মুকুন্দরাম রায়

মুকুন্দরাম রায়

‘ঘর ঘর সম্পদ আপনার নির্ভর,
সুপ্তের রাজ্যে দৈবের সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া।’

ফতেজঙ্গপুরের কিয়দংশ নিয়েছিল বাংলার অন্যতম ভূঁইয়া বা ভৌমিক রাজা মুকুন্দরাম রায়ের রাজ্য। ফতেয়াবাদ পরগণা (বর্তমান ফরিদপুর) ছিল ভূষণা চাকলার অন্তর্গত। যশোর, খুলনা, বাখরগঞ্জ ও ফরিদপুরের কতকগুলো পরগণা মিলে গড়ে উঠেছিল ভূষণা চাকলা।

রাজা মুকুন্দরাম রায় প্রথমে সামান্য জমিদার ছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি, কবির কল্পিত আপনার পায়ে দাঁড়িয়ে সুপ্তের রাজ্যে, নিদ্রিত বাঙ্গালীর দেশে, দৈবের সাড়া জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে কেমন করে আপনার পায়ে দাঁড়াতে হয়। তিনি নিজের বাহুবলে, অধিকার বাড়িয়ে, তখনকার দিনে, বাংলার বিখ্যাত বার ভূঁইয়ার অন্যতম বিশেষ পরাক্রমশালী ভূঁইয়া রূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। মহাপরাক্রম- শালী পাঠান ও মোগল সবারই সাথে তিনি সুদীর্ঘকাল সমানে লড়েছিলেন।

মোগল পাঠানের যুদ্ধে ফতেয়াবাদের পাঠান মোরাদ খাঁ মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই মোরাদ খাঁর বন্ধু ছিলেন মুকুন্দরাম রায় মহাশয়। উড়িষ্যার শাসনকর্তা কতুল খাঁ, মোরাদ খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্রগণকে আক্রমণ করেন কিন্তু নাবালকগণের পিতৃবন্ধু মুকুন্দরাম রায় ঘোরতর যুদ্ধ করতে আরম্ভ করেন।

বাদশার তখনকার প্রতিনিধি ছিলেন, রাজা তোডরমল্ল। তিনি মুকুন্দরাম রায়ের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে মুকুন্দরাম রায়কে ফতেয়াবাদের অধিকাংশ স্থানের শাসন-কর্তৃত্ব দান করেন এবং তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।

রাজা হয়ে মুকুন্দরাম রায় নানা সদনুষ্ঠানে রত হলেন। এত সদাশয়তা দেখাতে লাগলেন যে তাঁর প্রজারা তাঁর একান্ত অনুরক্ত হয়ে উঠল।

রাজকার্য চলছিল বেশ – কিন্তু সায়দ খাঁ নামে একজন মোগল হলেন বাংলার শাসনকর্তা। তিনি মুকুন্দরাম রায়কে পদচ্যুত করলেন। রাজা মুকুন্দরাম রায় এ অপমান সইবার লোক ছিলেন না। নিজে মহাবীর ছিলেন। তিনি পদাহত সর্পের মতো গর্জে উঠে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

ফতেজঙ্গপুরে উভয় পক্ষের তুমুল যুদ্ধ হলো। কামানের গর্জনে, সৈন্যগণের হুঙ্কারে, অশ্বগণের হেষারবে, কান বধির হয়ে উঠল। রাজা মুকুন্দরাম রায় জয়লাভ করলেন। জয়োল্লাসে তিনি ফিরছিলেন রাজধানীতে, এমন সময় সংবাদ এল, বাংলার শাসনকর্তা সায়দ খাঁর নিযুক্ত ফতেয়াবাদের নূতন মোসলমান শাসনকর্তা তাঁকে যুদ্ধে ব্যাপৃত ও যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থিত জেনে তার অরক্ষিত রাজপুরী করলেন আক্রমণ।

রাজা এই দুঃসংবাদ শুনে ছুটে এলেন বাড়ীতে। ব্যস্ত হয়ে প্রতিকার করতে উদ্যত হচ্ছেন, এমন সময় হঠাৎ সায়দ খাঁ সসৈন্যে- রাজা মুকুন্দরাম রায়ের রাজধানী ফতেজঙ্গপুর আক্রমণ করলেন। দুই বিপুল সৈন্যের সহিত অসম্ভব যুদ্ধ করিয়া রাজা পরাজিত ও নিহত হলেন। রাজা মুকুন্দরাম রায়ের ছয়টি ছেলে ছিলেন। তন্মধ্যে পিতৃভক্ত পুত্র শত্রুজিৎ পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করে অবশেষে পরাজিত ও বন্দী হলেন। দিল্লীতে বন্দী অবস্থায় তাঁর দেহাবসান ঘটল। শত্রুজিতের নামানুযায়ী যশোর ‘শত্রুজিতপুর’ বলে একখানি গ্রাম এখনো রয়েছে।

ফতেয়াবাদের কায়স্থ সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা মুকুন্দরাম রায়ের স্বজাতি-হিতৈষণা আমরা তাঁর সমাজের অসংখ্য কুলীন কায়স্থগণের জায়গীরসমূহ হতেই বিশেষভাবে বুঝতে পারি।

কায়স্থ-কুল-তিলক রাজা মুকুন্দরাম রায় নেই কিন্তু তার সযত্ন প্রতিষ্ঠিত ‘ভূষণা সমাজ’, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণশ্রেণীর ‘ভূষণাপটী’ এখনো তাঁর কীর্তি ঘোষণা করছে। সত্যি এই ভৌমিকেরা— এক এক জন এক একটি রত্ন। এদের জন্মে দেশ ও কুল গৌরবোজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *