মৃত্যু উপত্যকা – ১

এক

মানুষের মন মেজাজের মতই প্রতিটা শহরেরও নিজস্ব একটা মেজাজ থাকে। মানুষের আনন্দ, ক্রোধ, সন্দেহ, প্রতিশোধ-সব মিলিয়ে একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

আজ বুধবার বীভার শহরের ভিজিলেন্স কমিটি একজন লোকের বিচারের ব্যবস্থা করছে। বোধহয় ফাঁসি হবে লোকটার। প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে তার। তারা কেউই সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বন্ধুর চারিত্রিক মাহাত্ম্য প্রচার করবে না, কিন্তু তারা ওই লোকের মতই, অন্ধকারের বাসিন্দা-আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অভ্যস্ত। পাহাড়ী মানুষ তারা। কঠোর, রুক্ষ, কঠিন।

সেকারণেই আজ বীভার টাউনে অনিশ্চয়তা।

ইণ্ডিয়ান এলাকায় এই বীভার টাউন গড়ে উঠেছে দুঃসাহসী কিছু লোকের ঐকান্তিক চেষ্টায়। আইনের আওতার বাইরে শহরের অবস্থান। সেজন্যে নিজেরাই তারা অস্ত্রের আইন তৈরি করেছে। ভিজিলেন্স কমিটির কোন আইনগত ভিত্তি নেই কোথাও। মানুষ এখানে জমির দখল বজায় রাখতে পারলেই মালিক হিসেবে বিবেচিত হয়, ঠিক তেমনি, দুর্দমনীয় পশ্চিম অভিযাত্রীরা অস্ত্রের জোরে আইন রক্ষায় ভিজিলেন্স কমিটি গড়ে তুলেছে। যারা একেবারে আইন মানতে রাজি নয়, তাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যেই এই আয়োজন।

ছোট একটা র‍্যাঞ্চিং শহর এই বীভার, পাহাড়ের পাদদেশে। ওই পাহাড়েই বাস করে বন্দির ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব। শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের বনিবনা নেই। যারা ব্যবসা করে বা র‍্যাঞ্চিং করে, তাদের প্রতি এই বিশেষ শ্রেণীটির আছে স্রেফ অবজ্ঞা।

প্রতিনিয়ত এই সমস্যার মাঝ দিয়ে দিন পার হয় জিম কার্সনের মত লোকদের। আইন নেই তাদের সমস্যার সমাধান করার জন্যে। কোন সরকার নেই যে নিরাপত্তা দেবে। কিছুদিন আগে মাত্র শেষ হয়েছে গৃহযুদ্ধ। আউট-লদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তবু পশ্চিমে টিকে আছে মানুষ।

আজ লেভি ফক্সের বিচারের দ্বিতীয় দিন। শহরে থমথমে একটা পরিবেশ। একটা বাছুর চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে লেভি ফক্স। এক ডলার দিলে অমন একটা বাছুরের মালিক হতে পারত সে।

র‍্যাঞ্চ থেকে এসে প্রধান সড়ক দিয়ে শহরে ঢোকার সময় পরিবেশটা আঁচ করে নিল জিম কার্সন। স্টেবলে ঘোড়া রেখে মালিক ল্যাংড়া পেগ জেসনকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিচার কেমন চলছে? জুরি ঠিক হয়েছে?’

যুদ্ধে হারানো পায়ের হাঁটুর কাছটা চুলকাল পেগ, তিক্ত চেহারা। বলল, ‘ওরা লেভিকে ভয় পাচ্ছে, নইলে কালকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিত।’

‘লেভিকে ভয় পাচ্ছে?’ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল জিম। ‘লেভি ফক্সকে?’

‘ওই হলো। বার্ড কেলটনকে ভয় পাচ্ছে। কেলটনের পাহাড়ী স্যাঙাতরা ‘শহরে এসে অপেক্ষা করছে, যেমন করে গরু মরার অপেক্ষায় বসে থাকে শকুনের দল।’

‘আগেও চোরদের মরতে দেখেছে ওরা,’ শুকনো স্বরে মন্তব্য করল জিম। ‘তবে তারা কেউ বার্ড কেলটনের লোক ছিল না।’

‘ঘোড়াটাকে দলাইমলাই করে খাওয়া দিয়ো, আমি চললাম।’ স্টেবলের ছায়াময় শীতলতা থেকে বেরিয়ে এল জিম, ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল স্টোর লক্ষ করে। স্টোরের ছাউনির তলায় গিয়ে দাঁড়াল ও, একটা সিগারেট ধরিয়ে আরও ভাল করে অনুভব করার চেষ্টা করল শহরের পরিবেশ। রাস্তায় অলস ভঙ্গিতে চোখ বুলাল, কিছুই ওর নজর এড়াচ্ছে না। ছোট ছোট ব্যাপারগুলো ওকে বলে দিল অবস্থা কেমন।

হার্ডওয়্যার স্টোরের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো ওর। ওটার দোতলায় বিচারের আয়োজন করা হয়েছে। বাড়িটার কোণে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো সিকামোর গাছের তলায় অপেক্ষা করছে পাঁচ ছয়জন পাহাড়ী লোক। কঠোর চেহারা। গম্ভীর। চারপাশে নজর চালাচ্ছে তারা। বিচার দেখতে আসা শহুরে লোকদের দিকে অবহেলা নিয়ে তাকাচ্ছে। সিগারেট টানছে আর অপেক্ষা করছে। নিজেদের মাঝে কথা বলছে নিচু চাপা স্বরে। ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, নজর রাখতেই তাদের পাঠানো হয়েছে।

রাস্তার দু’ধারে দোকান আর সেলুনগুলোর সামনে বেঞ্চে বসে রয়েছে কিছু লোক। তাদের কেউ কেউ পাহাড়ী, আবার শহরের লোকও রয়েছে কিছু। জ্যাকফর্ক পাহাড়ের পাদদেশের ছোট র‍্যাঞ্চার আর কাউহ্যাণ্ডরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে।

একটু পরেই জুরিরা তাদের মতামত জানাবে।

থমথমে একটা পরিবেশ। টানটান উত্তেজনা। যেকোন মুহূর্তে ঘটবে বিস্ফোরণ।

র‍্যাঞ্চার আর কাউহ্যাণ্ডরাও নজর রাখছে চারপাশে। প্রয়োজনে লড়বে।

কয়জন জুরি ঠিক হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। তারা কী মত দেবে তাও নিশ্চিত নয়। কিন্তু বন্দিকে যদি অভিযুক্ত করা হয় তা হলে গোলমাল যে পাকিয়ে উঠবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। জ্যাকফর্ক উপত্যকার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

জিম কার্সনের বয়স আটাশ। লম্বা মানুষ সে, মোটামুটি সুদর্শন। পেটা দেহ। পরনে রেঞ্জের উপযুক্ত পোশাক। জিন্সের প্যান্টটা গুঁজে রেখেছে গোড়ালি ছাড়ানো বুট জুতোর ভেতর। তাকে দেখলে প্রথম পলকেই অলস একটা সিংহ মনে হয়, যদিও কাছ থেকে যারা চেনে তারা জানে যে মোটেই অলস লোক নয় জিম কার্সন।

জিমের কাঁধ দুটো চওড়া, সরু কোমর। শার্টের নিচে শক্তিশালী পেশির আভাস। রোদে পুড়ে গায়ের রং বাদামী। হাসিখুশি মানুষ সে। জীবনটাকে সহজ ভাবে নিতে জানে। তবে বন্ধুরা বলে অত্যন্ত কঠোর এবং সাহসী মানুষ সে। সেজন্যে অনেকে তাকে পছন্দ করে, আবার অনেকে করে ঘৃণা।

জুরিরা বোধহয় আলাপ আলোচনা করছে। সিগারেটটা মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে মাড়িয়ে সেলুনে ঢুকল জিম। ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত উত্তেজিত বোধ করছে। জানে, বারুদে ঠাসা পিপের সঙ্গে লাগানো দড়িতে আগুন জ্বলছে। পিপের খুব কাছেই আছে ও। বিস্ফোরণ ঘটলে রক্ষা পাবে না।

সেলুনের ভেতরে খদ্দের প্রায় নেই বললেই চলে। তিন চারজন গম্ভীর চেহারার লোক টেবিলে বসে ড্রিঙ্ক করছে। নিচু স্বরে নিজেদের মাঝে আলাপ চলছে তাদের। জিমকে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতে দেখে সেলুন মালিক ম্যালোন এগিয়ে এল, হাতের শীতল বীয়ারটা নামিয়ে রাখল জিমের সামনে।

‘শীঘ্রি জুরিরা তাদের ঘোষণা দেবে?’ জিজ্ঞেস করল জিম।

কমবয়সী আইরিশ লোক ম্যালোন, মুখে সর্বক্ষণ লেগে আছে হাসি, চওড়া কপালের ওপর থেকে ব্যাক ব্রাশ করা চুলে রুপোলি ছোপ লেগেছে অসময়ে। আস্তে করে মাথা নাড়ল সে, মৃদু হাসছে। ‘বলো, কারও কিছু করার আছে? আমি যতদূর বুঝি, কেয়ামত পর্যন্ত সময় নিক না ওরা। যে রায়ই দিক, এটা নিশ্চিত যে লাশ পড়বে। যা করার কোর্ট করুক না, তোমরা কেন মাথা গলাচ্ছ! ঠিক আছে, মানলাম লেভি গরু চুরি করেছে, তার মানে কি এই যে সেজন্যে গোটা কাউন্টিকে যুদ্ধে ঠেলে দিতে হবে?’

জিম জানে ম্যালোন ভয় পাচ্ছে না। শান্তিপ্রিয় ব্যবসায়ী সে, চায় না শহরের ওপর ঝঞ্ঝার ঘনঘটা নেমে আসুক।

‘একটা গরু চুরির ব্যাপার নয় এটা, তুমি তো ভাল করেই জানো,’ বলল গম্ভীর জিম। ‘প্রতিবছর র‍্যাঞ্চারদের তিরিশভাগ বাছুর চুরি করে নিচ্ছে ওরা। ওই তিরিশভাগ গরু থাকা বা না থাকার মানে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারা আর না খেতে পেয়ে মরার তফাৎ। ব্যাপারটা একটা গরু নয়, গরুচোরদের বুঝিয়ে দেয়া যে অন্যায় করে কেউ পার পাবে না।’

‘কথা ঠিক,’ স্মিত হাসল ম্যালোন। ‘কিন্তু ভাবতেই ভয় লাগছে যে কী ঘটবে। লেভি তো বার্ড কেলটনের লোক। আর বার্ড কেলটন নিজের লোককে নরক পর্যন্ত সাপোর্ট করে। সে ভাল কাজই করুক আর খারাপ কাজ।’

ভ্রূ কুঁচকাল জিম। ‘ভাল বা খারাপ যা-ই করুক?’

‘বার্ড কেলটনকে ছোঁয়া যায় না। বড় বেশি চতুর। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে অন্যায় কিছু করছে সে।’

‘সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’

‘ওকে না ঘাঁটানো পর্যন্ত ঝামেলা হবে না।’

‘ঝামেলার ভয়ে আমরা তো আর না খেয়ে মরতে পারি না।’ কাঁধ ঝাঁকাল জিম। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘লোক দরকার। শুনলাম এদিকের অবস্থা জেনে নতুন লোক র‍্যাঞ্চে কাজ নিতে উৎসাহী নয়। জানো কিছু?’

‘আমিও তাই জানতাম, কেউ এখানে কাজ নিয়ে মরতে চাইবে না। কিন্তু একটু আগে ঠ্যাং বাঁকা এক বোকা বুড়ো এখানে এসেছিল কাজের খোঁজে।’ জিমের দেয়া কয়েনটা নিয়ে ড্রয়ারে রাখল সে। ‘পরিস্থিতি তো জানে না। আমি তাকে নিরুৎসাহিত করেছি। ব্যাটা বলল এমন পরিস্থিতিই তার পছন্দ।’ দরজার দিকে তাকাল ম্যালোন। ‘ওই যে লোকটা, আবার আসছে।’

সুইং ডোর ঠেলে মাত্র ঢুকেছে লোকটা। উঁচু হিলের বুট পরে থাকার পরও মাত্র ফুট পাঁচেক হবে সে দৈর্ঘ্যে। মাথায় মস্ত একটা হ্যাট, চেহারা প্রায় ঢেকে রেখেছে। পা দুটো এতই বাঁকা যে ছোট একটা কুকুর দু’পায়ের ফাঁক গলে লাফিয়ে চলে যেতে পারবে হাঁটু স্পর্শ না করেই। কান দুটো বিরাট, নাকটা খাড়া। চেহারাটা এমনই যে দেখলে হাসি পায়, যদিও এখন আগন্তুকের নীল চোখে গম্ভীর দৃষ্টি!

‘শর্টি ব্রাউনকে বহুদিন থেকে চেনে জিম। কথা বলে উঠতে যাচ্ছিল ও, কিন্তু শর্টি ব্রাউনের চেহারায় নির্বিকার নিস্পৃহ ভঙ্গি দেখে থেমে গেল। জিমের ভেতর দিয়ে চেয়ে আছে’ শর্টি, ভাব দেখে মনে হলো জীবনে কখনও ওকে দেখেনি আর।

হাত ইশারা করল ম্যালোন। ‘এই যে, শোনো।’ জিমকে দেখাল। ‘এ জিম কার্সন। লোক খুঁজছে।’

জিমের পাশে এসে দাঁড়াল শর্টি। এখনও চেহারায় জিমকে চিনতে পারার কোন ছাপ নেই।

‘মিস্টার,’ বলল সে, ‘তুমি নিশ্চয়ই এমন কাউকে কাজে নেবে না যে কাজ করতে উৎসাহী নয়?’

‘ঠিক কোন্ ধরনের কাজ করতে তুমি উৎসাহী নও?’ শর্টির বহু ব্যবহৃত হোলস্টার আর প্রায় মাটি ছোঁয়া অস্ত্র দেখল জিম। অস্ত্রে শর্টি অত্যন্ত দ্রুত, চোখের পলকে ওটা বের করে নিখুঁত লক্ষ্যে তপ্ত সীসে ছুঁড়তে ওস্তাদ।

বাঁকা পায়ে চাপড় মারল শর্টি। ‘কাজে আমার আপত্তি নেই, যতক্ষণ না মাটিতে নামতে হয়। মাটি আর আমার পা ঠিক খাপ খায় না।’

‘তোমার সাহায্যকারী কোথায়?’ গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল জিম।

‘কীসের সাহায্যকারী?’

‘অস্ত্র বের করার পর ওটার ওজন বহন করে যে, তার কথা বলছি।’

চিন্তিত চেহারা হলো শর্টির। ‘কিছুদিন ধরে লোকের অভাবে আছি।’

‘ঘোড়ায় চড়তে পারো?’

শর্টির গম্ভীর বিষণ্ন চেহারায় আরেকটু হলেই হাসির রেখা ফুটে উঠত। জিমের সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন ওই র‍্যাঞ্চে বুনো ঘোড়া পোষ মানানোর কাজ করত সে। ওর মত ঘোড়ায় চড়তে পশ্চিমে খুব কম মানুষই পারে। জিম সেটা জানে। খেলছে ছোকরা ওরই খেলা।

‘পারি, যদি কেউ ওটাকে স্থির করে ধরে রাখে। তোমার র‍্যাঞ্চে নিশ্চয়ই ঘোড়ায় ওঠার জন্যে মই আছে? মই যেখানে নেই সে র‍্যাঞ্চে কাজ করি না আমি।’

‘এখানে আমরা নতুন। এখনও মই তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। তবে তোমার জন্যে একটার ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত ছেলেরা গাছের ডালে উঠে সেখান থেকে ঘোড়ার পিঠে নামে। তুমি নিশ্চয়ই তা করতে পারবে?’

‘আপাতত কয়েকদিন ওভাবে কাজ চালিয়ে নিতে পারব বৈকি।’ জিমের চোখে তাকাল শর্টি। ‘কাজটা তা হলে পাচ্ছি?’

‘অস্থায়ী ভাবে কাজে নিয়ে দেখতে পারি,’ চিন্তার ভঙ্গি করল জিম। ‘মাসে একশো ডলার পাবে। সঙ্গে থাকা খাওয়া বিনা পয়সায়।’

‘চলবে না,’ বলল শর্টি। ‘আমার ধারণা আমি একশো পঁচিশের যোগ্য। তবে শুনেছি এদিকে থাকলে প্রচুর অস্ত্রের ধোঁয়া নাকে আসবে। ঠিক আছে, ওটা আমার কাছে মাসে পঞ্চাশ ডলারের চেয়ে দামী। তার মানে হচ্ছে আমাকে পঁচাত্তর ডলার দিলেই চলবে তোমার। এতে তুমি যদি রাজি না হও তা হলে কাজটা আমি চাই না।’

‘ঠিক আছে, পরখ করে দেখা যাক তোমাকে।’ ম্যালোনের দিকে হাতের ইশারা করল জিম। ‘একে বীয়ার দাও।’

‘ধন্যবাদ,’ খুশি খুশি গলায় বলল শর্টি। ‘বারটেণ্ডার, এ মত বদলাবার আগেই আমাকে তিনটে বীয়ার দাও।’

নতুন পরিচিতরা যেমন দু’এক কথা বলে, তেমনি ভাবে বীয়ার শেষ করল ওরা। তারপর জিম বলল, ‘ওপরে এসো। কী কাজ করতে হবে সে সম্বন্ধে তোমাকে মোটামুটি একটা ধারণা দেব।’

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল ওরা। সেলুনের ওপরে হোটেল। সেখানে একটা ঘর নিয়েছে জিম। ঘরে ঢুকে জানালার সামনে দুটো চেয়ারে বসল দু’জন। জানালা দিয়ে কোর্ট রুমের ভেতরটা দেখা যায় ওখান থেকে।

বসার পর না চেনার ভঙ্গিটা দূর হয়ে গেল দু’জনের আচরণ থেকে। ‘আগন্তুক সাজার পেছনে কারণটা কী?’ জানতে চাইল জিম।

‘শুনলাম এদিকে গোলমাল চলছে। তোমার অবস্থান বোঝার আগে কোন পক্ষ নিতে চাইনি আমি। কে জানে, আমি হয়তো বিপক্ষে যোগ দেব।’

ভ্রূ নাচাল জিম। ‘একথা শুনে আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। আমি হয়তো তা-ই চাইব। তার আগে বলো, এদিকে হঠাৎ করে তোমার `আগমনের কারণটা কী? ব্যাঙ্ক ডাকাতি টাকাতি করে ভেগে এসেছ নাকি?’.

‘তা আর পারলাম কই।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল শর্টি। ‘একটা কাজ হাতে নিয়েছিলাম, ক্যাটল ড্রাইভ। কিছু গরুর গায়ে দেখলাম জে সি ব্র্যাণ্ড। জানতাম এই ব্র্যাণ্ডের মালিক জিম কার্সন নামের এক গর্দভ। চিন্তা করে মনে হলো ওটা হয়তো সেই পুরানো বোকাটার ব্র্যাণ্ডই হবে। তাই গরু পৌঁছে দিয়ে বোকাটার কী হলো জানতে সোজা চলে এলাম এই এলাকায়।’

‘কবের ঘটনা?’

‘মাস ছয়েক তো হবেই।’

‘ছয় মাসের মধ্যে আমি কোন গরু বিক্রি করিনি। কে গরুর মালিক সেটা খুঁজে বের করেছ?’

‘হ্যাঁ। কেলটন নামের এক লোকের কাছ থেকে গরু কিনেছে র‍্যাঞ্চার। ডুরাণ্টে কিনেছে। আমাকে বলল কেলটন লোকটা এদিকে থাকে। তার খোঁজে চলে এলাম, জানতাম তোমার দেখাও পেয়ে যাব।’

খবরটা হজম করতে করতে একটা সিগারেট রোল করে ধরাল জিম। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর। কিন্তু বিস্মিত হলো না ও। অনেক দিন ধরেই ও ধারণা করছিল রাসলিঙের সঙ্গে বার্ড কেলটন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

শর্টির চোখে চোখ রাখল জিম। ‘তোমার জায়গায় আমি হলে ভুলেও আপাতত বাৰ্ড কেলটনের পেছনে লাগতাম না।’

‘কেন?’

‘দুটো কারণে। এক, ইতিমধ্যেই আমাকে পেয়ে গেছ তুমি। দুই, কেলটনকে এটা জানতে দেয়া উচিত হবে না যে তুমি জানো সে আমার গরু চুরি করে বিক্রি করেছে। সে যদি জানে তা হলে যে করে হোক তোমাকে খতম করে দেবে।’

‘তাই?’ বাঁকা হাসল শর্টি। ‘এবার বলো কবে ওকে আমরা গাছ থেকে লটকে দেব।’

‘সম্ভব নয় আপাতত। তুমি যা বলছ সেটা আগে প্রমাণ করতে হবে।’

‘কী করতে বলো তুমি?’

আরও গম্ভীর হয়ে গেল জিমের গলা। ‘পাহাড়ে বাস করা কিছু শয়তানের কারণে ফতুর হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছে আমাদের। গরু হারাচ্ছে সবাই। গত দু’বছরে এই প্রথম একজনকে ধরা গেছে। তাকেও ধরে রাখা যাবে কিনা সন্দেহ। দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। কী ঘটছে সবাই আমরা বুঝতে পারছি, কিন্তু এতদিন কিছু করা যায়নি। আজকে চোরটার বিচার হবে। কিন্তু তাতে আমাদের কোন লাভ হবে কিনা সন্দেহ।’

‘সমস্যা কোথায়?’

‘ম্যাভরিকিং। ব্র্যাণ্ড না করা বাছুর চুরি হয়ে যাচ্ছে। আগে ব্র্যাণ্ড করা গরু চুরি হত, কিন্তু গত দু’বছর ধরে বাছুর চুরি করছে। বাছুরের মাকে খুন করে ফেলে ওরা, যাতে ওটা বাচ্চার পিছু নিতে না পারে। মানে বুঝছ? আমরা শুধু বাছুরই হারাচ্ছি না, গরুও হারাচ্ছি।’

সিগারেট রোল করতে করতে কিছুক্ষণ ভাবল শর্টি, তারপর ওটা ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘কিন্তু মা ছাড়া বাছুরগুলোকে ওরা বাঁচাচ্ছে কী করে? দুধ ছাড়া তো মরে যাবার কথা।’

‘কী ঘটছে তা বলতে পারি না।’

‘আশ্চর্য!’ আপনমনে বলল শর্টি। ‘যাকে তোমরা চোর ধরেছ সে এ ব্যাপারে কী বলছে? তার তো জানা আছে।’

‘জানে, কিন্তু মুখ খুলবে না।’

‘কাদের হয়ে কাজ করে সে? একজন লোক একটা একটা করে বাছুর চুরি করে তো আর গোটা রেঞ্জ খালি করে দিতে পারে না।’

‘জানে না কেউ। আমরা কয়েকজন ধারণা করছি সে কার হয়ে কাজ করত, কিন্তু প্রমাণ নেই কোন। সবকিছুর পেছনে আছে বার্ড কেলটন। অত্যন্ত চতুর লোক সে। দক্ষ। তার পক্ষে এমন একটা কুকীর্তি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। নিজেকে ফীডার বলে প্রচার করে লোকটা। খাবার বিক্রি করে, গরু কেনে, আবার বেচেও। সম্ভবত চোরদের কাছ থেকে গরু কিনছে সে। আবার এমনও হতে পারে যে সে নিজেই চোরদের নেতা। কিন্তু আজকে যার বিচার হবে সেলোক এব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে একটা কথা ঠিক, কিছুদিন আগেও সে বার্ড কেলটনের হয়ে কাজ করত।’

‘কোনভাবে ওর মুখ খোলানো যায় না? ইণ্ডিয়ানরা মুখ খোলানোর অনেক কায়দা জানে।’

‘কাজ হবে না। আমাদের তুলনায় নিজের বকে অনেক বেশি ভয় পায় লোকটা। শহরের সবাই কেলটনকে সমঝে চলে। অনেকেই বিশ্বাস করে না যে সে কোন বেআইনী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।’

‘তারমানে তোমরা নিশ্চিত হয়ে তার বিরুদ্ধে নামতে পারছ না।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি জানি লোকটা অত্যন্ত পিছলা এক আস্ত বদমাশ। অন্তত অ্যাম্বুশ।

‘আমার ফোরম্যান লিওস্টর্ম ছাড়া লেভির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার আর কেউ ছিল না। গতকাল সাক্ষ্য দিয়েছে সে। তারপর গতরাতে র‍্যাঞ্চে ফেরার সময় নিখোঁজ হয়ে গেছে। কেউ বলতে পারে না কী হয়েছে তার।

‘লেভি জেলে, কাজেই এব্যাপারে তার কোন হাত নেই। তবে বন্ধু আছে তার অনেক। এছাড়া যারা ওর মতই বেআইনী কাজে জড়িত, তারা ওর পক্ষ নিয়েছে। আমাদের নানা ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সাক্ষীদের খুন করা হচ্ছে। নিজেদের চামড়া বাঁচাতে যা খুশি তাই করতে পারে তারা।’

‘আমার ধারণা কাজটা ভাল লাগবে আমার,’ বলল শর্টি। ‘কোত্থেকে শুরু করব আমরা?’

‘জুরিরা আলোচনার জন্যে সময় নিয়েছে। তারা যখন বিচারের রায় দেবে তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারে না। শহরে বেশ কিছু পাহাড়ী লোক এসে উপস্থিত হয়েছে। লেভিকে দোষী ঘোষণা করলে যেকোন সময় লড়াই শুরু হয়ে যেতে পারে। মন দিয়ে শোনো, আমি তোমাকে কী করতে হবে বলে দিচ্ছি। আমার ধারেকাছে এসো না। পাহাড়ী লোকগুলোর সঙ্গে জুটে যাও। ওদের অনুসরণ করবে, দরকারে পাহাড় পর্যন্ত। পারলে ওদের সঙ্গে যোগ দেবে। চোখ- কান খোলা রাখবে। বোঝার চেষ্টা করবে কী ঘটছে ওখানে। অবস্থা কীরকম বুঝে পরে র‍্যাঞ্চে আমার সঙ্গে দেখা করে জানাবে।’

আর কিছু করতে হবে?’ শুকনো স্বরে জিজ্ঞেস করল শর্টি।

কোর্ট রূমের দিকে চোখ রেখে বসে ছিল জিম, দেখল জানালা দিয়ে হাত বের করে রাস্তায় দাঁড়ানো লোকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল একজন।

নড়ে উঠল সবাই। বাড়িটার পাশে সিঁড়ি, সেদিকে পা বাড়াল।

‘জুরিরা বোধহয় সীটে বসেছে,’ বলল জিম। উঠে দাঁড়াল। ‘এখন থেকে মানুষের, সামনে আমাকে আর চিনো না। গোপনে কাজ করতে হবে তোমাকে। পাহাড়ী লোকগুলোর সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা কোরো। পারলে কেলটনের দলে যোগ দাও।’

‘ওর দলে যোগ দেব কীভাবে?’

‘জানি না। বুদ্ধি খাটাও। দেখো কী হয়।’

‘বুদ্ধি?’ হাসল শর্টি। ‘বুদ্ধিই যদি থাকত তা হলে এসবের সঙ্গে নিজেকে জড়াই আমি? সে যাই হোক, ঠিক আছে, আমি একদান খেলার চেষ্টা করে দেখি।’

তাই ছিল অতীতে। আমি জানলেও শহরের লোক ওর অতীত জানে না।’

‘ওদের তুমি জানাওনি কেন?’

‘ভেবেছি হয়তো বদলে গেছে সে। হয়তো এখানে এসেছে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে। তাই যদি হয় তা হলে একটা সুযোগ পাবার অধিকার আছে তার। যদিও আমার ব্যক্তিগত ধারণা, খারাপ কাজ করে চলেছে সে এখনও। তুমি আমার ব্র্যাণ্ড করা গরু অন্য লোকের ড্রাইভে দেখায় এখন আমি নিশ্চিত।’

‘আউট-লদের সঙ্গে লোকটা নির্ঘাত জড়িত।’

‘ওর অবস্থান একটু খুলে বলছি। শুনে দেখো তোমার কী মনে হয়। উপত্যকার ওপরে চমৎকার ঘাসজমিতে বিরাট এলাকা লীয নিয়ে একটা র‍্যাঞ্চ করেছে সে। প্রথমে শুরু করেছে খাবার বিক্রেতা হিসেবে। নিচের জমিতে ঘাসের অভাব হওয়ায় কম দামে পরে গরু কিনেছে। ওগুলোকে মোটাতাজা করে তারপর বিক্রি করেছে বেশি দামে। সবই করেছে আইন মেনে। কারও কিছু বলার নেই, একটা ব্যাপার ছাড়া। পাহাড়ে আউট-লদের অভাব নেই। প্রয়োজন পড়লে তাদের কাজে নেয় কেলটন। হয়তো তাদের দিয়ে গরু চুরি করায়। এমনও হতে পারে যে তাদের কাছ থেকে চোরাই গরু কেনে। কিন্তু এসব প্রমাণ করা কঠিন হবে।’

‘কেলটনের মতলব কি সে ব্যাপারে তা হলে তোমার পরিষ্কার কোন ধারণা নেই,’ মন্তব্য করল শর্টি।

‘তা নেই,’ স্বীকার করল জিম। ‘ও মুখে যা বলে সেটুকুই আমরা জানি। আর যা সে বলে সেটা সম্পূর্ণ আইনী।’

‘কিন্তু ওর একজন লোককে তোমরা ধরে ফেলেছ গরু চুরির সময়।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু কেলটন ওই লোকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। সে বলেছে এক মাস আগেই লেভি, মানে বন্দিকে সে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বুঝতেই পারছ, তাকে ফাঁসানোর কোন উপায় নেই। কেলটনকে ধরতে হলে চোরাই গরু সহ ধরতে হবে। আগেই বলেছি, আমাদের বাছুরগুলো ব্র্যাণ্ডিঙের আগেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। ওগুলো খুঁজে পাবার আর কোন উপায় থাকছে না আমাদের।’

‘চতুরতার সঙ্গে কাজ সারছে বলতে হবে! ভ্রূ কুঁচকাল শর্টি। ‘তুমি একটু আগেই বললে অন্য ব্র্যাণ্ডের গরু সহ কাউকে ধরা যাচ্ছে না। তা হলে এই লেভি লোকটা ধরা পড়ল কী করে?’

‘লোকটা একটা বাছুরকে গুলি করে মেরে স্যাডলে তুলছিল, এমন সময় আমাদের প্রতিবেশী তরুণ জনি উডফোর্ড আর আমার ফোরম্যান গাস লিওস্টর্ম ওকে দেখে ফেলে। ওরা লেভিকে ধরে নিয়ে আসে। পরে আমরা লেভির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করি। তারপর বিচারের কাজ শুরু হওয়ার দু’দিন আগে জনি উডফোর্ডকে পাওয়া গেল, মাথার পেছনে গুলি করে খুন করা হয়েছে তাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *