও অন্যান্য অংশ কীভাবে নির্মিত হবে তা আমি ও গ্লাম ঠিক করে দেব। আসবাব প্রস্তুতকারক একজন কুশলী কারিগর।
সে বার ফুট উচ্চ ও ষোল ফুট চৌকো চমৎকার একটি কাঠের চেম্বার বানিয়ে দিল । শার্সি সমেত জানালা এবং দরজা তো রইলই এবং ওরই মধ্যে লন্ডন বেডচেম্বারের মতো দুটো কুঠুরিও বানিয়ে দিল । ছাদের সঙ্গে যুক্ত করে কব্জা লাগিয়ে এমন কৌশলে শোবার খাট তৈরি করে দিল যে সেটি ওঠানো নামানো যাবে। রাজবাড়ির বিছানা সরবরাহকারী উত্তম বিছানা তৈরি করে দিল। খাটসমেত বিছানা গ্লাম সহজেই রোদে দিতে পারত আবার দরকারের সময় নামিয়ে দিত। কাঠের মিস্ত্রী আমার জন্যে দুটি সুন্দর চেয়ার তৈরি করে দিল, ঠেস দেবার জায়গায় হাতির দাঁতের মতো চমৎকার একটা সাদা পদার্থ সেঁটে দিল ।
দুটো টেবিল তৈরি করে দিল আর আমার জিনিসপত্র রাখবার জন্যে একটা দরজাওয়ালা অনুচ্চ আলমারিও বানিয়ে দিল। কাঠের ঘরের দেওয়াল ও মেঝেতে তুলোর তোশক বসিয়ে দেওয়া হল। যারা আমাকে বয়ে নিয়ে যাবে, দুর্ঘটনাক্রমে তাদের হাত থেকে আমি পড়ে গেলেও আমার দেহে যেন আঘাত না লাগে। আমাকে আরাম দেবার সব রকম ব্যবস্থাই করা হল। দরজায় তালার ব্যবস্থা করে দিতে বললাম কারণ এ দেশের ইঁদুরকে আমার বড় ভয়। একজন স্যাকরা অতি ছোটো একটি তালা বানিয়ে দিল।
ওদের তুলনায় খুবই ছোটো। অবশ্য এর চেয়ে বড় তালা আমি ইংল্যান্ডে একজন ভদ্রলোকের বাড়ির ফটকে দেখেছিলাম। তালার চাবি রাখবার জন্যে পকেটের মধ্যে ছোটো একটা পকেট করলাম। চাবি নিজের কাছেই রাখতাম কারণ ভয় ছিল গ্লাম যদি চাবি হারিয়ে ফেলে, এই চাবি ওর কাছে খুবই ছোটো। দেশে সবচেয়ে যে পাতলা সিল্ক আমাদের ইংলিশ কম্বলের চেয়ে অল্প পাতলা। এত মোটা কাপড়ের পোশাক পরতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল তবে ক্রমশ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পোশাক ওদের ফ্যাশান অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল যার খানিকটা পারসিক পোশাকের মতো, আর খানিক চৈনিক পোশাকের মতো। তাহলেও পোশাকের ইজ্জত আছে।
মহারানির কাছে আমি শেষ পর্যন্ত এমন প্রিয় হয়ে উঠলাম যে রানি আমাকে ছাড়া আহারে বসতে পারতেন না। তাঁর খাবারের টেবিলের উপরে বাঁ দিকে আমার জন্যে এবং আমার মাপ মতো একটি টেবিলও চেয়ার বসানো হল। গ্লামডালক্লিচ পাশেই একটি টুলের উপর দাঁড়িয়ে থাকত আমাকে সাহায্য করবার জন্যে। রানি আমার জন্যে এক সেট ডিশ প্লেট ছুরি কাঁটা চামচ তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। লন্ডনে একটি খেলনার দোকানে আমি এক সেট খেলাঘরের ডিনারসেট দেখেছিলাম। সেগুলো আমার কাছে যেমন ছোটো মনে হয়েছিল আমার ডিনারসেট নিশ্চয় এদের কাছে তেমনি ছোটো মনে হচ্ছে। রুপোর এই বাসনগুলো আমার ছোটো নার্স গ্লাম সযত্নে পরিষ্কার করে একটি রুপোর কৌটায় ভরে তার পকেটে রেখে দিত এবং দরকারের সময় বার করে নিত।
রানির সঙ্গে দুজন রাজকুমারী ছাড়া আর কেউ ভোজন করত না। রানির বড় কন্যাটির বয়স ষোল আর ছোটোটির তের বছর এক মাস। রানি এক টুকরো মাংস আমার টেবিলে তুলে দিতেন, আমি আমার আবশ্যক মতো টুকরা কেটে নিতাম। আমি আবার সেই টুকরো থেকে ছোটো ছোটো টুকরো আমার কাঁটায় গেঁথে মুখে পুরতাম তাই দেখে রানি খুব কৌতুক অনুভব করতেন। কারণ রানি নিজে যে ( তাঁর হজমশক্তি দুর্বল ছিল) মাংসের বড় টুকরোটি মুখে পুরতেন সেটি এত বড় ছিল যে ‘বারজন ইংরেজ চাষী’ সেই এক টুকরো মাংস পেলে তাদের একবারের খাওয়া হয়ে যেত। একজন মহিলা (অবশ্য আকারে বৃহৎ) অত বড় এক টুকরো মাংস মুখে পুরছেন দেখেই আমার গা গুলিয়ে উঠত । একটা সারস । অর্ধেক অংশ তিনি মুখে পুরে দিতেন তারপর হাড়গোড় সব কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেতেন। সেই সারস পাখি আমাদের ন’টা টার্কির সমান হবে আর তিনি মাংস খেতে খেতে যে রুটির টুকরো মুখে দিতেন তা আমাদের বার পেনি দামের দুটো রুটির সমান। পিপে থেকে সোনার কাপে সুরা ঢেলে তিন ঢক করে খেয়ে ফেলতেন। তার ছুরি ও চামচ ও অন্যান্য সরঞ্জাম তাঁর হাতের মাপ মতোই ছিল। আমাকে গ্লাম একবার আমার কৌতূহল মেটাতে ডাইনিং হলে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে টেবিলের উপর বিরাট আকারের ছুরি কাঁটা দেখে আমি অবাক। বাবাঃ, এত বিরাট আকারের ছুরিকাঁটা আমি কখনো দেখি নি, ভাবতেই পারি না।
প্রতি বুধবার (আগে বলেছি বুধবার ওদের স্যাবাথ ডে–বিশ্বাস দিবস) রাজা; রানি, রাজকুমার ও রাজকুমারীরা মহারাজার কক্ষে একত্রে ডিনার খেতেন। তাঁদের টেবিলের উপর আমারও টেবিল পড়ত, আমিও তাঁদের সঙ্গে আহার করতাম। কারণ মহারাজাও আমাকে পছন্দ করতে আরম্ভ করেছেন। ওঁদের টেবিলের বাঁ দিকে আমার টেবিল পড়ত, পাশেই থাকত লবণদানী। রাজকুমার আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন। তিনি ইউরোপের রীতিনীতি, ধর্ম, আইন, শাসনকার্য, শিক্ষা ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে চাইতেন।
আমি যথাসম্ভব তাঁর কৌতূহল চরিতার্থ করতাম। তাঁর বোধশক্তি ও বিচারবুদ্ধি তীক্ষ্ণ ছিল । আমার বক্তব্য শোনার পর তিনি বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করতেন। তবে আমি এ কথা বলব যে আমার প্রিয় স্বদেশভূমির বিষয় যথা তার ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থলে জলে যুদ্ধ, ধর্ম নিয়ে বিভেদ, দেশের রাজনৈতিক দল, শিক্ষা নিয়ে গোঁড়ামি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতাম। রাজকুমার তখন আমাকে তাঁর হাতে তুলে নিয়ে অপর হাত দিয়ে আমার পিঠে মৃদুভাবে হাত বোলাতে বোলাতে খুব হাসতেন। হাসতে হাসতে আমাকে প্রশ্ন করতেন, মশাই তুমি কোন দলের? হুইগ না টোরি? রাজদণ্ডের সমান দীর্ঘ একটি সাদা যষ্টি নিয়ে তাঁর প্রথম মন্ত্রী তাঁর পশ্চাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে কুমার বললেন মানুষের এই সব জাঁকজমক ও আড়ম্বর তুচ্ছ মনে হয় যখন ভাবি আমার হাতের উপরের এই ক্ষুদে মানুষরাও নাগরিকদের উপাধি ও সম্মান প্রদান করে, বাড়ি ঘর শহর তৈরি করে, সাজপোশাক তৈরি করে, ভাব ভালোবাসা করে, আবার যুদ্ধও করে, অপর মানুষকে ঠকায়, বিশ্বাসঘাতকতাও করে। আমাদের মহান দেশ সম্বন্ধে কুমারের ভালো মন্তব্য শোনবার সময় যেমন গৌরব বোধ করছিলাম তেমনি কটু মন্তব্য শোনবার সময় ক্রোধও হচ্ছিল, মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের শিল্প বা সমর-সজ্জা, ফ্রান্সের কিছু কলঙ্ক, ইউরোপের স্বাধীন নারী, আমাদের নৈতিক উৎকর্ষ বা ধর্মাচরণ, সম্মান বা সত্যবাদীতা কিংবা অহংকার ও হিংসা সম্বন্ধে তাঁর অনেক মন্তব্য আমার ভালো লাগে নি।
কিন্তু মুখ বুজে সবই সহ্য করতে হয়, আমার এমন ক্ষমতা নেই যে ওদের সঙ্গে পেরে উঠি ৷ মনকে বোঝাই, নিজের দেশেও তো অনেক কিছু দেখে বিদ্রূপ করি বা হাসি বা বাহবা দিই, অতএব এ ধরনের দোষ গুণ এদেরও থাকবে। মাঝে মাঝে আমিও মনে মনে হাসি। রানি যখন আমাকে তাঁর হাতে তুলে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান তখন আমার নিজেকেই নিজের আসল আকার অপেক্ষা খুব ছোটো মনে হয়। তখন আমার হাসি পায়।
কিন্তু আমার ক্রোধ হয় এবং আমি মর্মাহত হই যখন রানির সেই দুর্বিনীত বামন আমাকে বিদ্রূপ করে । ওদের দেশে অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষা তার উচ্চতা অনেক কম (ওর উচ্চতা তিরিশ ফুটের বেশি নয়)। তবুও সে আমার চেয়ে অনেক লম্বা, তারই সুযোগ নিয়ে সে মাঝে মাঝে সীমা ছাড়িয়ে আমাকে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ করে। অপমানে আমার গা জ্বালা করে । আমি যখন রানির খাস কামরায় রাজসভার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বলি সেই সময়ে সে ইচ্ছে করে আমার পাশ দিয়ে কয়েকবার যাবে ও সেই সঙ্গে আমার ক্ষুদ্র আকৃতি নিয়ে আমাকে ব্যঙ্গ করবে। আমি কী আর করব, তখন তাকে ‘এসো আমার ভাই’ বলে শুধু সম্বোধন করতাম। বা ঠাট্টএর কিছু বলতাম। আমার কোনো মন্তব্য তাকে খোঁচা দিয়ে থাকবে তাই একদিন আমি যখন মহারানির ডাইনিং টেবিলে আহার করছিলাম সেই সময়ে বামনটা একটা চেয়ারে উঠে আমাকে আমার কোমর ধরে ক্রীম ভর্তি বড় একটা রুপোর বাটিতে ফেলে দিয়েই পালাল। আমি সাঁতার না জানলে ডুবেই যেতাম । গ্লামডালক্লিচ তখন আমার পাশে না থাকলেও ঘরে অপর প্রান্তে ছিল, আর রানি যদিও সামনেই ছিল কিন্তু এমন ভয় পেয়েছিল যে কী করবেন বুঝতেই পারছিলেন না।
আমার ছোট্ট নার্স আমাকে রক্ষা করার জন্যে ছুটে এসে ক্রিমের বাটি থেকে তুলে নিল। ততক্ষণে আমি বেশ খানিকটা ক্রিম গিলে ফেলেছি। তবে আমার কোনো ক্ষতি হয় নি, পোশাকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গ্লাম আমাকে শুইয়ে দিল। বামনটাকে শাস্তি দেওয়া হল, তাকে বেশ করে চাবুকপেটা করা হল এবং সেই বাটি ভর্তি সব ক্রিমটা তাকে খেতে হল। রানি তাকে আর কাছে আসতে দিলেন না। শুধু তাই নয়, তাকে প্রাসাদ থেকে বিদায় করে এক অভিজাত মহিলাকে দান করে দিলেন। আমি বাঁচলাম। হিংসুটে বেঁটে বামনটা রেগে গিয়ে আমার আরো সাংঘাতিক কিছু ক্ষতি করতে পারত । এর আগেও বেঁটেটা আমার সঙ্গে বিশ্রী রকম রসিকতা করেছে। তা দেখে রানি হেসেছেন বটে কিন্তু সেই সঙ্গে অস্বস্তি বোধও করেছেন এবং বেঁটেটাকে হয়তো কঠোর শাস্তি দিতেন যদি না আমি বাধা দিতাম। মহারানি মজ্জাভর্তি একটা ফাঁপা হাড় তুলে নিলেন তারপর তার ভিতর থেকে মজ্জা ঠুকে ঠুকে বার করে নিয়ে ও পরে হাড়টা চুষে খেয়ে নিয়ে হাড়টা প্লেটের উপর দাঁড় করিয়ে রাখলেন। বেঁটের মাথায় সর্বদা দুষ্ট বুদ্ধি।
গ্লাম যে টুলটায় দাঁড়িয়ে আমার খাওয়ার তদারক করে সে নিজের চেয়ার ছেড়ে চট করে সেই টুলটায় উঠে দাঁড়িয়ে টপ করে আমাকে তুলে নিল তারপর আমার পা দুটো টিপে ধরে সেই ফাঁপা হাড়ের মধ্যে কোমর পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিল। আমি সেই অবস্থায় অসহায় হয়ে আটকে রইলাম। আমি সেই অবস্থায় প্রায় এক মিনিট আটকে ছিলাম, কেউ লক্ষ করে নি এবং আমিও চেঁচাই নি। এরা গরম মাংস খান না তাই আমার পা পোড়ে নি কিন্তু আমার মোজা ও ব্রিচেস নষ্ট হয়ে গেল। বেঁটে কয়েক ঘা বেত খেয়ে ছাড়া পেল, আমি অনুরোধ না করলে রীতিমতো উত্তম-মাধ্যম খেতে হত।
আমার সাহসিকতার জন্যে রানি আমাকে মাঝে মাঝে চুটকি মন্তব্য করতেন এবং হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করতেন, ’কী গো তোমাদের দেশের সব লোক তোমার মতো ভীতু নাকি?’ একটা ঘটনা এইরকম ঘটেছিল। এ রাজ্যে গ্রীষ্মকালে মাছির বড় উৎপাত। এক একটা মাছি ডানস্টেবল সারস পাখির সমান বড়, আমি যখন খেতে বসতাম এই বিশ্রী পোকাগুলো আমাকে বিরক্ত করে মারত, কানের কাছে সর্বদা ভোঁ ভোঁ করত। মাঝে মাঝে পোকাগুলো আমার খাবারের উপর বসে মলত্যাগ করত বা ডিম পাড়ত।
এসব অবশ্য এদেশের মানুষের নজরে আসত না, চোখ বড় হলে কী হয় এত ছোটো জিনিস ওদের চোখে ধরা পড়ে না। কখনো কখনো মাছিগুলো আমার নাকে বা কপালে বসে দংশন করত আর আমি বেশ বুঝতে পারতাম কী একটা চটচটে পদার্থ আমার দেহে লাগল। সেটার বিশ্রী গন্ধ। আমাদের দেশের প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা বলেন যে ঐ চটচটে পদার্থর জন্যে ওরা ঘরের ভিতরের ছাদে পা উঁচু করে হাঁটতে পারে। বিশ্রী মাছিগুলোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে আমাকে রীতিমতো হাত পা ছুঁড়তে হত। খুব খারাপ লাগত যখন মাছিগুলো মুখে বসত। বেঁটে বামনটা স্কুলের ছেলের মতো প্রায়ই পাঁচ সাতটা মাছি ধরে, রানিকে মজা দেখাবার জন্যে আমার নাকের তলায় ছেড়ে দিত। আমি আমার ছোরা বার করে ওগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে দুটুকরো করে দিতাম। টেবিলে যারা থাকত তারা আমার কৌশলের প্রশংসা করত।
একদিন সকালের কথা মনে পড়ে। আমি যাতে মুক্ত বায়ু সেবন করতে পারি এজন্যে গ্লামডালক্লিচ আমার ঘর-বাক্সটা জানালার ধারে রেখে গেছে। ইংল্যান্ডে আমরা যেমন জানালার বাইরে পাখির খাচা টাঙিয়ে দিই সেরকম আর কি। তবে এভাবে আমার ঘর-বাসা টাঙানো সাহস হয় না। আমি একটা একটা শার্সি তুলে দিয়েছি।। পরিষ্কার দিন। টেবিলের উপর কেক রাখা হয়েছে, চেয়ারে বসে একটু একটু করে কেক খেতে খেতে ব্রেকফাস্ট করছি, এমন সময় বোধহয় মিষ্টি কেকের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে গোটা কুড়ি বোলতা খোলা জানালা দিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরের ভিতর বোলতাগুলো উড়তে উড়তে বোঁ বোঁ আওয়াজ করছে যেন ব্যাগপাইপ বাজছে। কয়েকটা বোলতা তো কেকের উপর বসে খানিকটা করে কেক তুলে নিয়ে গেল। কতকগুলো তো আমার মাথার উপর বা মুখের কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, হুল ফুটিয়ে দিলেই হয়েছে আর কি! যাহোক আমি সাহস করে আমার ছোরা বার করে ওগুলোকে আক্রমণ করলাম । চারটে বোলতাকে মাটিতে পেড়ে ফেললাম, বাকিগুলো জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিলাম। এক একটা বোলতা আকারে তিতির পাখির সমান। ওদের হুল দেখলাম, এক একটা দেড় ইঞ্চি লম্বা আর সুচের মতো ধারালো। মরা বোলতাগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। বোলতাগুলো এবং আরো কিছু জিনিস আমি ইউরোপে অনেককে দেখিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে ফিরে আমি তিনটে বোলতা গ্রেশাম কলেজে দান করেছিলাম আর একটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম।