ব্রবডিংনাগদের দেশে – ৪

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

[ দেশটির বর্ণনা। আধুনিক মানচিত্র সংস্কারের প্রস্তাব। রাজপ্রাসাদ ও নগরের বর্ণনা। লেখকের ভ্রমণের বিশেষত্ব। প্রধান মন্দিরের বিবরণী । ]

আমি এবার পাঠকদের এই দেশটির সংক্ষেপে কিছু বিবরণ দেব। তবে পুরো দেশটা নয়। প্রধান নগর লোরক্রগ্রুড-এর চারদিকে দুহাজার মাইল পর্যন্ত আমি ঘুরেছি, সেইটুকুর বিষয়ই জানাব। কারণ মহারানি আমাকে নিয়ে মহারাজার সঙ্গেই বেরোতেন।

মহারানিকে এক জায়গায় রেখে মহারাজা দেশের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসতেন। মহারাজার অধিকারে এই দেশটি দৈর্ঘ্যে ছহাজার মাইল ও প্রস্থে তিন থেকে পাঁচ হাজার মাইল হবে । কী ভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম বলতে পারব না, আমার বিশ্বাস যে ইউরোপের ভৌগোলিকরা একটা মস্ত ভুল করেছেন, তাঁরা বলেন ক্যালিফরনিয়া ও জাপানের মধ্যে সমুদ্র ব্যতীত কোনো দেশ নেই। কিন্তু আমার চিরদিনই বিশ্বাস যে পৃথিবী তার ভারসাম্য রক্ষা করবার জন্যে টারটারি মহাদেশের বিপরীতে নিশ্চয় আর একটা দেশ রয়েছে। তাই অ্যামেরিকার উত্তর পশ্চিম দিকে যে বিশাল দেশটি রয়েছে সেটি তাদের ম্যাপ ও চার্টে দেখিয়ে ভ্রম সংশোধন করুক এবং এই বিষয়ে আমি তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।

এই রাজ্যটি একটি উপদ্বীপ যার উত্তর-পূর্ব দিকে আছে তিরিশ মাইল উচ্চ এক পর্বতশ্রেণী যা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য, কারণ পর্বত চূড়ায় বিশাল আগ্নেয়গিরি আছে।সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিতরাও জানেন না পর্বতের ওধারে মানুষ বা কী ধরনের জীব বাস করে অথবা কোনো জীব হয়তো ওধারে বাস করেই না। এই রাজ্যের তিন দিকে সমুদ্র। সারা সমুদ্র উপকূলে কোথাও একটাও বন্দর নেই। তাছাড়া নদীগুলো যেখানে সমুদ্রে পড়েছে সেখানে বিরাট সব সুচালো পাথর আছে আর সেই পাথরের উপর ক্ষিপ্ত সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। এজন্যে ওখানে ছোটো নৌকো ভাসাতেও কেউ সাহস করে না।

এই কারণে এই দেশের মানুষ দেশ থেকে বেরোতে পারে নি এবং অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারে নি। এরা একাই বসবাস করছে। দেশের বড় বড় নদীগুলাতে বড় বড় জলযান। বড় বড় সুস্বাদু ওরা এই মাছ খায়। সমুদ্রেও আরও মাছ আছে, সে মাছের আকারের ইউরোপের সমুদ্রের মাছের মতো। একে তো এরা সমুদ্রে যেতে পারে না এবং যেহেতু সমুদ্রের মাছের আকার এদের তুলনায় ক্ষুদ্র অতএব ওরা সমুদ্রে মাছ ধরার ঝুঁকি নেয় না। এদেশে গাছপালা ও পশুপাখি প্রচুর এবং তাদের আকারও বিরাট। কেন এমন হয়েছে তা দার্শনিকরা স্থির করবেন। মাঝে মধ্যে তিমি মাছ সমুদ্র উপকূলের সুচালো পাথরে আছাড় খেয়ে পড়লে এরা তিমিটাকে তুলে আনে, রান্না করে তৃপ্তি করে খায়। এই তিমি এত বড় যে একজন মানুষ তার কাঁধে ফেলে বয়ে আনতে পারে না তবে টুকরি করে লোরব্রুলগ্রুডে বয়ে আনে। একটা মাছ আমি রাজার ডাইনিং টেবিলে একটা ডিশে দেখেছিলাম। এ মাছ দুর্লভ তবে রাজা এ মাছ পছন্দ করলেন না, হয়তো এর বিরাট আকারের জন্যে। আমি অবশ্য গ্রীনল্যান্ডে এর চেয়েও বড় তিমি দেখেছি ।

এদেশের জনসংখ্যা মন্দ নয়। একান্নটি নগর আছে, দেওয়াল ঘেরা শহর আছে প্রায় একশ, গ্রাম আছে প্রচুর। পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে লোরক্রলগ্রুড নগরটির বর্ণনা দেওয়া উচিত। একটি নদীর দুই তীরে নগরটি প্রায় সমান দুই অংশে বিভক্ত। নগরে বাড়ি আছে আশি হাজারের উপর। দৈর্ঘ্যে নগরটি তিন গ্লংলু (অর্থাৎ ইংরেজি হিসেবে চুয়ান্ন মাইল) আর প্রস্থে আড়াই গুংলু। রাজার আদেশে নগরের রাজকীয় মানচিত্রটি মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং স্কেল অনুসারে আমি নিজে সেই একশ ফুট ম্যাপের উপর খালি পায়ে হেঁটে ম্যাপ যাচিয়ে দেখেছি।

রাজপ্রাসাদটি একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ বাড়ি নয়, সাত মাইল ব্যাপী অনেকগুলো বাড়ির সমষ্টি। প্রধান ঘরগুলো সাধারণত দু’শ চল্লিশ ফুট উঁচু এবং ঘরের মেঝের মাপও সেই অনুপাতে লম্বা ও চওড়া। গ্লামডালক্লিচ ও আমাকে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেওয়া হয়েছিল । গ্লামের গভরনেস সেই গাড়িতে করে গ্লাম ও আমাকে প্রায়ই শহর দেখাতে বেরোত, গ্লাম কিছু কেনার জন্যে কোনো দোকানেও ঢুকত। আমি আমার ঘর-বাক্স সমেত ওদের সঙ্গী হতাম । আমার অনুরোধে গ্লাম আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসত যাতে আমি শহরের. বাড়ি ঘর, লোকজন ভালো করে দেখতে পাই। আমাদের গাড়িটি ওয়েস্ট মিনিস্টার হলের মাপ মতো হবে তবে চৌকো। অতটা উঁচু হবে না হয়তো, ঠিক বলতে পারছি না।

একদিন কয়েকটা দোকানের সামনে গভরনেস গাড়ি থামাতে বলল। সেখানে বসে ছিল একপাল ভিখারি । গাড়ি থামাতে দেখেই তারা গাড়ি ঘিরে ফেলল। ইস্ কী বীভৎস দৃশ্য। এমন গা গুলোয়ে ওঠা দৃশ্য কোনো ইউরোপীয় দেখে নি। একটা বুড়ির বুকে ক্যানসার, একেই তো বিরাট ওদের শরীর তায় ফুলে আরো বড় হয়েছে, দগদগে ঘা আর গর্ততে ভর্তি। কয়েকটা গর্তয় আমি হয়তো ঢুকে যাব। একটা লোকের ঘাড়ে বিরাট এক টিউমার, পাঁচ গাঁট উলের সমান হবে। খট্ খট্ করতে করতে একটা ভিখারি এল, তার।কাঠের পা এক একটা পা কুড়ি ফুট। ভিখারিদের ছেঁড়া, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত জামা কাপড়ের উপর দিয়ে উকুন চরে বেড়াচ্ছে দেখে গা ঘিন ঘিন করতে লাগল । আমি আমার খোলা চোখে উকুনের পা ও অন্য অঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের দেশে মাইক্রোস্কোপে দেখা উকুনের চেয়ে আরো স্পষ্ট দেখছি। স্পষ্টভাবে এত বড় উকুন আমি এই প্রথম দেখলাম। সঙ্গে যন্ত্রপাতি বা ছুরি থাকলে (দুর্ভাগ্যক্রমে এসবই আমি জাহাজে ফেলে এসেছি) একটা উকুন ধরে ছিরে দেখতাম কিন্তু সব মিলিয়ে চারদিকের দৃশ্য এতই জঘন্য যে পেট থেকে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে।

আমি প্রাসাদে যে বাক্স-ঘরে থাকি সেটা গাড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার পক্ষে অসুবিধেজনক। তাছাড়া ওটা গ্লামডালক্লিচের কোলের রাখার পক্ষে উপযুক্ত নয়।

সেজন্যে মহারানি সেই ছুতোর মিস্ত্রিকে দিয়েই ছোটো একটা ঘর বাক্স তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। এটা লম্বা ও চওড়া উভয় দিকে বার ফুট আর দশ ফুট উঁচু। বাক্স তৈরি করবার সময় আমিও মিস্ত্রিকে কিছু নির্দেশ দিয়েছিলাম। এ বাক্সটাও ঠিক অন্য বাক্সের মতো তবে ছোটো। তিন দেওয়ালে তিনটে জানালা ছিল তবে দূর পাল্লার ভ্রমণে কোনো দুর্ঘটনা এড়াবার জন্যে জানালায় জাল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেদিকে জানালা ছিল না সেদিকে দুটো মজবুত আলত্রাপ ছিল। আমার যদি ঘোড়ার পিঠে চড়বার ইচ্ছে হত তাহলে আরোহীর কোমল বন্ধনীর সঙ্গে ঐ আলত্রাপ জুড়ে দেওয়া হত । আমি যখন রাজা বা মহারাজার সঙ্গে কোথাও যেতাম বা উদ্যানে বেড়াতে চাইতাম কিংবা কোনো মন্ত্রী বা মহিলার বাড়ি যেতাম এবং সেই সময় গ্লামডালক্লিচকে যদি তখন পাওয়া না যেত তাহলে কোনো বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে আমাকে এইভাবে পাঠানো হত।

ইতোমধ্যে অনেক উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এবং তাঁরা আমাকে তুচ্ছ মনে না করে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সে অবশ্য আমার গুণ অপেক্ষা তাঁদের সহৃদয়তার জন্যেই, তাঁদের বাড়ি আমি মাঝে মাঝে ঐ বাক্সয় উঠে ঘোড়ায় করে যেতাম অবশ্য ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে। যখন ঘোড়ার গাড়ি চেপে দূরে কোথাও ভ্রমণে যেতাম তখন গাড়ির ভিতরে ক্লান্তি লাগলে আমি বাইরে যেতে চাইলে কোচোয়ানের পাশে একটি কোমল বালিশের উপর আমার বাক্সটি বসিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু কোচোয়ানের বেল্টের সঙ্গে বাক্সটি সবসময় আটকে থাকত যাতে পড়ে না যায়। বাক্সর ভিতরে শোবার জন্যে বিছানা সমেত একটি খাট ছিল, সিলিং থেকে একটি হ্যামকও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মেঝের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আঁটা দুটি চেয়ার ছিল যাতে চেয়ার উল্টে আমি পড়ে না যাই। কিন্তু আমি সমুদ্র যাত্রায় অভ্যস্ত তাই গাড়ির ঝাঁকুনি মাঝে মাঝে বেশি হলেও আমাকে কাবু করতে পারত না।

যখন আমার শহর দেখবার ইচ্ছে হত তখন একটা বিশেষ ব্যবস্থা করা হত। আমার জন্যে তখন একটা তাঞ্জাম আনা হত। তাঞ্জামটা বইত চারজন মানুষ, মহারানির ভৃত্যদের উর্দি পরে। সঙ্গে আরো দুজন লোক যেত। সেই তাঞ্জামে গ্লামডালক্লিচ আমার বাক্স-ঘর তার কোলে নিয়ে বসত। শহরের লোকেরা আমার কথা শুনেছিল, তারা আমাকে দেখবার জন্যে তাঞ্জামের চারদিকে ভিড় করত। গ্লামডালক্লিচ আমাকে বাক্সঘর থেকে বার করে তার হাতের উপর রাখত যাতে লোকজন আমাকে ভালো ভাবে দেখতে পায়।

শহরের বড় মন্দিরটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা। বিশেষ করে মন্দিরের চুড়োয় উঠতে। কারণ ঐ চুড়ো হল শহরের সর্বোচ্চ, সব বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। আমার অনুরোধ রক্ষা করতে আমার নার্স আমাকে নিয়ে মন্দিরের চুড়োয় উঠল। চুড়োয় উঠে আমি নিরাশ হলাম কারণ জমি থেকে এটি মাত্র তিন হাজার ফুট উঁচু যা এদেশের মানুষের তুলনায় খুব একটা উঁচু নয়। এমন কি ইউরোপে এর তুলনায় অনেক উঁচু অট্টালিকা দেখা যায়, উদাহরণ স্বরূপ সলসবেরি স্টিপলের কথা বলা যায়। তবে আমি এদেশের কাছে নানাভাবে কৃতজ্ঞ, এদের ছোটো করতে চাই না। মন্দির চুড়োটা আমার আশানুরূপ উঁচু না হতে পারে কিন্তু এর কারুকার্য ও শিল্পশোভা অতি চমৎকার । মন্দিরটি অত্যন্ত মজবুত। বড় বড় পাথর কেটেএর দেওয়াল গাঁথা হয়েছে। দেওয়ালগুলো একশ ফুট চওড়া । প্রত্যেকটা পাথর চল্লিশ ফুট চৌকো। মন্দিরের গায়ে খাঁজে খাঁজে দেব দেবী অথবা সম্রাটদের মারবেল মূর্তি। বিরাট বিরাট সব মূর্তি, আসল মানুষের চেয়েও বড়। একটা মূর্তি থেকে একটা কড়ে আঙুল ভেঙে মাটিতে পড়ে ছিল, আমি সেটা তুলে মেপে দেখলাম চার ফুট এক ইঞ্চি। গ্রাম সেটা তুলে নিয়ে রুমালে বেঁধে বাড়ি নিয়ে চলল। তার বয়সী মেয়েরা এইসব টুকিটাকি সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখে।

মহারাজার রন্ধনশালাটি দেখবার মতো। বাড়িটার মাথায় একটা গম্বুজ আছে, ছ’শ ফুট উঁচু । বাড়ির তুলনায় উনুন তত বড় নয়, আমাদের সেন্ট পলস গির্জার গম্বুজের মতো হবে। উনুনটা আমি এদিক থেকে ওদিক মেপে দেখলাম, দশ কদম। রন্ধনশালার হাতা, খুন্তি ও অন্যান্য সরঞ্জামের বিবরণ দিলে তো পাঠকেরা বিশ্বাস করবে না, ভাববে সব ভ্রমণকারীর মতো আমি বুঝি বাড়িয়ে বলছি। আমি এইসব বর্ণনা দিতে বিরত থাকলাম কারণে এই বই যদি ব্রবডিংনাগ দেশের ভাষায় অনূদিত হয় তাহলে এদেশের রাজা ও প্রজারা ভাববে আমি বুঝি ওদের ছোটো করে দেখেছি।

মহারাজা তাঁর আস্তাবলে কখনো দু’শ এর বেশি ঘোড়া রাখতেন না। এক একটা ঘোড়া চুয়ান্ন থেকে ষাট ফুট উঁচু। যখন তিনি কোনো শুভদিন বা কোনো উপলক্ষে অন্যত্র যেতেন তখন তাঁর সঙ্গে পাঁচশ ঘোড়ার এক রক্ষীবাহিনী যেত, সে এক দারুণ দৃশ্য। ব্যাটালিয়াতে তাঁর অশ্বারহী সৈন্যবাহিনী দেখবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই চমৎকার দৃশ্যের আমি অন্যত্র বর্ণনা দেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *