বারো
শহরের শেষ প্রান্তে একটা ছোট সাদা রঙের বাড়িতে থাকে ডাক্তার বেনসন। বাড়িটার পেছনে বড় একটা বার্ন আছে, সেখানে রাখা হয় ডাক্তারের বাগি, ঘোড়া এবং দুধেল গাইটাকে। কিচেনের দরজা আর বার্নের মাঝখানে আছে একটা ছাউনি। ওখানে গরুর দুধ দোয়ায় ডাক্তার।
একটা পাতাল ঘর আছে ছাউনির মেঝের নিচে, সেখানে দুধ রাখা হয় যাতে ঠাণ্ডা থাকে। এখন সেই পাতাল ঘরে একটা চৌকি ফেলা হয়েছে। চৌকির পাশে একটা চেয়ার। সারাদিন চৌকিতে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে আস্তে আস্তে সেরে উঠছে জিম কার্সন। ওকে যখন লিণ্ডা পাহাড় থেকে নিয়ে এল তারপর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্থির হয়েছে জিমকে এখানেই রাখা হবে।
কেলটনের লোকরা এখনও জিমকে খুঁজছে। শহর দখল করে নিয়েছিল তারা, পরে সরে গেছে। জানত জিম আহত, কাজেই অস্ত্র হাতে তাকে বারবার খোঁজা হয়েছে। ডাক্তারের বাড়িতে দু’বার হানা দিয়েছে তারা। জিম চায়নি এখানে থেকে ডাক্তারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে, কিন্তু ডাক্তার ওর কোন কথা শুনতে রাজি হয়নি। ডাক্তারের এক কথা, রুগীকে চোখের সামনে রাখতে চাই, যাই ঘটুক না তাতে। দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে জিমের ক্ষত, কিন্তু রক্তক্ষরণের কারণে এখনও অত্যন্ত দুর্বল বোধ করছে ও। তাছাড়া ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি।
অনেক তর্কের পর জিমকে মেনে নিতে হয়েছে যে দিনের বেলাটা ও সেলারে থাকবে। রাতের কথা আলাদা। ডাক্তারের বিধিনিষেধ কোন কাজে আসেনি। তার ভ্রূ কুঁচকানো বৃথা গেছে। রাতে জিম নিজের দায়িত্বে বেরিয়ে পড়ে, ঘুরে বেড়ায় শহরের অলিতে গলিতে।
মিসেস বেনসনের সঙ্গে রয়ে গেছে লিণ্ডা, এখনও ওর ধারণা নিজে দেখাশোনা না করলে অযত্ন হবে জিমের। অন্য র্যাঞ্চারদের কাছ থেকে খবর আনার দায়িত্বও পালন করছে লিণ্ডা। ও কাজে ব্যস্ত থাকুক সেটাই চায় জিম তাতে মানুষ খুন করেছে সেটা ভুলে থাকা ওর পক্ষে সহজ হবে।
নিরাপত্তার খাতিরে ছয়টা র্যাঞ্চ থেকে সমস্ত মহিলাদের শহরে সরিয়ে আনা হয়েছে। যারা র্যাঞ্চ আর শহরে যাতায়াত করছে তারা এখন প্রত্যেকেই সশস্ত্র।
খোলা জমি থেকে যতটা পারা যায় গরু সরিয়ে সবার গরু একসঙ্গে চরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে কম লোকের পক্ষে ওগুলো খেয়াল করে রাখা সম্ভব হবে। শহরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে নতুন ভিজিলেন্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক সদস্য ডেপুটি শেরিফ হিসেবে বস্কেট-এর অধীনে শপথ নিয়েছে। কস্টিগ্যানের মৃত্যুর পর বস্কেটই নিয়েছে শেরিফের দায়িত্ব।
গোটা এলাকায় বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। সবাই অপেক্ষা ব্ৰছে এরপর কেলটন কী করে তা দেখার জন্যে’। চালাক লোক সে। ভাইয়ের মৃত্যু এবং নিজের একজন লোক ফাঁসিতে ঝুলবে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এতই খেপে গেছে যে থামবে না সে কিছুতেই, যেভাবেই হোক একটা শো-ডাউন চাইবে সে।
এক রাতে ডাক্তার যখন নতুন করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে তখন আলাপের এক পর্যায়ে জিম বলল, ‘কেলটন এখন জানে যে ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়েছি আমরা। ওর চুরি ধরা পড়ে গেছে। হয় লড়তে হবে ওকে, নয়তো পালাতে হবে। পালাচ্ছে না কারণ অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সে। নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা আছে তার। ওগুলো বাস্তবায়িত করতে পারলে এই এলাকা ওর দখলে চলে যাবে।’
‘পালানোর লোক নয়, কেলটন,’ চিন্তিত স্বরে বলল ডাক্তার। ‘বেপরোয়া মানুষ। আমার তো ধারণা শুধু টাকার জন্যে রাসলিং করছে না সে। ক্ষমতা চাই তার। ক্ষমতা অর্জনের জন্যে দরকার হলে রক্তের নদী বইয়ে দেবে। নিজেকে ধ্বংস করতেও বাধবে না। তার ওপর ওর ভাই মারা গেছে। কেলটনকে যতটুকু চিনি তাতে পাগলা কুকুর হয়ে গেছে ও। হয় সব ধ্বংস করে দেবে, নয়তো নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
জানার কোন উপায় নেই কতজন লোক যোগাড় করেছে কেলটন। পাহাড়ে আইন-না-মানা লোকের কোন অভাব নেই। শহরের বাসিন্দাদের খেদিয়ে বীভার টাউন দখল করে নেয়ার সুযোগ ঘটলে খুশি মনে তারা যোগ দেবে কেলটনের সঙ্গে। শুধু যে তারা আর্থিক ভাবে লাভবান হবে তা নয়, শহরে কর্তৃত্ব করতে পারাটা বিরাট একটা বিজয় হিসেবে দেখবে লোকগুলো।
সেলারে জিমের তৃতীয় দিনে এল বার্ট উডফোর্ড। সামান্য যেকজনকে নিজের আস্তানার খবর দিতে লিণ্ডাকে বলেছে জিম, বার্ট তাদের মধ্যে একজন।
ভেজা ভেজা সেলারের ভেতরে মুখোমুখি বসল ওরা। লণ্ঠনের কাঁপা কাঁপা মৃদু আলোয় ভুতুড়ে লাগছে পরিবেশটা। জিমকে নতুন খবর শোনাচ্ছে বার্ট।
‘লুথার কোল পাহাড়ে গিয়ে শর্টি আর তোমার দেখা গরুর পাল খুঁজে পেয়েছে। দুপুরে আমাদের র্যাঞ্চে এসেছিল। বলল বাছুরগুলো আছে, কিন্তু গাভী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘গাভীগুলো আমাদের কিনা সেটা আমি পরীক্ষা করে দেখিনি,’ জানাল জিম। ‘হতে পারে ওগুলোও আমাদের।’
‘হতে পারে। বাছুর যে আমাদের সেটা লুথার পরখ করে দেখেছে, কোন সন্দেহ নেই আর
‘ওগুলো ফেরত আনতে হবে। আমার ধারণা লড়াই বাধবে সেক্ষেত্রে। কেলটনকে আগে কোণঠাসা করতে হবে। আশা করি বাছুরের কাছাকাছিই থাকবে সে। এন সে জানে ধরা পড়ে গেছে।’
লুথারও এ ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে বলল। পাইনটপে থেমেছিল ও, সেখানে কেলটনের এক লোকের সঙ্গে কথা হয়। এক সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করেছিল ওরা। লোকটা মাতাল হয়ে মুখ ছুটিয়ে দেয়। কেলটন র্যাঞ্চে নেই। লড়াইতে সামান্য আহত হয়েছে। ডুরাণ্টে গেছে চিকিৎসার জন্যে।’
‘ও মরলে ভাল হত। ঝামেলা মিটে যেত।’
‘লুথার বলল কেলটন তার লোকদের ছড়িয়ে পড়তে বলেছে। ফিরে আসার পর তাদের ডাকা হবে।’ একটু থামল বার্ট, তারপর বলল, ‘তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারবে না, জিম। কিন্তু আমরা পারি। আমাদের উচিত দল বেঁধে গিয়ে বাছুরগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করা। এব্যাপারে আমাদের মধ্যে আলাপও হয়েছে। সবাই রাজি।’
‘আমিও এমন একটা কিছুই করার কথা ভাবছিলাম,’ বলল জিম। ‘তবে আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। ঘোড়া চালানোর জন্যে একটা হাতই যথেষ্ট। অস্ত্র চালাতেও অসুবিধে হবে না।’
‘লিণ্ডা বলল তোমার যাওয়া চলবে না। ‘
‘জীবনে আর এমন সুযোগ না-ও আসতে পারে। যাচ্ছি আমি। খবরটা ছড়িয়ে দাও। পাইনটপে সবার সঙ্গে দেখা করব আমি।’ একটা সিগারেট ধরাল চিন্তিত জিম, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘শর্টির কাছ থেকে কোন খবর পেলে?
‘না। শেষ দেখেছি যেরাতে লিণ্ডা তোমাকে নিয়ে বনের দিকে গেল। কেলটনের লোকদের অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর থেকে শর্টির আর কোন খোঁজ জানি না। খুব ঝুঁকি নিয়েছিল শর্টি। কেলটনকে খুব কাছে আসতে দিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। হয়তো ধরা পড়ে গেছে।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ দ্বিমত পোষণ করল জিম। ‘সহজে মরার বান্দা না শর্টি। আশপাশেই কোথাও আছে ও। ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ঠিক সময়ে বান্দা হাজির হয়ে যাবে।’
‘একবারও তোমার মনে হয়নি কাজটা বেশি শক্ত ঠেকায় চলে যেতে পারে সে?’
‘কে? শর্টি?’ হাসল জিম। ‘পালানোর লোক নয় সে। কাজ যত কঠিন হবে শর্টি তত মজা পাবে। সারাক্ষণ বকবক করে বিরক্ত করে মারবে ও, কিন্তু বিপদের মুখে কাউকে ফেলে পালাবে না।’, বার্ট উঠে দাঁড়াতে বলল, রওনা হয়ে যাও। ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে আমিও রওনা দেব। দেখা হবে পাইনটপে।’
কারও চোখে পড়ে যেতে পারে ভেবে জিমের নিজের ঘোড়াটা ডাক্তারের বাড়িতে রাখা হয়নি। বার্ট চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বার্নে এল জিম, পুরোপুরি সশস্ত্র। ডাক্তারের একটা ঘোড়ায় স্যাডল চাপিয়ে বার্ন থেকে বের করে আনছে এমন সময়ে ধরা পড়ে গেল লিণ্ডার কাছে।
‘জিম!’ রাগের কারণে চাপা শোনাল লিণ্ডার গলা। ‘কোথায় যাচ্ছ! একী! যাও, বিছানায় শুয়ে পড়ো।’
লিণ্ডা সচেতন নয় কতটা অধিকার নিয়ে কথা বলছে। জিম অন্তরে অনুভব করল লিণ্ডার দুশ্চিন্তা। ভাল লাগল ওর। মনটা ভরে গেল কেউ একজন ওর কথা ভাবে জেনে।
‘দুঃখিত, লিণ্ডা,’ শান্ত গলায় বলল জিম। ‘যেতে আমাকে হবেই।’ বার্ট এসে কী বলে গেছে সংক্ষেপে জানাল ও, তারপর বলল, ‘গরু উদ্ধার করার এটা একটা বিরাট সুযোগ।’
‘কিন্তু যাওয়া চলবে না তোমার,’ জোর দিয়ে বলল লিণ্ডা, ‘এখনও তুমি সুস্থ হয়ে ওঠোনি।’
দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জিম। অন্ধকারে ওর পাশে চলে এল লিণ্ডা।
‘আমি জানি লড়াই তুমি কতটা ঘৃণা করো,’ নরম গলায় বলল জিম। ‘আমিও লড়তে চাই না। কিন্তু আমাদের সামনে আর কোন উপায় নেই। কখনও কখনও মানুষকে এমন কাজ করতে হয় যেটা সে করতে পছন্দ করে না। না গিয়ে কোন উপায় নেই আমার। আমি দুঃখিত, লিণ্ডা, কিন্তু তোমার অনুরোধ আমি রাখতে পারব না।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল লিণ্ডা, তারপর নিচু স্বরে থেমে থেমে বলল, ‘আমার ভুল ভেঙেছে, জিম। জানি যা তোমাকে করতে হবে, সেটা না করে কোন উপায় নেই তোমার।’
অন্ধকারে মেয়েটার মুখ দেখতে চেষ্টা করল জিম, দেখতে পেল না কোন্ অনুভূতির খেলা চলছে ওখানে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লিণ্ডার চেহারা।
জিজ্ঞেস করল বিস্মিত জিম, ‘তা হলে কি আমি ধরে নেব তোমার মতবাদ পাল্টে গেছে?’
জিমের বাহুতে হাত রাখল লিণ্ডা। ‘হ্যাঁ। এখন আমি জানি লোকটাকে খুন করার পর তুমি যা বলেছিলে সেটাই সত্যি। আর কিছু করার ছিল না আমার, তাই না?’
‘হ্যাঁ। কিছুই করার ছিল না তোমার। যা করেছ তা যদি না করতে তা হলে মারা যেতাম আমি। তুমি অপমানিত হতে। জেনে ভাল লাগছে যে পরিস্থিতি কেমন তা বুঝতে পারছ তুমি।’
‘তা হলে আমার কথা রাখো, জিম। আমি চাই না এই দুর্বল শরীরে বাইরে যাও তুমি। ঘোড়ায় চড়ার তুলনায় তুমি এখনও অনেক অসুস্থ।’
‘আমি দুঃখিত, আন্তরিক গলায় বলল জিম, ‘কিন্তু এই একবার নার্সের কথা অমান্য করতেই হবে আমাকে। চিন্তা কোরো না, আমি সতর্ক থাকব। তাছাড়া শয়তান লোক সহজে মরে না। আমি মরব না।’
ঘোড়ায় উঠল ও এক হাতের জোরে, তারপর শেষ বারের মত লিণ্ডাকে দেখে নিয়ে আস্তে করে ঘোড়াটাকে সামনে বাড়াল। রাস্তায় ওঠার পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপ করে ওকে দেখছে লিণ্ডা।
গুহায় যখন ছিল তখনকার অনুভূতিগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছে লিণ্ডা, চোখে টলটল করছে অশ্রু। অনুভব করছে জিমের জন্যে দুশ্চিন্তা ঠেকাতে পারছে না ও। ভাবতেই ভাল লাগে ওই মানুষটা শুধু তার। ভাল লাগার মানুষটা মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছে। বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক চিরে।
.
বার্ট গেছে লোক সংগ্রহে। ধীরে ধীরে পাইনটপের দিকে এগিয়ে চলল জিম, চেষ্টা করছে যতটা পারে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে। মাঝরাতে পাইনটপের এক মাইল আগে পৌঁছে থামল ও। অন্যান্যরা আসার আগে পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করল।
লুথার কোল আর টয় ল্যানি একই সঙ্গে এল। একটু পর এল বুড়ো জে বি উডফোর্ড। তৈরি হয়ে এসেছে। ঊরুতে ঝুলছে দুটো সিক্সগান, স্যাডল বুটে রাইফেল। তার পর এল প্যাট ম্যালোন। চমৎকার একটা নীল সার্জের সুট তার পরনে, নিচে সাদা শার্ট। মাথায় ডার্বি হ্যাট। ঠোঁটে ঝুলছে মোটা একটা সিগার। ভাব দেখে মনে হলো সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছে।
‘তুমি এখানে, প্যাট!’ বিস্মিত বোধ করল জিম। ‘তোমার তো শহরে থাকার কথা।’
হাসল সেলুনকীপার। ‘সারাদিন একজায়গায় বসে থাকা কতটা বিরক্তিকর সেটা তুমি বুঝবে না। মাঝে মাঝে তাজা বাতাস দরকার। সেজন্যেই এসেছি।’
তার স্যাডল বুটের ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে একটা হরিণ মারার রাইফেল। শোল্ডার হোলস্টারে ঝুলছে সিক্সগান।
‘জানতাম না তুমি পিস্তলবাজ,’ হাসল জিম। ‘দেখে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় পাকা দোকানী। আগে যদি জানতাম সর্বক্ষণ বুকের কাছে পিস্তল নিয়ে বসে আছো তা হলে ভুলেও তোমার সেলুনে মদ খেতাম না।’
‘পিস্তলবাজ নই আমি। এই অস্ত্রটা এক পিস্তলবাজের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম এক পোকার গেমে। ওই লোকেরও ধারণা ছিল ঊরু থেকে নিচে পিস্তল ঝোলানো দরকার। চমৎকার ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল।’
‘তারপরও আমি বলব আমাদের সঙ্গে আসা তোমার উচিত হয়নি। নিজের খদ্দের খুন করবে নাকি তুমি? এটা তো ভাল ব্যবসায়িক বুদ্ধি হলো না।’
‘আর বলো কেন সেকথা!’ কাঁধ ঝাঁকাল ম্যালোন। ‘কেলটনের লোকরা এখন আর আমার সেলুনে আসে না। কস্টিগ্যানকে খুন করে সেলুনে ঢুকেছিল ওদের বেশ কয়েকজন। জোর করে সেলুন দখল করে নেয়। আমার সংগ্রহ করা সেরা মদ গিলেছে ওরা। অন্তত পঞ্চাশ ডলার ধসিয়ে দিয়েছে। দাম চেয়েছিলাম। কর্কশ হাসি হেসে বলল, যদি না দেয় তো কী করব আমি। চিন্তা করো, একজন আইরিশম্যানের জন্যে এটা কত বড় অপমান!’ ট্রিগার গার্ডে আঙুল ঢুকিয়ে পিস্তলটা চরকির মত ঘোরাল ম্যালোন। ‘সেজন্যেই এসেছি। দু’চারটার পাছা ফুটো করে দেব, যাতে আমার মদ ওদের দেহে না থাকে।’
‘নিজ দায়িত্বে পথ চলতে হবে তোমাকে,’ বলল জিম। ‘আসতে চাইলে আসতে পারো, বাধা দেব না। কিন্তু ঝুঁকিটা তুমি না নিলেও পারতে।’
বার্ট উডফোর্ড উপস্থিত হলো কয়েকটা র্যাঞ্চ থেকে সংগ্রহ করা আট-দশজন কাউবয় নিয়ে।
এবার এগোল ওরা পাইনটপের দিকে। আগে আগে চলেছে জিম আর লুথার কোল। ক্রমেই খাড়া হচ্ছে ট্রেইল। চাঁদের আলো অতিপ্রাকৃতিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শর্টির সঙ্গে যে টিলায় ঝর্নার পাশে দেখা হয়েছিল সেই একই ট্রেইলে আছে ওরা এখন।
লুথার কোলের চেনা থাকায় গরুগুলোকে খুঁজে বের করতে কোন অসুবিধে হলো না ওদের।
গরু জড়ো করতে শুরু করল ওরা। ‘কীভাবে এগুলো এখানে এল সেব্যাপারে কিছু জানো?’ কোলকে জিজ্ঞেস করল জিম।
‘ব্যাক ট্র্যাক করে প্রেয়ারি পর্যন্ত গিয়েছিলাম,’ জবাবে জানাল কোল। ‘ওখানে একটা প্রাচীন লগিং ট্রেইল আছে। ওদিক দিয়েই গরু আনা হয়েছে। আমরা যে নিয়ে যাব তখনও ওই পথই ব্যবহার করব।’
‘তা হলে এবার রওনা হওয়া যায়,’ কাউবয়দের উদ্দেশে গলা উঁচাল জিম। গরুগুলোকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়েছে তারা। যাত্রার জন্যে প্রস্তুত।
‘রাস্তাটা আমি চিনি,’ বলল কোল। ‘তুমি চাইলে আমি আগে আগে থাকতে পারি।’
দু’পাশে পাথরের খণ্ড এমন একটা সরু খাদের ভেতর ওদের নিয়ে এল কোল। গরু পার করানো হলো খাদের ভেতর দিয়ে। বার্ট, ল্যানি আছে দু’পাশে। পেছনে বুড়ো জে বি উডফোর্ড আর কাউবয়রা। গরু সামলাতে কোন অসুবিধে হলো না।
কোন ঝামেলা না করে এগোচ্ছে বাছুরগুলো। তাড়া দেয়া হচ্ছে না, ফলে জন্তুগুলোর ভেতর কোন অস্থিরতা নেই। মাঝে মাঝে ডাকছে তারা, আর আছে পাথুরে জমিতে খুরের আওয়াজ-এছাড়া চারপাশ নীরব।
গামলা আকৃতির একটা ঘাসজমি পার হয়ে বনের ভেতর ঢুকল ওরা। অন্ধকার যেন মুড়ে নিল ওদেরকে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কাউবয়দের গলা। ম্যাচের আগুন দেখা যাচ্ছে। সিগারেট ধরাচ্ছে কেউ কেউ।
‘ঝামেলা তো হলো না,’ বলল জে বি উডফোর্ড। ‘কিছু গরুও ফেরত পেলাম।
‘এখনও বন পেরিয়ে যেতে পারিনি আমরা,’ মনে করিয়ে দিল জিম। ‘মনের ভেতর খচখচ করছে। এত সহজ হওয়ার কথা নয় কাজটা।’
‘কী ভাবছ তা হলে?’ জিজ্ঞেস করল বুড়ো। ‘মনে করছ এটা একটা ফাঁদ?’
‘জানি না। তবে মন বলছে এত সহজে গরু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারার কথা নয় আমাদের। বড় বেশি সোজা লাগছে না? আমার ধারণা সামনে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।’
ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল উডফোর্ড, কিন্তু হাসিটা ফাঁপা শোনাল।
দীর্ঘ নীরবতা নামল সবার মাঝে। গরুগুলো পাহাড়ী পথ বেয়ে ধীরে ধীরে নামছে। লগিং ট্রেইলে পৌছে গেল। দু’পাশে সুউচ্চ গাছের সারি। মাথার ওপর পাতার আচ্ছাদন। বেশির ভাগ জায়গাতেই সেই ছাদ ভেদ করে চাঁদের আলো আসে না। মাঝে মাঝে গাছের পাতা কম ঘন হলে সেখানে দেখা যাচ্ছে রুপোলি আলো।
একটা অগভীর ঝর্না পার হতে হবে ওদের। সেটার পাড়ে গরুগুলোর গতি কমাল ওরা, যাতে জন্তুগুলো তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতে পারে। চারপাশে আগের মত পাহাড় নেই। বেশ একটা খোলামেলা জায়গা এটা। রাস্তার ধারে একটা পড়ো কেবিন। গরুগুলো পানি খাওয়ার পর আবার রওনা হলো ওরা।
ম্যাচ জ্বেলে একটা সিগারেট ধরাল জিম, আগুনের আলোয় ঘড়ির দিকে তাকাল।
‘ভোর হতে এখনও এক ঘণ্টা বাকি,’ বলল ও। ‘এই জায়গাটা পার হয়ে যেতে পারলে অস্বস্তি দূর হবে।’
‘এখনও মন থেকে আশঙ্কা ঝেড়ে ফেলতে পারোনি?’ মৃদু হাসল জে বি উডফোর্ড।
‘অস্বস্তি হচ্ছে,’ স্বীকার করল জিম।
‘তুমি ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়ছ না, বন্ধুদের মাঝে আছো।’
মেরুদণ্ডের কাছে শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে জিমের। মনের ভেতর কে যেন সতর্ক করে দিচ্ছে। ভ্রূ কুঁচকাল জিম। বিরক্ত হয়ে ভাবল, হয়তো শারীরিক দুর্বলতার কারণেই এমন মনে হচ্ছে।
‘সামনে, এই যে, সমস্যা কী?’ মাথা ঘুরছে জিমের, সেজন্যেই হয়তো গরুগুলো এগোচ্ছে কিনা নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করল। ‘কী হলো, লুথার? এগোচ্ছ না কেন?’
‘লাইনে রাখার চেষ্টা করছি।’
‘থামলে কেন?’
কোন জবাব এল না সামনে থেকে। চট করে সতর্ক হয়ে উঠল জিম, ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাল।
গাছের কারণে বাছুরগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কাউবয়রা ছড়িয়ে আছে। এখনও গরুগুলোকে লাইনে এনে সামনে বাড়াতে শুরু করেনি। স্টিরাপে উঠে দাঁড়াল জিম। উত্তেজনায় গলা কেঁপে গেল। ‘বার্ট! এগোও। দেখো লুথার থামল কেন।’
ওর পাশে চলে এল বুড়ো উডফোর্ড।
‘আশ্চর্য তো!’ জিমের উদ্বেগ তাকেও পেয়ে বসেছে। ‘ব্যাপার কী? এসো তো, জিম!’
গরুগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগোল সে। বার্টের গলা শুনতে পেল জিম। ‘লুথার! কোথায় তুমি? কী হলো!’
মানুষগুলোকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে গরুগুলো অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে।
এক টানে খাপ থেকে রাইফেলটা বের করে নিল জে বি উডফোর্ড। বিড়বিড় করে বলল, ‘ব্যাপার আমার পছন্দ হচ্ছে না।’
গাছের ভেতর ছোট ছোট কালো ছায়া সরে যেতে দেখল জিম। বামদিক থেকে ভেসে এল ঘড়ঘড়ে একটা কণ্ঠ। জিমের স্নায়ু বেহালার তারের মত টানটান হয়ে গেল, শিরদাঁড়ায় অনুভব করল শিরশিরে অনুভূতি।
‘ঝামেলা!’ বলেই পিস্তল বের করল ও।
‘হ্যাঁ,’ সায় দিল উডফোর্ড। ‘ছেলেরা তৈরি হও!’
কে যেন টের পেল সামনে অন্য কেউ আছে। তার দলের লোক নয়। বিশৃঙ্খল একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো। সবাই প্রশ্ন ছুঁড়ছে।
পরমুহূর্তেই রাতের প্রশান্তি ছিঁড়েখুঁড়ে দিল রাইফেলের তীক্ষ্ণ হুঙ্কার। বনের প্রান্তে দেখা গেল কমলা রঙের অগ্নি ঝিলিক। সে আলোয় আবছা ভাবে পরিস্ফুট হলো হামলাকারী লোকগুলো।
‘ফাঁদ!’ চেঁচিয়ে উঠল উডফোর্ড। ‘ফাঁদ! ঘিরে ফেলেছে আমাদের!’