পীতাম্বর রায়

পীতাম্বর রায়

‘তাঁদের গরিমা-স্মৃতির বর্মে,
চলে যাব শির করিয়া উচ্চ
যাদের গরিমাময় এ অতীত
তারা কখনই নহে মা তুচ্ছ

***

চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া
অতীতের সেই মহা আদর্শ,
জাগাইব নূতন ভাবের রাজ্য
রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ।

—দ্বিজেন্দ্রলাল

সে অনেক দিনের কথা। রাজসাহী বিভাগে পুঁটিয়া তখন একখানি সামান্য গ্রাম। সেখানে কোথা হতে এসে বাস করতে লাগলেন একজন পরম নিষ্ঠাবান, ব্রাহ্মণ। মুনি ঋষির মতো তিনি দিন কাটান। কোনো রকম ভোগ বিলাসে তার মোটেই আসক্তি নেই। একেবারে সাত্ত্বিক, সাধু ব্রাহ্মণ। একটা কুঁড়ে তুলে তাতে একটা আশ্রম গড়ে তিনি রাত দিন ভগবানের পূজায়— ভগবানের ধ্যানে ডুবে থাকবেন।

ঠাকুরটির নাম বৎসরাচার্য। ঋষি তিনি সিদ্ধপুরুষ তিনি, সুতরাং তাঁর মহিমা অল্পাধিক সকলেই জানতেন। নানাভাবে কখনো বা উপদেশ, কখনো বা তাবিজ, কবচ দিয়ে তিনি লোকের উপকার করতেন। যাকে যা বলতেন, তা ফলে যেত। সকলেই তাঁকে মান্য করতেন, অত্যন্ত ভক্তির চক্ষে দেখতেন।

মুর্শিদাবাদের নবাবগণ তখন ছিলেন দেশের মালিক। তাঁদেরই একজন কর্মচারী জায়গীর স্বরূপ একখানি পরগণা প্রাপ্ত হন। কর্মচারীটির নাম ছিল লস্কর খাঁ। লস্কর খাঁ তাঁর জায়গীরের জায়গার নাম রেখেছিলেন লস্করপুর।

তাঁর মৃত্যু হলো, সুতরাং লস্করপুর পরগণা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।

একদিকে বাংলা দেশের যারা খাজনা দিতেন, তারা খাজনা বন্ধ করলেন। নবাবের বড় রাগ হলো। তিনি একজন মোসলমান সেনাপতিকে মোগল সৈন্যসহ এই বিদ্রোহীদের দমনের জন্য পাঠালেন। সেই সেনাপতি এলেন লস্করপুরে। এসে শুনলেন পুঁটিয়ায় এক সাধু আছেন, তাঁর অনেক কিছু ক্ষমতা। যাকে যা বলেন, তাই ফলে যায়।

মোসলমান হলে কি হবে? সেই সেনাপতি সাহেব বৎসরাচার্যের নিকট উপস্থিত হলেন। বিদেশ বিভূম কিসে কি হয় বলা যায় না। একজন সাধু যদি পিছনে থাকেন হয়তো তিনি দুর্দৈবের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পাবেন, এই তার ধারণা। যত সব বিদ্রোহীদের নিয়ে তো খেলা!

বৎসরাচার্য সেনাপতির সব কথা শুনলেন। তার অভীষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করলেন, ফলে তিনি সব বিষয়ে আশাতীত সাফল্য লাভ করে। আচার্যদেবকে পদ্মানদীর তীরবর্তী সেই লস্কর খাঁর লস্করপুর পরগণাই প্রণামী দান করলেন।

কিন্তু বৎসরাচার্য ঠাকুরের বিষয় বাসনা ছিল না। তিনি জমিদারী দেখবেন কি?

এদিকে, ঠাকুর ছিলেন গৃহী। স্ত্রী-পুত্র ছিল। পুত্রও অনেক কজন কিন্তু তাঁদের মধ্যে চতুর্থ পুত্র পীতাম্বর ও পঞ্চম পুত্র নীলাম্বরই সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

পুত্রদের মধ্যে পীতাম্বর রায় অত্যন্ত চতুর ছিলেন। নানা কৌশলে সেনাপতি, নবাবও অবশেষে সম্রাটের অনুগ্রহ ভাজন হয়ে উঠেন। সম্রাট তাঁকে ‘রায়’ উপাধি ভূষণে ভূষিত করে তার পৈতৃক সম্পত্তি লস্করপুর তাঁকে উপহার দান করেন। সম্রাটের সহায়তায় পীতাম্বর রায় মহাশয় ক্রমে বড় জমিদার হয়ে উঠেন। পীতাম্বর রায় মহাশয় কিছুদিন জমিদারি পরিচালনা করে মৃত্যুমুখে নিপতিত হন, তারপর তাঁর ভ্রাতা নীলাম্বর রায় জমিদারির অনেক কিছু উন্নতি করেন, তার বিন্দুমাত্র অহঙ্কার ছিল না, প্রজারা তাঁকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত।

অনন্তর নীলাম্বর রায় মহাশয়ের অভাব হলো তার পুত্র আনন্দচন্দ্র রায় দিল্লীশ্বর কর্তৃক রাজা উপাধি লাভ করেন ক্রমে রতিকান্ত, রামচন্দ্র, নরনারায়ণ, দর্পনারায়ণ, জয়নারায়ণ, রাজেন্দ্রনারায়ণ ও যোগেন্দ্রনারায়ণ রাজা হন। এই রাজা যোগেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রীই ছিলেন রাণী শরৎসুন্দরী ও তাঁর পুত্র সন্তান না হওয়ায় তিনি দত্তক গ্রহণ করেন। সেই দত্তক পুত্র ও তাঁর পত্নী রাণী হেমন্তকুমারী দেবীকে রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *