রাজা প্রাণনাথ রায়

রাজা প্রাণনাথ রায়

‘পথিক সুজন,
নেহারিয়া তাঁর কীর্ত্তি – ভক্তিপুত মনে
সম্ভ্রমে নোয়ায় শির । হৃদয়-গগনে
ভাসে তার কত ছবি, কত পুণ্য কথা –
কত বরষের হায়, কত শত ব্যথা!’ –

—এমদাদ আলি

উত্তর-রাঢ়ী কুলীন কায়স্থ স্বর্গীয় দেবকীনন্দন ঘোষ ছিলেন রংপুর জেলার অতি পুরাতন জমিদার বর্ধনকুঠীর বারেন্দ্র কায়স্থ রাজাদের কর্মচারী। তাঁর হরিরাম বলে ছিলেন এক পুত্র। এই হরিরাম ঘোষ মহাশয়েরই আর একটি নাম ছিল- দিনরাজ ঘোষ। অনেক দিন তিনি বেশ প্রতিপত্তির সহিত নবাবী করলেন। তারপর তাঁর সময় ফুরিয়ে এলে তিনি কালের কোলে ঢলে পড়লেন। তাঁর ছেলে শুকদেব রায় হলেন নবাব। কিন্তু তাঁর নিশ্চিন্তে নবাবী করার ভাগ্য ছিল না। এক মস্ত বড় শত্রু জুটল। কোচবিহারের রাজা হয়ে উঠলেন দুর্দান্ত। তিনি এসে বারবার তাঁকে জ্বালাতে শুরু করলেন তাঁর রাজ্যে লুটতরাজ করে তাকে একেবারের পথে বসাবার উপক্রম করে তুললেন— আগুন দিয়ে পোড়ায়ে— সব কেড়ে নিয়ে তাঁকে একেবারে কষ্টের চূড়ান্ত সীমায় ফেললেন। নবাব শুকদেব রায়ের মৃত্যু হলে তার ভাগ্যবান পুত্র প্রাণনাথ রায় পিতৃপরিত্যক্ত সেই সামান্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন। তখন ঘনঘটা কেটে গেছে চারদিকে ফুটে উঠেছে জ্যোৎস্না জ্যোৎস্না নয়- বুঝি দিনের আলো।

প্রাণনাথ রায় মহাশয় যখন নবাবী গ্রহণ করলেন তখন তিনি চারদিক লক্ষ্য করে দেখলেন যে নিজে বিশেষ চেষ্টা না করলে কিছু হওয়ার উপায় নেই— মুহূর্ত বিলম্ব না করে নিজেই কারও কোনো সনদ টনদ না নিয়েই নবাব হয়ে দাঁড়ালেন। কোচবিহারের রাজা তাঁর বাবাকে যে নির্যাতন করতেন সে সব তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন, উপায় ছিল না বলে বহু কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। নবাব হয়ে তাঁর সকলের আগে চেষ্ট হলো এই রাজাকে শায়েস্তা করা। তিনি নানা চেষ্টা করে, অনেক সৈন্য বাড়ালেন। বেশ করে তাদের শিখালেন যুদ্ধ। তারপর যুদ্ধ করে, কোচবিহারের রাজাকে পরাস্ত করে বৈরনির্যাতন করলেন। তাঁর পৈতৃক রাজ্যের উত্তরাংশটা কোচবিহারের রাজা দখল করেছিলেন, তিনি তা আবার কেড়ে ছিলেন। মোগল ও উজবগসর্দারদেরে বিদ্রোহের অপরাধে অপরাধী করে তাদের হাত থেকে নিয়ে নিলেন তাদের যত সব জাইগীর। কতক তাঁর পিতার সনদের বলে আর কতক বলপূর্বক নিজের অধিকারভুক্ত করলেন। পিতার সময় যা রাজ্য ছিল তার সময়ে তার চেয়ে ঢের বেড়ে গেল। দিনাজপুর জেলার সবটা হলো তার নিজের, তারপর রংপুর, বগুড়া, রাজসাহী, মালদ, পূর্ণিয়া এই পাঁচটা জেলার অনেকাংশ তার অধিকারভুক্ত হলো। ক্রমে তার আয় হয়ে দাঁড়াল নয় লাখ টাকা। ‘নবলক্ষের রাজা’ বলে তাঁর বিশেষ খ্যাতি জন্মিল।

তাঁর সময়ে সব জিনিস ছিল সস্তা। তাঁর রাজত্বের চতুঃপার্শ্বের মধ্যে কোচবিহারের রাজার অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল, কিন্তু কোচবিহারের রাজার আয় ছিল মোটেই তিন লাখ- আর রাজা প্রাণনাথ নিজের চেষ্টায় আয় করেছিলেন নয় লাখ। এতেই বেশ অনুমান করা যেতে পারে যে তার মতো বড় রাজা আর তখন কেউই ছিলেন না। যে জায়গায় তিনি যুদ্ধ করে কোচবিহারের রাজাকে পরাজিত করেন সেই জায়গায় তিনি গড়ে উঠান তাঁর রাজধানী। তিনি তাঁর এই নতুন রাজধানীর নাম দেন বিজয় নগর। কিন্তু ‘বিজয় নগর’ নাম দিলে কি হবে? দিনাজপুরের নবাব বা রাজার রাজধানী বলে ঐ স্থানটিকে সকলেই বিজয় নগর না বলে বলতে লাগল দিনাজপুর। রাজা প্রাণনাথ রায়ের প্রতিষ্ঠিত সেই রাজধানীই আধুনিক দিনাজপুর শহর। পুরাতন দিনাজপুর যেখানে ছিল তা তো আগেই বলেছি- সে ছিল কান্ত নগরের নিকটে।

পরাস্ত হয়েও কোচদের রাজা ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। রাতদিন রাজা প্রাণনাথের রাজ্যে নানা উপদ্রব করতেই থাকলেন। রাজা প্রাণনাথ কি করবেন?– বাধ্য হয়ে বহু সৈন্য রেখে অতি সতর্কতার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। রাজ্যরক্ষার জন্যই অবশ্য সৈন্য রাখতে হলো। কিন্তু তাতে বেড়ে গেল তাঁর অনেক ব্যয়।

আকবর বাদশার সেনাপতি রাজা মানসিংহ এলেন উদ্ধত কোচ রাজাকে শাসন করতে। তাঁর পক্ষে নবাব বা রাজা প্রাণনাথ রায়। ঠাকুর ভানুসিংহের ও রাজা মানসিংহের সমস্ত রসদ জুগিয়েছিলেন এই রাজা প্রাণনাথ রায় তা ছাড়া সৈন্য দিয়েও যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। কোচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ অগত্যা মানসিংহের সঙ্গে সন্ধি করেন। ফলটা বড় মন্দ হলো না। রাজা মানসিংহ তাঁদের জিগীষার নিবৃত্তির জন্য এক চমৎকার উপায় করলেন। রাজা প্রাণনাথকে বলে তাঁর করদ রাজা বলে ঘোষণা করে দিলেন। আর কোচবিহারের রাজার সঙ্গে পাগড়ী বদল করিয়ে বন্ধুত্ব করালেন। এত দিনকার এত ঝঞাট এইভাবে খানিকটা মিটে গেল। এখনো চলে আসছে এ বন্ধুতা। এই আপোষ-মীমাংসার পর রাজা প্রাণনাথের তেমন আর কোনো উদ্বেগজনক শত্রু রইল না। রাজ্য নিষ্কণ্টক হওয়ায় শান্তি দেখা দিল। প্রজারা হয়ে উঠল সুখী। রাজা প্রাণনাথও এই শুভ অবসরে রাজার যেসব কাজ সেই সব আরম্ভ করে দিলেন। আয় বেশ ছিল— তিনি করতে লাগলেন মুক্তহস্ত দান। রাজ্যময় জলের অভাব যেখানেই সুবিধা পেলেন— জলাশয় খনন করিয়া দিলেন, প্রজাদের মধ্যে ধর্মভাব বৃদ্ধির জন্য নানা দেবদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে দেব-মন্দির গড়ে, নানা ধর্মোৎসব করায়ে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করলেন। সকর্মে অজস্র অর্থ ব্যয় করেও তার কোষাগারে প্রভূত অর্থ সঞ্চিত হতে থাকল।

রাজা প্রাণনাথ রায়ই তখনকার দিনে – সে অঞ্চলে সর্বপ্রথম, ভূমিতে বংশানুক্রমিক স্বত্ববান রাজা বলে সনদ পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা বা পিতামহ ছিলেন কেবল নবাব, অর্থাৎ অস্থায়ী প্রতিনিধি শাসনকর্তা। রাজারা ছিলেন ভূমিতে স্বত্ববান মালীক আর নবাবেরা ছিলেন, বেতনভোগী অস্থায়ী চাকর। এজন্য নবাবদের চেয়ে রাজাদের সম্মান ছিল বেশি। মোগল সাম্রাজ্যের শেষভাগে নবাবেরা প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাদের নবাব উপাধি তেমনই ছিল। তখন অনেক রাজ্য নবাবদের অধীন থাকায় নবাব উপাধি হয়ে উঠেছিল রাজা উপাধিরও চেয়ে উঁচু। বহু ব্যয়ে সর্বমনোরম এক মন্দিরে তিনি শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন। এই মন্দির- রাজা প্রাণনাথ রায় মহাশয়ের বংশের একটি মহাকীর্ত্তি এবং বাঙ্গালী শিল্পের একটি পরমোৎকৃষ্ট নিদর্শন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *