ঈষা খাঁ
‘দৈবায়ত্ত কুলে জন্মঃ
মমায়ত্তং হি পৌরুষম্’
অযোধ্যা বা আউধ হতে বাংলা দেশে ব্যবসা করতে এলেন কালিদাস গজদানী নামে একজন ক্ষত্রিয় রাজপুত ব্যবসায় বাণিজ্য করতেন বলে অনেকে তাঁকে বৈশ্য বলে বলেছেন। যা হোক কি হবে জাত বিচার দিয়ে?
সত্যি, বড় কুলে ভালো বংশে জন্মানো বিধাতার হাত। কিন্তু মানুষ চেষ্টা করলে বড় হতে পারে, বীর হতে পারে, ধনী হতে পারে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। দৈববাদীরা এতেও অবশ্য দৈবের হাত দেখাতে ছাড়বেন না কিন্তু মোটামুটি মীমাংসা হচ্ছে দৈব ও পুরুষকার দুইয়েরই দরকার, ঘুমন্ত সিংহের মুখে আপনি এসে হরিণ ঝাঁপিয়ে পড়ে না পড়লেও সে হচ্ছে একটা ব্যতিক্রম। যাঁরা অজগরের মতো হাঁ করে পড়ে থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে সাহস পান তাঁদের সঙ্গে একমত হওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
কালিদাস গজদানী মহাশয় সুদূর অযোধ্যা দেশ থেকে, সেই রেল ষ্টীমার, মোটর, লরী, লঞ্চ শূন্য দিনে বহুকষ্টে ঢাকা অঞ্চলে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করলেন, অসাধারণ উন্নতির আকাক্ষা না থাকলে, আমাদের ন্যায় বাড়ীমুখো বাঙ্গালীর মতো হলে হয়তো তিনি দেশে ‘আঁটার রুটি আর ঘিউ খেয়েই’ জীবন কাটাতেন। তিনি যে সে প্রকৃতির ছিলেন না— এ তাঁর এই সুদূর অভিযানেই সুস্পষ্ট উপলব্ধি হয়। বর্তমান নারায়ণগঞ্জের প্রায় এক মাইল উত্তরে ছিল খিজিরপুর বলে একখানি গ্রাম, এখানে এসে ব্যবসায়ী কালিদাস গজদানী মহাশয় তার ব্যবসায় আরম্ভ করেন। ব্যবসায়ে চলছিলও মন্দ নয় কিন্তু তিনি দেখলেন বাংলার উর্বরা ভূমিও বাণিজ্যের চেয়ে কম লাভজনক নয়।
তখন দেশে চোর-ডাকাতের তত ভয় ছিল না, রাজধানী দিল্লীও বহুদূরে। রাজার উপদ্রবও তত বেশি নেই। তাই তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে সোনারগাঁয়ের কাছে সামান্য কিছু জমি কিনলেন— কিনে তাতে স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করে দিলেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন সোনার হাতী দান করতেন বলে গজদানী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন।
যে জমি কিনলেন, তা অনেক নয় কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল মস্ত বড় বহু আশায় ভরা। স্বাধীনভাবে থাকবেন এই ছিল তার আকাঙ্ক্ষা, জমিগুলি ছিল খাজনা করা কিন্তু খাজনা দেওয়ার মতো মনোবৃত্তি তাঁর ছিল না। তিনি ‘আবার খাজনা দেব কাকে?’ এমনই একটা দুর্ধর্ষভাব মনে মনে পোষণ করতেন। সে কি চলে?
কিন্তু এক এক সময়ে এক একটা লোক, এক এক জায়গায় জন্মে যারা অসম্ভব সম্ভব করে তোলেন দম্ভভরে বলেন- ‘অসম্ভব কথাটা অভিধান হতে উঠিয়ে দেও— সে কি গো? মানুষের কাছে আবার অসম্ভব কি?’
এমন লোকের কথা, অনেক ইতিহাস খুঁজে দেখেছি, ঐতিহাসিকগণ উল্লেখও করেননি করবেনই বা কেন? তারা উল্লেখ করেন, যারা গতানুগতিক, প্রকারান্তরে কাপুরুষ রাজভক্ত বলে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁদের কথা। বাঙ্গালীর লিখিত কোনো ইতিহাসে কালিদাস গজদানীর তেমন উল্লেখ নেই। এমনকি তার ছেলে মহাবীর ঈশা খাঁর কথাও নয়।
সুলতানের লোক খাজনা চাইতে এলে তিনি তাঁদের বার বার হাঁকিয়ে দিতেন। ক্রমে এক, দুই করে বহুবার তিনি তাঁদের এইভাবে অপমানিত করলেন, খাজনাও বাকি হলো অনেক। হিসাবের সময় কথাটা শাহানশাহের কানে বেশ অতিরঞ্জিত হয়েই উঠল।
শাহানশাহ চটে লাল হলেন। তিনি হুকুম দিলেন – সেনাপতিকে!
সেনাপতি বেছে বেছে তাঁর সহকারীদের সৈন্যসামন্ত দিয়ে পাঠালেন। দু-চারবার যুদ্ধ হলো। বাদশাহর সৈন্যরা পরাস্ত হয়ে ফিরে গেল।
দরবারে যুক্তি করে, ঠিক করা হলো, বিরাট আয়োজন করো, যত সৈন্য, যত গোলা, যত বারুদ লাগে নিয়ে গিয়ে বেটাকে এখুনি জাহান্নামে দাও।
একে একে বড় বড় সেনাপতি সোলেম খাঁ, তাজ খাঁ, দুবিবার খা সোনারগাঁয়ে গেলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য্য গজদানী পরাস্ত হলেন না, শেষে সন্ধি করতে হলো।
কিন্তু সন্ধি তো একটা কৌশল মাত্র। গজদানী সন্ধি মানবার পাত্র ছিলেন না। হঠাৎ একদিন প্রভাতে অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্ধি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সংবাদ পহুঁছিতে বিলম্ব হলো না গজদানী আবার বিদ্রোহী হয়েছেন। এবার গজদানী বেশ ভালোভাবেই বিদ্রোহ শুরু করলেন। দূরদেশে থাকেন সুলতান- তিনি তাঁর কি করবেন এই হলো তার দৃঢ় বিশ্বাস।
কিন্তু সুলতানের তা সহ্য করবার মতো হৃদয় ছিল না। শত্রুকে তিনি মোটেই উপেক্ষা করতেন না।
অসংখ্য সৈন্য পাঠিয়ে গজদানীর সর্বনাশ করতে তিনি উদ্যত হলেন। প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতি এবার নির্দয়ভাবে গজদানীকে আক্রমণ করলেন। সে আক্রমণ গজদানী সহ্য করতে পারলেন না, সুলতানের হুকুম ছিল— জন বাচ্চা শুদ্ধ গজদানীকে একেবারে উৎসন্ন করার, তাই হলো, গজদানীকে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে তাঁকে নির্মমভাবে তীক্ষ অসির আঘাতে নিহত করা হলো।
শুধু তা-ই নয়। তাঁর বংশের কেউ যদি বাংলায় থাকে তাহলে হয়তো সে প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করবে। এইজন্য তাঁর ছেলে ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁকে প্রাণে না মেরে, ভারতের বাইরের তুরাণ দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করে ফেলা হলো। সুলতান ভাবলেন বিষবৃক্ষের মূলোচ্ছেদ হলো! কিন্তু বিধাতা একটা মায়ার খেলা খেললেন। স্বাধীন রাজার ছেলেরা হলেন যে কিছুতেই যেন তারা বাংলা দেশে না আসতে পারে।
রাজার ছেলে ক্রীতদাস হয়ে দেশ ছেড়ে, মা ছেড়ে, বাড়ীঘর, খেলার সঙ্গী, সব ছেড়ে তুরাণদের গৃহে অতি কষ্টে দিন কাটাতে লাগলেন। সবই ভগবানের ইচ্ছা। বিপদ, সম্পদের অগ্রদূত এও তো ঠিক।
তাঁদের সহায় হলেন তাঁদের স্নেহময়, সদাশয় পিতব্যদের কুতব খাঁ।
বলতে একটু গোল হয়েছে। কালিদাস গজদানী মহাশয়, কেন তা জানা যায়নি, স্বধর্ম ছেড়ে, মোসলমান হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারের সকলেই যে মোসলমান হয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। জমিদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এ কর্ম করেছিলেন, মোসলমান হয়ে তাঁর নাম হয়েছিল সুলেমান। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, কালিদাস গজদানী বা সুলেমান সাহেব যখন বারংবার খাজনা বন্ধ করে বিদ্রোহী হচ্ছিলেন তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন সুলতান শের শার পুত্র ইসলাম শা। ইনি ছিলেন পাঠান। এঁর সৈন্যরাই সুলেমানকে পরাজিত, বন্দী ও নিহত করে এবং তাঁর ছেলে ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁকে বিক্রয় করে ফেলেন।
এই সময়ে সুলেমানের ভ্রাতা কুতব খাঁ নানা কৌশলে ভাইয়ের রাজত্ব রক্ষা করছিলেন। শাসনকর্তা ছিলেন সেলিম খাঁ বলে একজন। তিনি বড় নির্মম ছিলেন। তাঁর আমলে কুতব খাঁর ভ্রাতৃম্পুত্রদের জন্য কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর তাজ খাঁ বলে একজন শাসনকর্তা বাংলায় এলেন। ইনি এসে দেখলেন, সুলেমানের মতো কুতব খাঁ বিদ্রোহভাবাপন্ন নন। দেশে নানা সৎকাজ করেছেন, তার সদ্ব্যবহারে সকল লোকই তার উপর ভারী খুশি। অযথা হাঙ্গামায় ফল নেই। ভেবে তাজ খাঁ তাঁর সঙ্গে কোনো অসদ্ব্যবহার করা সঙ্গত বোধ করলেন না, বরং মিত্রভাবে, সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁর কথামতোই চলতে লাগলেন।
কুতব সাহেবের কোনো সন্তান ছিল না। ভাইয়ের ছেলেদের উপর ভারী টান ছিল। তিনি অনেক বলে কয়ে বহু চেষ্টায় নিজের দায়িত্বে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রগণকে ফিরিয়ে আনলেন। বহুদিনে, বহুকষ্টে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো।
ঈশা খাঁ ও ইসমাইল খাঁ পুনরায় সোনারগাঁয় আনীত হলেন। পিতৃব্য ও ভ্রাতপুত্রদ্বয়ের আনন্দের আর সীমা রইল না।
ঈশা খাঁ তখন বড় হয়েছেন। বেশ শান্তশিষ্ট ও বুদ্ধিমান হয়েছেন। দুঃখে যাদের গড়ে উঠে জীবন, অনেক সময় দেখা যায় তারাই বড় মানুষ হন।
অল্প দিনের মধ্যে ঈশা খাঁর গুণে সকলে মুগ্ধ হলেন। তাঁর পিতৃব্য কুবত খাঁরও তখন বয়স হয়েছিল। তিনি উপযুক্ত ভ্রাতুস্পুত্রের হাতে রাজ্য সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে খোদার নাম করতে লাগলেন।
কত দিন বেশ চলল। যুদ্ধ নেই, বিগ্রহ নেই, খান, দান, ভয় নেই, ভাবনা নেই। কিন্তু ঈশা খাঁ তো অমন থাকতে পারেন না!
‘কে বাদশা? – তাকে কেন আবার খাজনা দিতে হবে?’ এমনই এক বংশানুক্রমিকভাবে তিনি উন্মনা হয়ে উঠলেন। না— না, এতগুলো টাকা খাজনা দিতে যাব কেন। দেখাই যাক না, না দিলে কি হয় এইভাবে তিনি বিব্রত বিভোর হলেন। খাজনা দেওয়া বন্ধ হলো। বাদশার সৈন্য এল, ঈশা খা তাদের তাড়িয়ে দিলেন। একবার নয়, দুবার নয়— বহুবার হলো এ কাণ্ড! ঈশা খাঁর পরাজয়, সে তো একটা মজার কথা- সন্ধি করে বাদশার অধীনতা স্বীকার করে, তাকে আর তার সেনাপতি ও লোকজন, সৈন্যসামন্তকে খুসী করে, তিনি খাজনা দিয়ে দিতেন, আবার সুযোগ পেলেই বন্ধ করতেন। যখন যেভাবে চলে- তাই। আর যেবার তিনি জয়লাভ করতেন, সেবার যে কি হতো তা তো সহজেই বোঝা যায়— বাদশার কর্মচারীরা যে খালি হাতেই ফিরে যেতেন তাতে আর সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিক চাল- ঈশা খাঁ বেশ ভালো করেই চালাতেন। দেখতে তিনি অতি সুপুরুষ ছিলেন, বীরত্বের চিহ্ন তার দেহে ফুটে বের হতো। তিনি বহুগুণে গুণবানও ছিলেন! কাহারও কাহারও মতে বারজন ভৌমিকের মধ্যেই তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ ভৌমিক।
কয়েকজন ঐতিহাসিক বলেছেন : ঈশা খাঁ প্রথমে বাংলার স্বাধীন সুলতান দাউদ শার সেনাপতি হয়েছিলেন। দাউদ শার পর নিজ বাহুবলে ও বুদ্ধি কৌশলে বাংলার একজন পরাক্রান্ত জমিদার বা ভৌমিক হয়ে উঠেন। ক্রমশ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা অঞ্চলে জমিদারী বাড়িয়ে, ফৌজ ও রণপোত গড়ায়ে, নারায়ণগঞ্জের নিকট সোনারগাঁ পরগণার খিজিরপুরে দুর্গ ও রাজধানী সংস্থাপন করে স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করতে থাকেন। দিল্লীর বাদশাকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন।
সে যা হোক, ঈশা খাঁর বুদ্ধি ও বল প্রভাবে বাদশাকে যে অত্যন্ত বিভ্রাটে পড়তে হয়েছিল তাতে আর সন্দেহ নেই। ঈশা খাঁর পুনঃপুন অবাধ্যতায় বাদশা অধীর হয়ে উঠলেন। বাদশার সেনাপতিদের মধ্যে সাহাবাজ খাঁ ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বী ও বুদ্ধিমান। এবার তাকেই ঈশা খাঁকে দমন করতে পাঠানো হলো। বিপুল সৈন্য নিয়ে সাহাবাজ খাঁ সহসা ঈশা খাঁকে আক্রমণ করলেন। ঈশা খাঁ এমন সাংঘাতিক আক্রমণের প্রত্যাশা করেননি। প্রতিরোধ করবার কোনো উপায় না পেয়ে, তিনি সন্ধির প্রস্তাব করে পাঠালেন। কিন্তু সাহাবাজ খাঁও ঈশা খাঁর চেয়ে কম ধূর্ত ছিলেন না— তিনি তাঁর মতলব বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার সঙ্গে সঙ্গেই খিজিরপুর আক্রমণ করলেন। ঈশা খাঁ ভাবছিলেন, অন্যান্যবারের মতো এবারও বুঝি কর্তৃপক্ষ টক করে তার সন্ধির প্রস্তাবে বাধ্য হবেন, কিন্তু তা হলো না। সাহাবাজ খাঁর অতর্কিত প্রবলাক্রমণে ঈশা খাঁ একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। পলায়ন ভিন্ন আর গত্যন্তর রইল না।
মোগল সেনাপতি সাহাবাজ খাঁ অনায়াসে খিজিরপুর দুর্গ অধিকার করলেন। দুর্গ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে ঈশা খাঁর অধীন, খিজিরপুরের নিকটবর্তী পম্পা নদীর পরপারের বর্তমান তপ্পা নামক পরগণা, যা তখন বাজুহারের অন্তর্গত ছিল, সেখানকার অস্ত্রাগার ও মস্বাদি গ্রামের ধনাগার ও রসদাগার অধিকার করলেন।
ঈশা খাঁর এ অত্যাচার সহ্য হলো না। তিনি বাংলায় নিশ্চিন্ত থাকলেন না। অনেক সৈন্য, অস্ত্র ও রসদ গোপনে গোপনে সংগ্রহ করলেন।
সেনাপতি সাহাবাজ খাঁর কানে এ সংবাদ গেল, তিনি ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী সুপ্রসিদ্ধ ‘তোটক’ নগরে দুর্গ নির্মাণ করে তার শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকলেন; কুমার সনন্দের পরপারে ছিল এ স্থান।
সাহাবাজ খাঁর অধীনে তারসুন বলে একজন অত্যন্ত সাহসী সেনাপতি ছিলেন, তিনি তাঁকে ভাওয়ালের পথে তোটক হতে বজরাপুর পাঠালেন। বজরাপুরে ঈশা খাঁর সৈন্যরা তাঁর বন্ধু মাসুম কাবুলীর নেতৃত্বে একত্র হয়েছিলেন।
তারসুন মহাবীরের মতো যুদ্ধ করলেও পরাস্ত হয়ে বন্দী হলেন, তাঁকে বধ করা হলো।
সেনাপতি তারসুনের অলৌকিক বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও প্রভুভক্তির কথা সাহাবাজ খাঁর কর্ণগোচর হইবা মাত্র তিনি মাসুম কাবুলীর এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার জন্য ব্রহ্মপুত্রের শাখা পণার নদীর তীরে হতে ছুটে চললেন।
বর্ষার জল কম ছিল, মোগলদের সুবিধা হলো, তারা নদীর ধারে বাসের সুযোগ পেল।
ঈশা খাঁ সব শুনলেন। তাঁর চতুরতার সীমা ছিল না। তিনি তাঁর অদ্ভুত বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন, তাঁর পাঠানো সৈন্যগণ ব্রহ্মপুত্র হতে ১৫টি খাল কেটে বর্ষার জল সেই সকল খাল দিয়ে দিয়ে মোগল শিবিরের দিকে চালিয়ে দিল। জল ছুটে চলল কল কল করে।
ঈশা খাঁ সম্মুখযুদ্ধে এলেন না। নদী-নালার গোলক ধাঁধায় মোগল সৈন্য ও সেনাপতিকে হতবুদ্ধি করে তুললেন। খালগুলো এমন চমৎকার কৌশলে কাটা হয়েছিল যে সেগুলো দিয়ে নদীর বাণের জল চালিয়ে সব ভাসিয়ে দিতে লাগলেন। মোগল সৈন্য সে জলে হাবুডুবু খেতে লাগল। প্রবল জলস্রোতে মোগলের তাঁবু ডুবে গেল রসদ ভিজে গেল, বন্দুক, তলোয়ার সব ভেসে গেল, তারপর পাঠালেন সেই জল-প্লাবনের মতোই পাঠান সৈন্যের প্লাবন। মোগলেরা বড় বিপদে পড়লেন।
এমন সময়, হরিণগুলো যেমন শিকারীর ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে যখন আর পথ পায় না – ফিরে দাঁড়ায় ঘেরুয়া হয়ে শিকারীকে প্রাণপণ আক্রমণ করে তেমনই মোগল সৈন্যদের আর প্রাণের আশা নেই ভেবে একজন সুদক্ষ গোলন্দাজ তাঁর হাতের বন্দুকটি তুলে ধরে পাঠান সেনাপতির মস্তক লক্ষ্য করে অতি কষ্টে নিক্ষেপ করলেন। অব্যর্থ সে লক্ষ্য, পাঠান সেনাপতি সেই গুলির আঘাতে বিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন।
নায়ক নেই— ছত্রভঙ্গ পাঠান সৈন্য চারদিকে পালাতে লাগল। যদি না পালাত তাহলে বোধ হয় মোগলদের এক প্রাণীও রক্ষা পেত না।
কৃত্রিম জল শুকিয়ে উঠল। সে আবার এক বিপদ। জলাভাব দেখা দিল, একদল মাত্র সৈন্য নিয়ে যা কিছু যুদ্ধ করছিলেন ঢাকার মোগলদের দারোগা সায়দ মোহাম্মদ সাহেব। কিন্তু তিনিও বন্দী হলেন; মোগলদের বিপদের সংবাদ শুনে ঢাকা হতে কতকগুলো রণতরী ও সৈন্য এল বটে কিন্তু তাদের আসবার আগেই তাদের থানাদার বন্দী হলেন। কোনো উপায় রইল না।
তখন মোগলদের দুর্ধর্ষ সেনাপতি সাহাবাজ খাঁ ঈশা খাঁর সঙ্গে সন্ধি করতে সম্মত হলেন, দারোগা সায়দ মোহাম্মদ ঈশা খাঁর বন্দী ছিলেন, তাঁকে দিয়েই ঈশা খাঁর কথা সাহাবাজ খাঁকে ঈশা খাঁ বলাতে লাগলেন।
সন্ধির শর্ত হলো- মাসুম কাবুলী বঙ্গদেশ ছেড়ে যুদ্ধবিগ্রহ ছেড়েছুড়ে একেবারে মক্কায় চলে যাবেন। সোনারগাঁয়ে বাদশার থানাদার থাকবেন। ঈশা খাঁ যথারীতি বাদশাকে খাজনা দেবেন। ঈশা খাঁ সাহাবাজ খাঁর এসব শর্তেই রাজি হলেন, কিন্তু মনের সঙ্গে নয়।
সাহাবাজ খাঁ ঈশা খাঁকে বিশ্বাস না করে সসৈন্যে সেখানে এক বছর তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকলেন। ঈশা খাঁর মনের কথা অতি অল্প দিনের মধ্যে ফুটে বের হলো। তিনি কূটনীতি অবলম্বন করলেন। অনেক আমীর দিগকে বড় বড় ভেট দিতে লাগলেন। অনেক আমীর সেনাপতি সাহাবাজ খাঁকে ছেড়ে, সোনারগাঁ ছেড়ে চলে যেতে লাগলেন। তাঁদের ঘুষ দিয়ে, বাধ্য করে তাড়িয়ে ঈশা খাঁ আবার স্বমূর্তি ধারণ করলেন। সাহাবাজ খাঁ ধূর্তের ধূর্ততা টের পেলেন কিন্তু যুদ্ধ ভিন্ন উপায় কি? যুদ্ধ করবেন কাদের নিয়ে? সকলেই ক্লান্ত, সকলেই বিরক্ত। এদিকে সাহাবাজ খাঁর কড়া শাসনে সকলেই মনে মনে অসন্তুষ্ট, যুদ্ধ করলেও তা সহজে মিটবার নয়, বাংলার বার ভূঁইয়া তখনো দুরন্ত। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করলে যদি কিছু হয়, আমীরেরা বললেন— বার ভূঁইয়াদের নামে মাত্র সম্রাটের অধীন বলে স্বীকার করায়ে ছেড়ে দেওয়া হোক, কিন্তু সেনাপতি সাহাবাজ খাঁর ইচ্ছা তাঁরা সম্রাটের একবারে পদানত হয়ে থাকুক।
মতভেদে আত্মকলহ শুরু হলো। মহিব আলি খাঁ ছিলেন সাহাবাজ খাঁর দক্ষিণ হস্ত। তিনি সাহাবাজ খাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন, ক্রমে অধিকাংশ সেনাপতিই তাঁর পথ অনুসরণ করলেন, বাকি রইলেন শুধু সেনাপতি কাবুলী খাঁ। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন- সৈন্যেরা তাঁর কথা শুনল না। ভাওয়ালে এক যুদ্ধ হলো, সেই যুদ্ধে কাবুলী খাঁ আহত হলেন। ভাওয়াল ছেড়ে যাওয়া ভিন্ন গতি রইল না।
তিনি চলে গেলে সেনাপতি সাহাবাজ খাঁ সকলকে একত্র করবার জন্য শেষ চেষ্টা করলেন, কোনো ফল হলো না। একা তিনি কি করবেন? অগত্যা, যুদ্ধের সব ফেলে তিনি প্রাণ নিয়ে তাণ্ডার দিকে পালিয়ে গেলেন। এবার মোগলদের মীর আদনের পুত্রগণ ও অপরাপর বহু সৈন্য বন্দী হলো।
মোহাম্মদ শা গজনভী বলে যিনি সাহসী সেনানায়ক ছিলেন তিনি কয়েকজন লোকের সঙ্গে সহসা জলে ডুবে মরলেন। জন কয়েক মাত্র সঙ্গী নিয়ে সেনাপতি সাহাবাজ খাঁ আট দিন পর সেরপুরে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
তিনি উপায়ান্তর না দেখে বাদশাকে খুলে লিখলেন। বাদশা বহু সৈন্য সঙ্গে দিয়ে তাঁর বিচক্ষণ সেনাপতি উজীর খাঁকে পাঠিয়ে দিলেন, দুজনের চেষ্টায় পাঠানগণ কতকটা শান্ত হলো, বাদশা সাহাবাজ খাঁর স্থানে উজীর খাকে বাংলার সুবেদার করে সাহাবাজ খাঁকে দেশে ফিরে যেতে আদেশ দিলেন। উজীর খাঁ অল্পদিন বাংলা শাসন করেই পরলোক গমন করলেন। বাংলা দেশ নিয়ে বাদশার বড় চিন্তা হলো। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ শাসনকর্তা, অম্বরাধিপতি মানসিংহকে বাংলা দেশ শাসন করতে পাঠালেন। মানসিংহ যেমন যোদ্ধা, তেমনই রাজভক্ত, তেমনই কূটনীতিক বিশারদ ছিলেন।
মানসিংহ সুকৌশলে বিহার ও উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন করে, এলেন বাংলা দেশে। বাংলা দেশের বার ভূঁইয়াদের যন্ত্রণায় সকলে ছটফট করছিলেন। প্রধান শত্রু ছিলেন ঈশা খাঁ আর তাঁর সঙ্গী মাসুম কাবুলী। এদের সঙ্গে উড়িষ্যার ও বিহারের বিদ্রোহীদেরও যোগ ছিল।
মানসিংহ ঈশা খাঁর রাজধানী খিজিরপুর অবরোধ করলেন। ঈশা খাঁর দল তখন মহাপরাক্রান্ত। যত সব বিদ্রোহী তাঁর দলে। প্রথম যুদ্ধে মানসিংহ ঈশা খাঁর কিছুই করতে পারলেন না, বরং মানসিংহের এক জামাতাই নিহত হলেন। কেমন করে নিহত হলেন সে এক বড় মজার কথা।
এ হচ্ছে, ১৫৯৫ খৃষ্টাব্দের কথা, ক্ষত্রিয় বীর রাজা মানসিংহ ঈশা খাঁর এগারো সিন্ধু দুর্গ অবরোধ করলেন। ঈশা খাঁ তখন সেখানে ছিলেন না। দুর্গাবরোধ সংবাদ শুনে তিনি সৈন্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। ঈশা খাঁর সৈন্যগণ তার অবাধ্য হলো। যুদ্ধ করতে সম্মত হলো না, কিন্তু ঈশা খাঁ কাপুরুষ ছিলেন না, তিনি রাজা মানসিংহকে অগত্যা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বললেন এই যুদ্ধে যিনি জীবিত থাকবেন তিনিই বাংলা একাকী ভোগ করবেন।
রাজা মানসিংহ ঈশা খাঁর এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। ঈশা খাঁ ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধস্থলে এসে উপস্থিত হলেন, দেখলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী একজন তরুণ যুবক, রাজা মানসিংহ আসেননি, এসেছেন তাঁর জামাতা। ঈশা খাঁ তাঁরই সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। তিনি ঈশা খাঁর হাতে নিহত হলেন। ঈশা খাঁ রাজা মানসিংহকে ভীরু বলে ভৎসনা করে নিজের শিবিরে চলে গেলেন। কিন্তু ঈশা খাঁ শিবিরে প্রবেশ করতে না করতেই সংবাদ এল যে রাজা মানসিংহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। ঈশা খাঁও পশ্চাৎপদ হওয়ার লোক নন। তিনি অশ্বারোহণে, তড়িৎ গতিতে যুদ্ধভূমিতে।
উপনীত হলেন, এসে বললেন- ‘যাবৎ তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজা মানসিংহ বলে চিনতে না পারবেন, তাবৎ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন না। কিন্তু ঈশা খার রাজা মানসিংহকে চিনতে বিলম্ব হলো না। প্রথম আক্রমণেই মানসিংহের তরবারি ভেঙ্গে গেল। ঈশা খাঁ আপনার তরবারি রাজাকে দিলেন। কিন্তু রাজা তা না নিয়ে ঘোড়া হতে নেমে পড়লেন। ঈশা খাঁও নামলেন, নিরস্ত্র রাজার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে উদ্যত হলেন।
মানসিংহ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন না, প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশা খাঁর উদারতা, সাহস ও বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বন্ধু বলে আলিঙ্গন করলেন এবং তাঁকে আপ্যায়িত করে, উপহারাদি দানে সন্তুষ্ট করে বিদায় দিলেন।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার লিখেছেন :- মানসিংহ অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেও যখন ঈশা খাঁকে দমন করতে পারলেন না তখন কূটবুদ্ধির আশ্রয় নিলেন। তিনি ঈশা খাঁকে বুঝালেন, কেন মিছামিছি লোকক্ষয় করেছেন। এতে আমিও সুখে নেই আপনার প্রজাদেরও সুখ নেই, আমরাও হয়রানি হচ্ছি। মোগলের শক্তি অফুরন্ত তা তো আপনি জানেনই— যত দিন বশ্যতা স্বীকার না করবেন, তত দিন আপনার নিস্তার নেই। বাদশার নাম মাত্র অধীনতা স্বীকার করুন, কেবল বার্ষিক একটা রাজস্ব দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো অধীনতা নেই, আপনি আপনার রাজ্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবেন। ঈশা খাঁ অনবরত যুদ্ধে বিরক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বিচক্ষণ রাজা মানসিংহের যুক্তি তাঁর মন্দ লাগল না। তিনি সন্ধি করে, বশ্যতা স্বীকার করলেন! মানসিংহ ঈশা খাঁকে মসনদ-ই-আলি’ অর্থাৎ ঈশ্বরের সিংহাসন উপাধি ভূষণে সম্মানিত করে দিল্লী ফিরে গেলেন।
অন্য একজন বলেছেন :- ‘ঈশা খাঁ এর পর রাজা মানসিংহের সঙ্গে আগ্রায় সম্রাট আকবরের নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হলো। শেষে সম্রাট যখন তাঁর এগারো সিন্ধুর দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিবরণ শুনলেন, তখন তাকে অবিলম্বে কারামুক্ত করে, দেওয়ান ও মসনদ-ই-আলি উপাধি এবং বাংলার অনেক পরগণার শাসনভার দিয়ে সম্মানিত করলেন। বাইশটি পরগণাও দিয়েছিলেন বলে এই ঐতিহাসিক বলেছেন।
ঈশা খাঁ আধিপত্য করতেন সুবর্ণগ্রামে। সমগ্র পূর্ববাংলা তাঁর অধীন ছিল। তিনি আসামের অন্তর্গত রাঙ্গামাটিতে, নারায়ণগঞ্জের অপর তীরবর্তী ত্রিবেণীতে, যে স্থানে লক্ষ্যা নদী ব্রহ্মপুত্র হতে বের হয়েছে সেই স্থানের নিকটবর্তী এগারো সিন্ধুতে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। ময়মনসিংহের জঙ্গলবাড়ীতে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। শেরপুর দশকাহনিয়ায়ও দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।
১৫৮৩ খৃষ্টাব্দের রালফ ফিচ নামক একজন প্রসিদ্ধ ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্তে ঈশা খাঁর কথা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন : এই সমস্ত দেশের প্রধান রাজার নাম ঈশা খাঁ। তিনি অন্যান্য অধিপতিদিগের মধ্যে প্রধান এবং খৃষ্টানদের পরম বন্ধু।
ঈশা খাঁ বাঙ্গালী ছিলেন, অথচ তেমন বীরের কথা বাংলার ঐতিহাসিকগণ লিখেননি। এই বাঙ্গালী বীর জলে-স্থলে সমান বিক্রমে মোগল সেনাপতিদের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তাঁর অসংখ্য রণ-তরী ছিল! পূর্ববঙ্গের বড় বড় নদী ছিল তাঁর আত্মরক্ষার উপায়স্বরূপ।
কামরূপ যখন কোচবিহারের অধীন ছিল, ঈশা খাঁ তখন কোচবিহারের রাজাকে জয় করেছিলেন।
ঈশা খাঁ প্রজার সুখ ও সচ্ছলতার জন্য সর্বদা চেষ্টা করতেন। তিনি রাজ্য মধ্যে বহু খাল ও পুকুর কাটায়ে তার রাজ্যময় জলের সুব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
তাঁর রাজত্ব সময়ে সোনারগাঁয়ে টাকায় (৪) চার মণ চাল বিক্রয় হতো, শস্য বেশ জন্মাত, খাজনাও খুব অল্প ছিল। বিদেশে তিনি দেশের মাল রপ্তানি করতে দিতেন না। কাজেই প্রজার সুখের আর সীমা ছিল না। ঈশা খাঁর জয়-পতাকা সমুদ্রতট অবধি উড়েছিল। ময়মনসিংহের অন্তর্গত সুসঙ্গের রাজ্যের সীমা অবধি ঈশা খাঁর রাজ্যের সীমা ছিল।
১৫৯৮ খৃষ্টাব্দের শেষাংশে বা ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দে বীরোত্তম ঈশা খাঁর দেহান্তর ঘটে।
তাঁর দুই ছেলে ছিলেন। একজনের নাম ছিল মুসা খাঁ ও অন্যটির নাম ছিল মোহাম্মদ খাঁ। তারা কখনো মোগল বাদশার সঙ্গে শত্রুতা করেননি। মোগল সম্রাটের প্রতিনিধি এসে ১৬৩২ খৃষ্টাব্দে হুগলি অবরোধ করেন, তখন মুসা খাঁর ছেলে মাসুম খাঁ মোগল জাহাজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বাদশার আসাম আক্রমণকালে তিনি ২৫ খানা কোষা নৌকা দিয়ে বাদশাকে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা যায়।
ঈশা খাঁকে বাঙ্গালীর ভুলবার উপায় নেই। তাঁর কীর্তিতে বাংলা দেশ ভরে রয়েছে। এখনো তাঁর অসীম বীরত্বের নিদর্শন সুদৃঢ়, সুদৃশ্য কামান এখানে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। বেশি দিনের কথা নয়— এই সাঁইত্রিশ বছর আগেও একজন কৃষক ক্ষেত চাষ করবার সময় একে একে ঈশা খাঁর সাত সাতটি কামান পেয়েছিল। তখনকার ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন অফ বেঙ্গল- এইচ, ই, ষ্টেপলটন সাহেব ঐ কামানগুলির সময় নির্ণয় করতে চেষ্টা করেন, পিস্তল নির্মিত এই কামানগুলিতে ছিল ১০০২। উহা কি কামানের নম্বর, না কোনো সন বা তারিখ তা নির্ণয় করা দুরূহ হয়েছে।
কারো কারো মতে, বাংলার ভৌমিকশ্রেষ্ঠ ঈশা খাঁ যাবজ্জীবন মোগলের বশ্যতাই স্বীকার করেননি। একজন বাঙ্গালীর পক্ষে এমন সাহস, এমন দুর্ধর্ষতা— এমন বীরত্ব যে কত গৌরবের, তা ভাবলেও শরীর পুলকিত হয়ে উঠে। বাল্যে তিনি বিক্রিত হয়ে ক্রীতদাস রূপে সুদূর তুরাণে বিতাড়িত হয়েছিলেন, তাঁর জীবনের শেষাংশের এতাদৃশ মহনীয় বীরত্ব কাহিনী, এতাদৃশ অবদান পরম্পরা কার না চিত্তে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে? – ঈশা খাঁর অনেক কথা বলা হলো এবার আর একটি কথা বলব তা চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গল্পে বলা হয়েছে। তাহাই আবার বলিতেছি।
বার ভূঁইয়ার অন্যতম দুই ভূঁইয়া ছিলেন চাঁদ রায় ও কেদার রায়, তাঁদের কথা আগেই বলেছি, তাদের রাজধানী ছিল শ্রীপুরে।
ঈশা খাঁর সঙ্গে এঁদের খুব ভাব ছিল, রাজ্যের নানা পরামর্শের জন্য ঈশা খাঁ এলেন— শ্রীপুরে। সেখানে তাঁর যথেষ্ট সংবর্ধনা করা হলো।
দৈবের নির্বন্ধ! ঈশা খাঁ ছদ্মবেশে শ্রীনগরের শোভা ও সৌন্দর্য দেখতে বের হলেন। সঙ্গে সৈন্যসামন্ত কিছু রইল না চললেন একাকী।
ঈশা খাঁ দেখলেন- শ্রীনগরে কত বড় বড় বাড়ী, বাড়ীতে বাড়ীতে উড়ছে নিশান রাস্তায় রাস্তায় গাড়ী, ঘোড়ার অবধি নেই। দেখতে দেখতে এলেন রাজবাড়ীর সামনে। সে কি প্রকাণ্ড অট্টালিকা! মহলের পর তার মহল। চলেছে, আঙ্গিনার পর তার আঙ্গিনা!
তখন সন্ধ্যা কাল! হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠল— দেয়ালের গায়ের নকশায় নকশায় আলো ঠিকরে পড়ল। ঈশা খাঁ চেয়ে দেখলেন, ছাদের উপর একটি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। পরনে তাঁর শাদা ধবধবে শাড়ী, চুলগুলো তার মেঘের বরণ, কাঁধে, চোখে, মুখে পড়েছে এলিয়ে। মুখখানা যেন পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্য ছেনে কে গড়েছে!
দেখে ঈশা খাঁর চোখের পলক আর পড়ল না— তাঁর চোখের মণি যেন আর নড়ল না- এমন মেয়েও আছে? ঈশা খাঁ ভাবলেন, এঁকে যেমন করে হোক পাওয়াই চাই। খেয়াল নেই। কিন্তু যে তা কি করে হবে? তিনি যে মোসলমান।
ঈশা খাঁ পাগলের মতো হয়ে ফিরলেন সোনারগাঁয়ে তাঁর বাড়ীতে। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি দূত এনায়েত খাঁকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠালেন চাঁদ রায়ের কাছে।
দূত গিয়ে চিঠি দিল। কেদার রায় কৌটা খুলে আতরমাখা সেই চিঠি পড়ে- ক্রোধে অধীর হয়ে বললেন, যাও, তোমার মণিবকে বলো- এ চিঠির উত্তর তরোয়ালের মুখে দেওয়া হবে।’
কলাগাছিয়ায় ঈশা খাঁ, চাঁদ-কেদারের কাছে হেরে গেলেন, কেদারের কামানে কলাগাছিয়ার দুর্গ মাটির সঙ্গে মিশে গেল। যেখানে ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী ও গঙ্গা এসে মিশেছে, সেইখানে ছিল ঈশা খাঁর ত্রিবেণী-দুর্গ। ঈশা খাঁ আশ্রয় নিলেন সেই ত্রিবেণীতে। কেদার রায় তাঁর নৌসেনার শুধু দেড়শ ছিপ নিয়ে নদী বেয়ে চললেন। ছিপের হাজার সৈন্য নিয়ে নিজে কেদার রায় ত্রিবেণীর নিকটে এসে পড়লেন। কিন্তু শ্রীমন্ত ঠাকুর বলে একজন ষড়যন্ত্রকারী ব্রাহ্মণের চেষ্টায় চাঁদরায়ের মেয়ে স্বর্ণময়ী বা সোনামণি যাকে দেখে ঈশা খাঁ পাগল হয়েছিলেন, তিনি ঈশা খাঁর হস্তগত হলেন। এই অপমানে রাজা চাঁদ রায় জীবন ত্যাগ করলেন।
তারপর—দিন গেল, মাস গেল— স্বর্ণময়ী ঈশা খাঁ সাহেবের অঙ্কলক্ষ্মী হলেন।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে ঈশা খাঁ মরে গেলে, মোগলেরা নাকি, সোনারগাঁও আক্রমণ করেছিলেন,
দশ দিন দশ রাত্রি ঈশা খাঁর বেগম স্বর্ণময়ী বা সোনাবিবি সোনারগাঁওকে মোগলের হাত থেকে রক্ষা করে অবশেষে চিতা জ্বেলে পুড়ে মরেছিলেন।
ঈশা খাঁর জীবনে এটি কু কি সু কাজ তার বিচার করবার অবসর আমাদের নেই দরকারও নেই।
আমরা শুধু ভাবি, যদি এ ঘটনা না ঘটত, তাহলে চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সঙ্গে ঈশা খাঁর সম্মেলনে যে অদ্ভুত শক্তির উদ্ভব হতো, তাতে হয়তো আমাদের মাতৃভূমি বাংলা দেশের রূপ অন্য আকার ধারণ করত।