তাপের শীর্ষে

তাপের শীর্ষে

নাড়ু, তোর মা মরে গেছে।

সন্তোষ একটু নুয়ে কথাটা বলল। নাড়ু তাকিয়ে ছিল বাসটার দিকে। এইমাত্র যে ছেলেটা উঠল, একটু আগেই সে নাড়কে জিভ দেখিয়েছিল। নাড়ু দোতলা বাসটার দিকে তাই তাকিয়ে ছিল।

হাতের থলিটায় কাপড় আছে, মা আনতে বলেছিল। পেয়ারা আছে, মা খেতে ভালোবাসে। থলিটা দু-হাতে বুকের কাছে আঁকড়ে নাড়ু তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। চোখ সরিয়ে নিল সন্তোষ। আকাশটা ঘোলাটে। আজকেও বৃষ্টি হবে। ফুটপাথটা ন্যাড়া। নীলরতন সরকার হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে ঘাস উঠেছে।

ঘাস মাড়িয়ে সন্তোষ হাঁটছিল। পিছনে নাড়ু আসছে। সন্তোষ ঘুরে দাঁড়াল।

তুই আর আসিসনি, এখানেই থাক। আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।

কেন?

ব্যবস্থা করতে হবে তো। সার্টিফিকেট না দিলে কিছুই তো করা যাবে না। নাড়ু দাঁড়িয়ে থাকল। বাবা চলে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ডানদিকের ঘরের কোণের বেডে মা আছে। সিঁড়ির পাশেই খাঁচার মতো লিফট নেমে এল। কখনো সে ওঠেনি। দরজা খোলার সময় ছড়াৎ শব্দ হল। মাথায় রুমালবাঁধা মেয়েলোকটা লিফট থেকে বেরোবার সময় তাকিয়ে গেল। ও কি কমলাদির মতো বিধবা? কমলাদি মাছ খায় না, কমলাদি মা-র কাছে এসে রোজ দুপুরে গল্প করত। একদিন কাঁদছিল মা-র কোলে মুখ গুঁজে। দুটো লোক লিফটে ঢুকল। চৌকো লোহাটা দেয়াল বেয়ে নামতে নামতে থামল। তারের দড়ি কাঁপছে। ওপর থেকে লিফটের দরজা খোলার শব্দ এল।

নাড়ু হাসপাতালের গেট পার হয়ে ফুটপাথে দাঁড়াল। বাস যাচ্ছে। দোতলা থেকে একটা লোক থুথু ফেলল। রাস্তার গর্তে এখনও বৃষ্টির জল জমে। গর্তের চারপাশে খোয়া-ছড়ানো। ট্যাক্সিটা গর্ত মাড়িয়ে গেল। খোয়া ছিটকে এসে গায়ে লাগতে পারত।

নাড়ুর ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সরে এসে গেটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। থলিটা বুকে চেপে কুঁজো হয়ে নাড়ু কাঁদল। কাঁদল অনেকক্ষণ ধরে। শুধু একটি বুড়ি যেতে যেতে ওকে দেখে একটুক্ষণ দাঁড়াল, কাছে আসার জন্য পা বাড়িয়েও কী ভেবে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। নাড়ু জোরে কাঁদেনি। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছিল। পিঠটা অল্প অল্প কাঁপছিল। খুব কাছে কেউ এলে শুনতে পেত গুনগুন গানের মতো একটা সুর। ওর পিছন দিয়ে অনেক মানুষ চলে গেল। কেউ কেউ তাকিয়েছিল। শুধু বুড়িটা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে চলে গেছল। অনেকক্ষণ পরে জামার হাতায় চোখ মুছে নাড়ু দোতলা বাস দেখতে লাগল।

অল্পবয়সি ডাক্তার দুঃখ জানালেন। বললেন, আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি। হঠাৎ পরশু থেকে—আপনি তো দেখেই গেছলেন। কাল থেকে গ্লুকোজ স্যালাইন চলছিল। এরপর ডাক্তারবাবু বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে গেলেন। সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে আবার বললেন, সার্টিফিকেট আমি এখুনি দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি।

সন্তোষ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। পর্দা সরিয়ে একটি নার্স উঁকি দিয়ে গেল। ওষুধের গন্ধ আসছে। ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে বারান্দায়। জমাদার দড়িবাঁধা সোয়াবটা ছুড়ে ছুড়ে নিশ্চয় বারান্দা সাফ করছে। ফরফর করে উড়ল টেবিলের কাগজ। ডাক্তারবাবু কাচের ড্যালাটা নিয়ে লোফালুফি করছেন।

বারান্দায় বেরিয়ে এল সন্তোষ। থুথু ফেলল কাঠগুঁড়োর বাক্সে। বারান্দার বাঁ-ধারে দুটো কেবিন। পর্দা ঝুলছে। খাটে বসে গল্প করছে একটি জোয়ান। সিঁদুরপরা একটি মেয়ে কমলালেবু ছাড়াচ্ছে। ডান দিকে অনেক দরজা। দরজায় পর্দা নেই। সারি সারি ওয়ার্ড। সেই বাচ্চা মেয়েটির পায়ে-বাঁধা ভারী লোহাটা এখনও ঝোলানো রয়েছে। অনেক দিন ও এখানে আছে। হাউহাউ করে একদিন কেঁদেছিল বাড়ি যাবার জন্য। ও ভালো হয়ে যাবে একদিন। একদিন বাড়ি ফিরে যাবে।

হাসপাতালের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে। একপক্ষ বুঝি গোল দিল। সন্তোষ মুখ ফিরিয়ে এক বার তাকাল। মাঠটাকে ঘিরে থোকা থোকা মানুষ, যেন কালো পিঁপড়ের সারি। দেখতে বেশ লাগে। সেই বইওয়ালাটা আসছে। ও রোজ একগাদা পত্রিকা সঙ্গে করে আনে। পা-ভাঙা মেয়েটিকে একখানা বই কিনে দিলে কেমন হয়। পকেটে হাত দিল সন্তোষ। খড়খড় করল চারখানা দশটাকার নোট।

বুকে হাত জড়ো করে মেয়েটি শুয়ে আছে। সন্তোষ পাশে এসে দাঁড়াল। তাকাল মেয়েটি। অবাক হয়ে গেছে।

কেমন আছ?

ভালো।

বাড়ি থেকে কেউ আসেনি?

এসেছিল, চলে গেছে।

সন্তোষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটি।

একে বই কিনে দিয়ে কী লাভ! একে খুশি করে কী আনন্দ পাব! অন্যের আনন্দ দেখে আমার কী দরকার মিটবে! আমার তো কিছুর দরকার নেই। সন্তোষ পাশের বেড়ে তাকাল। বেডটা খালি। লাল কম্বলে ঢাকা। হয়তো আজকেই কেউ এসে যাবে। কোণে সেই হাসিখুশি ফর্সা মেয়েটির নাকে অক্সিজেনের নল। আজ সকালে নিশ্চয় অপারেশন হয়েছে। ওকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চয় ওর মা। উনি কাঁদছেন। মেয়ের বিপদ কেটে গেছে তাই কাঁদছেন। বমি করছে মেয়েটি। আঁচল দিয়ে মা মুখ মুছিয়ে দিলেন। ওই ছেলেটি কালকেও বোকার মতো বসেছিল। মেয়েটিকে কাল বিরক্ত দেখেছিলুম। আজও বিরক্ত করতে এসেছে। কেন আসে?

সন্তোষ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল। সকলে ওর দিকে তাকাল, মেয়েটি কথা বলছে। কথা বলা ওর এখন উচিত নয়। চোখটা ভিজে ভিজে, কাঁদছে, বোধ হয় কষ্ট হচ্ছে। নীচু হয়ে সন্তোষ ছেলেটিকে বলল, কথা বলতে দিচ্ছেন কেন, তাতে বমি আরও বাড়বে।

চুপ করে মেয়েটির মুখের দিকে ছেলেটি তাকিয়ে বসে রইল। ছেলেমানুষ, এখনও সংসারের আঁচ গায়ে লাগেনি। ও চিরকাল হয়তো এমনি করে বোকার মতো তাকিয়ে থাকবে। সন্তোষ পিছন দিকে তাকাল। পাশে তাকাল। সব কটা বেডের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে। ওরা কেন তাকিয়ে রয়েছে তা জানি। ওরা ফিসফিস করে কী বলছে তাও জানি। ওরা কৌতূহলী হয়ে পড়েছে। আমি এখনও কেন কাঁদছি না; ওরা খুশি হবে কাঁদলে। কিন্তু কেন কাঁদব!

ঘরের আর এক কোণের সেই বেডটা লালপর্দায় ঢাকা। সন্তোষ পর্দার পাশে দাঁড়াল। সারা ঘরের মানুষ এখন আমার দেখছে। একটু ঝুঁকে উঁকি  দিলেই পর্দার ভিতরটা দেখা যাবে। কিন্তু কী দেখব? ওই মানুষগুলো রোজ আমায় আসতে দেখেছে, দিনের পর দিন, তবু ওরা আমায় দেখছে। ওরা নতুন কিছু-একটা আমার মধ্যে দেখতে চায়। কিন্তু আমি কী দেখাব? সেই মানুষটা আছে কি? হাসপাতালে আসার আগের মানুষটা! ও আগে হাসত, রাগ করত, রাগ ভাঙাবার জন্য অপেক্ষা করত। তারপর দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে থেকে স্বভাব বদলে গেল, চেহারা বদলে গেল। তার মানেই ও নতুন হল কি? নতুন কথাটার মানে কী? ওকে আগে দিনরাত কাছে পেতুম, কিন্তু হাসপাতালে মাত্র দু-ঘণ্টার সম্পর্ক তৈরি হল। বাঁধা সময়ে রোজ এক ধরনের কথা বলা আর শোনা। ক্লান্ত হয়ে পড়তুম, হাঁপিয়ে উঠতুম, ভালো লাগত না আর আসতে। আজ সেই একঘেয়েমির হাত থেকে রেহাই পেলুম। তবে কেন কাঁদব? ওদের আশা পূরণ করতে কেন কষ্ট করব!

উঁকি দিলেই পর্দার ভিতরটা দেখা যায়। সন্তোষ না দেখে বারান্দায় বেরিয়ে এল। এবার হাঙ্গামা অনেক। আগে সার্টিফিকেটটা নিতে হবে, শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতায় চেনাশোনা কেউ নেই। কারুর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

সবই ভগবানের হাত।

চমকে উঠল সন্তোষ। বইওয়ালা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা কথাটা বলেছে।

হ্যাঁ, চেষ্টার তো ত্রুটি হয়নি। বহুদিন ভুগল।

কী হয়েছিল?

টিউমার, দু-বার অপারেশন হয়েছে, ধকলটা সামলাতে পারল না।

সন্তোষ বারান্দার বাইরে তাকাল। পুরো বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরা। কেন, রোগীরা যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে! মরাটা কি ভগবানের হাতে? হ্যাঁ তো বললুম, না ভেবেই বললুম। অমন না ভেবে আমরা অনেক কথাই বলি! আমার এখন মুখের ভাব বিষণ্ণ করা উচিত। নয়তো লোকটা কিছু মনে করতে পারে। কিন্তু যদি না করি তাহলে কী হয়। আজ বৃষ্টি হবে। না হলেই ভালো। ক-টা বাজল? যত রাত হবে ততই অসুবিধে। কলকাতাটাকে তো দিনের বেলাতেই ধাঁধা মনে হয়।

বাড়িতে আর কে আছে?

কেউ না! শুধু একটা বছর চারেকের বাচ্চা!

মুখের চুকচুকানি শব্দটা শুনতে বেশ লাগে। লোকটা সত্যিই বেশ ভালো। একটা বই কিনে সাহায্য করা উচিত। বইওয়ালার হাত থেকে সন্তোষ একটা পত্রিকা তুলতে যাচ্ছিল। খপ করে বইওয়ালা কেড়ে নিল। সন্তোষের হাত দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, শান্ত হোন। ছেলের মুখ চেয়ে বুক বাঁধুন! অস্থির হলে কি চলে?

নাড়টা এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিকই বলেছে বইওয়ালা। ছোটো ছেলে, ওকে এখনই খাইয়ে দেওয়া উচিত। হাঙ্গামা চুকতে ক-টা বাজবে কে জানে!

কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না! কলকাতায় চেনাশোনা তো কেউ নেই।

চারটে লোকও নেই?

না, কারখানায় ছুটি হয়ে গেছে। এখন আর সেখানেও কাউকে পাব না।

তাহলে তো সৎকার-সমিতিতে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

লোকটা ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছে এরপর করণীয় কাজগুলোর। অনেক কাজ। কিন্তু এখন যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে কী হয়! ওরা অপেক্ষা করবে, আমার বাড়িতে খবর দেবে। না এলে গাদায় ফেলে দেবে।

সঙ্গে টাকা আছে তো?

আছে।

আর দেরি করবেন না।

হ্যাঁ যাচ্ছি।

হাঁটতে শুরু করল সন্তোষ। কালকেই বুঝেছিলাম ও আর বাঁচবে না। আজ পোস্টাপিস থেকে টাকা তুলে রেখেছি। সেভিংসের লোকটা খচ্চর। একেবারে কোনো সময়েই সই মেলে না। আজ মিলে গেছে। বোধ হয় ওর মেজাজ ভালো ছিল। বইওয়ালা জিজ্ঞেস করল সঙ্গে টাকা আছে কি না। যদি বলতুম নেই, তাহলে কি ও দিত! নিশ্চয় দিতে পারত না। ও কি আমায় আশ্বস্ত করতে চাইল? না কি পরে একসময় একথা বলেছি বলে নিজেকে বিবেকবান ঠাউরে আনন্দ পাবে।

বাবা।

তুই এখানে এলি কেন?

সিঁড়ির শেষ ধাপে সন্তোষ দাঁড়িয়ে। দারোয়ান তাকিয়ে আছে, ওর একটা হাত নাড়ুর। কাঁধে। সান্ত্বনা দিচ্ছিল। অথচ ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল।

আমি ওপরে যাব।

কেন?

মাকে দেখতে চায় ছেলেটা। দেখে কী করবে। চোখ উলটে আছে হয়তো, কিংবা জিভটা ঝুলে আছে। ঠোঁট চাটা অভ্যেস। রেগে গিয়ে যখন কথা বলতে পারে না তখন ঠোঁট চাটে। মরার সময় হয়তো রেগে উঠেছিল। বুক পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল তো! কিন্তু রাগার সঙ্গে বুকের কী সম্পর্ক, সে তো মাথার।

বাবা, দেখতে যাব।

কী দেখবি? দেখার আর আছে কী?

নাড়ুর কাঁধে হাত রেখে সন্তোষ হাঁটতে শুরু করল। অন্ধকার হয়ে আসছে। যারা রোগী দেখতে এসেছিল ফিরে যাচ্ছে। নার্সেস কোয়ার্টারে কেউ গান গাইছে। আউটডোরের দরজায় কাতরাচ্ছে মাঝবয়সি এক সধবা। হাতের তিনটে আঙুল ঘেঁচে গেছে।

ট্রামরাস্তা পার হয়ে ওরা তিনটে হোটেল পেল।

নাড়ু, কিছু খেয়ে নিবি নাকি?

খিদে নেই!

পরে পাবে, খেয়ে নিলে হত।

না, খিদে নেই।

নাড়ু তুই এখানে থাক। আমি সৎকার-সমিতির অফিসে যাচ্ছি, এখুনি ফিরব। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সন্তোষ কথাগুলো বলল।

এক প্যাকেট সিগারেট কিনি।

মা তোমায় সিগারেট খেতে বারণ করেছিল।

থমকে পড়ল সন্তোষ। ছেলেটা মনে করে রেখেছে। ওর সামনেই একদিন কথা হয়েছিল বটে। মরার সঙ্গে স্মৃতির একটা যোগ আছে। পুরোনো মানেই তো মৃত। স্মৃতিও তাই। স্মৃতি জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলে। কী দরকার পুরোনো কথা মনে রাখার! রাত্রে অপারেশন হয়েছিল। সারারাত গেটে বসেছিলুম। ভোর বেলায় দারোয়ানকে বলেছিলুম একটু খবর এনে দিতে। ও যেতে রাজি হয়নি। ঝগড়া হয়েছিল। আমাকে আটকেছিল, ভেতরে যেতে দেয়নি। গালাগালি দিয়েছিলুম। কিন্তু এখন ও আর আমায় আটকাবে না। এখন আর ওর ওপর রাগ নেই, কিন্তু সেদিন অসম্ভব রেগে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তায় তখন জল দিচ্ছিল। দাঁড়ালুম, পাশে ছিল সিগারেটের দোকান। সাড়ে তিন বছর পর খেলুম পর পর তিনটে।

সিকিটা পালটে দাও ভাই।

প্যাকেট খুলতে খুলতে সন্তোষ পিছনে তাকাল। বুকের অসুখ এখনও সারেনি। বেশি জোরে টান দেওয়া ঠিক নয়। ওর ভয় ছিল সিগারেট খেলে আমি শিগগিরই মরে যাব। কিন্তু ও-ই আগে মরল। বেঁচে থাকতে খাইনি, আমার নিজের মরার ভয়ে না ওর কথা রাখতে!

বাবা!

তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমার বেশি দেরি হবে না।

জোরে জোরে টান দিয়ে সন্তোষ সিগারেটটা ফেলে দিল। বাসটা এসে গেছে।

তুই থাক, কেমন।

আকাশটা মেঘলা। মাথা নীচু করে নাড়ু আস্তে আস্তে হাঁটল। মা বলত, নাড়ু বৃষ্টি হবে, ইশকুল যাসনি। বলত, তোর বাবার গেঞ্জিটা এখনও শুকোল না, এসে রাগ করবে। তোর বাবা পোস্তর বড়া খেতে ভালোবাসে, লক্ষ্মীটি চট করে কানাইয়ের দোকান থেকে ঘুরে আয়।

ইটের টুকরোটায় শট মারল নাড়ু, রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ল। ওটা যদি ট্রামলাইনের ওপর পড়ত তাহলে ট্রামটা গুঁড়িয়ে দিয়ে যেত। ট্রামের তার থেকে অমন বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে কেন! মা বলেছিল আকাশের বিদ্যুৎকে মেশিনে জমা করে রাখে। তাই থেকে খরচ হয়। বিদ্যুৎ চমকায় শুধু বর্ষাকালে, তাও মাঝে মাঝে। ওইটুকুতে সারা বছর এত আলো হয় কী করে? সেই ছেলেটা আমায় জিভ ভেঙিয়ে গেছে। ওর মা যদি জানতে পারে তাহলে কি বকবে?

মাথা নীচু করে হাঁটতে হাঁটতে নাড়ু হাসপাতালের মধ্যে ঢুকল। চুপচাপ। থমথমে। আউটডোরে গল্প করছে দুটি ছাত্র। সধবাটির হেঁচা আঙুলে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছে কম্পাউণ্ডার। একটা বেড়াল ঢুকল। গোড়ালি ঠুকল একজন। বেড়ালটা বেরিয়ে গেল। হাফ প্যান্টপরা ওয়ার্ডবয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঝিমোচ্ছে। এই বাড়িটা ছাড়িয়ে আর একটা রাস্তা। নাড়ু রাস্তায় নামল।

গন্ধ আসছে। ওষুধের গন্ধ। কুনিপিসির ছেলে হবার সময় এমন গন্ধের ওষুধ এসেছিল। মা দু-রাত্তির ওদের বাড়ি ছিল। কুনিপিসি মরে গেল, সবাই কাঁদলে মাও কাঁদল। কুনিপিসি বাবার বোন নয়, পাশের বাড়িতে থাকে। বাবা কাঁদল না।

এসো খোকন, এখানে বসো।

দারোয়ান নাড়কে ডাকল। গুটিগুটি ওর পাশে নাড়ু দাঁড়াল। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে চুপ করে বসে রইল দারোয়ান। ছড়াৎ করে লিফটের দরজা খুলল। খট খট করে চলে গেল এক ডাক্তার।

ওপরে যাবে, দেখতে?

চুপ করে রইল নাড়ু।

যাও।

দারোয়ান পিঠে হাত রেখে চাপ দিল। পায়ে পায়ে নাড়ু সিঁড়ির দিকে এগোল। জুতোর শব্দ হচ্ছে ঠিক ওই ডাক্তারের মতো। জুতো কিনতে যাবার সময় মা বলে দিয়েছিল ফিতেওয়ালা কালো রঙের জুতো কিনতে। বাবা মা-র জন্য একটা চটি কিনেছিল, কালো রঙের।

খোকা দাঁড়াও, উঠে এল দারোয়ান। লিফটে চড়বে?

নাড়ু ঘাড় কাত করল।

এই জগদীশ, খোকাকে দোতলায় নিয়ে যা।

নাড়ু লিফটের মধ্যে ঢুকল। বোতাম টিপতেই গোঁওও শব্দ উঠল। ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট উঠতে শুরু করল। দারোয়ান হাসছে। ওর জুতো, হাঁটু, পেট, মাথা দেয়ালে ঢাকা পড়ে গেল। বুক শিরশির করছে। সেই চৌকো লোহাটা এখন নীচে নেমে আসছে। পেটের নীচে ব্যথা করছে। মা রোজ রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে নর্দমায় বসিয়ে দিত। মা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত, নইলে ঘুমের ঘোরে পড়ে যেতুম।

লিফট থামতে নাড়ু বেরিয়ে এল। লিফট আবার নীচে নেমে গেল। চৌকো লোহাটা ওপরে উঠতে উঠতে থেমে গেল। লোহার দড়িটা কাঁপছে। যদি দড়িটা ছেড়ে। নাড়ুর বুক কাঁপল, বাজ পড়ার শব্দে এমন করে বুক কাঁপত। ছুটে মাকে জড়িয়ে ধরতুম।

বারান্দা ধরে নাড়ু হাঁটতে শুরু করল। কেবিনে একটা লোক খাটে শুয়ে বই পড়ছে। বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘেরা। পাখিরা আসতে পারবে না। জুতোর শব্দ হচ্ছে। রোগীরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। একেবারে শেষের দরজায় নাড়ু দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে চেয়ারে বসে নার্স কী লিখছিল। ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েও আবার বসে পড়ল।

আঙুলে ভর দিয়ে নাড়ু ঘরে ঢুকল। সবাই দেখছে। মাথা নীচু করে লাল পর্দা-ঘেরা খাটের পাশে না দাঁড়াল। এবার কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু রোগীদের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

এইটিই তো আসত বাপের সঙ্গে।

হাঁ। একটি ছেলে।

তবু রক্ষে, মাত্র দুটি। আমার মতো হলে বাপের অবস্থাটা ভাবুন তো!

ভাবব আর কী, আবার বিয়ে করবে।

ইস, অতই সোজা!

সাদা চাদরে মুখ পর্যন্ত ঢাকা। নাড়ু সাবধানে চাদরটা গলা পর্যন্ত নামিয়ে দিল। চোখ বোজানো। মুখটা একটু ফাঁক করা। চোখের কোলে কালি। নাড়ু দাঁড়াল, চোখের পাতা যেন ভিজে ভিজে। কেঁদেছিল।

চাদর দিয়ে নাড়ু চোখ মুছিয়ে দিল। কপালটা চওড়া দেখাচ্ছে। চুলগুলো পাতলা হয়ে গেছে। জট পড়েছে। কমলাদি মাঝে মাঝে খোঁপা বেঁধে দিত, এখন যদি আঁচড়ে দিই তাহলে কি নার্স এসে আমায় বকবে?

খাটের লাগোয়া ছোট্ট আলমারিটা নাড়ু খুলল। চিরুনি, সিঁদুরকৌটো, আয়না, সাবান, মাজন, তেলের শিশি। সবগুলো এক বার হাতে করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কান পাতল, নার্সের জুতোর শব্দ শোনা যায় কি না।

উনিও বলেন, গানের মধ্যে রবীন্দ্র সংগীতই সবথেকে ভালো। এখানে একটা রেডিয়ো থাকলে বেশ হত।

যাট নম্বর বেডের মেয়েটি গান জানে, ডাকুন-না।

আপনি যান, কাল একটা বই চেয়েছিলুম, দেয়নি।

খস খস শব্দ হল। অনেক দিনের জট, চিরুনি আটকে যাচ্ছে। মাথাটা নড়ে উঠতেই ফ্যাকাশে মুখ করে নাড়ু তাকিয়ে রইল।

চুলের গোছা আঙুলে পাকিয়ে মা চুল আঁচড়াত। না হলে মাথায় খুব ব্যথা লাগে। চুলগুলো সব পিঠের তলায়।

মৃতের কাঁধ ধরে নাড়ু তুলতে গেল। মাথাটা কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল বালিশে। খট খট জুতোর শব্দ আসছে। তাড়াতাড়ি মাথাটা সিধে করে চাদর টেনে দিল। পিছিয়ে আসার সময় থলিতে পা লাগল।

দুটো পেয়ারা গড়িয়ে পড়ল। থলিটা তুলে নিল নাড়।

তুমি একা যে, বাবা কোথায়? এখানে আর থেকো না, বাইরে গিয়ে বোসো।

নার্স ওর কাঁধে হাত রেখে ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। নাড়ু মাথা নামিয়ে হেঁটে গেল বারান্দা ধরে। নীচে নেমে দেখল দারোয়ানের টুল খালি। আবার রাস্তায় এসে দাঁড়াল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন।

সন্তোষ আর সৎকার-সমিতির ছাইরঙা পোশাকপরা লোকটি গাড়ির মধ্যে স্ট্রেচারটা তুলে দিল। ডালা দুটো বন্ধ করতেই গাড়ির পিছনটা একটা টিনের বাক্স হয়ে গেল। ড্রাইভার আর সমিতির দুজন লোক বসল সামনের সারিতে, পিছনে সন্তোষ আর নাড়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় পড়তেই সন্তোষ বলল, দেরি হয়ে গেল। গাড়ি ছিল না, তাই বসেছিলুম।

রাস্তার দিকে মুখ ফেরাল নাড়। পাশ দিয়ে ট্রাম যাচ্ছে। সমান সমান যাচ্ছে। ঘণ্টা পড়ল। ট্রামের গতি মন্থর হল। নাড়ু হাসল।

বাবা, ট্রামগাড়ি মোটরের সঙ্গে পারে না?

ওকে যে থামতে থামতে যেতে হয়, তোক উঠবে নামবে—তবে তো!

সন্তোষ আড়চোখে তাকাল এক বার। জ্বলজ্বল করছে ছেলেটার চোখ। গোগ্রাসে বাইরের সব কিছু যেন গিলছে।

দোকান, আলো, মানুষ। সমিতির আপিসের কেরানিটি বেশ গপ্পে লোক। ফোন করে ডাকলে ওরা যায় না। অনেক বার গিয়ে বাকি ঠকেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকানা দেওয়া হয় বিয়েবাড়ির। ঠাট্টা করা আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। নাড়ু তখন ছ-মাসের। মুখে রুমাল বেঁধে ডাকাত সেজে এক বার ওর মাকে ভয় দেখিয়েছিলুম। তারপর থেকে রোজ খিলটা খুলেই ছুটে ঘরের মধ্যে পালাত। এক বারও দেখত না কে কড়া নেড়েছে। মাস কয়েক পরেই ও ভুলে গিয়েছিল ব্যাপারটা। ঠাট্টা জিনিসটাই এমন। নাড়ু এখন বাইরে তাকিয়ে। ভুলে গেছে হাত কয়েক পিছনেই ওর মা রয়েছে। ও কি এটাকে ঠাট্টা ভেবেছে? মরাটা কি ঠাট্টা? তাই যদি হয় তাহলে বাঁচাটাও কি তাই? ঠাট্টা মানুষ ভুলে যায়। বাঁচাও কি ভোলে? তাহলে কি আমি বেঁচে নেই?

চমকে উঠল সন্তোষ। গাড়িটা একটা গর্তে পড়েছিল। ঝনঝন করে উঠেছে পিছনের বাক্সটা। তালু দিয়ে পিঠের টিনের পাতাটাকে সে ছুঁল। কনকনে ঠাণ্ডা। এর মধ্যে একটা মড়া আছে। মড়াটা ঝাঁকুনিতে নিশ্চয় নড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে ঠাট্টা কোথায়! চিরজীবন কি এই মড়াটাকে পিছনে নিয়ে আমায় বুঝতে হবে যে বেঁচে আছি?

ট্রাফিক-আলোর নির্দেশে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ খলবল করে নাড়ু বলল, বাবা, সেই ট্রামটা!

তুই বুঝলি কী করে?

বা রে, ওই মোটকা লোকটা যে তখনও বই পড়ছিল।

ছেলেটা ভুলে গেছে পিছনেই একটা মড়া চলেছে। সন্তোষ ড্যাশবোর্ডের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে রইল। অপরিণত মনই পারে জীবন-মৃত্যুর কথা ভুলতে। ওরাই কিন্তু সুখী হয়। সুখের জন্য আমি কি এই মুহূর্তগুলোকে ভুলে যাব? যদি যাই তাহলে ক্ষতি কী!

বাবা, এ রাস্তাটার নাম কী?

সন্তোষ চুপ করে তাকিয়ে রইল বাইরে। চিকচিক করছে রাস্তা। জলে আলো পড়েছে। বৃষ্টি হয়েছে। কাঠগুলো ভিজে থাকবে। ধোঁয়া হবে, চোখ জ্বলবে। পুড়তে দেরি হবে। শুয়োরের বাচ্চা এই বৃষ্টিটা!

বাবা, বৃষ্টি নামলে ওই বইওয়ালারা কী করে?

তেরপল দিয়ে ঢেকে দেয়।

কাঠগুলো কি খোলা জায়গায় রাখে? ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করলেই পারে, করলে কত সুবিধে হয়। হাঙ্গামা বাঁচে। খাটুনি বাঁচে। এখন হয়তো সারারাত চিতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

বাবা—

চুপ কর দিকিন।

গাড়িটা মেডিকেল কলেজের গেট পার হল। এখান থেকে আর একটা মড়াকে তুলে নেওয়া হবে। পাশবালিশের মতো একটা পুটলি নিয়ে দুটো লোক অপেক্ষা করছিল। পুঁটলিটাকে পিছনের বাক্সে তুলে দিয়ে তোক দুটো সন্তোষের পাশে বসল। এবার গাড়িটা সোজা শ্মশানে যাবে।

সামনের সিটে সৎকার-সমিতির লোক দুটো মাঝে মাঝে কথা বলছে। সন্তোষ ওদের কথায় কান পাতল। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ছে আর প্যাচপেচে বর্ষায় ধোপারা কাপড় দিতে দেরি করে। সন্তোষ বাইরে মুখ ফেরাল।

উনি আপনার কে হন?

স্ত্রী।

আমার ভায়ের মেয়ে। এর আগে দুটিকে শ্মশানে দিতে হয়েছে। বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে।

মুখ ফেরাল সন্তোষ। ওপাশের লোকটি গাছের গুঁড়ির মতো বসে। রাস্তার আলোর জ্বলজ্বল করছে চোখ। চোখের নীচে ভাঁজগুলো ঠিক কাকের মতো। ওর চোখ ফুটে যদি এখন দুটো কাকের ছানা বেরিয়ে আসে, কেমন হয়। চিৎকার করবে, মুখের লাল গর্তটা দেখা যাবে। নাড়ুর মা-র পেটের ব্যাণ্ডেজটা কালো হয়ে গেছে।

হঠাৎ গাড়িটা কাঁপতে শুরু করল। ট্রামলাইন সারানো হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়া হয়েছে। সন্তোষ কান পাতল, পিছনে যেন একটা শব্দ হচ্ছে। পুটলিটা বোধ হয় গড়িয়ে গেল। ওর মধ্যে একটা বাচ্চা আছে? বাচ্চাটা গড়িয়ে নাড়ুর মা-র কোলের কাছে যাবে কি? ছেলেপুলে খুব ভালোবাসে। হাত বাড়িয়ে পুঁটলিটাকে বুকে চেপে যদি আদর করে।

গাড়িটা কাঁপছে। সন্তোষও কাঁপছে। খপ করে নাড়ুর হাতটা সে আঁকড়ে ধরল। নখ বসে গেল। হাতটা মুচড়ে ছাড়াতে চাইল নাড়। উলটো পাকে সন্তোষ চেপে থাকল। কিসকিস করে উঠল তার কষের দাঁত। নাড়ু অস্ফুট শব্দ করল।

সমান রাস্তায় পড়তেই গাড়ির কাঁপুনি থেমে গেল। সন্তোষ হাতটা ছেড়ে দিল। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, তোর ভয় করছে?

না।

আমারও না।

গাড়িটা দশটার কেরানির মতো শ্মশানের দিকে ছুটছে। হাওয়া আসছে। সন্তোষ চোখ বুজল। পাশের লোক দুটো জবুথবু হয়ে রয়েছে। নাড়ু রাস্তার মানুষ আলো দোকান দেখছে।

উবু হয়ে বসে আছে সন্তোষ। মোটা গুঁড়িগুলো পাতা হয়েছে। চ্যালাকাঠ চৌকো ছকে তার ওপর সাজানো হচ্ছে। নাড়ু দেওয়ালের লেখা পড়ছে। কাঠকয়লায় লেখা মৃতদের নাম আর ঠিকানা। দু-চার লাইনের পদ্যও আছে। পড়তে পড়তে নাড়ু দূরে সরে গেল। ছোট্ট চিতাটা জ্বলছে।

তোমাদের শেষ হতে সেই দুপুর রাত।

দুজন লোকের একজন বলল। চুপ করে রইল নাড়। লোকটা কিছুক্ষণ নাড়ুর দিকে তাকিয়ে পাশের গুম-মেরে-থাকা লোকটিকে বলল, তুই এক বার তারকেশ্বরে যা, কত লোকেরই তো মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছে। আর নয়তো বল, সুকুমারের বোনের সঙ্গে সম্বন্ধ করি, ওদের বাড়ির মেয়েরা এক-একটা আট-বিয়োনি, ছ-বিয়োনি।

হু হু করে চিতাটা জ্বলছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট একটা কচি মুখ। নাড়ু সরে দাঁড়াল। উনুন ধরাবার সময় মা-র চোখ দিয়ে জল পড়ত। পেঁয়াজ কাটার সময়ও জল পড়ত। মা-র নাম আর ঠিকানা যদি দেওয়ালে লিখি তাহলে কি কেউ বকবে? এ দেওয়ালটা কাদের? কাঠ কেনার সময় বাবা যাদের পয়সা দিল, তাদের কি? নাম লিখতে কি পয়সা লাগবে? বাবার কাছে পয়সা চাইলে বকবে। বাবা কাঁদেনি, ওই লোকটা কাঁদছে। ধোঁয়ার জন্য কাঁদছে কি? কিন্তু ওখানে তো ধোঁয়া নেই। আমি কেঁদেছিলুম। আমি মাকে ভালোবাসি।

সন্তোষ একইভাবে বসে ছিল। চিতা সাজানো হয়ে গেছে। এধার-ওধার তাকিয়ে সে নাড়কে ডাকল। চিৎকার করে ডাকল। দেওয়াল ঘেঁষে অন্ধকার দিকটায় নাড়ু সরে গেল। তিনটে লোক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে। ওদের এড়িয়ে নাড়ু আরও

অন্ধকারে পাঁচিলের ধার পর্যন্ত চলে এল। পাঁচিলের পরেই গঙ্গা।

চিৎকার আসছে। নাড়ু পাঁচিল আঁকড়ে দাঁড়াল, যাব না। কিছুতেই না। এখানকার গন্ধ ভালো লাগছে না। গরম লাগছে। মানুষগুলো সব কেমন কেমন। এখানে থাকব না, দেওয়ালে মা-র নাম লিখব। লুকিয়ে লিখব।

সন্তোষ খুঁজতে খুঁজতে নাড়ুর কাছে এল। নরম সুরে বলল, আয় নাড়ু, এখানে থাকিসনি!

ওরা সাজানো চিতার কাছে এল। সমিতির লোকেরা মৃতদেহটা মাটিতে নামিয়ে দিয়ে গেছে। সেইভাবেই এতক্ষণ পড়ে আছে। তবে পরনের কাপড়টা সন্তোষ বদলিয়ে একটা কোরা থানে ঢেকে দিয়েছে।

পায়ের দিকটা তুই ধর, তুলে দিই।

মৃতের কাঁধ ধরে সন্তোষ তাকাল। নাড়ু ইতস্তত করছে। চিতা সাজানোর ডোম নাড়ুর পাশে দাঁড়াল।

ভয় কী খোকাবাবু, এ তো হালকা লাশ আছে।

গোঁজ হয়ে নাড়ু দাঁড়িয়ে রইল। ডোম হাসল। সন্তোষকে লক্ষ করে বলল, কষ্ট হচ্ছে? হবেই তো।

তুমি একটু ধরো তো ভাই।

সন্তোষ কাঁধটা মাটি থেকে খানিকটা তুলে ধরে তাকিয়ে রইল ডোমের দিকে। নাড়ু অস্বস্তি বোধ করল। কেমন শক্ত চোখে বাবা তাকাচ্ছে। রেগে গেলে অমনভাবে তাকায়, নিতুদের নতুন চুনকাম করা দেওয়ালে ছবি এঁকেছিলুম বলে নালিশ করেছিল। বাবা তখন ওইভাবে তাকিয়েছিল। মা জড়িয়ে ধরেছিল তাই লাঠির ঘা পিঠে পড়েনি। মা-র হাতে কালশিরে পড়েছিল। কাচের চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল। ডোমটা মা-র পা দুটো আঁকড়ে ধরেছে। ঝড় জমাদার ছুঁয়ে দিয়েছিল বলে মা চান করেছিল। বাবা ঝড়কে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। একে বাবা নিজে থেকে ডেকেছে।

সরো, আমি ধরছি।

মৃতের পা-দুটো নাড়ু প্রায় ছিনিয়ে নিল। ডোম হেসে সরে দাঁড়াল। হালকা দেহটা অনায়াসেই চিতায় উঠল। শুধু সাজানো কাঠগুলো এক বার খচমচ করল। কতকগুলো কাঠ মৃতের বুকের ওপর ডোম চাপিয়ে দিল।

নাড়ু আয়, মুখে আগুন দিবি।

সন্তোষ হাতে-মাথায়-কপালে ঘি মাখিয়ে দিল। অল্প আলোতে চুলে-লেগে-থাকা বনস্পতির গুঁড়ো গুড়ো দানাগুলো আকাশের তারার মতো দেখাচ্ছে। চিতা জ্বলে উঠলেই চুলের সঙ্গে ওগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তুলো পাকিয়ে একটা সলতে তৈরি করে সন্তোষ মৃতের ঠোঁটের ওপর রাখল। নাড়ু কাছে আয়।

দেশলাই জ্বেলে সন্তোষ কাঠিটা নাড়ুর হাতে দিল। নিভে গেল কাঠিটা। আর একটা জ্বালতে গেল, জ্বলল না। চারটে কাঠি নষ্ট হতেই বিরক্ত হল সে। ঝিরঝিরিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েই থেমে গেল। ছোট্ট চিতাটা এখনও জ্বলছে। ছুটে গিয়ে সন্তোষ দেশলাইটা সেঁকে আনল। কাঠি জ্বেলে নাড়ুর হাতে তুলে দিয়ে আড়াল করে ধরল।

এক পলকের জন্য নাড়ু সন্তোষের মুখে তাকাল। ঠোঁট দুটো তেলতেলা। ফু দিয়ে যদি নিভিয়ে দিই কাঠিটা? তাহলে ধরে ফেলবে, মারবে!

হয়তো নিজেই আগুন দিয়ে দেবে। মা-র মুখে ছেলেদেরই আগুন দিতে হয়, নয়তো পাপ হয়।

সলতেটা জ্বলে উঠতেই নাড়ু কাঠিটা ফেলে দিল। মড়মড় করে পাটকাঠি ভাঙছে ডোম। পিছিয়ে গেল নাড়।

কতক্ষণ লাগবে পুড়তে?

ঘণ্টা তিন-চার।

কাঠ ভিজে নেই তো, যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ক-দিন ধরে!

নাড়ু হাঁটছে। দুপাশে সার-দেওয়া মাটিখোঁড়া জমি, দুটো নিবুনিবু চিতার পাশে জটলা করছে কতকগুলো লোক। মাঝখানে পথটা সিধে গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে। সিঁড়ির মাথায় এসে নাড়ু দাঁড়াল। শ্মশানের আলোয় জল দেখা যাচ্ছে। জল চিকচিক করে কাঁপছে। হাসলে মা-র গোটা শরীরটা অমন কাঁপত। আমার গঙ্গায় চান করতে ইচ্ছে করছে।

হ্যাই, তোজো, হিটলার, সবকোই ফল-ইন হো যাও। হাম গোলি করেঙ্গা।

গলায় শালপাতা-জড়ানো লোকটা বীরদর্পে আকাশের দিকে আঙুল তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।

টে–ন শন।

পা জোড়া করে, গটগটিয়ে লোকটা কুন্ডলী-পাকানো কুকুরটাকে লাথি কষাল। কুকুরটা ছুটে পালাতেই সে ঘুরে দাঁড়াল নাড়ুর দিকে। নাড়ু ছুটে পালিয়ে এল সন্তোষের পাশে। চিতা ধরে গেছে। আধপোড়া পাটকাঠিগুলো গুঁজে দিচ্ছে ডোম।

কোথায় গেছলি?

ওইদিকে, গঙ্গা দেখছিলুম।

একা যাসনি, মাতাল-গেঁজেলরা আছে।

একটানা সুর করে কিছু পড়ার শব্দ আসছে। অনেক লোক একসঙ্গে পড়ছে। উবু হয়ে সন্তোষ দেখছে ডোমের কাজ। মাংস পোড়ার গন্ধ।

আবার কোথায় যাচ্ছিস?

নাড়ু থেমে গেল। সেখান থেকেই বলল, এদিকে গান গাইছে।

না, যেতে হবে না, এখানে থাক।

নাড়ু সন্তোষের কাছে এসে দাঁড়াল। কাঠের ফাঁক দিয়ে আগুন উঠছে। কুঁকড়ে গুটিয়ে গেল চুলগুলো। মুখটা দেখা যাচ্ছে। চোখ-বোজানো। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক-করা। হাতের আঙুল কালো হয়ে উঠেছে। গোড়ালি দুটো ভারী দেখাচ্ছে। একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মাথার কাছে এক ঝলক আগুন হুস করে ঠেলে উঠল।

নাড়ু চোখ ফেরাল। সন্তোষকে আড়চোখে দেখল। চোখ দুটো যেন ঘুমে ভারী। অমন চোখ করে পুজোর সময় বাবা যাত্রা দেখে! মা থাকে চিকের আড়ালে। কৌটো-ভরতি পান না থাকলে মা যাত্রা দেখতে পারে না।

একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। আগুনের আঁচ লাগল নাড়ুর গায়ে।

কোথায় যাচ্ছিস?

ওইদিকে।

না।

হাতের মুঠো শক্ত করে নাড়ু তাকিয়ে রইল। উঠে দাঁড়াল সন্তোষ। চিতার আলোয় তার চোখ জ্বলছে।

তুই এখান থেকে বার বার পালাচ্ছিস কেন?

নাড়ুর কাঁধে নাড়া দিল সন্তোষ। পুট পুট শব্দ হচ্ছে। চিতার পাশে দাঁড়-করানো একটা কাঠ পড়ে গেল।

কথা বলছিস না কেন? মন খারাপ করলে কি মা বেঁচে উঠবে? অমন অনেক কষ্ট আসবে জীবনে, সইবি কী করে!

বলো হরি–হরিবোল।

চমকে ওরা মুখ ফেরাল। অনেকগুলো মানুষ ঢুকল শ্মশানে। আথালিবিথালি কাঁদছে এক মাঝবয়সি বিধবা। কয়েক জন তাকে ধরে নিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। ওদের পাশ দিয়েই খাটটাকে বয়ে নিয়ে গেল। ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধে ঝেঁঝে উঠল জায়গাটা। সন্তোষ মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিঁড়ির কাছ থেকে কান্নার রেশ আসছে।

হাওয়াটা এমন বিদঘুটে বইছে…

চিতার ওপর ঝুঁকে সন্তোষ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবার বলল, আগুন সব মাথার দিকে উঠে এসেছে। পা দুটো এখনও ধরল না।

বাবা আমি দেয়ালে নাম লিখব।

কী লিখবি?

চোখাচোখি হল ওদের। পা দিয়ে এক টুকরো জ্বলন্ত কাঠকে চিতায় ঠেলে সন্তোষ বলল, কী হবে লিখে, কালকেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে।

পাগলটা চিৎকার করছে। বিধবার কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃতদেহ নামিয়ে লোকগুলো চাপা স্বরে জটলা করছে। সারা শ্মশানে মাংস পোড়ার গন্ধ চারিয়ে রয়েছে। বাইরে রেলইঞ্জিন হঠাৎ হুইসল দিল।

নীচু হয়ে নাড়ু একটা ফুল তুলে নিল। এইমাত্র খাট থেকে পড়ে গেছে। সন্তোষের নজর এড়ায়নি। হাত বাড়াল সে। নাড়ু হাত মুঠো করে পিছনে রাখল।

কী করবি ওটা নিয়ে?

বাড়িতে নিয়ে যাব।

কেন?

আমি গঙ্গায় দেব।

না, গঙ্গার কাছে যেতে হবে না।

আমি চান করব।

না, অসুখ করবে।

সন্তোষ উঠে দাঁড়াল। নাড়ু পিছিয়ে গেল। পিছনে দেওয়াল। সামনে জুড়ে সন্তোষ এগিয়ে আসছে। থমকে গেল। কুকুরটা নাড়ুর গা ঘেঁষে আসতেই তাড়াতাড়ি একটা ঢিল কুড়িয়ে নিল। মেরো না খোকা, ও কামড়াবে না।

শ্মশানের গেটের কাছে শোয়া লোকটা শুয়ে শুয়েই বলল, আজ সকালেই ওর বাচ্চাটা রেলে কাটা পড়েছে। ওকে মেরো না।

পাগলা একদৃষ্টে তাকিয়ে। সন্তোষ নাড়কে আগলে শক্ত হয়ে দাঁড়াল।

অ্যাই ক্যাপ্টেনসাব, ইধার আও।

গেটের কাছে শোয়া লোকটা পাগলকে ডাকল। মিলিটারি কায়দায় ঘুরে পাগল সেলাম করল। গটগট করে লোকটার কাছে গিয়ে হাত পাতল। মাটি থেকে একটা ঢিল তুলে লোকটা ওর হাতে দিতেই সেলাম করে পাগল চলে গেল সিঁড়ির দিকে। আচমকা ইঞ্জিনের হুইসল বাজল। মালগাড়ি শান্টিং-এর শব্দ আসছে।

ভয় পেয়েছিলি?

চিতার একধারটা ধসে পড়ল। ওঁড়োগুঁড়ো ফুলকি উড়ছে। আগুন গোলাপি হয়ে উঠেছে।

আমাদের ভাগ্যি ভালো এখনও বৃষ্টি নামেনি।

টেনে টেনে কান্নার সুর আসছে। মালগাড়ি শান্টিং হচ্ছে। লোহায় লোহায় ঠোকাঠুকি হয়ে কর্কশ শব্দটা গুড়গুড় করে সরে যাচ্ছে এক গাড়ি থেকে আর এক গাড়িতে।

শম্ভুজ্যাঠার দিদি মালগাড়ির তলা দিয়ে পার হতে গিয়ে কাটা পড়েছিল।

নাড়ু চুপ করে থাকল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে সন্তোষ আবার বলল, সকাল হলেই আগে তোর জন্য কোরা কাপড় কিনতে হবে। কিন্তু ডোম ব্যাটা গেল কোথায়? এক বার ডেকে আনবি?

কেন?

মাথাটা বাঁশ দিয়ে ভেঙে দেবে। দেওয়ালের সঙ্গে সিঁটিয়ে গেল নাড়। থরথর করে কেঁপে উঠল ওর গোটা শরীর। ভয় করছে। হাসপাতালের লিফটের সেই চৌকো লোহাটার মতো বাবা যেন নেমে আসছে। অনেকক্ষণ পেচ্ছাপ করিনি। যন্ত্রণা হচ্ছে। খিদে পাচ্ছে। থলিতে পেয়ারা আছে। মা খেতে ভালোবাসে।

দাঁড়িয়ে রইলি যে?

পারব না।

কথা বললে শুনিস না কেন? তখন বললুম, ফুলটা দিতে দিলি না কেন?

আমার ইচ্ছে, আমার খুশি।

নাড়ু চিৎকার করে উঠল। সন্তোষ থ হয়ে গেছে। গোড়ালি আর পায়ের পাতা এখনও পোড়েনি। ফুলে টসটস করছে। হাওয়া দিচ্ছে। আগুন কাত হয়ে মাথার দিকে জ্বলছে।

আমার কথা শুনবি না?

না।

শুনবি না?

না।

থলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নাড়ু একটা পেয়ারা ধরল। বাবা এগিয়ে আসছে। মারব। চৌকো লোহার মতো এগিয়ে আসছে। পালাব। এই শ্মশান থেকে বেরিয়ে যাব। যেদিকে হোক চলে যাব। ছুটব।

আমার অবাধ্য হবি? বল, অবাধ্য হবি?

নাড়ুর হাত মুচড়ে ধরল সন্তোষ। বিকট চিৎকার করে বিধবাটি ছুটে এল। সাজানো চিতায় মৃতদেহটা তোলা হচ্ছে।

ছিটকে পিছিয়ে গেল সন্তোষ। হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। শরীর জ্বলে উঠল। ছেলে আমায় ঘৃণা করে। আমি কী অন্যায় করেছি! ও শাস্তি দিতে চায়, অতটুকু ছেলে কী বোঝে দোষ-গুণের। ওকে শায়েস্তা করতে হবে। মারতে হবে। ভীষণ মারব, ওকে কাঁদিয়ে ছাড়ব।

ছুটে এল সন্তোষ নাড়ুর দিকে। জ্বলন্ত চিতাটাকে পাক দিয়ে নাড়ু ছুটল। শ্মশানের গেট পার হয়ে রাস্তায় পড়ল। পিছনে সন্তোষ ছুটে আসছে। দু-ধারে নির্জন রাস্তা গঙ্গার ধার ঘেঁষে সিধে চলে গেছে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনে সারি দিয়ে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। এক লহমা ইতস্তত করে নাড়ু মালগাড়ির তলা দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

নীচু হয়ে গাড়ির ফাঁক দিয়ে সন্তোষ গলে এল। অন্ধকার। এক হাত দূরেই আর একসার ওয়াগন। লম্বা টানা একটা গলি যেন। চিৎকার করে সন্তোষ ডাকল। কান পাতল। সাড়া নেই। আবার চিৎকার করল। সাড়া নেই। টুকরো পাথরের গলিটা এবড়োখেবড়ো। সন্তোষ টলে পড়ছিল। দু-হাত দিয়ে দু-দিকের ওয়াগন ধরে দাঁড়াল।

লোহার লাইনে কাঁপতে কাঁপতে কাছে আসছে একটা শব্দ। অন্ধকারে ফুলকিগুলো ছিটকে উঠছে। ইঞ্জিন আসছে। কোন লাইনে আসছে। সন্তোষ নাড়ুর নাম ধরে চিৎকার করল। কান পাতল। লাইনে গুড়গুড় শব্দটা জোর হচ্ছে। ওপাশে যেন পাথর ছিটকে পড়ার শব্দ হল। নাড়ু কি হাঁটছে? ইঞ্জিনটা কোন লাইন ধরে আসছে? ও যদি ভয় পেয়ে গাড়ির তলা দিয়ে আবার পালাতে যায় আর সেই সময়ই ইঞ্জিন গাড়িতে ধাক্কা দেয়। শম্ভুজ্যাঠার দিদির মুন্ডুকাটা লাশটা কাঁপছিল। কাঠের স্লিপার ক-টায় অনেক দিন পর্যন্ত কালো ছোপ ধরে ছিল। নাড়ুর মা র পেটের ব্যাণ্ডেজটা কালো হয়ে গিয়েছিল। এই গলিটা অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না।

খড়খড় শব্দ হল গাড়ির ওধারে। কেউ যেন কুচো পাথরের উপর হাঁটছে। সন্তোষ উবু হয়ে গাড়ির তলা দিয়ে তাকাল। অন্ধকার। হাত দিল চাকায় নিরেট, ঠাণ্ডা, এটার ওজন কত? আবার যদি নাড়কে ডাকি তাহলে ও ভয় পাবে। আবার পালাতে চাইবে। তার থেকে চুপিচুপি গিয়ে ধরে ফেলি।

সন্তোষ কুঁজো হয়ে এগোল দু-সারি ওয়াগনের মাঝে ফাঁকটুকুর দিকে। হঠাৎ ঝাঁকুনি খেল একদিকের সারিটা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সন্তোষ। ইঞ্জিনে ধাক্কা দিয়েছে। সারিটা একটু পিছিয়ে গিয়ে থেমে পড়ল।

মাটি আঁকড়ে সন্তোষ শুয়ে আছে। ওর একদিকের সারিটা অনড়। অন্য দিকেরটা চলতে শুরু করেছে। মাটিতে মুখ চেপে শুয়ে থাকল সে, শব্দ হচ্ছে, লোহায় লোহা ঘষার শব্দ। ওধারে নাড়ু এখন কী করছে? পার হতে যদি দেরি হত? মুন্ডুকাটা লাশটা এতক্ষণে কাঁপতে শুরু করত। লাইনে শব্দ হচ্ছে। মালগাড়িগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। পায়ে পিঁপড়ে উঠেছে। মাটিতে সোঁদা গন্ধ। ঘাম জমেছে কপালে। মরে যাচ্ছিলুম। এমনিভাবে মাটি আঁকড়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তীক্ষ্ণ শীতল জলের ধারা। ইঞ্জিনটা মালগাড়ি টেনে নিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল সন্তোষ। লাইনের ওধারে মাটির ওপরে একটা অন্ধকার জমাট হয়ে রয়েছে। কেউ কাটা পড়েছে কি? টলতে টলতে ছুটে এল সন্তোষ। ওকে দেখে কুকুরটা হাড়-চিবোননা বন্ধ করল। লেজ নাড়ছে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার সে হাড় চিবোতে শুরু করল।

বৃষ্টি পড়ছে। সারা শরীরে বৃষ্টি পড়ছে। কাঁপতে কাঁপতে সন্তোষ লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করল। নাড়ুর মা-র চিতাটা বোধ হয় নিভে গেল।

সন্তোষ নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *