কন্দর্পনারায়ণ বসু রায়
‘জগদানন্দের নন্দন কন্দর্প, সাক্ষাৎ ছিলেন যেমন কন্দর্প,
মহাধনুর্দ্ধর আর মানী মহারথ।
ছিলেন মহাশূর অক্ষৌহিণীপতি, সব্যসাচীর সমান সমাজের পতি
যুদ্ধপ্রিয়, মহাচক্রী যেন সাক্ষাৎ মন্মথ।’
– ঘটককারিকা
বরিশাল জেলায় চন্দ্রদ্বীপ ও বাকলা। এখানকার রাজা ছিলেন কায়স্থদের মধ্যে কুলীন ও সমাজপতি দনুজমর্দ্দন রায়।
তাঁর ছিল এক মেয়ে, সেই মেয়ের আবার ছিল এক ছেলে, তার নাম ছিল পরমানন্দ বসু। তিনিই তার মাতামহের সম্পত্তি পেলেন। মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে পরমানন্দ বসু, ‘রায়’ উপাধি লাভ করলেন। কালে রাজা পরমানন্দ বসু রায়ের পুত্র হলো, তার নাম হলো জগদানন্দ। বিধাতার ইচ্ছায় তিনি তার বাড়ির সামনের নদীর জলে ডুবে মারা গেলেন। সকলেরই মনে বড় আক্ষেপ হলো। রাজা মারা গেলে সিংহাসন শূন্য থাকতে পারে না। তাঁর ছেলে কন্দর্পনারায়ণ বসু রায় হলেন রাজা। এই কন্দর্পনারায়ণের ক্ষমতার অন্ত ছিল না। নদীর জলে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর দুঃখে তিনি তাঁর রাজধানী নদী-তীর হতে কচুয়াতে তুলে নেন। সেখান থেকে মাধবপাশায় যান।
রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায় মহাবীর ছিলেন, তাঁর অসীম বীরত্বে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের মহিমা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কিন্তু তিনি বার ভূঁইয়াদের যা শ্রেষ্ঠ গৌরব অর্থাৎ মোসলমান সম্রাটের অধীনতা অস্বীকারের যে প্রচেষ্টা তাতে সারাজীবন স্থির থাকতে পারেননি।
রাজা কন্দর্পনারায়ণ নিজে অসাধারণ শক্তিশালী ছিলেন। মোসলমান সেনাপতি মহাবীর গাজিকে যুদ্ধে নিহত করেছিলেন। মগদের সঙ্গে তাঁর অনেক যুদ্ধ হয়, সব যুদ্ধেই তিনি জয় লাভ করেন। এক অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল তার সৈন্য বিভাগে। ঘটককারিকাকার লিখেছেন, তিনি দেখতে অতিশয় সুপুরুষ ছিলেন, যেমন নাম ছিল, তেমনই ছিল তাঁর রূপ। বাসরিকাটি, ক্ষুদ্রকাটি ও মাধবপাশা বলে তিনি তিনটি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। হোসেনপুর নামক নগর হতে মোসলমানগণকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানেও একটি শহর গড়ে তাঁর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন রেখে গেছেন। তাঁর রাজধানী মাধবপাশায় এখনও পিতলের কামান রয়েছে, সেগুলো দেখলে তাঁর বীরত্ব কাহিনী স্মরণ করে আনন্দ হয়। ঘটককারিকার শ্লোকরাশি পড়লে এখনও হর্ষে উৎফুল্ল হতে হয়।
তিনি রাজা ছিলেন, রাজার মতোই ছিল তার ব্যবহার, আশ্রয় দান করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি অনেকবার যুদ্ধে বিব্রত হয়েছিলেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, যখন মাসুম কাবুলীর সঙ্গে মোগল সেনাপতি সাহাবাজ খাঁর যুদ্ধ হয়, তখন রাজা কন্দর্পনারায়ণ সাহাবাজ খাঁকে তাঁর প্রার্থনানুযায়ী যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্য ও যুদ্ধ জাহাজ দান করে যথেষ্ট সাহায্য করেন, শুধু তাই বললে অন্যায় বলা হবে, হোসেনপুরে যে যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে রাজা কন্দর্পনারায়ণ পাঠানগণকে এমনভাবে পরাস্ত করেন যে তেমন পরাজয় বুঝি তাদের আর কেউ কখনও করতে পারেনি।
সপ্তগ্রামের পাঠান বীর মীরজা মজাদ খাঁ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মোগল বাদশাহের পক্ষ গ্রহণ করলে উড়িষ্যার পাঠান নবাব কতুল খাঁ তাঁকে সমুচিত শিক্ষা দিতে চেষ্টিত হন। সে আক্রমণ যে সে আক্রমণ ছিল না, ভীত মীরজা মজাদ খাঁ পালিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সেলিমাবাদে চলে যান। নবাব কতুল খাঁ সেখানেও তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হন। অনুপায় হয়ে মীরজা মজাদ খাঁ তখন মহাবীর রাজা কন্দর্পনারায়ণের শরণাপন্ন হন। রাজা কন্দর্পনারায়ণ নিজের বন্ধুস্থানীয় নবাব কতুল আঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও মীরজা মজাদ খাঁকে আশ্রয় দান করে রক্ষা করেন। নবাব কতুল খাঁ রাজা কন্দর্পনারায়ণের প্রভাব ও বীরত্ব এবং সৈন্যবল জ্ঞাত ছিলেন, কোনোক্রমেই তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে সাহসী হননি।
রাজা গণেশ পাণ্ডুয়ার রাজা ছিলেন। তাঁর পুত্র যদু নামক একজন নবদীক্ষিত মোসলমান রাজা গণেশের মৃত্যুর পর পাণ্ডুয়া ও সপ্তগ্রামে অত্যাচার করতে উদ্যত হয়, তার ভাব দেখে শুনে, স্বধর্মপরায়ণ রাজা কন্দর্পনারায়ণ সে যাতে হিন্দুদের উপর অত্যাচার না করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে অনেকদিন পাণ্ডুয়ায় থাকেন। তার ভয়ে যদু সেখানে কিছুই করতে সাহসী হয় না, রাজা কন্দর্পনারায়ণ সেখানে টাকশাল করে, রূপোর টাকা তৈরি করাতেন, এখনও তার নিদর্শন পাওয়া যায়।
আগেই বলেছি, তিনি স্থিরভাবে আগাগোড়া বার ভূঁইয়ার যা যা ধর্ম তা তা পালন করতে পারেননি; সে জন্য অনুতাপও ভোগ করেছিলেন বিস্তর। অনুতাপ দগ্ধহৃদয়ে তিনি বহুদিনাবধি ভীমবিক্রমে মোগল সৈন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ উপস্থিত করেন। দীর্ঘকাল সেসব যুদ্ধ হয়। মোগল সৈন্য পরাজিত হয়। মোগলদের সপ্তগ্রামের সুরক্ষিত, অত্যুন্নত, সুরম্য, দুর্ভেদ্য দুর্গ রাজা কন্দর্পনারায়ণ স্বীয় অধিকারভুক্ত করেন। রাজা কন্দর্প নারায়ণের নামাঙ্কিত মুদ্রা মাটির নিচ থেকে মাঝে মাঝে বের হয়ে এখনও সে কীর্তি ঘোষণা করছে।