প্রতাপাদিত্য গুহ
‘শোর নগর ধাম, প্রতাপ আদিত্য নাম,
মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতসায় কেহ নাহি আঁটে তাঁ’য়
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।।
বরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর
বাহান্ন হাজার যাঁ’র ঢালী।
ষোড়শ হলকা হাতী, অযুত তুরঙ্গ সাতি
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।।’
-ভারত চন্দ্র
তিনশ’ সাড়ে তিনশ’ বছর আগেকার কথা। তখন মোসলমান পাঠানদের আমল। শেষ পাঠান সুলতান দাউদ ছিলেন সম্রাট। বঙ্গজ প্রসিদ্ধ কুলীন কায়স্থ আঁশ গুহের সন্তান শ্রীহর্ষ ছিলেন সুলতানের প্রধান কর্মচারী। তাঁর প্রতিভার ছিল না অন্ত, দক্ষতার ছিল না শেষ। নানাগুণে মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাঁকে ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ উপাধি দান করেন। আর তাঁর খুড়তুতো ভাইকে দেন ‘রাজা বসন্ত রায়’ উপাধি।
যমুনা হতে সাগর-দ্বীপ অবধি সারা চব্বিশ পরগণা, যশোর ও খুলনার অর্ধাংশ ছিল তাঁদের জায়গীর। মোগলেরা যুদ্ধ বাঁধালেন, পাঠানদের রাজ্য গেল। রাজা বিক্রমাদিত্য গৌড় ত্যাগ করে রাজধানীর যশোরে এলেন, মোগল সম্রাটকে কর দিতে স্বীকার করে, করলেন রাজ্য রক্ষা। রাজা বিক্রমাদিত্য আর রাজা বসন্ত রায় দু’ভায়ে রাজত্ব করতে লাগলেন। ছিলেন পাঠানদের লোক হলেন মোগলদের। এমন সময় রাজা বিক্রমাদিত্যের হলো এক ছেলে। রাজবাড়ীতে ভারী আনন্দ কিন্তু বিধাতার লীলা বুঝা ভার। সূতিকা ঘরেই রাণী মারা গেলেন, নবজাত কুমারের পিতা রাজা বিক্রমাদিত্য আর তাঁর ভাই রাজা বসন্ত রায় আর তাঁর স্ত্রীর যত্নে কুমার দিন দিন
শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো বাড়তে লাগলেন, যেমন তার রূপ, তেমনই তাঁর বলিষ্ঠ দেহ। একদিন, দুদিন করে, একমাস দু’মাস করে, একবছর, দু’বছর করে কুমার বেশ বড় হয়ে উঠলেন, কুমারের নাম রাখা হলো প্রতাপাদিত্য। উপযুক্ত শিক্ষক যত্ন করে, তাকে পড়াচ্ছেন। অসাধারণ মেধাবী সে কুমার, যা শেখেন তা আর ভোলেন না। ক্রমে সংস্কৃত, বাংলা, আরবী, পারসী প্রভৃতি ভাষায় ওস্তাদ হয়ে উঠলেন। শুধু তাই নয় অস্ত্রশস্ত্রও বাদ গেল না। ক্ষত্রিয় কায়স্থ রাজবংশে তাঁর জন্ম, যুদ্ধ শিখবেন না তিনি? তাও কি হয়?
রাজার ইচ্ছা নয় যে ছেলে যুদ্ধবিদ্যা শেখে। কিন্তু ছেলের সেই দিকেই বেশী ঝোঁক। একটা কথা আছে না, সকাল বেলাই বুঝা যায় সারা দিনটা কেমন যাবে, এও তাই। কুমারের শৈশবকালেই তাঁর অসাধারণ অস্ত্র নৈপুণ্য, নানাভাবে ফুটে উঠল। সুবোধ, শান্তশিষ্ট ছেলেটি নন তিনি প্রতিভা আর। বিদ্যুতে বুঝি কিছু ঐক্য আছে— কেউ-ই পারে না ঠিক থাকতে। দুই-ই চঞ্চল দুই-ই অস্থির। পিতার সঙ্গে ছেলের আরও এক জায়গায় দেখা দিল বে-মিল। পিতা বুদ্ধিমান ছেলে হৃদয়বান। এ অনৈক্য যে সে অনৈক্য নয় বিভ্রাট আর ঝগড়া বাঁধে বাঁধে অবস্থায়, সে সবের মীমাংসা করে দিতেন, বসন্ত রায় মহাশয়। আর একটা মজার কথা শোনো- ঠিক এই সময়, ভারত বর্ষেরই আর একটা জায়গায় জন্মিলেন, আর এক রাজবংশে, আর এক রাজকুমার। একজন জন্মিলেন, দুর্গম অরণ্যপরিবেষ্টিত সুন্দরবনের পাশে বাংলা দেশের যশোরে, অন্যজন জন্মিলেন রাজপুতানার দুর্গম গিরিসঙ্কট উদয়পুরে। একজনের নাম হলো প্রতাপাদিত্য, অন্যজনের নাম হলো প্রতাপসিংহ। দুজনেরই কীর্তিতে ভারতবর্ষ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। যশোরে আর রাজপুতানায় যে দুই প্রতাপ জন্মিলেন, তাঁদের জন্মের সময় কমনীয় রমণী কণ্ঠের হুলুধ্বনির অভ্যর্থনায় কেউ এতটুকুনও অনুমান করতে পারেনি যে অদূর ভবিষ্যতে, একদিন, তাদের মহোজ্জ্বল মহিমায় কোটি কণ্ঠ বন্দনা-মুখর হয়ে উঠবে।
মোগলেরা করতেন নানা অত্যাচার, নানা উপদ্রব। কিশোর প্রতাপ সেসব শুনতেন, উদ্বিগ্ন হতেন, অত্যাচার নিবারণের জন্য সঙ্কল্প করতেন, আর তাঁর বাবা রাজা বিক্রমাদিত্য, বাদশাহের বল, বাদশাহের ক্ষমতা, বাদশাহের অগণিত সৈন্য ও অর্থের কথা বলে ছেলেকে নিরস্ত্র ও দুর্বল করে তুলতেন।
প্রতাপ সারাদিন যুদ্ধ শিখতেন, মল্লক্রীড়া, অশ্বারোহণ ও শর চালনায় ব্যাপৃত থাকতেন।
একদিন হলো কী— কিশোর বয়সের প্রতাপ ছুঁড়লেন একটা চিলের উপর একটা তীর। চিল উড়ছিল। আর তার ওড়া হলো না, প্রতাপের অমোঘ তীরের আঘাতে ছটফট করতে করতে, ঘুরে এসে পড়ল রাজা বিক্রমাদিত্যের সামনে। সবই ভগবানের লীলা! রাজার মন বড্ড খারাপ হয়ে উঠল। কি এ ছেলেটা। রাগে তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।
যাচ্ছেতাই একটা কাণ্ডই হতো যদি সে সময় রাজা বসন্ত রায় সেখানে না আসতেন। তিনি অনেক বলে কয়ে তার দাদা বিক্রমাদিত্যের রাগ কমালেন। কুমারের আশ্চর্য শর-নৈপুণ্যের কথাও ফেনিয়ে বলতে ছাড়লেন না।
ঘটনার এমনই চক্র, ঠিক সেই সময়ে কুমার প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে এসে জুটলেন অসাধারণ সাহসী বীর, যুবক চক্রবর্তী আর সূর্যকান্ত গুহ। ভারী মজা হলো। ‘একা রামে রক্ষা নেই দোসর লক্ষ্মণ।’ এক প্রতাপের কাণ্ডেই সকলে চমৎকার বোধ করছিল, এবার আরও দু-দুজন। সঙ্গীদের নিয়ে তিনি আরম্ভ করে দিলেন ঘোড় দৌড়, বন্দুক ছোড়াছুড়ি ও সুন্দরবনে প্রবেশ করে ভীষণ, বড় বড় যত সব বাঘ, ভালুক শিকার। ঔদ্ধত্যের আর সীমা রইল না। বাবা আর কাকা কি করেন এ দামাল ছেলে নিয়ে? দুজনে বুদ্ধি খাটিয়ে, প্রতাপকে বিয়ে করালেন। কিন্তু বিয়ে করিয়ে বউ ঘরের আনলে হবে কি? প্রতাপ ক্ষেপে উঠেছেন মোগল-সম্রাটের শিকল ভাঙ্গতে, বিয়ের মতো শিকল দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখার চেষ্টা একটা প্রহসন ছাড়া যে কোনো কিছুই নয়, তা তাঁর বাবা আর তাঁর কাকা বুঝলেন না।
সেদিন প্রথম বসন্তের রাত্রি ছিন্ন কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে নির্মল আকাশ ফুটে বেরুচ্ছে। রাত্রি তখন প্রায় অবসন্না হয়ে এসেছে, দিগন্তের শ্যাম রেখায়, অরুণ্যের আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, প্রতাপের বাবা আর কাকা দুজনে পরামর্শ করছেন। পরামর্শ করে প্রতাপকে পাঠালেন, মোগল সম্রাটের দরবারে। ভাবলেন, মোগল-সম্রাটের ঐশ্বর্য্য দেখলেই প্রতাপের দম্ভ কমে যাবে, প্রতাপের বিরক্ত মন সুরক্ত হবে। রাজা বিক্রমাদিত্য সামন্তরাজা, তার প্রতিনিধি হয়ে তার ছেলে সম্রাটের দরবারে দিল্লীতে প্রেরিত হলেন।
প্রতাপ ভাবলেন, তা ভালোই করছেন তাঁর বাবা আর তাঁর কাকা। সঙ্গী শঙ্কর আর সূর্য্যকান্তকে সঙ্গে করে, নানা উপহারের ডালি নিয়ে প্রতাপ নৌকায় দিল্লীতে উপস্থিত হলেন।
দিল্লীর সম্রাট মোগল কুলতিলক আকবর বাদশাহ। তাঁর অমাত্য ছিলেন তোডলমল্ল। প্রতাপকে দেখে তাঁরা ভারী খুশি হলেন। দিন যায়, রাত আসে – রাত যায় দিন আসে, প্রতাপ তীক্ষবুদ্ধি বেশ বুঝলেন, সম্রাট আকবরের কূটনীতি। কিন্তু করবেন কি, সেই হচ্ছে কথা। যত সব বড় বড় রাজা, সবারই সঙ্গে সম্রাট করেছেন, করছেন কুটুম্বিতা কারও আর মাথাটিও তুলবার উপায় নেই।
কুমারের মন বড় খারাপ হলো। সেদিন শ্যামবর্ষা আকাশে তাঁর বিজয় অভিযান শুরু করেছে। মেঘে মেঘে ঢেকে গেছে সারা নভোমণ্ডল। নীলিমায় ভরে উঠেছে দিগ্বলয়। সজল পবন কিশলয় ছিঁড়ে, উড়িয়ে খেলছে। ক্ষীণা স্রোতস্বতীতে নেমেছে বর্ষার প্লাবন- উদ্দাম তার গতি।
সহসা তাঁর মনে এক বুদ্ধি খেলল। তার বাবা সম্রাটকে দেবার জন্য তার সঙ্গে যে দু’বছরের খাজনা দিয়ে দিয়েছিলেন, তা আর তিনি সম্রাটকে দেননি— দিলেনও না। না দিয়ে সম্রাটকে কৌশলে জানিয়ে দিলেন যে, যশোরের রাজা বিক্রমাদিত্য অর্থাৎ তার বাবা সম্রাটের দুবছরের খাজনা বন্ধ করেছেন। এ কিন্তু তার ভারী অন্যায়। সম্রাট যখন খুব রেগে গেলেন তখন প্রতাপাদিত্য সম্রাটকে জানিয়ে দিলেন যে সম্রাট তার সে খাজনা অনায়াসেই পেতে পারেন, যদি তিনি প্রতাপাদিত্যকে রাজ্যের সনদ দেন- রাজা বলে স্বীকার করেন। খাজনা তো পাবেনই তাছাড়া প্রতাপাদিত্য বাংলার বিদ্রোহও দমন করে দেবেন। সম্রাটের প্রবল সহায়ও হবেন।
প্রতাপাদিত্য রাতদিন দরবারের হালচাল তীব্র দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলেন। একদিন এক মজার কাণ্ড হলো। দরবারে উঠল এক সমস্যা। কেউ আর তা পূরণ করতে পারলেন না। পূরণ করলেন কুমার প্রতাপাদিত্য। সুযোগ যখন আসে তখন এমনি করেই আসে। সম্রাট ভারী খুশি হলেন। তার পরেই প্রতাপের এই প্রার্থনা, সঙ্গে সঙ্গে এতগুলো বাকি খাজনা অনায়াসে লাভ করে সম্রাট তার উপর একেবারে যারপরনাই প্রীত হয়ে উঠলেন। যশোরের রাজ সনদ তো প্রতাপ পেলেনই তাছাড়া তাঁর সম্মানের জন্য সম্রাট তাঁর দেহরক্ষীরূপে কমল খোঁজার অধীনে দিলেন বহু সৈন্য।
প্রতাপের আনন্দ দেখে কে! পথে পথে সম্রাটের অধিকৃত বিভিন্ন রাজ্য— নানা দুর্গ দেখতে দেখতে এসে উপস্থিত হলেন যশোরে।
সম্রাটের সনদের বলে তিনি এখন রাজা। তাঁর বাবা সব শুনলেন। মনে মনে বড় অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহী ছেলেকে শায়েস্তা করতে সচেষ্ট হলেন। প্রতাপের কাকা রাজা বসন্ত রায়ের কানে একথা গেল। তিনি তাঁর দাদাকে বুঝিয়ে, ফুলের মালা নিয়ে প্রতাপের শিবিরে গেলেন। প্রতাপকে সাদরে ও সস্নেহে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। প্রতাপের বাবার তখন অনেক বয়স। প্রায় সব বিষয়ের ভার তিনি ছেড়ে দিলেন তার ছেলের ওপর। পিতায় পুত্রে মিলন হলো।
প্রতাপ রাজকার্যে মন দিলেন। তিনি অনুসন্ধান করে দেখলেন তার রাজ্যে অন্য কোনো অশান্তি তেমন কিছু নেই, মস্ত বড় অশান্তিই সৃষ্টি করছে যত সব, আরাকানের মগেরা আর পর্তুগালের ফিরিঙ্গীরা। তারা জল পথে আসছে আর বরিশাল, খুলনা, চব্বিশ পরগণা প্রভৃতি তার রাজ্যে লুটপাট করছে। আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, গ্রামকে গ্রাম পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে, স্ত্রীলোকদের উপর পিশাচের মতো অত্যাচার আরম্ভ করে দিয়েছে। তাদের দমন না করলেই নয়। কিন্তু তারাও কম দুষ্টু নয়। প্রতাপ ভেবেচিন্তে কয়েকটা ভালো ভালো দুর্গ তৈরি করালেন, কতগুলো জাহাজ গড়ালেন, গোলাবারুদ তৈয়ারী করালেন। তারপর সুশিক্ষিত সব সৈন্যকে নিয়ে এইসব দুর্গ হতে, জাহাজ হতে গোলাবর্ষণ করে হাজার হাজার ডাকাতকে পুড়িয়ে মারলেন, দূরে যারা ছিল তারাও ভয়ে পালিয়ে গেল। আপদ চুকে গেল। দেশের লোক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল।
আকাশ সেদিন ঘোর মেঘলা, কুলায়ে কুলায়ে পাখীরা স্তব্ধ। বর্ষণকাতর বন যুঁথিকার ছিন্নদলের নেই কোনো সুষমা, নেই কোনো সৌরভ- আনন্দ বিহীন বহির্জগৎ- শুধু বহির্জগৎ কেন বুঝি রাজা প্রতাপাদিত্যের অন্তর্জগৎও আলোড়িত হচ্ছিল নানা ভাবের সংঘর্ষে। স্বাধীনতা ঘোষণা করলে, যে যুদ্ধ বাঁধবে তার ফল কি হবে কে জানে? কিন্তু আশা। দরিদ্রের আশার ন্যায়ই কি তার বুকের ভিতর উঠবে আর লীন হয়ে যাবে? না- না তা হতে পারে না- প্রতাপাদিত্য পড়েছিলেন ঋষিদের সেই উদাত্ত গাঁথা-
‘উত্থানেনামৃতং লব্ধমুত্থানেন সুরাহতাঃ
উত্থানেন মহেন্দ্রেন শ্রেষ্ঠং প্রাপং দিবীহচ।’
উদ্যমের দ্বারাই দেবতারা অমৃত লাভ করেছিলেন, তাঁদের উদ্যমেই অসুরেরা পরাজিত হয়েছিল, ইন্দ্র বড় হয়েছিলেন, স্বর্গরাজ্য লাভ হয়েছিল।
স্বাধীনতা?— সে ধন তো কোনো জাতি কোনোদিন দান স্বরূপে পায়নি। নিজের উদ্যমে, নিজের চেষ্টায়, নিজের ত্যাগ স্বীকারে, নিজের পরিশ্রমে, পৌরুষের পুরস্কার রূপে তাকে যে অর্জন করতে হয়।
এমন সব আয়োজন, এমন সব উদ্যোগ করতে হবে, যাতে পরাজয়ের আশঙ্কা না থাকে—তিনি যশোরের নিকটে ধূমঘাটে গড়ালেন এক দুর্ভেদ্য দুর্গ।
দুর্গ গড়া হচ্ছে, একদিন এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেল। বনে জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে আগুনের শিখা। সকলে দেখে বিস্মিত হলেন। রাজার নিকট সংবাদ গেল। তিনি অনুসন্ধান করে দেখলেন অগ্নি-নির্গমনস্থলে দাঁড়িয়ে করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা কালীমূর্তি। রাজা প্রতাপাদিত্যের মন আনন্দে নেচে উঠল। যশোরেশ্বরীর মূর্তি দেখে, ভক্তি গদগদ কণ্ঠে তিনি তাঁর স্তব করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলেন মা প্রসন্না হয়ে নিজে দেখা দিয়েছে, তার চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ নিশ্চিত। মায়ের দয়া হলে কি হয়? দেশময় এ শুভসংবাদ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ল। উৎসাহ ও উদ্দীপনার সীমা রইল না।
বৃদ্ধ রাজা বিক্রমাদিত্য ঠিক এই সময়ে দেহত্যাগ করলেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের পিতৃশ্রাদ্ধ। বাংলার রাজন্যবর্গ ও পণ্ডিতমণ্ডলী নিমন্ত্রিত হলেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের নিমন্ত্রণে দেশের প্রায় অধিকাংশ হিন্দুরাজা ও মোসলমান নবাব এসে উপস্থিত হলেন। সকলকেই বিশেষ আদর-আপ্যায়িত করে সন্তুষ্ট করা হলো। চতুর রাজা কথা প্রসঙ্গে সকলেরই মনের ভাব জানতে চেষ্টা করলেন। সম্রাট আকবরের উপর কার কেমন প্রীতি, কার কেমন ভীতি তাও তিনি জেনে নিলেন। সকলেই শুধু ভয়ে জড়সড় হয়ে আছেন কিন্তু স্বাধীনতা সকলেরই কাম্য। কেউ যদি সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন, সকলেই গোপনে বা প্রকাশ্যে তার সহায়তা করবেন এই আশ্বাস ও এই ধারণা প্রতাপাদিত্যের মনে বদ্ধমূল হলো। আশায় উৎফুল্ল হয়ে রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে অগ্রসর হলেন।
আপদ ও সঙ্কটের জায়গায়ই গড়লেন ভালো ভালো দুর্গ। জলপথে যুদ্ধ ও গতিরোধের নিমিত্ত গড়ালেন ভালো যুদ্ধের জাহাজ, বজরা আর পানসী নৌকা। বহুদূর থেকে যেখানে যা ভালো তাই জোগাড় করে, লোহা, পাথর আনিয়ে হাজার হাজার কামান আর বন্দুক, গোলা, গুলি, বারুদের যোগাড় হলো। বাকি রইল সৈন্য। তাই বা বাকি থাকবে কেন? উচ্চ-নীচ নানা জাতি থেকে বাছা বাছা জোয়ান নিয়ে সাহসী লোকদের ধরে, সন্তুষ্ট করে তার সৈন্যদল গড়ে উঠল, যারা এতদিন ছিল জলের দস্যু, ঘোর শত্রু, তারা হলো রাজা প্রতাপাদিত্যের চেষ্টায় ও সদ্ব্যবহারে তার পর্তুগিজ ও মগ সৈন্য। অসভ্য অথচ দুর্ধর্ষ কুকীরাও দলে দলে এসে তার সৈন্যদলে ভর্তি হলো। নায়ক হলেন বীর শঙ্কর ও সূর্যকান্ত ।
রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকা রাজা বসন্ত রায়ের ছেলে কচু রায়, যার ভালো নাম ছিল রাঘব, তাঁকে কয়েকজন কুচক্রী লোক, রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে শত্রুতা বাড়াবার জন্য ষড়যন্ত্র করে নিয়ে রেখে এল হিজলীর নবাব ঈশা খাঁর কাছে। জ্ঞাতিবিরোধ যদি উপস্থিত হয়, তাহলে ঘর সামলাতে অত্যন্ত বেগ পেতে হবে ভেবে রাজা প্রতাপাদিত্য সর্বাগ্রে নবাবকে এই দুষ্কর্মের সহায়তার জন্য শাস্তি দিতে যুদ্ধের আয়োজন করলেন। অস্ত্রশস্ত্রে যুদ্ধের জাহাজ সব ভরে, মা যশোরেশ্বরীকে খুব ঘটা করে পূজা দিয়ে, সঙ্গে সেনাপতি শঙ্কর, সেনাপতি সূর্যকান্ত, সেনাপতি রডা, মদন, রঘু প্রভৃতি বীরবৃন্দকে নিয়ে রাজা প্রতাপাদিত্য হিজলী আক্রমণ করলেন। স্থলপথেও অসংখ্য সৈন্য প্রেরিত হলো। জলে স্থলে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। রাজার অবিরামবর্ষী কামানের গোলার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না। নবাব গোলার আঘাতে দেহত্যাগ করলেন। নবাব মারা গেলে তার সেনাপতি বলবন্ত সিংহ বেশীক্ষণ পাঠান সৈন্যগণকে নিয়ে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারলেন না। হিজলী প্রতাপাদিত্যের অধীন হলো। হিজলী জয় হলো সত্য কিন্তু রাজা তাঁর ভাই রাঘবকে হাত করতে পারলেন না। রূপরাম বলে একটি কুচক্রী লোক ছিল, সে রাঘবকে নিয়ে দিল্লীতে পালিয়ে গেল। বাদশাহের নিকট রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অনেক কিছু অতিরঞ্জিত করে জানাল।
বিজয়ী রাজা প্রতাপাদিত্য মহাউল্লাসে ও মহাসমারোহে অনেক ধনরত্ন নিয়ে ঘরে ফিরলেও শান্তিতে থাকতে পারলেন না। বিক্রমপুরের অন্য ভূঁইয়া, রাজা চাঁদ রায় নানা কারণে রাজা প্রতাপাদিত্যের উপর খড়গহস্ত হয়ে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত হলেন। প্রতাপাদিত্য এতে ভয় পাওয়ার লোক ছিলেন না। তিনি মুহূর্ত বিলম্ব না করে, সসৈন্যে ঢাকার বিক্রমপুরের রাজধানী শ্রীপুর আক্রমণ করলেন। অল্প সময়ে বহুসৈন্য ধ্বংস হলো। রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের চৈতন্য হলো। এ যে আত্মকলহ! সন্ধি হলো। দু’রাজার মিত্রতাও হলো। তাঁরা শেষে ঠিক করলেন যে মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করবেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের দুর্গ ধূমঘাটে স্বাধীনতা জ্ঞাপক অভিষেক হবে। দেশের সকল রাজাকে নিমন্ত্রণ করা হলো। সমবেত রাজন্যবৃন্দকে স্বাধীনতা হীনতার দুর্দশার কথা রাজা প্রতাপাদিত্য বেশ করে বুঝিয়ে বললেন। সকলের সহানুভূতি চাইলেন।
সম্রাট আকবরের কানে অনেক কিছু বিরুদ্ধ সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি শুনলেন রাজা প্রতাপাদিত্য হিজলী অধিকার করেছেন। অনেক সৈন্য সামন্ত যোগাড় করেছেন, নিজের নামে মুদ্রা তৈয়ারী করাচ্ছেন, রূপরাম তার ওপর নানা কারিগরী করে যত কিছু কথার বহর রচনা করলেন, সম্রাট সেসব শুনে, একেবারে রেগে বাঘ হলেন। প্রতাপের প্রতাপ খর্ব করতে আজ্ঞা দিলেন। সংবাদ রাষ্ট্র হতে দেরি হলো না।
রাজা প্রতাপও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তিনি তাঁর সহকারী, সুবক্তা শঙ্কর চক্রবর্তীকে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে প্রজাগণকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। তিনি ঘুরতে ঘুরতে মোগল সম্রাটের বলাবল বুঝতে বুঝতে রাজমহলে গিয়ে উপনীত হলেন।
রাজমহলে রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ও প্রচারক শঙ্কর চক্রবর্তী মহাশয় সর্বত্র সম্রাটের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বর্ণনা করতে লাগলেন। সেখানে ছিলেন সম্রাট আকবর বাদশাহের একজন চতুর কর্মচারী, তার নাম ছিল শের খাঁ। রাজদ্রোহ-প্রচারককে তিনি নানা কৌশলে ধরে ফেললেন ও বন্দী করলেন।
এই সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজা প্রতাপাদিত্য বন্ধু ও সেনাপতির এই রূপ দুর্দশার সংবাদে সসৈন্যে রাজমহল আক্রমণ করলেন। তাঁর সৈন্যগণের নিকট বাদশাহী সৈন্য জলে স্থলে সর্বত্র হেরে গেল। সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী নিজেই কৌশলে কারামুক্ত হয়েছিলেন, এখন রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে মিলে মহানন্দে যুদ্ধের আয়োজনে ব্যাপৃত হলেন।
কী কাণ্ড সব হয়ে গেল! ঈশা খাকে মেরে ফেলানো হলো, বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায়, কেদার রায়কে আক্রমণ ও সন্ধি হলো, শের খাঁ পরাজিত হলেন, সবই দুঃসংবাদ, একজন সামন্ত রাজার এই দুঃসাহস ও আস্পর্ধা সম্রাট আকবর সহ্য করতে পারলেন না, তিনি অসংখ্য সৈন্য দিয়ে তার বাছা সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁকে রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপ খর্ব করতে পাঠালেন। সৈন্যরা ছুটে চলল। প্রথম এল সপ্তগ্রামে, সেখান থেকে নৌকায় গেল মাতলা দুর্গে ও তারপর গেল রায়গড় দুর্গে। দুটো দুর্গই আক্রমণ ও অবরোধ করলে, উভয় পক্ষে আরম্ভ হলো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, মোগল সৈন্যের সংখ্যা ছিল না, মরে আর নূতন সব আসে। প্রতাপাদিত্য ভেবেচিন্তে বীর কমল খোজা ও সূর্যকান্তকে বিরাট সৈন্যদল সঙ্গে দিয়ে পাঠালেন, তাঁরা এল দুদিক থেকে, আক্রমণ করল অতর্কিতভাবে, মোগল সৈন্যের পেছন দিকে।
সামনে সব গোলন্দাজ সৈন্য দুর্গ থেকে ছাড়ছে অনর্গল কামান, আগুনে পুড়ে মরছে যত মোগল সৈন্য, আবার পেছনে সুদক্ষ সেনাপতি কমল খোজা ও সূর্যকান্তের নতুন সৈন্যের অজস্র, অনর্গল গোলাবর্ষণ। কতক্ষণ আর সইবে? মোগল সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁ অতিকষ্টে অবশিষ্ট সৈন্যগণকে একত্র করে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, পথে যেতে যেতে ভাবলেন মাতালা দুর্গ বুঝি অরক্ষিত, এই ভেবে তিনি সেই দুর্গ করলেন আক্রমণ। কিন্তু মাতালা দুর্গ অরক্ষিত তো ছিলই না বরং দুর্গ হতে যেসব গোলার বৃষ্টি হতে লাগল তাতে সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁ হতভম্ব হয়ে গেলেন। জলযুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন সুবিখ্যাত পর্তুগিজ বীর রডা, তিনি জাহাজ থেকে গোলার আগুনে প্রলয় সৃষ্টি করে তুললেন।
স্থলে সেনাপতি সূর্যকান্ত, সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী, মদন মল্ল, সুখময়, কমল খোজা, সুন্দর প্রভৃতি মহাবীরেরা গজারোহী, অশ্বারোহী, পদাতিক প্রভৃতি সৈন্য নিয়ে রাজা প্রতাপাদিত্যের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন, কি সে সাংঘাতিক যুদ্ধ। মোগল সেনাপতি হেরে গেলেন, পালিয়ে জীবন বাঁচালেন।
বিজয়গৌরবে রাজা প্রতাপাদিত্য স্বীয় রাজধানী যশোরে ফিরে যশোরেশ্বরীর পুজো করলেন। দু-দুবার মোগল সম্রাট তার কাছে পরাজিত হলেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরাট বাহিনী সেজে চলল, রণভেরী বাজিয়ে গঙ্গার দু’ধার দিয়ে, বড় বড় সব রণতরী চলল জলপথে; পথে পড়ল সরস্বতী নদী তীরের মোগলদের সাজানো সপ্তগ্রাম নগর। রাজার সৈন্যরা তা লুট করলেন।
তারপর জয় করা হলো রাজমহল। অনেক পাঠান নবাব ও অনেক হিন্দু রাজা তাঁকে দিতে লাগলেন সৈন্য, বল, ভরসা। তখন তাঁর পূর্ণ উন্নতির সময়।
এইবার নবোদ্যমে রাজা প্রতাপাদিত্য আক্রমণ করলেন পাটনা। শুনে, সম্রাটের ক্রোধের সীমা থাকল না। আবার নিদারুণ যুদ্ধ বেঁধে উঠল। মোগল-সেনাপতিরূপে প্রেরিত হলেন মহাবীর আজিম খাঁ।
রাজা প্রতাপাদিত্যের ঢাল নিয়ে যুদ্ধ করবার পদাতিক সৈন্যই ছিল বায়ান্ন হাজার, অন্য সৈন্যদের তো কথাই নেই। সেনাপতি আজিম খাঁও পরাজিত হলেন। রাজার উদ্যোগ আরও ঊর্ধ্ব দিকে ধাবিত হলো।
এ সময়ের কিঞ্চিৎ পূৰ্বেই সম্রাট আকবর ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। সম্রাট হয়েছিলেন তার ছেলে জাহাঙ্গীর বাদশাহ। সম্রাট আকবর ছিলেন প্রায় ছ’মাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর তিনি মারা গেলেন, নতুন বাদশা হলেন ইত্যাদি নানা গোলমালে অনেক দিন আর যুদ্ধ করতে হলো না- রাজা প্রতাপাদিত্য প্রায় একরকম শান্তিতেই এ সময়টা কাটিয়ে নিলেন। গৃহভেদী বিভীষণরূপে ছিল রূপরাম। সে রাত-দিন বাদশাহের কানে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, নানাভাবে তুলতে লাগল, অবশেষে এমন এক সময় এল যখন বাদশাহ সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠলেন। কাবুল ও চিতোর রাজা মানসিংহকে সেনাপতি করে বাদশাহ জাহাঙ্গীর এক বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠালেন রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে।
রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন বারাণসী জয়ের চেষ্টায়। এদিকে তাঁর রাজ্যের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে চলছিল নানা কুটিল ষড়যন্ত্র। সময় যখন খারাপ আসে তখন এমনই হয়। ঘেরাও- সরিকাণী বিরোধ দেখা দিল।
রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর ছেলেকে দিয়েছিলেন রাজ্যের দশ আনা ভাগ, ছয় আনা দিয়েছিলেন রাজা বসন্ত রায়কে। সেই দেয়াদেয়ীর সময়ে রাজা বসন্ত রায়ের ভাগে পড়েছিল ‘চাকশ্রী’ নামক একটি বন্দর। চাকশ্রী ছিল সমুদ্রতীরে। সেখানে দুর্গ করতে পারলে বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ সহজ হবে ভেবে রাজা প্রতাপাদিত্য তার কাকা রাজা বসন্ত রায়কে হয় ‘চাকশ্রী’ ছেড়ে দিয়ে তত্তুল্য জায়গা নিতে, নয় তার সঙ্গে মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু রাজা বসন্ত রায় তার ছেলেদের উত্তেজনায় প্রিয় ভ্রাতৃষ্পুত্র রাজা প্রতাপাদিত্যের কোনো প্রস্তাবেই সম্মত হতে পারলেন না। এতে রাজা প্রতাপাদিত্যের বড্ড রাগ হলো।
বহ্নি ধূমায়িত হচ্ছিল, জ্বলে উঠল একটা অদ্ভুত ঘটনায়। রাজা বসন্ত রায়ের বাবার সাম্বৎসরিক শ্রাদ্ধ হচ্ছিল। তিনি তার ভাইপো রাজা প্রতাপাদিত্যকেও সেই শ্রাদ্ধে করেছিলেন নিমন্ত্রণ। রাজা প্রতাপাদিত্য নিমন্ত্রণে এলেন, বিধাতার ইচ্ছায় এক আশ্চর্য্য কাণ্ড ঘটল।
যেই রাজা প্রতাপাদিত্য শ্রাদ্ধের জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন অমনই রাজা বসন্ত রায় তাঁর কোশার গঙ্গাজল ফুরিয়ে যাওয়ায় তার ছেলেকে ডেকে বললেন- ‘গঙ্গাজল আন শিগগিরই’ কথাটা কিছুই নয়- কিন্তু অনেক কিছু হয়ে দাঁড়াল ভুলে।
‘গঙ্গাজল’ ছিল রাজা বসন্ত রায়ের তরবারিরও নাম। রাজা প্রতাপাদিত্য কোশার গঙ্গাজলের কথা ভাবলেন না, ভুলে ভাবলেন যে তাঁর কাকা তাঁকে কেটে ফেলতে আনতে বলছেন তার তরবারি। এত অস্পর্ধা! তাঁকে নিমন্ত্রণ করে এনে তার শিরশ্চেদ করতে ছেলেকে বলছেন তরবারি আনতে। রাজা প্রতাপাদিত্য ক্রোধে হিতাহিত বোধশূন্য হলেন। নিজের তরবারির আঘাতে এত প্রিয় কাকার মাথা কেটে ফেললেন। শ্রাদ্ধ স্থলে রক্তগঙ্গা বইল।
রাজা বসন্ত রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে অগ্রসর হলেন, তাঁরও দশা তাঁর পিতার মতোই হলো। ক্রমে বসন্ত রায়ের অপর ছেলে জগদানন্দ, পরমানন্দ, রূপরাম, মধুসূদন, মাণিক্য প্রভৃতি সবাই রাজা প্রতাপাদিত্যের হাতে শেষ হলেন। কিসে কি হয়ে গেল! রাজা বসন্ত রায়ের স্ত্রীই- রাজা প্রতাপাদিত্যকে সূতিকা ঘর থেকে মানুষ করেছিলেন, কিন্তু ক্রোধের সময় সে কথা রাজার আর মনে পড়ল না, তার কাকিমাও বুঝলেন এ সময়ে অনুনয়, বিনয় বৃথা। তিনি বহু কষ্টে সকলের ছোট ছেলে রাঘবকে লুকিয়ে রাখলেন এক কচুবনে, সেই হতে তার নাম হলো— কচু রায়। একেই বসন্ত রায়ের কর্মচারী, হিজলীর জমিদার ঈশা খাঁর নিকট লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রতাপাদিত্য সেই ঈশা খাঁকে বধ করলে রূপরাম রাঘবকে নিয়ে দিল্লীতে সম্রাটের আশ্রয় নেয়। এ তো আগেই বলেছি। গৃহশত্রুই যদি না থাকত তাহলে রাজা প্রতাপাদিত্যের চেষ্টায় হয়তো বাংলাদেশের রূপ অন্য রকমের হয়ে যেত।
এক শত্রুদের কথা বললেম। আর এক শত্রুর কথা বলছি। তিনি হচ্ছেন চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র রায়, শক্রতার কারণ ভারী চমৎকার!
এই শত্রু রাজা রামচন্দ্র রায় ছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্যের জামাতা। শ্বশুরের সঙ্গে জামাইয়ের শক্রতা, সেও কি সম্ভব? কিন্তু তাও ঘটে, সংসারে বিচিত্র কিছুই নেই।
রাজা প্রতাপাদিত্যের মেয়ের সঙ্গে হচ্ছিল রাজা রামচন্দ্রের বিয়ে। রাতে বাসর ঘরে একজন পুরুষ মানুষকে সাজিয়ে এনেছিলেন জামাতা রামচন্দ্র রায়, মেয়ে লোকের পোষাক পরিয়ে, সে মেয়েদের সঙ্গে করছিল হাসি ঠাট্টা,এ সংবাদ রাজা প্রতাপাদিত্যের কানে গেল। তিনি হুকুম দিলেন তার জামাইকে কেটে ফেলতে, কিন্তু সে কি হয়? রাজা প্রতাপাদিত্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও রাজা বসন্ত রায়ের কৌশলে, কোনোক্রমে স্ত্রীবেশ ধারণ করে, রাজা রামচন্দ্র পালিয়ে বাঁচলেন।
জামাই মানুষ শ্বশুরের এ অপমানজনক ব্যবহারে হাড়ে হাড়ে চটে গেলেন। এমন শ্বশুরের মেয়েকে আর ঘরে নেবেন না এই হলো তার জেদ। অপরাধ করলেন বাবা, ফল ভোগ করতে হলো যে কোনো দোষে দোষী নয় সেই অতটুকুন মেয়ের!
মেয়ের কাণ্ড শোনো। মেয়ে রাত-দিন কাঁদতে লাগল। বাবার কাছে বলে লাভ নেই— মায়ের প্রাণে আর সহ্য হলো না, তিনি লোকজন সঙ্গে নিয়ে মেয়ে জামাই বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। জামাই মেয়েকে কিছুতেই জায়গা দিলেন না। মেয়েও নাছোড়বান্দা, স্বামীর রাজ্যের যে কোনো জায়গায়, ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে হলেও তিনি পড়ে থাকবেন, এই হলো তাঁর প্রতিজ্ঞা। তাই হলো।
এক দিন দুদিন করে অনেক দিন, সে সতী-লক্ষ্মী পড়ে রইলেন জীর্ণ গৃহে, শীর্ণ দেহে। রাজা রামচন্দ্র রায়ের মা বউয়ের এ দুঃখ আর সইতে পারলেন না। তিনি ছেলেকে অনেক বলে কয়ে সেই সতী-লক্ষ্মী বউকে ঘরে তুললেন। কিন্তু শ্বশুরের প্রতি রাজা রামচন্দ্র রায়ের মনোভাবের কোনোই পরিবর্তন হলো না। তিনি সুযোগ পেলেই অপকারের চেষ্টায় রইলেন।
এই বধূর প্রথম অবতরণের স্থান আজও আছে। তার নাম ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’। ঘটনাটি নিয়ে কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নাটক। রাজা প্রতাপাদিত্যের আর এক জন শত্রু ছিলেন- ভবানন্দ মজুমদার! তার কথা, মহাকবি ভারতচন্দ্র রায় কবি গুণাকর তাঁর ‘মানসিংহ’ গ্রন্থে অনেক করে বলেছেন। রাজা মানসিংহ ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি, দুর্ধর্ষ প্রতাপাদিত্যকে কূটনীতি ভিন্ন জয় করা অসম্ভব ভেবে রাজা মানসিংহ ভবানন্দ মজুমদারকে নানা প্রলোভন দিয়ে হস্তগত করেন। প্রতাপকে পরাস্ত করে তার রাজ্য ভবানন্দ মজুমদারকে দেবেন এই প্রলোভনে প্রতাপের সমস্ত গৃহ-ছিদ্র বের করে নেন। ভবানন্দ মজুমদারও নানাভাবে প্রতাপের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে তার আরাধ্য স্বয়ং ভগবতীও তার উপরে অবশেষে বাম হয়েছিলেন। সে ঘটনাও ভারী চমৎকার।
রাজা প্রতাপাদিত্য ঘুম থেকে উঠছিলেন, বাইরে চেয়ে দেখলেন, একজন মেয়ে মানুষ ঝাড় দিচ্ছে, কিন্তু তার বক্ষঃস্থল অনাবৃত। রাজার ভারী রাগ হলো, তিনি হঠাৎ হুকুম দিয়ে বসলেন মেয়েটির স্তন কেটে ফেলতে। এতে প্রতাপাদিত্যের আরাধ্য যশোরেশ্বরী ভগবতীর বড় রাগ হলো। সামান্য অপরাধে এত কঠোর দণ্ড। রাতেই দেবী প্রতাপাদিত্যের মহিষীকে স্বপ্ন দেখালেন, তিনি প্রতাপাদিত্যের উপর ভারী বিরূপ হয়েছেন, আর তাঁর রাজ্যে থাকবেন না।
অম্বরের রাজা মানসিংহ বাংলায় এলেন। চক্রান্ত করে হুগলীর কাননগো দপ্তরের ভবানন্দ মজুমদারকে আর ভবেশ্বর রায় ও তাঁর কনিষ্ঠ ভাইকে প্রলোভনে হাত করলেন। সব ঠিকঠাক করে রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে পাঠালেন দূত। দূতের হাত দিয়ে দিলেন অসি আর শৃঙ্খল। প্রতাপাদিত্য দূতকে বললেন:- ‘তুমি দূত, তোমাকে আর কি বলব বল, সেই দেশদ্রোহী, মিত্র ও স্বজাতিদ্রোহী মানসিংহ যদি আজ এখানে আসত তাহলে এখানেই তার ঐ অসির পরীক্ষা হতো। আমি তোমার প্রভুর মস্তক ছেদনের জন্য ঐ অসিই নিলুম, ঐ শৃঙ্খল নিয়ে গিয়ে তুমি তোমার প্রভুর পায়ে পরিয়ে দিও।
যুদ্ধ বাঁধল। সে যে সে যুদ্ধ নয়। প্রতাপাদিত্য নিজে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র উদয়াদিত্য ও মহাবীর সেনাপতিগণ দীর্ঘকাল অলৌকিক যুদ্ধ করলেন; কিন্তু সময় যখন মন্দ হয় তখন কিছুতেই কিছু হয় না।
ঘোরতর সম্মুখ যুদ্ধ হচ্ছে; পেছন হতে ভবানন্দ মজুমদারের এক দল সৈন্য প্রতাপকে আক্রমণ করল, পশ্চাদ্দিক রক্ষা করতে চেষ্টা করবার সময় মানসিংহ পূর্ব বন্দোবস্ত মতো ভীষণভাবে সামনে আক্রমণ করলেন। ষড়যন্ত্র সফল হলো। বঙ্গের শেষবীর রাজা প্রতাপাদিত্য বন্দী হলেন। অন্যান্য সেনাপতিরা ও প্রতাপাদিত্যের পুত্র উদয়াদিত্য অলৌকিক যুদ্ধ করে যুদ্ধস্থলে প্রাণত্যাগ করলেন।
মানসিংহ মহাবীর প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করে, লোহার খাঁচায় ভরে, বাদশাহের ইচ্ছা অনুসারে নিয়ে চললেন দিল্লী, এমন মহাবীরকে বাদশাহ স্বচক্ষে দেখবেন এই তার বড় সাধ।
কিন্তু বাদশাহের সাধ পূর্ণ হলো না। পথে রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে রাজা মানসিংহ কাশীধামে উপস্থিত হলে, রাজা প্রতাপাদিত্য চতুঃষষ্টি যোগিনীর বাড়ীতে তারই প্রতিষ্ঠিতা ভদ্রকালীর মূর্তি দর্শন করতে চান, অনুমতি পেয়ে, তদ্গত চিত্তে ইষ্ট দেবীকে দর্শন করতে করতেই মূর্চ্ছিত হন ও ইহলীলা সংবরণ করেন। এ হচ্ছে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের কথা।
চন্দ্রদ্বীপের অনেক কুলীন কায়স্থকে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি যশোর-সমাজ স্থাপন করেছিলেন ও বহু ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত এবং সিদ্ধ পুরুষের আশ্রয়স্থল স্বরূপ ছিলেন। এমন বীর, এমন শক্তিমান সাধক বাংলায় বড় জন্মেননি। তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন বিখ্যাত তান্ত্রিক শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চাননের নিকটে, তার পুরোহিত ছিলেন তর্কপঞ্চানন মহাশয়েরই ভাই চণ্ডীবর ঠাকুর মহাশয়। রাজা প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় পুত্র মুকুটমণি, যশোর ছেড়ে বিক্রমপুরে গিয়ে বাস করেন, সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তীর অসামান্য বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজা মানসিংহ শঙ্কর চক্রবর্তীকে মুক্তিদান করেন।