মুক্তো

মুক্তো

গাড়িটা যে এইভাবে পথে বসাবে, চন্দন মিত্র তা ভাবতে পারেনি।

ভোরে দিঘা থেকে রওনা হয়ে খড়গপুর পর্যন্ত মসৃণভাবে এসেছে। ব্রততী আর এক বছরের বাবলুকে জামশেদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়েছে চন্দন। ব্রততী যাবে বড়োদিদির কাছে, থাকবে দিন পনেরো। দিঘায় ওরা দু-দিন ছিল চন্দনের এক অনুরাগীর বাড়িতে।

পুরোনো স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড। চন্দন ছ-হাজার টাকায় কিনেছে চার মাস আগে। গাড়ি চালানোটা শিখবে শিখবে করেও শেখা হয়নি। ড্রাইভার রেখেছে। মাসে তিনশো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা ওর গায়ে লাগে। কেমন একটা ভয় ওর আছে, নিজে গাড়ি চালালে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে।

চার বছর আগে জ্যোতিষী কোষ্ঠীবিচার করে যা যা বলেছিল তার অধিকাংশই মিলে গেছে। যেমন বিদেশে ভ্রমণ, যশ-খ্যাতি, আর্থিক সাফল্য, বিয়ে, চাকুরি—সবই প্রায়। এশিয়ান গেমস খেলতে ব্যাঙ্কক, তেহরান, ইণ্ডিয়া টিমের সঙ্গে হংকং, নাইরোবি, সিঙ্গাপুর, কাবুল, কলম্বো, রেঙ্গুন। মারডেকা খেলতে দু-বার কুয়ালালামপুরে। যশ ও খ্যাতি ব্যাপারটা কেমন চন্দন সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। সে শুধু লক্ষ করেছে বাড়ির বাইরে মানুষজন তাকে দেখলেই তাকায়, মেয়েরা ফিসফাস করে। গাড়িওলা লোকেরা তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে লিফট দিতে চায়, অপরিচিতরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ ও দু-চার কথা বলার জন্য প্রায়ই ডাক আসে। তার নামে খবরের কাগজে হেডিং হয়; চন্দনের সৌরভ বা সুরভিত চন্দন-জাতীয় বিশেষণ তার খেলার দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এক বার ট্যাক্সিতে যাবার সময় কানে এসেছিল, ভগবানের ছেলে যাচ্ছে রে! তার ক-দিন আগেই শিল্ড ফাইনালে যুগের যাত্রী জিতেছিল তার দেওয়া একমাত্র গোলে। এসব ব্যাপার যদি যশ বা খ্যাতি হয় তাহলে চন্দন যশস্বী এবং খ্যাতিমান।

আর্থিক সাফল্য অবশ্যই চন্দন পেয়েছে। কোনোক্রমে স্কুল ফাইনাল পাস। ক্লাবই ব্যাঙ্কে চাকরি করে দিয়েছে। এখন পাচ্ছে প্রায় আঠারোশো। জ্যোতিষী বলেছিল গোমেদ আর পোখরাজ ধারণ করতে, করেছে। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার তার দর উঠেছিল। সে বছরই। এখন সে ফ্লাটের মালিক, বেনামিতে একটি ওষুধের দোকান করেছে, পঞ্চাশ হাজার টাকা খাটছে সুদে এবং সম্প্রতি এই গাড়িটি।

জ্যোতিষী বলেছিল, সুন্দরী বউ পাবে, বতু অর্থাৎ ব্রততী প্রকৃত সুন্দরীই। চন্দনের ভক্ত এক ফিলম ডিরেক্টর ব্রততীর জন্য কিছুদিন ধরনাও দিয়েছিল। ফিলমে নামাটা চন্দনের পছন্দ নয়। বতু তাকে ভালোবাসে এবং সে বতুকে। বতু চায় চন্দন স্মার্ট লোকদের মতো নিজেই গাড়ি চালাক। কিন্তু জ্যোতিষী বলেছিল ত্রিশ বছরের পর ফাঁড়া আছে, একটা মুক্তো ধারণ করলে হয়। তখন বয়স ছিল সাতাশ। ত্রিশ হোক তো, এই ভেবে মুক্তো আর ধারণ করা হয়নি, আজও হয়নি।

গাড়িটা কিনেই তার মনে পড়েছিল ফাঁড়ার কথাটা। শরীর ছমছম করে উঠেছিল। গোল এরিয়ার হিংস্রতম ডিফেণ্ডারদের মোকাবিলায় যে কখনো ভয় পায়নি সেই চন্দন মিত্র গোপনে ভয় পায় অ্যাকসিডেন্টকে। হাত-পা বিচ্ছিন্ন ধড়, গুঁড়িয়ে-যাওয়া পাঁজর, তালগোল পাকিয়ে চটকানো দেহ—নিজের এইরকম একটা চেহারা যখনই তার চোখে ভেসে ওঠে তখন কিছুক্ষণের জন্য সে বিমর্ষ বোধ করে। গাড়িতে দিঘা রওনা হবার সময় ড্রাইভার ত্রিপিত সিংকে বার বার নির্দেশ দিয়েছিল—ত্রিশ মাইলের বেশি জোরে যাবে না, অন্য গাড়ির সঙ্গে রেস দেবে না, ওভারটেক করবে না, ট্রাক-বাস-লরি সামনে পড়লেই বাঁয়ে সরে যাবে।

এইসব বলার পর তার মনে হয়েছিল বয়সটা বোধ হয় সত্যিই বেড়েছে। খেলার দিন যে ফুরিয়ে আসছে, তা তো এবারই বোঝা গেল। তন্ময়, বাসব, প্রদীপকে ট্রান্সফারের দশ দিন। আগে তুলে রেখেছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে রাখে। এক ধাক্কায় দশ হাজার টাকা এবার কমে গেছে।

বোম্বাই রোডের উপর অচল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে চন্দন ভাবল, বয়স বাড়ছে। দু-এক বছরের মধ্যেই টিম তাকে খারিজ করে দেবেই। আয় কমে যাবে। গাড়িটা কেনার কি কোনো দরকার ছিল? দশ বছর আগেও তো ট্রাম আর বাস ছিল তার সম্বল। তারও আগে আধপেটা দিন আর এখানে-ওখানে খেপ খেলা।

ত্রিপিত সিং খগপুরে ফিরে গেছে ডিস্ট্রিবিউটর বক্সটা সঙ্গে নিয়ে। গোলমাল ওটাতেই ঘটেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে চন্দন খড়ঙ্গপুরগামী একটা ট্রাককে হাত তুলে থামতে বলেছিল। অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যায়। তার পিছনে একটা প্রাইভেট মোটর ছিল। আপনা থেকেই সেটা থামে। দরজা খুলে দিয়ে পিছনে বসা লোকটি বলেছিল, আসুন।

চন্দন ঈষৎ গর্ব বোধ করেছিল। কিন্তু ত্রিপিত ছাড়া ব্যাপারটা দেখার জন্য আর কেউ ছিল। গত বছরও দুটো পত্রিকা তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। লিগ এখন মাঝামাঝি, ইতিমধ্যে তিন বার তার ছবি বেরিয়েছে। কয়েক লক্ষ লোক তার মুখ চেনে। শুধুমাত্র তাকে দেখেই গাড়ি থামে, এখনও থামে— দর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও। বাঙালিরা সত্যিই ফুটবল ভালোবাসে।

ওই গাড়িতে ত্রিপিত গেছে খঙ্গপুর। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। মনে হয়, ঘণ্টা দুই। গাড়ি পাহারা দেবার জন্য চন্দন রয়ে গেল। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে নেমে, দরজা লক করে সে পায়চারি শুরু করল।

রাস্তাটা এখানে–পাশাপাশি ছটা লরি যেতে পারে, এমন চওড়া। দু-ধারেই খেত, পাটের আর ধানের। প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টি হয়ে গেছে দু-সপ্তাহ আগে। কাল রাতেও হয়েছে। দূরে জমিতে লাঙল দিচ্ছে এক চাষি। চন্দন অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের জন্য তৃষ্ণা বোধ করল।

বোম্বাই রোড থেকে সরু সরু মাটির পথ বেরিয়ে গ্রামের দিকে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে ওইরকম এক পথের মুখে এসে পড়ল। কয়েকটা চালাঘরের দোকান। তার পাশে পাঁচিল ঘেরা এক কারখানা। গোটা তিনেক এক তলা কোয়াটার্স। একটা গ্রামেরও আভাস পাওয়া যায় গাছপালার আড়ালে।

কামারের দোকানের পাশে সাইকেল সারাইয়ের দোকান, তার পরেরটি চায়ের। দোকানের বাইরে বাঁশের বেঞ্চে দুটি লোক বসেছিল সুটকেস আর থলি নিয়ে। বোধ হয় এখানে বাস থামে। চন্দন তাদের পাশে বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখল সাড়ে দশটা।

দোকানটির শীর্ণ এবং জীর্ণ দশার মতো দোকানিটিও। শাড়িটার রং একদা লাল ছিল বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় ওর গায়ের রং একদা গৌর ছিল। হয়তো দেহেও লাবণ্য ছিল এবং তারুণ্যও। এখন দু-চোখে খিটখিটে উত্তাপ এবং পাড়ুর মুখ। একটি বছর দশ বয়সের ছেলে কয়লা ভাঙছে।

চা হবে?

চন্দন গলাটা চড়িয়েই বলল।

হবে।

বিস্কুট, চানাচুর, কেক ছাড়াও পাঊরুটি এবং বাতাসাও আছে। পান, বিড়ি, সিগারেটও একপাশে। সব কিছুই কমদামি, দেখে মনে হয় এদের অনেকগুলিই দীর্ঘকাল পড়ে রয়েছে।

এই মেয়েটি বা বউটিই তাহলে মালিক। এই তো দোকানের অবস্থা, চলে কী করে? স্বামী হয়তো কোথাও কাজটাজ করে। এইসব ভাবতে ভাবতে চন্দন চারধারে চোখ বুলিয়ে, মেদিনীপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে যথেষ্ট রকমের মন-জোড়ানো কিছু না পেয়ে আবার দোকানের দিকে তাকাল। তার মোটরটাকে সে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে।

দোকানে ছ্যাঁচা বেড়ায় একটা ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি আটকানো। চন্দন অলস চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, ছবিটা কীসের। ছবি যতটা বিবর্ণ তার থেকেও অপরিচ্ছন্ন কাচটা। ঠাওর করতে না পেরে, কৌতূহলবশেই সে উঠে ছবির কাছে এল।

স্ত্রীলোকটি চা তৈরি করতে করতে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল। প্রায় উলঙ্গ লোকটি পিটপিট করে তাকিয়ে। বেঞ্চে-বসা লোক দুটি উঠেছে, বোধহয় বাস আসছে।

মলিন কাচের পিছনে, চন্দন ক্রমশ বুঝতে পারল, একটা ফুটবল টিম। আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে সে যা আবিষ্কার করল, তাতে চমকে ওঠারই কথা। আইএফএ-র সাতচল্লিশ সালের টিম, যা বর্মা, সিঙ্গাপুর সফর করেছিল।

এ ছবি এখানে কে টাঙাল।

চন্দন স্ত্রীলোকটিকে লক্ষ করেই বলল।

ওর বাবা।

ছেলেটিকে মুখ তুলে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের ভঙ্গির মতো কণ্ঠস্বরও কর্কশ।

ছবিটা যুগের যাত্রীর টেন্টেও টাঙানো আছে। যাত্রীর চার জন এই টিমে ছিল। তাদেরনামগুলো চন্দন জানে।

খুব বুঝি ফুটবল ভালোবাসে?

জবাব এল না। স্ত্রীলোকটির বদলে ছেলেটি বলল, বাবার ছবি আছে ওটায়।

ভাঁড়ে না গেলাসে?

স্ত্রীলোকটি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে।

ভাঁড়ে।

চন্দন কৌতূহলভরে এবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় তোমার বাবা?

ও এগিয়ে এসে মাটিতে বসা চার জনের মধ্যে একজনের মুখে আঙুল রাখল।

শিবকৃষ্ণন।

চন্দন ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ছবির দিকে মুখ ফেরাল।

যুগের যাত্রীরই শিবকৃষ্ণন। ডাকসাইটে লেফট-ইন। ওর আমলে সব থেকে পপুলার প্লেয়ার। হায়দরাবাদের কোনো এক গ্রাম থেকে বাচ্চা বয়সে কলকাতায় এসে কালীঘাট স্পোর্টিং ইউনিয়ন ঘুরে দু-বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলে যুগের যাত্রীতে আসে। যখন ও খেলা ছাড়ে তখন চন্দনের বয়স বছর চারেক। প্রবীণরা যখন পুরোনো আমলের কথা বলে, তখন শিবকৃষ্ণনের নাম অবধারিত ভাবেই ওঠে।

থ্রু পাস দেবার নাকি মাস্টার ছিল। ধীর শান্তভাবে খেলত। হেডিং বা শুটিং তেমন ছিল না। খালিপায়েই খেলে গেছে। পায়ে আঠার মতো বল লাগিয়ে রাখত, জনা তিনেককে অবহেলায় কাটাতে পারত। শিবের মতো ইনসাইড আজ কলকাতার মাঠে নেই। এখন সামনে প্লেয়ার পড়লে কাটিয়ে বেরোতে ক-জন পারে? মনে আছে, কেওএসবি-র হেণ্ডারসনকে ছ-বার কী রকম কাটিয়েছিল।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের বল হোল্ড করে রাখা নাকি দেখার ছিল। নষ্ট হল নেশা করে। গাঁজা, চরস কিছুই বাদ ছিল না। এখনকার মতো পয়সা তো সে-আমলে পেত না। তবু বিশ-পঁচিশ যা পেত উড়িয়ে দিত। আহা, কী বল ছাড়ত।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। শিবের গল্প অনেক বার চন্দন শুনেছে। প্রথম দিকে বিস্মিত হত, পরের দিকে বিরক্ত। বুড়োদের কাছে যা ভালো, সবই পুরোনো আমলের। তখন নাকি প্লেয়াররা আদা ছোলা চিবিয়ে ক্লাবের জন্য জান দিত, টাকা পাওয়ার চিন্তাই করতে পারত না, তখনকার প্লেয়াররা নাকি ভদ্রতার বিনয়ে মাখনের মতো ছিল। আজ যে যুগের যাত্রী দেখছ, এত টাকা, এত ট্রফি, এসবের শুরু ওই আমল থেকে। ওরাই ক্লাবকে প্রথম সাসসেস এনে দেয়, রোভার্সে, ডুরাণ্ডে ফাইনালে সেমি-ফাইনালে ক্লাবকে তোলে, যাত্রীকে পপুলার করে, অল ইণ্ডিয়া নাম হয়।

সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়াবে। এসব কথা চন্দন মানে। বহু জায়গায় বক্তৃতায় সে ছটোদের উপদেশও দিয়েছে-বড়োদের শ্রদ্ধা করবে, অতীতকে ভুলবে না। নিজেও সে অতীতের নামি ফুটবলার দেখলেই প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে। তারপর দেখে চারপাশের লোক সপ্রশংস চোখে তার দিকে তাকিয়ে, তখন নিজেকে খানিকটা লম্বা মনে হয়।

শিবকৃষ্ণন তোমার বাবা?

চন্দনের কণ্ঠে পরিষ্কার অবিশ্বাস। ছেলেটি লাজুক চোখে স্ত্রীলোকটির দিকে তাকায়।

হ্যাঁ। ভাঁড়টা এগিয়ে ধরে বলল।

চন্দন সেটা নিয়ে বলল, আপনি?

বউ।

উনিই তো যুগের যাত্রীর শিবকৃষ্ণন?

কী জানি।

কী জানি।

চন্দনের বিস্মিত প্রতিধ্বনিতে ভ্রূ কুঁচকে স্ত্রীলোকটি তাকাল।

উনি তো ফুটবল খেলতেন?

হবে। আমি ওসব কিছু জানি না!

উনি কোথায়?

ঘরে।

কিছু করছেন কি, মানে ব্যস্ত? দেখা হতে পারে?

করবে আবার কী, যা করার সে তো আমিই করি। দিনরাত তো বিছানাতেই পড়ে থাকে।

কিছু হয়েছে কি ওঁর?

মাথার যন্ত্রণা, হাঁটুতে ব্যথা, বুকে হাঁপানি, সর্দি কাশি—আপনি কি ওর চেনা? হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিতে পারেন?

চেষ্টা করতে পারি।

শিবকৃষ্ণনের বউ চন্দনের মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে ছেলেকে বলল, আমি এখন দোকান ছেড়ে যেতে পারব না, তুই সঙ্গে করে নিয়ে যা।

ছেলেটির সঙ্গে চন্দন কয়েক পা এগোতেই ডাক পড়ল, চায়ের পয়সাটা দিয়ে যান।

দাম চুকিয়ে সে রওনা হল, গাড়িটা খারাপ হওয়া এখন তার কাছে শাপে বর মনে হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে সবাইকে চমকে দেবে।

শিবকৃষ্ণনকে সে খুঁজে বার করেছে, কথা বলেছে। সবাই তো ধরেই নিয়েছে, ও মারা

গেছে।

জ্যান্ত শিবকৃষ্ণনকে দেখে আসার গল্প করলে সবার আগে দৌড়ে আসবে তো খবরের কাগজের, ম্যাগাজিনের লোকেরা।

অল্প দূরেই ছোট্ট একটা কুঁড়ে। একখানিই ঘর। দরজায় দাঁড়িয়ে চন্দন ভিতরে তাকাল। দেয়ালে এক হাত গর্ত, এটাই ঘরের জানালা। ওর মনে হল নীচু তাপপাশে একটা লোক শুয়ে। ঘরে আসবাব কিছুই নেই। গোটা দুই অ্যালুমিনিয়াম থালা আর একটা মগ মেঝেয় উপুড় করা। একটা মাটির হাঁড়ি, জলের কলসি, আর কয়েকটা শিশি। তক্তাপপাশের নীচে টিনের সুটকেস, এক জোড়া পুরোনো চটি। দেয়ালে দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। কুলঙ্গিতে কয়েকটা কৌটো আর বিঘতখানেকের আয়না।

লোকটি অর্থাৎ শিবকৃষ্ণন, যে কলকাতা বা ভারতের ফুটবল মাঠে সাতাশ বছর আগে শিব নামে খ্যাত ছিল—পাশ ফিরে শুয়ে। পরনে জীর্ণ লুঙ্গি মাত্র।

ছেলেটি পিঠে ধাক্কা দিতেই চিত হয়ে মুখ ফেরাল।

আমি কলকাতা থেকে এসেছি। গাড়িটা খারাপ হয়ে বন্ধ হতে চা খাবার জন্য দোকানে বসি। ছবিটা দেখে ভাবলুম দেখেই যাই মানুষটাকে, এত গল্প শুনেছি আপনার সম্পর্কে।

শিব উঠে বসল। ছবির লোকটির সঙ্গে চেহারার কোনো মিল নেই। কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফে গালের গর্ত ঢাকা, হাত দুটো লাঠির মতো সরু, বুকের প্রায় সব পাঁজরই গোনা যায়। শুধু মাথাটার আকৃতি থেকে অনুমান করা যায় এই লোকই শিবকৃষ্ণন। দেহের সঙ্গে বেমানান আকারের বেঢপ মাথাটা, কপাল মাত্রাতিরিক্ত চওড়া। অথচ হেডিং নাকি খুবই বাজে ছিল।

আমার বিষয়ে গল্পই শুনেছেন, নিশ্চয় খেলা দেখেননি। বয়স কত?

দুর্বল কণ্ঠস্বর। প্রায় চল্লিশ বছর বাংলায় বাস করে নিখুঁত বাংলা উচ্চারণ।

না, দেখিনি, ওই ছবিটা যখনকার তখনও আমি জন্মাইনি। আপনার কী অসুখ? সিরিয়াস কিছু কি?

না না, অসুখটসুখ কিছু নেই। এরকম শরীর খারাপ ফুটবলারদের তো হয়ই, বল নিয়ে

আধঘণ্টা মাঠ এধার-ওধার করলেই ঠিক হয়ে যায়।

আপনি কি এখনও মাঠে নামেন না কি?

চন্দন অবাক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। এই শরীর, এই বয়স-বলে কী!

মাঠে নামব যে, মাঠ কোথায়, বল কোথায়? একটু হেসে বলল, বয়স কোথায়, হেলথ কোথায়? আসলে আমার মনে হয়, ফুটবলারের শরীরের অসুখ সারাতে পারে শুধু খেলে, বল খেলে। দাঁড়িয়ে কেন বসুন বসুন।

তক্তার তলা থেকে ছেলেটা একটা রবারের বল বার করে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। দূর থেকে ওর মায়ের চিৎকার শুনেই বলটা ফেলে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল।

বউ আমার বাঙালি, এখানকারই মেয়ে। কলকাতার হোটেলে কাজ করত, আমিও করতুম, তখন পরিচয় হয়। আমার জন্য অনেক করেছে, এখনও করে।

আপনার এই অবস্থা—ফুটবলারদের সাহায্য-টাহায্য, পেনশন এসব তো দেওয়া হচ্ছে, অ্যাপ্লাই করুন-না।

যেভাবে তাকিয়ে আছে, চন্দনের মনে হল না তাতে অভিমান রয়েছে। অথচ বুড়োরাই তো বেশি অভিমানী হয়।

টাকার তো সবসময়ই দরকার।

আমি তাহলে ফুটবল খেললাম কেন, অন্য কিছু করে টাকা রোজগার করতে পারতাম তো। খেলে তো টাকা পেতাম না।

চন্দন অস্বস্তি বোধ করল। সত্যিই তো, তারা কীসের জন্য খেলত। হাততালির জন্য। এইটুকু ছাড়া আর কী?

আপনি কোনো খেলাটেলা করেন?

চন্দন বলতে যাচ্ছিল, আপনার ক্লাবেই এখনও আমি স্টার গণ্য হই। কিন্তু বলতে গিয়ে গলাটা কে যেন চেপে ধরল। কোনোক্রমে বলল, একটুআধটু ফুটবলই।

অ।

শরীরে রোগ নেই, আর্থিক কষ্ট নেই, ভালোই আছি। চন্দনের মনে হল এই বুড়োটা একটু যেন হামবড়া ধরনের।

আপনি খেলাটেলা দেখেন?

বছর পাঁচেক আগে খড়গপুরে একটা ম্যাচ দেখেছি, তাও ষোলো বছর বাদে।

পাঁচ বছর আগে চন্দন খঙ্গপুরে একটা এগজিবিশন ম্যাচ খেলে গেছে। দেড়শো টাকা নিয়েছিল। সেই ম্যাচটাই কি?

কী মনে হল, এখনকার প্লেয়ারদের।

চুপ করে রইল।

আপনাদের সময়ে আর এখনকার সময়ের খেলায় অনেক বদল হয়ে গেছে।

কিন্তু স্কিল, সেন্স, শুটিং এসব?

এবার চন্দন চুপ করে রইল।

আমার খালি রসিদের, সোমানার, মেওয়ার, আমার কথা মনে পড়ছিল।

এবার চন্দন আড়চোখে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু-ঘণ্টা কেটেছে, ত্রিপিতের ফেরার সময় হল। দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। কাল ম্যাচ পোর্টের সঙ্গে। ইজি ব্যাপার, তাহলেও তাড়াতাড়ি ফিরে রেস্ট নিতে হবে। তিনটে দিন খুবই ধকলে কেটেছে।

যেসব গোল মিস করছিল…

হঠাৎ চন্দনের ইচ্ছে হল এই লোকটিকে কষ্ট দিতে। এই নাক-সিটকানো ভাবটা সে অনেক দেখেছে। ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।

জানেন কি এখন ফুটবলাররা কেমন টাকা পায়?

না, কাগজ পড়তে পারি না, লেখাপড়া করিনি।

চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট হাজারও।

আমি এক বার দুশো টাকা পেয়েছি মোহনবাগানকে গোল দিয়ে। বকাইবাবু দিয়েছিল খুশি। হয়ে। কমল ওইরকম বল না দিলে গোলটা পেতাম না। ওকে একশো দিয়েছিলাম।

এখনকার অনেক প্লেয়ারেরই গাড়ি আছে, অনেকেই বাড়ি করেছে, দোকান ব্যাবসা কেঁদেছে, হাজার হাজার টাকা জমিয়েছে।

কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের কোনো একটা দিনে ফিরে গিয়ে ও বোধ হয় সেই গোলটা দেখতে পাচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

আমার হেডিং নাকি খারাপ, অথচ গোলটা পেয়েছিলাম হেড করে। বাজে কথা রটানো হয়েছিল আমার সম্পর্কে। জীবনে অনেক গোলই আমি হেড করে দিয়েছি।

তক্তাপোশ থেকে নেমে রবারের বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চন্দনকে দিল। হাত ধরে ওকে ঘরের বাইরে আনল।

এটা ছুড়ুন। আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে গোলটা করেছি, ছুড়ুন।

চন্দন বিব্রত হয়ে, কিছুটা মজাও পেয়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার উপর তুলে দিল। হাত মুঠো করে, অল্প কুঁজো হয়ে ও তৈরি।

বলটা ওর কাঁধের উপর পড়ল। ফসকে গেছে। চন্দন কুড়িয়ে নিয়ে এবার আরও আলতো আরও উঁচু করে তুলে দিল।

মুখ তুলে অপেক্ষা করছে শিবকৃষ্ণন। বলটা যখন মাথার কাছাকাছি তখন বাঁ ধারে হেড করার জন্য মাথা ঝাঁকাল। ওর থুতনির উপর পড়ল।

অপ্রতিভ হয়ে শিবকৃষ্ণন বলটার দিকে তাকিয়ে রইল মুখ নীচু করে।

আবার দিন।

চন্দন আর তিন বার বল শুন্যে ছুড়ল। তিন বারই ও ফসকাল।

থাক!

না না, আমি পারব, আপনি আবার ছুড়ুন।

দূর থেকে পর পর দু-বার মোটরের হর্ন ভেসে এল। ত্রিপিত নিশ্চয়।

থাক আপনার শরীর খারাপ।

আর এক বার, শুধু এক বার।

বৃদ্ধ যেন ভিক্ষা চাইছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল চন্দনের।

এই শেষ বার।

শিবকৃষ্ণন অপেক্ষা করছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, ঘাড় এবং বাহুরশিরাগুলো ফুলে উঠেছে। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদ। পিছনে শাখাপ্রশাখা মেলা বিরাট এক বট গাছ। তার পিছনে বিস্তৃত খেত। কচি ধানের চারা। লাঙল দিচ্ছে চাষি। ডান দিকে একটা ডোবা। কলা গাছ। দূর থেকে ভেসে এল ইলেকট্রিক ট্রেনের ভেঁপু। এইসবের মধ্যে এককালের ফুটবলার, প্রায় অসমর্থ, পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের যৌবনে ফিরে যাবার জন্য জেদ ধরে দাঁড়িয়ে। জীবনে শেষ বারের মতো ও একটা হেডিং দেখাতে চায়।

যদি এবারও ফসকায়? দূরে অধৈর্যভাবে হর্ন বাজল।

এবার যদি ফসকায়, তাহলে বৃদ্ধ চুরমার হয়ে যাবে। বরং থাক, ওর হেড করা দেখে কোনো লাভ নেই। চন্দন বলটা মাটিতে ফেলে দিল।

কী হল?

না। আমার সময় নেই, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।

শুধু এক বার, এই শেষ!

চন্দন হাঁটতে শুরু করেছে। ওর পিছনে পিছনে আসছে শিবকৃষ্ণন।

কতটুকু সময় আর লাগবে, এক বার…হেড করতে পারি কি না-পারি দেখাব। কলকাতায় গিয়ে আপনি বলবেন, শিবের হেডিং দেখেছি, হ্যাঁ ষাট বছরের শিবের…একটুখানি, এক মিনিটও লাগবে না…

চন্দন হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধ ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বোম্বাই রোডে পা দিয়ে চন্দন এক বার তাকায়। বিরাট মাঠ, বিরাট বট গাছের পটভূমিতে জীবনের কিনারায় পৌঁছোনো ক্ষীণ চেহারার একটা মানুষকে সে দেখতে পেল।

একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটতে গিয়েও ঘটল না। চন্দন তখনই ঠিক করল, জ্যোতিষীর কথামতো কালই মুক্তোর আংটি গড়াতে দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *