ব্রবডিংনাগদের দেশে – ২

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

[ চাষীর কন্যার বিবরণী। লেখককে প্রথমে বাজারে পরে নগরে নিয়ে যাওয়া হল। ভ্রমণের খুঁটিনাটি বিবরণী। ]

আমার কর্ত্রী মহিলার ন’বছরের একটি কন্যা আছে। কন্যাটি বয়সের তুলনায় কিছু পাকা; চমৎকার সেলাই করতে পারে, খেলার পুতুলটির নিপুণ হাতে সাজাতে পারে। সেও তার মা স্থির করল ইঁদুরের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্যে শিশুদের দোলনায় আমাকে রাত্রে শোয়ানো হবে। একটা ক্যাবিনেটের ড্রয়ার বার করে নিয়ে দোলনাটি তার মধ্যে রাখা হল এবং দোলনা সমেত ড্রয়ারটি ঝুলিয়ে দেওয়া হল। আমি যতদিন এই পরিবারে ছিলাম ততদিন এইটিই আমার শয্যা ছিল তবে যখন আমি ওদের ভাষা শিখতে লাগলাম তখন আমার অসুবিধা বলতে থাকায় ওরা দোলনটির অনেক উন্নতি সাধন করে দিয়েছিলেন। এই মেয়েটি ভারী চমৎকার, প্রায়ই আমার কাছে থাকত, আমার অনেক কাজ করে দিত। আমি কয়েকবার ওর সামনে পোশাক পরিবর্তন করেছিলাম। ও তা দেখেছিল তাই আমাকে ও কয়েকবার পোশাক ছাড়িয়ে অন্য পোশাক পরিয়ে দিয়েছিল।

আমি অবশ্য এ কাজটি তাকে করতে দিতাম না তবে সে আমার একটা কাজের কাজ করে দিয়েছিল । সে আমাকে সাতটা শার্ট তৈরি করে দিয়েছিল। যতদূর সম্ভব মোলায়েম কাপড় সে বেছে নিয়েছিল তবুও তা আমাদের থলের কাপড়ের চেয়েও মোটা। শার্টগুলো সে নিজেই কেচে দিত। সে আমার শিক্ষয়িত্রীও কারণ সে আমাকে ওদের ভাষা শেখাত।

আমি আঙুল দিয়ে কোনো জিনিস দেখালে সে নিজের ভাষায় তার নামটা বলে দিত অতএব ভবিষ্যতে আমার প্রয়োজন মতো কিছু চেয়ে নিতে পারতাম। মেয়েটির মেজাজ খুব ঠাণ্ডা। তার উচ্চতা এখন চল্লিশ ফুট, বয়স অনুসারে আরো একটু বেশি হওয়া উচিত ছিল। সে আমার নামকরণ করল ‘গ্রিলড্রিল’। তার পরিবারের সকলে আমাকে এই নামে ডাকত, পরে সারা দেশ। শব্দটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অর্থ করা যেতে পারে। ইংরেজি করলে হয়তো অর্থ হবে ‘ছোটো মানুষ’। ওদেশে আমি ওরই জন্যে বাস করতে পেরেছিলাম এবং যতদিন ওদেশে ছিলাম ততদিন আমাদের ছাড়াছাড়ি হয় নি। আমি ওকে গ্লামডালক্লিচ নামে ডাকতাম যার অর্থ ক্ষুদে নার্স। সে আমাকে ভালোবেসে যেভাবে আমার যত্ন করেছিল তা আমি স্বীকার না করলে আমি অকৃতজ্ঞ। আমিও যথাসাধ্য প্রতিদান দেবার চেষ্টা করতাম। কথাটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিবেশীদের কাছে আমি আলোচ্য হয়ে পড়লাম।

আমার কর্তা তার ক্ষেতে একটা অদ্ভুত জীব কুড়িয়ে পেয়েছেন, একটা এসপ্ল্যাকনাকের চেয়ে বড় নয়, জীবটি সর্বাংশে আমাদেরই মতো মানুষ, সব বিষয়ে আমাদের অনুকরণ করতে পারে, ওর নিজেরও একটা ভাষা আছে, আমাদের ভাষাও কিছু শিখেছে, দু পায়ে সোজা হাঁটে, ধীর ও স্থির, ডাকলেই কাছে আসে, অঙ্গপ্রসঙ্গ সুগঠিত, অমনটি দেখা যায় না আর গায়ের রঙ। অভিজাত পরিবারের তিন বৎসরের মেয়েটির চেয়ে ফর্সা। আমার কর্তার বন্ধু প্রতিবেশী এক চাষী কথাটা শুনে একদিন সত্য মিথ্যা যাচাই করতে এল।

আমাকে তখনি তার সামনে হাজির করা হল। আমার কর্তা আমাকে টেবিলের উপর তুলে দিল। আমাকে আদেশ করতেই আমি টেবিলের উপর হাঁটতে লাগলাম এবং তারপর খাপ থেকে আমার লম্বা ছোরাখানা বার করে দুচারবার ঘুরিয়ে আবার খাপে পুরে রাখলাম, তারপর আমার বন্ধু গ্লামডালক্লিচের নির্দেশ অনুসারে কর্তার অতিথিকে তাদেরই ভাষায় অভ্যর্থনা জানালাম। এই আগন্তুকের বয়স হয়েছিল। চোখে কম দেখে তাই সে পকেট থেকে চশমা বার করে পরল। তাই দেখে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম কারণ তার চোখ দুটো দেখাচ্ছিল যেন দুটো জানালায় দুটো চাঁদ। আমাকে ভালো করে দেখবার জন্যেই চশমা পরলেন। আমাদের বাড়ির লোকেরা আমার হাসির কারণ বুঝতে পারল কিন্তু আগন্তুক নিরর্থক আমার উপর চটে গেল। লোকটি কৃপণ স্বভাবের, পয়সা রোজগারের দিকে তার নজর। সে আমার কর্তার কাছে বলল পাশের শহরে ওকে নিয়ে যাও সেখানে ওকে দেখিয়ে দুপয়সা রোজগার করতে পারবে। শহরটা বেশি দূরে নয়, আমাদের বাড়ি থেকে বাইশ মাইল, ঘোড়ায় চেপে গেলে আধঘণ্টা সময় লাগবে। আমার সন্দেহ হল কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমি লক্ষ করলাম যে আমার কর্তা এবং আগন্তুক দুজনে মিলে ফিস ফিস করে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে আমার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। আমি তাদের কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না। একটা কিছু ঘটতে চলেছে। তবে আমি পরদিন সকালে সব জানতে পারলাম। আমার ক্ষুদে নার্স গ্লামডালক্লিচ আমাকে সবকিছু বলল। ব্যাপারটা সে চালাকি করে তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। বেচারি গ্লাম! সে আমাকে তার বুকের উপর তুলে নিল আর এমন ভাবে কাঁদতে লাগল যেন সেই দোষী। সে আশঙ্কা করছে যে ঐ গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকগুলো আমার ক্ষতি করবে, আমাকে নিয়ে এমনভাবে নাড়াচাড়া করবে যে তাদের টেপনটাপনে হয় আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব নয়তো আমার হাত পা একটা কিছু ভাঙবে। সে বলতে লাগল যে আমি বিনয়ী ও নম্র। নিজের সম্মান রাখতে জানি আর সেই আমাকে নিয়ে ওরা ছেলেখেলা করবে, আমার চূড়ান্ত অপমান করে ছাড়বে। শুধু কিছু অর্থের লোভে আমাকে কতকগুলো বাজে গ্রাম্য মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে, কী বিশ্রী। সে বলতে লাগল যে তার বাবা আর মা কথা রাখে না, তারা বলেছিল গ্রিলড্রিল আমার। কিন্তু এখন ওরা কথা রাখছে না। গত বছরে ওরা এমন ভান করলে যে একটা ভেড়ার বাচ্চা আমাকে দিয়েই দিল কিন্তু সেটা যেই বড় হল আর মোটা হল অমনি সেটা একটা কসাইকে বেচে দিল । আমার নার্স এত দুঃখ প্রকাশ করলেও আমি বুঝলাম আমার কিছু করার নেই, ওরা যা করবে তা আমাকে মেনে নিতেই হবে তবে আমার আশা আমি একদিন মুক্তি পাবই । এদের হাতে যতদিন থাকব ততদিন আমি কিছু করতে পারব না এমন কি ইংল্যান্ডের রাজা এদের হাতে পড়লে তাঁকেও এইসব বিড়ম্বনা সহ্য করতে হত।

পাশেই একটা শহরে হাট বসে। আমার কর্তা তাঁর বন্ধুর পরামর্শে আমাকে হাটে নিয়ে যাবেন। তিনি আমাকে একটা বাক্সের মধ্যে ভরলেন, সঙ্গে আমার ক্ষুদে নার্সকেও নিলেন। সে আমার পিছনে বসল। বাক্সটা চারদিকে বন্ধ তবে আমাকে ভিতর থেকে বাইরে বের করবার জন্যে একটা দরজা আছে আর বায়ু চলাচল করবার জন্যে বাক্সের গায়ে কয়েকটা ছোটো ছোটো গর্ত করা আছে। আমার যাতে না কষ্ট হয় সেজন্যে গ্লাম তার পুতুলের বিছানার একটা তোষক বাক্সের মধ্যে বিছিয়ে দিয়েছিল। ইচ্ছে করলে আমি তার উপর শুতেও পারি। গ্লাম আমাকে আরাম দেবার চেষ্টা করলে কী হবে।

গাড়ির সে কি ঝাঁকানি। ঝড়ের সময় জাহাজেও এরকম বা এমন ঘন ঘন ঝাঁকানি খেতে হয় না। বিরাট ঘোড়া, পা ফেলছে চল্লিশ ফুট পর পর। যদিও আধঘণ্টার যাত্রা তবুও ঐ সময়ের মধ্যে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। পথ বেশি নয়, লন্ডন থেকে সেন্ট অ্যালবানস যতটা দূর অতটা দূর হবে। কর্তা একটা সরাইখানার সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন । এখানে উনি মাঝে মাঝে আসেন। কর্তা সরাইওয়ালার সঙ্গে পরামর্শ করলেন, আমার জন্যে একজন ঘোষক দরকার যে হাটে ও শহরে চিৎকার করে বলবে, একটি অদ্ভুত জীব পাওয়া গেছে, যদি দেখতে চাও তো গ্রীন ঈগল-এ চলে এস। জীবটি আকারে একটি এসপ্লাকনাকের (ও দেশের সুন্দর একটি পশু প্রায় ছ’ফুট লম্বা) চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে ঠিক মানুষের মতো, কথা বলতে পারে এবং নানা ক্রীড়াকৌশল দেখাতে পারে। এছাড়া ঐ ঘোষক আমাকে জনসাধারণকে দেখবার জন্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও করবে। এইরকম একজন লোক পাওয়া গেল।

সরাইখানার সবচেয়ে বড় ঘরে আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। ঘরখানা লম্বা ও চওড়ায় দুদিকে তিনশ ফুট। আমার ক্ষুদে নার্স আমাকে দেখাশোনা করবার জন্যে এবং দর্শকদের সামনে কী দেখাব বা করব তার তালিম দেবার জন্যে টেবিলের পাশে একটা নিচু টুলে উঠে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে অযথা ভিড় না বাড়াবার জন্যে এবং যাতে আমার অসুবিধা না হয় সেজন্যে কর্তা ঠিক করলেন একসঙ্গে তিরিশজনের বেশি লোক ঘরে ঢোকানো হবে না। আমার ক্ষুদে বান্ধবী আমাকে টেবিলের উপর বিশেষ কায়দায় হাঁটতে বলল। আমি তাই হাঁটলাম তারপর আমি যাতে বুঝতে পারি ওদের এমন ভাষায় আমাকে প্রশ্ন করতে লাগল। আমিও যত জোরে সম্ভব চিৎকার করে সেগুলোর উত্তর দিতে থাকলাম। দর্শকরা ঘরে আসবার পর আমি বেশ কয়েকবার ঘুরেফিরে তাদের অভিবাদন জানালাম, বললাম তোমরা আমার অভিনন্দন গ্রহণ কর, তোমরা স্বাগতম, ক্ষুদ্র বক্তৃতাও দিলাম। সেলাই করবার সময় গ্রাম আঙুলে যে টুপি পরত, সুরা পান করাবার জন্যে সেইরকম একটা টুপি সে আমাকে দিয়েছিল।

আমি তাতে সুরা ঢেলে দর্শকের সামনে পান করলাম। তারপর খাপ থেকে আমার লম্বা ছোরা বার করে ইংরেজদের মতো ওদের কিছু কসরৎ দেখালাম। সেদিন বার দল দর্শককে আমার কলা কৌশল দেখাতে হল। কোনোবার কম কোনোবার বেশি এইভাবে খেলা দেখাতে দেখাতে, গোলমাল এবং কেউ কেউ আমাকে বিরক্ত করার ফলে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, প্রায় আধমরা। যারা আমার কসরৎ দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তারা আমার বিষয়ে এমন বাড়িয়ে বলতে লাগল যে পরবর্তী দল দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতে চায়। আমাকে যাতে কেউ স্পর্শ করতে না পারে বা কেউ ক্ষতি করতে না পারে এজন্যে কর্তা নিজ স্বার্থে টেবিলের চারদিকে বেঞ্চি দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন এবং একমাত্র আমার নার্স ছাড়া আমাকে যাতে কেউ স্পর্শ করতে না পারে সেজন্যে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন। তবুও স্কুলের একটা দুষ্টু ছাত্র আমার মাথা লক্ষ্য করে একটা হেজেলনাট ছুঁড়ে মারল। ভাগ্যিস অল্প একটুর জন্যে সেটা ফসকে গিয়েছিল নইলে আমার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে পড়ত। নাটটা কুমড়োর সমান বড়। যাহোক দুষ্টু ছেলেটাকে ধরে প্রহার দিয়ে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হল ।

আমার কর্তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে আমাকে আবার দেখা যাবে পরের হাটবারের দিন। বাড়ি থেকে শহরে যাবার সময় আমার খুব কষ্ট হয়েছিল, গায়ে হাত পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল তারপর আটঘণ্টা খেলা দেখিয়ে আমি এত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিলাম না। গলা দিয়ে স্বরও বেরোচ্ছিল না। ইতোমধ্যে নিজ স্বার্থের জন্যেই এবং হয়তো আমাকে কিছু আরাম দেবার উদ্দেশ্যে কর্তা একটা গাড়ি তৈরি করালেন। সুস্থ হয়ে উঠতে আমার তিন দিন লাগল, তবুও কি নিস্তার আছে, বিশ্রাম পাবার উপায় নেই। আমার কথা শুনে একশ মাইলের মধ্য থেকে বহু লোক আমাকে দেখবার জন্যে দলে দলে আসতে লাগল। এ অঞ্চলে অনেক লোকের বাস, বউ বাচ্চা নিয়ে তারা আসতে লাগল। কর্তাও তাদের কাছ থেকে মোটা দর্শনী আদায় করতে লাগলেন। মাত্র একটা পরিবার এলেও তাদের কাছ থেকে তিরিশ জনের দেয় দর্শনী আদায় করছিলেন। বুধবার ওদের স্যাবাথ ডে তাই সেদিন ছাড়া মাকে রোজই খানিকটা সময় দর্শকদের সামনে হাজির করা হত। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তবে ইতোমধ্যে আমাকে হাটবারে শহরে নিয়ে যাওয়া হয় নি।

আমার কর্তা যখন বুঝতে পারলেন যে আমাকে হাটে বাজারে দেখালে বেশ দুপয়সা উপার্জন হচ্ছে তখন তিনি স্থির করলেন যে রাজ্যের বড় বড় শহরে আমাকে নিয়ে যাবেন। অতএব দীর্ঘ ভ্রমণের জন্যে তিনি প্রস্তু হলেন, বাড়ি ও চাষবাস দেখাশোনার ব্যবস্থা করলেন এবং স্ত্রীকে সব বুঝিয়ে তাকে সাবধানে থাকেতে বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমি এই দেশে আসবার দুমাস পরে ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই আগস্ট আমরা যাত্রা করলাম। যে বড় শহরে যাচ্ছি সেটা রাজ্যের মধ্যস্থলে অবস্থিত, বাড়ি থেকে প্রায় তিন হাজার মাইল দূরে। কর্তা গ্লামডালক্লিচকেও সঙ্গে নিলেন, সে থাকবে পিছনে।

আমি তো আছি বাক্সের মধ্যে গ্রাম বাক্সটা কোলের উপর তুলে নিয়ে কোমরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেশ করে বেঁধে নিল। আমার যাতে কষ্ট না হয় সেজন্যে গ্রাম বাক্সটার ভিতরে সব দিকে নরম কাপড় বসিয়ে দিয়েছিল। আর তার পুতুলের বিছানা থেকে অনেকগুলো তোষক এনে মেঝেতে বিছিয়ে দিয়ে চাদর পেতে দিয়েছিল। আমি যাতে আরামে থাকতে পারি সেজন্যে সে চেষ্টার ত্রুটি করে নি। কর্তা ও গ্লাম ছাড়া আমাদের সঙ্গে ছিল বাড়ির একটি বালক যে মালপত্র নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চলল ।

আমার কর্তার মতলব ছিল পথে যত শহর সেখানে আমাকে দেখানো হবে এবং আমাদের রাস্তা থেকে পঞ্চাশ বা একশ মাইলের যত গ্রাম বা যদি কোনো ধনী ব্যক্তি থাকে তবে সেখানেও আমাকে দেখানো হবে, মূল লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। আমরা প্রতিদিন সহজেই একশ দেড়শ মাইল অতিক্রম করতাম, তারও বেশি হয়তো পারা যেত কিন্তু যদি আমার কষ্ট হয় সেজন্যে গ্লাম তার বাবাকে বলত ঘোড়ায় চেপে একটানা যেতে তার কষ্ট হয়। মুক্ত বাতাস উপভোগ ও আশপাশ দেখার জন্যে গ্লাম আমাকে মাঝে মাঝে বাক্সের বাইরে এনে ছেড়ে দিতে কিন্তু আমার কোমরে একটি দড়ি বাঁধা থাকত, দড়িটি সে ছাড়াত না । ভ্রমণ পথে আমরা পাঁচ ছটা নদী পার হলাম, নদীগুলো মিশরের নীলনদ বা ভারতের গঙ্গা নদী অপেক্ষা অনেক বেশি চওড়া ও গভীর। লন্ডন ব্রিজের নিচে টেমস নদী যেমন ঠিক তেমন বা তত ছোটো কোনো নদী আমার চোখে পড়ে নি। বড় নগরে পৌছবার আগে দশ সপ্তাহ কেটে গেল, ইতোমধ্যে আমাকে আঠারটি বড় শহরে, অনেক বড় গ্রামে এবং কিছু ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে দেখানো হল। অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে আমরা সেই বড় নগরে পৌছলাম যার নাম লোরব্রুগ্রুড বা দুনিয়ার গৌরব। নগরের প্রধান রাস্তার উপরে, প্রাসাদ থেকে অনুতিদূরে আমার কর্তা বাসা নিলেন। আমার চেহারা ও গুণাবলীর বর্ণনা দিয়ে কর্তা যথারীতি প্রাচিরপত্র টাঙিয়ে দিলেন। তিনশ থেকে চারশ ফুট চওড়া একটা বড় ঘর কর্তা ভাড়া নিলেন। একটা গোল টেবিলও আনলেন, তার ব্যাস ষাট ফুট । এরই উপর আমাকে খেলা দেখাতে হবে এবং আমি যাতে টেবিল থেকে পড়ে না যাই সেজন্যে টেবিলটি ঘিরে তিন ফুট উঁচু বেড়া দেওয়া হল। আমাকে প্রতিদিন দশবার দেখানো হত, সকলে অবাক হত তবে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরত। আমি তখন ওদের ভাষায় মোটামুটি কথা বলতে পারি তবে বুঝতে পারি সবই। গ্লাম আমাকে বাড়িতে শেখাত পড়াত। পথে আসতে আসতেও পড়িয়েছে যার ফলে ওদের ভাষার অক্ষর পরিচয় হয়েছে এবং লিখতেও পারি। তরুণীদের ব্যবহার যোগ্য একটা ছোটো ধর্মপুস্তক গ্লাম তার পকেটে রাখত, ছোটো হলেও বইখানা স্যামন’স অ্যাটলাসের মতো বড় হবে। গ্লাম আমাকে সেই বইখানাও পড়িয়েছিল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *