লক্ষ্মণ মাণিক্য
‘মেঘমন্দ্র, কুলিশ নিস্বন, মহারণ, ভূলোক দ্যুলোকব্যাপী
অন্ধকার উগরে আঁধার, হুহুঙ্কার শ্বাসিতে প্রলয় বায়ু,
ঝলকি ঝলকি তাহে ভায়, রক্তকায় করাল বিজলিজ্বালা,
ফেনময়, গর্জি মহাকায়, ঊর্মিধায়, লঙ্ঘিতে পর্বত-চূড়া।’
– বিবেকানন্দ
‘বাছা! ভেবো না, ভোরে এখানেই পাবে কূল। কূলে উঠে মাটি খুঁড়ো। খুঁড়লেই দেখবে আমার পাথরের মূর্তি, প্রতিষ্ঠা করো এইখানে, তুমি হবে এখানকার রাজা।’
তখন রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে, তন্দ্রার ঘোরে বিশ্বম্ভর শূর দেখলেন, এমনই এক স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। জেগে উঠে, সবার কাছে বললেন, তাঁর স্বপ্নের কথা।
ক্রমে রাতের আঁধার দূরে গেল। পূর্ব দিকে উঠল অরুণ। পাখিরা ডাকল। তাদের ডাকে, সকলে জেগে উঠে, সবিস্ময়ে দেখলেন, যেখানে আগের দিন অগাধ জল করছিল থৈ থৈ, সেখানে এক প্রকাণ্ড বালুকাময় ভূমি করছে ধূ-ধূ।
বিশ্বম্ভর শূর ছিলেন মিথিলাবাসী রাজ্য আদিশূরের বংশধর। যাচ্ছিলেন, সপরিবারে নৌকারোহণে চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শন করতে। নৌকো মেঘনা বেয়ে চলছিল। রাত্রিকাল – মাঝিরা মেঘনার অকূল জলে ফেলেছিল দিক হারিয়ে। সেখানে মেঘনা সমুদ্রের মতো বিস্তীর্ণ। জলহীন দেশের লোক নদীর এমন বিস্তার দেখে পাচ্ছিলেন ভয়। ভয়ে ভয়ে ঘুম, ঘুম তো নয় তন্দ্রা, সেই তন্দ্রা ঘোরে দেখছিলেন স্বপ্ন। স্বপ্নে যা দেখছিলেন তা তো আগেই বলেছি।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে, দেবীর নির্দেশ মতো মাটি খুঁড়ে, সত্যি সত্যি পেলেন। মার এক পাথুরে বারাহী মূর্ত্তি, স্থির হলো সেইদিনই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্রাহ্মণ তো সঙ্গেই ছিলেন, প্রতিষ্ঠায় কোনোই কষ্ট হলো না।
কিন্তু সারা দিন উঠল না এতটুকুনও রোদ। আকাশ রইল কুয়াশায় ছেয়ে। কিচ্ছু দেখবার উপায় নেই, সেই আঁধারে আঁধারেই হলো মূর্ত্তির প্রতিষ্ঠা। মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেই যে নৌকা ছেড়ে দেবেন তারও উপায় রইল না। কুয়াশা না দূর হলে নৌকো ছাড়বার উপায় নেই। সে নৌকায় তো আর কম্পাস বা দিক নির্ণয় যন্ত্র ছিল না – দিক ভুল হলে সমুদ্রে পড়ে যে যাবে প্রাণ। কাজেই তারা সারা দিন রাত রইলেন সেই চড়াতেই।
পরদিন সূর্যোদয় হলো, সকলে চেয়ে দেখলেন, দেবীকে স্থাপন করা হয়েছে পূর্বাভিমুখে, বিশ্বম্ভর শূর মশাই তা দেখে বলে উঠলেন— পশ্চিমে লোক কিনা তাই – ‘ভুল হুয়া’ অর্থাৎ ভুল হয়েছে। সেই থেকে আজ অবধি ঐ জায়গার নাম হয়ে রয়েছে ‘ভুলুয়া’! দেবদেবীর মূর্তি দক্ষিণ বা পশ্চিমমুখী করে স্থাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে হলো তার ব্যতিক্রম- ভুল। এই ভুলুয়া পরগণা আজকাল নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত। ভুলুয়ার এই মা বারাহী দেবীর তিন তিনটে মুখ, চারটে হাত। দেবীমূর্ত্তির এখনো আছে, ‘আমিক্ষাপাড়া’ বলে এক গ্রামে, পুরোহিতগণের বাড়ীতে দর্শকেরা তাঁর দেখা পেয়ে থাকেন।
বিশ্বম্ভর শূরের অধস্তন চতুর্থ পুরুষই হচ্ছেন আমাদের বাংলার দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম ভৌমিক লক্ষ্মণ মাণিক্য মশাই।
বিশ্বম্ভর শূর মশাই সত্যি সত্যি মার কৃপায় রাজা হলেন। সব লোক হলো তাঁর বাধ্য। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বাংলা দেশে খাঁটি ক্ষত্রিয় কেউ ছিলেন না। অথচ তাদের থাকতে হবে এই দেশে। ছেলে হলো, মেয়ে হলো। বিয়ে দিতে হবে তো? ক্ষত্রিয়োচিত যা কিছু কাজকর্ম সবই করতেন কায়স্থেরা। এই জন্য তিনি কায়স্থদের সঙ্গেই বিয়ের সম্পর্ক করতে লাগলেন। তখন তো আর রেলগাড়ি, স্টিমার, মোটর, এরোপ্ল্যান ছিল না— শিগগিরই কোথাও যাওয়া যেত না, কাজেই বারবার মিথিলায় যাওয়ার চেয়ে, তিনি তাঁর মেয়েকে, গাভার পরমানন্দ ঘোষের সঙ্গে বিয়ে দেন। চন্দ্রদ্বীপের কায়স্থ সমাজ এতে ভারী ক্ষুন্ন হন। পরমানন্দ ঘোষ মশাই একঘরে হন। নিরুপায় হয়ে তিনি ভুলুয়ায় তার শ্বশুর মশাইয়ের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এই সংবাদে লক্ষ্মণ মাণিক্য মশাই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে এর প্রতিকারে সচেষ্ট হন।
রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য, চন্দ্রদ্বীপ-সমাজাধিপতি রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায়ের পুত্র রাজা রামচন্দ্র রায়, বিক্রমপুর সমাজাধিপতি রাজা কেদার রায়, ভূষণা সমাজাধিপতি রাজা মুকুন্দরাম রায় মহাশয় ও যশোহর সমাজাধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্যের নিকট তাঁর জামাতা গাভার পরমানন্দ ঘোষের দুর্দশার কথা, বিস্তারিতভাবে, সবিনয় জ্ঞাপন করলেন।
তারা সকলেই অত্যন্ত সদ্বিবেচক লোক ছিলেন। সকলেই বুঝলেন, লক্ষ্মণ উচ্চ বংশের সন্তান, গাভার ঘোষেরাও উচ্চবংশ। তাছাড়া রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য একজন বিশিষ্ট রাজাও বটেন! এমতস্থলে তাদের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করলে অপরাপর কায়স্থগণের কোনোই অন্যায় হয় না। এই সমস্ত ভেবে, সমস্ত দলপতিই ভুলুয়ার অধিপতিকে সাহায্য করতে সম্মত হলেন।
রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের বাড়ীতে একটা বিয়ে উপস্থিত হলো, সকলেই সেই বিয়েতে যোগদান করলেন, এলেন না কেবল বিক্রমপুরের জন কয়েক অভিমানী কায়স্থ। দলপতিরা তাদের সমাজচ্যুত করলেন ও ঘটকদের দিয়ে লিখালেন:
‘বেচাগ্রাম স্থিতা সর্ব্বে।
যে চতুর্ম্মণ্ডলে স্থিতা;
চান্দনী-চাকুলী চৈব
নাস্তি তেষাং কুলং বুধা।’
এই জন্য, বিক্রমপুরান্তর্গত বেজগাঁ, চতুর্মণ্ডল, চান্দনী ও চাকুলীবাসীগণ কুলহীন হলেন।
মগদের অত্যাচারের কথা আগেই বলেছি। তারা বড়ই বাড়াবাড়ি শুরু করলে। রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের রাজ্যেও লুটতরাজ আরম্ভ করে দিলে। একে একে তিন-তিনবার রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য তাদের তাড়িয়ে দিলেন, সমাজপতিদের সঙ্গে যুক্তি করে সামাজিক শাসনের সৃষ্টি করে এক আজ্ঞা প্রচার করলেন যে কারও বাড়ীর উপর দিয়ে অক্ষত শরীরে কোনো মগ চলে গেলে তাকে সমাজে অচল করা হবে। কিন্তু এত করেও মগদের শাসন করা সম্ভব হয়ে উঠল না। গোদের উপর বিষফোড়ার ন্যায় তারা আবার নতুন উপায়ে দেশের লোকদের জ্বালাতন শুরু করলে।
রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের ছিলেন এক ভাই, তিনি বড় ভাইকে তাড়িয়ে নিজেই রাজা হবেন এমন একটা ষড়যন্ত্র করছিলেন। সেই গৃহশত্রু বেশ জানতেন যে মগদের রাজা আরাকানাধিপতিই হচ্ছেন তাঁর দাদার প্রধান শত্রু। তিনি সেই শত্রুর সঙ্গে গোপনে করলেন মিত্রতা। মিত্রতা করে বাইরের কুমীরকে ঘরে ডেকে আনবার ব্যবস্থা করলেন। আরাকানরাজকে ভুলুয়া আক্রমণ করতে পরামর্শ দিলেন। নিজেও কতকগুলো লোভী, বর্বর সৈন্য নিয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে সহসা যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। ষড়যন্ত্রে রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য পরাস্ত হলেন ও রাজ্য ছেড়ে খিজিরপুরে গিয়ে অন্যতম ভৌমিক ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলির শরণাপন্ন হলেন, ঈশা খাঁর সঙ্গে ছিল বাদশার পরমপ্রিয় রাজা মানসিংহের ভাব। মানসিংহ বাদশাকে লিখে, বাংলার সেনাপতিকে নিয়ে, বাংলার বার ভূঁইয়ার সাহায্যে মগদের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন।
শহর কসবায় যুদ্ধ আরম্ভ হলো। যুদ্ধে মগেরা এমনভাবে পরাজিত হলো যে একজন মগও ভুলুয়া অঞ্চলে থাকতে পারলে না। এই যুদ্ধের মতো যুদ্ধ বড় একটা হয় না, এখনো কসবার মাটি খুঁড়ে সেই যুদ্ধের বন্দুক, কামান, তীর, ধনুর চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।
তখনকার যুদ্ধ, এখনকার যুদ্ধের মতো ছিল না। বারুদ গেঁদে বন্দুক ও কামান ছোড়া হতো, এখন মেসিনে মিনিটে মিনিটে বহু গুলি ছোড়া হয়, তখন কার্টিজ ছিল না, মেসিন ছিল না। এখন কার্টিজ ও মেসিন হয়েছে। তখনকার কামান, বন্দুক ছুড়তে হতো কত দেরী, ততক্ষণ কিন্তু শয়ে শয়ে গুলোলের গুলি, ধনুকের তীর এসে বিপক্ষের প্রাণ করত নাশ, তখন এখনকার মতো বন্দুক আর কামান দিয়ে ঠিক যুদ্ধ চলত না। দূরের শত্রুদের ধ্বংস, ও দুর্গ ভাঙবার জন্যই কামান, বন্দুক বেশি চালানো হতো। নিকটে যুদ্ধ আরম্ভ হলে হতো তরোয়ালে তরোয়ালে, বর্শায় বর্শায় যুদ্ধ।
এইভাবে ভুলুয়ার লক্ষ্মণ মাণিক্য আবার রাজা হলেন। তার রাজা হবার লোভী ভাই পড়লেন ফাঁপরে। অগত্যা তিনি দাদার শরণাপন্ন হলেন। এত দিন পরে কুচক্রী ভাইকে ফিরে পেয়ে রাজার বড় আনন্দ হলো। তিনি বারাহী দেবীর পূজার বিশেষ ব্যবস্থা করলেন ও বহু ভূ-সম্পত্তি দেবোত্তর করে দিয়ে মায়ের এই বিশেষ কৃপার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এছাড়া রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য নানা জায়গা থেকে বহু বিদ্বান, গুণবান ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যাদি ও হিন্দুদের এনে জায়গীর নিয়ে ভুলুয়াতে স্থাপন করলেন।
রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য যশোরের রাজাকে বিয়েতে অধিক সম্মান করেন। এতে যশোরের রাজার জামাতা চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র রায় ভারী রেগে যান এবং সৈন্য সামন্ত ও জাহাজ নিয়ে রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। রাজা রামচন্দ্র ছিলেন যুবক, এদিকে লক্ষ্মণ মাণিক্য নিজে ছিলেন অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ। তার শক্তির কথা শুনলে আশ্চর্য্য বোধ হয়। তিনি প্রত্যহ এক এক মণ লোহার এক একটা মুগুরের দুটো মুগুর ভাঁজতেন। এক মন লোহার বর্ম পরে নামতেন যুদ্ধে, তাঁর মতো এত ভারী জিনিস পরে যুদ্ধ করতে বড় বেশি শোনা যায় না।
গায়ে বল থাকলে, অনেক সময় মানুষ একটু হঠকারী হয়ে ওঠে। রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যেরও তাই হলো। যুদ্ধে রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য রাজা রামচন্দ্র রায়কে নিজ হাতেই ধরে আনবার জন্য এক লাফ দিয়ে তাঁর রণতরীতে পতিত হলেন। কিন্তু একা কি করবেন, কি হবে তা আর ভাবলেন না! যা হবার তাই হলো। রাজা রামচন্দ্র বহু সৈন্যের সহায়তায় তাকে বন্দী করে চন্দ্রদ্বীপে নিয়ে গেলেন।
চন্দ্রদ্বীপে নিয়ে তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন। কিন্তু রাজা রামচন্দ্রের মা এমন বীরকে হত্যা করতে মানা করলেন। রাজা মায়ের কথামতো লক্ষ্মণ মাণিক্যকে তাঁর কারাগারে বন্দী করে রাখলেন।
রাজা রামচন্দ্রের ভারী শখ হলো যে রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের শরীরে কত বল আছে, তিনি কেমন বীর একবার নিজে পরীক্ষা করে দেখবেন। এই মনে করে, তিনি রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যকে কারাগার হতে শৃঙ্খলমুক্ত করে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। লক্ষ্মণ মাণিক্য শৃঙ্খল মুক্ত হয়েই রাজা রামচন্দ্রকে বধ করতে উদ্যত হলেন। রাজা রামচন্দ্রের দেহরক্ষীগণ লক্ষ্মণ মাণিক্যকে ধরে ফেলে, রামচন্দ্রের প্রাণ রক্ষা করল।
এইবার রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের অন্তিমকাল ঘনিয়ে এল, রাজা রামচন্দ্রের মা হুকুম দিলেন, লক্ষ্মণ মাণিক্যকে কেটে ফেলতে। ঘাতক তৎক্ষণাৎ তাঁর আদেশ পালন করল। সামাজিক কেলেঙ্কারিতে যার হয়েছিল সৃষ্টি সেই আগুনে বঙ্গের এমন বীর চলে গেলেন, আর আসবেন কি না কে জানে।