লিলিপুটদের দেশে – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

[ এক অসাধারণ কৌশল-বলে লেখক একটা আক্রমণ প্রতিহত করল । তাকে উচ্চ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হল। ব্রেফুসকুর রাষ্ট্রদূত এসে সন্ধি প্রস্তাব করলেন। দুর্ঘটনাক্রমে সম্রাজ্ঞীর কক্ষে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রাসাদের বাকি অংশ রক্ষা করতে লেখকের কৃতিত্ব।]

ব্লেফুসকু সাম্রাজ্য যে দ্বীপে অবস্থিত সেই দ্বীপটি লিলিপুট দ্বীপের উত্তর পূর্বদিকে । মাঝে আটশত গজ প্রশস্ত একটি প্রণালী দ্বারা বিভক্ত। ঐ দ্বীপ আমি এখনো দেখি নি এবং পাছে জাহাজ থেকে বা অন্যভাবে শত্রুপক্ষ আমাকে দেখে ফেলে এই ভয়ে আমি সমুদ্রতীরে যেতাম না। এদেশে আমার আগমনের খবর ওরা এখনো জানে না কারণ যুদ্ধকালে দুইদেশের মধ্যে সর্বপ্রকার যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে মৃত্যুদণ্ড। সম্রাট দুই দেশের মধ্যে জাহাজ চলাচল আগেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

আমাদের গুপ্তচর খবর এনেছে যে শত্রুপক্ষের পুরো নৌবহর এখন অনুকূল বাতাসের জন্যে বন্দরে অপেক্ষা করছে। কীভাবে আমি শত্রুপক্ষের নৌবহরটা আটক করব তারই একটা পরিকল্পনা সম্রাটের কাছে পেশ করলাম। প্রণালীটির গভীরতা সম্বন্ধে আমি সর্বাধিক অভিজ্ঞ কয়েকজন নাবিকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। এ পথে তারা বহুবার চলাচল করেছে। তারা আমাকে বলল প্রণালীর মাঝখানটাই সবচেয়ে গভীর । জোয়ারের সময় সত্তর গ্রামগ্রাফ গভীর অর্থাৎ ইউরোপীয় মাপে ছফুট। আর বাকি অংশ বড়জোর পঞ্চাশ গ্লামগ্লাফ। আমি হেঁটে ব্লেফুসকুর উত্তর-পূর্বতীরের দিকে গেলাম এবং পকেট থেকে দূরবীন বার করে একটা ছোটো পাহাড়ের আড়াল থেকে ওদের নৌবহর লক্ষ করতে লাগলাম। দেখলাম যে পঞ্চাশটা যুদ্ধজাহাজ অনেক ছোটো জাহাজ বা নৌকো রয়েছে। আমি ফিরে এলাম। আমাকে আদেশ জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেই আদেশবলে আমি বললাম আমার অনেক মজবুত দড়ি ও লোহার বার চাই । ওরা যে দড়ি আনল তা টুন সুতোর চেয়ে একটু মোটা আর লোহার রডগুলো সুচের মতো লম্বা ও মোটা। আমি তিনখানা করে সুতো নিয়ে পাকিয়ে মোটা করলাম আর লোহার রডগুলো বেঁকিয়ে হুক তৈরি করে দড়ির ডগায় বাঁধলাম। তারপর আমি আবার উত্তর-পূর্ব তীরে ফিরে গেলাম। আমার কোট, মোজা ও জুতো খুলে ফেললাম, গায়ে রইল শুধু চামড়ার জার্কিন। জোয়ার আসবার আধঘণ্টা আগে পানিতে নামলাম, মাঝখানে তিরিশ গজ আন্দাজ সাঁতরে পার হয়ে আবার হাঁটতে আরম্ভ করলাম। আধ ঘণ্টার আগেই আমি ওদের নৌবহরের কাছে পৌঁছে গেলাম। আমাকে দেখে শত্রুরা এত ভয় পেয়ে গেল যে ওরা জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পারে উঠল। পারে তখন হাজার তিরিশ ক্ষুদে সৈন্য জমায়েত হয়েছে। আমি তখন হুক বাঁধা দড়িগুলো বার করে ছিপ ফেলার মতো সেগুলা পর পর ছুঁড়ে মাছ ধলার মতো করে জাহাজগুলো গাঁথতে লাগলাম। ইতোমধ্যে আমার হাতে ও দেহের অন্য অংশে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর এসে বিঁধছে । খুবই বিরক্তিকর। মুখে যেগুলো বিধছিল সেগুলো আমাকে বেগ দিচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল চোখে যদি তীর বেঁধে তাহলে অন্ধ হয়ে যাব। কিন্তু চট করে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। চশমাজোড়া আমার পকেটেই রয়েছে। সম্রাটের অনুসন্ধানকারীরা আমাকে সার্চ করার সময় সেটা দেখতে পায় নি। আমি সেটা পকেট থেকে বার করে চট করে পরে নিলাম। এবার শত্রুর তীর উপেক্ষা করে সাহস করে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তীর এসে আমার চশমার কাচে আঘাত করল কিন্তু ঐ পর্যন্তই, কোনো ক্ষতি করতে পারল না। জাহাজগুলোতে আমার হুক লাগানো হয়ে গেল, এবার সব দড়ি একত্র করে টান মারলাম কিন্তু জাহাজ নড়ল না। বুঝলাম নোঙ্গর বাঁধা আছে। পকেট থেকে ছুরি বার করে নোঙ্গরের দড়িগুলো কচাকচ করে দিলাম । এদিকে শত শত তীর বর্ষিত হচ্ছে, হাতে ও মুখে তীর বিধছে। ভ্রূক্ষেপ না করে এবার সব দড়ি ধরে টান মারতেই জাহাজগুলো বন্দর থেকে বেরিয়ে আসতে আরম্ভ করল এবং পঞ্চাশটা যুদ্ধজাহাজ আমি টানতে টানতে নিয়ে ফিরে চললাম।

ব্রেফুসকুডিয়ানরা প্রথমে আমার মতলব বুঝতে পারে নি। কিন্তু পরে তারা আমার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক ও বিহ্বল হয়ে গেল। তারা আমাকে নোঙরের দড়ি কাটতে দেখেছিল, তখন ভেবেছিল আমি বোধহয় জাহাজগুলোকে এদিক ওদিক ভাসিয়ে দেব। কিংবা জাহাজগুলো ভেঙে দেব। কিন্তু যখন দেখল জাহাজগুলোর কোনো ক্ষতি না করেসেগুলো জড়ো করে আমি টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছি তখন তারা হতাশ হয়ে এমন চেঁচামেচি করতে লাগল যে তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। খানিকটা এগিয়ে যাবার পর আমি যখন বুঝলাম আর বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন আমি থামলাম এবং আমার মুখ ও হাত থেকে বিদ্ধ তীরগুলো পটাপট তুলে ফেললাম। এই দ্বীপে নামবার পর যখন আমি শরাহত হয়েছিলাম তখন লিলিপুটরা আমাকে যে মলম লাগিয়ে দিয়েছিল, এখন আমার কাছে সেই মলম খানিকটা ছিল। আমি তীর লাগা জায়গায় সেই মলম লাগিয়ে দিলাম।

ইতোমধ্যে জোয়ার এসে গিয়েছিল তাই আমি প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। জোয়ার কমে গেলে আবার চলতে আরম্ভ করলাম। চশমাটা খুলে পকেটে রাখলাম। জাহাজ বাঁধা দড়িগুলো বেশ করে ধরে জল ভেঙে এগিয়ে চললাম। এবং অবশেষে নিরাপদে লিলিপুটেদেশের রাজবন্দরে পৌঁছলাম। অভিযানের ফলাফল জানবার জন্যে সম্রাট তার সভাসদদের নিয়ে তীরে আমার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা দেখছিলেন জাহাজের বহর অর্ধচন্দ্রাকার বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমাকে তারা দেখতে পাচ্ছে না।

তখন আমি এক বুক পানিতে এবং যখন প্রণালীর মাঝখানে গভীরতম জায়গাটিতে এসেছি তখন তো আমার একগলা পানি, শুধু মুণ্ডটি ভাসছে। সম্রাট তখন ভাবছিলেন আমি বুঝি ডুবে গেছি এবং শত্রুপক্ষের জাহাজ সার বেঁধে তাঁদের আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু অবিলম্বে তাঁর ভয় দূর হয়েছিল। ইতোমধ্যে পানির গভীরতা কমে গেছে এবং আমার দেহটাও ক্রমশ জল থেকে ওপরে উঠছে। এইভাবে আমি দ্বীপের কাছে এসে গেলাম এবং ওদের কথাও আমার কানে আসাতে লাগল। আমি তখন জাহাজের দড়ির গুচ্ছ বাগিয়ে ধরে চিৎকার করে বললাম “লিলিপুটের সর্বশক্তিমান মহারাজের জয় হোক।” তীরে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট আমাকে যথোচিতভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং তৎক্ষণাৎ দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘নারডাক’ দ্বারা আমাকে ভূষিত করলেন।

এবার সম্রাট আমাকে বললেন যে সুবিধামতো আর একদিন ঐ দ্বীপে গিয়ে শত্রুদের সমস্ত জাহাজ লিলিপুট বন্দরে নিয়ে আসতে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে সম্রাটের আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল যে তিনি চান ব্লেফুসকু দ্বীপটাকে অধিকার করে তাকে তাঁর সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে রূপান্তরিত করতে। সে প্রদেশ শাসন করবে তাঁরই প্রেরিত এক প্রতিনিধি বা ভাইসরয় এবং তিনি চান বিগ এনডিয়ান নির্বাসিতদের ডিমের সরু দিক ভাঙতে বাধ্য করা ও তাদের ধ্বংস করা। এর ফলে সম্রাট সারা দুনিয়ার সম্রাট হতে পারবেন। কিন্তু আমি তাঁকে তাঁর এই অভিসন্ধি থেকে বিরত করবার চেষ্টা করলাম। তাঁকে বোঝাতে চাইলাম যে তাহলে ঘোর অবিচার হবে, সুনীতি বলে না এমন ভাবে প্রতিহিংসা নিতে। শেষ পর্যন্ত আমি বেঁকে দাঁড়ালাম এবং স্পষ্টই বললাম যে এক স্বাধীন ও সাহসী জাতিকে এইভাবে ক্রীতদাস করতে চাইলে তার মধ্যে আমি নেই। যখন এই বিষয় নিয়ে মন্ত্রণাসভায় ও রাজপরিষদে আলোচনা হল তখন অধিকাংশ জ্ঞানী ও গুণী মন্ত্রী ও পরামর্শদাতারা আমার অনুকূলেই মত দিলেন।

কিন্তু আমার এই স্পষ্ট ঘোষণা মহামান্য সম্রাটের পরিকল্পনার সহায়ক নয়। তিনি আমার যুক্তি মানতে রাজি নন, ফলে তিনি আমাকে কখনই ক্ষমা করেন নি। মন্ত্রণা পরিষদে তিনি তাঁর মনোভাব সুকৌশলে ব্যক্ত করেছিলেন। আমি পরে শুনেছিলাম পরিষদে আমার সমর্থকরা সম্রাটের মুখের উপর প্রতিবাদ করেন নি, তাঁরা নীরব ছিলেন কিন্তু একদল আমার শত্রু হয়েছিল তারা আমার বিরদ্ধে কিছু মন্তব্য প্রকাশ করেছিল।

অচিরেই সম্রাট এবং আরো কয়েকজন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন যা মাস দুয়েকের ভেতরেই সোচ্চার হয়ে উঠল এবং আমি প্রায় ধ্বংস হতে যাচ্ছিলাম। বুঝলাম রাজারাজড়াদের যতই সেবা করা যাক তাঁদের মন যুগিয়ে চলতে না পারলে পতন অনিবার্য । যে সেবা বা স্বার্থ ত্যাগ করা হয়েছে তা তখন মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

ব্লেফুসকু দ্বীপে হানা দেওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পরে শান্তির বিনীত প্রস্তাব নিয়ে ব্লেফুসকু থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দূত এল। বলাবাহুল্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হল এবং পুরোপুরি আমাদের সম্রাটের অনুকূলে। চুক্তির সেসব শর্তের উল্লেখ করে আমি পাঠকদের বিরক্ত করতে চাই না। প্রায় পাঁচশজন উপদেষ্টা সমেত ছ’জন রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন। পরাজিত হলেও তারা এসেছিল সাড়ম্বরে যা তাদের সম্রাটের উপযুক্ত বলতে হবে অথচ ব্যাপারটির গুরুত্ব তারা লঘু করে দেখে নি। তারা রাজার কাছে রাজার মতোই এসেছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমি ওদের কিছু সাহায্য করেছিলাম এবং তারা ব্লেফুসকু ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানাবার জন্যে একদিন আমার বাড়িতে এল। তারা আমার সাহস ও উদারতার প্রশংসা করল কারণ আমি তো ইচ্ছে করলে ওদের জীবন ও সম্পত্তির প্রচুর ক্ষতি করতে পারতাম কিন্তু তা করি নি । তাদের সম্রাটের তরফ থেকে আমাকে তাদের দ্বীপে যাবার আমন্ত্রণ জানাল । তারা আমার অসাধারণ শক্তি ও শৌর্যের কথা শুনেছে তার কিছু প্রমাণ দেখাতে বলল। আমি তাদের নিরাশ করলাম না তবে তার বিবরণ জানাবার দরকার মনে করছি না।

তারা অবশ্য আমার শক্তির চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে অবাকও হল যেমন, সন্তুষ্টও হল তেমনি। আমিও তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের সম্রাটের প্রতি আমার অভিনন্দন জানালাম। আরো জানালাম যে তাদের সম্রাটের বীরত্ব, অনুকম্পা ও সুশাসক হিসেবে তাঁর খ্যাতির কথা আমি শুনেছি এবং দেশে ফেরার আগে আমি স্বয়ং তাদের দ্বীপে গিয়ে সম্রাটকে আমার অভিনন্দন জানিয়ে আসব। পরবর্তী সময়ে আমাদের সম্রাটের সঙ্গে আমার যখন সাক্ষাৎ করার সুযোগ হল তখন আমি ব্লেফুসকুডিয়ান সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। সম্রাট অবশ্য দয়া করে আমাকে অনুমতি দিলেন কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে নয়। কারণটা আমাকে তাঁরই একজন সভাসদ জানিয়েছিল । ব্লেফুসকু দ্বীপের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আমার যে সাক্ষাৎ হয়েছিল তারই এক বিকৃত রূপ ফ্লিমন্যাপ এবং বলগোলাম সম্রাটের কাছে পেশ করেছিল। তাতে সে অনেক রং চড়িয়েছিল। তাই সম্রাট আমার প্রতি একটু বিরূপ অথচ আমি বেআইনী কিছু করি নি। এই প্রথম আমি রাজসভার চক্র ও চক্রান্তের কিছু ধারণা করতে শিখলাম।

লক্ষণীয় যে ইউরোপে পাশাপাশি হলেও দুই দেশের মধ্যে যেমন ভাষার তফাত থাকে এবং দুই দেশেই যেমন নিজের ভাষার প্রাচীনত্ব, সৌন্দর্য ও বলিষ্ঠতা নিয়ে গৌরব বোধ করে অনুরূপভাবে ব্লেফুসকু ও লিলিপুট দ্বীপের ভাষাও ভিন্ন। লিলিপুটদের ভাষা শিখলেও আমি ওদের ভাষা জানি না অতএব আমাকে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলতে হয়েছিল। তবুও আমাদের সম্রাট যুদ্ধে জয়লাভ করার সুবাদে ব্লেফুসকুডিয়ানদের বাধ্য করেছিলেন তাদের পরিচয়পত্র পেশ করতে এবং কথাবার্তা লিলিপুট দ্বীপের ভাষায় চালাতে। ব্যবসা বাণিজ্য নির্বাসিত বা আশ্রয়প্রার্থী ও ভ্রমণ, শিক্ষা ইত্যাদির জন্যে উভয় দ্বীপের লোকজনই অপর দ্বীপে যাওয়া-আসা করত। অবশ্য যুদ্ধের সময় ছাড়া। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসী, ব্যবসায়ী বা নাবিক, অনেকেই অপর দ্বীপের ভাষা উত্তমরূপেই জানত। সেটা আমি জানতে পারলাম যখন কয়েক সপ্তাহ পরে আমি ব্রেফুসকু দ্বীপের সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার শত্রুদের চক্রান্ত সত্ত্বেও আমার সে ভ্রমণ উপভোগ্য হয়েছিল। আমি যথাস্থানে তার বিবরণ দেব।

পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে যে বন্দীদশা থেকে আমার মুক্তির জন্যে যে সব শর্ত আরোপ করা হয়েছিল তার কয়েকটি আমার মনঃপূত হয় নি এবং সেগুলো আমার কাছে অপমানজনক ও বশ্যতা স্বীকারের সামিল মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন বাধ্য হয়েই আমাকে শর্তগুলো মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমি এ দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘নারডাক’ উপাধি দ্বারা ভূষিত। অতএব ঐসব শর্ত নিয়ে বর্তমানে আলোচনা করা আমার পক্ষে মর্যাদাহানিকর এবং সম্রাটও সেইসব শর্ত নিয়ে আর কথা তোলেন নি, তোলা সম্ভবও ছিল না । যাহোক সম্রাটের উপকার করার আমার একটা সুযোগ এল এবং আমার মতে সে কাজ আমি করেছিলাম তার জন্যে আমি প্রচুর কৃতিত্ব দাবি করতে পারি।

একদিন মাঝ রাত্রে আমার দরজার কয়েকশত লিলিপুটের চিৎকারে সহসা আমার ঘুম

ভেঙে গেল । আকস্মিক এই গোলমালে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ‘বার্গলাম’, ‘বার্গলাম’ শব্দটা বার বার আমার কানে আসতে লাগল। কয়েকজন মানুষ আমার কানের কাছে এসে বলতে লাগল, শিগগির চল রাজপ্রাসাদে আগুন লেগেছে। একজন দাসী একটা জমাটি উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তারই অমনোযোগিতার ফলে আগুন লেগে গেছে। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ে চিৎকার করে বললাম, সবাই সরে যাও, আমাকে রাস্তা ছেড়ে দাও। তারা সরে গেল, আমি প্রাসাদের দিকে ছুটলাম, আকাশে চাঁদ ছিল তাই কাউকে মাড়িয়ে ফেলি নি। প্রাসাদে পৌঁছে দেখলাম ওরা দেওয়ালে মই লাগিয়ে বালতি করে জল তুলে জল ঢালছে। কিন্তু জল আনতে হবে অনেক দূর থেকে।

তাছাড়া বালতিগুলোও ছোটো, দর্জিরা সেলাই করবার সময় আঙুলে যে চুট পরে তার চেয়ে বেশি বড় নয় । তবুও তারা যথাসাধ্য করছে কিন্তু আগুনের প্রকোপ ভয়াবহ । ওটুকু পানিতে কিছুই হচ্ছে না। আমার গায়ে কোটটা থাকলে সেটা খুলে চাপা দিলে আগুন নিবে যেত। কিন্তু কোট তো আমি বাসায় রেখে এসেছি, তাড়াতাড়িতে শুধু লেদার জার্কিনটা পরে এসেছি। এদিকে আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে, সমস্ত প্রাসাদটাই বুঝি ছারখার হয়ে যাবে। কিন্তু এমন সময় আমার মাথায় এক উপস্থিত বুদ্ধি এসে গেল । গত সন্ধ্যায় আমি ‘গ্লিমিগ্রিন’ নামে এক অতি সুস্বাদু সুরা প্রচুর পরিমাণে পান করেছিলাম ।

ব্লেফুসকুডিয়ানরা এই সুরাকে ‘ফুনেক’ বলে। এই সুরার একটি দোষ বা গুণ আছে। সেটি হল একটি মূত্রবর্ধক। সৌভাগ্যের বিষয় যে আমি দীর্ঘসময় মূত্রত্যাগ করি নি অথচ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই আমি তার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। আগুন নেভানোর আর কোনো উপায় না দেখে আমি সেই আগুনের ওপরে প্রবল বেগে মূত্রত্যাগ করলাম এবং তিন মিনিটের মধ্যেই আগুন নিভে গেল এবং যে প্রাসাদ বহু দিন ধরে ও বহু ব্যয়ে ক্রমশ গড়ে উঠেছিল তা ধ্বংস থেকে বেঁচে গেল ।

দিনের আলো ফুটে উঠল আমি বাসায় ফিরে এলাম। সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে সাহস হল না কারণ প্রাসাদটিকে যেভাবে বাঁচিয়েছিলাম তা শোভন নয়, রাজপ্রাসাদে মূত্রত্যাগ লজ্জাজনক, কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও তো ছিল না। রাজধানীতে রাজার বাসভবনে এ হেন কাজ নিশ্চয়ই আইনানুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই মনে কিছু ভয় নিয়েই ফিরে এলাম। যাহোক মহামান্য সম্রাটের দূতের কাছ থেকে একটা বার্তা পেয়ে কিছু আশ্বস্ত হলাম । সম্রাট নাকি আমাকে ক্ষমা করার জন্যে তাঁর বিচার বিভাগকে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু সরকারিভাবে তা পাওয়া যায় নি।

আমি আরো একটা খবর পেলাম যে সম্রাজ্ঞী আমার দুষ্কর্মের জন্যে ঘৃণাভরে প্রাসাদের এক দূর প্রান্তে সরে গেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন তাঁর প্রাসাদের যে অংশ পুড়ে গেছে সে অংশ যেন মেরামত না করা হয়। মেরামত করলেও তিনি সেখানে ফিরে যাবেন না। ছিঃ ছিঃ কী কাণ্ড। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তাঁর প্রিয় পাত্রীদের নাকি বলেছিলেন যে তিনি এর প্রতিকার করবেন ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *