মৃত্যু উপত্যকা – ১৬

ষোলো

মাঝরাত। পাইনটপে তুমুল হৈ-হল্লা চলছে। দূর থেকে সে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সিকি মাইল দূরে ঘোড়া থামাল জিমের দল। রাস্তার ধারে ঝোপের ভেতর ঘোড়া বেঁধে এগোল ওরা।

সেদিন স্টিচকে পেটানোর আগে বনের ভেতর যেখানে দাঁড়িয়েছিল জিম, সেখানে থামল ওরা। জ্যাকের দোকানটা রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে। আলো বেরিয়ে আসছে একতলার জানালা দিয়ে। দোতলাতেও কয়েকটা জানালায় আলো দেখা গেল।

জ্যাকের দোকানের দু’ধারে কয়েকটা কেবিনের ফাঁকফোকর দিয়েও হলদে আলো বের হচ্ছে। ওখানে আস্তানা গেড়েছে কেলটনের লোকরা।

জ্যাকের দোকানে কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে। সঙ্গত করছে একটা গিটার। পাহাড় থেকে মেয়েরা এসেছে। তাদের সঙ্গে পা ঠুকে ঠুকে নাচছে লোকজন। চেঁচাচ্ছে মাতাল গলায়। জমে উঠেছে আসর।

ড্রেক আর স্যাডল প্রস্তুতকারক দু’পাশ দেখতে গিয়েছিল, ফিরে এল তারা।

‘প্রায় তিরিশটা ঘোড়া ছিল,’ বলল ড্রেক। ‘দড়ি খুলে ভাগিয়ে দিয়েছি আমরা। অনেক বেশি লোক। আমরা সামলাতে পারব না। কী করবে ভাবছ, জিম?’

‘লড়াই করব। আউট-ল দল চিরতরে শেষ করে দিতে হবে। তার আগে একটা কাজ করতে হবে। মন দিয়ে শোনো তোমরা, প্রথমে শেষ কেবিনটায় আগুন দেবে। কেবিনে যদি মেয়েমানুষ থাকে তা হলে বের হতে দেবে। নিজের জিনিস নিয়ে সরে পড়তে দেবে। সঙ্গে যদি কেলটনের লোক থাকে তা হলে পরিস্থিতি বুঝে যা ব্যবস্থা নেবার নেবে। নিজের নিরাপত্তা দেখবে আগে। পাহাড়ের সবকয়টা বদমাশের মৃত্যুর বিনিময়েও তোমাদের কারও এক ফোঁটা রক্ত ঝরুক তা আমি চাই না।’

‘আর তুমি কী করবে?’

‘কেলটন হয়তো জ্যাকের ওখানে আছে, আবার না-ও থাকতে পারে। লোকদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজে সে দূরে সরে থাকতে পারে। সে কোথায় সেটা আমাদের জানতে হবে। কেবিনগুলোতে আগুন দাও, দেখো ভেতরের লোকগুলোকে বের করে গ্রেফতার করতে পারো কিনা। জ্যাকের দোকান থেকেও ওদের বের করতে হবে। শর্টিকে নিয়ে পেছনের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাব আমি, ঘরগুলো তল্লাশী করে দেখব। কেলটন আছে কি নেই সেটা নিশ্চিত হবার পর জ্যাকের ব্যবস্থা করা যাবে। এখানে শয়তানগুলোকে সে-ই আশ্রয় দেয়।’

‘আর আমি কী করব?’ জিজ্ঞেস করল রেড।

একটু চিন্তা করল জিম, তারপর বলল, ‘যাদের সঙ্গে কাজ করেছ তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে আমি তোমাকে বলতে পারি না। অপেক্ষা করো তুমি। এখানে যদি কেলটনকে না পাই তা হলে ওর র‍্যাঞ্চে তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।’

‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো রেড। ‘তবে বসে থাকব না আমি। কোন কাজে লাগি কিনা সে চেষ্টা করে দেখব। কেলটন আমার কাছে একটা বুলেট পায়।‘

রাস্তা পেরিয়ে জ্যাকের বাড়ির পেছনে চলে এল জিম আর শর্টি। পেছনের দরজা দিয়ে আলো আসছে। অন্ধকারে থমকে দাঁড়াল ওরা।

একটু পরেই লক্ষ করল শ’খানেক গজ দূরে লাল একটা আভা দেখা যাচ্ছে। একটা কেবিনে আগুন দেয়া হয়েছে। রাতের নীরবতা চিরে দিল এক মহিলার তীক্ষ্ণ চিৎকার। দু’তিনটা গুলি ফুটল।

ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে জ্যাকের দোকানের সামনের দিকের একটা দরজা খুলে গেল। ভারী একটা স্বর ঘোষণা করল, ‘নিচের দিকে আগুন লেগেছে।’

বেহালা আর গিটার থেমে গেল। পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। লোকজন তাড়াহুড়ো করে দোকান থেকে বের হচ্ছে।

আরও কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জিম বলল, ‘এবার এসো আমার সঙ্গে।’

একসঙ্গে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল ওরা, হাতে উদ্যত অস্ত্র। করিডরে লোকজনের আওয়াজ হচ্ছে, ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসবে যেকোন সময়। যাতে সহজে ওদের দেখা না যায় সেজন্যে লণ্ঠন নিভিয়ে দিল শর্টি।

‘তুমি ডানদিক কাভার করো,’ বলল জিম, বামদিকের প্রথম দরজাটা খুলল ও। পাহাড় থেকে আনা একটা মেয়ে মোটা এক লোকের কোলে বসে ছিল। দরজা খুলে যেতে বোকা বোকা চেহারায় তাকাল মোটকু। ‘বেরোও!’ খেঁকিয়ে উঠল জিম। মোটা লোকটার ওপর অস্ত্র তাক করে বলল, ‘সোজা নিজের বাসায় ফিরে যাও। নাকি গুলি খাওয়ার শখ আছে?’

চেয়ারের পিঠে ঝুলন্ত মোটকুর গানবেল্ট হাতে তুলে নিল জিম, জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অবাক চোখে জিমের দিকে চেয়ে ঢোক গিলল মোটকু। বলল, ‘যাচ্ছি আমি। তবে পরেরবার ঘরে ঢোকার আগে নক কোরো।’

পরের দুটো ঘর খালি। চতুর্থ ঘর থেকে আরও একজনকে বের করল জিম। শেষ ঘরটাও খালি। শর্টির কপালও খোলেনি। একই সঙ্গে দু’পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। শ্রাগ করল শর্টি।

‘কেলটন এখানে নেই।’

‘হ্যাঁ, নেই। ঝামেলা বাড়ল।’

হঠাৎ রাস্তায় তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। পায়ের আওয়াজে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে দৌড়ে জ্যাকের দোকানে এসে ঢুকছে কেলটনের স্যাঙাতরা।

‘আমাদের লোকদের মুখোমুখি হয়েছে ওরা,’ বলল শর্টি। ‘নিচের তলায় আশ্রয় নিয়েছে।’

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল জিম, তারপর বলল, ‘কয়েকটা লণ্ঠন ধরিয়ে ফেলো। ওপরের ঘরগুলোতে আগুন দিয়ে যাই। ধোঁয়ার ঠেলায় বাইরে বের হতে হবে ওদের।’

নিজেও জিম লণ্ঠন কাত করে মেঝেতে তেল ঢালল। ম্যাচের কাঠির আগুন দ্রুত ছড়াতে শুরু করল তেলের পথ ধরে। শুকনো কাঠে আগুন ধরতে বেশি সময় লাগছে না। কয়েকটা ঘরে আগুন দেয়ার পর শর্টির সঙ্গে করিডরে বেরিয়ে এল ও। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল, ‘যথেষ্ট হয়েছে। নিচতলায় ধরতে বেশিক্ষণ লাগবে না।’

‘সাবধান!’ বলেই গুলি করল শর্টি। দু’জন লোক পেছনের দরজা দিয়ে বের হচ্ছিল, শেষেরজন মাথায় গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। শর্টি আবার গুলি করার আগেই পেছনে দরজা বন্ধ করে সরে পড়ল অন্য লোকটা। দরজায় ঠেলা দিয়ে জিম দেখল বাইরে থেকে আড়া দিয়ে দরজা বন্ধ করে গেছে লোকটা।

কিচেন হয়ে বাড়ির সামনে চলে এল ওরা। রাস্তায় কোন লোক চোখে পড়ল না। একটা জানালার পাশে দাঁড়াল জিম। জানালাগুলো লক্ষ্য করে গুলি করছে ওর লোকরা। হাত বের করে তাদের থামতে ইশারা করল ও। গুলি থামার পর জানালা টপকে রাস্তায় নামল জিম আর শর্টি। জিম চেঁচাল বাড়ির ভেতরের লোকগুলোর উদ্দেশে।

‘পুড়ে মরতে না চাইলে অস্ত্র ফেলে মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে এসো তোমরা। কারও হাতে অস্ত্র দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে। মেয়েদের আগে পাঠাও।’

বাড়ির ভেতরে কে যেন হেসে উঠল। পরক্ষণেই জানালাগুলো দিয়ে গুলি ছুটে আসতে শুরু করল। দোকানের ভেতরটা ইতিমধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেছে।

রাস্তা পার হলো জিম আর শর্টি। সঙ্গীদের কাছে চলে আসার পর জিম বলল, ‘গুলি করা লাগবে না। বাড়িতে আমরা আগুন দিয়েছি, বের হতে হবে ওদের।’

পুরো বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগল না। বাইরে থেকে আগুনের ফুলকি দেখতে পেল ওরা। বাড়ির ভেতরে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচাচ্ছে আটকে পড়া মেয়েরা।

আবার সাবধান করল জিম, ‘মেয়েদের বাইরে পাঠাও! বেরিয়ে এসো মাথার ওপর হাত তুলে। ঘিরে ফেলা হয়েছে তোমাদের।’

প্রত্যেকটা কেবিন আর আউটবিল্ডিং জ্বলছে। রাতের আকাশে এখন লালের ছোপ। বাতাসের কারণে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। দূরের কালো পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে সে আলোয়।

কড়কড় মড়মড় নানা আওয়াজ করে পুড়ছে শুকনো কাঠ। ক্রমেই রাতের আঁধারকে হারিয়ে দিচ্ছে হলদে-লাল আগুন।

‘ঠিক আছে,’ দোকানের ভেতর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল। মেয়েদের পাঠাচ্ছি আমরা। গুলি কোরো না।’

ড্রেককে সামনে পেয়ে জিম বলল, ‘কেলটন পাহাড়ের যেখানেই থাকুক এই আগুন দেখতে পাবে। দায়িত্ব নাও। মেয়েরা বের হবার পর বোলো ইচ্ছে করলে তারা শহরে যেতে পারে। পরের স্টেজে যেখানে খুশি যেতে বাধা দেয়া হবে না তাদের। প্রত্যেকটা লোককে সার্চ করতে হবে। অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিলে ক্ষতি নেই। সবার চেহারা মনে গেঁথে নিয়ে জানিয়ে দিয়ো পরেরবার তাকে দেখা গেলে কোন কথা বলার আগে গুলি করা হবে। কেউ ঝামেলা করতে চাইলে বিনা দ্বিধায় গুলি করবে।’

‘আর তুমি কী করবে?’

‘কেলটনকে এখনও পাইনি। তবে পাব। একটা জায়গাতেই থাকতে পারে সে। সেখানেই যাব। রেড আর শর্টিকে নিচ্ছি আমি।’

রেডকে ডাকল ও। রেড ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেরি না করে রওনা হয়ে গেল ওরা তিনজন। ড্রেক আর অন্যান্যরা ব্যস্ত হয়ে পাহাড়ী দস্যুদের বন্দি করছে। লোকগুলোর ভাব দেখে মনে হলো না লড়াইয়ের কোন ইচ্ছে আছে।

‘একটা ঝামেলা মিটল,’ কিছুদূর যাওয়ার পর বলল শর্টি। ‘এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে পাহাড় সাফ করে ফেলতে দেরি হবে না।’

‘তুমি কী করছিলে, রেড?’ জিজ্ঞেস করল জিম।

‘একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এক পরিচিত লোককে দেখলাম এক মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটাও পরিচিত। চমৎকার নরম একটা বিছানা আছে ওর। সে যাই হোক, লোকটা খুব খারাপ মানুষ নয়। ওর সঙ্গে একটা চুক্তিতে এসেছি। মেয়েটাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছিল, রাজি হয়ে গেলাম। তথ্যের বিনিময়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছি। ওর মুখেই শুনলাম মাত্র এক ঘণ্টা আগেও কেলটন এখানে ছিল। এক লোকের ওপর শহর আক্রমণের দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছে। বাজি ধরে বলতে পারি টাকা-পয়সা জড়ো করে পালাবে সে। বিপদ দেখলে ওর মত লোকরা এভাবেই সরে পড়ে।’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। তো পথ দেখাও। ওর বাড়িতে যাচ্ছি আমরা। কত দূর?’

‘খুব বেশি দূর নয়। চলো পথে যেতে যেতে তোমাকে ওর বুদ্ধির কিছু জিনিস দেখাব।’

রেডই আগে আগে চলেছে। ক্রমেই ওপর দিকে উঠছে রাস্তাটা। এক পাশে খাড়া পাহাড়, অন্য পাশে গভীর জঙ্গল।

‘চোরাই গরু খুঁজতে অনেক বেশি দূরে যেতে হয়েছিল তোমাকে,’ বলল রেড। ‘দেখো এবার।’

রাস্তার ধারে একটা বার্নের সামনে থামল সে। বার্নের দরজার সামনে গভীর একটা নালা আছে। সেটার ওপর কাঠ পেতে ঢোকার রাস্তা করা হয়েছে। ঘোড়া থেকে নেমে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল রেড।

‘একটা কাঠি জ্বালো।‘

বার্নের পেছনে চলে এসেছে ওরা। আরও একটা দরজা খুলল রেড।

‘এটা কেলটনের এক নম্বর পথ। একটা ড্র আছে দরজার পর। বেশিরভাগ সময়েই ওটা শুকনো থাকে। বৃষ্টির সময় পাহাড়ের পানি নামে ওপথে। কিন্তু যখন শুকনো থাকে তখন ড্রটাকে কেলটনের র‍্যাঞ্চে যাবার শর্টকাট পথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিত্যক্ত এই বার্নের পেছনের দরজা না খুললে একশো বছরেও কেউ পথটা খুঁজে পাবে না। প্রচুর গরু এপথে নেয়া হয়েছে।’

‘চলো বার্নে আগুন দিয়ে রওনা হয়ে যাই,’ বলল গম্ভীর জিম। ‘হাতে আমাদের বেশি সময় নেই।’

সামান্য খড় আর ম্যাচের একটা কাঠিই যথেষ্ট হলো। গনগনে আগুন পেছনে ফেলে ড্র’-এর ভেতর দিয়ে কেলটনের র‍্যাঞ্চের দিকে এগোল ওরা। একবার পেছনে তাকাল চিন্তিত জিম। বার্নের আগুন আকাশ চাটছে।

‘জলদি চলো,’ তাগাদা দিল ও। ‘আগুনটা কেলটন দেখতে পাবে। বুঝে ফেলবে এর মানে কী। হয়তো আমরা পৌছুবার আগেই পালিয়ে যাবে সে।’

‘আমার তা মনে হয় না,’ দ্বিমত পোষণ করল রেড। ‘লোকটা তোমাকে ঘৃণা করে, নিজের সর্বনাশের জন্যে তোমাকেই দায়ী ভাবে। তোমার মুখোমুখি না হয়ে কোথাও যাবে না সে।’

পরবর্তী আধঘণ্টা অন্ধকার ড্র ধরে ওপরের দিকে এগোল ওরা। ড্র শেষ হওয়ার পর পথ দেখিয়ে ওদের নিয়ে চলল রেড। পার হলো আরও এক ঘণ্টা। জিমের মনে হলো কোনদিনও এই পথ ফুরাবে না।

পুব আকাশে ধূসরের ছোঁয়া লেগেছে এমন সময় জিমের পাশে ঘোড়া নিয়ে এল রেড। ‘একশো গজ দূরের বাঁকটা দেখতে পাচ্ছ? ওখান থেকে ফাঁকা জমির শুরু। একটা বার্নের পেছনে হাজির হবো আমরা, বাড়ি থেকে কেউ দেখতে পাবে না।’

‘ভাল। কেলটনকে বেরিয়ে আসতে বলব আমি,’ জানাল জিম। ‘আস্ত আর্মি নিয়ে বসে থাকলেও তোয়াক্কা করি না। কেলটনের শেষ না দেখে শান্তি নেই আমার।’

লোকজন নেই বলে মনে হলো কেলটনের র‍্যাঞ্চে। বার্ন ঘুরে বাড়িটার দিকে এগোল ওরা। কাঠের মোটা মোটা গুঁড়ির তৈরি বাড়ি, অত্যন্ত মজবুত। নিচু এবং লম্বাটে। বসে আছে একটা গামলা আকৃতির ঘাসজমির মাঝখানে। এখানে ওখানে তৃপ্ত মুখে চরছে গরুর দল। বাড়ির সামনের হিচরেইলে মাত্র দুটো ঘোড়া দেখা গেল। করাল বা বার্নে কোন জন্তু নেই।

বাড়িটার পেছনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামল জিম, দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। ওকে অনুসরণ করছে রেড আর শর্টি। নিঃশব্দে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিচেনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জিম। কিচেনের পরই বিরাট একটা লিভিং রূম।

এক কোনায় টেবিলে বসে আছে বার্ড কেলটন, ব্যস্ত হাতে কী যেন ভরছে একটা ব্যাগে। জিমের ঢোকার শব্দ পায়নি সে। চুপ করে লোকটাকে কিছুক্ষণ দেখল জিম। গভীর মনোযোগে ব্যাঙ্ক নোট আর কয়েন ভরছে লোকটা ব্যাগে।

‘তা হলে দেখা হলো, কেলটন,’ মৃদু স্বরে বলল জিম।

ঘুরে তাকাল কেলটন, জিমকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল। চেহারায় নানা অনুভূতির ছাপ পড়ল। শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। চোখ সরু করে চেয়ে আছে। এখন লোকটার সুদর্শন চেহারায় স্পষ্ট বিদ্বেষ। অনেকক্ষণ লাগল তার নিজেকে সামলাতে। সাদা হয়ে গিয়েছিল চেহারা, লাল হলো, তারপর আবার ফ্যাকাসে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

‘কী চাও, জিম কার্সন?’ ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

‘বলেছিলাম তোমাকে খুঁজে বের করব। তোমাকে শহরে নিয়ে যেতে এসেছি।’

জিমের কাঁধের ওপর দিয়ে রেডের দিকে তাকাল কেলটন। ‘আচ্ছা,’ তিক্ত শোনাল কণ্ঠস্বর। ‘তা হলে আমার লালচুলো বন্ধু পথ দেখিয়ে এনেছে!

‘না আনলে নিরাপদে কেটে পড়তে, তাই না, কেলটন?’

‘তোমার কাছ থেকে পালানোর কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। জানি একটু আগে আমার লোকরা আত্মসমর্পণ করেছে। ঠিকই ধরেছিলে তুমি, ওরা তোমাদের গরু চুরি করছিল। কিন্তু সেটা আমি জানতাম না। তৈরি হচ্ছিলাম নিজের লোকদের ভুল স্বীকার করে তোমাদের সঙ্গে মিটমাট করার জন্যে। সেজন্যেই টাকা বের করেছি। শহরে গিয়ে ক্ষতিপূরণ করব।’

‘আমার ধারণা তুমি একটা জঘন্য মিথ্যেবাদী, কেলটন। জুরিদের সামনে বোলো এসব কথা। আমি তোমাকে গ্রেফতার করছি।’

‘তা হবে না। কোন সুযোগই পাব না আমি। সবাইকে আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছ তুমি। ওরা আমাকে বিশ্বাস করবে না।’

‘উঠে দাঁড়াও, কেলটন। মনস্থির করার জন্যে তিরিশ সেকেণ্ড সময় দিলাম হয় তুমি আমার সঙ্গে যাবে, নয়তো জোর করে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো আমি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেলটন। ‘বুঝতে পারছি নিরস্ত্র লোককে গুলি করতেও বাধবে না তোমার। ঠিক আছে, তুমিই জিতলে। তোমার সঙ্গে যাব আমি।’

উঠে দাঁড়াল কেলটন, ঘুরে টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ তুলে নিল। ‘আমি কী করতাম এটা তার প্রমাণ। একটা লিস্ট। যেসব র‍্যাঞ্চারের গরু আমি পাহাড়ের লোকদের কাছ থেকে না জেনে কিনেছি সেসব র‍্যাঞ্চারদের সবার নাম আছে এখানে, কত টাকা করে পাবে সেটাও লেখা আছে। বিশ্বাস না হলে একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারো। তোমার নামও আছে।’

কাগজটা ডানহাতে ধরে এগিয়ে এল কেলটন, তার বামহাত প্যান্টের পকেটে।

কেলটনের চোখ জিমের মুখে। জিম দেখছে কাগজটা।

ঝট করে বামহাত বের করল কেলটন। পরক্ষণেই একসঙ্গে গর্জন ছাড়ল দুটো অস্ত্র। বদ্ধ ঘরের ভেতর বিকট আওয়াজ হলো।

লুকানো একটা ছোট পিস্তল বের করেছে কেলটন। জিম দেখে ফেলেছে। সর্বক্ষণ চোখের কোনায় কেলটনের বামহাতটার দিকে নজর ছিল ওর। লোকটাকে ড্র করতে দেখেই নিজের অস্ত্র বের করে কোমরের কাছ থেকে গুলি করেছে ও। কেলটনের গুলি জিমের বাহুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

বুক চেপে ধরে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল কেলটন। উঠে বসল হাঁটুতে ভর দিয়ে। ‘তুমি আমার সঙ্গে চালাকি করেছ,’ শুধু এটুকু বলতে পারল, তারপর কাত হয়ে আবার পড়ে গেল মেঝেতে। কয়েকবার খিঁচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল দেহটা।

‘জানোয়ার কমল একটা’ বলে এগিয়ে এল শর্টি।

টেবিলের কাছে গিয়ে ব্যাগটা খুলে ভেতরে হাত ভরল জিম। টাকা বের করে বলল, ‘বহু লোকের কষ্টের ফসল আছে এখানে। এত টাকা আছে যে ইচ্ছে করলে এখান থেকে চলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারত লোকটা।’ ব্যাগটা বন্ধ করল ও। ‘টাকাগুলোতে রক্ত লেগে আছে। ভাল কাজে ব্যয় করতে হবে। এটাকায় অনেক গরীব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানো যাবে।’

শর্টির চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। বলল, ‘অবাক ব্যাপার, তাই না!’ নিজেকে আমার কেন যেন বঞ্চিত মনে হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘হয়তো হঠাৎ করে সব থেমে যাওয়ায়। করার কিছু নেই বলে। ভবিষ্যতে কী করব কে জানে!’

‘এদিকের দায়িত্বে থাকো আপাতত,’ বলল জিম। ‘আমাকে শহরে ফিরতে হবে।’

হাসল শর্টি। ‘একটা মিষ্টি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্যে যাচ্ছ নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ।’

রেডের দিকে ফিরল শর্টি। ‘রেড, সনোরার মেয়েগুলোর কথা ভুলে যেয়ো না। আমিও যাব ভাবছি। তোমার আমার মত সুদর্শন লোকদের জন্যে ওরা পাগল। চলো যত তাড়াতাড়ি পারি রওনা হয়ে যাই। এই এলাকা অসহ্য রকমের সভ্য হয়ে যাচ্ছে।’

বেরিয়ে এল জিম কেলটনের র‍্যাঞ্চ হাউস থেকে, ঠোঁটে মৃদু হাসি। চোখে আগামী দিনের রঙিন স্বপ্ন। লিণ্ডা ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *