চাঁদগাজি
‘বায়ু বহে আপনার মনে
প্রভঞ্জন করিছে গঠন
ক্ষণে গড়ে, ভাঙ্গে আর ক্ষণে
কত মত সত্য অসম্ভব।
জড় জীব বর্ণ, রূপ ভাব!’
স্বামী বিবেকানন্দ
মহাভারতে লেখা আছে শিশুপাল ছিলেন ভারী দুর্দান্ত রাজা। তাঁর প্রতাপে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত। যে বংশে তিনি জন্মেছিলেন তার নাম ছিল চেদিবংশ। ঢাকা জেলার ভাওয়াল পরগণা এই চেদিবংশীয় রাজাদের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
পরে এই পরগণা কামরূপ রাজ্যের অধীন হয়। কিন্তু বাংলা দেশে পাল রাজগণ রাজা হলে তারা এ রাজ্য বহু রণ করে যুদ্ধ করে, তাদের অধিকারভুক্ত করেন, সেই হতে ভাওয়ালের একটা নামই হয়ে যায় ‘রণভাওয়াল’। ‘কাপাসিয়া’ বলে যে জায়গা এখনো আছে সেখানে আজও রাজা শিশুপালের বাড়ীর ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। সাভারের নিকট রাজা হরিশচন্দ্র পালের আর তেলিয়াবাদে যশোপালের বাড়ীর ভগ্নাবশেষ এখনো।
দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের মহিমার সাক্ষ্য দান করছে। পাল রাজাদের সে সময়ের যথেষ্ট প্রতাপ ছিল— সৈন্য সামন্তেরও অন্ত ছিল না। কিন্তু বিধিনির্বন্ধ লঙ্ঘন করবে কে? তাঁদের সময়ে একদল মোসলমান হয়ে উঠলেন ধর্মের নামে উন্মত্ত। তাঁরা তাঁদের ধর্ম প্রচার করে, অন্য জাতীয়দের স্বীয় জাতিতে পরিণত করে, পাগলের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন। তাঁদের ছিল অনেক লোক, অনেক অস্ত্রশস্ত্র, তাছাড়া দিল্লীর বাদশা দিতে লাগলেন তাঁদের মহা উৎসাহ। হিন্দুগণের সঙ্গেই হলো বেশির ভাগ যুদ্ধ আর যত শত গোলমাল। গৌড়ের দক্ষিণ পূর্বাংশ এই অস্ত্রধারী ধর্মোন্মাদগণ অধিকার করে বসলেন। এঁদের নেতা যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল পালোয়ান গাজি। গাজি শব্দের অর্থ বীর। বীর পালোয়ান গাজি ধর্মোন্মত্ত অনুচরগণের সহায়তায় অচিরে মস্ত বড় এক রাজ্যের সৃষ্টি করলেন। তার বংশীয়েরাই হলেন পরে গাজি বংশ বলে বিখ্যাত।
কথিত আছে, এই পালোয়ান গাজির পুত্র ভাওয়াল গাজি সাহেব নিজ ক্ষমতায় তদানীন্তন দিল্লীর সম্রাটের নিকট হতে জায়গীর প্রাপ্ত হন। তাঁরই নামানুসারে ‘ভাওয়াল পরগণা’ নামের সৃষ্টি হয়। তৎকালে বুড়িগঙ্গার তীর হতে গারো পাহাড়ের পাদদেশ অবধি অরণ্য স্থানের সবটাই ভাওয়াল নামে কীর্ত্তিত হতো। চৈরা নামক গ্রামে ছিল তাঁদের রাজধানী। তাঁদের সম্ভ্রমের অবধি ছিল না। ঢাকা জেলার কয়েকটি পরগণার শাসনভার, এই গাজিবংশের শাসনকর্তাদের হস্তেই ন্যস্ত ছিল।
বার ভূঁইয়াদের অন্যতম এই ভাওয়ালের নিকটবর্তী চাঁদপ্রতাপের চাঁদ গাজি সাহেব স্বাধীন ছিলেন। নামে মাত্র মোগল সম্রাটের অধীন হলেও কার্যত সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জীবিত কালাবধি অন্যান্য ভূঁইয়াদের ন্যায় ইহারও প্রতাপ অক্ষুন্ন ছিল। তাঁরই নামানুযায়ী পরগণার নাম চাঁদপ্রতাপ হয়। ভাওয়ালে এঁদের দুই ভাইয়ের নামে দুটি পরগণার সৃষ্টি হয়ে অদ্যাবধি বিদ্যমান আছে। এক ভাই সেলিমের নামানুসারে যে পরগণা হয় তার নাম হয় সেলিম প্রতাপ। অপর ভাই সুলতানের নামানুসারে হয় সুলতান প্রতাপ পরগণা। ভাওয়াল পরগণার সদর খাজনার কথা ভাবলেই বুঝা যায় যে রাজ্যটি ছিল কত বড়। মোটামুটি সদর খাজনার পরিমাণ হচ্ছে ৪৮,৩০০ টাকা।
খিজিরপুরের বিখ্যাত ভূঁইয়া ঈশা খাঁ ও বিক্রমপুরের কেদার রায় সুদীর্ঘকাল তাঁদের স্বাধীনতার জন্য মোগল সম্রাটের সঙ্গে সংগ্রাম করেন। তাঁদেরই পার্শ্ববর্তী এই চাঁদ গাজি সাহেবও তাঁদের মতানুবর্ত্তনী হয়ে তাঁদের সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদান করেছিলেন। সম্রাট আরঙ্গজেবের রাজত্ব কালাবধি এই গাজিবংশের আধিপত্য প্রায় অক্ষুন্ন ছিল বললেই চলে।
দুর্ভাগ্যচক্রে গাজি বংশধরগণ হয়ে পড়েন বিলাসী, চরিত্রহীন। খাঁটি মোসলমানদের বংশের এই পাপ ভগবান সইলেন না। যাঁরা তাঁদের কর্মচারী ছিলেন, তাঁরা হুজুরদের এই ত্রুটি তীব্র দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলেন, সুযোগ এসে ধরা দিল। বলরামপুর, গাছা, পালাসনা প্রভৃতি স্থানের জমিদারগণের পূর্ব্বপুরুষেরাই ছিলেন এই গাজি সাহেবদের কর্মচারী, তাঁরা হলেন এক একজন জমিদার।
সুলতান গাজি সাহেবের যখন চৈতন্য হলো তখন আর কিচ্ছু নেই। এখন গাজীবংশ হৃতগৌরব। বলবার জন্য রয়েছে কেবল তাঁদের পোড়া স্মৃতি।