লিলিপুটদের দেশে – ৬

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

[ লিলিপুটবাসীদের পরিচয়, তাদের শিক্ষা; তাদের আইনকানুন, তাদের রীতিনীতি, শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি। সেদেশে লেখকের জীবনযাপন। জনৈক অভিজাত মহিলাকে দুর্নাম থেকে রক্ষা।]

আমার মতলব ছিল যে সাম্রাজ্যের প্রবন্ধকার বিশেষ এবং আলাদা একটা রচনা লিখব। কিন্তু পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে আমি দ্বীপের একটা সাধারণ পরিচয় দেব।

দ্বীপবাসীদের গড় উচ্চতা মোটামুটি ছইঞ্চির নিচে এবং জীবজন্তু, পশু পাখি ও গাছপালার আকারও সেই অনুসারে। উদারহরণ স্বরূপ সবচেয়ে বড় ঘোড়া বা বলদ উচ্চতায় চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি, ভেড়া দেড় ইঞ্চি, কম বা বেশি। হাঁসগুলো আমাদের দেশের চড় ই পাখির চেয়ে ছোটো । ছোটো প্রাণীগুলো এইভাবেই ক্রমশ ছোটো হয়েছে। পোকামাকড় তো আমার চোখেই পড়ে না, সেগুলো এতই ছোটো যে আমার দৃষ্টির বাইরে। কিন্তু প্রকৃতি লিলিপুটিয়ানদের দৃষ্টিও সেই রকম করেছে। তারা ছোটো ছোটো জিনিসও ভালোই দেখতে পায় এবং নিখুঁতভাবে। তবে বেশি দূরে তারা দেখতে পায় না। তাদের দৃষ্টি কেমন প্রখর তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একদিন এক বাবুর্চিকে দেখলাম কোথা থেকে একটা লার্ক পাখি বার করল যেটা একটা মাছির মতো ছোটো, আর একদিন দেখি একটি তরুণী সেলাই করছে কিন্তু তার সুচ ও সুতো. দুইই আমার কাছে অদৃশ্য। তাদের সবচেয়ে উঁচু গাছ সাত ফুট লম্বা। রাজার বাগানে যেসব লম্বা গাছগুলো আছে আমি মুঠো করে হাত তুললেও তাদের স্পর্শ করতে পারি। শাকসবজিও সেই মাপ মতো। পাঠক তাদের আকার কল্পনা করে নেবেন।

আমি তাদের শিক্ষা ও পড়াশোনা সম্বন্ধে এখন বিশেষ কিছু বলব না তবে প্রায় সব বিষয়েই তাদের বিদ্যা কয়েক যুগ ধরে বিকশিত হয়েছে। তাদের হাতের লেখার পদ্ধতি বড়ই অদ্ভুত। তা ইউরোপীয়দের মতো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে নয় বা আরবীয়দের মতো ডান দিক থেকে বাঁ দিকেও নয়। চৈনিকদের মতো উপর থেকে নিচে নয় বা কাসকাজিয়ানদের মতো তলা থেকে উপর দিকে নয়। ইংল্যান্ডের অনেক মহিলার মতো ওরা কাগজের কোনাকুনি লেখে।

মৃতদেহ কবর দেবার সময় মাথা রাখে নিচের দিকে এবং পা উপর দিকে। তাদের মতে এগার হাজার চাঁদ পরে তারা আবার কবর থেকে উঠে আসবে। তারা মনে করে পৃথিবী চ্যাপ্টা এবং এইএগার হাজার চাঁদের মধ্যে পৃথিবী উল্টে যাবে। তখন মৃতরা পুনর্জীবন লাভ করবে এবং তাদের মাথা উপর দিকে হয়ে যাবে। তারা তাদের নিজেদের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে। এদের মধ্যে যারা পণ্ডিত তারা এই মতবাদে বিশ্বাস করে না; বলে এ অসম্ভব । তথাপি প্রচিলত প্রথা কেউ অমান্য করে না। এই রাজ্যে এমন কিছু আইন ও প্রথা আছে যা অতি অদ্ভুত। এইসব আইন ও প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত আইন ও প্রথা সমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত, তাহলেও এদের যুক্তি আছে। তবুও কথা হচ্ছে এগুলো ওরা মেনে চলে কিনা। প্রথম উদাহরণটি আমি দেব গুপ্তচরদের সম্বন্ধে। এদেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধের জন্যে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বিচারের সময় নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে পারলে, যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল তাকে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর খালাস পাওয়া আসামী যেহেতু তার নির্দোষিতা প্রমাণ করতে পেরেছে তখন অর্থ ও সময় অপচয়ের জন্যে; যে বিপদের ঝুঁকি তাকে নিতে হয়েছিল, কারাগারে অযথা তাকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে এবং তাকে আত্ম-সমর্থনের সময় যে মনোকষ্ট সহ্য করতে হয়েছে এ সবের জন্যে তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় চারগুণ। এই ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ ও সম্পত্তি আসে কোথা থেকে?

যে ব্যক্তি অভিযোগ করেছিল এবং যার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তার ধনসম্পত্তি থেকে। কিন্তু সে ব্যক্তির যদি যথেষ্ট পরিমাণে ধনসম্পত্তি না থাকে তাহলে রাজকোষ থেকেই সবকিছু মিটিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাটও মুক্তি পাওয়া আসামীকে কিছু আনুকূল্য বা সম্মান অর্পণ করেন এবং তার নির্দোষিতা সারা শহরে প্রচার করা হয়।

চুরি অপেক্ষা জাল জুয়াচুরিকে তারা বড় অপরাধ মনে করে এবং এজন্যে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। তারা বলে সাবধান হলে এবং নিজের জিনিসের উপর নজর রাখলে চোর চুরি করতে পারে না কিন্তু ঠক ব্যক্তি পরের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে বিপদে ফেলে । ঠক ব্যক্তি সততা ভঙ্গ করে। জিনিস বেচাকেনার সময় অসাধু ব্যবসায়ী যদি নির্দোষ ব্যক্তিদের ঠকাতে থাকে তাহলে সেই অসাধু ব্যবসায়ীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং তাকে রোধ করবার জন্যে যদি কোনো আইন না থাকে তাহলে এই অসাধুতা বাড়তেই থাকবে এবং নির্দোষ ব্যক্তি চোরের শিকার হবে। আমার মনে পড়ছে আমি একবার অপরাধীর জন্যে সম্রাটের কাছে মধ্যস্থতা করেছিলাম। লোকটির কাছে তার মনিব বেশ কিছু অর্থ গচ্ছিত রেখেছিল কিন্তু লোকটি সেই অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায়। লোকটির পক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আমি বলেছিলাম লোকটি শুধু বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধে অপরাধী। বিশ্বাসভঙ্গ বলে আমি যে লোকটিকে চরম দণ্ডের সামনে ফেলে দিলাম তা আমি বুঝতে পারি নি। তবে বুঝলাম বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রথা অপরাধের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব ভিন্ন হতে পারে।

প্রত্যেক সরকারের পুরস্কার ও তিরস্কার অথবা শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা আছে তবে তা সর্বদা প্রয়োগ করা হয় না। তিরস্কার বা শাস্তিদানে সরকার অনেক ক্ষেত্রে উদার কিন্তু পুরস্কারের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনুদার। একমাত্র লিলিপুটিয়ানদের দেখলাম তারা আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে। যদি কোনো ব্যক্তি প্রমাণ করতে পারে যে সে তিয়াত্তরটি চাঁদ ধরে দেশের আইন শৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলেছে তাহলে তার প্রচলিত জীবনধারাও ব্যক্তিগত গুণানুসারে তাকে নির্দিষ্ট একটি তহবিল থেকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয় বা সে ইচ্ছামতো ব্যয় করতে পারে। এছাড়া তাদের ‘স্নিলপল’ বা ‘আইনমান্যকারী’ উপাধি দ্বারা ভূষিত করা হয়। তবে এই উপাধি ওরা পুরুষানুক্রমে ভোগ করতে পারে না। আমি যখন ওদের বলতাম যে আমাদের ফৌজদারী দণ্ডবিধিতে শাস্তির বিধান আছে কিন্তু পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই ওরা অবাক হত। ওরা বলল ওদের বিচারালয়ে তাদের ন্যায়দেবীর ছটি চোখ আছে, দুটি সামনে, দুটি পিছনে আর দুটি দুপাশে । তিনি সব দিক দেখেন, তাঁর ডান হাতে আছে এক থলি সোনার মোহর আর বাঁ হাতে খাপেভরা তলোয়ার, শাস্তি অপেক্ষা পুরস্কারের ব্যবস্থাই অধিক।

চাকরিতে নিয়োগের জন্যে যোগ্যতা অথবা প্রার্থীর নৈতিক চরিত্র ও সততার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা বলে জনগণের জন্যেই সরকার, থানে জটিলতার কোনো স্থান নেই। জনগণ যেন সরকারি কাজকর্ম সহজ ও সরলভাবে বুঝতে পারে। অতি বুদ্ধিমান লোক নিযুক্ত করলে এবং তারা কোনো দোষ করলে তারা সেই দোষ ঢাকবার জন্যে চতুরতার আশ্রয় নেয়। কারণ সে বুদ্ধি তার আছে কিন্তু সরল একজন কর্মী দোষ করলে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমান ও কম যোগ্য কর্মী অপেক্ষা এই সরল মানুষকে বোঝা অনেক সহজ হয় এবং সে কাজে যে ভুল করেছে তা স্বীকার করার ফলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়ে না, সমাধান সহজ হয়।

অনুরূপভাবে এরা ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষকে চাকরির জন্যে মনোনীত করে কারণ তাদের সম্রাট ঈশ্বরে বিশ্বাসী। সেই ঈশ্বরের অস্তিত্বে যে বিশ্বাসী নয় সে সম্রাটেরও বিশ্বাসভাজন হতে পারে না। এইজন্যে এখানে চাকরিতে নিয়োগের জন্যে ক্রীড়াকৌশলে দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেখানে কোনো কারচুপি করার সুযোগ নেই। এই পরীক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান সম্রাটের ঠাকুর্দা প্রচলন করেছিলেন। অকৃতজ্ঞতা এদের দৃষ্টিতে মস্ত অপরাধ। তার যে উপকার করে সে উপকার সে যদি স্বীকার না করে তাহলে সে মনুষ্যজাতির শত্রু এবং এমন ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

লিলিপুটদের দেশে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য অথবা সন্তানদের প্রতি পিতামাতার কর্তব্যের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরস্পরের সম্পর্ক ওরা অন্য দৃষ্টিতে দেখে। ওরা বলে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে পশুর মতো মানুষেরও সন্তান জন্মায়। সন্তান তার অজান্তেই পৃথিবীতে এসেছে অতএব পিতামাতার প্রতি তার কোনো দায়দায়িত্ব না-ও থাকতে পারে । সেরকমই সন্তানদের শিক্ষার ভারও পিতামাতার হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই জন্যে প্রতি শহরে সাধারণের জন্যে নার্সারি স্কুল আছে। বাচ্চার বয়স যেই কুড়ি চাঁদ হবে কারণ সেই বয়সে শিশুদের কিছু জ্ঞানগম্যি হয়, তখন কুটিরবাসী ও শ্রমিক ব্যতীত প্রত্যেক বাপ মাকে তাদের ছেলেমেয়েদের নার্সারি স্কুলে পাঠাতে হবে। সেখানে তারা প্রতিপালিত হবে ও লেখাপড়া শিখবে। ছেলে ও মেয়েদের গুণ ও যোগ্যতা অনুসারে এই সব নার্সারি স্কুল কয়েক রকমের করা হয়েছে। এই সকল স্কুলে নানা গুণের যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা আছে। তারা বাপ মায়ের বিত্ত ও পদমর্যাদা অনুসারে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলে। অবশ্য শিশুরা কতখানি নিতে পারবে সেদিকে নজর রাখা হয়, জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না। আমি প্রথমে ছেলেদের নার্সারির কিছু কথা বলব তারপর মেয়েদের নার্সারির বিষয়।

ধনী ও অভিজাত পরিবারের ছেলেদের নার্সারি গুলোতে রাশভারী পণ্ডিত এবং যোগ্য সহকারী শিক্ষক নিযুক্ত আছে। শিশুদের আহার ও পোশাক সাধারণ। সম্মান ও সততা, ন্যায়বিচার, সাহস, শালীনতা, দয়া, ধর্ম ও দেশের প্রতি প্রেম ও আনুগত্যের ভিত্তিতে তাদের শিক্ষানীতি রচিত হয়েছে এবং তাদের সেই ভাবেই গড়ে তোলা হয়। আহার নিদ্রার অল্প সময় ব্যতীত ছাত্রদের কোনো না কোনো কাজে লিপ্ত রাখা হয়। তবে এর মধ্যে দুঘণ্টা খেলবার সময়। সেই সময়ে দৈহিক ব্যায়ামও করতে হয়। চার বছর বয়স পর্যন্ত তাদের জামাকাপড় পরিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু তারপর নিজেদের পোশাক নিজেকেই পরতে হয়, তারা যে পরিবারের ছেলে হোক না কেন।

কিছু বয়স্ক নারী কর্মী আছে। তাদের বয়স আমাদের পঞ্চাশ বছর বয়সের সমান। এই নারী কর্মীদের ঘরদোর সাফ, বাসন মাজা, ঝাড় পৌঁছ ইত্যাদি কাজ করতে হয়। ছাত্রদের কখনো ভৃত্যদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় না। সেজন্যে অশিক্ষিত লোক মারফত কুশিক্ষার পাবার সুযোগ পায় না। ছোটো থেকে বড় বা বড় থেকে ছোটো নার্সারিতে বা খেলাঘরে, মাঠে যাবার সময় সর্বদা সঙ্গে শিক্ষক বা তাঁর সহকারী সঙ্গে থাকেন। বাপ-মাকে বছরে দুবার তাদের ছেলেকে দেখতে দেওয়া হয় তাও এক ঘণ্টার বেশি নয়। শিক্ষক সে সময় উপস্থিত থাকেন এবং ফিসফিস করে বা গোপনে কোনো কথা বলা তখন নিষেধ। খেলনা, টফি চকলেট বা কোনো উপহার আনা নিষিদ্ধ। এমন কি আদর করাও নিষেধ তবে প্রথম সাক্ষাৎ ও বিদায়ের সময় বাপ-মা ছেলেকে চুম্বন করতে পারে। ছেলেদের শিক্ষার ও তাকে খুশি রাখার যাবতীয় খরচ বাপ মাকে দিতে হয় এবং সেই খরচ আদায় করার ভার সরকারের।

সাধারণ নাগরিক, ব্যবসায়ী, বৃত্তিধারী, পেশাজীবী এবং কারিগরদের ছেলেদের নার্সারিগুলোতে তুল্যমূল্যভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু যেসব ছাত্র পিতার বা অন্য কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণ করবে তাদের সাত বছর বয়স হলে শিক্ষানবিশি করতে দেওয়া হয় । যারা একটু উচ্চশ্রেণীর তাদের ছেলেদের পনের বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ আমাদের একুশ বছর বয়সের সমান পর্যন্ত শিক্ষানবিশ থাকতে হয় তবে সাধারণত শেষ তিন বছর ক্রমশ শিথিল করাও হয়। বড়ঘরের মেয়েদের নার্সারির ব্যবস্থা ছেলেদের নার্সারির মতো। তবে মেয়েদের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষকের উপস্থিতিতে দাসী তাদের জামাকাপড় পরিয়ে দেয় কিন্তু পাঁচ বছর পার হলেই মেয়েরা নিজেদের পোশাক নিজেরাই পরে । কিন্তু এইসব দাসী বা নার্স যদি কখনো মেয়েদের কাছে কোনো বাজে গল্প করে বা কুশিক্ষা দেয় তাহলে তাদের শহরে প্রকাশ্যে বেত মারা হয়, এক বছর জেল দেওয়া হয় অথবা দেশের কোনে। নির্জন স্থানে চিরজীবনের জন্যে নির্বাসন দেওয়া হয়।

ছেলেদের মতো মেয়েরাও সাহসী হতে শেখে, নির্বোধ হতে লজ্জা পায়। তারা অহেতুক দামি অলংকার পরে না তবে যেটুকু দরকার সেটুকু পরতে দেওয়া হয়। ছেলে ও মেয়েদের পাঠক্রমে আমি কোনো তফাত দেখি নি তবে মেয়েদের ব্যায়াম ও খেলা তাদের উপযোগী করা হয়েছে। এছাড়া মেয়েদের ঘর গেরস্থালীর কাজ ও সহবৎ শিখতে হয়। কারণ একদিন তারা বড় হবে, গৃহিণী হবে, স্বামীর পাশে দাঁড়াবে, অতিথিদের আপ্যায়ন করবে। বার বছর বয়স হলে মেয়েদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় কারণ তাদের তখন বিয়ের বয়স হয়েছে। যাবার আগে বাপ-মা শিক্ষকদের কাছে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যান এবং মেয়েও তার শিক্ষিকা ও বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে চোখের জল ফেলে। নিম্নস্তরের মেয়েদের নার্সারিতে মেয়েদের উপযোগী কাজ শেখানো হয়। যাদের শিক্ষানবিশির জন্যে মনোনীত করা হয় তাদের সাত বছর বয়েসে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বাকি মেয়েদের এগার বছর বয়স পর্যন্ত রাখা হয়।

নিম্নস্তরের ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েদের জন্যে নার্সারিতে তাদেরও বাপ-মাকে বছরে একবার টাকা দিতে হয় এবং একটা অংশ নার্সারির স্টুয়ার্ডকে দিতে হয়, তবে পরিমাণ কম । ধনী দরিদ্র সকলকেই তার ছেলেমেয়েদের প্রতিপালন ও শিক্ষার জন্যে নিয়মিত অর্থ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ লিলিপুটিয়ানদের মতে দেশে যত ইচ্ছা সন্তান হবে আর তাদের প্রতিপালন ও শিক্ষার জন্যে রাজকোষ থেকে অর্থ দেওয়া হবে তা চলতে পারে না। ধনী পিতামাতা তাদের সন্তানদের সকল ব্যয় নির্বাহের জন্যে নার্সারিকে বেশি পরিমাণ অর্থ দেয়। শিক্ষাখাতে যে অর্থ আদায় ও ব্যয় করা হয় তার আয় ব্যয়ের হিসেব কঠোর ভাবে রক্ষিত হয়।

কুটিরবাসী ও শ্রমিকদের সন্তানরা নার্সারিতে যায় না কারণ তাদের জন্যে নার্সারি নেই । তারা বাড়িতেই থাকে এবং বড় হলে বাপ মায়ের পেশা বা বৃত্তি গ্রহণ করে। তারা জমি চাষ করে বা অন্য কাজ করে। পুঁথিগত বিদ্যা তাদের কাজে লাগে না। এদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ বা রোগাক্রান্ত হয় তাদের হাসপাতালে আশ্রয় দেওয়া হয় কারণ লিলিপুট দ্বীপে ভিক্ষা নিষিদ্ধ । ভিক্ষা কী, তারা জানে না।

এবার আমার কথা কিছু বলি। ন’মাস তের দিন আমি দ্বীপে কী করে অতিবাহিত করলাম, কী করে সময় কাটাতাম, কী কাজ করতাম, এ বিষয়ে পাঠকদের কৌতূহল হতে পারে। মাথায় তো নানারকম বুদ্ধি খেলে এবং প্রয়োজনও আছে তাই একদিন রাজার বাগান থেকে কাঠ নিয়ে এসে নিজের জন্যে কাজ চালানো গোছের একটা টেবিল আর চেয়ার তরি করলাম। আমার শার্ট ও বিছানার চাদর তৈরি করবার জন্যে দুশ জন মেয়ে দর্জি নিযুক্ত করা হল । একটা টেবিলক্লথও তৈরি করতে হবে। ওরা যদিও বেশ মোটা ও মজবুত কাপড় এনেছিল তবুও তা আমার পক্ষে খুব পাতলা তাই ওরা কাপড়গুলো তিন পুরু করেছিল । শুধু তাই নয়, ওদের কাপড়ের থান তিন ইঞ্চি চওড়া আর তিন ফুট লম্বা অতএব সেইসব থান জুড়ে জুড়েও বড় থান তৈরি করতে হল। এবার আমার জামার মাপ নিতে হবে। আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম। বেশ মোটা দড়ি নিয়ে একজন দাঁড়াল আমার গলায় আর একজন আমার উরুর উপর। আর একজন একটা মাপবার ফিতে নিয়ে সেই দড়িটা মাপতে লাগল। এইভাবে ওরা শার্টের ঝুলের মাপ নিল। তারপর ওরা আমার বুড়ো আঙুলের ঘেরের মাপ নিল। বুড়ো আঙুলের ডবল মাপ নাকি কব্জির ঘেরের মাপ।

তারা আমার গলা ও কোমরের মাপও নিল। জামাটার প্যাটার্ন কেমন হবে তা বোঝাবার জন্যে আমি আমার পুরানো শার্টখানা জমিতে পেতে দিয়েছিলাম। তারা যে জামা তৈরি করল তা আমার গায়ে ঠিকই হয়েছিল। এরপর আমার কোট ও প্যান্ট তৈরি করতে হবে, সেজন্যে তিনশ দর্জি নিযুক্ত করা হল। আমার মাপ নেবার জন্যে তারা আমাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলল তারপর মই লাগিয়ে আমার ঘাড়ে উঠে ওলন দড়ি ফেলে কোটের ঝুলের মাপ নিল । আমি দেখলাম এইভাবে মাপ নিতে ওদের অযথা পরিশ্রম হচ্ছে এবং অসুবিধেও হচ্ছে। তখন আমি ওদের দড়ি দিয়ে আমার হাত, কোমর ইত্যাদির মাপ নিয়ে ওদের বলতে লাগলাম। তারা আমার বাড়ির ভেতর একটা ঘরে বসে আমার কোট প্যান্ট তৈরি করতে লাগল। আমার বাড়িতে কারণ, ওগুলো যত তৈরি হয়ে আসছিল ততই তো মাঝে মাঝে তুলে ধরবার দরকার হচ্ছিল। দেখা দরকার জিনিসটা কেমন হচ্ছে। এভাবে জামা প্যান্ট ওদের পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব নয় তাই মাঝে মাঝে আমাকেও সাহায্য করতে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত শার্ট, কোট ও প্যান্ট ভালোই দাঁড়াল।

আমার খাবার তৈরির জন্যে তিনশ বাবুর্চি ও খানসামা নিযুক্ত হয়েছিল। তারা আমার বাড়ির কাছে কুটির তৈরি করে সপরিবারে বাস করত আর আমার জন্যে দুটো পদ রান্না করে দিত । আমি কুড়িজন ওয়েটারকে আমার হাতে করে টেবিলে তুলে দিতাম, খিদমত খাটাবার জন্যে নিচে থাকত একশ জন। তাদের কাছে থাকত সুরার পিপে। ওপরে যারা থাকত তারা টেবিলের কানায় চাকা লাগিয়ে রেখেছিল। ইউরোপে আমরা কুয়ো থেকে যেমন করে জল তুলি ওরা তেমনি চাকার ভেতর দিয়ে দড়ি ঝুলিয়ে দিত। দড়ির প্রান্তে থাকত বালতি । নিচের খিদমতগারেরা পিপে থেকে বালতিতে মদ ঢেলে দিত। ওরা সেই মদ উঠিয়ে নিয়ে টুলে চড়ে আমার গেলাসে ঢেলে দিত। ওদের এক ডিশ মাংস আমি এক গালেই শেষ করতাম আর এক পিপে মদ আমার গলা ভেজাতে পারত, তার বেশি নয়।

ওদের মাটনও ভালো তবে খুব ছোটো কিন্তু বিফ-এর টুকরো বড় এবং অতি সুস্বাদু। একবার কোথা থেকে একটা কোমরের টুকরো এনেছিল যেটা আমি এক গ্রাসে খেতে পারি নি, তিনটে টুকরো করতে হয়েছিল, তবে এত বড় টুকরো বিরল। আমরা স্বদেশে যেমন সহজে মুর্গির ঠ্যাং চিবিয়ে খাই এখানে মাংসর সরু সরু হাড়গোড়াগুলো সেভাবে স্বচ্ছন্দে চিবিয়ে খেতে দেখে আমার বাবুর্চি, খানসামা ও ওয়েটাররা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। এছাড়া ওদের বিশ তিরিশটা পাখির মাংস আমি এক গ্রাসেই খেয়ে ফেলতাম। এমন রাক্ষুসে খাওয়া তো ওরা দেখে নি, অবাক হবেই তো!

আমার থাকা ও খাওয়ার খবর সম্রাটের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি স্বচক্ষে তা দেখবার জন্যে একদিন সম্রাজ্ঞী, রাজকুমার ও রাজকুমারীদের সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে আহার করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁরা সকলেই অনুগ্রহ করে এলেন এবং আমি তাঁদের সযত্নে আমার টেবিলের ওপর তুলে নিলাম। রাজবাড়ি থেকে তাঁদের বসবার চেয়ার, টেবিল ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম আনিয়ে আমার টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছিলাম । এই ভোজে সম্রাটের প্রধান কোষাধ্যক্ষ ফ্লিমন্যাপও এসেছিল। খাবার সময় আমি লক্ষ করতে লাগলাম যে ফ্লিমন্যাপ আমার দিকে বাঁকা চোখে চাইছে যা আমার ভালো লাগে নি । আমি অবশ্য সেদিন বেশ তৃপ্তি করেই খেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছিল। ফ্লিমন্যাপের কিছু একটা মতলব আছে। সম্রাট এই যে আমার বাড়িতে এলেন এর সুযোগ নিয়ে লোকটা নিশ্চয় সম্রাটের কান ভাঙাবে। আমার বিরুদ্ধে সে কিছু একটা করলে আশ্চর্য হব না। লোকটা স্বভাবগম্ভীর তবুও আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে যদিও সেটা দেঁতো হাসি তথাপি আমি জানি লোকটা আমার দুষমন। আমার অনুমান মিথ্যা নয়। ফ্লিমন্যাপ সম্রাটের কাছে অভিযোগ করেছে যে রাজকোষের অবস্থা ভালো নয়, তাকে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হচ্ছে কারণ হলাম আমি। আমাকে পুষতে সম্রাটের ইতোমধ্যেই সাড়ে লক্ষ প্রাগ (ওদের সবচেয়ে বড় আকারের স্বর্ণমুদ্রা, ছোটো চুমকির মতো হবে আর কি) খরচ হয়ে গেছে অতএব তার পরামর্শ প্রথম সুযোগেই আমাকে বরখাস্ত করা হোক। আমার জন্যে একজন নির্দোষ মহিলার কিছু দুর্নাম রটেছিল তবে আমি তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবার তাঁকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। সে কাহিনী এখানে বলা আমি কর্তব্য মনে করছি। রাজসভায় নানা রকম মানুষ থাকে, কারো বদঅভ্যাস পরনিন্দা করা, চুকলি কাটা, অথচ এর দ্বারা তার কোনো স্বার্থ সিদ্ধ হয় না।

এইরকম কোনো এক ব্যক্তি মহা-কোষাধ্যক্ষ ফ্লিমন্যাপের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় যে তার স্ত্রী আমার প্রতি অনুরক্ত যা একেবারেই অসম্ভব। এই মুখরোচক সংবাদটি মাত্র কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। মহিলা অবশ্য আমাকে পছন্দ করতেন, আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন তবে কখনো একা বা গোপনে আসেননি। যখনি এসেছেন তখনি সঙ্গে গাড়িতে এনেছেন অন্তত তিনজনকে, তাঁরা তার বোন ও কন্যা বা অপর কোনো আত্মীয় বা বান্ধবী। ওদেশের অভিজাত পরিবারের মহিলারা এমন দলবেঁধে অনেকের বাড়ি যান। আমার ভৃত্যদের বলা ছিল আমার বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি এসে থামলে যেন আগে খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে আমি তৎক্ষণাৎ নিজে গিয়ে ঘোড়া ও গাড়ি সমেত সকলকে তুলে এনে আমার টেবিলে রাখতাম।

টেবিলের এক অংশে আমি গোল বেড়া লাগিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম, তার ভেতরে গাড়ি থাকত যাতে পড়ে না যায়। গাড়িতে ছ’টা ঘোড়া থাকলে সহিস দুটো ঘোড়া খুলে দিত, আমি সেদুটোকে পরে তুলে দিতাম। গাড়ি, ঘোড়া, সহিস, কোচোয়ানে আমার টেবিল ভর্তি হয়ে যেত। আমি যখন অতিথিদের সঙ্গে কথা বলতাম তখন কোচোয়ান কাউকে গাড়িতে চাপিয়ে আমার টেবিলের ওপরেই গাড়ি ছোটাত। অনেক অপরাহ্ণ আমি আমার অতিথিদের সঙ্গে গল্প করে মহানন্দে কাটিয়েছি। এই ডাহা মিথ্যা আমার কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম, একজন নির্দোষ মহিলার নামে এমন জঘন্য কলঙ্ক রটনার জন্যে আমি কোষাধ্যক্ষ ও সেই দুজন বাজে লোক, ক্লুন্ট্রিল আর ড্রনলো, যারা এই কলঙ্ক রটিয়েছিল তাদের ওপর অত্যন্ত চটে গেলাম। আমি চ্যালেঞ্জ জানালাম যে তারা প্রমাণ করুক যে কোনো পুরুষ বা মহিলা কখনো আমার কাছে গোপনে বা ছদ্মবেশে এসেছিল কি না। অবশ্য মুখ্য সচিব রেলড্রেসলি একবার সম্রাট কর্তৃক আমার কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। সে ঘটনা আমি আগেই বলেছি। আমি দেশের সর্বোচ্চ ‘নারডাক’ উপাধিতে ভূষিত অতএব আমিও একজন মানী লোক। সেজন্যেও নয়, আমার.জন্যে একজন নির্দোষ মহিলার নামে কুৎসা রটবে এমন ঘটনা সহ্য করা যায় না।

কোষাধ্যক্ষ মশাইও উচ্চ সম্মানে সম্মানিত, তিনি ‘ক্লামগ্লাম’ উপাধি পেয়েছেন কিন্তু তা নারডাক অপেক্ষা এক ডিগ্রি কম। যেমন ইংল্যান্ডে ডিউকের পরে মারকুইসের স্থান। তথাপি ফ্লিমন্যাপ অতি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত এবং পদের সুযোগ সে পুরোপুরি গ্রহণ করেবাজে গুজবে বিশ্বাস করে সে শুধু আমাকেই নয়, তার স্ত্রীকেও অবহেলা করেছিল । পরে যদিও সে তার ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রীর সঙ্গে মিটমাট করে নিয়েছিল কিন্তু আমাকে সে অপদস্থ করতে ছাড়ে নি। সম্রাটও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *