পাঁচ
পরদিন দুপুর নাগাদ কবর দেয়া হলো গাস লিওস্টর্মকে। খবর পেয়ে এসেছে গোটা বিশেক পরিচিত মানুষ। সমবেদনা জানাল না তাদের কেউ। উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে কোন মনোযোগ দিতে পারল না জিম, যেন একটা ঘোরের ভেতর রয়েছে। ওকে বিরক্ত না করেই আনুষ্ঠানিকতা সারা হলো। গাস লিণ্ডস্টর্মের লাশ দেখার পর থেকে সময় সম্বন্ধে ধারণা হারিয়েছে জিম। ওর মনে পড়ল না যে কাছের লাইন ক্যাম্পে যেতে হবে, চার্লিকে জানাতে হবে যাতে সে গিয়ে ল্যানির সার্চ পার্টিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। মনে পড়ল না যে সারারাত কিছু খায়নি ও, খাওয়া দরকার শরীর সুস্থ রাখতে হলে।
উঠানে দাঁড়ানো সিকামোর গাছটার নিচে বেঞ্চে বসে রাতে বোতলকে বোতল মদ খেয়েছে ও। সন্ধ্যার কথা সেটা। তারপর সকালে প্রতিবেশীরা যখন আসা শুরু করল তখনও বেঞ্চে বসে আছে ও, এক কনুই হাঁটুর ওপর রাখা, অন্য হাতে মাথা চেপে ধরে রয়েছে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। চেয়ে আছে মাটিতে পড়ে থাকা অসংখ্য সিগারেটের টুকরোর দিকে। এক পাশে পড়ে আছে একটা খালি মদের বোতল। বেঞ্চে রাখা বোতলটার অর্ধেক খালি।
প্রতিবেশীরা যখন এল তখন মুখ তুলে তাকায়নি ও। উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। তারা দু’একটা সান্ত্বনার বাণী জানাতে গিয়ে ওর মানসিক অবস্থা বুঝে সরে থেকেছে। এ এমন এক মানসিক অবস্থা যখন কাউকে সান্ত্বনা বা উপদেশ দেয়াটা একটা অন্যায়।
কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা। শেষ বারের মত লাশ দেখতেও ওঠেনি জিম। অথচ গাস ছিল ওর সত্যিকারের বন্ধু, সহকর্মী। এখন সে শুয়ে আছে ওর লিভিং রূমে, সোফার ওপর। মৃত। আর কখনও ফিরবে না সে, হেসে বলবে না, ‘বুড়ো শেয়াল, সমস্ত কাজ শেষ করে এসেছি, এবার পকেট থেকে বেতনটা বের করো দেখি, একটু ফুর্তি করে আসি।’
মিসেস উডফোর্ড, তার স্বামী আর ছোট ছেলে বার্টের সঙ্গে বাকবোর্ডে চেপে এসেছে লিণ্ডা। সবাই ওরা সিকামোরের নিচে বসে থাকা জিমের কাছে এক মুহূর্তের জন্যে থেমেছে। তাদের উপস্থিতি প্রায় খেয়ালই করেনি জিম। মনে হয়েছে যেন ও কাউকে চেনে না।
একটু পরই বুড়ো জেফ উডফোর্ড ছেলেকে নিয়ে কবর খোঁড়ার কাজে সাহায্য করতে চলে গেছে। মিসেস উডফোর্ড সান্ত্বনা দিতে যাওয়ায় চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়েছে লিণ্ডা। বুঝতে ওর দেরি হয়নি যে এখন ওসবের উপযুক্ত সময় নয়। আপনমনে দুই মহিলাকে বাউ করেছে জিম, তারপর ডুবে গেছে নিজের চিন্তায়। অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ করতে গেছে মিসেস উডফোর্ড। মনের মাঝে অনিশ্চয়তা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে লিণ্ডা, ওর চোখ একবার গেছে মাটিতে পড়ে থাকা শূন্য বোতলের দিকে, তারপর ও দেখেছে বিভ্রান্ত জিমকে।
একটু পর ও যোগ দিয়েছে মিসেস উডফোর্ডের সঙ্গে। লিণ্ডার দোদুল্যমানতা বুঝে মিসেস উডফোর্ড বলেছে, ‘সত্যিকারের একজন ভাল মানুষ ও, লিণ্ডা। গাস ছিল ওর ভাইয়ের মত। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে জিম। এখন ওকে একা থাকতে দেয়াই বোধহয় উচিত হবে।’
চোখে বিস্ময় নিয়ে প্রৌঢ়া মহিলাকে দেখেছে লিণ্ডা, দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, ‘ভাল মানুষ হলে বন্ধু মারা যাবার পর কেউ এভাবে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যায়? আমি তো বুঝতে পারছি না কেন…’
‘হ্যাঁ, মা, তুমি বুঝতে পারছ না। জিম কার্সন মাতাল হয়নি। ওর যা মানসিক অবস্থা তাতে এক গ্যালন হুইস্কি গিললেও মাতাল হবে না ও। এদিকের পুরুষরা নিজেদের দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করে না। প্রকাশ করাটা দুর্বলতা মনে করে। সত্যিকারের পুরুষ যখন আঘাত পায় তখন ওরা নিজের মাঝে কষ্ট লুকিয়ে রাখে, মদ খায় মনের দুঃখবোধটাকে ভোঁতা করে দিতে। গাস লিওস্টর্মের প্রতি কোন অবহেলা দেখাচ্ছে না ও, অবজ্ঞা নেই ওর মনে, সময়টা পার করছে ও দোজখ- যন্ত্রণায়। আমি এদের বুঝতে পারি। আমার স্বামীও এই একই ধাঁচে তৈরি। পারলে এখন বাচ্চাদের মত চিৎকার করে কাঁদত জিম, কিন্তু না কাঁদার বয়স হয়ে গেছে ওর। অন্তরটা ওদের চওড়া এবং গভীর, লিণ্ডা; বড় একটা নদীর মত। যে স্রোত নিচ দিয়ে বয়ে যায় তা যত তীব্রই হোক, বলো তুমি, সে স্রোত কি দেখা যায়?’
‘সবাই ওকে নিয়ে ভাবছে,’ স্বীকারের সুরে বলেছে লিণ্ডা, ‘নিশ্চয়ই ওর মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছে, যে কারণে সবাই ওকে এত পছন্দ করে। কিন্তু তারপরও…’
‘হ্যাঁ, লিণ্ডা, সবাই ওকে পছন্দ করে, ওর জন্যে ভাবে। একদিন এই জিম কার্সনের মত লোকরাই এই এলাকা বদলে দেবে, গড়ে তুলবে সভ্যতা। এদের মত মানুষের রক্ত-মাংসেই উর্বর হবে জমি। জিমের মত লোকরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যাতে অন্যরা বেঁচে থাকতে পারে।’
ফিরে তাকিয়ে দেখল লিণ্ডা, এখনও বেঞ্চে বসে মাটির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিম কার্সন। নিজের ভেতর অপরিচিত একটা অনুভূতির অস্তিত্ব টের পেল ও। কেমন যেন লেগে উঠল জিমের জন্যে। মনের মাঝে ভয় অনুভব করল লিণ্ডা। ও কি রুক্ষ কঠোর ওই লোকটাকে ভালবেসে ফেলেছে?
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্নার পাড়ে জন্মেছে বেশ কিছু জুনিপার গাছ। ওখানেই কবর খোঁড়া হয়েছে। দুপুর নাগাদ ছয়জন প্রতিবেশী বার্ন থেকে তক্তা খুলে তৈরি করা কফিনে করে লিওস্টর্মের লাশ নিয়ে গেল জুনিপারের ধারে। আস্তে করে কবরে নামিয়ে দেয়া হলো কফিন। জীবিত অবস্থায় ওখানে জুনিপারের ছায়ায় বসে পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঝর্নার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসত লিণ্ডস্টর্ম। এখন থেকে সব সময় ওখানেই থাকবে ও।
বুড়ো উডফোর্ডের পরনে একটা কালো কোট। বুট জুতোয় নতুন করে রং করা হয়েছে। তার দীর্ঘ চুল ছেঁটে দিয়েছে মিসেস উডফোর্ড। এখন সে দাঁড়িয়ে আছে কবরের সামনে। এক হাতে হ্যাট, অন্য হাতটা নার্ভাস ভঙ্গিতে গোঁফ পাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে পাহাড়ের দিকে, তারপর তার দৃষ্টি স্থির হচ্ছে অপ্রশস্ত কবরে শোয়ানো কফিনের ওপর।
সবাই তার চারপাশে অপেক্ষা করছে নীরবে। প্রত্যেকের চেহারা গম্ভীর। গাস লিওস্টর্মকে পছন্দ করত তারা। সৎ একজন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করত।
‘বন্ধুরা,’ শুরু করল উডফোর্ড, ‘আমরা জানি যে ওর মৃতদেহ সামনে রেখে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করাটা গাস পছন্দ করত না। কিন্তু যা করতে হবে সেটা তো করতেই হবে। এবার আসা যাক গাসের কথায়। ও ছিল এমন একজন মানুষ যে নিজের কাজ অন্তর ঢেলে করত। কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসত ও। আমি জানি না ঈশ্বর এই গুণ ছাড়া আর কোন গুণের কারণে পুরুষ মানুষকে স্বর্গে নেবেন কিনা। ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কোন জ্ঞান নেই আমার। শুধু এটুকু বুঝি, সৎ একজন পুরুষ সবসময়ই স্বর্গে স্থান পাবার উপযুক্ত। গাস ছিল তেমনই একজন মানুষ, কাজেই ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।
‘আমরা সবাই জানি গাস লিওস্টর্ম কেন জীবন দিয়েছে। আমাদের সবার স্বার্থ রক্ষার জন্যে কাজ করছিল লিওস্টর্ম। যে ঝামেলা আমরা মোকাবিলা করছি সেই একই ঝামেলা গাসও মোকাবিলা করেছে। ও শুধু ওর বসের হয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই খুন হয়নি, ও আমাদের সবার পক্ষেও কাজ করছিল। ভবিষ্যতের কঠিন দিনগুলোয় গাসের এই আত্মত্যাগের কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। সবাই যদি আমরা নিজের নিজের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের স্বার্থও দেখি তা হলেই কেবল এখানে টিকতে পারব।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল উডফোর্ড, এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘গাস, আর কিছুই বলার নেই আমাদের। বিদায়, বন্ধু! সত্যিকারের পুরুষের মত বেঁচেছ তুমি, মারাও গেছ সত্যিকারের পুরুষের মত। ভাল থেকো তুমি।’
ফিউনারাল শেষ হবার পর তরুণ বার্ট উডফোর্ডকে একপাশে ডেকে নিল টয় ল্যানি। কারও কানে যাবে না এমন দূরত্বে পৌঁছে বলল, ‘বার্ট, জিমের জন্যে আমাদের কিছু একটা করতে হবে। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে জিম। সর্বক্ষণ গাসের কথা ভাবছে। ওকে ওর মানসিক বন্দিশালা থেকে উদ্ধার করতে হবে। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে কোন এক কৌশলে ওর কাছ থেকে মদের বোতলটা সরিয়ে ফেলা। যেকোন একজনকে কথা বলে বা অন্য কোন ভাবে ওকে ব্যস্ত রাখতে হবে, অন্যজন বোতলটা সরিয়ে নেবে। দরকার হলে মাথায় বাড়ি দিয়ে ওকে অজ্ঞান করে নিতে হবে। যা-ই করতে হোক না কেন, বোতল যাতে খুঁজে না পায় ও।’
‘অজ্ঞান করে ফেলাটাই বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ হবে,’ বলল বার্ট উডফোর্ড। ‘ঘুম ওর জন্যে এখন আশীর্বাদ। তাছাড়া হুঁশ থাকলে ও হয়তো একা একা কেলটনের মোকাবিলা করতে গিয়ে ফাঁদে পড়ে যাবে।’
বাড়িটা ঘুরে দু’জন ওরা চলে এল সিকামোর গাছের পেছনে, দেখল বেঞ্চে কেউ নেই। খুঁজতে শুরু করল ওরা। বার্নে এসে দেখল জিম কার্সনের ঘোড়া আর স্যাডল ওখানে নেই।
বড় বেশি দেরি করে ফেলেছে ওরা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে। করাল থেকে ফেরার সময় হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল টয় ল্যানি, নিচু স্বরে বলল, ‘ও গেছে কেলটনের মুখোমুখি হতে। ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, ইণ্ডিয়ানদের মতই ট্রেইলগুলো চেনে জিম। আর ও এমন এক মানুষ যে পাইনটপের এদিকে থামবে না।’
‘আর তার মানে জিমকে নিয়ে তিনজনকে হারালাম আমরা,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্ট। ‘ওকে বাঁচতে দেবে না কেলটন। পাহাড়ে অসংখ্য লোক আছে যারা জিমকে খুন করতে পারলে খুশি হবে।’
.
প্রথম যখন জিম চারপাশ সম্বন্ধে সচেতন হলো তখন খেয়াল করে দেখল স্যাডলটাকে বালিশ বানিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে ও। চোখ মেলল। একঝাড় অ্যালডারবেরির ঝোপের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল পাইন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামান্য সূর্যের রশ্মি আসছে।
আবার চোখ বন্ধ করল জিম। ভাবার চেষ্টা করল কখন এখানে এসেছে। জায়গাটা কোথায়। কিছুক্ষণ ওকে সাহায্য করল না স্মৃতিশক্তি, তারপর ঝাপসা ভাবে মনে পড়ল গাস লিওস্টর্মকে খুঁজে পাওয়া, তার শেষকৃত্য এবং ওর রওনা হয়ে যাওয়া।
অনেকে এসেছিল সমবেদনা জানাতে। তাদের মধ্যে মিসেস উডফোর্ড আর লিণ্ডাও ছিল। আতঙ্কিত চেহারায় দৃষ্টিতে অপছন্দ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল লিণ্ডা। এখন মনে পড়ল তখন ও বসে ছিল সিকামোরের নিচে একটা বেঞ্চে। মনে পড়ল সারারাত মদ্যপান করেছে সে। কাউবয়রা অতিরিক্ত মদ পান করবে সেটা লিণ্ডার দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত একটা কাজ। কাউবয়রা মদ খেয়ে নাচের আসরে হুল্লোড় করে, এব্যাপারে কয়েকবার আপত্তি জানিয়েছে লিণ্ডা।
শেষ পর্যন্ত ওকে নিয়ে নাচের আসরে যাওয়াই বাদ দিতে হয়েছে জিমকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিম। অনুভব করল, মেয়েটিকে আপন করে পাবার কোন সম্ভাবনা নেই ওর। লিণ্ডার পছন্দ হওয়ার তুলনায় যথেষ্ট সভ্য নয় ও। এখন জিম বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করল, মেয়েটিকে না পাওয়ার যে একটা ব্যথা অন্তরে ও অনুভব করত সেটা এখন আর নেই। মদ খাওয়াটা ঠিক হয়নি, নিজের মনে স্বীকার করল জিম। মাথাটা এখনও ধরে আছে। চিন্তাগুলো অস্পষ্ট। কিছুই ভাল লাগছে না। মুখের ভেতরটা মনে হচ্ছে মরুভূমির কর্কশ বালুতে ভরা।
শরীর গড়িয়ে দিয়ে ক্রল করে অ্যালডারের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল ও, চারপাশে চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। এদিকের পাইন গাছগুলো এত মোটা যে দু’হাত বেড় দিয়ে ধরতে পারবে না জিম। এটা নিশ্চিত যে পাহাড়ের অনেক ওপরে কোথাও আছে ও। ঘোড়াটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও থাকবে, নইলে স্যাডল এখানে থাকবে কেন! সামান্য ঢাল বেয়ে ওপর দিকে উঠতে শুরু করল ও। মন বলছে ঘোড়াটাকে সামনে পাওয়া যাবে।
একটু এগিয়েই থামতে হলো ওকে। আরেকটু হলেই গাছের আড়াল ছেড়ে বের হয়ে যেত ও। সামনে সরু একটা রাস্তা, চলে গেছে পাইন গাছের ফাঁক গলে এঁকেবেঁকে।
জ্যাকের দোকানটা রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে। সূর্যের আলোয় পোড় খাওয়া পুরানো একটা দোতলা বাড়ি ওটা, পাইনের শুকনো কাঠ দিয়ে তৈরি। দেখে মনে হয় বাড়িটা পরিত্যক্ত, কিন্তু তা ঠিক নয়; ছাদের এক কোনা ফুঁড়ে ওঠা চুলার চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। জিম শুনেছে দোকানটার মালিক আসলে বার্ড কেলটন।
গাছের আড়াল থেকে দোকানটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গত দু’দিনের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। বার্ড কেলটনের মুখোমুখি হতে বের হয়েছে ও র্যাঞ্চ থেকে। গাস লিওস্টর্মকে অত্যাচার শেষে খুন করে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে যে চ্যালেঞ্জ কেলটন করেছে সেটার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। হাতে কোন সত্যিকার প্রমাণ না থাকলেও ওর ধারণা এ ঘটনায় বার্ড কেলটন দায়ী। এখন ওর মানসিক অবস্থা যেমন তাতে প্রমাণ থাকাটা ততটা জরুরী নয়।
মনে পড়ল ফিউনারালের সময় সবার অজান্তে র্যাঞ্চ থেকে বের হয়ে এসেছে ও। ল্যানি বা অন্যরা ওকে কিছুতেই একা কেলটনের এলাকায় আসতে দিতে রাজি হত না। যে করে হোক ওকে ঠেকাত ওরা। এপর্যন্ত যেভাবেই হোক অন্ধকারের মাঝে চলে এসেছে ও, তারপর মাতাল অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকালের জন্যে অপেক্ষা করবে।
হত্যাকাণ্ডগুলো ওর মনে কী ধরনের অনুভূতির জন্ম দিয়েছে? নিজের ভেতরটা হাতড়ে দেখল জিম, কোন অনুভূতির চিহ্নও খুঁজে পেল না। গাস চিরতরে চলে গেছে, তবু অন্তরটা ওর শুধুই ফাঁকা। লিণ্ডা ওর স্ত্রী হবে না, তাতে কী!
অন্তরটা যেন মরে গেছে ওর। যে করে হোক বার্ড কেলটনকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হবে, এছাড়া সচেতনতায় আর কোন ভাবনা নেই। এতই নির্বিকার লাগছে যে কেলটনের প্রতি কোন রাগও অনুভব করছে না ও। যা করতে হবে তা করতে হবে, কেলটনকে খুন করা এমনই একটা ব্যাপার। জানে, বার্ড কেলটনকে ও খুঁজে বের করবে, দরকার হলে দোজখ পর্যন্ত ধাওয়া করে হলেও, হত্যা করবে ও লোকটাকে।
চিন্তাশক্তি একটু বাড়ার পর অনুভব করল, যদিও রাতে বিশ্রাম এবং ঘুম পেয়ে শরীরের ক্লান্তি কমে গেছে, কিন্তু মনে করতে পারল না শেষ কখন খাবার খেয়েছে। প্রচণ্ড খিদেয় পেটের ভেতরটা মোচড় মারছে। কেলটনকে খুঁজে পেতে বোধহয় বেশ সময় লাগবে। লোকটা এখন কোথায় আছে সেটা জানা থাকলে ভাল হত। জ্যাকের পেট থেকে কেলটনের খবর বের করা যাবে না। জ্যাক আজও বেঁচে আছে তার একমাত্র কারণ মুখ বন্ধ রাখতে জানে সে। বাড়তি কথা বলার অভ্যেস যাদের আছে তারা এদিকের পাহাড়ী এলাকায় বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরতি পথ ধরল জিম, একটা ঝর্নার ধারে নিজের ঘোড়াটাকে খুঁজে পেল, তাজা ঘাসে চরছে। কখন ঘোড়াটাকে বেঁধেছিল মনে করতে পারল না। ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে বনের ধারে নিয়ে এল ওটাকে। সরু একটা ট্রেইল খুঁজে পেয়ে ওখানেই ঘোড়াটা বাঁধল। প্রয়োজনে দ্রুত সরে পড়তে পারবে। জ্যাকের দোকানে যেতে হবে ওকে, খাবার কিনতে হবে, তারপর পাহাড়ী দস্যুরা ওর উপস্থিতি টের পাবার আগেই সরে যেতে হবে এখান থেকে। এখন কেলটনের স্যাঙাতদের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই ওর। স্বয়ং কেলটনকে চাই ওর।
বনের প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধুলো মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে দোকানটার দিকে এগোল জিম। বারান্দায় উঠে দরজার হাতলে হাত রেখে কাঠুরেদের তৈরি পথটায় নজর বোলাল। নেই কেউ। নির্জীব একটা সাপের মত পড়ে আছে ধুলোময় রাস্তা।
এখানে দেখার তেমন কিছু নেই। পাইনের তৈরি কয়েকটা কুঁড়ে, বেশিরভাগেরই দরজা নেই। ধূসর, পরিত্যক্ত। পুরানো একটা লাম্বারিং ক্যাম্প ছিল এটা। দোকানের একশো গজ দূরে ছিল স’মিল। এখন আর কেউ থাকে না এখানে। শুধু জ্যাক আর তার দোকান মনুষ্যবসতির চিহ্ন বহন করছে।
সাবধানে এদিকটা এড়িয়ে চলে পাহাড়ী লোকজন। তবে তাদের কেউ যখন জ্যাকের চিনির তৈরি হুইস্কি গিলে অতিরিক্ত মাতাল হয়ে পড়ে তখন আশ্রয় নেয় ওই কুটিরগুলোর কোন একটায়। কখনও কখনও ঘর ভাড়া করে জ্যাকের ওপর তলায়। আজকে তেমন কারও উপস্থিতি নেই। অন্তত ওর চোখে পড়েনি। দরজাটা খুলে দোকানের ভেতরে ঢুকল জিম, পূর্ণ সতর্ক। পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর হাতের তালু ছুঁয়ে আছে সিক্সগানের বাঁট।
পেছনের একটা টেবিলে হাতের স্টেক ভরা প্লেট দুটো রেখে কে ঢুকেছে দেখতে ঘুরল জ্যাক। চিকনচাকন লোক সে, মাথার চুলগুলো ধূসর, গোঁফটা এমনই যে তার বিষণ্ণ চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। একটা চোখ কানা, লাল অক্ষিকোটর দেখতে বিশ্রী লাগে। কাউন্টারের পেছনে এসে দাঁড়াল সে, ভাল চোখটায় নীরব প্রশ্ন। অপেক্ষা করছে আর গোঁফে তা দিচ্ছে দু’আঙুল এক করে।
‘সার্ডিনের এক ডজন ক্যান,’ বলল জিম। ‘সঙ্গে আরও কিছু থাকলে ভাল।’ তেলমাখা মাছের ক্যানগুলো কাউন্টারের ওপর রাখল জ্যাক। ‘পনির চলবে? কোথাও না থেমে রান্নাবাড়া না করে পথ চলতে হলে খাবার হিসেবে ওগুলো চমৎকার।’
মাছি ভিনভিন করছে পনিরের চাকার ওপর। এক নজর তাকিয়ে নিচু গলায় ‘চলবে’, বলল জিম।
‘কয় টুকরো?’ জিজ্ঞেস করে হাতের ছুরিটা পনিরের গায়ে ঠেকাল জ্যাক। জিম কার্সন কিছু বলছে না দেখে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কয় টুকরো দেব?’
কথাটা এবারও শুনতে পেল না জিম। এই মাত্র পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে দোকানের তিনটে টেবিলের একটায় বসেছে এক লোক এবং তার সঙ্গিনী। ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ তাদের ওপর। এমন এক জায়গায় জিম দাঁড়িয়ে আছে যে লোকটা ঘুরে না তাকালে ওকে দেখতে পাবে না। পেছনের জানালার দিকে মুখ করে বসেছে লোকটা।
পনিরের ওপর ছুরি ধরে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক, চোখটা স্থির জিমের ওপর। সেদিকে জিমের খেয়াল নেই, পা বাড়াল ও লোকটার দিকে। অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে ওর।
মহিলা টিনের কফি কাপে চুমুক দিয়ে ওটার ওপর দিয়ে জিমকে এগোতে দেখল। অগোছাল লাগছে মহিলাকে দেখতে। চেহারার ওপর এসে পড়েছে কয়েক গোছা চুল। চোখ দুটো রক্তলাল, ঘুমে জড়ানো। যেন সারারাত বিশ্রাম পায়নি। পরনের লাল পোশাকটা কোঁচকানো। বুঝতে জিমের দেরি হলো না, পাহাড়ী লোকদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে পয়সা কামায় যেসব মেয়েরা, এ তাদেরই একজন। কেলটনের লোকরাই এদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়।
থামল না জিম, সোজা গিয়ে দাঁড়াল লোকটার পেছনে। কাঁধে হাত রাখল।
প্রায় লাফিয়ে উঠল ম্যাক স্টিচ। ভাব দেখে মনে হলো ওর কাঁধে গরম একটা ব্র্যাণ্ডিং আয়রন চেপে ধরেছে কেউ। খোঁচা-খোঁচা দাড়িভরা চেহারা ফিরিয়ে জিমকে দেখল সে। কে কাঁধে হাত রেখেছে সেটা বুঝে চেহারায় কঠোরতার ছাপ পড়ল। চুলের ভেতর আঙুল চালাল সে। অজান্তেই ঊরুর দিকে নামতে শুরু করল একটা হাত। মনে নেই যে গানবেল্ট ওপরতলায় রেখে এসেছে। পিস্তলটা নেই বুঝতেই চেহারায় কয়েক রকমের অনুভূতির ছাপ পড়ল। ভয়, আক্রোশ, ঘৃণা, বিরক্তি।
‘কী চাও?’ আক্রমণাত্মক একটা ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল সে।
‘ছোট্ট একটা প্রশ্নের উত্তর চাই, স্টিচ। বলতে পারো এই মুহূর্তে বার্ড কেলটনকে আমি কোথায় পাব?’
দেখা মাত্র ওকে গুলি করে এখানেই শেষ করে দেয়া হবে না বুঝে স্বস্তিটুকু গোপনের সাধ্যাতীত অসফল চেষ্টা করল স্টিচ। কর্কশ কণ্ঠে হাসল। বাতাসে হাতের ঝাপটা দিল।
‘আমি জানব কোত্থেকে!’
‘তোমার জায়গায় আমি থাকলে মনে করার চেষ্টা করতাম,’ মৃদু শান্ত স্বরে জানাল জিম।
মহিলা এধরনের পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছে, স্টিচের দিকে একবার মুখ তুলে তাকালও না সে, চুপচাপ নাস্তা খাচ্ছে।
‘নিজের জমি ছাড়িয়ে এসেছ তুমি,’ ট্যাড়া স্বরে বলল স্টিচ। ‘ভাল চাইলে কেটে পড়ো। ছেলেরা কিন্তু একটু পরেই নিচে নামবে।’
‘ঝুঁকিটা নেব আমি,’ শান্ত স্বরে জানাল জিম। ‘আমার ধারণা মেয়েলোক নিয়ে ফুর্তি করার সময় কাউকে সঙ্গী করো না তুমি। এবার কাজের কথায় আসা যাক। এখনও কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি।’
‘জাহান্নামে যাও!’ খেঁকিয়ে উঠল স্টিচ। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।
টেবিল থেকে আধখালি বোতলটা তুলে নিয়ে গায়ের জোরে ওটা স্টিচের মাথার তালুতে নামিয়ে আনল জিম। ঝনঝন করে বোতলটা ভেঙে গেল। চোখ বন্ধ করল স্টিচ। জ্ঞান যাতে না হারায় সেজন্যে মাথা দোলাল পাগলের মত। চোখ জ্বলছে মদ লেগে। শার্টের হাতায় মুখটা মুছল সে। গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বুনো জন্তুর মত একটা চাপা গর্জন। দু’হাতে টেবিলটা ধরে ছুঁড়ে ঘরের কোনায় ফেলে দিল জিম, চাপা স্বরে মহিলার উদ্দেশে বলল, ‘সামনে থেকে সরো।’
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে জ্যাকের কাউন্টারের কাছে চলে গেল মহিলা। কফির কাপটা নিতে ভোলেনি। চেহারা একেবারেই নির্বিকার। কার কী হলো তাতে তার পেশায় কোন বাজে প্রভাব পড়বে না।
স্টিচের দিকে মনোযোগ দিল জিম।
‘ওঠ!’ খেঁকিয়ে উঠল ও। ‘তুই মরিস কি লেটন মরে তাতে এখন আর আমার কিছু যায় আসে না।’
স্টিচের নাকে গায়ের জোরে ঘুসি বসাল জিম। আওয়াজটা শুনে মনে হলো বাছুরের কপালের শক্ত হাড়ে প্রচণ্ড জোরে কুঠারের কোপ মারা হয়েছে।
দীর্ঘদেহী লোক স্টিচ। ঘুসির আঘাতে চেয়ার উল্টে মাটিতে পড়ে গেল সে। সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগল বেশ। টলছে সে। ফাটা নাক থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে। নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ হলো। এক ঝলক তাজা রক্ত বের হলো নাকের ফুটোগুলো দিয়ে। শার্টের হাতায় নাক মুছে রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে। কঠোর লোক, দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিচু শান্ত স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘অস্ত্রটা যদি ব্যবহার করার ইচ্ছে থাকে তো সে চেষ্টাই করো। তোমাকে আমি খালি হাতে দু’টুকরো করে ফেলব।’
পনির কাটা ছুরি হাতে দৌড়ে এল জ্যাক, দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘এখানে না! অন্যখানে বিবাদ করো গিয়ে। বেরোও তোমরা! বাইরে! বাইরে!’
স্টিচ বা জিম, দু’জনের কেউই জ্যাকের কথায় কর্ণপাত করল না। মহিলা দূর থেকে এক মুহূর্ত জ্যাককে দেখল, তারপর তার দৃষ্টি স্থির হলো স্টিচের ওপর।
শিকার সামনে পাওয়া চিতাবাঘের মত জিমের দিকে ছুটে এল ম্যাক স্টিচ। শেষ সময়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দু’জনের মাঝখান থেকে সরে গেল জ্যাক।
নিশ্চিন্ত চেহারায় কফি কাপে চুমুক দিল পতিতা। লড়াইরত লোক দু’জনের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যেও দৃষ্টি সরছে না। চেহারা দেখে মনে হলো উপভোগ করছে, যেন তাকে পাওয়ার অধিকারের জন্যেই লড়ছে দু’জন পুরুষ।