লিলিপুটদের দেশে – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

[ লেখক সম্রাট ও তাঁর পুরুষ ও নারী সভাসদদের কিছু ক্রীড়াকৌশল দেখালেন। লিলিপুটদের ক্রীড়ানুষ্ঠান। কয়েকটি শর্তে লেখককে স্বাধীনতা দেওয়া হল। ]

আমার সদ্ব্যবহার, ভদ্রতা, সম্রাট ও তাঁর সভাসদ, সামরিক বিভাগ ও জনসাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। তাঁরা সকলেই সন্তুষ্ট বলে আমার মনে হচ্ছে। আমার আরো মনে হচ্ছে যে শীঘ্রই আমি মুক্তি লাভ করব । যাতে আমি সকলের মন যুগিয়ে চলে তাদের বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারি। আমি সেই চেষ্টাই করতে লাগলাম। স্থানীয় ব্যক্তিরাও ক্রমশ বুঝতে পারছে যে আমি তাদের কোনো ক্ষতি করব না। যেমন আমি মাঝে মাঝে শুয়ে পড়তাম এবং সেই সময়ে পাঁচ ছ’জন লিলিপুট যদি আমার হাতের চেটোয় উঠে নৃত্য আরম্ভ করে দিত তাহলে আমি কখনো বাধা দিতাম না। ছোটো ছেলেমেয়েরাও ক্রমশ সাহসী হয়ে আমার চুলের মধ্যে লুকোচুরি খেলত। আমি এখন ওদের ভাষা বেশ বুঝতে পারি এবং ওদের ভাষাতে কথাও বলতে পারি। সম্রাটের একদিন ইচ্ছে হল দেশীয় কিছু ক্রীড়া দেখিয়ে আমার চিত্তবিনোদন করবেন। নানারকম খেলাধুলায় লিলিপুটরা বেশ পারদর্শী এবং অনেক দেশের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। মাটি থেকে বার ইঞ্চি উপরে ও দু ফুট দীর্ঘ দড়ির (আমার চোখে সুতো) উপর তাদের খেলাগুলো দারুণ।

পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি হলেও আমি এ বিসয়ে কিছু বলব। রাজসভায় যারা বড় চাকরির প্রার্থী তাদের এই দড়ির খেলা শিখতে হয়। যে কোনো পরিবারের অথবা অল্প শিক্ষিত প্রার্থীরা যুবা বয়স থেকেই এই দড়ির খেলা শিখতে থাকে। যখনি কোনো বড় পদ খালি হয়, সে মৃত্যুর জন্যেই হোক বা অসাধুতার জন্যে কর্মচ্যুত হলে, প্রার্থীরা উক্ত শূন্য পদের জন্যে আবেদন করে । তখন সম্রাট ও তাঁর সভাসদদের মনোরঞ্জনের জন্যে দড়ির খেলা দেখাতে হয়। মাটিতে না পড়ে যে সবচেয়ে উঁচুতে লাফাতে পারবে শূন্য পদটি তাকেই দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করবার জন্যে এবং তিনি যে তাঁর কর্মকুশলতা অব্যাহত রেখেছেন তা দেখাবার জন্যে সম্রাট তাঁকেও দড়ির খেলা দেখাতে আহ্বান করেন। কোষাধ্যক্ষ ফ্লিমন্যাপকেও মাঝে মাঝে লাফিয়ে দড়ি ডিঙোতে বলা হয় তবে এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের যে কোনো সম্মানীয় প্রতিযোগী অপেক্ষা তাঁর জন্যে দড়ি এক ইঞ্চি উঁচুতে ধরা হয় । কোষাধ্যক্ষ মশাই এই খেলাটি উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন, তিনি কিছু অতিরিক্ত কৌশলও দেখাতেন। পক্ষপাতিত্ব না করেও বলতে পারি যে আমার বন্ধু ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্পর্কীয় মুখ্য সচিব রেলড্রিসালও বড় কম যায় না, কোষাধ্যক্ষের পরেই তাঁর স্থান আর বাকি সব বড় অফিসাররা মোটামুটি কৌশলী।

এই প্রতিযোগিতায় মাঝে মাঝে মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটে, সংখ্যা বড় কম নয়। আমি নিজেই দু’তিন জন প্রার্থীকে হাত পা ভাঙতে দেখেছি। কিন্তু বিপদটা আরো বড় আকারে দেখা যায় যখন মন্ত্রীরা স্বয়ং প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়। কারণ তাঁরা তাঁদের সহকর্মী অপেক্ষা যে সেরা তা প্রমাণ করবার জন্যে নিজ ক্ষমতা অপেক্ষা শক্তি প্রয়োগ করে ফলে তারা প্রায়ই আহত হয়। আমি এই দ্বীপে আসবার দু’এক বছর আগে আমার বন্ধু ফ্লিমন্যাপ তার ঘাড় ভেঙে ফেলত যদি না ভাগ্যক্রমে রাজার একটি কোমল কুশন তার পতনের স্থানে পড়ে থাকত।

আরো একটি ক্রীড়া আছে। কিন্তু সেটি বিশেষ উপলক্ষে কেবল সম্রাট ও তাঁর প্রথম সারির মন্ত্রীদের সমক্ষে দেখান হয়। সম্রাট তাঁর টেবিলের উপর ছ’ইঞ্চি মাপের সিলকের তিনটি সরু সুতো রাখেন । প্রথমটি নীল, দ্বিতীয়টি লাল এবং তৃতীয়টি সবুজ। সম্রাট যদি কাউকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ দেখাতে চান তখন এইগুলো তাদের শক্তির স্বীকৃতি স্বরূপ উপহার দেওয়া হয়। তবে তাদের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে হয়। প্রতিযোগিতাটি হয় সম্রাটের আড়ম্বর পূর্ণ চেম্বার অফ স্টেট হলে। এখানে প্রার্থীদের যে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে হয় তা আগে প্রতিযোগিতা থেকে ভিন্ন এবং এ ধরনের ক্রীড়া আমি পৃথিবীর, কোথাও দেখি নি।

সম্রাট দিকচক্রবালের সঙ্গে উভয় প্রান্ত সমান্তরাল রেখে হাতে একটি ছড়ি ধরেন এবং প্রার্থীদের কখনো ছড়িটি কয়েকবার লাফিয়ে অতিক্রম করতে হয়, আবার কখনো সামনে দিয়ে বা পিছন ফিরে ছড়ির নিচ দিয়ে যেতে হয়। সম্রাট অবশ্য ছড়িটি ইচ্ছামতো উঁচু নিচু বা এ পাশ ও পাশ করেন। সময় সময় তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছড়ির অপর প্রান্ত ধরেন আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী একাই ছড়িটি ধরেন। যে সর্বাপেক্ষা সহজে ছড়ির উপর বা নিচে দিয়ে ছড়িটি অতিক্রম করতে পারে তাকে নীল সুতো উপহার দেওয়া হয়। পরবর্তী স্থানাধিকারীকে দেওয়া হয় লাল সুতো এবং তৃতীয় ব্যক্তি পায় সবুজ সুতো। বিজয়ীরা এই রঙিন সুতো তাদের কোমরে বাঁধে। কোমরে এরকম রঙিন বন্ধনীযুক্ত অনেক অফিসারকে রাজসভায় দেখা যায়।

রাজার অশ্বশালার যোদ্ধাদের ঘোড়াগুলোও আমাকে চিনে নিয়েছিল। তারা আমাকে আর ভয় পেত না এবং আমার পায়ের খুব কাছে আসত। আমি মাটিতে হাত পাততাম আর অশ্বারোহী লাফিয়ে আমার হাতে নামত। একবার সম্রাটের একজন শিকারি তো তার ঘোড়ায় চড়ে আমার জুতোসমেত পা লাফিয়ে পার হয়েছিল। নিশ্চয় খুব কৃতিত্বের ব্যাপার। সম্রাটকে কতকগুলো অন্যরকমের খেলা দেখাবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল।

আমার নিজের খেলা নয়, লিলিপুটদের দিয়েই আমি খেলা দেখিয়েছিলাম। আমি সম্রাটকে বললাম দু’ফুট লম্বা এবং সাধারণ একগাছা বেতের মতো পুরু কিছু ছড়ি আমাকে আনিয়ে দিন। সম্রাট তখনি তাঁর বনবিভাগের মন্ত্রীকে সেইমতো আদেশ দিলেন। পরদিন সকালেই ছ’খানা আটঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে ছ’জন কাঠুরিয়া ছড়ি এনে হাজির । আমি ছড়ি বলছি কিন্তু ওদের কাছে এগুলো কাঠের মোটা গুঁড়ির সমান। আমি ন’খানা ছড়ি বেছে নিলাম তারপর সেগুলো চারদিকে পোঁতা ছড়িগুলার সঙ্গে মাটিতে শুইয়ে বেঁধে রাখলাম। তারপর আমি আমার রুমালখানা বেশ টান টান করে ঐ ন’টা ছড়ির মাথায় লাগিয়ে মাটিতে পোঁতা কাঠিগুলোর সঙ্গে বেঁধে দিলাম। তার মানে একখানা সামিয়ানা টাঙানো হল আর কি। কিন্তু ঢিলেঢালা নয় বেশ মজবুত করেই বেঁধে দিলাম। আমার কাজ শেষ করে আমি সম্রাটকে অনুরোধ করলাম বাছা বাছা চব্বিশ জন অশ্বারোহীকে আনতে। তারা আমার খাটানো এই সামিয়ানার উপর তাদের ক্রীড়াকৌশল দেখাবে। আমার প্রস্তাব সম্রাট অনুমোদন করলেন এবং অশ্বারোহী আনবার জন্যে হুকুম দিলেন। অশ্বারোহীরা আসতে আমি তাদের সবাইকে কাপ্তেন ও অস্ত্রশস্ত্র সমেত আমার খাটানো রুমাল-সামিয়ানার উপর তুলে দিলাম। তারা সার দিয়ে দাঁড়াল। এরপর ওরা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং তাদের তলোয়ার ও ভোঁতা তীর বা ভোঁতা বর্শা বার করে নকল যুদ্ধ আরম্ভ করে দিল। একদল আক্রমণ করে, অপর দল আক্রমণ প্রতিহত করে এবং পাল্টা আক্রমণ করে। বেশ মজার অথচ উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য। এমন চমৎকার কুচকাওয়াজ আমি দেখি নি। আমার রুমালটি বেশ মজবুত করেই বাঁধা ছিল, ওদের অসুবিধে হচ্ছিল না, যেন মাঠেই খেলা দেখাচ্ছে। এই কুচকাওয়াজ দেখে রাজা অত্যন্ত কৌতুক বোধ করলেন এবং এই খেলা পরপর কয়েকদিন চলবার আদেশ দিলেন। সম্রাট খেলাটি এতদূর উপভোগ করলেন যে তিনি আমাকে বললেন তাঁকে সামিয়ানার উপর তুলে দিতে। তখন তিনি নিজেই তাঁর ঘোড়সওয়ারদের আদেশ দিতে লাগলেন। শুধু তাই নয় তিনি আমাকে বললেন সিংহাসন সমেত মহারানিকে তুলে ধরে রাখতে যাতে তিনিও খেলাটি ভালো করে দেখতে ও উপভোগ করতে পারেন। আমি মহারানিকে মঞ্চ থেকে দু’গজ দূরে তুলে ধরে রাখলাম। সেখান থেকে তিনিও খেলা দেখে খুব আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। আমার ভাগ্য ভালো যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নি। কেবল একটা তেজী ঘোড়া রুমালে একটা সরু ছিদ্রে পা ঢুকিয়ে ফেলেছিল ফলে সে নিজেও পড়ে যায় এবং তার আরোহী কাপ্তেনকেও ফেলে দেয়। আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে ওদের তুলে দিয়েছিলাম। পরে আমি একহাত দিয়ে ফুটোটি বন্ধ করে অপর হাত দিয়ে ঘোড়সওয়ারদের একে একে সামিয়ানার উপর থেকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। যে ঘোড়াটা পড়ে গিয়েছিল তাঁর বাঁদিকের কাঁধে আঘাত লেগেছিল কিন্তু কাপ্তেনের কোনো আঘাত লাগে নি । রুমালটি আমি মেরামত করে দিয়েছিলাম তবে ঐ খেলার পুনরাবৃত্তি করতে আমি আর সাহস করি নি। রুমালটির উপর দিয়েও ধকল গেছে, জীর্ণ হয়েছে।

আমি মুক্তিলাভের দু’তিন দিন আগে যখন নানা অনুষ্ঠান মারফত সম্রাটের চিত্তবিনোদন করছিলাম সেই সময় একজন দ্রুতগামী অশ্বারোহী দূত ছুটে এসে সম্রাটকে খবর দিল যে দ্বীপে যেখানে আমি অবতরণ করেছিলাম সেখানে মস্ত বড় কালো রঙের একটা জিনিস পড়ে আছে। জিনিসটার আকার বড় অদ্ভুত। মাঝখানটা মানুষ সমান উঁচু আর চারদিক ঘিরে চওড়া বারান্দা মতো। প্রথমে ভেবেছিল এটা বুঝি কোনো প্রাণী কিন্তু পরে লক্ষ করে দেখল ওটা ঘাসের উপর শুধু পড়ে আছে, নিশ্চল। কেউ কেউ সাহস করে একজনের ঘাড়ে চেপে জিনিসটার মাথায় উঠল। মাথাটা চ্যাপ্টা, পা চেপে বোঝা গেল ওটা ফাঁপা । তাদের অনুমান জিনিসটি পাহাড়-মানুষের এবং মাননীয় সম্রাট আদেশ দিলে ওরা পাঁচটি ঘোড়া নিয়ে গিয়ে জিনিসটি নিয়ে আসতে পারে। আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছি ওরা কী জানাতে চাইছে। খবরটা পেয়ে আমি আনন্দিতই হলাম। জাহাজ ধ্বংস হবার পর নৌকায় উঠে টুপিটা মাথায় ভালো করে বসিয়ে দিয়ে আটকে দিয়েছিলাম। নৌকোতে তো প্রচুর ধকল গেছে, দড়িটা কোনো সময়ে ছিঁড়ে গেছে।

তারপর আমি দ্বীপে অবতরণ করে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তখন কোনো এক সময়ে টুপিটা আমার মাথা থেকে খুলে পড়ে গিয়ে হয়তো বাতাসে দূরে কোথাও ছিটকে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সমুদ্রে সাঁতার দেবার সময় টুপিটা হয়তো আমার মাথা থেকে খসে গেছে। আমি সম্রাটকে অনুরোধ করলাম যত শীঘ্র সম্ভব টুপিটা আনিয়ে দিতে। জিনিসটি ও তার ব্যবহার কী তা আমি সম্রাটকে বুঝিয়ে দিলাম। পরদিনই এক দল ঘোড়সওয়ার টুপিটি নিয়ে এল। কিন্তু টুপির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। ওরা টুপির কানায় দুটো বড় বড় ফুটো করেছে। সেই ফুটোয় হুক আটকে দিয়েছে। হুকে দড়ি বেঁধে ঘোড়ার সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে, তা প্রায় আমাদের আধ মাইলটাক হবে । তবু তো জমি এবড়োথেবড়ো নয়, বেশ মসৃণ বলা যায় তা নইলে টুপির দফা রফা হয়ে যেত ।

এই ঘটনার দুদিন পরে। সম্রাট সৈন্যবাহিনীর একটা বড় অংশ রাজধানীর আশে পাশে ব্যারাকে থাকত। রাজামশাইয়ের কী খেয়াল হল তিনি বাহিনীর সেনাপতিকে আদশে দিলেন যে পাহাড়-মানুষ তার দুই পা যতদূর সম্ভব ফাঁক করে দাঁড়াবে সৈন্যবাহিনী পতাকা উড়িয়ে ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে সেই দুই পায়ের তলা দিয়ে মার্চ করে যাবে। সেনাপতি সমরবিদ্যায় অভিজ্ঞ এবং আমার অনুরক্ত। আদেশ পেয়ে সেনাপতি তাঁর বাহিনীকে সাজাতে আরম্ভ করলেন। কোন বাহিনীর পর কোন বাহিনী, পদাতিক কতজন থাকবে, অশ্বারোহীরা পাশাপাশি ক’জন থাকবে, তাদের হাতে পতাকা থাকবে, কোন সুরে ব্যান্ড বাজবে ইত্যাদি সব তিনি সম্পূর্ণ করে ফেললেন। তিন হাজার পদাতিক এবং হাজার অশ্বারাহী কুচকাওয়াজে যোগ দেবে। সম্রাট কঠোর আদেশ জারি করলেন যে সৈন্যরা যেন তাদের শালীনতা ও শোভনতা বজায় রাখে, কেউ যেন আমাকে উপহাস না করে তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কিন্তু ছোকরা সৈন্য বা অফিসারদের দোষ দেওয়া যায় না। আমার পরনের ব্রিচেস জোড়ার যে শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল তা দেখে ওদের মধ্যে যে কেউ হাসি সংবরণ নাও করতে পারে। তবে কেউ আমাকে বিদ্রূপ করে নি।

আমি আমার মুক্তি দাবি করে সম্রাটের কাছে বার বার আবেদন করতে লাগলাম। সম্রাট তখন প্রথমে তাঁর মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং পরে জাতীয় প্রতিনিধি মণ্ডলীর পূর্ণ অধিবেশনে আমার মুক্তি প্রসঙ্গটি পেশ করলেন। কেউ আপত্তি করল না। ব্যতিক্রম শুধু স্কাইরেস বলগোলাম। কে জানে কেন বিনা প্ররোচনায় সে আমার দুষমন হয়ে গেল। সে একা কী করবে? আমার মুক্তির বিরুদ্ধে আর কেউ আপত্তি করল না।

এবং সম্রাট স্বয়ং আমার মুক্তি সমর্থন করলেন। রাজার অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন মন্ত্রী হলেন গালবেত, অভিজ্ঞ রাজনীতিক। আমার মুক্তির শর্তগুলো তিনি রচনা করলেন অবশ্য স্কাইরেস বলগোলামের দাবিতে। নইলে হয়তো আমার মুক্তির জন্যে কোনো শর্তই আরোপ করা হত না। সেই শর্তগুলো স্কাইরেস স্বয়ং আমার কাছে নিয়ে এল, সঙ্গে এনেছিল দুজন আন্ডার সেক্রেটারি এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। শর্তগুলো আমাকে পড়ে শুনিয়ে শপথ নিতে বলা হল। শপথ নিতে হবে প্রথমে আমার স্বদেশ প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ও পরে লিলিপুটদের দেশের নির্ধারিত আইন মোতাবেক। শপথ নেবার সময় আমাকে বাঁ হাত দিয়ে আমার ডান পা ধরতে হবে। আমার ডান হাতে মাঝের আঙুল দিয়ে আমার মাথা স্পর্শ করতে হবে আর বুড়ো আঙুলটি রাখতে হবে আমার ডান কানের ডগা ছুঁয়ে। সেই বিচিত্র দেশের জনগণের আচার ব্যবহার ইত্যাদি এবং আমার মুক্তির শর্তগুলো জানবার জন্যে পঠকদের নিশ্চয় কৌতূহল হচ্ছে। অতএব তাঁদের কৌতূহল নিবারণের জন্যে আমি সেগুলো প্রতিশব্দ অনুসারে যথাসাধ্য অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম।

গোলবাস্টো মোমারেন এভলেম গুরডিলো শেফিন মুলি উলি গিউ, লিলিপুটদের সর্বশক্তিমান সম্রাট যিনি বিশ্বের একাধারে আনন্দ ও ভীতি, পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত পাঁচ হাজার ব্লুটুগ (বার মাইল আন্দাজ পরিধি) ব্যাপী যার সাম্রাজ্য, যিনি রাজার রাজা, মানবপুত্রগণ অপেক্ষা দীর্ঘ, যার পদভারে মেদিনী কাঁপে, যার মস্তক সূর্য স্পর্শ করে এবং যার ঈষৎ অঙ্গুলি হেলনে পৃথিবীর যে কোনো রাজার জানু কম্পিত হয়, যিনি বসন্তের মতো মনোরম গ্রীষ্মের মতো আরামপ্রদ শরতের মতো ফলপ্রসু কিন্তু শীতের মতো ভয়ংকর এ হেন মহামহিম রাজাধিরাজ সম্রাট আমাদের স্বর্গরাজ্যে সদ্য আগত পাহাড়মানুষের জন্যে নিম্নোক্ত শর্ত আরোপ করছেন যা তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ নিয়ে কঠোর ভাবে পালন করতে হবে।

এক: আমাদের মহামান্য সম্রাটের পাঞ্জাযুক্ত অনুমতি পত্র ব্যতীত পাহাড়-মানুষ আমাদের রাজ্য ছেড়ে যেতে পারবে না।

দুই: আমাদের বিশেষ অনুমতি ব্যতীত যে আমাদের রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং রাজধানীতে আসবার আগে তাকে অন্তত দু ঘণ্টার সতর্কতামূলক নোটিস দিতে হবে যাতে নগরবাসীরা নিজ নিজ আবাসে আশ্রয় নিতে পারে।

তিন: উক্ত পাহাড়-মানুষ কেবলমাত্র নগরের বড় রাস্তা দিয়েই চলবে এবং কখনো মাঠ বা শস্যক্ষেতের উপর দিয়ে হাঁটবে না বা সেখানে শয়ন করবে না।

চার: রাস্তা দিয়ে সে যখন হাঁটবে তখন যেন বিশেষভাবে নজর রাখে যাতে সে আমার প্রিয় কোনো নাগরিক ও তাদের ঘোড়া বা গাড়ি পদদলিত না করে ফেলে এবং রাজি না হলে কোনো নাগরিককে যেন নিজের হাতে তুলে না নেয়।

পাঁচ: জরুরি প্রয়োজন হলে পাহাড়-মানুষ জরুরি বার্তা বহনের জন্যে অশ্বসমেত অশ্বারোহী দূতকে তার পকেটে বহন করে নিরাপদে নিয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে নিরাপদে সম্রাটের কাছে ফিরিয়ে আনবে। এ কাজ তাকে করতে হবে যে কোনো এক চন্দ্রের ছ’দিন।

ছয়: ব্লেফুসকু দ্বীপবাসীরা আমাদের শত্রু, তারা আমাদের আক্রমণ করবার তোড়জোড় করছে। যদি আমাদের আক্রমণ করে তাহলে পাহাড়-মানুষকে আমাদের মিত্র হতে হবে এবং ওদের নৌবহর ধ্বংস করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।

সাত: উক্ত পাহাড়-মানুষ তার অবসর সময়ে আমাদের শ্রমিকদের সাহায্য করবে। আমাদের প্রধান পার্কটির দেওয়াল গাঁথবার জন্যে অথবা কোনো রাজপ্রাসাদ তৈরি করারসময় ভারী ভারী পাথরও তাকে তুলে দিতে হবে।

আট: উক্ত পাহাড়-মানুষ দুই চাঁদ সময়ের মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রটা পায়ে হেঁটে ঘুরে এসে তার মাপ দাখিল করবে।

সর্বশেষে আমরা বিশ্বাস করি উক্ত পাহাড়-মানুষ এই শপথ গ্রহণ করবে এবং শর্তগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। এজন্যে তাকে প্রতিদিন আমাদের ১৭২৮ জনের ভরণপোষণের উপযুক্ত মাংস ও পানীয় সরবরাহ করা হবে। আমাদের রাজপুরুষদের কাছে সে যেতে পারবে এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও তাকে দেওয়া হবে। আমাদের শাসনের একানব্বইতম চন্দ্রের দ্বাদশ দিবসে বেলফ্যাবোরাক প্রাসাদে এই চুক্তি সম্পাদিত হল।

আমি শপথ গ্রহণ করলাম এবং শর্তগুলো আনন্দের সঙ্গে মেনে নিলাম। যদিও কয়েকটা শর্ত আমার পক্ষে সম্মানজনক ছিল না। সেই শর্তগুলো নৌবহরের প্রধান স্কাইরেস বেলগোলাম আমার প্রতি হিংসাবশে আরোপ করতে তার প্রভাব বিস্তার করেছিল। শপথ গ্রহণ এবং শর্ত মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শেকল খুলে দেওয়া হলো৷ আমি মুক্ত হলাম। আমি স্বাধীন। এই অনুষ্ঠানের পুরো সময় সম্রাট আমা কাছে ছিলেন। আমি তাঁর পদতলে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাকে উঠতে আদেশ করলেন এবং তারপর অনুগ্রহ করে আমার প্রতি যেসব প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলেন তার পুনরাবৃত্তি করলে আমার অহংকার প্রকাশ করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করলেন যে আমি তাঁর উপযুক্ত ভৃত্য হব এবং আমার প্রতি যে আনুকূল্য দেখানো হয়েছে ও ভবিষ্যতে দেখানো হবে আমি তার মর্যাদা রাখব।

পাঠক বোধহয় লক্ষ করেছেন যে আমার মুক্তিদান উপলক্ষে আমার শেষ শর্তে, সম্রাট অনুগ্রহ করে আমার জন্যে যে খাদ্য ও পানীয় বরাদ্দ করেছেন তা ১৭২৮ জন লিলিপুটবাসীর উপযুক্ত। কিছুদিন পরে রাজপরিষদে আমার এক বন্ধুকে আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে তারা ঠিক কী করে ১৭২৮ জনের হিসাব করলেন, অনুমানিক নয় একেবারে যথার্থ সংখ্যা।

উত্তরে আমার সেই বন্ধু বললেন যে সম্রাটের গাণিতিকরা কোয়াড্রান্টের সাহায্যে আমার দেহটা মেপে নিয়ে তাদের নিজের একজন মানুষের দেহের তুলনা করেছে এবং সেই অনুপাতে তারা হিসেব করে ঐ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। অতএব এই হিসেব থেকেই পাঠক লিলিপুটবাসীদের মেধা সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *